| 26 এপ্রিল 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

গীতগোবিন্দ : রাধাকৃষ্ণ প্রেমের আদিকাব্য

আনুমানিক পঠনকাল: 11 মিনিট

জয়দেবের প্রমাণ্য জীবনী নেই। তাঁর জন্মস্থান সঠিকভাবে কোথায়, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। তিনি বাঙালি কি না সে বিষয়ে সংশয় আছে। কিন্তু বাঙালি তাঁকে আপনজন বলে মনে করে। রাধাকৃষ্ণকথার সূত্রপাত তাঁরই হাতে। বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাসের পূর্বসূরী তিনি। তাঁর গীতগোবিন্দে আমরা প্রথম রাধাকৃষ্ণলীলার মুখোমুখী হই। এতে বিলাসকলা কিংবা হরিস্মরণ কোনটার প্রাধান্য, সে বিচারের ভার আপনাদের উপর।

             

      

।। বিলাসমত্ত কৃষ্ণ ।।

বসন্তকাল। বাসন্তীফুলের মতো কোমলাঙ্গী রাধা বড় নিঃসঙ্গ। কৃষ্ণের সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন  তিনি। অসহ্য হয়ে উঠছে বিরহবেদনা। এমন সময়ে এলেন তাঁর প্রিয় এক সহচরী। তিনি রাধাকে বললেন, ‘ সখি! এই বসন্ত, এই স্নিগ্ধ মলয় বায়ু, মধুপ কোকিলের এই মধুরধ্বনি বিরহীজনের কাছে বড় দুঃখদায়ক। তোমার শ্যাম এখন যুবতীদের সঙ্গে বিলাসকলায় মত্ত। ওই দেখো সখী, বহু রমণীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ আবেশবিহ্বল তোমার শ্যামকে। তার নীলাভ দেহ শ্বেত চন্দনে চর্চিত, পীতবসন বনমালীর কুণ্ডল দুলছে কেলিশিহরণে। সুমধুর স্বরে পঞ্চমরাগ গাইতে গাইতে এক গোপবধূ কৃষ্ণের দেহ নিপীড়ন করছে তার দুই স্তন দিয়ে। ওই দেখো আর এক গোপবধূকে, সে ধ্যান করছে কৃষ্ণের মুখ, তার বিলাসকাতর দুই চোখে কামনার আগুন। কৃষ্ণের সঙ্গে কানে কানে কথা বলার ছলনায় আর এক গোপবধূ মুখচুম্বন করছে তার। দেখো, দেখো, আর এক গোপবধূ যমুনাতীরের বেতসলতার কুঞ্জে কৃষ্ণের পীত অঞ্চল নিয়ে টানাটানি করছে। কৃষ্ণের বংশীধ্বনি শুনে করতালি দিয়ে নাচছে কেউ কেউ।

‘ সখি! তোমার শ্যাম আজ বিলাসমত্ত। সে কারোকে চুম্বন করছে, কারোকে আলিঙ্গন করছে, কারোকে রমণ করছে, আবার কারোর মানভঞ্জন করছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে যেন দেহধারী শৃঙ্গাররস।’

 রাস উৎসবে কৃষ্ণের বিলাসকলা দেখতে দেখতে রাধার বুকে জাগে বেদনা। হায়, এই কৃষ্ণকে একদিন তিনি গাঢ় আলিঙ্গনে বুকে বেঁধেছিলেন, সুধাময় কৃষ্ণকে করেছিলেন চুম্বন।

 

।। দুঃখহারী কৃষ্ণ ।।

সহচরীর কাছে আপন মনোবেদনা ব্যক্ত করে রাধা বললেন, ‘ সখি, আমার মনে পড়ছে শরতের সেই রাসের কথা। যার সুধাময় অধরের স্পর্শে মোহন বংশী মখরিত হত মধুর ধ্বনিতে, যার কটাক্ষে দুলে উঠত কুণ্ডল,- সেই কৃষ্ণ আজ অন্য যুবতীদের সঙ্গে বিলাসে মত্ত। অর্ধচন্দ্রাঙ্কিত ময়ূরপুচ্ছে যে কেশব বাঁধত তার কেশগুচ্ছ, মনে হত যেন ইন্দ্রধনুতে সজ্জিত নবজলধর,- সেই কৃষ্ণ আজ পরিত্যাগ করেছে আমাকে। বিপুলনিতম্বা যুবতীকে দেখে চুম্বনের লোভে ছুটে যেত কৃষ্ণ আর তার মুখখানি দেখে মনে হত বন্ধুককুসুমরঞ্জিত,-সেই কৃষ্ণের কাছে আজ আমি উপেক্ষিতা। বাহু প্রসারিত করে যে কৃষ্ণ আলিঙ্গন করত যুবতীদের এবং যার দেহের ভূষণের দ্যুতিতে দূরীভূত হত তমসা,- সেই কৃষ্ণ আজ অন্যের সঙ্গে বিলাসমত্ত। যার কপালের চন্দনতিলক ম্লান করত চাঁদের রূপকে, যার প্রশস্ত বক্ষ পীন পয়োধর মর্দনে নির্মম,- সে কৃষ্ণ আজ আমার নয়। মণিময় মকরকুণ্ডলে যার গণ্ডের শোভা, পীতবসনে যে বনমালী মানব-দানব-দেবতা সকলের প্রিয়,-সেই কৃষ্ণের কাছ থেকে আজ আমি বিচ্ছিন্না। কদম্বতলে বসে যে কৃষ্ণ আমাকে হানত নয়নবাণ, যার রূপদর্শনে দূরে যেত ভবতাপ এবং হৃদয়ে প্রবাহিত হত কামনার তরঙ্গ,-সেই কৃষ্ণ আজ আমার প্রতি বিরূপ। সখি! আমি তার কোন দোষ দেখি না, তার প্রতি কোন রাগ আমার নেই, ভুল করে তারই গুণ গাই অবিরত। জানি সে পরানুরাগী, তবু তাকেই আমি চাই।’

