| 21 সেপ্টেম্বর 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

ফার্স্ট বয়

আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিট

।। মানব চক্রবর্তী ।।

ছেলের রেজাল্ট হাতে নিয়ে স্কুল বিল্ডিংয়ের বাইরে এসে অম্লান চাবির রিং আঙুলে ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, দেখতে হবে তো কার ছেলে! সঙ্গে সঙ্গে পাশে থাকা অস্মিতা ফোঁস করে উঠল, কী স্বার্থপরের মতো কথা! ছেলের জন্য রাতদিন দৌড়চ্ছি, এই টিউটর থেকে সেই টিউটর, নিয়মিত হোম-ওয়ার্কের দেখাশুনা, টিচার্স-পেরেন্ট মিটিংয়ে যাওয়া, রাত জেগে ছেলের পাশে বসে ওকে বুস্ট-আপ করা, এসবের কোনও দামই নেই? অর্কর জন্য তুমি ক’টা রাত জেগেছ সত্যি করে বলত?
—আহ্‌… এসব কি অস্বীকার করছি! তোমার পরিশ্রম, তীক্ষ্ণ নজরদারি, সঠিক পেট্রনেজ না থাকলে অর্ক এতটা সফল হয়তো হতো না। বলেই অম্লান অস্মিতার মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। তারপরই, স্মার্ট ভঙ্গিতে বলে উঠল, আসলে আমিও ক্লাস ওয়ান থেকে ক্লাস টেন অবধি কখনও দ্বিতীয় হইনি। একটা জেনেটিক ব্যাপার তো আছেই।
চকচকে চেরি-কালারের মারুতি। ড্রাইভ করছে অম্লান। পেছনের সিটে অস্মিতা আর অর্ক। ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটা বড় ফাইভ স্টার চকোলেট বার করে অর্কর হাতে দিয়ে অস্মিতা বলল, আমি জানতাম তুমি এবার ফার্স্ট হবেই। কেন যেন আমার মন বলছিল…
—থ্যাংকস মম।
ক্লাস এইট থেকে নাইনে উঠল অর্ক চ্যাটার্জি। নাইন্টি-এইট পার্সেন্ট মার্কস। শহরের নামকরা কনভেন্ট স্কুলের উজ্জ্বল ছাত্র। রেজাল্ট হাতে দিয়ে প্রিন্সিপাল টম জোসেফ তো বলেই ফেললেন অর্ক ইজ অ্যা জেম, এই সিরিয়াসনেস ধরে রাখতে পারলে আইসিএসই-তে এক থেকে দশের মধ্যে চলে আসার সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি। উই আর প্রাউড অফ অর্ক…
কথাগুলো মনে পড়ছিল আর শরীরটা হাল্কা লাগছিল অম্লানের।
চওড়া পিচের রাস্তা, দু’পাশে সারি-সারি কৃষ্ণচূড়া গাছ, ডানদিকে মস্ত বড় ড্যাম, পরিচ্ছন্ন পথঘাট, মেঘহীন নীল আকাশ— সবই যেন দারুণ এক সুখের আবহ হয়ে অম্লান ও অস্মিতার উজ্জ্বল মুখচোখে ছড়িয়ে পড়েছে।
হঠাৎ অস্মিতা ছেলেকে শুধোল, তা প্রিয়া আহুজার পজিশন কী?
অর্ক বলল, জানি না।
অম্লান মৃদু হেসে ঘাড় বাঁকিয়ে বলল, আমি জানি, থার্ড, নাইন্টি-থ্রি পার্সেন্ট। সেজন্যই মনে হয় ওর বাবা রেজাল্ট নিতে আসেননি। সম্ভবত অফিসে ফোন করে আগেই জেনে গেছেন। গত বছর প্রিয়া ফার্স্ট হওয়ার পর মিঃ আহুজা, আমাদের ডিপার্টমেন্টের প্রোডাকশান ম্যানেজার তো, আমাকেই প্রথম ফোন করে নিজের মেয়ের ফার্স্ট হওয়ার কথা জানিয়েছিলেন। সঙ্গে ছোট্ট একটা খোঁচাও ছিল ‘ডিফারেন্স অফ ইলেভেন মার্কস, তাও আমার প্রিয়া জ্বর নিয়ে ম্যাথ্‌স পরীক্ষায় বসেছিল। সুস্থ থাকলে ইট কুড্‌ হ্যাভ বিন ফার মোর, এনিওয়ে, অর্ককে শুভেচ্ছা…’
