| 26 এপ্রিল 2024
Categories
গীতরঙ্গ

গণিত সংখ্যা: গণিত জগতের স্বপ্ন-কন্যা: লীলাবতী । পায়েল চট্টোপাধ্যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

”একটি পুকুরের মধ্যস্থলে একটি জলপদ্ম ফুটিয়াছে। জলপদ্মটি পানির পৃষ্ঠদেশ হইতে ১ ফুট উপরে, এমন সময়ে দমকা বাতাস আসিল, ফুলটি ৩ ফুট দূরে সরিয়া জল স্পর্শ করিল। পুকুরের গভীরতা নির্ণয় কর।”- লীলাবতী

“এই ধরনের প্রচুর অংক আমি আমার শৈশবে পাটিগণিতের বইয়ে দেখেছি। অঙ্কেরর শেষে লীলাবতী নামটি লেখা। কে এই লীলাবতী? তার সঙ্গে জটিল অংকের সম্পর্কই বা কী?

হুমায়ূন আহমেদের ‘লীলাবতী’ উপন্যাসের মুখবন্ধের শুরু এমনই। লীলাবতী। অংক বা সংখ্যার মত এমন বিষয়বস্তুর সঙ্গে লীলাবতীর যোগ কোথায়? ‘লীলাবতী’ এক স্বপ্নের নাম।গাণিতিক সমস্যার ভেতরে জীবনের কাব্যময়তা খুঁজে পাওয়ার পথের নাম লীলাবতী।

গণিত জগতের মহা-পন্ডিত ভাস্করাচার্যের নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্নাক্ষরে লিখিত। দক্ষিণ ভারতের বিজ্জবিড় নগরে বাস করতেন ভাস্করাচার্য। অঙ্ক ও জ্যোতিষ বিষয়ে অসাধারণ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন।

গণিত বিষয়ের মহা-মূল্যবান গ্রন্থ ‘সিদ্ধান্তশিরোমণি’ রচনা করেছিলেন ভাস্করাচার্য। মোট চারটি খন্ড-যুক্ত এই বই। প্রথম খন্ডটির নাম ‘লীলাবতী’। আচ্ছা, এমন কাব্যিক নাম কেন হল একটি গণিতের বইয়ের এক অধ্যায়ের? নেহাত কতগুলো গাণিতিক সংখ্যা আর শব্দ জুড়ে তৈরি নয় লীলাবতী। গাণিতিক সমস্যাকে ছন্দ, কথোপকথন আর শব্দমালা দিয়ে সাজিয়ে রচনা করা হয়েছিল ‘লীলাবতী’।

আনুমানিক ১১৫০ খ্রিস্টাব্দে রচিত হয়েছিল ‘সিদ্ধান্তশিরোমণি’ গ্রন্থ। এটি পৃথিবীর আদিমতম গাণিতিক গ্রন্থ। এর রচয়িতা পন্ডিত ভাস্করাচার্যের আনুমানিক বয়স তখন ছত্রিশ। ভারতবর্ষেই প্রথম এমন বই রচিত হয়েছিল। এই গ্রন্থের ‘লীলাবতী’ খন্ডে কাব্যময়তার সঙ্গে মিশেছিল আবেগ, অনেকখানি জীবন আর সন্তানস্নেহ।

লীলাবতীকে নিয়ে কথিত আছে অনেকগুলি মতবাদ। তবে যে মতবাদটি সবচেয়ে বেশি গ্রাহ্য হয়েছে, প্রথমে তার কথাই আলোচনা করা যাক। বেশিরভাগ ঐতিহাসিকের মতে লীলাবতী ছিলেন পন্ডিত ভাস্করাচার্যের বিদুষী কন্যা। ভাস্করাচার্য জ্যোতিষবিদ্যার মাধ্যমে গণনা করে দেখেছিলেন তাঁর প্রাণের চেয়ে প্রিয় কন্যার বৈধব্যযোগ। তবুও পিতৃহৃদয় কন্যার বিবাহ দিতে আকুল। আয়োজন করা হলো বিয়ের। লীলাবতী তখন কিশোরী। পিতা সবরকম ব্যবস্থা করে রেখেছেন দুর্ভাগ্য এড়ানোর। কিশোরী লীলাবতী তাকিয়ে থাকবে একটি জলভরা পাত্রের দিকে। কৌতুহলী চোখ। বড় পাত্রের ভিতর রাখা রয়েছে আরো একটি ছোট্ট পাত্র। পেয়ালার মতো সেই ছোট্ট পাত্রের নীচে আছে একটি সূক্ষ্ম ছিদ্র। এর মধ্যে দিয়ে জল ডুকছে ছোট পাত্রে। নিয়মমাফিক নির্দিষ্ট সময় পর সেই পাত্র ডুবে যাবে বড় জলভরা পাত্রে। সেই মুহূর্তই হবে শুভক্ষণ এবং বিবাহ-লগ্ন। প্রস্তুতি, আয়োজন এমনটাই ছিল। ব্যাকুল পিতা অপেক্ষা করছিলেন বৈধব্য যোগের বাধা এড়িয়ে সুস্থায়ী, সুন্দর, শান্তিপূর্ণ সাংসারিক জগতে প্রিয় কন্যার পদার্পণের। কিন্তু ভাগ্যের লিখন খন্ডানো বোধহয় এত সহজ নয়! হঠাৎ করে মেয়ের নাক থেকে মুক্তর ছোট্ট নোলক খুলে পড়েছিল সেই ছোট পাত্রের মধ্যে। নোলকের পড়ে যাওয়ার ফলে ছোট পাত্রে থাকা ছিদ্র বন্ধ হয়ে গেল। ফলে সেই পাত্র আর বড় জলভরা পাত্রে ডুবল না। ভাগ্যের কাছে সেদিন হার মেনে নিতে হয়েছিল কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাকে। তবে জীবনের কাছে হার মানেননি গণিতবিদ ভাস্করাচার্য। বৈধব্যযোগের ভয়ে কন্যা-সম্প্রদানের আগে লীলাবতীর বিয়ে ভেঙে যায়। তবে মেয়ের জীবনকে থামতে দেননি বাবা। পড়াশোনা শিখিয়েছিলেন আন্তরিকতার সঙ্গে। মেয়েও বাবার ভালোবাসার আশ্রয়ে খুঁজে পেয়েছিল অর্থবহ জীবন। অঙ্কের অনুরাগী হয়ে ওঠে সে। এই মেয়ের সঙ্গে কথোপকথনের ভঙ্গিমায় রচিত হয় ভাস্করাচার্যের ‘সিদ্ধান্তশিরোমণি’ গ্রন্থের ‘লীলাবতী’ অংশ। লীলাবতীকে নিয়ে ঐতিহাসিকদের সর্বজনগ্রাহ্য মতবাদ এটাই। কেবলমাত্র নীরস সংখ্যায় সাজানো অঙ্ক নয়, ‘লীলাবতী’ গ্রন্থে রয়েছে পাতা-ভরা সন্তানস্নেহ আর আলোয়-ভরা জীবনের বার্তা। ‘লীলাবতী’ গ্রন্থে ধাকা গাণিতিক সমস্যাগুলোই পরে আধুনিক ভাবে উপস্থাপিত হয়েছে পড়াশোনার ক্ষেত্রে।

লীলাবতী ও ভাস্করাচার্যকে নিয়ে এছাড়াও অনেক মতবাদ রয়েছে ইতিহাসে। তবে পিতার এমন সন্তান-স্নেহ যেকোনো সময়ই জীবনের দিশা। লগ্নভ্রষ্টা কন্যার গভীর দুঃখে ভাস্করাচার্য আক্ষেপ করেছেন। কিন্তু সেই আক্ষেপের মধ্যে হারিয়ে যেতে দেননি জীবনের ইতিবাচকতাকে। তিনি বলেছেন ” মা গো! তোমার জন্য কিছু করার সামর্থ্য আমার নেই, তবে পৃথিবীর মানুষ যেন বহুযুগ তোমাকে মনে রাখে, সেই ব্যবস্থাই আমি করছি।” নাবালিকা, অবুঝ মেয়ের মনোকষ্ট দূর করতে বাবা তাঁকে সন্ধান দিয়েছিলেন আত্ম-শুদ্ধির পথের। মহান সৌন্দর্যের পথ খুঁজে পেয়েছিলেন গাঢ় প্রজ্ঞার মাধ্যমে। তাই অনেক গবেষক বলেন ‘সিদ্ধান্তশিরোমণি’ গ্রন্থের লীলাবতী অংশটি লীলাবতীর নিজেরই রচনা। তবে অনেক ঐতিহাসিক এই মতকে অস্বীকার করেছেন। লীলাবতী গ্রন্থের যেখানে কথোপকথনের মাধ্যমে গাণিতিক সমস্যার কথা বলা হয়েছে, লীলাবতীকে সখে, প্রিয়ে এমন শব্দে সম্বোধন করা হয়েছে।

এই সম্বোধনের কারণে অনেক ঐতিহাসিক আবার লীলাবতীকে ভাস্করাচার্যের কন্যারূপে মানতে অস্বীকার করেছেন। তাঁদের মতে লীলাবতী সম্ভবত ভাস্করাচার্যের স্ত্রী। অংকের প্রতি গভীর অনুরাগছর সঙ্গে পন্ডিত ভাস্করাচার্য মিশিয়েছিলেন ভালোবাসা। তাই গাণিতিক সমস্যার সমাধান করেছেন আন্তরিকতার বাঁধনে।

‘সিদ্ধান্তশিরোমণি’ গ্রন্থটির ১৩টি অধ্যায় রয়েছে। খন্ড চারটি।পাটিগণিতের এই বইতে আলোচনা করা হয়েছে আট রকম গাণিতিক প্রক্রিয়া। ‌ যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ, বর্গ, ঘন, বর্গমূল, ঘনমূল ছাড়াও শূন্যতত্ত্ব, ঋণাত্মক সংখ্যা, করণী, বজ্রগুণন নিয়েও আলোচনা রয়েছে। ছন্দের মাধ্যমে লীলাবতীকে অঙ্ক শিখিয়েছেন ভাস্করাচার্য। প্রাঞ্জল ভাষায় ফুটে উঠেছে হৃদয়াবেগ। হাতি, রাজা, পদ্মফুল, বানর এমন সব চরিত্রের ব্যবহার করা হয়েছে। লীলাবতীকে সম্বোধন করে উপস্থাপনা করা হয়েছে অঙ্কের।

যেমন,”মৃগনয়না লীলাবতী, বল দেখি পারো যদি ১৩৫গুণন ১২ কত হয়, যদি তোমার জানা যায় গুণন প্রক্রিয়া, পৃথকঅংশে আর পৃথক অংকে?”

কোথাও আবার ছন্দে ছন্দে উপস্থাপনা করা হয়েছে অঙ্কের।

“এক ঝাঁক মৌমাছি উড়ে উড়ে যায়, এক-পঞ্চমাংশ কদম ফুলের মধু খায়, এক-তৃতীয়াংশ গেল শিলিন্দের কূলে, তাহারা মনের আনন্দে কলকল করে, এই দুই সংখ্যার অন্তরের তিনগুণ ক্রতুজা ফুলেতে ছিল, বাকি এক মৌমাছি গুনগুন করিতে লাগিল, বল দেখি লীলাবতী মোট কয়টি মৌমাছি ছিল?”

উত্তর উপস্থাপনা করা হয়েছে এভাবে, ”চপলমতি লীলাবতী মনে মনে হিসেব করে উত্তর দিলো ১৫টি”।

প্রাচীন সময়ে এমন অভিনব ভাবে অঙ্কের উপস্থাপনা সত্যিই অভূতপূর্ব। যদিও কোন ঐতিহাসিক বলেন লীলাবতী সম্পূর্ণরূপে কাল্পনিক চরিত্র। কল্পনা হোক বা সত্য, বিশুদ্ধ গণিতের সঙ্গে কাব্যময়তার এমন মেলবন্ধন, পরম মমতায় তার উপস্থাপনা, লীলাবতী গ্রন্থকে, সর্বোপরি এই চরিত্রকে অনন্যতা দিয়েছে। গণিতের সাহিত্য-রূপের নিদর্শন লীলাবতী কোথাও যেন অন্তরের সাধনার প্রতিচ্ছবি।

হুমায়ূন আহমেদের রচিত ‘লীলাবতী’ উপন্যাসও প্রভাবিত এই স্বপ্নকন্যার কাহিনীর মাধ্যমে। লীলাবতীর কথা জানতে পেরে এই প্রখ্যাত সাহিত্যিক এতটাই অভিভূত হয়েছিলেন যে তাঁর উপন্যাসের নাম রেখেছিলেন ‘লীলাবতী’। লেখকের অবচেতনে লীলাবতীর কাহিনী জায়গা করে নিয়েছিল। তিনি স্বপ্নে দেখেছিলেন ‘লীলাবতী’ নামের এক কাল্পনিক কন্যাকে। তাঁর ‘লীলাবতী’ও বাবা-মেয়ের গল্প শোনায়। নীরস গাণিতিক সমস্যার সঙ্গে এভাবে সন্তানস্নেহ, আবেগ, মমতার মিশ্রণ লীলাবতীকে সংখ্যাতত্ত্বের গণ্ডি পার করে অসাধারণত্বের পথে তার উত্তরণ ঘটিয়েছে।

 

 

 

তথ্যসূত্র:- ‘লীলাবতী’ উপন্যাস, রচয়িতা- হুমায়ূন আহমেদ

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত