Irabotee,irabotee.com,ইরাবতী,শৌনক দত্ত,sounak dutta,copy righted by irabotee.com

আত্মকথন

Reading Time: 4 minutes

কাউকেই ভালো লাগে না। মিশতে গেলে এক ধরনের তীব্র আতঙ্ক তৈরি হয়। সবাই যত স্বাভাবিক মেলামেশা করতে পারে, তার কিছুই পারি না। ছোটবেলা থেকেই এই সংকোচটা আমার মধ্যে কাজ করে চলেছে। এর পেছনে একটা ছোট্ট গল্প আছে। আমি তখন স্কুলেই ভর্তি হই নি। সবার বাসায় যেমন অতিথি আসে, আমাদের বাসায়ও সেবার একজন অতিথি এলো। বেশিরভাগ অতিথিই কিছু না কিছু হাতে করে নিয়ে আসে। সেই অতিথিও খালি হাতে আসেনি। সাথে এনেছিলো দুই রকমের মিষ্টি আর ঝাল সমুচা। আমি তখন জানতাম না যে অতিথি কিছু নিয়ে আসলে সেখান থেকে অতিথিকেও খেতে দিতে হয়। মা যখন সেখান থেকে খাবার নিয়ে অতিথিকে দিতে যাচ্ছেন তখনই আমি অবুঝের মতো বলে উঠেছিলাম-মা, এসব তো আমাদের জন্য উনি এনেছেন। তুমি ওনাকে এসব দিচ্ছো কেন?

গলার স্বর সামান্য উচ্চ পর্যায়ে থাকায় সেই কথাগুলো অতিথির কানে যে পৌঁছে ছিলো সেটা তার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো। অতিথি যাবার পরই মা সেদিন আমাকে ঠাস করে এক থাপ্পড় মেরেছিলেন। পরে বাবা সব ঠান্ডাভাবে বুঝিয়ে বললেও বহুদিন আমি থাপ্পড় মারার কারণ বুঝে উঠতে পারিনি। এই বয়সে এই ঘটনা ভাবলেই লজ্জা লাগে। সেই অতিথির সাথে একবার দেখা হয়েছিলো আমার। ভদ্রলোকের সাথে মোটেও স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারিনি।

কারো সাথে মেশার সময় যে দুশ্চিন্তা আমার তৈরি হয় তার জন্য আমার নিজেরও কিছু দোষ আছে।যেমন ছোটবেলায় আমি খুবই খেলাধুলা করার সুযোগ পেতাম। বাবা-মা থাকতেন অফিসে। বড় বোন তার কলেজ আর কোচিং নিয়ে ব্যস্ত। কাজেই আমার বেশিরভাগ সময় কাটতো একলা বাসায় বন্দি অবস্থায়। মাঝে মাঝে সামান্য আঁতকে উঠতাম যখন হঠাৎ করে কোনো ফকির বেল টিপে কর্কশ গলায় বলতো, আম্মা একখান ভিইক্ষা দিফেন?

আমার তখন “অন্যদিকে যান” কথাটা বলতেও গলা কাঁপতো।

নিচে নেমে যখন আমি খেলাধুলা করতাম তখন আমি যেন পুরোপুরি স্বাধীন। সেই স্বাধীনতা আমি মুখ দিয়ে প্রকাশ করতাম। সেই প্রকাশ কেউই সহ্য করতে পারলো না। একদিন যাদের সাথে খেলতাম সবাই আমাকে ডেকে বললো তারা আমার সাথে আর খেলবে না। কারণ তাদের বাবা মা নিষেধ করেছেন। আমার মুখের ভাষা বলে অনেক খারাপ। সেদিন বাসায় এসে অনেক কেঁদেছিলাম। এরপরে তারা আমাকে আবার খেলায় নিলেও আমার আর বন্ধু হতে পারে নি। হয়ত তারা চায়নি, কিংবা আমি চাইনি।

বড় হবার সাথে সাথে এইসব সুপ্ত ভীতি যেন আরো বাড়ছে। স্কুলে পড়ার সময় বহু ছেলের সাথে আমার পরিচয় হলো। তাদের সাথে আস্তে আস্তে ঘনিষ্ঠতাও বাড়ছিলো। আমাদের মধ্যে এক ছেলে ছিলো নাম রাদিফ। সে সামান্য উগ্র স্বভাবের ছিলো।

একদিন সে স্কুলে আসলেও স্বভাবত আমরা সবাই টিফিন পিরিয়ডে জড় হলাম গল্প গুজব করার জন্য। কিন্তু সেই সময়টা মোটেও আমার জন্য সুখকর ছিলো না। কারণ সবাই রাদিফের বদনাম করছিলো। একজন দেখলাম তার বাবাকে নিয়ে যথেষ্ট কটুক্তি করলো। তার বাবা বলে বিবাহিত অবস্থাতেই তার এক আত্মীয়ের মেয়ের সাথে পরকীয়া করেছিলো। এসব দেখে ও শুনে মনে হয়েছিলো তারা আজ রাদিফের বদনাম করছে, তার মানে একদিন আমাকে নিয়েও বদনাম করবে। পুরো ক্লাসের ছেলেরা তখন আমার বদনাম শুনে এখন যেভাবে হাসছে ঠিক সেভাবে হাসবে।

সেদিনের পর আমি আর ক্লাসের গল্প গুজবে অংশ নেইনি। যতক্ষণ টিফিন পিরিয়ড থাকতো আমি স্কুল মাঠে বসে থাকতাম।

তাই বলে নিজেকে নিয়ে যে বদনাম কখনো শুনিনি তা নয়। একবার বাসা থেকে বের হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামছি তখনই শুনলাম নিচের দুই আন্টির মধ্যে কথা হচ্ছে। তারা কথা বলছে তিনতলার ছেলেটার অর্থাৎ আমার ড্রেস আপ নিয়ে। আমার কোনো ড্রেসই বলে স্টাইলের সাথে মিলে না। তাদের এই নিষ্ঠুর আলোচনার মাঝেই আমি তাদের সামনে দিয়ে নেমে গেলাম। কিন্তু তাদের কোনো ভাবান্তর হলো না। এবং ততক্ষণে কোনো খাবারে কি মশলা দিতে হয় তা নিয়ে আলোচনা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

আমি যে একদম লাজুক ছিলাম তা নয়। তবে আমি যখন ক্লাস টেনে পড়ি তখন দেখলাম আমার অনেক ক্লাসমেটেরই প্রেমিকা আছে। তাদের সেই সুন্দর মুহুর্তের গল্প আমার ভালো লাগতো। গভীর আগ্রহে আমি সেসব শুনতাম। আমারো একজনকে পছন্দ ছিলো। তার নাম মনীষা। মনীষাকে আমি দেখেছিলাম স্কুলের সায়েন্স ফেস্টে। আমাদের মধ্যে মোটামুটি কথাও হতো। ক্লাস টেনে পড়লেও অন্যদের মতো আমার এসব নিয়ে এত ধারনা ছিলো না। ততদিনে আমি সামান্য কবিতা-টবিতা লিখি।ওকে যে আমি পছন্দ করি সেটা কবিতা লিখে একদিন ওকে ম্যাসেঞ্জারে জানালাম।

পরদিন স্কুলে এসে দেখি বিরাট বিপত্তি ঘটে গেছে।মনীষা সেই কবিতা সবাইকে দেখিয়ে আমাকে নিয়ে অনেক বাজে কথা বলেছে। ক্লাসে আমাকে নিয়ে সেদিন অনেক হাসাহাসি হলো। সবার এইসব তামাশা আমার ক্লাস টেনের সব মুহুর্ত নষ্ট করে দিলো। মনীষা এরপর থেকে আমার সাথে আর কথা বলেনি। আমিও আর কথা বলার চেষ্টা করিনি।

তাই বলে কখনোই যে কোনো মেয়ের সাথে আমার ভাব ছিলো না তা নয়। ছোটবেলা থেকে আমি আর অর্ণা একসাথে বড় হয়েছি। অর্ণা আমাদের পাশের বিল্ডিংয়ে থাকতো। আমাদের মধ্যে একটা সুন্দর বোঝাপড়া ছিলো। ও অন্যদের মতো আমি কবিতা লিখি তা নিয়ে হাসি-তামাশা করতো না। আমরা প্রায়ই রাত জেগে অনেক কথা বলতাম। দুজনে মিলে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যেতাম। আমি মনের বশে বিভিন্ন বার ওর কাঁধে হাত রেখেছি, ওর হাত ধরেছি। চোখের কাছে চুল এসে গেলে সরিয়ে দিয়েছি। ও এসব খারাপভাবে দেখতো না। আবার আমিও খারাপ উদ্দেশ্যে এসব করতাম না। কিন্তু একদিন অর্ণা আমাকে বললো ওর কপাল ছুঁয়ে আমি একদিন জ্বর এসেছে কিনা দেখেছিলাম সেটা ওর প্রেমিক পছন্দ করেনি। ওর প্রেমিকের মতে আমি অসভ্য। তাই ও আর আমার সাথে বেশি মিশতে পারবে না। তবে ম্যাসেঞ্জারে কথা বলতে পারবে। এই কথাগুলোয় যে আমি কত আঘাত পেয়েছিলাম তা ও বুঝেনি। এখন আর ওর সাথে ওত ঘোরাও হয় না আবার ওর সাথে কথাও হয় না।

লেখালেখির শখ অনেক থাকায় আমি এস.এস.সি পাশের পরই এক সাহিত্য পত্রিকার সাথে যুক্ত হলাম। লেখার হাত ভালো হওয়ায় কিছুদিনের মধ্যে আমি সম্পাদকের প্রিয় হয়ে উঠলাম এবং তাদের সাপ্তাহিক আড্ডায় একদিন ডাক পেলাম।

কিন্তু সেসব আড্ডাতেও দেখি একই অবস্থা। বিভিন্ন লোকের বদনাম চলে। সেসব বদনাম আমার ভালো লাগে না।

একদিন চুপচাপ পত্রিকার অফিসে বসে আছি তখনই লিটন ভাই আসলেন। তিনি পত্রিকায় নির্বাহী সম্পাদক। তিনি এসে অনেকক্ষণই আমার সাথে কথা বললেন। কিন্তু সমস্যা হলো এর পরে। উনি সম্পাদককে গিয়ে বললেন আমি ওনার সাথে বেয়াদবি করেছি। আমার কথাবার্তার স্টাইল বলে জঘন্য। সেদিন প্রতিবাদ করতে ইচ্ছা করলেও মুখ থেকে একটা শব্দও বের করতে পারিনি।

এভাবেই আমি বড় হচ্ছি। স্কুল পেরিয়ে এখন কলেজে। কিন্তু সব জায়গায় এই একই অবস্থা।সবাই এসব স্বাভাবিক ভেবে নিয়ে জীবনের একটা অংশ বানিয়ে নিলেও আমি এটা পারি না। ফলে আমি এখনো বন্ধুহীন। সময় কাটে একা। যেখানে আমার একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সময় কাটাবার কথা। আমার ভয় হয়, আমার পুরা জীবনটাই একা কাটবে কিনা। কিন্তু মাঝে মাঝে অর্ণা ফোন দিয়ে আমার খবর নেয়। তখন মনে হয় নাহ! আপাতত আমি একা নেই। একজন অন্তত আছে।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>