রাধা বেদনাব্যাকুলকণ্ঠে বলে যান, ‘সখি! রাত্রিকালে আমি চলে যাই নিভৃতকুঞ্জে, তাকাই চারদিকে, যদি সে কোথাও থাকে সংগোপনে, আমার কামনা নিশ্চয়ই স্পর্শ করবে তাকে। তুমি কৃষ্ণকে আমার কাছে এনে দাও। প্রথম মিলনকালে আমি যখন লজ্জিতা ছিলাম, তখন চাটুবাক্যে আমাকে প্রবোধ দিতে দিতে আমার বসন উন্মোচিত করে দিয়েছিল। পল্লবশয্যায় শায়িত আমার বক্ষে শয়ন করত সে, চুম্বন দিয়ে আমার চুম্বনের উত্তর দিত। রতি লালসায় যখন আমি আবিষ্ট হতাম তখন সে পুলকিত হত; আমার শরীর স্বেদসিক্ত হলে সে আবার রতি প্রার্থনা করত। আমার কণ্ঠস্বর শুনে সে হারাত রতিশাস্ত্রের বিচার, আমার কেশ থেকে ফুল খসে পড়লে সে ‌আমার স্তনে চিহ্নিত করত নখাঘাত। তার মৈথুন পূর্ণতা পেত আমার নূপুরের শব্দে, আমার মেখলা খসে পড়লে সে সাদরে আমার মুখ চুম্বন করত। রতিসুখে আমি যখন শ্রান্ত হতাম, তখন আবার রতি অভিলাষ করত সে। সুন্দরী গোপনারীরা কটাক্ষ করলেও যে শ্যাম আমাকে দেখে কামনাচঞ্চল হত আর যার হাত থেকে খসে পড়ত মোহনবংশী,- সেই কৃষ্ণকে এনে দাও আমার কাছে। আজ কৃষ্ণবিহনে নব অশোকগুচ্ছ পীড়া দেয় আমার চক্ষুকে, স্নিগ্ধ বাতাস দগ্ধ করে আমার হৃদয়, সঞ্চরমান ভৃঙ্গে মুখর রসালকলিও আমাকে আনন্দ দিতে পারে না।’

 

।।মুগ্ধ মধুসূদন।।

কৃষ্ণকে রাধার ধ্যানে তন্ময় দেখে একে একে চলে গেলেন ব্রজনারীরা। অনুতাপের দহন শুরু হয়েছে কৃষ্ণের মনে। রাধার সন্ধানে ছুটে গেলেন তিনি যমুনাকূলে। না, সেখানে রাধা নেই। কুঞ্জ শূন্য দেখলেন। বিরহ বিযাদে কৃষ্ণ আপন মনে বলতে লাগলেন, ‘ আমাকে গোপী পরিবৃত দেখে ক্রুদ্ধ হয়েছে রাধা। অভিমানে চলে গেছে দূরে। আমার বিরহে কী করে কাটাচ্ছে দিন! তাকে ছাড়া আমারও বা কী করে দিন কাটবে!

‘চিন্তাপ্রযুক্ত তার বঙ্কিম ভ্রূর কথা মনে পড়ছে। সে যেন রক্তোৎপলের উপর ভ্রমর।… আমি তার হৃদয়ে হৃদয় রেখেছি, তাহলে বৃথা কেন ঘুরে মরছি এদিক-ওদিক?… হে তন্বি! এখন ঈর্ষাকাতর তোমার হৃদয়, তোমার দেখা পেলে ভরিয়ে দিতাম অনুনয়ে।…হয়তো আমার সমুখ দিয়ে চলে যাচ্ছ তুমি, তবু আগের মতো কেন করো না প্রেমসম্ভাষণ!… হে প্রিয়ে! ক্ষমা করো আমাকে, আর কোনদিন এমন অপরাধ করব না।

