| 27 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

পাপবিদ্ধ

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

এক

রাখহরি এমন একজন মানুষ যিনি মনে করেন না বর্তমানে এই দেশ এক সংকটের মধ্যে দিয়ে চলছে। শিল্প বানিজ্যে মন্দা, কর্ম সংস্থানের গতি হ্রাস, ধর্মীয় উন্মাদনা, সর্বোপরি এক অভূতপূর্ব অন্তঃসারশূন্যতা যে মানুষকে ক্রমশ গ্রাস করে ফেলছে- এইসব বিষয়ের থেকে বহুদুরে পিচ ঢালা কালো রাস্তার ওপর দিয়ে তিনি যান, সাইকেলের হ্যান্ডেলে দুইদিকে বাজারের ব্যাগ ঝুলিয়ে প্যাডেল করতে করতে ফিরে আসেন সেইখানে- যেখানে শহরের অন্যান্য বাড়িগুলোর তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম ঘিঞ্জি একটি বাড়িতে কম উচ্চতা বিশিষ্ট পৃথুলা একজন রমণী যিনি অনবরত মুঠো ভরে প্লাস্টিক নিয়ে যত্রতত্র ছুঁড়ে ফেলেন এবং মিউনিসিপ্যালিটির জলের জন্য কোনও পয়সা দিতে হয়না বলে চব্বিশ ঘণ্টা কলের মুখ খোলা রাখেন- তার অপেক্ষায় ঘনঘন ঘড়ির দিকে তাকান। এই রমনী তার স্ত্রী। মঙ্গলা। তবে তার আপাত নিরুদ্বিগ্ন জীবনে চিন্তার একটি কারণ অবশ্যই আছে। বয়স। গত আষাঢ়ে তার পঁচাত্তর পেরিয়েছে। না, তার চিন্তা নিজের জন্য নয়। চিন্তা মায়ের জন্য, যিনি, সঠিক ভাবে বলা সম্ভব না হলেও, অন্তত পঁচানব্বই উত্তীর্ণা। শরীরে বার্ধক্যজনিত রোগ-বালাই লেগেই থাকে। যদিও নিজের প্রাত্যাহিক কাজ প্রায় সবটাই নিজে করেন মা, তবু কখনও কাপড় নোংরা হয়ে যায়, বিছানা ভিজে যায়। বয়স যত বাড়ছে এরকম দুটো ঘটনার মধ্যে সময়ের ব্যবধান তত কমছে। রাখহরিই সব পরিস্কার করেন। মঙ্গলাকে তার ভরসা হয় না। হবেই বা কি করে! সারা জীবন তো তিনি মা আর বউ-এর মধ্যে ছোটখাটো বিষয় নিয়ে খটমট লেগে থাকতেই দেখলেন। দোষ যে সব ক্ষেত্রে তার বউয়েরই সেরকমটা নয় ঠিকই, তবে হাজার হলেও বউ-কে তার কখনই একজন ভাল মনের মানুষ মনে হয়না। বরং উল্টোটাই, প্রমাণিত ভাবে তিনি একজন কুচুটে, স্বার্থপর এবং অলস গোছের মানুষ। সেজন্যই রাখহরির চিন্তা হয়।

বিশেষ করে সেবার যখন বাজারের ব্যাগ নিয়ে এসে বারান্দার কোনায় নামিয়ে সবে বলেছেন,”কই গো, ব্যাগ দুটো উল্টে জিনিসগুলো তুলে রেখো।’- বুকে একটা তীব্র ব্যাথা অনুভব করলেন। সেই ব্যথা যা সেরে যাবার আগে তাকে অত্যন্ত আশঙ্কিত করে গেল কারণ তিনি জানতে পারলেন এটা একটা মৃদু হার্ট অ্যাটাক। না, মৃত্যুভয় তিনি ঠিক পান না। ছেলে মেয়েরা বড় হয়েছে, নিজেদেরটা বুঝে নিতে শিখেছে, এখন মরতে তার ভয় কি! শুধু একটাই বাধা- কুঁচকনো চামড়ার ওপর কালো ফ্রেমের মধ্যে মোটা কাঁচ বসানো মায়ের মুখ। তিনি চলে গেলে মা-কে দেখবে কে! মঙ্গলা ঠিকমতো দেখবে না তিনি ভালোই জানেন। কথায় কথায় খিটমিট করবে, দূরছাই করবে। সময়ে সময়ে খেতেও  দেবে কিনা কে জানে! ছেলে মেয়েগুলোও পেয়েছে মায়ের ধারা। ছেলে তো বহুদিন হল বিয়ে থা করে ভিন্ন হয়েছে, তবে দূরে তো আর কোথাও নয়, বাড়ির পাশেই রাখহরি নিজেই জমি দিয়েছেন- চাইলে একটু ঠাকুমাকে দেখতেই পারত। মেয়ের কথা আলাদা, এখন বিয়ে হয়ে গেছে। তবে ন মাসে ছ মাসে কখনও, এমনকি পূজার সময়েও, হাত দিয়ে ঠাকুমার জন্যে কিছু একটা বেরিয়েছে বলে তো মনে পড়ে না। বরং এ বাড়িতে এলে নিজের মায়ের সঙ্গে এক কোনায় বসে ঠাকুমাকে নিয়ে গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর করে, ওর মা গাল পাড়ে আর ও শুনে শুনে মাথা নাড়ে। রাখহরি বোঝেন সবই। দুশ্চিন্তায় কপালে ঘাম দেখা দেয়। তার নিজের কিছু একটা হয়ে গেলে মায়ের কষ্ট আর চোখে দেখা যাবে না। কিন্তু মানুষের নিঃশ্বাসের ওপর আর কার কেরামতি চলে! এখন সন্তান হয়ে তিনি কি করে মায়ের মৃত্যু কামনা করেন?

দুই

হেমন্তকাল। বাতাসে হালকা ঠাণ্ডার ভাব চলে এসেছে। সকালে মা উঠান ঝাঁট দেওয়া পাতায় আগুন দিয়ে হাত পা সেঁকে নেন। বুড়ো হাড়ে ঠাণ্ডা বেশী লাগে। রাখহরি দুই কাপ চা করে নিয়ে বারান্দায় বসেন। সকালের কাঁচা সোনালী রোদে নিজেদের সেঁকে নিতে নিতে মা ব্যাটা চা খায়। কথা বিশেষ হয় না। মধ্যে মধ্যে মা বলে,”কালকে রাতে বেগুন ভাজা দিল না তো আমাকে। মঙ্গলা দেয় নি।”
রাখহরি বলে, “বেগুনভাজা কোথায় পাবে? বেগুনই ছিল না বাড়িতে, তার ভাজা! তুমি যে কি দেখতে কি দেখ মা!”
চা পর্ব সমাধা হলে রাখহরি এক বালতি জল রেখে আসেন মায়ের বাথরুমে। দিন শুরু হয় এইভাবে। এককালে গ্রামীণ হাসপাতালে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মী ছিলেন। এখন অবসরকালীন ভাতা আর পৈত্রিক জমিজমা থেকে প্রাপ্ত আয় দিয়ে চলে যায় বেশ স্বচ্ছলভাবেই। পরিবারে সেরকম বড় কোনও অসুখ নেই বলে অভাবও নেই। সকালে হাট বাজার, একটু চায়ের দোকানে বসা, শেষ বেলার ঘুম আর সন্ধেবেলার তাস- জীবন বলতে এটুকুই, মধ্যে মধ্যে কেবল সঙ্গের কালো কাঁধ ব্যাগে চিড়া মুড়ি বেঁধে নিয়ে জমিতে যাওয়া তদারকি করতে, কখনও ফিরতে সন্ধে গড়িয়ে যায়। তবে ইদানীং খানিকটা ঝিমিয়ে থাকেন রাখহরি। তাসের আড্ডায় আর নে শাল্লা বলে ছুঁড়ে মারেন না টেক্কা। হা হা শব্দে সহযোগীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেন না হাসির ছোঁয়াচে রোগ। সেজন্য তার শরীর খানিক দায়ী বটে, তবে তার চেয়ে অনেক বেশী দায়ী মনের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা রিনরিনে দুশ্চিন্তার স্রোত। যদি সত্যিই তার ভাল মন্দ কিছু একটা হয়েই যায়, তবে মায়ের কি হবে! বিড়ি খেয়েও যেন সুখ পান না রাখহরি। মা আর মঙ্গলার মধ্যে অশান্তি বাধলে পেয়ারা গাছের নীচে বসে মা সুর করে কাঁদে,”এত লোকের মরণ হয়, আমার হয়না কেন!”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেকথা তো আমিও বলি…” কড়াইতে খুন্তির সুঁই সুঁই শব্দ ছাপিয়ে মঙ্গলার গলা কানে এলে অসহায় বোধ করেন রাখহরি।
সেদিন তাসের আড্ডায় বিশ্বাসবাবু বললেন,”রাখহরিদার মায়ের থেকে কিন্তু সেঞ্চুরি চাই।”
হ্যাঁ হ্যাঁ, সেঞ্চুরি সেঞ্চুরি…সমবেত ধ্বনি সহমত বোঝায়। ও পাড়ার চক্রবর্তী দেশ বিদেশের খবর রাখে বোঝা যায়, বললেন,”ভারতে গড় আয়ু এখন প্রায় সত্তর ছুইছুই। তবে রাখহরিদার মা কিন্তু আমেরিকা জাপানকেও হার মানিয়েছে।”
পড়ে রইল রাজা, পড়ে রইল জোকার, রাখহরি মন বসাতে পারে না। গড় ব্যাপারটা তিনি বোঝেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতিতে মানুষ এখন বাঁচছে বেশিদিন। শরীরের চিকিৎসা না হয় হল, তবে মানুষের মনের চিকিৎসা কে করবে! বেশী বেঁচে যদি মুখঝামটাই জোটে তবে ওই বাঁচায় কি লাভ! বাড়ি ফিরে ডাল আলুসেদ্ধ দিয়ে অল্প ভাত খান রাখহরি। মায়ের রাতের খাওয়া হয়ে যায় খানিক আগেই। তারপর সারারাতে কখনও কখনও মুখ চলতে থাকে। বয়স হলে বোধহয় এরকম হয়- এই ভেবে মায়ের ঘরে নাড়ুর কৌটো, বিস্কুটের কৌটো, মুড়কি ইত্যাদি রেখে আসা রাখহরির বহুদিনের অভ্যেস। তবে এসবের ফলে দুশ্চিন্তাও একটু বাড়ে। কেননা ইদানীং, রাখহরি দেখেছেন, খেতে নিলেই মায়ের বিষম লাগে, প্রায় দমবন্ধ হয়ে যাওয়ার যোগার। দুপুর আর রাতের খাওয়ার সময় তাই তিনি বাড়িতেই থাকেন। সেরকম হলে মাথায় থাবা দিয়ে, বুকে পিঠে হাত ডলে দিয়ে আবার সব স্বাভাবিক করেন। সেদিন রাত্রে শুয়ে ছিলেন রাখহরি। শরীরটাও ভাল যাচ্ছিল না, যেন হাত পা মাথা সব ঝিমঝিম করছে, দেহে বল নেই। রাত তখন কত হবে? ঘড়ি দেখেন নি, তবে দেড়টা পৌনে দুটো হবে বোধহয়। মায়ের ঘর থেকে খুক খুক কাশির আওয়াজ। প্রথমটায় মনে হয়েছিল কাশি, পরক্ষনেই বুঝলেন কাশি নয়,শব্দটা ক্রমেই অন্যরকম হচ্ছে। বিষম লেগেছে মায়ের। ভয়ংকর বিষম। রাখহরি বিছানা ছেড়ে উঠতে নেবেন, কিন্তু পারছেন না। কোত্থেকে এক আলিস্যি এসে যেন তাকে সর্বাঙ্গে জাপটে ধরেছে। মঙ্গলাকে বললেন,”একটু দেখ তো উঠে গিয়ে, মায়ের মনে হয় গলায় খাবার আটকেছে।” আশ্চর্য! কেন যে বললেন! তিনি তো জানেনই মঙ্গলার উত্তর,”তোমার মায়ের ওরকম হতেই থাকে, নতুন দেখছ নাকি আজকে?” বরং একটা অন্যরকম ভাবনা মাথায় উদয় হচ্ছে। এমন একটা ভাবনা যা মুখে বলা যায় না। কিছুতেই না। রাখহরি ঝেড়ে ফেলতে চেষ্টা করছেন। পারছেন না। খুব চেষ্টা করছেন। উফফ, কিছুতেই পারছেন না। আশ্চর্য! তিনি ভাবছেন ঘুমিয়ে পড়েছেন। কিন্তু না, ঘুমিয়ে তো তিনি পড়েন নি। বরং ঘুমানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু ঘুম তো আসছে না। মায়ের ঘর থেকে যে শব্দটা আসছিল, ধীরে ধীরে থেমে গেল। মা কি তবে ঘুমিয়ে পড়ল! চোখ বন্ধ করে কাঠ হয়ে শুয়ে রইলেন রাখহরি।

তিন

এসব কিছুই অবশ্য সেভাবে আর মনে ছিল না রাখহরির। ডাক্তার বদ্যি দেখিয়ে কয়েকমাস হল শরীরটা আগের থেকে একটু ভাল হয়েছে। এখন আবার পুরনো অভ্যেসেই ফিরে এসেছেন তিনি। তাসের আড্ডায় হা হা হাসির ঝড় তোলেন। এই নে শাল্লা বলে জোকারের ওপর ছুঁড়ে মারেন টেক্কা। জমিজমাগুলো ইদানীং একটু সমস্যা দিচ্ছে বটে। চাষ ভাল হচ্ছে না। আধিদার ঠিকমত পয়সা দিচ্ছে না। এইসব সমস্যাগুলি নিয়ে আজ সকালেই তিনি গেছিলেন জমিতে। এদিকে আজ আবার মেয়ে জামাইয়ের আসার কথা ছিল আগে থেকেই। তাই সকাল সকাল দেড় কিলো কচি পাঁঠার মাংস কিনে মঙ্গলাকে দিয়ে তিনি গেছিলেন। ফিরতেও বেশ রাতই হল। প্রায় সোয়া ন’টা। বেশ জমিয়ে খিদে পেয়েছে। কিন্তু এখন আর জলখাবার কি খাবেন, এত রাতে! কলপাড়ে মুখ হাত ধুতে ধুতে হাঁক পাড়লেন মঙ্গলাকে,”একবারে ভাত দিয়ে দাও বুঝলে।” আহ, পাঁঠার মাংস তার বরাবরের প্রিয়। এখন একথালা ভাত আর পাঁঠার ঝোল- কেবল ভাবলেই খিদেটা যেন আরও চাগার দিয়ে উঠছে রাখহরির। লুঙ্গির ওপর হাফশার্ট পরে এই তিনি বসলেন বারান্দায় পেতে রাখা আসনে। মঙ্গলা রেখে গেল সামনে কাঁসার থালায় একথালা ভাত, পাশ দিয়ে দুটো বেগুন ভাজা, অল্প ঘাঁটি সবজী, ছোট বাটির এক বাটি ডাল আর ওই যে বাটি উপচানো পাঁঠার মাংস। মাংস ভাত থাকলে আর অন্য কিছু খেতে বিশেষ ইচ্ছে করে না রাখহরির। অল্প ভাত ভেঙ্গে তিনি একটু ডাল ঢাললেন। তারপর একটা মাংসের টুকরো নেবেন বলে হাত বাড়ালেন বাটির দিকে। মাংসের টুকরো ছুয়েই একেবারে চমকে উঠলেন। কি ঠাণ্ডা! মঙ্গলা ফ্রিজ থেকে বের করে সরাসরি দিয়ে দিয়েছে, এই মঙ্গলার এক দোষ। আবারও মাংসের টুকরোয় আঙুল ছোঁয়ালেন রাখহরি। এই ঠাণ্ডা তার খুব চেনা। এই শীতলতা তিনি আগেও পেয়েছেন। দুম করে মনে পড়ে গেল সেদিনের কথা। শুকনো পাতায় মচমচ শব্দ তুলে ভোরবেলা রাখহরি গিয়েছিলেন মায়ের কাছে।
“মা, কি ব্যাপার? এখনও উঠো নি, মা”
কোনও উত্তর নেই।
“শরীর খারাপ নাকি?”, চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা মায়ের ঘাড়ে একটা ঠেলা মারবেন বলে ছুঁতেই একেবারে যেন ছিটকে সরে এলেন রাখহরি। শীতল একটা গা! মা আর নেই। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে বসে থেকে মায়ের গায়ের মত ঠাণ্ডা পাঁঠার মাংস দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে শুরু করলেন রাখহরি।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত