Categories
প্রসঙ্গ: গ্রামবার্ত্তা ও সাংবাদিকতায় রাষ্ট্রীয়ভাবে কাঙাল হরিনাথ পদক প্রবর্তন
আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট
ঊনিশ শতকের আলোকিত সাংবাদিক, গ্রামীণ সাংবাদিকতার প্রবাদ পুরুষ ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’র সম্পাদক, নির্ভীক কলম সৈনিক, অনুচ্চর জনগণের কণ্ঠস্বর কাঙাল হরিনাথ মজুমদার নিপীড়িত, অসহায়-বঞ্চিত নারী-পুরুষের শিক্ষা কাণ্ডারী এক বটবৃক্ষ। এ বৃক্ষের শেকড়ের সন্ধানে মেতে থাকতে তাঁর উত্তরসূরিরা বদ্ধ পরিকর। তাঁর সমস্ত- সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ড ও সৃষ্টির যৎকিঞ্চিত মূল্যায়ন হলেও পরবর্তীতে তা যেন অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছে। এই মহান পুরুষের সৃষ্টিকে যথাযথ মর্যাদা ও মূল্যায়ন শুধু ‘কাঙাল স্মৃতি তর্পণেই’শেষ নয় এই মনীষীর কালোত্তীর্ণ মর্যাদাটুকু দেয়া আমাদের জাতীয় কর্তব্য।
বাংলাদেশে বাংলায় সংবাদপত্র প্রকাশনায় প্রথম সুযোগ্য ও অন্যতম উত্তরসূরী ছিলেন কুষ্টিয়া জেলার নিভৃত পল্লীর কুমারখালী কুণ্ডুপাড়ার তিলি পরিবারের কাঙাল হরিনাথ মজুমদার । যিনি কারো ধমককে ভয় পাননি, কোনো প্রলোভনের কাছে কখনো মাথা নোয়াননি। স্বাধীন চেতা পল্লী প্রাণা। গ্রাম বাংলার কাদা-মাটির মানুষ কাঙাল হরিনাথ। তিনি নিঃস্ব-নিরক্ষর গ্রামবাসীদের অভাব-অভিযোগ, দুঃখ-দুর্দশা নিরসনে এবং আমলাদের বর্বরোচিত নির্যাতন তৃণমূল থেকে উৎপাটনের কাহিনীর প্রতিবাদ ও প্রতিকারের অভিপ্রায়ে বাংলা ১২৬৭/বৈশাখ হাতে লিখে দ্বিমাসিক পত্রিকা প্রকাশনা শুরু করেন। এ সময়ে তিনি কলকাতার ইংরাজী পত্রিকার এজেন্ট ও সাংবাদিক নিযুক্ত হন, তিনি সংবাদ সংগ্রহ করে বাংলায় লিখে পাঠালে সম্পাদক তা ছেঁটে-কেটে ইংরেজী অনুবাদ করে ছাপাতেন। কিছুদিন পর ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় সাংবাদিকতার দায়িত্ব পেলে প্রবন্ধাকারে সংবাদ পাঠাতেন। বাংলা ১২৭০ বৈশাখ বঙ্গাব্দে কলকাতা গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্ন যন্ত্র থেকে তিনি তাঁর দ্বিমাসিক “গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা”কে মাসিক গ্রামবার্ত্তায় উন্নীত করে ছাপাক্ষরে প্রথম আত্ম-প্রকাশ ঘটিয়ে ইতিহাসের সূচনা করলেন। ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ নিয়মিত মাসিকের পাশাপাশি একসময় পাক্ষিক ও সাপ্তাহিকারে আত্মপ্রকাশ ঘটে। গ্রাম হিতৈষণার আদর্শ নিয়েই ‘গ্রামবার্ত্তা’র আত্মপ্রকাশ। ১২৮০ সালে নিজ আবাসলয়ে মথুরানাথ মুদ্রণযন্ত্র নামে ছাপাখানা স্থাপন করেন। এ মুদ্রণ যন্ত্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটা পরিস্কার জানা যায় ১২৮০/১৭ শ্রাবণ কলকাতার ‘অমৃতবাজার’ প্রকাশিত সংবাদে। মথুরানাথ মুদ্রণযন্ত্র (এম এন প্রেস) যা আজো কালের সাক্ষী হয়ে ‘কাঙাল কুটিরে’ দণ্ডায়মান। কাঙালের এ ছাপাখানা দেখতে আজো দেশ-বিদেশ থেকে পর্যটক, গবেষক, কবি, সাহিত্যিক প্রভৃতি বিদ্ধজনেরা আসেন। এ প্রেস থেকে সে সময় বিভিন্ন প্রকার পত্র-পত্রিকা ছাপা হয়েছে। উল্লেখ্য কুষ্টিয়া লাহিনীপাড়া থেকে প্রকাশিত মীর মশাররফের ‘আজীজন নেহার’(লালন একাডেমীতে রক্ষিত), ‘হিতকরী’, শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণবের ‘শৈবী’ (পাংশার) রওশন আলীর ‘কহিনূর’, ললিত মোহন পাল ও রাধা বিনোদ সাহা(সাহাজী) ‘বঙ্গীয় তিলি সমাজ পত্রিকা’ প্রভৃতি।
মুনতাসীর মামুনের ঊনিশ দশকে বাংলাদেশের সংবাদ সাময়িক পত্র ১ম খণ্ড থেকে জানা যায়-অখন্ড ভারতবর্ষে সে সময় (১৮৬৬-৬৭ সাল) বাংলাদেশে সর্বমোট ৩১টি প্রেস বা মুদ্রণযন্ত্র ছিল। এর মধ্যে কলকাতায় ১২টি, ঢাকায় ২টি, রংপুর ২টি, মুর্শিদাবাদে ২টি, হাওড়ায় ২টি, ময়মনসিংহ ১টি, মেদিনীপুর ১টি, বর্ধমান ১টি, হুগলী ১টি, ভবানীপুর ১টি ও শ্রীরামপুর ৪টি। অন্য একটি তথ্যে(১৮৭২-৭৩) জানা যায় ঢাকায় ৩টি ও নদীয়া তথা কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে ১টি। ১৮৭৩ এর হিসাব মতে প্রকাশিত বাংলা সংবাদপত্রের সংখা ছিল ৩৬টি। এরমধ্যে কলকাতা থেকে ১৭টি, বাঁকী ১৯টি জেলা সদর ও গ্রামাঞ্চল থেকে। চল্লিশ দশকে গ্রামভিত্তিক সংবাদপত্রের যে প্রকাশ শুরু হয়েছিল, পরবর্তী সত্তর দশকে এসে তার বেশকিছু সংখ্যাতাত্তিক বাড় বাড়ন- ঘটে। এ সময় গ্রামীণ সংবাদপত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো এক. ‘হালিশহর পত্রিকা’, দুই. ‘কাঁচরাপাড়া পত্রিকা’, তিন. মুর্শিদাবাদ পত্রিকা, চার. বরিশাল বার্ত্তাবহ এবং পাঁচ. সর্বোপরি হরিনাথ সম্পাদিত ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ বিশেষভাবে দেখা যায়।
হরিনাথের এলাকায় নিকটবতী কোন ছাপাখানা না থাকায় যাতায়াতের অসুবিধা সত্বেও কলকাতা থেকেই প্রতিমাসে চারফর্মা আকারে ‘গ্রামবার্ত্তা’ বের হয়েছিল। রক্ষণশীল সমাজপতি ও অত্যাচারী ব্রিটিশ অনুগামীদের সঙ্গে আপোষরফা না করায় হরিনাথ ‘গ্রামবার্ত্তা’কে লাভজনক ব্যবসায় রূপ দিতে পারেন নি। লোকহিত-ব্রতে উদ্বুদ্ধ হয়ে কাঙাল হরিনাথ যে সাময়িক পত্র সম্পাদনা করেছিলেন, সে যুগে অখ্যাত ‘মফস্বল পল্লী’ কুমারখালী থেকে পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ একটি অসাধারণ ঘটনা; যা একজন মাতৃ-পিতৃ-আত্মস্বজন ও অসহায় সম্পদহীন দামালছেলে, সৎচরিত্রবান, নির্ভীক কলমযোদ্ধার পক্ষেই সম্ভব হয়েছিল। অপ্রিয় হলেও সত্য ঘটনাবলী টানটান করে প্রকাশের সাহসিকতা ও দৃঢ় চরিত্রের জন্য নিজ পরগণার জমিদার, প্রজার দণ্ডমুণ্ডের অধিকর্তা কর্তৃক কতই না নিগৃহীত হতে হয়েছিল। অর্থের প্রলোভন, লাঠিয়ালবাহিনী নিয়োগ, ভাড়াটিয়া গুণ্ডা নিযুক্ত, মিথ্যা মোকদ্দমায় জড়ানো প্রভৃতি শত চেষ্টায়ও গ্রামীণ এলিট ও পথিকৃৎ কাঙাল হরিনাথকে ভীত তঠস’ করতে পারেন নি। ঊনিশ শতকের মৃত্তিকা সংলগ্ন গ্রামীণ বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, কবি, সাহিত্যক, গীতিকার, লোকশিক্ষক, সাংবাদিক ও সমাজহিতৈষীগণ কায়েমী স্বার্থের সাথে সেবা পরায়নতার সম্পর্ক রাখতে ব্যর্থ হলে তাৎক্ষণিক যে সমস্যার সৃষ্টি হয়, কোন সুষ্ঠু সমাধান সূত্রে তার নিষ্পত্তি না হলে পরবর্তীকালে তা জটিলতর ও অসমাধেয় রূপ নেয়; এদেশে শ্রেণী বিভক্ত সমাজে এর সত্যতা সম্পর্কে আশা করি কেউ কোন দ্বিমতের অবকাশ রাখেন না। উপনিবেশিক শাসনামলে বাংলায় এ কথাটার যতখানি সত্য ছিল, বর্তমান একবিংশ শতকেও এর কোন হেরফের ঘটেনি; একথাটা নির্দ্বিধায় বলা যায়। প্রভূত আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করেই কাঙাল হরিনাথ পত্রিকা চালাতেন। অথচ এ সময় ঊনিশ শতকে অনেকেই প্রেস ব্যবসাকে লাভজনক ব্যবসা হিসাবে চালাতে অভ্যস- হয়ে উঠেছিলেন। সবাই জানেন, কলকাতার ‘বেঙ্গল হরকরার’ পত্রিকা রীতিমত লাভজনক প্রতিষ্ঠান, এ পত্রিকার সম্পাদককে সেকালে ৮০০/= টাকা বেতন দেয়া হতো। এই পত্রিকার পরিচালনা কাজে ৭০ জনের মত সাব-এডিটর সহ রিপোর্টার নিযুক্ত ছিলেন। এর দপ্তরে একটি পাঠাগারসহ পাঠ কক্ষও ছিল। আর হরিনাথ তাঁর দিনলিপি (ডায়েরী)তে লিখেছেন- ‘আমি সম্পাদক, আমি পত্রিকা বিলিকারক, আদায়কারী, পত্র লেখক ও সংসারের কর্তা’। কাঙাল হরিনাথ প্রেস করে নিরন্ন ১০/১২ জনের অন্ন সংস্থানের ব্যবস্থা করেন।
হরিনাথ প্রেস করে পল্লীর জনগণের অর্থাৎ সমাজ সেবার উদ্দেশ্যে প্রেসে পত্রিকা ছেপে ঋণজালে জড়িয়ে পড়েন। বরং দেখা যায় কাঙাল হরিনাথ মজুমদার উদরান্নের যশের বা প্রতিপত্তির সংস’ানের আশায় সম্পাদকের বৃত্তি অবলম্বন করেন নি। সংবাদ সাময়িকপত্র পরিচালনায় গ্রামীণ এলিটদের মধ্যে জাতি-ধর্ম-বর্ণ- নির্বিশেষে সকল সচেতন মহলে প্রশংসিত ছিলেন কাঙাল হরিনাথ। তিনি যুগোপযোগী ঐতিহাসিক শ্রেষ্ঠ মিশন। কাঙাল হরিনাথ যথার্থই তৃণমূল জনগণের প্রতীক বন্ধু ছিলেন। গ্রামবার্ত্তা পত্রিকা প্রকাশে কাঙাল হরিনাথ ৭০০/= টাকা ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে ইহলোক ত্যাগ করলে কাঙালের বাউল দলের শিষ্যগণ জনগণের আমন্ত্রণে গান গেয়ে বেড়াতেন। দ্রষ্টব্য ঃ দীনেন্দ্র কুমার রায় ভারতী-১৩০৩ পৃঃ ১১৪ লিখেছেন; “হরিনাথ তাঁর ফিকিরচাঁদের গীতাবলী নিজের প্রেস থেকে ছেপে বের করেছিলেন। তাঁরা বিভিন্নস্থানে কাঙাল হরিনাথের গান গাইবার সময় এই বই বিক্রী করে থাকেন, এতে কিছু অংশ অর্থ লাভ হতে থাকে; সেই অর্থ থেকে গ্রামবার্ত্তার সমস- ঋণ পরিশোধ হইয়াছিল।” চুড়ান-ভাবে গ্রামবার্ত্তার প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেল পরবর্তীকালে যে সব পত্রিকা এ অঞ্চল থেকে প্রকাশিত হয় তা গ্রামবার্ত্তার মতো পরিপূর্ণভাবে জনগণের প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম হয়নি। কাঙালের সাহিত্য-শিষ্য ও আশীর্বাদ পুষ্ট মীর মশাররফ হোসেন এবং শতীষচন্দ্র মজুমদার সম্পাদিত ‘হিতকরী’ পত্রিকায় ‘পল্লীবাসী’ প্রজার নামে ১৮৯১/২৬ আগষ্ট ১০৮ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত একটি চিঠিতে একজন পত্র লেখক উপরোক্ত আলোকে গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকার সাথে ‘হিতকরী’র তুলনা একপত্র ছাপা হয়েছে। গ্রাম হিতৈষণার আদর্শ নিয়েই গ্রামবার্ত্তার আত্মপ্রকাশ। বাংলা সাময়িকপত্র নগর-কেন্দ্রিক দৃষ্টি ভঙ্গির কারণে উপেক্ষিত গ্রামীণ স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য এ পত্রিকার একটি স্ববিশেষ অঙ্গীকার ছিল। গ্রামবার্ত্তার ১ম সংখ্যায় ১২৭০/বৈশাখ এ পত্রিকার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে সম্পাদকীয়তে লেখা হয়; “ এ পর্যন- বাঙ্গালা সংবাদ পত্রিকা যতই প্রচারিত হইতেছে তাহা কেবল প্রধান প্রধান নগর ও বিদেশীয় সংম্বাদাদিতেই পরিপূর্ণ। গ্রামীয় অর্থাৎ মফঃস্বলের অবস’াদি কিছুই প্রকাশিত হয় না। যেমন চিকিৎসক রোগীর অবস্থাদি সুবিদিত না হইলে তাহার প্রতিকারের সমর্থ হয়না, তদ্রুপ দেশহিতৈষী মহোদয়গণ গ্রামের অবস’া অবিদিত থাকিলে কিরূপে তাহার প্রতিকার করিতে যত্নবান হইবেন? যাহাতে গ্রামবাসীদিগের অবস’া ব্যবসার রীতি-নীতি, সভ্যতা, গ্রামীয় ইতিহাস, মফঃস্বল-রাজ-কর্মচারীগণের বিচারাদি এবং আশ্চর্র্য্য ঘটনাদি প্রকাশিত হয় তাহাই এই পত্রিকার প্রধানোদ্দেশ্য এবং লোক রঞ্জনার্থে ভিন্ন দেশীয় সম্ব্বাদ, গদ্য ও পদ্য চিত্তরঞ্জন বিষয়ও লিখিত হইবেক।’ ….।
সাময়িকপত্র সম্পাদনা কাঙাল হরিনাথের সামাজিক কর্মকাণ্ডের সর্বাপেক্ষা গৌরবময় অধ্যায় ‘গ্রামবার্ত্তা’ প্রকাশের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে তাঁর স্বলিখিত দিনলিপি ডায়েরী থেকে জানা যায়;-
“ … আমি ইতোপূর্বে নীলকুঠিতে ও মহাজনদিগের গদিতে ছিলাম, জমিদারের সেরেস-ায় দেখিয়াছিলাম এবং দেশের অন্যান্য বিষয় অনুসন্ধান করিয়া অবগত হইয়াছিলাম; যেখানে যত প্রকার অত্যাচার হয়, তাহা আমার হৃদয়ে গাঁথা ছিল। দেশীয় সংবাদপত্রের অনুবাদক রবিন্সন সাহেব যখন অনুবাদ কার্য্যালয় খুলিলেন আমিও সেই সময় গ্রামবার্ত্তা প্রকাশ করিলাম। ….’
কৃষক তাঁতী, রায়ত প্রজা, শ্রমজীবী মানুষের সমস্যা ও অধিকার এর প্রতিকার সম্পর্কে গ্রামবার্ত্তার ভূমিকা ও সচেতনতা ছিল প্রবল। এদের দুঃখ-দুর্দশার কথা বলতে গিয়ে গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা কোনসময় কোন দ্বিধা বা কুণ্ঠা বোধ করেন নি। পাক্ষিক গ্রামবার্ত্তায় প্রায় প্রতিটি সংখ্যাতেই এদের কথা বর্ণিত হয়েছে। এই দুঃখ-দুরাবস’ার বর্ণনায় রায়ত-প্রজার প্রতি সহানুভূতি,সরকারী ভূমিকা সম্পর্কে অভিযোগের সুরও কখনো ব্যঙ্গের ইঙ্গিতও মেলে। অনেক ক্ষেত্রেই সরকারী দায়িত্ববোধের অভাব বা উদাসীন্য সম্পর্কে বেদনা এবং অভিযোগ জানিয়ে কর্তব্য-চেতনা জাগানোর চেষ্টা রয়েছে। দেশীয় শোষক জমিদার কিংবা বাক-সর্ব্বস্ব তথাকথিত দেশ-প্রেমিকদের আচরণ ও ভূমিকাও পত্রিকায় সমালোচিত এবং নিন্দিত হয়েছে। দেশীয় তন’বায় সমপ্রদায়ের দূরাবস্থা এবং সরকারের ঔদাসীন্য সম্পর্কে ১৮৭৩/নভেম্বর সংখ্যায় গ্রামবার্ত্তায় তীব্র মন-ব্য স্বাদেশিকতার বিশেষ পরিচয় বহন করছে;-
“লাঙ্কেষ্টরের তাঁতীরা যতদিন গবর্ণমেন্ট হৃদয়ে বাস করিবে, ততদিন এদেশীয় তাঁতী-জোলার দূরাবস্থা সেই হৃদয়ে স্থান পাইবে, এরূপ ভরসা করা যায় না।” বাংলার কৃষক প্রজার দুঃখ-দুর্দশা ও কৃষি উন্নতি এবং মধ্যশ্রেণীর আয় উপার্জনের বিষয়টি পরষ্পর সাপেক্ষ বিবেচনা করে হরিনাথ সবসময়ই তাঁর আন-রিক সহানুভূতি প্রদর্শন করেছেন। জীবন সংগ্রামে বিপর্যস- ‘অন্ন-জন্ম-দাতা’ বাংলার কৃষকেরও মধ্যশ্রেণীর আয় উপার্জনের করুণ চিত্র ১৮৭০/জানুয়ারী গ্রামবার্ত্তায় লিপিবদ্ধ করেছেন;-
‘‘এক্ষণে গ্রাম ও পল্লীবাসী মধ্যবৃত্তি লোকের জীবিকা নির্ব্বাহ করা কঠিন হইয়াছে। …. জমিদারদিগের সহিত প্রজাদিগের চিরস্থায়ী বন্দোবস- না হইলে, গ্রাম ও পল্লীবাসী মধ্যমাস’ লোকদিগের উন্নয়নের অন্য কোন উপায় নাই। বস’তঃ মধ্যবৃত্তি লোকের কৃষিষ্কার্যে নিযুক্ত না হইলে চাষের উন্নতি হইবে না। খালখনন করিয়া নদীর জল আনিলে কোন ভূমিতে উপকার ও কোন ভূমির অপকার হয়, কি প্রণালীতে চাষ করিলে অধিক লাভ হইতে পারে; ইত্যাদি কৃষিকার্য্য বিষয়ীজ্ঞান যাহা কিছু মধ্যবৃত্তি ও চাষালোকেরই আছে; বিলাসী বড় মানুষদিগের তাহা কিছুমাত্র নাই।” প্রশাসন যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গের ত্রুটি-বিচ্যুতি স্খলনে গ্রামবার্ত্তা কঠোরভাবে সমালোচনা করেছে। পাবনা জেলার তদানিন-ন ইংরেজ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মফঃস্বল পরিদর্শনে এলে এক দরিদ্র বিধবার একটি দুগ্ধবর্তী গাভী জবরদসি- করে নিয়ে যান। এ সংবাদ হরিনাথের কর্ণগোচর হলে তিনি জেলার ম্যাজিস্ট্রেটের এ গর্হিত অন্যায় কাজের দীর্ঘ প্রতিবাদ জানিয়ে গ্রামবার্ত্তায় ফলাও করে ‘গরুচোর ম্যাজিষ্ট্রেট’ শীর্ষক শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করেন। গ্রামবার্ত্তার সংবাদ রাষ্ট্র হলে উক্ত ম্যাজিস্ট্রেট হরিনাথের প্রতি রুষ্ট হন এবং তাঁকে শায়েস্তা করবার জন্য চেষ্টা করেন। কিন’ কাঙাল হরিনাথের সত্য সেবার অসামান্য জনপ্রিয়তা চারিত্রিক দৃঢ়তার কারণে ম্যাজিস্ট্রেটের পক্ষে হরিনাথকে বিপদগ্রস’ করা আদৌ সম্ভব হয়নি। বরং পরবর্তীকালে সত্যনিষ্ঠ স্বাধীনমত প্রকাশের নির্ভীকতার জন্য হরিনাথ উক্ত ম্যাজিস্ট্রেটের প্রশংসা অর্জন করেন। ম্যাজিস্ট্রেট লেখেন;-“এডিটর আমি তোমাকে ভয় করিনা বটে; কিন’ তোমার নির্ভীক সত্য লেখনীর জন্য আমি অনেক কুকর্ম ত্যাগে বাধ্য হয়েছি।” গ্রামবার্ত্তা পত্রিকাই এসব অসহায় মানুষের একমাত্র অবলম্বন হয়ে দাঁড়ায়। এ পত্রিকার শাসনে অত্যাচারী ভূস্বামী কিংবা তার প্রতিনিধি সকলেই যথেষ্ট সংযত হয়েছিল। ঠাকুর জমিদারদের প্রজাপীড়নের কাহিনী হরিনাথ গ্রামবার্ত্তায় প্রকাশ করতেন। তার কিছুটা পরিচয়ের ছাপলক্ষ্য করা যায়, ‘কালের কাছারী’ শীর্ষক গ্রামবার্ত্তার একটি রূপক নক্শায়। এখানেও প্রজা পীড়কদের সংবাদপত্র ভীতির কারণে বোধোদয়ের ইঙ্গিত মিলেছে। হরিনাথ যে কেবল প্রজা পীড়নের