ধন্যবাদ
মধ্যরাতের একটু আগে কাকরাইল মোড় থেকে রিকশা ঠিক করলাম আমি আর নিয়ন ভাই, গন্তব্য পল্টন।
রিকশাওয়ালার পিঠ কামারখানার হাপরের মত ওঠানামা করছে। গেঞ্জির বড় দুটো ফুটো দিয়ে ল্যাম্পোস্টের আলোয় চোখে পড়ছে কালো শরীর।
নিয়ন ভাইয়ের মাথাটা একটু পিছিয়ে পুরু ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে নিলেন। বাতাস শুকনো হয়ে আসছে।
হঠাৎ কী মনে হলো, বললাম, নিয়ন ভাই, আপনাকে আমার দেখতে খানিকটা রেড ইন্ডিয়ানদের মতো লাগে।
দাঁড়াও, পালকের টুপিটা ঠিকঠাক করে নিই, ঠা ঠা ঠা! তো বলো, কেমন চলছে তোমার সংসার?
আমার তো এখন সব তালগোল পাকিয়ে যাবে। আগে আপনার কথা বলুন।
আমার কথা সবসময় কিভাবে আসে জানো? কেউ কিছু বলছে ধরো। তো তার দেওয়া সূত্র ধরে আসে। এ হলো কথা আসার সম্পাদকীয় উপায়, ঠা ঠা ঠা!
সংসার চমৎকার। সত্যি বলতে, এতো যে আনন্দ লুকিয়ে, জানা ছিল না। বিয়ের পরদিন ঘুম ভেঙে দেখি, যে মেয়েটাকে ভালোবাসি সে আমাকে রাম্পারের মতো আঁকড়ে ধরে ঘুমুচ্ছে। এই যে ফিরছি, মনে হচ্ছে এক আশ্চর্য উপহার আমার জন্যে অপেক্ষা করে আছে।
বাহ! তা, কী করে ও? কী নিয়ে পড়েছে?
প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে পড়েছে। ক’দিন পর পঞ্চগড়ে একটা প্রজেক্ট পড়বে। আপাতত ফ্রি। আপনার কেমন চলছে? আপনার সংসার।
আমার একার সংসার? তুমি শোনোনি বোধ হয়, আমি বিয়ে করিনি।
নতুন হাউজে এসেছি তিন মাস। অল্পসল্প কথা বলার স্তর থেকে চল্লিশের ঘরের সিনিয়র কলিগ নিয়ন ভাইয়ের সঙ্গে নিচে চা খেতে যাওয়ার মতো ঘনিষ্ঠতা হলেও, পারিবারিক কিছুতে আলাপ কখনো গড়ায়নি। আজও গড়াত না হয়ত, সপ্তাহ খানেক আগে যদি বিয়েটা না করতাম।
বিয়ে করবো করবো বলেও শেষতক করা হয়নি বুঝলে? নিয়ন ভাই বললেন। আর, আমি প্রেম ট্রেমও করিনি। বলা উচিৎ, আসলে করতে পারিনি। ঐ যে তুমি বললে না রেড ইন্ডিয়ান? তখনই বুকে একটা ঝিলিক দিয়ে গেল। এক নারী এমনি করে আমাকে বলেছিল- ইনকা। বলেছিল, আমার মুখ নাকি হুবহু ইনকাদের মতো। মনে পড়ল কারণ, ওই ভদ্রমহিলা আমাকে ভালোবেসেছিল; অবশ্য এটা আমার কল্পনাও হতে পারে, ঠা ঠা ঠা!
কল্পনা হতে পারে কেন বলছেন?
কোন ধরনের বোঝাপড়ামূলক কথাবার্তা আমাদের মধ্যে হয়নি। তবুও অনেকবারই মনে হয়েছে কথাটা। মনে হয়েছে, তেমন কোনো কথায় হয়ত আরেকটু হলেই গড়াত আলাপ, এমনকি, চাইলে হয়ত দুজন বিয়েও করতে পারতাম।
একটা গাছের নিচ দিয়ে যাচ্ছিল রিকশাটা। গাছের পাতার গতিমান ছায়া নিয়ন ভাইয়ের মুখের ওপর। আমি তার শেষ কথাটাকে ধরলাম।
চাইলে হয়ত তাকে বিয়ে করা যেত, বেশ। তো, হয়তকে বাস্তব করলেন না কেন? কোথায় বাধা ছিল? তিনি আপনাকে চাননি? বা আপনি তাকে?
নিয়ন ভাই বিব্রত হাসলেন। আমি বললাম, ইয়ে, এসব একেবারেই ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ন ভাই। মুখ ফসকে এতোদূর প্রশ্নটানা আমার খুবই অনুচিৎ হয়েছে।
ওকে চাইতাম না- তা নয়। চাইতাম। আসলে- হ্যাঁ। ওকে আমি কামনা করেছি।
আরো কিছু বলতে গিয়ে নিয়ন ভাই থেমে যাওয়ায় বুঝলাম, এমন সব কথা ওনার ভেতর জমা, যেগুলো প্রকাশ পেলে হাওয়া হয়ে যাবে। এরচেয়ে ওগুলো বুকে রেখে তিনি শ্বাস নেয়ার কাজ চালাচ্ছেন। কিন্তু এমন জায়গায় থেমেছেন, মনে হলো হাওয়া খেলানো ভালো।
থামলেন যে?
অদ্ভুত ব্যাপার কি জানো? তোমার বিয়ে করা দেখে আমার মনে হয়েছে, বিয়েটা বোধয় করাই যেতো। আমি আসলে ভয়ে ছিলাম আমার অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে। সাংবাদিকতা করে কিছুই জমাতে পারিনি। বড় সাংবাদিকও হতে পারিনি, ঠা ঠা ঠা, বাঁচা গেছে! আসলে সবখানে আমার নামের প্রভাব থাকতে পারে বুঝেছো? জানো বোধয়, নিয়ন একটা নিষ্ক্রিয় মৌল, এর অষ্টক পূর্ণ। কারও সঙ্গে এরা বিক্রিয়া করে না। প্রয়োজনও হয় না।
দারুণ বলেছেন।
তো- টাকা নিয়ে ভয় পেতাম। ভাবতাম কোনোরকমে নিজে চলা ভিন্ন আমার তো টাকা নেই, সোজা হিসেব। বিয়ে করে কাউকে সুখী করতে পারবো না। তুমি হয়ত বলবে খুবই তুচ্ছ এই ভাবনা, তাই না?
না নিয়ন ভাই, বলব না। স্থান কাল পাত্র বিচার আছে।
একদম ঠিক। স্থানকালপাত্র একটা বিষয়। তো- আমার বন্ধুদের কারও সঙ্গে এ কথা শেয়ার করতে পারিনি। কারণ শুনলেই কেউ হয়তো আমাকে টাকা দিতে চাইবে। আর কেউ হয়ত সুখী হতে টাকা লাগে না- ইত্যাদি কথা দিয়ে গুরুগম্ভীর তত্ত্বকথা আওড়াতে শুরু করবে সঙ্গে একগাদা উদাহরণ। কিন্তু আমার নিজস্ব কিছু ব্যাখ্যা তো ছিল। কোন নারীর সঙ্গে যে যুগল জীবনটা আমি চেয়েছিলাম, তা কাটাতে গিয়ে…
নিয়ন ভাই হঠাৎ খেই হারিয়ে ফেললেন।
