| 26 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

ইরাবতীর শ্রদ্ধাঞ্জলি : সিলভানা । হাবীবুল্লাহ সিরাজী

আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিট

মটরদানার মতো এক যুগ হজম করিয়া বসিয়া আছ। পিত্তে কোনো বিপত্তি নাই।
নাই কোনো অভিযোগ শূকর-বিড়ালের দাপানিতে। যতখানি অন্তরালে ছিলে তাহাকেই শ্রেয় বলিয়া মানিয়াছিলে। আলম-আরশাদে ছিল না কোনো নিষ্পত্তি। একজনের চিত্রযাত্রা হইতে অপরজনের পুস্তকভ্রমণ নূতন মাত্রায় দারুণভাবে উপভোগ্য হইয়া উঠিয়াছিল। ইহাতে ভ্রাতা বুলবুল যোগ না দিলেও সমর্থন করিতে ত’ কসুর করেন নাই। দিবসের প্রথম ভাগে ঝুল খাইতে খাইতে কলম-কাগজ লইয়া যাহারা দপ্তরে হানা দিত, তাহাদের নিষেধ ছিল না মধ্যাহ্ন পর্যন্ত দীর্ঘ হাই তুলিবার। ফলে তোমার নাকের ছাবি ও পায়ের মলে যে বিশ্রাম মিলিত, তাহা সহজেই বোঝা যায়। কলসে করপোরেশনের কলের ঢল ছলাত করিয়া উঠিলে শূন্য জেরিক্যান আওয়াজ দিত। হেলিয়া-দুলিয়া টিপু সুলতানে পূর্ণ করিয়া লইতে রোজকার বরাদ্দ। দর্শনায় দেশ মাতিলেও আপন আস্তানার সৌরভেরও ঘাটতি ছিল না। বাংলা-চুল্লু গলাগলি ধরিয়া কখনো আনন্দে, কখনো বেদনায় মালেকা-এ-তাবান্নুম বলিয়া ডাকিয়াছে আবার জাহান্নাম ভাবিয়া উড়াইয়া দিয়াছে। অপরাহ্নের আপ্যায়ন কেশদাম স্পর্শ করিয়া গেলেও হৃদয়ে কোনো রক্ত ঝরে নাই। তুমি সিলভানা, তোমারই মতো লীলাঝর্ণা।

ইত্তেফাক ডিলিক দিয়া হরদেও টপকাইয়া বান্ধববসতি ঘিরিয়া যে আয়োজন, তুমি ত’ তাহার এক মহাজন। অনাদরে কাটা বালিকাসকাল, অবহেলায় পার হওয়া কিশোরীবেলা এখন খনিমাখনে ‘ছাইয়া দিলকে…’। আঁচল উড়াইয়া দড়ির খাটিয়া কাঁপাইয়া এই যে তোমার গ্লাসসমূহ বিতরণ, তাহাতে চমক থাকিলেও মাধুর্যের ছুটি মেলে নাই; তাহাতে গমক জুটিলেও বিনয় হোঁচট খায় নাই। তোমাতে সন্ধ্যা আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে যতক্ষণ না গুরু ফেরে কাদামাখা পায়। রজনীতে গন্ধবিলাস ফুটিলে পালা করিয়া পঙ্গপাল ছোটে। বুড়িগঙ্গা তখন দক্ষিণ হইতে হাঁফাইতে হাঁফাইতে আসিয়া গলা জড়াইয়া ধরে। তোমার অপলক দৃষ্টিতে ঝিম ধরা আলো কি মুহূর্তের জন্যও কাঁপে? না, বাণিজ্যে আবেগ শত হস্ত দূরে; আকাশেই বিচরণ করুক ভাব। মাটির পাত্রে মালঞ্চের বাহারকে স্থান দিতে হইলে বড় মূল্য চুকাইতে হয়, তা তুমি তাপে ও ছাপে পূর্বাহ্নেই বুঝিয়া গেছ। তাই নব্য নাবিকের বৈঠায় সহসাই ভাটা পড়ে, প্রভাতের অপেক্ষায় রজনীতে জাগে না কোনো হুজ্জত। তুমি সিলভানা, আশাপূর্ণা।

রোহিতের কাটা কল্লার মতো চাঁদ জাগিল। হাসি খরচ হইতে না হইতেই জুটিল সুর। তালের জন্য অপেক্ষা না করিয়া বেতাল হানা দিল প্লাবিত জ্যোত্স্নায়। মানুষ ও পশুর ভেদ না করিয়া শিশুরা যত্রতত্র নিদ্রামগ্ন হইল। ফোয়ারা ছুটিল, আমোদে আমোদ ভাসিলে কাচখণ্ডে রক্তফোঁটা ধরা পড়িল। ইহা ত’ হইতেই পারে। যত ধুম, তত ফুল্ল তোমার গৃহস্থ। অন্দর সদরে আসিল, গলি সড়কে মিলিল, আসমান দুলিতে দুলিতে মতিঝিল পার হইয়া কমলাপুর ঢুকিয়া পড়িল। পদ্মায় ভাসা জসীমউদ্দীনের নৌকা তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মে পৌঁছাইলে তুমি কপালের টিপ খুলিয়া আঁচলে বাঁধিলে, যত্ন করিয়া পাতিলে নকশী কাঁথা। গমনের কালে তোমারে খুঁজিব চরণে…

জুড়িবার জন্য রথখোলা দণ্ডায়মান, স্টারের গলি ঘণ্টা পিটাইতেছে, ইস্কাটন-মালিবাগে চলিতেছে ধুন্ধুমার চরকি এবং কয়েেবলের  মতো একখানা বৈকাল ঠাটারীবাজারে জড়ো করিতেছে মহিষের শিং। কাহাকে কোথায় আসন দিই, আর কাহাকেই বা শাসন করি! বেলা বাড়ে ত’ চক্ষু ফোটে, চক্ষু ফোটে ত’ ওষ্ঠ শুকায়, ওষ্ঠ শুকায় ত’ বশের বাহিরে চলিয়া যায় পঞ্চ আঙুল। পেট্রলের প্রেমে মজিয়া পাবলিকা পড়িয়া থাকে, লাইন মিলাইয়া বাস ধরিবার কসরত করা বৃথা; বাকি রহিল তালের ডোঙার সত্ভাই রিকশা। তাই সই বলিতে খই ফোটে মোয়াজ্জেমের, ফিনকি দিয়া হাসেন বেলাল ভাই। আমাদের যাত্রা জারি থাকে।

সিলভানা কাশির ঔষধের কথা বলিয়াছিল। তিন দিন যাবৎ বড় বুয়ার ছেলেটি কষ্ট পাইতেছে। হামদুকে ফার্মেসিতে পাঠাইলাম। পাঁচতলা ভাঙিয়া সে ঔষধ ক্রয়ের নিমিত্তে পুরানা পল্টন ছুটিল। টেবিলে বাসের চেশিস চিৎ হইয়া পড়িয়াছিল। তাহাকে স্টিলের বডি পরাইবার জন্য চট্টগ্রাম পাঠাইলাম। অফিসকক্ষে শোঁ শোঁ করিয়া এয়ারকুলার দাপাইতেছে, আর মন লাফাইতেছে কতক্ষণে আঙুল স্পর্শ করিবে পূর্ণ গ্লাস। ঝাপসা সিলভানার মুখমণ্ডল স্পষ্ট হইতেই টেলিফোন বাজিল :

কত দূর?

এই ত’ যাই।

ঔষধ লইয়া হামদু ফিরিয়াছে। অফিস রহিল ওর জিম্মায়। রাজাবাজার হইতে মোটরসাইকেল দাবড়াইয়া ওয়ালীর পৌঁছাইতে মিনিট বিশেক লাগিবে, আর আমার রিকশাও ততক্ষণে পৌঁছাইয়া যাইবে সিলভানার চৌকাঠে। পাঁকে মুখ গুঁজিয়া আছে শূকর, বাচ্চারা কুঁই কুঁই করিয়া চক্কর কাটিতেছে, খাড়াইয়া মুতিতেছে ঝাঁকা মাথায় পাকা আম বিক্রেতা এবং সাইরেন বাজাইয়া অ্যাম্বুল্যান্স ছুটিয়া যাইতেছে উত্তরে। মধুর সহিত মালতী হিসাবে অপেক্ষমাণ সিদ্ধ ডিম, ফালি শসা ও চাক টমেটো। নিষ্ঠার সহিত মেয়ে গ্লাস পরিষ্কার করিল, বোতলের ছিপি খুলিল। চিয়ার্স।

সিল, এই নাও অষুধ।

কয় বার?

দিনে তিনবার।

গ্লাস শূন্য করিয়া সিগারেট ধরায় ফিউরী। টুল টানিয়া বসিল শিহাব। যাহার যাহার মাপ তাহার তাহার এখতিয়ারে।

সিলভানা আড়ালে গেল নতুন বোতলের জন্য। ওর মুখ ভারী, নাকের পাটা অস্থির। ছলছল চক্ষুতে অশ্রুবিন্দু না থাকিলেও বেদনার ছায়া জমা হইয়া আছে। তবে এক্ষণে আর কাহার সময় আছে এই সব লইয়া মাতিবার? বেলা নামিয়া গেল। যেইটুকু ফাঁক-ফোকর আছে তাহা দিয়া পূর্বাকাশ সামান্যই দৃষ্টিগোচর হয়। চন্দ্রোদয়ে এক চিলতে আলো ঘরের সম্মুখের চাতালে পড়ে। গলিতে হিজড়ার হল্লা সকল কিছু ছাপাইয়া কানে বাজিলে আসিফ আলী চিত্কার দেয় : মাগিরা আস্তে! কাহার কথা কে শোনে! আসিতেছে, যাইতেছে; একাকী কিংবা দলে। ব্যস্ত সিলভানা ঘোরের মধ্যে বেঘোর হইয়া ভাসিয়া বেড়াইতেছে।

আজান পড়িল। রাজপথে নামিল রাজহংস। বাবুলাল জনপথ পরিচ্ছন্ন করিতে বাহির হইয়া গেল। শূকরের গলা জড়াইয়া যাহারা গৃহে এবং গলিতে পড়িয়াছিল, তাহাদের হুঁশ হইতে সূর্যোদয় পর্যন্ত অপেক্ষা করিতে হইবে। এইখানে গত রজনীতে যে মাতম হইয়াছিল, তাহা আঁচলে ঝাড়িয়া সিলভানা কলতলায় পৌঁছাইলে তুলসীপাতাগুলি দুলিয়া উঠিবে : ভালো আছ? হ্যাঁ, সে ভালো আছে। কিংবা ভালো নাই। বাবা ছাড়িয়া গিয়াছে দুই বৎসর বয়সে, মা গাড়িচাপা পড়িয়াছিল যখন তাহার দশ। অনাহারে-অর্ধাহারে থাকিয়া, ময়লা মাখাইয়া, অবহেলা জড়াইয়া আজ ঝকঝকা যৌবনে আসিয়া কত কিছুই ত’ টগবগ করে। গ্লাসে বোতল আর কত দিন সামলান যাইবে?

দুনিয়া ভাঙিয়া পড়িলেও টিপু সুলতান রোডের রব মহাজনের হেলদোল নাই। ড্রামভর্তি মাল প্রবেশদ্বারে গড়াগড়ি খাইতেছে। সাদা লুঙ্গির উপর চওড়া বেল্ট সাঁটাইয়া তদারকি চলিতেছে নতুন ভবনের নির্মাণকাজের। কবি ঢুকিতেছে, সাংবাদিক গিলিতেছে, নানান কিসিমের খিস্তি উঠিতেছে, হ্যাপির কণ্ঠে খেলিতেছে নতুন সুর। উকিল ঢোক গিলিয়া কাছারিতে ছুটিল, আরজ আলী একটানে দুই গ্লাস নামাইয়া বুড়িগঙ্গা পার হইবে বলিয়া ছাতা খুলিল। বাহির হইতেই শামসুদ্দীনের খাসির মাংস ডাক দেয় : টাটকা, আট কেজি সাইজ। নির্বিকার রউফ ডাবের দোকানে মোটরবাইক হেলান দিয়া কোটা থলিতে পুরিবে। ইহার মধ্যেই টুক করিয়া সিলভানা ঢুকিয়া পড়ে, মাল ভরিয়া যাইবার কালে চোখ মারিয়া ফিক করিয়া হাসিয়া দেয়। হঠাৎ খেয়াল হইল, নিষ্পত্তির কাগজ লইয়া  ত’ রফিক ভাইয়ের আসিবার কথা।

গৃহ বদল হয় ত’ গুরু বদল হয়। আমার দশা কাঙালের। তাই, কখনো এই ঘর ওই ঘর করিয়া, আবার কখনো এই পাড়া ওই পাড়া ঝাঁকিয়া বৈকালকে মধ্যরাত অবধি টানিয়া লই। মই সঙ্গে চলে, সই শিয়রে থাকে এবং খই ফোটে মনসুর হইতে জসীম পর্যন্ত। ভাই খসরু দুয়ারে খিল দিলে মিল খুঁজিয়া ইকবাল হয়রান। রেলগেটে আসিয়া অপেক্ষা করিতেছে ওয়্যারলেস মোড়। মালগাড়ি এক্ষণে পার হইবে, তাহাতে সফুর চালান। সফুর ঘর নাই, রাস্তায় ফুরফুর করে কারবার। তাহাকেও একদিন সিলভানার রেডিওর চাবি ঘুরাইতে দেখিলাম। রেজাউল সাক্ষী।

বদলাইয়া যাইতেছে অনেক কিছু। চিত্র বদলাইতেছে, মিত্র বদলাইতেছে। ভাষা বদলাইতেছে, আশা বদলাইতেছে। দল বদলাইতেছে, ফল বদলাইতেছে। বদলখণ্ডের অভ্যন্তরে সিংহ বদলাইয়া হরিণ হইল, ভুরু বদলাইয়া ঊরু হইল। অপরাহ্ন বদলাইয়া পূর্বাহ্ন হইলে সিলভানা থম মারিয়া যায়। জল না মিশাইয়াও বল পাওয়া যাইতেছে না। জিজ্ঞাসিল :

বিষয় কী?

পোশাক বদল।

মানে?

সাদা ফালাইয়া খাকি।

ও, জিন সরাইয়া রাম।

সেই রকমই।

মণিমুক্তার খবর কী?

সাপ সামলায়।

কই?

বায়তুল মোকাররম।

আইচ্ছা। রহমান সাবে?

মূর্তিরে পাইছে। ফজুল বাত ছাড় ত’, বোতল নামাও।

আকাশ ভাঙিয়া পড়িলেও দড়ির খাটিয়া নড়িবে না। সমুদ্র উতলাইয়া পড়িলেও বাড়তি একটি গ্লাস ভরিবে না। তাই রজনীতে ভর দিয়া শক্তিসঙ্গ লাভের চেষ্টা করাই শ্রেয়।

বৈকালের চক এবং সন্ধ্যার ধকের মধ্যে পড়িয়া সিলভানা হজম করে রজনীর মত্ততা। বিড়ালেরা মিউ মিউ করে, কুকুরেরা লেজ দোলাইতে দোলাইতে ঘুরপাক খায় এবং শিয়ালেরা দূরের খাটাল হইতে গলা তুলিয়া নিজেদের জানান দেয়। পিঁপড়ে, ইঁদুর, আরশোলা ছাদ-মেঝেতে মিতালী গড়ে; কাক-কবুতর-প্যাঁচা উদাস নয়নে সিলভানাকে দেখে। গ্যাসের চুলায় আগুন জ্বলে ২৪ ঘণ্টা। ফাল্গুনের শিমুল, জ্যৈষ্ঠের ঝড়, শ্রাবণের স্বর, আশ্বিনের আকাশ এবং মাঘের হাওয়া তছনছ করিয়া যায় একান্ত প্রহর।

যাহারা আসে তাহারা ভালোবাসে নেশাসঙ্গ, যাহারা যায় তাহাদের পছন্দ দলরঙ্গ। জলচাহিদা মিটাইয়া মাঝেমধ্যে সিলভানা উদাস হইয়া পড়ে। বিকাল নিভিয়া গেলেও সাদা মুখমণ্ডল আয়নার সম্মুখে পড়ে না, ফুলতোলা শাড়িতে ফুটিয়া ওঠে না ‘রূপ তেরা মাস্তানা…। ’

কারওয়ান বাজার যে ঢেঁড়া পিটাইয়া হোমিওপ্যাথি শিশিতে অ্যালকো নামাইয়াছে, সেই সংবাদ দিলু পৌঁছাইল। জরিমানা যেই মতো ঘটুক, শুনিতেই মন দাবড় দিল। মধ্যাহ্নের সাকুরা তখন একটি ধুমধড়াক্কা লঞ্চঘাট। যাত্রীরা অপেক্ষা করে, আহ্লাদের ঘড়ি বুজাইয়া রউফুল ময়দান মাপে। একসময় এই দরজায় তালা পড়িতেই রেললাইন শিস দেয়, আড়তে জমিতে থাকে মেহগনি-কড়াই-কাঁঠাল-সেগুন। দুলাল সাজায় আর কোমরভাঙা কামার হইতে মাছের ঝুড়ি উল্টান ব্যাপারী পর্যন্ত টুল-বেঞ্চ দখলে রাখে। সুরমাই ফজলি লইয়া সিরাজ ব্যাগ নামাইতেই মনটা চলকে ওঠে। লও মন, দক্ষিণে যাই। এই দক্ষিণের টান সামলাইয়া, জোড়া প্রজাপতির ডোরা ফালাইয়া যখন পশ্চিমে যাত্রা করিলাম, তখন সিলভানা ঘরে নতুন পর্দা লাগাইবার আয়োজন করিতেছে।

ভাঙা বেঞ্চে বসিয়া ঢুলিতেছে দয়ারাম। রজনীর পরিণাম দিবসেও সমাপ্ত হয় নাই। আপ্পা শূকরগুলি তাড়াইয়া বড় সড়ক পার করিলে ভাদ্রের বেলা চাখিয়া দেখিল টিনের ছাপরা, টালির ছাউনি। সরু গলির দুই পাশে ছোট ছোট ঘর, একেক সংসার। ইহার মধ্যেই জন্ম-মৃত্যু, ভোগ-বাণিজ্য, শিক্ষা-সন্ত্রাস মায় স্টেডিয়াম হইতে চিড়িয়াখানা ঘুরপাক খাইতেছে। শীতলক্ষ্যা নামিলে, বুড়িগঙ্গা স্পর্শ করিলে এবং তুরাগ লেজের ঝাপটা মারিলেও বুঝি গায়ের মানচিত্রের হেরফের হইবে না; পালে পাইবে না টানের হাওয়া। আঁচল আলগা করিয়া সিলভানা তালপাখা ঘুরাইতেছিল। দেখিতেই মুখ তোলে :

এ বেলা?

হু। কাট মারলাম। মিঠঠা কই? রাস্তায় পাঠাও।

কেন, গাড়ি আছে?

হ। এই লও ২০ টাকা। ওরে দেও আর গাড়ির কাছে বইসা থাকতে কও।

হইল।

সিলভানা সরিতেই এক ঝাপটা পোড়া গন্ধ হামলাইয়া গেল। গাছের ডালে বসা কাক, কলপাড়ে মেলে দেওয়া শাড়ি এবং ভাট্টির চাড়ি মনে করাইল এক যুগ আগের বড় মগবাজারের কবুতর, শেমিজ আর মাটির চুলার কথা। পথ ফুরাইয়া যায়, আসমান ফুরায় না। সেই দিনের মিনু পর্দা দুলাইয়া চলিয়া গেল, আক্কাস রাস্তায় দাঁড়াইয়া সাবধান করিল। ইহার ফাঁকেই হুস করিয়া ঢুকিল সোজা লেজের বানর আর বীমা কম্পানির দালাল। কাহার যে কোথায় কী প্রয়োজন, বোঝাই মুশকিল! নারিন্দার পীর সাহেবের দরগা হইতে ফিরিল ভাইজান, আর মিয়া মনসফ বাংলাবাজারের গদি হইতে। তালা-চাবিওয়ালা গ্লাস উপুড় করিয়া হাঁক দিল, কই রে বান্দির বাচ্চা? আগুন লাগা, মুখ পোড়াই।

আগুন লাগিল, তবে মধ্যদিনে নয়, মধ্যরাতে। রুদ্রর সহিত কি আর কেহ ছিল?

কী পুড়িল তাহা বুঝিতে পারি নাই। ফিরিবার সময় গাড়ির জানালা দিয়া মুখ বাড়াইয়া কেবল বলিতে পারিয়াছিলাম : সিল, যাই। আগামীকাল রাতে বাগদাদ যাব। ইরাক। কুফা-কারবালা আর যুদ্ধের দেশ। ফিরলে দেখা হবে।

বাগদাদ হইতে এক বৎসর পরে ফিরিয়াছিলাম, কিন্তু সিলভানার সহিত আর দেখা হয় নাই। বলা যাইতে পারে, দেখা করি নাই।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত