জীবনের শোক-তাপ বোঝার বয়স তখন আমাদের কারোরই হয়নি। আমারই হল। জানুয়ারির মাঝামাঝি। রাত সাড়ে দশটা। মা আমাকে খাইয়ে মশারিতে ঢুকিয়ে লেপ চাপা দিয়ে বলল – ঘুমোও। বাবা ফিরলে শোওয়ার সময় একবার হিসি করে নেবে।
তখনই সদর দরজার কড়া নড়ে উঠল। এই শব্দ বাবার নয়। বাবা আস্তে আস্তে দুবার নাড়ে। মায়ের পেছন পেছন আমিও গেলাম। স্ট্রিট ল্যাম্পের স্বল্প আলোয় কাউকেই চিনতে পারছিলাম না। সোমনাথ কাকুর গলাটা শুধু চিনতে পারলাম। তারপর ভড়জেঠু প্রদ্যুৎকাকু অসীমজেঠু সবাইকে চিনতে পারলাম। সোমনাথ কাকু বললেন – বৌদি, আপনারা তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিন।
ঠান্ডায়, উৎকন্ঠায় জড়ানো গলায় মা বলল – কেন?
সবাই চুপ।
মা যেন এবার সাহস পেয়েছে। চাদরটা মাথায় তুলে বলল – কেন বলুন? কী হয়েছে? কোথায় যাব। কেউ কোনো কথা বলছে না। হয়ত কীভাবে বলবে ভাবছে। কিছুক্ষণ পর ভড়জেঠুবললেন – একটু হাসপাতালে যেতে হবে। আমরা রিকশা নিয়ে এসেছি।
মা চাদরটা মুখে চেপে দরজাটা ধরে বলল – হে ঠাকুর! এ আমার কী হল?
আমার তখন নতুন ক্লাসের সব বই কেনা হয়নি। মাত্র পাঁচটা হয়েছে।
বাবা ব্রাউন পেপারে খুব সুন্দর করে মলাট দিয়ে বলল – শনিবার মাইনে পাব; বাকি বই কিনে দেব।
কারখানায় কাজ। তাই বাবাদের সপ্তাহে সপ্তাহে মাইনে হয়। আমি নতুন বইয়ের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে বললাম – বাবা, সামনের মাসের এক তারিখ থেকে ড্রেস পরে যেতে হবে। না হলে ক্লাসে ঢুকতে দেবে না।
বাবা বলল – ঠিক আছে। পরের সপ্তায় ড্রেস হয়ে যাবে।
আমরা যখন সার্জিক্যাল ওয়ার্ডে গিয়ে দাঁড়ালাম তখন বাবার পাশে অরুণজেঠু আর কার্তিকজেঠু দাঁড়িয়ে। বাবার শরীরটা সাদা চাদরে মোড়া।
(৫)
আমাদের সঙ্গে পাড়ার জ্যোৎস্না কাকিমা এসেছিলেন। মহিলা সমিতি করেন। দারুণ সাহসী। আমার মনে হল কাকিমা বাবার মাথায় হাত দিলেই বাবা বেঁচে যাবে।
আফটারনুন ডিউটি করে বাবা ফিরছিল। সঙ্গে ওঁরাও। বাবা লরি চাপা পড়েছিল।
বিকেলে খেলতে যাচ্ছি না বলে বন্ধুরা সবাই চার দিন পর এল। ছোট্-কাপড় পরা অবস্থায় আমায় দেখে ওরা চমকে উঠল।
মৃত্যু কী! অকাল মৃত্যু কেমন! শৈশবে পিতৃহীন হওয়া কী! এসব বোধই আমার তৈরি হয়নি। বললাম – জানিস আমার বাবা মারা গেছে।
অমিতা, ডলি আমার দু হাত ধরে কেঁদে উঠল। মৃত্যুকান্না কী তা ওদের কান্নায় স্পষ্ট বুঝতে পারলাম। ঐ শীতের ভোরে গঙ্গার হাওয়ায় কাঁপতে কাঁপতে বাবার শেষকৃত্য করেছি। তখনো বুঝিনি পিতৃহীনতা কী।
আমার দু চোখ বেয়ে জল এল। কাঁদতে কাঁদতেই বললাম – আমার পাঁচটা মাত্র বই কেনা হয়েছে। বাকিগুলো বাবা রবিবার কিনে দেবে বলেছিল। আর ড্রেসটা সামনের হপ্তায়।
সঞ্জনা আমাকে মেঝেতে বসিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বেশ গিন্নির মতো বলল – কাঁদিস না পিকুন কাঁদিস না।
বুঝলাম আমরা বড় হচ্ছি।
ওরা চলে গেল।
ঠাম্মা আমাকে খই মুড়কি খেতে দিল। মা শুয়েছিল।
মা খুব ভেঙে পড়েছে। মায়ের ঘরে অনেক লোকজন। ছোটমামা-মাইমা, মাসি, পাড়ার লোক। ঠাম্মা খুব শক্ত। বাবাকে যখন বাড়িতে আনা হয়েছিল তখনই বাবার বুকে পড়ে কেঁদেছিল। আর কোনোদিন একটুও চোখের জল দেখা যায়নি। ষাট-বাষট্টি বছর বয়স। সব দায়িত্ব যেন মাথায় তুলে নিয়েছে। একটু পরেই ডাক্তারজেঠু আসলেন মাকে দেখতে। ঠাম্মা আর একটা চেয়ার ঢুকিয়ে দিল মায়ের ঘরে।
(৬)
বারান্দায় আমার পড়ার কাঠের চেয়ারে বসে খই মুড়কি খাচ্ছিলাম। মায়ের ঘরে যেতে যেতে আমার কুশনটা হাতে করে নিয়ে এসে ঠাম্মা বলল, – এটা কোমরে ঝুলিয়ে রাখ। এখানে ওখানে পড়ে থাকছে। আমার কোমরে গুঁজে দিয়ে বলল – একটা সন্দেশ দিচ্ছি। খা। আবার সন্দেশ আনতে ছুটল।
দাদুকে আমি দেখিনি। আমার জন্মের বছর চারেক আগে মারা গেছেন। বারান্দার লম্বা দেওয়ালে দাদুর সাদা কালো একটা পেল্লাই সাইজের ছবি ঝোলে। দাদু উকিল ছিলেন। দারুণ পসার ছিল। সেই টাকাতেই আমাদের বাড়ি, এতখানি জমি বাড়ির সামনে। দাদুর নাকি খুব ফুল গাছের শখ ছিল। আমি বাবাকে দেখেছি শীতকালে হরেকরকম ফুলের গাছ লাগাতে। অন্য সময়েও ফুল ফুটত-বেল যুঁই রজনীগন্ধা গন্ধরাজ-নানান ফুল।
সন্দেশ খেতে মোটেই ভাল লাগে না। একটুখানি খেয়ে বাকিটা জানলা দিয়ে ফেলে দিয়ে ভাবছিলাম আমার বাকি বই ড্রেসের কী হবে। স্কুলে কি আর যাওয়া হবে!
সব হল আমার। ঠাম্মা টাকা দিয়েছিল। ছোট মামার সঙ্গে গিয়ে বই, ড্রেস কেনা হল।
কিন্তু সমস্যা এল অন্য জায়গায়।
স্কুলে যেতেই দু-তিন দিন পর থেকে ছেলেরা আমার ন্যাড়া মাথায় তবলা বাজাতে শুরু করল। স্যার পেছন ফিরে বোর্ডে যখন কিছু লেখেন তখন কেউ না কেউ আমার মাথায় তবলা বাজিয়ে দেয়। স্যারকে বলতেই স্যার ওদের বকেন। অবশ্য তার কয়েকদিনের মধ্যেই ব্যাপারটা বন্ধ হয়ে গেল।
মশারির মধ্যে ঢুকতে বেরোতে বারবার মাথায় মশারি আটকে যায়। চান করার সময় মা ভাল করে মাথায় নারকেল তেল মাখিয়ে দিয়ে বলল, – দেখবি, এবার ভাল ঘন চুল গজাবে। আবার আমি খেলতে যাই। ঠাম্মা বারবার বলে দিয়েছে সন্ধের আগেই যেন ফিরি। এক বছর অপদেবতারা আমাকে ভয় দেখাবে। তাই ফিরি। তবুও মাঝে মাঝে আমার শরীর খারাপ হয়। ঠাম্মা নিয়াজিপীর মন্দিরে গিয়ে আমার নামে জলপোড়া নিয়ে আসে। খাইয়ে দেয়। বাড়ির চারপাশে সেই জল ছেটায়। আবার আমি ভাল হয়ে উঠি। স্কুলে যাই। খেলতে যাই।
(৭)
এক রবিবার সকাল দশটার সময় বাসবের বাড়ি গেলাম। ও নেই। সরস্বতীদি হাতে ঘড়ি পরতে পরতে নীচে নেমে এসে বলল, – ও মামার বাড়ি গেছে।
ফিরে আসছিলাম, সরস্বতীদি ডাকল। – শোন, যাবি আমার সঙ্গে এক জায়গায়?
বাসবরা পাঁচ ভাই বোন। ও-ই ছোট। ওর বড় সরস্বতীদি। অন্য দুই দিদির বিয়ে হয়ে গেছে। বড়দা দুর্গাপুরে থাকে। সরস্বতীদি কলেজে পড়ে। খুব সুন্দর দেখতে। লম্বা, ফর্সা কী সুন্দর চেহারা। ঠিক সরস্বতী ঠাকুরের মতো। তবে কাঁধ পর্যন্ত চুল।
জিজ্ঞেস করি, – কোথায়?
সরস্বতীদি সিঁড়ির নীচে নেমে এসে আমার ন্যাড়া মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল – ঠাকুমার কাছে যাব। যাবি?
বাসবের ঠাকমা আসলে ওর বাবার মামা। হিজরে। সবাই ভাই ঠাকমা বলে। বাসবের বাবার স্টেনলেস স্টিল বাসনের দোকান। এভাবেই চলে। এই বাড়িটাও নিতাই ঠাকমার। সবাই বলে নিতাই হিজরে। হিজরেদের নেত্রী উনি।
বললাম – যাব।
সরস্বতীদি হেসে আমার মাথাটা বুকে চেপে উঠল। মাথাটা বুকের ঠিক কাছে যাচ্ছিল
না, তবুও আমার মাথায় একটা চুমু খেয়ে বলল, – ভেরি গুড।
আমার সারা শরীরে একটা শিহরণ খেলে গেল। জীবনের পরিবর্তন আস্তে আস্তে বুঝতে শিখছি। – মা, আসছি। আমার হাত ধরে সরস্বতীদি বেরিয়ে পড়ল।
কী রকম ওর হাত! গা থেকে কী সুন্দর গন্ধ! আমি যেন হাওয়ায় ভাসছি।
একটু হাঁটতেই রিকশা পেয়ে গেলাম।
[চলবে]
আগের পর্ব ও লেখকের অন্য লেখা পড়তে ক্লিক করুন।
কথাসাহিত্যিক
স্কুলজীবনথেকে সাহিত্যচর্চা শুরু করে শূণ্য দশকের গোড়ায় পাকাপাকিভাবে সাহিত্যে চলে আসা। ইংরাজি সাহিত্যের ছাত্র। একটি দৈনিকে বেশ কিছু বছর সম্পাদকীয় বিভাগে থাকার পর এখন প্রকাশনা সংস্থায়। আনন্দবাজার, এইসময়, বর্তমান, প্রতিদিন, তথ্যকেন্দ্র, একদিন, উত্তরবঙ্গ সংবাদ, দৈনিক স্টেটসম্যান, গৃহশোভা, অদ্বিতীয়া প্রভৃতি বাণিজ্যিক পত্রিকার পাশাপাশি অসংখ্য প্রথম সারির লিটিল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে লেখা। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ তিনটি – ‘তুলির শেষ টান’, ‘বর্ষাপুরুষ’, ‘সামাজিক’। লিখেছেন চারটি উপন্যাসও। গল্প থেকে তৈরি হয়েছে চারটি সিনেমা। তুলি-রং এবং বই পড়ায় অবসর যাপন। বিশ্বাস করেন, যতদিন মানুষ, ততদিন গল্প। যতদিন গল্প, ততদিন স্বপ্ন। এবং সব স্বপ্ন আগামীর নির্মাণ ও উত্তরণে।