‘আমার হৃদয়ে মৃণালের হার—বাসুকি নয়, আমার কণ্ঠে নীলপদ্মের মালা-গরলের আভা নয়, আমার শরীর চন্দনচর্চিত—ভস্ম নয়। হে অনঙ্গ! মহাদেবভ্রমে আমার উপর পুষ্পশর নিক্ষেপ করো না। আমি তো মূর্ছিত মানুষ, কী হবে আমাকে বাণ মেরে? রাধার নয়নবাণে আমি জর্জের হয়ে আছি। রাধার ভ্রূপল্লব যেন ধনুক, আর তার আকর্ণবিস্তারী নয়ন হল গুণ। ত্রিভুবন বিজয়ের পর কামদেব তাঁর অস্ত্রগুলি তুলে দিয়েছেন রাধার হাতে, বিরহীজনের বুকে আঘাত দিতে। রাধার ভ্রূচাপ থেকে ছুটে আসা তির বিদ্ধ করেছে আমার হৃদয়, তার কৃষ্ণকুটিল কেশরাশি আমাকে বধ করতে উদ্যত, তার রঞ্জিত বিম্বাধর আমাকে আবিষ্ট করেছে, তার বর্তুল কুচযুগ বিদীর্ণ করেছে আমার বক্ষ, তার স্পর্শসুখ আমার সারা দেহে, আমার নয়নে তার দৃষ্টির স্বিগ্ধতা, নাসিকায় তার মুখপদ্মের ঘ্রাণ, শ্রবণে ভাসে তার মধুর কণ্ঠধ্বনি ; তবু কেন আমি দগ্ধ হই বিরহবেদনায়!’

 

।। স্নিগ্ধ মধুসূদন ।।

যমুনার তীরে বেতসকুঞ্জে বসে আছেন কৃষ্ণ বিষণ্ণ মনে। এমন সময়ে সেখানে এলেন রাধার এক সহচরী।

সহচরী বললেন, ‘ রাধা কাতর বিলাপ করতে করতে নিন্দা করছে চন্দন ও চন্দ্রকিরণের ; আজ তার কাছে মলয় বাতাসও গরলের সমান যন্ত্রণাদায়ক। হে কৃষ্ণ! তোমার বিরহে রাধার দেহ আজ ক্ষীণ। সারাক্ষণ তার বুকে লাগছে কামের আঘাত। তোমাকে কমলকবচে হৃদয়ে ঢেকে রেখেছে। আজ ফুলের শয্যা তার কাছে শরশয্যা, তবু তোমার আলিঙ্গন কামনা করে সে শয্যায় শুয়ে থাকার ব্রত নিয়েছে। রাহুর দন্তপিষ্ট চাঁদ থেকে ঝরে পড়া সুধার মতো তার দুই নয়ন হতে বারিধারা ঝরে পড়ছে অবিরল। কখনও বিরলে বসে কস্তুরীরসে সে তোমার ছবি আঁকে, শ্রীকরে নবচূতশর দিয়ে সে প্রণাম করে মদনমোহনকে, বলে : হে শ্যাম! এই আমি প্রণত হলাম তোমার পদতলে, তুমি বিমুখ হলে নিশাপতি চন্দ্র দহন করবে আমাকে। মনে মনে তোমার ছবি কল্পনা করে সে বিলাপ করে।

‘হে কৃষ্ণ! আজ রাধা গৃহেই বনবাসী, যেন সে দাবানলে বেষ্টিত বিরহিণী মৃগ ; দেহ তার দগ্ধ হয় অবিরত। হে কেশব! তোমার বিরহে স্তনের উপর প্রলম্বিত মণিময় হারকেও তার ভার মনে হয়। অঙ্গের চন্দনকে মনে হয় বিষ। তার সন্তপ্ত নিঃশ্বাসে কামানলের জ্বালা। তার কমলসম সজল দুটি নয়ন তোমাকে খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত। পল্লবশয্যাকে তার হুতাশন মনে হয়। করতলে কপোল রেখে সে তোমার চিন্তায় আচ্ছন্ন। জন্মান্তরে তোমাকে লাভ করার কামনায় সে কৃষ্ণনাম জপ করে চলেছে।

‘হে কৃষ্ণ! তোমার বিরহে তার কলেবর রোমাঞ্চিত হয়, সে শীৎকার করে, বিহ্বল হয়ে পড়ে, কখনও চেতনা হারায়। তার এই রোগের কোন চিকিৎসা নেই। একমাত্র তুমিই রক্ষা করতে পারো  তাকে। তোমার সঙ্গসুধা তাকে সুস্থ করতে পারে। এসব শুনে তুমি যদি এগিয়ে না এসো, তাহলে জানব তুমি বজ্রের চে্য়ে নিষ্ঠুর। ক্ষণিকের বিরহ যে রাধা সহ্য করতে পারে না, সে এখনও জীবিত আছে কেমন করে কে জানে!’

 

।। কামনাময় কৃষ্ণ ।।

কৃষ্ণ রাধার সহচরীকে বললেন, ‘সখি! তুমি রাধার কাছে যাও। তাকে বলো আমি এখানে আছি। তোমাকে মিনতি করছি তাকে নিয়ে এসো।’

তাই সখী রাধার কাছে গিয়ে বললেন, ‘তোমার বিরহে শ্যাম আকুল। কামনা উদ্রেককারী দক্ষিণা বাতাস আর পুষ্পসৌরভ তাকে বিরহ যন্ত্রণায় দগ্ধ করছে।… শিশিরসদৃশ হিম জ্যোৎস্নার দহনে কৃষ্ণ মুমূর্ষু।… অলির গুঞ্জন না শোনার জন্য সে বন্ধ করে রাখে তার কান, তার বিরহনিশি অতিবাহিত হয় তীব্র যন্ত্রণায়।…. সে এখন বিপিনে বসতি করছে, ভূমিতে লুটিয়ে নাম জপ করছে তোমার।… একদা যে কুঞ্জে তোমার সঙ্গে সহবাসে  তৃপ্ত হয়েছিল, এখন সেখানে তোমার স্তন আলিঙ্গনের জন্য আকুল হয়ে বসে আছে । তুমি আর বিলম্ব করো না।… যমুনাতীরে তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছে কৃষ্ণ, তোমার পীনপয়োধর মর্দনের জন্য চঞ্চল হয়ে আছে তার দুই হাত।… তোমার নামের ধ্বনিসংকেতে মৃদু মৃদু বাঁশি বাজছে, তোমার শরীর স্পর্শকারী বায়ুকে সে সমাদর করছে।…পাতা ঝরে পড়া বা পাখির উড়ে যাওয়ার শব্দে সচকিত হয় শ্যাম, তোমার আগমনের কথা ভেবে প্রস্তুত করে রাখে শয্যা।… রাধা, তুমি নূপুর খুলে ফেলো, রতিকালে বড় শব্দ হয়; সুনীল বসন পরে ঘন অন্ধকারে আত্মগোপন করে কুঞ্জে চলে যাও।… কৃষ্ণের বুকের মণিহারে বলাকার শোভা, বিপরীত সহবাসে তুমি তার বুকের উপর বিরাজিত হও বিদ্যুতের মতো।..তোমারে জঘন থেকে উন্মুক্ত করো আবরণ, পদ্মশয্যায় শয়ন করে রত্নভাণ্ডার লাভে বড় উৎফুল্ল হবে তোমার কৃষ্ণ।… রাত্রি শেষ হয়ে আসছে, আর বিলম্ব করো না, তাকে তৃপ্ত করো সহবাসে।… সখি! মদনবাণে তোমার কান্ত বড় পীড়িত, সে বারবার নিঃশ্বাস ফেলে চারদিকে তাকিয়ে দেখছে, ঘর-বাহির করছে, তারপর বিলাপ করছে।…অস্তাচলে গেলেন সূর্যদেব, গাঢ়তর হল অন্ধকার, আর বিলম্ব নয়, অভিসারে চলো রাধা।.. যখন দুজনের দেখা হবে তখন গাঢ় আলিঙ্গনে, চুম্বনে, নখরাঘাতে, মৈথুনে আপ্লুত হবে রাত্রি।…. চকিত দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে অন্ধকার তরুতলে ক্ষণিক বিশ্রাম নিয়ে ধীর পদক্ষেপে কৃষ্ণের কাছে যাও তুমি।…

 

 

।।কপট মুরারি ।।

রাধার সহচরী কৃষ্ণকে বললেন, ‘ওহে শ্যাম! তোমার অনুরাগিণী রাধা এমনই বেদনাবিদ্ধা যে সে কুঞ্জাভিসারে যেতে অক্ষম। সে তার বাসগৃহে অবশ হয়ে বসে রয়েছে।

‘তোমার মতো বেশভূষা করে সতৃষ্ণ নয়নে বারবার নিজেকে দেখে, নিজের মধ্যে খুঁজে পায় তোমাকে, তোমাকে ভেবে আমাকে সে আলিঙ্গন করে। তোমার আগমনে বিলম্ব দেখে সে বিলাপ শুরু করেছে।

‘ক্ষণে ক্ষণে সে রোমাঞ্চিত হচ্ছে, শীৎকার করছে, অবসাদগ্রস্ত হচ্ছে, বিলাপ করছে। হে কপট কৃষ্ণ! তোমার চিন্তাতেই সে মগ্ন হয়ে আছে।

‘পাতার শব্দে তার মনে হয় তুমি আসছ। তাই সে অলংকার পরে, শয্যা রচনা করে তোমার ধ্যান করে। তোমাকে ছাড়া কী করে কাটবে তার রাত্রি! কেন এই বটবৃক্ষতলে এখনও শুয়ে আছ তুমি, হে কৃষ্ণ! তুমি তার কাছে যাও।’

 

 

।। নাগর নারায়ণ ।।

সুন্দরীর ললাটে চন্দনবিন্দুর মতো বৃন্দাবন আলোকিত করে চাঁদ উঠল গগনে। এখনও এল না মাধব। তাই রাধা বিলাপকাতরা।

