| 24 অক্টোবর 2024
Categories
সময়ের ডায়েরি

গুরুমশাইয়ের বিদ্যাসাগর

আনুমানিক পঠনকাল: 2 মিনিট

শৈশবে বিদ্যাসাগর খুব চঞ্চল ও দুরন্ত ছিলেন। স্কুলে যাওয়ার পথে প্রতিদিন প্রতিবেশী মথুরামোহন মণ্ডলের মা ও স্ত্রীকে উত্যক্ত করতেন। বাবা-মা যা বলতেন ঠিক তাঁর উল্টোটা করতেন তিনি, পরিস্কার জামা কাপড় পরতে বললে ময়লাটা পরতেন, কম সময় স্নান করতে বললে দীর্ঘক্ষণ জলে দাপিয়ে বেড়াতেন। কিন্তু তাঁর শিক্ষক কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায় স্নেহ আর নানা কৌশল অবলম্বন করে ঈশ্বরচন্দ্রকে বশ করেছিলেন। ‘বিদ্যাসগর জীবনচরিত ও ভ্রমনিরাশ’ গ্রন্থে তাঁর ভাই শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন লিখেছেন এ-কথা।

ঈশ্বরচন্দ্রের ‘বিদ্যাসাগর’ হয়ে ওঠার পিছনে কালীকান্তর অবদান অস্বীকার করা যাবে না। কালীকান্ত তাঁর বিদ্যাবুদ্ধি আর সরল গ্রামীণ জীবনের মধ্যে থেকে বুঝেছিলেন, আগামী দিনগুলোতে ভারতবর্ষে ইংরেজি শিক্ষার স্ফুরণ হবে। তাই বিদ্যাসাগরকে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। তৎকালীন হিন্দু কলেজের নবীন, উদার পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রতি তাঁর নজর ছিল। বিদ্যাসাগর যদিও সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন, কিন্তু নিজের উদ্যোগে তিনি ইংরেজি শিখেছিলেন।
ঈশ্বরচন্দ্র নিজে গুরুমশাইয়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে বললেন, বালক বয়সে তিনি যখন বাবার হাত ধরে প্রায় ছাব্বিশ ক্রোশ পূর্বে কলকাতার পথে পা বাড়ালেন সেদিন গুরুমশাই ছিলেন তাঁর সঙ্গী। সমস্ত পথ হেঁটেছেন প্রিয় ছাত্রের সঙ্গে। মাইলস্টোনের মধ্যে লিখে রাখা ইংরেজি শব্দগুলো কালীকান্ত তাঁকে শিখিয়েছিলেন। বাবা ঠাকুরদাসও সাহায্য করেছেন তাঁকে।

ছেলেবেলায় প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়তেন ঈশ্বরচন্দ্র। অম্ল, অজীর্ণ, পেটের অসুখ লেগেই থাকত। একবার বেশ অসুস্থ হয়ে পড়লেন তিনি। খানাকুলের কোঠরা গ্রামে কবিরাজের কাছে আনা হল। তাঁর ওষুধ খেয়ে তিনি জীবন ফিরে পেলেন। বালক ঈশ্বরচন্দ্রের অসুস্থতা গুরুমশাইকে পীড়া দিত। ছাত্রের অসুস্থতা শিক্ষককে বেশি মনোযোগী করে তুলেছিল। বিদ্যাসাগর নির্মাণে তিনি বেশি করে উজাড় করে দেন।

একবার কালীকান্ত বিদ্যাসাগরের বাবা ঠাকুরদাসকে বললেন, ‘আপনার পুত্র অদ্বিতীয় বুদ্ধিমান, শ্রুতিধর বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। পাঠশালায় যাহা শিক্ষার তার সমস্ত শিক্ষা ইহার হইয়াছে। এখান হইতে কলিকাতায় লইয়া যাওয়া অত্যন্ত আবশ্যক হইয়াছে। আপনি নিকটে রাখিয়া ইংরাজি শিক্ষা দিলে ভাল হয়। এ ছেলে সামান্য ছেলে নয়। বড় বড় ছেলেদের অপেক্ষা ইহার শিক্ষা অতি উত্তম হইয়াছে। আর হস্তাক্ষর যেরূপ হইয়াছে তাহাতে পুঁথি লিখিতে পারিবে।’