… আসলে আমার বয়সও খুব বেড়ে যাচ্ছিল, বুঝলে? ঐ আরকি। তোমার বিয়ে দেখে নতুন রিয়েলাইজেশন হলো। তোমার বয়েস কত কম, সাতাশ আটাশ? তীব্র আবেগের কাল। এই বয়েসটায় আবেগের তোড়ে প্রাণ দিয়ে দিতে ইচ্ছে করে, না? খুব মজার সময়। এমন হাই টাইমে প্রেমের মতো একটা ব্যাপার নিজের সঙ্গে জড়াতে পেরেছো। দেখো তুমিও তো সাংবাদিকই, না? যদি তাই থাকতে চাও, যে ঝুঁকির ভয়ে আমি কারও জীবন জড়ালাম না আমার সঙ্গে তা তো তোমার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এইসব কাছা ছেঁড়া ভাবনা, বুঝলে? হিংসেই হলো বলতে পারো, ঠা ঠা ঠা! মনে হলো ভুলই করেছি।
নিয়ন ভাইয়ের মুখে গাঢ় অন্ধকার। আমার বুকটা ধরে এলো। নিয়ন ভাই চোখ নিচু করে রাস্তা দেখছেন।
রিকশা পল্টনে চলে এসেছে। রিকশা থেকে নেমে নিয়ন ভাই আমার হাত ঠেকিয়ে ভাড়া দিলেন। বললেন, তুমি তো আমার উল্টো দিকে যাবে। তো বিদায় নেয়া যেতে পারে, কী বলো।
আমি ব্যাগটা এক কাঁধ থেকে আরেক কাঁধে নিলাম। নড়ার কোনো লক্ষণ নেই। চোখ থেকে চশমা খুলে পাঞ্জাবির খুঁটে কাচ মুছতে মুছতে বললাম, নিয়ন ভাই, বাসায় যাবো, ঠিকাছে, তবে আপনার সঙ্গে আর কিছুক্ষণ থাকতে চাই। আপত্তি আছে?
নিয়ন ভাই হাসতে হাসতে মাথা নাড়ালেন। আমাকে সঙ্গ দিতে চাইছো? ভালোই হলো। তোমাকে আমার ওই এক্স কলিগের কথা বলি। তোমার শোনার দরকার আছে। কার কথা বলছি বুঝেছ তো। ওই যে আমাকে ইনকা বলেছিল।
বুঝেছি ভাই, বলুন। চা বলব?
হাঁ বলো।
আমরা চায়ের দোকানো নড়বড়ে এক বেঞ্চিতে বসলাম।
তো- উনি একদিন আমাকে বলল, নিয়ন, আপনি বিয়ে করেন না কেন? আমি তাকে কী জবাব দেবো কিছুক্ষণ ভাবলাম। তারপর ভাবলাম সত্যি কথাটাই বলি। মানে, আমি যা ভাবি আরকি। তোমাকে যা বললাম, সেটা তাকেও বললাম। আসলে কী বলব, মনটা তরলও হয়ে থাকতো তার সামনে এলে। ও ডিভোর্সড ছিল, অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ, কোপ আপ করতে পারেনি। যাক, ওটা অন্য গল্প। অন্য এবং অপ্রয়োজনীয়। তো- তাকে বললাম আরকি টাকার ব্যাপারটা। শুনে, বুঝলে, ও একটা জবাব দিয়েছিল। ওর কণ্ঠে একটা বিষণ্নতা ছিল, আমি সেটা তখন ধরতে পারিনি। একটা যেন আবেদন ছিল, আমি বুঝিনি, বুঝলে? বুঝেছি, ওখানে চাকরি ছেড়ে দিয়ে এখানে চলে আসার পর। অথবা বোঝাটা আমার কল্পনা।
পাশেই তেহারির দোকানের মেঝে পরিষ্কার করছে একটা দশ বারো বছরের ছেলে। ঝাড়–র কর্কশ শব্দ হচ্ছে। দোকানের আলোয় বাইরে দাঁড়িয়ে টাকা গুণছে এক হেঁটে বেড়ানো পান বিক্রেতা।
নিয়ন ভাই বললেন, সে বললো কী জানো? একটা মেয়ে বেশি কিছু চায় না। এই ধরো তোমার জন্যে সে অপেক্ষা করে আছে তো তার জন্যে কিছু একটা নিয়ে যাও? হতে পারে একটু বাদাম, বা দিনশেষের একটা বাসি ফুলের মালা? মানে একটা কিছু স্বীকৃতি, তাকে না বলেও বলা যে হ্যাঁ- তুমি আছো আর তুমি আমার জরুরি। তোমাকে অনুভব করি, ভালোবাসি। বা ধরো, খুব সস্তা একগাছি চুড়ি? সবুজ কাচের। কত সস্তা তুমি ভাবতেই পারবে না। মেয়েরা ঐ স্বীকৃতিটা চায়। ওটাই আসল।
নিয়ন ভাইয়ের কণ্ঠ মুছে গেল, কিন্তু বাজতে থাকলো মনের ভেতর। মিরপুর দশের স্টপেজে বাঁ পা রাখলাম। রাতে বারোটা পেরিয়েছে। দোকানপাট সব বন্ধ। শুধু ওভারব্রিজের নিচে একটা শুকনো মতো ছেলে সবুজাভ ছোট বালতিতে অনেকগুলো মলিন গোলাপ ফুল নিয়ে তখনও বসে আছে।
এগোলাম। ওর সোনালী বালতিটার সামনে বসে পড়ে ফুল দেখতে থাকলাম। ছেলেটাও আমাকে সাহায্য করতে থাকলো। তার চোখে যে ফুলগুলো ভালো, সেগুলো এগিয়ে দিচ্ছিল। হঠাৎ একটা খুব পছন্দ হলো। ফুলটার ওপরের প্রায় মলিন পাপড়িগুলো ফেলে দেয়া হয়েছে। ভেতরের উল্টো হয়ে থাকা ছোট্ট রসুনের মতো অংশটা টুকটুক করছে, সেখানে কোন মলিনতা নেই।
বুড়ো আঙুলে একটা কাঁটা বিঁধে গেলো। ছেলেটাকে দশ টাকা দিয়ে পথ ধরলাম।
শান্ত রাস্তা। রাতের বাতাস অবসর বুঝে মৃদুমন্দ বইছে।
বাসায় পৌঁছে কাঠের কবাটে লোহার কড়া নাড়লাম। ও দরজা খুলে দিলো। হাসছে। কাছে এসে নিজেই জড়িয়ে ধরলো আমাকে।
মনটায় কেমন আনন্দের বিষণ্নতা এলো। চুলের ঘ্রাণ নিলাম ওর। বললাম, অনেক দেরি করে ফেলেছি?
ও নিঃশব্দে দু পাশে মাথা নাড়লো। ঘরে গিয়ে আলোর মধ্যে দাঁড়িয়ে তাকে দেখলাম।
তোমার জন্যে একটা উপহার এনেছি। খুব সামান্য। নেবে?
ও হাসল নিঃশব্দে। কথা বললেই কোন মিষ্টি স্বপ্ন ভেঙে যেতে পারে। পাঞ্জাবির দীর্ঘ পকেটে রাখা গোলাপটা বের করে হাতে দিলাম। নরম আঙুল দিয়ে জড়িয়ে নিলো ফুলটার সবুজ ডাঁটা। পাতাগুলো তখনও ভেজা। মুখ নামিয়ে ঘ্রাণ নিলো। বেশ কিছুটা সময় এভাবে কেটে গেলো। দেখলাম, চোখে জল ঝিকমিক করছে। নড়ে গিয়ে টপাটপ গড়িয়ে পড়লো।
আমি ধন্য! নিয়ন ভাই তাহলে ঠিকই বলেছেন। না নিয়ন ভাই নয়, তার ঐ পুরনো সহকর্মী, বিয়েটা যার সঙ্গে হতেই পারতো।
লেখক। জন্ম- ১৯৮৭ সালের ৯ অগাস্ট, ঢাকায়। আহসানুল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তড়িৎ প্রকৌশলে স্নাতক। প্রকাশিত গ্রন্থ- ‘জঠর’ (২০১৬), ‘কারখানার বাঁশি’ (২০১৮)।