| 10 অক্টোবর 2024
Categories
গদ্য সাহিত্য

স্মরণ: লেখালেখির প্রধান শর্ত স্বাধীনতা- হাসান আজিজুল হক

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

২০১৭ খ্রিস্টাব্দে মার্চের শেষ সপ্তাহে হাসান আজিজুল হক স্যার রাজশাহী থেকে ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসেন। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার জানালেন হাসান স্যার উঠবেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ভবনের অতিথিশালায়। আরো বললেন, তিনি যে কদিন থাকবেন নিয়মিত তাঁর ভালোমন্দের খোঁজ খবর যেন রাখি। স্যারকে দূর থেকে দেখেছি এবং শুনেছি কিন্তু এই প্রথম কাছ থেকে দেখব বলে আমি মুখিয়ে রইলাম। যথাসময়ে হাসান স্যার আসলেন এবং কেন্দ্রের অতিথিশালায় থাকার বন্দোবস্ত হলো। প্রতি বৃহস্পতিবার কেন্দ্রে গুণীজনদের একটি আড্ডা হয়। এটি ‘বৃহস্পতিবারের আড্ডা’ নামে পরিচিত। হাসান স্যারকে আড্ডা সম্পর্কে জানালাম। তিনি অংশগ্রহণে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। সেদিন আড্ডায় সায়ীদ স্যার ছাড়াও আড্ডার আরো অনেক নিয়মিত অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের বর্তমান চেয়ারম্যান সৈয়দ আজিজুল হক স্যারও উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন একজন সাবেক সচিব। তিনি নিজেকে বেশ ফলাও করে প্রচার করছিলেন। প্রতিবেশী কোনো এক দেশের প্রধানমন্ত্রী সফরে আসলে তাঁকেও তিনি তাঁর কবিতা শুনিয়েছেন ইত্যাদি আলাপ। খেয়াল করলাম এমন আত্মপ্রচার বা নিজের ঢোল পেটানো দেখে স্যার মনে মনে বিরক্ত হলেন এবং এক পর্যায়ে বলেই ফেললেন,। “শোনো হে, বড় লেখক নিজের কথা বেশি বলে না। বলে অন্যের কথা।”


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,Hasan Azizul Huq short story writer


আড্ডার পরদিনও এই সচিব যথারীতি নিজের কিছু বই নিয়ে হাজির হলেন। কথা প্রসঙ্গে বললেন, “কবিতা যখন লিখবে, কথাসাহিত্য যখন লিখবে তোমার চৌহদ্দি শুধু বাংলাদেশ এইটুকু কেন মাথায় রাখবে? সমস্ত বিশ্বে যে হাওয়া বইছে এই হাওয়া থেকেও নিঃশ্বাস নিতে হবে। সেজন্য তোমাকে উইলিয়াম ফকনারও পড়তে হবে, ওয়াশিংটন আরভিংও পড়তে হবে, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে পড়তে হবে, ও হেনরি পড়তে হবে- সবাইকে পড়তে হবে তখন কে কার চাইতে ভালো এই কথাটা আর উঠবে না। হেসে হেসে আবৃত্তি করলেন সুকুমার রায়ের ‘ভালরে ভাল’ কবিতাটি,

“দাদা গো! দেখ্‌ছি ভেবে অনেক দূর—

এই দুনিয়ার সকল ভালো,

আসল ভালো নকল ভালো,


কিন্তু সবার চাইতে ভালো—

পাঁউরুটি আর ঝোলা গুড়।।”

আবৃত্তি শেষেই আবার প্রাণখোলা হাসি। জীবনটা কী? জীবনটা হলো সত্যজিৎ রায়ের সেই ননসেন্স লিরিকাল চর্চার মতো,

“আদিম কালের চাদিম হিম,

তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম।”

ইঙ্গিতময় কথার সুর তিনি ধরতে পারছিলেন কিনা জানি না তবে স্যার সেদিনও আবার পুনরাবৃত্তি করলেন- নিজের নয়, অন্যদের বই বেশি পড়ব। নিজের বই না পড়লেও চলবে। কিন্তু যে মুহূর্তে লিখবে তখন মুহূর্তটিকে অবিস্মরণীয় করে তুলবে। কিন্তু আবার যখন পড়তে যাবে তখন মনে হবে পুরোটা তো হলো না। অহংকার, দর্প, গর্ব থাকবে না। আরো ভালো করতে চাইবে।

ফের সুকুমার রায়ের কবিতা থেকে আবৃত্তি করে শোনান,
শুনেছ কি বলে গেল সীতানাথ বন্দ্যো?
আকাশের গায়ে নাকি টকটক গন্ধ?
টকটক থাকে নাকো হলে পরে বৃষ্টি –
তখন দেখেছি চেটে একেবারে মিষ্টি।

ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা মানুষের প্রতি সচরাচর আমাদের সমাজে একটি মোহ থাকে কিন্তু তিনি আরো বড় ক্ষমতাবান বলে সুপরামর্শের সঙ্গে সঙ্গে এমন সূক্ষ্ম উপহাসও করেতে পেরেছিলেন সেদিন।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,Hasan Azizul Huq short story writer


হাসান আজিজুল হকের লেখার একটি বড় অনুষঙ্গ দেশভাগ। পার্টিশন লিটারেচারের প্রসঙ্গ এলে তাই তাঁর নাম অনিবার্য হয়ে ওঠে। ‘আগুনপাখি’ উপন্যাসের অভিজ্ঞতা তো তাঁর জীবন থেকেই নেওয়া। ইচ্ছা করেই সকাল গড়িয়ে দুপুর গড়ানো প্রহরে রুমে উপচেপড়া ঝলমলে রোদের উজ্জ্বলতায় উসকে দিতে চাইলাম সে স্মৃতি। যে স্মৃতি ফিরে ফিরে আসে তাঁর লেখায়। জানালেন বর্ধমানে পূর্বপুরুষের ভিটে মাটি ছিল। যদিও এখন সব ভাগ হয়ে গেছে। বিরাট একান্নবর্তী একটি পরিবার ছিল। বাবা, চাচা-চাচী, দাদা-দাদী, বিধবা ফুপু ত্রিশ পয়ত্রিশজন লোক এক সঙ্গে বাস করতেন। সেসব পুরনো দিনের কথা ভাবতে গেলে মায়ের কথা খুব মনে পড়ে। মায়ের সযতন সতর্ক চোখ বৃহৎ পরিবারের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তাঁকেও আগলে রাখত। মায়ের খুব ন্যাওটা ছিলেন।

লেখালেখির প্রধান শর্ত স্বাধীনতা

গ্রামেই স্কুলজীবনের শুরু। বলছিলেন, “শিক্ষক হতে চেয়েছি সিএসপি বা বিসিএস কর্মকর্তা হতে চাইনি। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম জীবনে শিক্ষক হব যাতে কারও কাছে আমার মাথা বিক্রি করতে হয় না। যাতে আমার ক্লাসে ভাইস-চ্যান্সেলর ঢুকলেও বের করে দিতে পারি এই বলে যে, “আমি তো এখন ক্লাস নিচ্ছি আপনি পরে এসে কথা বলেন। শিক্ষকতার বাইরে স্বাধীনভাবে লেখালেখি করতে চেয়েছি। লেখালেখির প্রধান শর্ত হলো স্বাধীনতা। সে স্বাধীন জীবনই যাপন করেছি। কখনো কারও কাছে মাথা নত করিনি।”

প্রত্যাখান করেছিলেন একুশে পদক

একান্ত আলাপে আরো জানান, একুশে পদক যেমন পেয়েছেন তেমনি এ পদক একবার প্রত্যাখ্যানও করেছিলেন ১৯৯৫ সালে। সেবার সরকারের শিক্ষাসচিব তাঁকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন পুরস্কারের জন্য তিনি মনোনিত হয়েছেন পুরস্কার নেবেন কিনা। যে পুরস্কার জিজ্ঞেস করে দিতে হয় সে পুরস্কার গ্রহণ করবেন না বলে মুখের উপর জানিয়ে দেন। যদিও পরে ১৯৯৯ সালে তিনি একই পুরস্কারে ভূষিত হন। আলাপচারিতায় প্রাসঙ্গিকভাবে জ্যাঁ পল সার্ত্রের নোবেল প্রত্যাখানের কথাও আসে। একই সঙ্গে টলস্টয়ের কথাও। নোবেল কমিটি নাকি টলস্টয়ের কথা বিবেচনা করছিল। টলস্টয় বলেছিলেন, “আমি শুনতে পেয়েছি আমার কথা পুরস্কারের জন্য বিবেচনা করা হচ্ছে এটা যেন কদাচ না করা হয়।” এরা তো আমার চাইতে অনেক অনেক বড় লেখক। এসব পুরস্কার তোয়াক্কা করে তো আর লেখক হওয়া যাবে না। ক্ষুদে লেখক হতে পারি কিন্তু ওইটুকু সাহস ছিল নিজের আত্মমর্যাদের সঙ্গে আপস না করার।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


‘উজান’ স্রোতের বাসিন্দা

ছিলেন আজীবন প্রগতিশীল মিছিলের অগ্রসৈনিক। আদর্শিক বিশ্বাসের সঙ্গে আপস করেননি, মুখের উপর রূঢ় সত্য বলতে কুণ্ঠিত হননি বলে জীবননাশের হুমকিও এসেছে বারবার। জানান, কেটে টুকরো টুকরো করে বঙ্গোপসাগরে ভাসিয়ে দেওয়ার হুমকি টেলিফোনে দিয়েছিল প্রতিক্রিয়াশীলরা। নির্বিকার থেকেছেন। সাহসের সঙ্গে সেসব প্রতিকূল সময় মোকাবেলা করেছেন। খেদও প্রকাশ করেছেন এই বলে যে, “কোথাও কোথাও আমাদের হারও হয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের যে কোনো নাগরিক যে কোন ধর্মে বিশ্বাস করতে পারে। কেউ যেমন আস্তিক হতে পারে তেমনি কেউ নাস্তিকও হতে পারে।” কিন্তু আমরা সে সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে তুলতে পারলাম কই? ছিলেন উজান স্রোতের যাত্রী। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হাউজিং সোসাইটির (বিহাস)-এ নিজের বাড়িটির নামও তাই রেখেছিলেন ‘উজান’।

সেদিন আলাপচারিতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত ফটোগ্রাফার গোলাম মোস্তফা স্যারের এক প্রশ্নের উত্তরে আহসান লিটন নামে একজন স্যারের উপর একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন সে তথ্যও জানতে পারি। নির্মাতা রাজশাহী থেকে হাসান স্যারের জন্মভূমি বর্ধমানেও যান। ‘আগুনপাখি’ উপন্যাসটি কলকাতায় মঞ্চস্থ হয়। চন্দর কোথায়—নাটকটি ঢাকায় মঞ্চস্থ হয়। হিন্দুরা এ দেশে কিরকম ছিল এ নিয়ে ‘খাঁচা’ নামে একটি গল্প আছে সেটি নিয়ে আকরম খাঁন নামে একজন পরিচালক সরকারি অনুদারের অর্থে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের কথাও জানতে পারি।

দুদিনের অন্তরঙ্গ সময়ে কতই না বারোয়ারি প্রসঙ্গ এসেছে। আমাদের এ আলাপচারিতায় বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রথম ফটোগ্রাফার একুশে পদকপ্রাপ্ত সদ্যপ্রয়াত গোলাম মোস্তফা স্যারও উপস্থিত ছিলেন। তিনি বৃহস্পতিবারের আড্ডায় স্যারের কিছু ছবি তোলার আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং পরদিন ক্যামেরাসহ হাজির হন। আমাদের আলাপচারিতার ফাঁকে ফাঁকে স্যারের বেশ কিছু ছবিও উঠানো হয়। সঙ্গত কারণেই উপস্থিত সাবেক সচিবের নাম এড়িয়ে গেলাম। শুধু লেখক নন তিনি যথার্থই একজন গণবুদ্ধিজীবীও ছিলেন যিনি বিবেক ও বিশ্বাসের দায় এড়িয়ে শুধু মনোরম সাহিত্যচর্চা করেননি। প্রতিক্রিয়াশীলদের দুর্গে তিনি সবসময় প্রগতির পতাকা উড়ানোর যুদ্ধটাও করে গেছেন।

 

 

 

ছবি কৃতজ্ঞতা: একুশে পদকপ্রাপ্ত সদ্যপ্রয়াত ফটোগ্রাফার গোলাম মোস্তফা।

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত