প্রথমপুরুষ

Reading Time: 2 minutes

ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়ের বাবা নরেন্দ্রলাল ব্যানার্জি

 

নার্সিংহোমের বেবিকটে চোখ বুঁজে ঘুমিয়ে আমিকরলে আমায় আদর তুমি।

দশপুত্র সম এক কন্যা বলে কোলে নিলে তুলেহাত বুলিয়ে চুলে।

ঘুমিয়েছিলামমেয়ে হয়ে এসেছিলামতোমার দুঃখ তোমার সুখ ভাগ করে নেব বলে।

আমি নাকি তোমার আয়পয় বাড়ি ঘর সবকিছুরই মূলে।

আমি কিন্তু এসে তোমার কাজ বাড়িয়েছি কিতোমাকে দুদন্ড দাঁড়াতে দিই নি ।

রংবেরংয়ের জামাউলের মোজাছোট্ট মশারিতুলোর তোষকসর্ষের বালিশঅয়েল ক্লথবেবি পাউডারফিডিং বটল্থার্মোস 

সব কিছু একে একে কিনে কেটে মায়ের পাশে রেখে গেছ।

আমি ঘুমিয়েমা ও আধো ঘুমেহাত রাখলে মাথায় তুমি এসে থেমে।

বাড়ি এলাম আমাদের পুরোণো ভিটেয়গঙ্গাতীরে,শীতের দুপুরে।

আমি শুধু ঘুমঘুমআর ঘুম। আর তুমি কোন অছিলায় আমার পাশেঘুমপাড়ানি গানের সুরে।

খবরের কাগজ হাতেচায়ের চুমুক সাথে।

বেশ কয়েক বছর পরে

আমার স্কুলে ভর্তি হওয়ার পরেলেখাপড়ার সাথে শেখালে গান তোমার ছন্দে তোমার সুরে।

তোমার পাশে থেকে থেকে তৈরি হলাম আমি। আজ তোমার কথা গুলো তোমার চেয়েও দামী।

একে একে স্কুলকলেজইউনিভার্সিটির গন্ডি পেরোলাম ঠিক!

শুধু ছিলে পাশে তুমিদিলে শিক্ষাসাহচর্য্য তুমি পরিশ্রমী !

তুমি আমার সেই তেজোদৃপ্ত প্রথমপুরুষযাকে আমি দেখছি এতকাল!

গীতাগায়ত্রীগঙ্গা স্নানে আপ্লুতধ্যানমগ্নসৌম্যপ্রশান্ত কোমল মানুষ।

আমার জীবনের দ্বিতীয় পুরুষ খুঁজে এনে দিলেসেই তুমি আবার আমার মন ছুঁয়ে গেলে !

পাঠিয়ে দিলে স্বামীর ঘরেবিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ করে,তুমি চলে গেলে আমার থেকে দূরে।

বড় অভিমান হোল সেদিনযখন তোমাকে দেখিনি সবে মাত্র দুটো দিন।

ক্রমে ভুলে গেলাম আমিডুবে রইলাম সংসারেসঙ্গে আমার নতুন বন্ধুপ্রথম প্রেমিকআমার প্রিয় স্বামী।

পেলাম আমার ছেলেআরো গেলাম ভুলেস্বামীপুত্র সংসারসুখেসব পেয়েছির দেশে।

কি নিষ্ঠুর না আমিকি স্বার্থপর মেয়ে তোমারআজ তোমাকে পেয়েছিলাম তাই আমার জীবন ধন্য |

কিন্তু আজ সে কেমন বদলে গেল হয়ত তোমারই জন্য।

জানো ঠিক এমনি হয়গ্রীষ্ম যায়বর্ষা যায় মেয়েরা কেমন বদলে যায় ।

ঠিক এমনি হয়তোমার কালোচুল সাদা হয়মেয়েরা যেন বদলে যায় |

ঠিক এমনি হয় তোমার দাঁত নড়েপড়ে যায়মেয়েরা কেমন বদলে যায়।

ঠিক এমনি হয়বাবার চোখে ছানি পড়ে মেয়েরা শুধু বদলে যায়।

তুমি শাসন করেছ এতটাইযতটা করেছ সোহাগতোমার কাছেই হাতেখড়ি ভৈরবীইমনবেহাগ।

তোমার আবৃত্তিপুরস্কারে তুমি মহান আজস্বামিজীর শিকাগো লেকচারেগীতবিতানের পাতায় পাতায়,

বাচনভঙ্গিমায়পুরুষ কণ্ঠেআমি প্রণাম করি তোমায়।

কখনো তোমাকে দেখেছি তারাশঙ্করের কালিন্দীর জমিদারের বেশেকখনো টিপুসুলতানে মারাঠা ব্রাহ্মণের বেশে,

শরদিন্দুর ঝিন্দেরবন্দী কিম্বা উল্কায় !

তোমার হাত ধরে পয়লা বোশেখের হালখাতার মেহফিলেদোকানে সূর্যাস্তের বিকেলে ।

শীতের দুপুরেবইমেলার কোলাহলেবাছাই করা বইয়ের গোছায়ট্যাক্সি নিয়ে ব্যাস্ত রাস্তায়।

শরতের মিঠে রোদেনিউমার্কেটেকিম্বদন্তী সব ফ্রকের দোকানেচীনেপাড়ার নতুন জুতোর গন্ধ নিয়ে,

হাতে কারকোর চাইনিজের পার্সেল প্যাকের ভিনিগারের গন্ধ ছুঁয়ে |

মনে পড়ে যায়….

রোববারের সকালেকলের গানের চোঙ থেকে একে একে এলপি রেকর্ডের সুরে ..

সিন্ধু ভৈরবী থেকে শিবরঞ্জনীর মূর্ছনা ..সে ও তোমার সংগ্রহ থেকেআজ অনেক দূরে।

ডোভার লেন কনফারেন্সের নস্টালজিয়ার গন্ধ নিতে নিতেতোমার সঙ্গে ফ্লুরিজের কেকে,

বা জিমিস কিচেনেমেট্রোসিনেমার যুদ্ধের ভয়াবহ সিনেহাটারি কিম্বা ব্রুস লি দেখে।

কত কি পেয়েছি !

জন্মদিনের ভোরে মাথার বালিশের পাশে বুকঅফনলেজ থেকে শরদিন্দু অমনিবাস,

কিম্বা সঞ্চয়িতা থেকে বিশ্বপরিচয়পুশকিন অথবা আর্থার কোনান ডয়েল |

অকশান থেকে কেনা বিশাল জার্মান পুতুলহায়দ্রাবাদি মুক্তোর দুল।

হিসেব মেলাতে পারবো না..

আমি তখন অষ্টাদশীফ্রক থেকে শাড়িপ্রথম শাড়ি তোমার দেওয়া মেরুণ বালুচরি!

স্মৃতির ক্যানভাস থেকে হারিয়ে যাবে না সেই সুর।

তুমিও থাকবে আমার জীবনে সপ্ত ঋষির মতস্মৃতি সুমধুর।

সকলের সব দ্বেষ হিংসাকর্কশ কটুক্তি হজম করে আজ তুমি নিজের মহিমায় অমলিননীলকন্ঠ!

পবিত্রযজ্ঞউপবীত তোমার গঙ্গোদকে পূর্তপবিত্র!

হে ব্রাহ্মণ প্রণমি তোমারে !

তোমার গন্ডুষ পাত্রে তোমার উচ্ছিষ্ট পান করি

আশীর্বাদ করো পরমং তপঃ পিতা স্বর্গ পিতরি ।

.

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>