চিত্রই তুলে ধরেছেন বা অত্যাচারিত কৃষক প্রজার প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করেছেন তা নয়; এদের এ বিরোধ অবসানের জন্য সুনিদিষ্ট সুপারিশও পথ বাতলে প্রতিকার চেয়েছেন, দেখা যায় ১৮৭২/জুন সংখ্যায় বলা হয়;-‘আমরা গ্রামবার্ত্তার জন্মাবধি বলিয়া আসিতেছি। গবর্ণমেন্টের সহিত জমিদারদিগের যেমন চিরস’ায়ী বন্দোবস- আছে, তদ্রূপ জমিদারদিগের সহিত প্রজাদিগের একটা চিরস’ায়ী বন্দোবস- হওয়া সর্বোতভাবে কর্তব্য; তাহা হইলে সকল গোলোযোগের অবসান একেবারে শেষ হইবে।…’’
হরিনাথ জানিয়েছেন, “নিজের প্রেসে পত্রিকা ছাপা হওয়া সত্বেও পত্রিকা প্রকাশের চব্বিশ বছর পর রজত-জয়ন্তী প্রাককালে হরিনাথের মাথায় প্রায় ১২০০/= টাকা মূল্য আদায় বাঁকী থাকতে এবং ৭০০/= টাকা ঋণ ভার নিয়ে তিনি পত্রিকা প্রকাশনা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। টানা ২৪ বছর ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ প্রকাশের পর বন্ধ হয়ে গেলেও প্রেসটা যে ওঠে যায়নি তথ্য নির্দেশনায় দেখা যায়, কাঙাল হরিনাথের বংশধরগণ এই প্রেসের আয়ের উপর জীবিকা নির্ভর করে চলেছে। তাঁর চতুর্থ বংশধর অশোক মজুমদার নানা অসুস্থতায় মধ্য দিয়ে টেনে নিয়ে গেছেন তিনিও প্রয়াত হয়েছেন।
২০১৩ সালে জাতীয় জাদুঘরের আওতায় কাঙাল হরিনাথ মজুমদার জাদুঘর নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়ে ২০১৭ সালের ৯ ডিসেম্বর ‘ সাংবাদিক কাঙাল হরিনাথ মজুমদার জাদুঘর’ দর্শনার্থীদের জন্য দর্শনীর বিনিময়ে উন্মুক্ত করা হয়েছে।
এখন যা করা দরকারঃ
কাঙালের ঐতিহাসিক ছাপাখানা এম.এন প্রেস জাদুঘরে সংরক্ষণ করা। গবেষণাগার স্থাপনের ব্যবস্থা করা।
যাদুঘরে ‘গ্রামবার্ত্তা’ ও কাঙালের অপ্রকাশিত রচনাবলী সংরক্ষণের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি ও প্রকাশিত রচনাগুলো বাংলা কাঙাল রচনাবলী আকারে প্রকাশ করা।
আজ অব্দি সচলাবস্থায় এত পুরাতন প্রেস কোথাও আছে কিনা সঠিকভাবে জানা যায় না। বাংলা ভাষা সাময়িক সংবাদপত্র ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ জনকল্যাণ, সৎ সাংবাদিকতার আদর্শ ও উদ্দেশ্যে সততা, নিষ্ঠা ও আন-রিকতার সঙ্গে যথাযথভাবে গ্রামগঞ্জের তলদেশের অত্যাচার নিবারণ ও গ্রামবাসীর নানা প্রকার উপকার সাধন সহ বিশ্বদরবারে মাতৃভাষা সেবা করেন। সেই কারণে দূর মফঃস্বল থেকে প্রকাশিত হলেও সমকালে গ্রামবার্ত্তা একটি জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ সাময়িক পত্র হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে। কাঙাল হরিনাথ শিষ্য ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকার সম্পাদক রায় বাহাদুর জলধর সেন বলেন “বা
ঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাসে, বাঙ্গালা সংবাদপত্রের ইতিহাসে কাঙাল হরিনাথের নাম আলোচনায় কখনও কোনদিন তেমন করিয়া উল্লেখিত হয় নাই। পল্লীবাসী, জীর্ণকুটীরবাসী, শতগ্রন্থি যুক্ত মলিনবেশধারী কাঙাল হরিনাথের জীবনব্যাপী সাধনার সংবাদ কেহই গ্রহণ করেন নাই।” সাংবাদিকতার ইতিহাসে এমন সত্যনিষ্ঠ কলমি ক্ষুরধারের জন্য হরিনাথকে কম নিঃগৃহীত হতে হয়নি, কাঙালের সত্য সেবার মরমী কুশতত্ত্ব হয়ত পৌঁছে গেছে মানুষের কাছে।
তাঁর বাউল, কীর্তন, পাচালী ছাড়াও প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস, নাটক, ফিকিরচাঁদের গীতাবলী অপ্রকাশিত পান্ডুলিপি নিয়ে মোট ৪২ খানা গ্রন্থ আছে তাঁর। বিজয়বসন্ত তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। এছাড়া তাঁর বিখ্যাত একটি গান, ওহে দিনতো গেলো, সন্ধ্যা হল, পার করো আমারে”” সত্যজিৎ রায় তাঁর পথের পাঁচালী সিনেমায় ব্যবহার করেছেন। তা্ঁর এমএন প্রেস থেকে মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু ‘ উপন্যাস ছাপা হয়েছিল। এখান থেকেই মীর মশাররফ হোসেনের সম্পাদনায় হিতকরী, আজিজুন নেহার পত্রিকা সহ কহিনুর, শৈবী, সাহাজি, বঙ্গীয় তিলি সমাজ পত্রিকাও ছাপা হতো।
১২৩ বছর হলো আজ কাঙাল নেই। বাংলা ৫ বৈশাখ ১৩০৩ (১৮৯৬) এ দিনে তাঁর দেহবসান হয়। আর বাংলা ১২৪০ এর ৫ শ্রাবণ (১৮৩৩) তিনি কুষ্টিয়ার কুমারখালীর কুন্ডুপাড়ায় বাবা হলধর মজুমদার, মা কমলিনী দেবীর কোল জুড়ে এই আলোকিত মানুষ জন্মগ্রহণ করেন। নির্ভীক সৈনিকদের সংখ্যা কমে যেতে পারে শূন্য হয়নি এখনো। ফলে ভুলতে পারেনি মানুষ কাঙাল মনুষ্যত্বকে। গ্রাম সংবাদের পথ আগলে এগিয়ে চলেছে আজকের কলমসৈনিকেরা। তাই ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে সাংবাদিকতায় জাতীয় অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘কাঙাল হরিনাথ পদক’ প্রবর্তন করে উনিশ শতকের আলোকিত সংবাদকর্মী, গ্রাম সংবাদের জনক প্রাতস্মরণীয় কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের স্মৃতি ও নিদর্শন এর যথাযথ মূল্যায়ন এবং শেকড়কে সন্ধান করা জাতীয় কর্তব্য।
[লেখকঃ প্রাবন্ধিক, নাট্যকার]