তিনি আপনমনে বলতে লাগলেন, ‘ সময় চলে যায়, এলো না দয়িত আমার, বিফলে গেল আমার যৌবন, এখন কার শরণ নেব? এই গহন বনে যার জন্য এসেছি সে আমাকে জর্জরিত করছে মদনশরে।… বিরহানল দগ্ধ করছে আমার হৃদয়, আর পারছি না, এর চেয়ে মৃত্যু ভালো।.. এই মধুর বসন্তযামিনী ব্যাকুল করছে আমাকে। জানি না বনমালী এখন কোন নারীকে তৃপ্ত করছে।.. কৃষ্ণের জন্য পরলাম এই মণিভূষণ, সে এলো না, এসব তাই আমাকে বড় যন্ত্রণা দিচ্ছে।….আমার সুকুমার তনুতে কুসুমমালা কামশরের মতো যন্ত্রণা দিচ্ছে।…যার জন্য বসে আছি এই বেতসবনে, তার কী মনে পড়ে না আমাকে?… তবে কী সে অন্য কোন মোহে আবিষ্ট? তবে কী সে চলে গেছে অন্য কোন গোপিনির কাছে? নাকি সে সখাদের সঙ্গে খেলায় মত্ত? সে কী বিরহক্লান্ত হয়ে গমনাগমনে অক্ষম?…. ’

এমন সময়ে বিষাদমৌন সখী একাই ফিরে এলেন রাধার কাছে। তাকে একাকী দেখে শঙ্কিত হলেন রাধা। ভাবলেন কৃষ্ণ বোধহয় তাকে উপেক্ষা করে অন্য নারীতে  মগ্ন। রাধা সখীকে বললেন, ‘আমার চেয়ে রূপবতী কোন যুবতীর সঙ্গে শ্যাম রতিক্রীড়ায় মত্ত, কৃষ্ণের আলিঙ্গনে তার উচ্চ কুচযুগে দুলছে মণিহার, তার ললিতবদনে পড়েছে অলকচূর্ণ, কৃষ্ণের চুম্বনে  মুদ্রিত তার নয়ন, নরম কপোলে কম্পিত হচ্ছে যুগল কুণ্ডল, নিতম্বের দোলায় তার বসন বিস্রস্ত। শ্যামের দিকে সে লজ্জিতভাবে তাকিয়ে আছে, রতিরসহেতু ঘন শব্দ উঠছে, পুলককম্পনে সে ভেসে যাচ্ছে, কখনও নয়ন মুদ্রিত করে ঘন শ্বাস ফেলছে, রতিশ্রমজলে সুশোভিতা হয়ে সে শ্যামের কমনীয় বক্ষে শায়িতা।’

ডুবন্ত চন্দ্রের পাণ্ডুর রঙ দেখে রাধার মনে পড়ছে বিরহী কৃষ্ণের ম্লানমুখের কথা, দগ্ধ হচ্ছে তাঁর হৃদয়। রাধা তাঁর সখীকে বললেন, ‘দেখো সখি! যমুনাতীরে অভিসারে মত্ত কৃষ্ণকে। কামনাময়ী যুবতীকে চুম্বন করে সে তার ললাটে দিচ্ছে কস্তুরী তিলক। কুরুবক ফুল দিয়ে তার মেঘসদৃশ কেশরাশি সজ্জিত করছে। নখরাঘাতে লাঞ্ছিত তার স্তনে তারকার আভার মতো শোভা পাচ্ছে মুক্তাহার। মৃণালের মতো কোমল তার বাহুযুগলে পরিয়ে দিচ্ছে মরকতময় বালা যা দেখে মনে হচ্ছে পদ্মফুলে যেন ভ্রমর বসেছে। তার বিপুল জঘন যেন রতিগৃহ, মণিময় হারের শোভায় তা হার মানায় তুরণের শোভাকে। তার পদযুগল যেন লক্ষ্মীর নিবাস যা কৃষ্ণ তার বুকের উপর স্থাপন করে অলক্তকে রঞ্জিত করে। প্রবঞ্চক কৃষ্ণের জন্য আমি কেন এই বিজন বনে রাত্রি যাপন করছি বৃথা?’

রাধা বললেন, ‘তোমার কোন দোষ নেই সখী। কৃষ্ণ দয়াহীন, শঠ, বহুবল্লভ। অথচ তার জন্য আমার প্রাণ বিদীর্ণ হচ্ছে। যে নারীকে কৃষ্ণ ভোগ করছে তার প্রাণ আর তাপিত হয় না, যার সঙ্গে সে রতিকেলি করে সে ভয় করে না মদনবাণকে, কৃষ্ণের মধুর বচন যে শুনেছে সে মলয় সমীরে শঙ্কিত হয় না, স্থলপদ্মের মতো বনমালীর হস্তপদ যে স্পর্শ করেছে সে ব্যথিত হয় না চন্দ্রকিরণে, জলদবরণ শ্যাম যাকে আলিঙ্গন করে তার হৃদয়ে থাকে না বিরহবেদনা, সে যাকে আলিঙ্গন করে পরিজনদের পরিহাসে তার কষ্ট হয় না কোন, শ্যাম যাকে ভোগ করে তার কোন বেদনা থাকে না।’

শ্রীরাধা আপনমনে বলতে থাকেন, ‘হে মলয় সমীরণ, কেন তুমি বিরূপ এই বিরহিণীর প্রতি? তুমি মাধবকে এনে দাও আমার কাছে, তারপরে আমার প্রাণ হরণ করো।

‘যাকে স্মরণ করলে শত্রু মনে হয় সখীদের, শীতল সমীরণকে মনে হয় অনল, জ্যোৎস্নাধারাকে মনে হয় গরল — তার দিকেই ছুটে যায় মন। হে যমুনা, তোমার তরঙ্গে নিমজ্জিত করে প্রশমিত করো আমার যন্ত্রণা।’

 

।। বিস্মিত শ্রীহরি ।।

মনোদুঃখে রাত্রি অতিবাহিত হল শ্রীরাধার। প্রভাতে এলেন কৃষ্ণ। কাকুতি মিনতি করতে লাগলেন রাধার কাছে। রাধা ক্রুদ্ধ হয়ে বলতে লাগলেন, ‘তোমার কোন মিনতি বা অজুহাত শুনতে চাই না আমি। যার অনুরাগে লোচন ভরে আছে তোমার, কাজলমলিন যার দুই চোখ চুম্বন করে তোমার ওষ্ঠ নীলাভ, তার কাছে চলে যাও তুমি। রতিক্রীড়ার ফলে তোমার সমস্ত দেহে নারীর নখরাঘাত যেন মরকতে রচিত রতিবিজয়পত্র। তোমার বক্ষে সেই নারীর অলক্তকের ছাপ যেন মদনতরুর নবকিশলয়। আর তোমার অধরে সে নারীর দংশনক্ষত দেখে বড় বেদনা হয়। হে শ্যাম, তোমার দেহ অপেক্ষা তোমার মন অধিক কালিমালিপ্ত, তাই তুমি আমাকে বঞ্চনা করো। কপট তুমি, নারীহত্যার জন্য কুঞ্জে ভ্রমণ করো, রতিবঞ্চিতা খণ্ডিতা রাধার প্রতি কোন করুণা নেই তোমার। তাই  তোমাকে দেখে লজ্জা হয়।’

 

।। মুগ্ধ মুকুন্দ ।।

কলহান্তরিতা রাধা যখন কৃষ্ণচিন্তায় নিমগ্না তখন তাঁর সখী এসে বললেন, ‘ হে রাধা! অভিমান ত্যাগ করো। মৃদু মন্দ বায়ু প্রবাহিত হচ্ছে, অভিসারে আসছে তোমার শ্যাম, এ সময়ে ঘরে ফিরে যাওয়া ভালো নয়। তালফলের মতো সরস ও গুরুভার স্তনযুগলকে ব্যর্থ করো না। তোমাকে বারবার বলেছি শ্যামকে ত্যাগ করো না। কেন কাঁদছ তুমি, কেন দুঃখ করছে ! দেখে এসো তোমার শ্যাম এখন পদ্মশয্যায় শায়িত। তাকে দেখে দূর করো পরিতাপ। তোমার কাছে আসতে দাও তাকে, ডাকতে দাও মধুরস্বরে। তুমি স্নেহপরায়ণের প্রতি  আর প্রণতজনের প্রতি উদাসীন ও অনুরক্তজনের প্রতি নিষ্ঠুর হয়েছিলে—তাই তো চন্দনকে তোমার বিষ লাগে, চন্দ্রে পাও রবিতাপ, শিশির তোমাকে দগ্ধ করে, প্রেমে পাও সন্তাপ।’

 

।।মুগ্ধ মাধব ।।

দিনাবসানে রাধার ক্রোধ কিছুটা প্রশমিত হলেও তখনও তাঁর মুখ ম্লান। এমন সময়ে সেখানে উপস্থিত হলেন কৃষ্ণ । তাঁকে দেখে লজ্জিতা হয়ে রাধা তাকালেন সখীদের দিকে।

কৃষ্ণ রাধাকে বললেন, ‘ একবার কথা বলো রাধা, তোমার জ্যোৎস্নার মতো হাসিতে দূর হয়ে যাক অন্ধকার। হে চন্দ্রাননা! তোমার অধরসুধার জন্য আমার নয়নচকোর যে ক্রন্দন করছে। হে মানিনি! ত্যাগ করো মান, দান করো মুখপদ্মের মধু । যদি রাগ করে থাকো তাহলে কটাক্ষ শরে বিদ্ধ করো আমাকে, আলিঙ্গনাবদ্ধ করো, দংশন করো, যেভাবে পারো শাস্তি দাও।’

কৃষ্ণ বলতে লাগলেন, ‘তুমি আমার ভূষণ, তুমি আমার জীবন, তুমি আমার ভবসাগরের রত্ন, নিয়ত তুমি আমার। লালপদ্মের রূপ ধারণ করেছে তোমার নীলপদ্মের মতো দুটি নয়ন; সফল হবে তার রূপান্তর যদি কাম-কটাক্ষে রঞ্জিত  করতে পারো আমার হৃদয়। কুচকুম্ভে মণিহার দুলিয়ে বিস্তার করো বক্ষের শোভা, নিতম্বের  চন্দ্রহার প্রচার করুক কামদেবতার নির্দেশ। স্থলপদ্মের চেয়ে সুন্দর তোমার পদযুগল মৈথুনকালে শোভাময় হয়, অনুমতি দিলে আমি তাদের অলক্তকে রঞ্জিত করতে পারি। তোমার উদার চরণ হোক আমার শিরোভূষণ, এতেই বিদূরিত হয়ে যাবে আমার কামানল। তোমার বিপুল নিতম্ব এবং স্তনের দৃশ্যে ভরে আছে আমার মন। হে রাধা! কৃষ্ণ অন্য নারীতে আসক্ত নয়, তাই ভয় ত্যাগ করে কাছে এসো। আলিঙ্গন দাও, দশন দিয়ে প্রহার করো, স্তনভারে পিষ্ট করো, শাস্তি দাও কিন্তু মদনবাণে হত্যা করো না। তোমার ভ্রূভঙ্গিমা কালসর্পের মতো, তাতে আমার দেহমন আবিষ্ট, তোমার অধরসুধায় আছে ভীতিনাশের মন্ত্র। তোমার নীরবতা আমাকে ব্যথাতুর করে, মধুর আলাপে দূর করো সে ব্যথা, করুণা করো, আমাকে ফিরিয়ে দিও না তুমি। বান্ধবকুসুমের মতো রক্তিম তোমার অধর, মধুককুসুমের মতো পাণ্ডুর তোমার গণ্ড, তিলফুলের মতো নাসা, কুন্দফুলের মতো  দশন, তোমার বদনের করুণায় বিশ্বজয় করেছে মদনদেব। দৃষ্টিতে মদালসা তুমি, গমন তোমার মনোরমা, রম্ভার চেয়ে সুন্দর তোমার উরু, রতিকৌশলে কলাবতী তুমি, মর্ত্যবাসিনী তোমার অঙ্গে দেবনারীর দ্যুতি।’

 

 

।। সানন্দ গোবিন্দ ।।

বহু অনুনয়ে রাধাকে প্রসন্ন করলেন কৃষ্ণ। রাত্রিকালে সুসজ্জিত কৃষ্ণকে কুঞ্জে যেতে দেখে সহচরী রাধাকে বললেন, ‘ সখি! তোমার চরণে নতি স্বীকার করে কৃষ্ণ তোমার প্রতীক্ষা করছে বেতসকুঞ্জে, তুমি আর দেরি করো না, পয়ের নূপুর মুখরিত করে মরাল গমনে তার কাছে যাও। তার মোহন বংশীধ্বনি শ্রবণ করে পরিহার করো মান।

‘ওই দেখো, লতারা হাত তুলে অভিসারে যেতে বলছে তোমাকে। আর দেরি করো না। তুমি  তাকে আলিঙ্গন করছ, সে তোমাকে প্রেমালাপে তুষ্ট করে রমণ করছে, এসব ভেবে রোমাঞ্চিত হচ্ছে শ্যাম, কখনও বা আনন্দের আতিশয্যে মূর্ছিত হয়ে পড়ছে।’

দুচোখে কাজল, দুহাতে তমালগুচ্ছ, শিরোভূষণে নলিনীমালা, কুচের উপর কস্তুরিকালেখা—এভাবে নায়িকা অভিসার করলে মনে হয় যেন নিবিড় অন্ধকার তার আবরণ। গৌরবর্ণা অভিসারিকা তমসার দেহে রেখায়িত হলে মনে হয় স্বর্ণের মতো শুদ্ধ প্রেম আাঁধারনিকষে হেমসদৃশ। মণিময় হার, সোনার মেখলা, নূপুর-কঙ্কণেসজ্জিতা রাধাকে কুঞ্জদ্বারে লজ্জাবনতা দেখে সখী তাকে বললেন, ‘মনোহর কুঞ্জে সহাস্যবদনে কৃষ্ণসমীপে যাও রাধা। নবাশোকে সজ্জিত শয্যায় মেতে ওঠো রতিকেলিতে। সুগন্ধময় শীতলকুঞ্জে বিভোর হও প্রেমের গানে। বিপুল নিতম্বভারে অলসগতি হে রাধা, পল্লবঘন কুঞ্জে শ্রীহরির সঙ্গে বিহারে মেতে ওঠো।

‘কেলিগৃহ এখন মধুকরগুঞ্জনে মুখরিত, মদভরে তুমি মিলিত হও শ্যামের সঙ্গে। সুন্দর দন্তপংক্তিবিশিষ্ট হে রাধা, মধুর হাসিতে চলে যাও শ্যামের কাছে। মদনতাপে তাপিত শ্যাম চায় তোমার অধরামৃত, তুমি তার অঙ্ক অলংকৃত করো,  দেখবে সে তোমার ক্রীতদাস হয়ে চরণসেবা করবে।’

চপল নয়নে রাধা দেখলেন কৃষ্ণকে। তারপর নূপুরধ্বনির সঙ্গে প্রবেশ করলেন কুঞ্জে। চন্দ্রদর্শনে সিন্ধু যেমন পুলকে নৃত্যরত হয়, তেমনি রাধাকে দেখে কৃষ্ণের দেহে কামনার বিবিধ বিন্যাস দেখা গেল।

কৃষ্ণের বুকে দোদুল্যমান মুক্তার মালা যেন যমুনাজলের ফেনা, কৃষ্ণের শ্যামল দেহের পীতবাস যেন ইন্দীবর। তার কামনাময় মুখমণ্ডলের চঞ্চল চক্ষুদুটি যেন শরতের সরোবরে বিকশিত পদ্মে ক্রীড়ারত খঞ্জনযুগল। শ্যামের কমলসদৃশ বদনে যেন বিকাশের ছলে কুণ্ডল ধারণ করেছে সৌর আভা। তার মধুর হাসি বর্ধিত করে রতিলালসা। কৃষ্ণমেঘের মতো তার কুসুমসজ্জিত কেশদামে বিচ্ছুরিত হচ্ছে জ্যোৎস্নার আভা, তার কপালের চন্দনতিলক যেন স্বয়ং শশধর। তার রোমাঞ্চিত কলেবর মৈথুনের ইচ্ছায় অধীর।

প্রিয়তমকে দেখে রাধার নয়নতারা দুটি অতি বিস্তৃত হয়ে যায়, গড়িয়ে পড়ে আনন্দাশ্রু। কাজের ছলনায় সখীরা চলে গেলে রাধা গভীর অনুরাগে দেখলেন কৃষ্ণকে, দূরীভূত হল তাঁর লজ্জা।

 

।। সুপ্রীত পীতাম্বর ।।

কামাবেগে পুলকিতা এবং ঈষৎ লজ্জিতা রাধাকে পল্লবশয্যার দিকে বারবার তাকাতে দেখে কৃষ্ণ তাকে বললেন, ‘পল্লবশয্যায় তোমার চরণপদ্ম স্থাপন করো রাধা, চূর্ণ হয়ে যাক তোমার অহংকার। অনুগত কৃষ্ণকে একটু ভজনা করো। বহুদূর থেকে এসেছ তুমি, নূপুরের মতো অনুগত কৃষ্ণকে তোমার পদযুগল সেবনের আদেশ দাও। তোমার মুখ সুধার ভাণ্ডার, তার থেকে মধুময় বাক্য নিঃসৃত করো ; আমি তোমার বুক থেকে বিরহবাধার মতো নীলাভ দুকূল সরিয়ে দিই। আলিঙ্গনলুব্ধ পুলকিত স্তনদুটি স্থাপন করো আমার বুকে, শরীরে শরীর দিয়ে দূর করো সমূহ কামনার তাপ।

‘বিরহানলে দগ্ধ হয়ে আমি মৃতবৎ, অমৃতচুম্বনে আমাকে প্রাণ দাও। পিকরব শুনে আমার মন বিষাদময়, তোমার কণ্ঠের মতো মণিমেখলাদামে দূর করো আমার বিষাদ। ক্রোধ পরিহার করে মিলনে সম্মত হও রাধা।’

কৃষ্ণের অনুরোধে রোমাঞ্চিত হলেন রাধা। শুরু হল রতিক্রীড়া। রাধার বাহুতে বন্দি হলেন শ্যাম, স্তনভারে পিষ্ট হলেন, নখাঘাতে বিক্ষত হলেন, কেশভারে আকর্ষিত হলেন, চুম্বনে সম্মোহিত হলেন নবজলধর শ্যাম।

সঙ্গমের সময়ে প্রিয়তমকে পরাজিত করার অভিপ্রায়ে রাধা আরোহণ করলেন কৃষ্ণের শরীরে। তারপর যুদ্ধক্লান্ত হতে তাঁর নিতম্ব ও ভুজযুগ শিথিল হয়ে এল, কম্পিত হল বক্ষ। পুরুষের কর্ম তো নারীর সাধ্য নয়।

ঘনশ্বাসে ফুলে ওঠা রাধার কুচযুগ মর্দন করে কৃষ্ণ তাঁকে চুম্বন করলেন, রাধার চক্ষু নিমীলিত হল, শীৎকারে তাঁর বিকশিত দন্ত থেকে বিচ্ছুরিত হল দ্যুতি। কৃষ্ণের নখাঘাতে রাধার বক্ষ শোভিত, চুম্বনে মুছে গেছে অধরের রক্তিমাভা, শিথিল কেশদাম থেকে খসে পড়েছে ফুল। রাধার সলজ্জদৃষ্টি ব্যাকুল করে তুলল কৃষ্ণকে।

অবসন্না রাধা কৃষ্ণকে বললেন, ‘ কামের মঙ্গলঘটের মতো আমার কুচকলসযুগলে পত্রলেখা রচনা করো শ্যাম। তোমার চুম্বনে আমার নয়নদুটি থেকে অলিকুলের মতো কাজল মুছে গিয়েছে, তুমি তাকে আবার উজ্জ্বল করে দাও। ভ্রমরকুলের মতো আমার অলকদাম বিশৃঙ্খল হয়ে আছে, তুমি তার সংস্কার করে দাও শ্যাম। আমার ললাট থেকে শশাঙ্ককলঙ্করেখার মতো স্বেদবিন্দু মুছে কস্তুরীর তিলক দাও শ্যাম। বিস্রস্ত হয়ে গেছে আমার কেশদাম, কুসুমসাজে তাকে নতুন করে সজ্জিত করে দাও শ্যাম। কামগজগুহাসদৃশ আমার নিতম্বদেশ মণিময় মেখলাভূষণে আবৃত করে দাও ; কুচযুগে পত্রলেখা, ললাটে তিলকরেখা, জঘনে কাঞ্চীদাম, পদযুগলে নূপুর পরিয়ে দাও শ্যাম।’

             

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত