শিখ-পরিবারে জন্মেছেন ১৯৩৬, মতান্তরে ১৯৩৪ সালের ১৮ আগস্ট দিনায় (ব্রিটিশ ভারতের ঝিলম জেলা, বর্তমানে যেটা পাকিস্তানে অবস্থিত)। দেশত্যাগ নামক প্রলয়ের আঘাতে তাঁর পরিবারকে স্থানান্তরিত হয়ে চলে আসতে হয় দিল্লির রওশন আরা বাগে। সেখানে ইউনাইটেড ক্রিশ্চিয়ান স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন শেষ করেন তিনি। বম্বের (মুম্বাই) খালসা কলেজ এবং ন্যাশনাল কলেজ কম্বেতে ইন্টারমিডিয়েট পড়াকালীন বিদায় জানিয়েছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়াকে। সাহিত্যের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা এবং অসীম ক্ষুধা তাঁকে ঈর্ষণীয় পাঠকে পরিণত করেছিল। একই সঙ্গে তিনি শাস্ত্রীয় সংগীত ও চিত্রকলারও অনুরাগী। সাহিত্য, সংগীত ও চিত্রকলার সঙ্গ এবং চমৎকারিত্ব কবিতা-পাগল মাতৃহীন একাকী যুবককে গড়ে তুলছিল কবি করে, শিল্পী করে। পরবর্তী সময়ে চলচিত্রের বর্ণাঢ্য জগতে তাঁর কৃতীয় অবদানের জন্যে সকলেই তাঁকে চেনেন – কখনো গীতিকার, কখনো চিত্রনাট্য রচয়িতা, কখনো চলচ্চিত্র-নির্মাতা হিসেবে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে তিনি কবি।
কবিতায় যিনি প্রতিদিন বেঁচে ওঠেন – ভাব এবং ভাবনার অনির্ণীত জগৎ যাঁর কবিতার কোমল সংঘাতে পাঠকের কাছে উন্মোচিত হতে থাকে নব-নব রূপে। তাঁর কবিতার জগৎজুড়ে আছে ইতিহাস, শিল্প-অভিজ্ঞতা, সংগীত আর অধ্যাত্মবাদ। কবিতার বুনন ও বিস্তারে পাঠকরা তাঁকে সহজ করে পায়, পায় একাত্ম করে। তাঁর কবিতায় স্মৃতি গন্ধমেদুর, স্মৃতি বিষণ্ণ আলো। আজলায় ভরে জীবনের অনিমেষ মুহূর্তগুলি তিনি তুলে দিচ্ছেন তাঁর কবিতায়।
শিশু অবস্থায় মাকে হারিয়েছিলেন কবি। বৈমাত্রেয় ভাইবোনদের সঙ্গে আদরে-অনাদরে অনেকটা একাকীত্বের ভেতর বেড়ে উঠছিলেন। তখন তাঁর বছর চোদ্দ বছর, সেই বয়সে তাঁকে পাড়ার সবাই বাবা-মার দেওয়া ‘সম্পূরণ’ নামেই জানত, কিশোর সম্পূরণ স্কুল যাওয়ার আগে আর স্কুল থেকে ফিরে বসতেন বাবার ব্যাগ ও টুপির দোকানে।
এতক্ষণ যার কথা বললাম তার নাম সম্পূরণ সিং কালরা। কি চিনতে পারলেন না তো? কিন্তু যদি বলি ছেলেটির বাবা ও দাদা ছিলো তাঁর লেখালেখির ঘোর বিরোধী কিন্তু ছেলেটির প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি কবিতা মায়াময় আপনার, আমার, সবার বড্ড প্রিয় আর পৃথিবী তাঁকে গুলজার নামে চেনে। আজ সেই গুলজারের জন্মদিন। গুলজার হয়ে ওঠার পেছনে বই চুরির এই ঘটনাটি গুলজার বারবার স্মরণ করেন।
গুলজার যখন লেখালেখি শুরু করেছেন তখন তাঁর যাতায়াত চলছে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের বম্বে শাখায়, গণতান্ত্রিক লেখক ও শিল্পী সংঘে এবং বম্বে ইয়ুথ কয়্যারে। এসব সংঘের সঙ্গে সেসময় জড়িয়ে ছিলেন সলিল চৌধুরি, দেবু সেন প্রমুখ বাঙালি। যাতায়াত করতে করতে এঁদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হল গুলজারের। দেবু সেন একদিন তাঁকে নিয়ে গেলেন বিমল রায়ের মুন স্টুডিওর অফিসে। বিমল রায় তখন ‘বন্দিনী’ ছবি করবেন।
বৈষ্ণব পদাবলীর ভাব নিয়ে একটা গান লিখতে হবে। সমস্যা হল, হিন্দিতে সেই ভাব নিয়ে গান লিখবেন কে? বাংলার বৈষ্ণব ভাব না জানলে তো লেখা যাবে না। দেবু সেন বিমল রায়ের সঙ্গে গুলজারের আলাপ করিয়ে দিয়ে জানালেন যে, গুলজার গানটা লিখে দিতে পারবেন। কথা হচ্ছিল হিন্দিতে। বিমল রায়ের সংশয় হল, পাঞ্জাবি হয়ে গুলজার কেমন করে সে গান লিখবেন? তাই দেবু সেনকে বললেন বৈষ্ণব পদাবলীর ভাব ভালো করে বুঝিয়ে দিতে। দেবু সেন হেসে জানালেন, গুলজার বাংলা ভাষাটা ভালো জানেন তো বটেই, এমনকি বাংলা সাহিত্য তিনি গুলে খেয়েছেন! এর পর তাঁদের মধ্যে যা কথাবার্তা হয়েছিল, সমস্তই হয়েছিল বাংলাতে। গুলজার লিখেছিলেন ‘বন্দিনী’ সিনেমার- ‘মোরা গোরা অঙ্গ’ গানটি।
গানটি তো লেখা হল। কিন্তু সুরকার শচীন দেব বর্মণ চাইলেন তাঁর প্রিয় গীতিকার শৈলেন্দ্র গান লিখবেন, নতুন কারও সঙ্গে তিনি কাজ করবেন না। বিমল রায় তো পড়লেন মহা মুস্কিলে। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে ‘মোরা গোরা অঙ্গ’ গানটি ছবিতে রাখার ব্যবস্থা হল। কিন্তু বাকি গানগুলো লিখলেন শৈলেন্দ্র।
বিমল রায়ের ছবিতে গান লিখতে এসে তাঁর প্রিয়পাত্র হয়ে উঠলেন গুলজার। পরের ছবি ‘কাবুলিওয়ালা’তে সহকারী পরিচালকের কাজে বিমল রায় তাঁকে নিলেন। হাতে ধরে শেখালেন সিনেমা তৈরির খুঁটিনাটি। ইনি গুলজারের জীবনে দ্বিতীয় গুরু। সিনেমার গুরু।
বিমল রায়ের সঙ্গে কাজ করতে করতে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল রাহুল দেব বর্মণের। রাহুল তখন বাবার সহকারী। গুলজার আর রাহুলের বন্ধুত্ব হতে বেশি দেরি হয়নি। দুজনেরই তখন নতুন কিছু করে দেখানোর প্রবল উত্সাহ। তবে, গুলজারের প্রথম ছবি ‘মেরে আপনে’-তে সুর দিয়েছিলেন সলিল চৌধুরি।
‘পরিচয়’ ছবি থেকে গুলজার-রাহুলের পথ চলা শুরু। সেই পথের ইতিহাস তো এখন অভাবনীয় সৃষ্টিশীলতায় কিংবদন্তী। এর মধ্যিখানে হৃষীকেশ মুখার্জির জন্য স্ক্রিপ্ট লিখেছেন, হেমন্ত মুখার্জি, শচীন দেবের সঙ্গে গান লিখেছেন। কাজেই, বাঙালি-যোগ রয়েছে তাঁর সারাজীবন জুড়েই। গুলজার বিয়েও করেছিলেন বাঙালি মেয়ে রাখীকে। ফলে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর মনে যে বাঙালিয়ানার বীজ বুনে দিয়েছিলেন, কর্মসূত্রে ও ব্যক্তিজীবনে বাঙালি-সাহচর্য তাঁর সেই বাঙালিয়ানাকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। তাই আজো,তাঁর চোখের সামনে ভাসে সেই চুরি করে রাখা ‘মালঞ্চে’র ধূসর প্রচ্ছদ আর প্রচ্ছদ পেরিয়ে উজ্জ্বল বর্ণমালায় ডুবে যাওয়া একটি নিঃসঙ্গ ছেলে।

কবি ও কথাসাহিত্যিক। জন্ম ৭ আগস্ট, উত্তরবঙ্গের কোচবিহারে। স্কুল জীবন থেকেই লেখালেখির সূত্রপাত। সম্পাদনা করেছেন বেশ কয়েকটি সাহিত্য পত্রিকা এবং ওয়েবজিন। বর্তমানে ইরাবতী ডেইলি ওয়েবজিনের সাথে যুক্ত। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ : জল ভাঙে জলের ভেতর [২০১১], ঠোঁটে দাও জ্যোৎস্নার বিষ [২০১২], ডুব সাঁতার [২০১৭], নিরুদ্দেশ গাছে সন্ন্যাসীর মুখ [২০১৭]। গল্পগ্রন্থ : কারুময় খামে অচেনা প্রেম [২০১২]। উপন্যাস: ইতি খন্ডিত জীবন [২০২২]। প্রবন্ধ সংকলন: মাটির গন্ধ [২০২২]। সম্পাদনা গ্রন্থ: দুই বাংলার সাম্প্রতিক গল্প [২০২২] ।
শখ বইপড়া, লেখালেখি, ছবিতোলা, গান শোনা ও ভ্রমণ। বেশ কিছু গানও লিখেছেন তিনি।