এহেন কালীকান্ত ছিলেন কুলীন ব্রাক্ষ্মণ। বিয়ে করায় তাঁর কোনো আলস্য ছিল না, একের পর এক বিয়ে, আর শ্বশুর বাড়ির আতিথ্য নেওয়া ছিল তাঁর পেশা আার নেশা। বিদ্যাসাগরের বাবা কালীকান্তের পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ ছিলেন। অনেক অনুনয় বিনয় করে তাঁকে নিয়ে এলেন বীরসিংহ গ্রামে। নতুন পাঠশালার পত্তন করলেন।

ঈশ্বরচন্দ্র কালীকান্ত মহাশয়ের কথা বলতে গিয়ে লিখেছেন, ‘আমি তাঁহাকে অতিশয় শ্রদ্ধা করিতাম। তাঁহার দেহত্যাগের কিছু পূর্বে একবার মাত্র তাঁহার উপর আমার ভক্তি বিচলিত হইয়াছিল।’

কৌলিন্য প্রথার কারণে বহুবিবাহ করেছিলেন কালীকান্ত। তাঁর প্রথম স্ত্রীকে শিশুপুত্র ও কন্যাসহ ফেলে রেখে এসেছিলেন বাপের বাড়িতে। কোনদিন খোঁজও নেননি। তাঁর মেয়ে বড় হয়ে আর এক কুলীনের স্ত্রী হয়েছিলেন। তিনিও স্বামী পরিত্যক্তা হন। একবার স্বামী পরিত্যক্তা মেয়ে প্রসন্নময়ীকে নিয়ে স্ত্রী এসেছিলেন কালীকান্তর কাছে। একটু নিরাপদ আশ্রয় চেয়েছিলেন। কিন্তু ভরণপোষণে অস্বীকার করেন কালীকান্ত, তারপর তাঁরা এসেছিলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। তাদের দুঃখে কেঁদে ফেলেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। বিদ্যাসাগর এরপর কথা বলেন গুরুমশাইয়ের সঙ্গে। তিনি স্পষ্ট জানতে চান, স্ত্রী-কন্যার ভরণ-পোষণ গুরুমশাই নেবেন কিনা। কালীকান্ত মুখের ওপর না বলে দেন। বিদ্যাসাগর তাতে খুবই অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু গুরুমশাইয়ের স্ত্রী-কন্যার জন্য প্রতিমাসে চার টাকার ব্যবস্থা করলেন। আর বীরসিংহের বাড়িতে তাঁদের আশ্রয় দিলেন। কলকাতায় আসার সময় হল বিদ্যাসাগরের। তিনমাসের অগ্রিম তিনি দিয়ে এলেন বারো টাকা। কালীকান্ত তখন বাড়িতে আসতে লাগলেন। এরপর বিদ্যাসাগর ডাকযোগে যে টাকা পাঠাতে লাগলেন তা আত্মসাৎ করতে লাগলেন নিজেই। বহুদিন পর গ্রামে ফিরে বিদ্যাসাগর শুনলেন, মেয়ে প্রসন্নময়ীকে নিয়ে গ্রাম ছেড়েছেন গুরুমশাইয়ের স্ত্রী। তারপর তিনি নিজের ‘বহু বিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার’ পুস্তিকায় লিখছেন, ‘কন্যাটি সুশ্রী ও বয়স্কা, বেশ্যাবৃত্তি অবলম্বন করিয়াছে।’ কালীকান্ত একনিমেষে প্রিয় ছাত্রের কাছে কীট পতঙ্গের মতো হয়ে গেলেন। বিদ্যাসাগরের ব্যথিত হৃদয় অপমানিত নারীর জন্য নীরবে কেঁদেছিল।

বৃদ্ধ বয়সে কালীকান্তর ইচ্ছে হয়েছিল এক বালিকাকে বিয়ে করবেন। তখন তিনি প্রায় মৃত্যপথযাত্রী। এ-কথা ছাত্রের কানে গিয়েছিল। সব শুনে বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, এই ইচ্ছা পাপ। বিদ্যাসাগর এরপর থেকে আর মাস্টারমশাইয়ের ছায়া মাড়াননি। বাড়িতে জলস্পর্শ করতেন না।

(কৃতজ্ঞতা – সুদিন চট্টোপাধ্যায় / পাতায় গাঁথা ভেলা ও বঙ্গদর্শন)

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত