মেট্রোলাইনের ছায়াপথ

Reading Time: 5 minutes

।। বীথি চট্টোপাধ্যায়।।

 

ট্যাক্সিটা কিছুতেই সেদিন যেতে রাজি হলনা। এদিকে তখন রাত আটটা বেজে গিয়েছে। উনিশ শো সাতাশি- অষ্টাশি সালে রাতের শহরে ট্যাক্সি পাওয়া ছিল গুরুতর এক সমস্যা। হেমন্তের হিম পড়া রাত। আমি ছিলাম পার্কস্ট্রীটের কাছে আর যাব বরানগরে নিজের তৎকালীন আস্তানায়। একটু এগিয়ে যদি মেট্রো করে চলে যেতে পারি তাহলে দমদমে নামতে পারব। সেখান থেকে রিক্সা নিয়ে বাড়িতে চলে যাওয়া যাবে।
সিঁড়ি দিয়ে তাড়াতাড়ি নামছিলাম। কারণ শেষ মেট্রো ছেড়ে যাবে রাত নটায়। ঘড়িতে তখন আটটা চল্লিশ মতো বাজে। তখনও এমন সময় ছিল যে মেট্রোর টিকিট নিয়ে আমি বুঝতে পারতাম না যে আমি যে ট্রেনের টিকিট কেটেছি সেই ট্রেনটা কোনদিক থেকে কোন প্লাটফর্মে আসবে। লজ্জা করে এসব কথা লুকিয়ে কোনও লাভ নেই যে আমি সত্যি তখনও মেট্রোয় একেবারেই অভ্যস্ত হয়ে উঠিনি। টিকিট কেটে কাউন্টারের ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম,কোনদিকের প্লাটফর্মে ট্রেন আসবে? হেভি পাওয়ারের চশমার ফাঁক দিয়ে এক পলক বিরস মুখে তিনি তাকালেন। বাম দিকে, আগে এগিয়ে যান, এগিয়ে যান। যেন খুব বিরক্ত উনি, দাঁত মুখ খিঁচিয়ে রইলেন। আমি টিকিট হাতে নিয়ে স্টেশন চত্বরে প্লাটফর্মের দিকে এগিয়ে গেলাম। পিছনে পড়ে রইল টিকিট কাউন্টার।
প্লাটফর্ম প্রায় জনশূন্য। একা দাঁড়িয়ে আছি। দূরে ট্রেনের লাইন চলে গিয়েছে সুড়ঙ্গপথ ধরে। মাটির তলায় একা থাকলে আমাদের মনে একটা শূন্যতা তৈরি হতে পারে। সেই সাতাশি সাল নাগাদ কলকাতা মেট্রো তখন আমাদের কাছে নতুন একটা ব্যাপার। এখন যেমন মেট্রো আমাদের কাছে খুব স্বাভাবিক তখন তা ছিলনা। আমরা মেট্রো স্টেশনে নামলে তখন চারদিকে চোখ মেলে জায়গাটাকে দেখতাম। জায়গাটা কীভাবে সাজানো, নতুন কী কী সেখানে রয়েছে ; এইসব কিছুর দিকে আপনিই চোখ চলে যেত অনেকের। যেমন তখন সেই বছর তিরিশ আগে মেট্রো স্টেশনের এসকালেটর আমাদের কাছে ছিল নতুন একটা ব্যাপার। চলন্ত সিঁড়ি দেখে তখন আমরা বেশ উত্তেজিত হতাম মনে মনে। চলন্ত সিঁড়ি দেখে কেউ অবাক হতে পারে একথা শুনলে এখনকার ছেলেমেয়েরা হাসবে নিশ্চয়। যাইহোক প্রায় নটা বাজতে চলল। চারদিক ফাঁকা। হু হু করে স্টেশনের এয়ার কন্ডিশন থেকে ঠান্ডা হাওয়া ছুটে আসছে। আমি শাড়ির আঁচলে কান মাথা ঢাকলাম ; বেশ ঠান্ডা লাগছিল। চারপাশটাকে ভারি নিস্তব্ধ লাগল। কেন যেন মনে হল, এই চার পাঁচটা মিনিট আর কাটতে চাইছেনা। সামনে বিরাট ঘড়ি তবু বারেবারে নিজের হাত ঘড়ি দেখছিলাম।
এইসময় একটি রোগা মত ছেলে আমার পাশ দিয়ে হেঁটে গেল। এই স্টেশন চত্বরে এতক্ষন আমি ছাড়া আর কোনও জীবন্ত প্রাণী চোখে পড়েনি। ছেলেটি আমার পিছনে প্লাটফর্মের বেঞ্চিতে গিয়ে বসল। একটু মাথা নিচু করে সে বসে রইল। ঘড়িতে ঠিক নটা বাজে। ট্রেন এলোনা তো? আমি ছটফট করে উঠলাম। মেট্রোরেল তো আসতে এক মিনিটও দেরি করেনা? কী হল আজকে? আমি ঠিক দিকে এসেছি তো? কাকে জিজ্ঞেস করি? ধারেকাছে কোনও রেল পুলিশকে দেখিনি। বেশ উতলা হয়ে উঠলাম। পিছনে বেঞ্চিতে যে ছেলেটি রয়েছে, সে তো দেখছি খুব শান্তভাবেই বসে আছে যেন তার কোনও তাড়া নেই। একটু ইতঃস্তত করে আমি ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম ‘ আচ্ছা দমদমে যাবে যে গাড়িটা সেটা তো এলোনা? আপনি কি কিছু জানেন? আপনি কোন দিকে যাচ্ছেন? ‘
ছেলেটি মুখ তুলল। ফ্যাকাসে ফর্সা মুখ। ছেলেটি কি একটু অসুস্থ ? সে বলল ‘আজ আর গাড়ি আসবে না।’
আমি আরও চঞ্চল হয়ে উঠলাম। ‘ সেকি? কেন? নটার ট্রেনটা আসবেনা? ‘ সে মাথা নাড়ল। ‘লাইন জ্যাম হয়ে গেছে। একটা সুইসাইড আছে দুটো স্টেশন আগে।’ আমি আকাশ থেকে পড়লাম যেন। ‘ ‘মানে? কী বলছেন? সুইসাইড আছে মানে?’ ছেলেটি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল ‘বাংলা বোঝেননা আপনি? একজন সুইসাইড করেছে লাইনে, রেলের সামনে ঝাঁপ দিয়ে, বডি দলা পাকিয়ে রেলের নিচে ঢুকে গেছে। বডি না বের করলে গাড়ি এগোবে কী করে? ‘ ফ্যাকাসে হাসল ছেলেটি।
আমি ভাবছিলাম কী করব এবার! আমাকে তো তাহলে স্টেশন থেকে ফিরে যেতে হবে। উপরে উঠে ট্যাক্সি খুঁজে ধরতে হবে। অথবা বাসে করেও যেতে পারি। আমি একটু আফশোস করলাম। ইস্ ট্যাক্সিটা যখন যেতে রাজি হলনা তখনই কেন যে প্রথমেই বাসে উঠে পড়িনি… এতক্ষণ তাহলে অর্ধেক রাস্তা পৌঁছে যেতাম। একটু আরামে যাব ভেবে কেন যে মেট্রো ধরতে এলাম। এখন নটা বেজে পাঁচ কখন বাস পাব কে জানে?
আচ্ছা এই ছেলেটা ঠিক কথা বলছে তো? সত্যি এই লাইনে মেট্রো আজ আর আসবেনা? কেউ লাইনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে বলে? তাহলে ও এখানে বসে আছে কেন? পথঘাটে এমন অনেক লোক হামেশাই দেখা যায়, যারা অনেকসময় না জেনে ভুল রাস্তা বলে দেয় বা বিনা কারণে ভুল কথা বলে। তাতে মানুষ খুবই ভোগান্তিতে পড়ে মাঝেমাঝে। আমি মনেমনে দোনামোনা করছিলাম। হয়তো কোনও কারণে আজ ট্রেন আসতে দু-দশ মিনিট দেরি করছে। ঘড়িতে নটা পাঁচ। আর পাঁচ মিনিট কি দেখব? যদি ট্রেন তারমধ্যে এল ভাল নয়তো উপরে উঠে বাসে করে ফিরব? ছেলেটি হঠাৎ বলল
‘ ট্রেন আসবেনা। ট্রেনের তলায় বডি ঢুকে রয়েছে।’ আমার ভুরু আপনিই কুঁচকে গেল সেই কথা শুনে। স্পষ্ট স্বরে জিজ্ঞেস করলাম ‘আপনি কী করে জানলেন? আপনার হাতেই তো দেখছি রেলের টিকিট। যদি এই লাইনে ট্রেন নাই আসে তাহলে টিকিট কেটে আপনি এখানে বসে আছেন কেন? আপনাকে কে বলল যে ট্রেন আসবেনা?’ ছেলেটি মাথা নিচু করল, ‘বেশ, দাঁড়িয়ে থাকুন আপনি। সারারাত স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকুন। মনেহচ্ছে আপনাকেও এই লাইন টানছে। আপনার মন চাইছেনা এখান ছেড়ে যেতে।’ আমি চমকে উঠেছি। পাগল না মাতাল ছেলেটা। কীসব উল্টোপাল্টা বকছে। আমাকে লাইন টানছে মানে? দিশেহারা লাগল। ছেলেটি তার কথা থামায়নি। সে বলে যাচ্ছিল। ”মানুষের যে কত দুঃখ। মিল লক আউট। মালিকের সঙ্গে ইউনিয়নের তলায় তলায় কত ভাব। ইউনিয়নের লিডাররা মিলের গেটে তালা মেরে দেবে। মালিকের কাছে টাকা খাবে যাতে অনেক লেবার ছড়িয়ে ছিটকে গিয়ে কাজ ছেড়ে দেয়। বাড়িতে ভাঙা ছাদ, রোগা রোগা ভাইবোন, কতদিন বাড়িতে ভাত হয়নি। শুধু শুকনো রুটি। সবকটা আশা করে আছে কখন খোকা দুটো বেশি পয়সা আনবে। সেদিন ভাত হবে। রোজই জিজ্ঞেস করবে, ‘হ্যাঁরে চাকরির কিছু হল। কাল যেখানে গেলি তারা কিছু বলল?’ বাবা রোজ কাজ খুঁজতে বেরোবে। ভাইটা টিউশন নিচ্ছিল, কাল ছাড়িয়ে দিলাম। বাবা আজও সকালে বেরিয়েছে। একটা বুড়ো মানুষ দোকানে দোকনে ঘুরে কাজ খুঁজেছে আর লোকে দূরদূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে। রাস্তার ধারে বসে বুড়োটা ধুতির খুঁটে চোখ মুছেছে। এই শহরে কেউ সেটা দ্যাখেনি। কিন্ত বলুন তো দিদি খোকনইবা টাকা আনবে কোথা থেকে? মিল বন্ধ। কে দেবে বলুন তো নতুন চাকরি?” আমার পা মাটির সঙ্গে আটকে গিয়েছিল। ছেলেটির দৃষ্টিতে কোনও বজ্জাতি ছিলনা। তার কথার কোথাও ছিলনা কোনও কৃত্রিমতা। আমি বেঞ্চিতে তার পাশে বসলাম ‘মিল বন্ধ? কোথায় তোমার মিল? বাড়ি কোথায়? কেন বসে রয়েছ এখানে?’ ছেলেটি হাতের টিকিটটা প্লাটফর্মের মেঝেতে ফেলে দিল, ‘কোথায় যাব বলুন? ট্রেন তো আজ আর আসবেনা। সামনের স্টেশনে বডি ঢুকে রয়েছে ট্রেনের তলায়। খুব কষ্ট।’ আমি সোজা তাকলাম ছেলেটার সাদা মুখের দিকে। তারপর আর কিছু মনে নেই।
চোখ মেলে দেখলাম আমার স্বজন পরিজন আমার সামনে। আমি বিছানায় শুয়ে। ধড়ফড় করে উঠে বসতে যাচ্ছিলাম। প্রায় সকলে মিলে আমাকে উঠতে নিষেধ করল। শুনলাম যে আমি নাকি মেট্রো স্টেশনের প্লাটফর্মের মেঝেতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিলাম। কয়েকজন যাত্রী আমাকে উদ্ধার করেন। ব্যাগ থেকে পরিচয় খুঁজে পেয়ে বাড়িতে খবর দেয় পুলিশ। আমার বাড়ির লোকজনকে আমি শুধু জিজ্ঞেস করেছিলাম। দমদমের ট্রেনটা কি সেদিন ছেড়েছিল ঠিক সময়ে? কেউ-ই ঠিক জানেনা ট্রেন এসেছিল কিনা। কারুর মনে নেই। আমি বারবার জিজ্ঞেস করছিলাম, ‘ যে ট্রেনে আমার দমদম আসবার কথা ছিল সেই ট্রেনটা কি কোনও কারণে আসেনি সেদিন? ‘ বাড়ির লোক ঠিক যেন বোঝেনি আমার প্রশ্ন। ট্রেন এলো কি না এলো সে কী আর কেউ অত মনে রাখে। যারা আমাকে উদ্ধার করে বাড়িতে খবর দিয়েছিলেন তাঁরা কেউ ওদের বলেনওনি যে ট্রেন সেদিন দেরি করছিল কিনা।
ডাক্তারবাবু বলেছিলেন মাটির নিচে গেলে কেউ কেউ এক্সট্রিম সাফোকেশনে ভুগে জ্ঞান হারিয়ে ফেলতেই পারেন। কেউ হঠাৎ গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে পারেন। কেউ আবার নানারকম উদ্ভট হ্যালুসিনেশনেও ভোগেন মাটির তলায় গেলে। এসবকিছুই রেয়ার আন্ডারগ্রাউন্ড সিনড্রোম বলে একটা লক্ষণ। অল্প কিছু মানুষ এই সিনড্রোমে আক্রান্ত হন। তাঁরা এমন অনেক কিছু দেখেন যা তাঁদের অবচেতনে চাপা রয়েছে। সেই অবচেতন বাস্তবের রূপ ধরে হ্যালুসিনেশন হয়ে সামনে চলে আসে কখনও কখনও। ডাক্তারবাবু তাঁর কয়েকটি ওষুধ বদলে দিলেন।
হ্যালুসিনেশন? রঙচটা সাদা-কালো স্ট্রাইপ দেওয়া জামা পরা ফ্যাকাসে মুখের কোনও ছেলের সঙ্গে তারমানে আমার আদৌ দেখাই হয়নি? অসুস্থ হয়ে দু-তিনদিন কাগজ পড়িনি। না-পড়া কাগজে তন্নতন্ন করে আমি কিছু খুঁজছিলাম। কিছুক্ষণ পরে আমার বুকের কাছে একটা দীর্ঘশ্বাস উঠে এল। খবরটা বেরিয়েছে।মেট্রোয় ঝাঁপ দিয়েছিল সেদিন কেউ। তার কাজ চলে গিয়েছিল। অনটনের সংসার…. কাউকে আমি কিছু বলিনি তারপরে । সেদিনের সেই ছেলেটির মুখটা সারাজীবন আমার মনে ছবি হয়ে থেকে গিয়েছে। কয়েক বছর পরে ভিড়ে ভিড়াক্রান্ত মেট্রো স্টেশনে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ আমার মনে হয়েছে বেঞ্চিতে ওই তো ;ওই ডোরাকাটা শার্ট, ফ্যাকাসে মুখে সে বসে, ওকে? সেই খোকন না? আমাদের যেন চোখাচোখি হয়েছে, যেন খোকনের দৃষ্টি আমাকে বলেছে- তুমি ঠিকই দেখছ। হ্যাঁ আমি সেই সেদিনের খোকনই। এই শহর আমাকে একদিনেই ভুলে গিয়েছে। তুমি ভুলতে পারোনি। খোকন আমার জন্যে হাত নেড়েছে ভিড়ের ভিতর থেকে আলাদা হয়ে। আর আমি ওর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে ট্রেনে উঠে পড়েছি নীরবে।

 

.

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>