অস্মিতা সঙ্গে সঙ্গে বলল, এবারে ফোন করে তুমিও মিঃ আহুজাকে জানিয়ে দাও…
মুচকি হেসে অম্লান বলল, সে কি আর বাকি রেখেছি? মিঃ জোসেফের কাছ থেকে ফার্স্ট সেকেন্ড থার্ডের রেজাল্ট দেখেই আমি মিঃ আহুজাকে মেসেজ পাঠিয়ে দিয়েছি ‘অর্ক ফার্স্ট, প্রিয়া থার্ড, হিউজ ডিফারেন্স অফ মার্কস, এনি ওয়ে, প্রিয়াকে শুভেচ্ছা…’
হঠাৎ অর্ক বলল, আমাকে গাড়ি চালানো শিখিয়ে দেবে বাপি?
—অবশ্যই। গাড়ি চালানো কোনও ব্যাপারই না। একমাসেই তোমাকে শিখিয়ে দেব। তবে হ্যাঁ, আগে তোমার লাইসেন্স হোক তারপর… আর তো মাত্র ক’টা বছর… ওসব ভাবনা ছেড়ে তুমি বরং আরও কনসেনট্রেড করো পড়াশুনায়। যত উঁচু ক্লাসে উঠবে, তত বাড়বে কম্পিটিশন, পার্সেন্টেজ আরও বাড়াতে হবে।
সামনের মোড় ঘুরেই বাঁ দিকে একটা ভালো রেস্টুরেন্ট। এখানে যে আসবে অম্লান, সেটা আগে জানায়নি। অস্মিতাও জানত না। অর্ক এখানকার মাটন বিরিয়ানি খুব ভালোবাসে। ফলে রেজাল্ট নিয়ে ফেরার পথে অম্লান সোজা রেস্টুরেন্টের পার্কিংয়ে গাড়ি দাঁড় করাতেই অর্ক হাত মুঠো করে বলল, মনে মনে ঠিক এটাই আমি চাইছিলাম, তুমি কি থট্‌-রিডার নাকি?
অম্লান গাড়ি লক করে ছেলের মাথায় হাত রেখে বলল, কিছুটা তো বটেই। তোমার ভালো-মন্দ প্রতিটি পদক্ষেপ আমি স্টাডি করি। মানে যাকে বলে গুড গার্জিয়েনশিপ। এর ফলে অনেক কিছুই মিলে যায়।
ঠোঁট বাঁকিয়ে অস্মিতা বলল, এখানে থট-রিডারের প্রশ্নই আসে না। দুপুর হয়েছে। ক্ষিধেও পেয়েছে। অর্ক ফার্স্ট হয়েছে। এই সবক’টা ঘটনাকে মেলালে পরবর্তী যা হয়, যেহেতু অর্কর ফেবারিট ডিশ হল মাটন-বিরিয়ানি এবং সেটাও অন দ্য ওয়ে পড়ছে, ফলে যা হওয়াটা খুব স্বাভাবিক ছিল তাই হয়েছে। এটা একটা মোস্ট-ন্যাচারাল কমনসেন্সের ব্যাপার।
অর্ক অস্মিতার হাত ধরে হেসে বলল, মাম্মির আরগুমেন্টগুলো সব সময় রিয়েলিস্টিক আর রিজনেব্‌ল…
সূর্য মাথার ওপরে। তিনজনের খর্বুটে ছায়া ক্রমশ এগচ্ছে এসি রেস্টুরেন্টের দিকে।
অম্লান মৃদু কেশে বলল, হ্যাঁ, সেটা অবশ্য ঠিকই বলেছ, তোমার মা উকিল হলে সফল হতোই হতো!
অর্ক হাসল। অম্লান হাসল। শুধু অস্মিতা গম্ভীর স্বরে বলল, অর্কর মা হয়ে যে সাফল্য পাচ্ছি তার চেয়ে বেশি কিছু কাম্য আমার নয়।
সঙ্গে সঙ্গে অস্মিতাকে জড়িয়ে অর্ক বলে উঠল, মাম্মির কাছে তুমি হেরে গেছ বাপি… মাম্মি ইজ ব্রিলিয়ান্ট।
মনে মনে অস্মিতা বলল, ছেলের সাফল্যের সব কৃতিত্ব নিজে নেবে কোন মা তা সহ্য করতে পারে! মুখে অবশ্য চওড়া হাসি ফুটিয়ে ডিপলোম্যাটিক ঢঙে সে বলল, থাক আর বোলো না অর্ক, বাপি রাগ করবে।
রেস্টুরেন্টে ঢুকেই অর্ক দেখল ডান দিকের দ্বিতীয় টেবিলটাতে বসে আছে তাদেরই ক্লাসের পল্লব, সঙ্গে তার বাবা-মা।
অর্ককে দেখামাত্র পল্লব উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আরে তুই? নিশ্চয়ই সেলিব্রেট করতে এসেছিস! কথা শেষ করেই সে নিজের মা-কে বলল, এই যে অর্ক, আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট বয়, এবার নাইন্টি এইট পার্সেন্ট পেয়েছে, এক কথায় ব্রিলিয়ান্ট।
পল্লবের মা মিষ্টি হেসে বলল, তোমার কথা পল্লবের মুখে প্রায়ই শুনি, ও বলে তুমি নাকি কঠিন কঠিন অঙ্ক ম্যাজিকের মতো দ্রুত করে ফেলো!
এবারে অর্ক একটু লজ্জা পেয়ে বলল, ও আমাকে খুব ভালোবাসে তাই একটু বেশি বেশি বলে আন্টি। কথাটা শেষ করেই সে বন্ধুকে শুধোল, তুইও মনে হয় রেজাল্ট পেয়েই সেলিব্রেট করতে চলে এসেছিস!
—আরে ধুস্‌… আমার আবার সেলিব্রেট! ম্যাথ্‌স-এ ধেরিয়েছি। সেভেন্টি পার্সেন্ট। খিদে পেয়েছিল, তাই বাবাকে বলতেই এখানে নিয়ে এলো।
অম্লান সেভেন্টি পার্সেন্ট শুনেই গম্ভীর স্বরে ছেলেকে ডাকল, এসো অর্ক, আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে।
হাত নেড়ে অর্ক চলে এল একদম আগে ক্যাশ কাউন্টারের সামনের টেবিলটাতে।
অম্লান ছেলের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে চাপা স্বরে মৃদু ভর্ৎসনার ঢঙে বলল, থিংক হাই, ড্রিম হাই, সেভেন্টি পার্সেন্ট পাওয়া ছেলে তোমার বন্ধু হতে পারে না।
ফিসিস্বরে অর্ক বলল, না বাপি, ও খুব ভালো ছেলে, দারুণ ক্রিকেট খেলে, আমাদের স্কুল টিমের মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট প্লেয়ার…
মাটন-বিরিয়ানির অর্ডার দিয়ে অম্লান রুমালে মুখ মুছে ঘাড় সামান্য ঘুরিয়ে পল্লব ও তার বাবা-মাকে দেখল। ওদের হাসিমুখে গল্প করতে-করতে খাওয়া দেখে সে অবাক হয়ে ভাবল, সদ্য রেজাল্ট বেরিয়েছে, মাত্র সেভেন্টি পার্সেন্ট ক্লাস এইটে, তবুও দারুণ আনন্দে তিনজন মিলে খাওয়া-দাওয়া করছে। এত আনন্দ আসে কোথা থেকে? ওরা কি জানে না কনভেন্ট স্কুলের নাইন-টেনের সিলেবাস কত টাফ? ক্লাস এইটে যদি এত পুওর রেজাল্ট হয় তো বোর্ড— একজামে তো আটকে যাবে। ছিঃ… গার্জেন যদি কড়া নয় ছেলেমেয়ে মানুষ হবে কী করে!
অর্কদের খাওয়া-দাওয়া যখন মধ্যপথে তখন পল্লব আর তার মা এলো সামনে, এসে হাতজোড় করে অস্মিতাকে নমস্কার জানাল। বলল, একদিন ছেলেকে নিয়ে আমাদের বাড়ি আসবেন দিদি, খুব খুশি হব, স্ট্রিট নং একুশ, বি-টু। আমার ছেলেটা এত খেলাপাগল যে বইপত্র নিয়ে বসতেই চায় না, অর্ক এলে যদি একটু চেঞ্জ হয়।
অস্মিতা মৃদু হেসে বলল, সময় পাওয়াই মুশকিল, সারাদিন ছেলের পেছনেই কেটে যায়, দেখি, সময় বার করতে পারলে একদিন না হয় যাব।
ওরা চলে গেল।
অর্ক আগ্রহে শুধোল, সত্যি মাম্মি নিয়ে যাবে একদিন পল্লবদের বাড়ি?
অম্লান গম্ভীর স্বরে বলল, অবশ্যই নয়। ওটা কথার কথা। কেউ যেচে আমন্ত্রণ জানালে ওরকম বলতে হয়। পল্লবের কাছে থেকে তুমি কী পেতে পার? নাথিং। তোমার সঙ্গে মিশলে ওর হয়তো লাভ হবে, কিন্তু তোমার কোনও লাভ নেই। বরং তুমি যদি বলো এবারে ক্লাস নাইন থেকে ফার্স্ট হয়ে যে টেন-এ উঠেছে তাদের বাড়ি নিয়ে যেতে, তাহলে কালই আমি নিয়ে যাব।
—বাঃ রে, তাকে কি আমি চিনি?
—চিনতে ক’মিনিট লাগে? ওদের বাড়ি গিয়ে পরিচয় করলেই হল। তাতে তোমারই লাভ। ওর নোটস, সাজেশান, মেথড অফ প্রিপারেশন সব জানতে পারবে। মনে রেখ, তুমি ফার্স্ট বয়, তোমার অ্যাকম্পানিও তেমনই হওয়া উচিত।
অস্মিতা বিরক্ত, আঃ, শান্তিতে খেতে দাও তো ছেলেটাকে। ও সরল মনে কথাটা বলেছে, তা নিয়ে এত কথার কী আছে শুনি!
আড়চোখে বউকে দেখে অম্লান বলল, সে তুমি বুঝবে না, এ হল অ্যাপ্রোচ, আর এখানেই ফার্স্ট বয়ের সঙ্গে অন্যদের ফারাক। কথা শেষ করেই সে নিজের প্লেট থেকে একটা মাংসের টুকরো অর্কর প্লেটে দিয়ে বলল, খাও, এনজয় ইয়োরসেলফ।
খাওয়া শেষের মুখে অস্মিতা বলল, অর্কর জন্য আইসক্রিম বলো।
—শুধু ওর জন্য কেন, সবার জন্যই আইসক্রিম আসবে, ডোন্ট ওরি। খাওয়ার বিল মিটিয়ে বাইরে এসেই অম্লানের মনে হল প্রকাশদাকে একটা খবর দেওয়া উচিত, সেকেন্ড-হাফটা যদি ম্যানেজ করে দিতে পারে। অফিস সুপারিনটেন্ডেন্ট বলে কথা! গাড়ির কাছে এসে অম্লান ফোন করল, শোনো প্রকাশদা, সেকেন্ড-হাফটা যদি ম্যানেজ করে দিতে পার তো খুব ভালো হয়, এই সবে ছেলের রেজাল্ট নিয়ে বেরুলাম… এ্যাঁ… হ্যাঁ… ফার্স্ট, নাইন্টি-এইট পার্সেন্ট…হ্যাঁ নিশ্চয়ই হবে, একদিন বাড়িতে তোমায় ডাকব।
ওপারের কথাগুলো শোনা গেল না, তবে অম্লানের চওড়া হাসি আর গর্বভরা চাহনি বুঝিয়ে দিল ফার্স্ট বয়ের বাবা কনগ্রাচুলেশনের স্বাদগন্ধ চুটিয়ে উপভোগ করছে। মৃদু হাসি, ঘাড় নাড়া আর হুঁ হাঁ শেষে অম্লানের মুখে সেই এক কথা, কার ছেলে দেখতে হবে তো!
ফোন শেষ হতেই অর্ক শুধোল, বাপি তুমি মিথ্যে বললে কেন?
—কীসের মিথ্যে?
—এই যে, সবে ছেলের রেজাল্ট নিয়ে বেরুলাম…
—আঃ এগুলো মিথ্যে নয়, কথার পিঠে কথা, না হয় দেড়ঘণ্টাই হল, অফিসে বা কর্মক্ষেত্রে দেড়ঘণ্টার কোনও ভ্যালু আছে? যেখানে গোটা দিন না গিয়েও দিব্যি ম্যানেজ হয়ে যায়! এমন আনন্দের দিনে কে আবার অফিস যায়!
দু’দিন পরেই রবিবার।
অম্লান খাসির মাংস নিয়ে ঘরে এলো। খবরের কাগজ নিয়ে সবে বসেছে তখনই এল সুশীল। ওর ছেলে সানি অর্কর সঙ্গে একই ক্লাসে পড়ে। সুশীল অম্লানের দীর্ঘদিনের সহকর্মী।
অস্মিতা চায়ের কাপ নিয়ে এগিয়ে এলো, হেসে শুধোল, সানি কেমন রেজাল্ট করেছে সুশীলদা? কত পার্সেন্ট?
সুশীল গম্ভীর স্বরে বলল, খুব খারাপ…
উঠে এলো অম্লান, শুধোল, খুব খারাপ মানে?
হতাশ স্বরে সুশীল বলল, ছেলেটা ফেল করেছে। সানি পড়াশুনায় খুব একটা ভালো নয়, মিডিওকার। কিন্তু ও যে ফেল করবে, স্বপ্নেও ভাবিনি। ম্যাথ্‌স আর ইংরেজি দুটোতেই আটকে গেছে। অন্যান্য সাবজেক্টেও পুওর মার্কস…
—ছিঃ, খুব খারাপ খবর… ভাবতেই পারছি না।
—চিন্তায় রাতে আমার ঘুম হচ্ছে না। শোন, তোর ছেলের ম্যাথ্‌স আর ইংরেজির খাতা দুটো আমায় দে। সানি ও দুটো খাতা দেখে নিজেকে প্রিপেয়ার করবে। পরের বছর পাশ না করলে তো বের করে দেবে স্কুল থেকে।
কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অম্লান মুখচোখে আফশোস ভঙ্গি করল, ভুরু কোঁচকাল, ঠোঁটে মৃদু দাঁত-চাপা দিয়ে বলল, ইস্‌… গতকালই একজন এসে অর্কর ম্যাথ্‌স, ইংলিশ, জিওগ্রাফি-র খাতাগুলো নিয়ে গেল। দু’দিন আগে যদি বলে রাখতিস, তাহলে… সরি সুশীল, অনেক লেট করে ফেললি।
সুশীল মনঃক্ষুণ্ণ-স্বরে বলল, আজ রবিবার, শুক্রবার রেজাল্ট বেরিয়েছে, শক্‌ সামলাতেই দুটো দিন গেল, যাক্‌, কপাল খারাপ। অর্কর খাতাগুলো পেলে সানির খুব কাজে লাগত…
সুশীল উঠে দাঁড়াল। অম্লানও। সমবেদনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, শোন, এসব দুঃসময়ে মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়। তারপর সহকর্মীর পিঠে সান্ত্বনার হাত রেখে ফের বলল সে, খবরদার, বেশি বকাঝকা করিস না ঠান্ডা মাথায় বোঝা। আর একটু খবর রাখবি পাড়ায় কাদের সঙ্গে মিশছে। প্রাইভেট টিউটরদের কাছেও খবর নে, নিয়মিত ক্লাস করতে যায় কিনা, ছেলের হোমটাস্ক রোজ চেক করবি।
সুশীল ঘাড় নেড়ে বিড়বিড় করে কী বলল বোঝা গেল না। ধীর পায়ে বেরিয়ে গেল।
দুপুরে চান-টান সেরে অম্লান অর্ক আর অস্মিতা খেতে বসেছে। খেতে খেতে একসময় অর্ক বলল, খাতা দুটো সানির বাবাকে দিলে কী এমন ক্ষতি হতো?
মাংস চিবুতে চিবুতে অম্লান বলল, সে তুমি বুঝবে না। তোমার পরিশ্রমের ফসল আমি যাকে-তাকে দিয়ে দেব? কী সব বোকার মতো কথাবার্তা।
অর্ক সুস্বাদু মাংসখণ্ডের সঙ্গে ‘বোকা’ শব্দটাকে গিলে আড়চোখে বাবাকে দেখে মৃদু হাসল।
অস্মিতা ছেলেকে আরও দু’পিস মাংস দিয়ে বলল, তোমার বাপি তোমার পড়াশোনার জন্য তোমার শরীর-স্বাস্থ্যের জন্য তোমার খুশির জন্য যা করে তার সবটা তুমি জানো না।
অর্ক মাথা নিচু করে মৃদু-মৃদু ঘাড় নাড়তে লাগল, তারপর একনজর বাবাকে দেখে বলল, অতসব আমি জানব কেমন করে, আমার জানার পরিধিই বা কতটুকু! বাবা যে অত ভালো অভিনয় জানে সেও কি জানতাম?
ভাতের গ্রাস অম্লানের মুখের কাছে থেমে গেল। কথাটা মনে মনে রি-ওয়াইন্ড করে স্তব্ধ সে, শান্তশিষ্ট ফার্স্টবয় যে এত কথা জানে সেও কি অম্লান আগে কখনও জানত!
খাওয়া শেষে অম্লান ও অস্মিতার নির্বাক চাহনির মাঝে অর্ক উঠে গেল বেসিনের দিকে।

 

 

 

.

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত