হুমায়ূন ভাই, ডাক পাড়ি

Reading Time: 3 minutes
নিচের দিকের ক্লাসেই পড়ি। হুমায়ূনজ্বরে আক্রান্ত। তিনি এসেছেন বিভাগীয় গণগ্রন্থাগারের আয়োজিত মেলায়। সেই রাইফেল ক্লাব থেকে লম্বা লাইন। লাইব্রেরি ভবনের সামনে হুমায়ূন আহমেদ বসে আছেন। লাইনে একটি বালক দাঁড়িয়ে। হাতে খাতা। একটিই প্রশ্ন লেখা
আমরা যা বুঝি কিন্তু বলতে পারি না আপনি তা বোঝেন ও বলে ফেলেন, এইজন্যেই আপনি জনপ্রিয়। মন্তব্য করুন।
লাইন এগিয়ে যাচ্ছে। আমার সামনে পড়তেই খুবই ইমোশনাল আমি প্রণাম করে বসলাম। রীতিমত পায়ে হাত দিয়ে। তিনি প্রশ্নটি পড়লেন। চটজলদি কিছু একটা লিখলেন। দেখি আমার দেখাদেখি প্রণামের ঢল নেমেছে। মঞ্চে বাংলাদেশের  ফেসবুক বুস্টিংহীন জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ। 
এ-ই আমাদের একমাত্র দেখা হওয়া। কলেজে উঠে ‘অন্যদিন’ পত্রিকায় লেখার সূত্রে আবার তাঁর লেখা ধারাবাহিক পড়ি। কিন্তু কোনোদিন তাঁর কোনো ধারাবাহিক উপন্যাস শেষ হতে দেখি নাই৷ মনে আছে, লুৎফর রহমান রিটন দারুণ এক কাগজ করেছিলেন ‘ছোটোদের কাগজ’ নামে। সেখানে ‘কালো যাদুকর’ ধারাবাহিক শুরু হল কিন্তু শেষ হলো না, বই বেরিয়ে গেলো বইমেলায়। এসবে বিরক্তি হতো আবার ‘দেশ’ পত্রিকার শারদে টানা আট বছর আটটা উপন্যাস পেয়েছিলাম। অন্যদিন ঈদসংখ্যা তো ছিলোই। একবার বিদেশ গিয়ে তিনি ইন্টারভিউতে বললেন, বাংলাদেশে সবচে সস্তায় চাল পাওয়া যায়৷ একটা প্রতিবাদ চিঠি দিলাম। ছাপলো না। ‘হাউজের লেখক’ জিনিসটা তখন বুঝি না, বয়স কম। সব প্রতিবাদযোগ্য জিনিসেই সাড়া দিই৷ একবার ফিলিপস আয়োজন করলো গল্পলেখার প্রতিযোগিতার৷ তিনি বললেন, তরুণরা চরিত্র নির্মাণ করতে পারে না। আবার চিঠি দিলাম। সেটাও ছাপা হলো না৷ বাল্বের খালি প্যাকেট, টুথপেস্টের খালি প্যাকেট পাণ্ডুলিপির সাথে পাঠানোর এ-ই পদ্ধতি আস্তে আস্তে অশ্লীল লাগতে থাকে৷ ততদিনে সুবিমল মিশ্রের সাথে পরিচয় হচ্ছে৷ 
শরৎ বাবুর ‘শ্রীকান্ত’ একজীবনে প্রচুর ঘুরে বেড়িয়েছে৷ সন্দীপন শরৎচন্দ্রের ভাষাকে ‘কাঁচা পায়খানা’র সাথে তুলনা করলেও বলেছেন, এ-ই এক লেখক যিনি গাড়ি চড়ে আসেন৷ তো, শ্রীকান্তের এ-ই ভ্রমণশীলতা বাঙালিজীবনেরই এক বিশেষ সৌন্দর্যের প্রতীক। সমরেশ বসু যেমন কালকূট ছদ্মনামে বেশ কিছু ভ্রমণ উপন্যাস লিখেছেন৷ এখানে ভ্রমণের নানান অভাবিত বিবরণের সাথে যাপনের নানা দার্শনিক প্রশ্ন তোলা হয়েছে। কুম্ভ মেলা নিয়ে কালকূট রচিত ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’ আমরা কে না পড়েছি! এক উদাসীন দার্শনিকতা সেখানে মানবপ্রকৃতির মত ছড়িয়ে আছে। সিনেমাও হয়েছিলো পরে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, স্ট্রাগলিং জীবনে অসংখ্য লেখা লিখতে হয়েছিলো। এসব লেখার মাঝেই জন্ম নিলো নীললোহিত। এক যুবক যার পকেটে পয়সা থাকে না। দাদাবৌদির সংসারে থাকা এক নিম্নমধ্যবিত্ত বাঙালি যুবক। যার হৃদয়ে ঘুরে বেড়ানোর বাসনা অথচ এক রত্তি পয়সা নাই৷ 
হুমায়ূন আহমেদের হিমু’র গন্ডীটা বড়ো ছোটো, ঢাকার আশেপাশে, সংকট সামগ্রিক নয়, কাকতাল প্রায়ই প্রধান আশ্রয়। বাঙালি কল্পনার আশ্রয় যে নারী সেই নারী নীললোহিতে মার্গারিটা আর হিমুতে রূপা। শেষ দিকে হিমু র‍্যাব নিয়ে, রিমান্ড নিয়ে সরস ভঙ্গিতে উচ্চকিত হয়েছিলো৷ হুমায়ূন লিখেছিলেন, প্রকৃতির রিমান্ড থেকে কারো মুক্তি নেই৷ 
মিসির আলীর আত্মিক পরিচয় তিনি ঈশ্বরে অবিশ্বাসী। নাস্তিক। কালের ক্রেজ জয়া আহসান প্রযোজিত ‘দেবী’ সিনেমায় এ-ই সত্য পরিচয়কে আড়াল করে বস্তাপচা ভূতের গল্প তৈরি করা হয়েছে। এমনকি কুব্রিকের শাইনিং ছবিতে যেমন জোড়া বাচ্চা মেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে এখানেও কাট টু কাট। সে যাক, মিসির আলী যুক্তির সন্ধানী। প্রথম দুটি বই তো তুলনারহিত। দেবী আর নিশীথিনী। 
নাটকের হুমায়ূন অন্য হুমায়ূন। নাটক দেখা, টেলিভিশনের সামনে বসা যে পারিবারিক উৎসব, সবাই মিলে আরেকটু ঘেঁষে থাকা, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী দেশে এটা তাঁর একক অবদান। যারা বলেন, নাটকে সস্তা ভাঁড়ামি করতেন তিনি তাঁদের প্রশ্ন খাদক নিমফুল কিংবা অয়োময়ের কাছাকাছি তুল্য কিছু বাংলা ভাষার নাটক মাধ্যমটিতে থাকলে জানান। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ বিপক্ষ নিয়ে আজকাল অনেক নতুন কথা শুনি।  কিন্তু সরকার অধ্যুষিত গণমাধ্যমে পাখির মুখে ‘তুই রাজাকার’ বলানো কিংবা ‘জলিল সাহেবের পিটিশন’ এ-র মতন গল্প লেখা যখন ঘাতক দালালের বিচার অনেক দূরের বস্তু, কঠিন কাজ!
আগুনের পরশমণি-র মতন অসামান্য সিনেমার নির্মাতা কেমন করে দুই দুয়ারী, নয় নম্বর বিপদ সংকেতের মতন জিনিস বানায় তা-ও প্রশ্নসাপেক্ষ। তবে, প্রত্যেক বড় লেখকই জীবনের শেষ দিকে একটা ‘ডেসপারেট ড্রাইভ’ দেন, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে ‘আলো নেই’, আহমদ ছফা’র ক্ষেত্রে ‘অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী’, সমরেশ বসু’র ক্ষেত্রে ‘দেখি নাই ফিরে’ আর হুমায়ূন আহমেদের ক্ষেত্রে ‘দেয়াল’ আর ‘ঘেঁটুপুত্র কমলা’। মাঝে মাঝে বাংলা সিনেমার পূর্বসুরীহীন এমন ফিল্ম কেমন করে নির্মাণ সম্ভব!
প্রথম কৈশোরে আমরা বন্ধুরা প্রকাশ করেছিলাম ‘নাব্যিক’ বলে এক পত্রিকা। সেইখানে তাঁর আদলে এক লেখককে নিয়ে গল্প লেখা হয় যিনি টাকা ছাড়া কিছুই বোঝেন না! অসংখ্য উপন্যাস পড়ে বিরক্ত হচ্ছিলাম। যেমন, অনুবাদগুলি। নিজেই বলছেন, খানিকটা পড়ে বই চাপা দিয়ে নিজের মত লিখছেন৷ এ-ই জায়গায় তিনি পুরো ব্যর্থ, আর কোথাও না। একটি উদাহরণ ‘ম্যান অন ফায়ার’ এ-র হুমায়ূনকৃত ‘অমানুষ’ আর কাজী আনোয়ার হোসেনকৃত মাসুদ রানা সিরিজের ‘অগ্নিপুরুষ’। মনে পড়ে, মৃত্যুর আগে আগে ‘নিউইয়র্কের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ’ এ-র কথা। কী সুন্দর বই! একইসাথে মনে পড়ে, ‘মেঘের ওপর বাড়ি’- র থিমটুকু বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দেবযান’ উপন্যাসের সাথে মিলিয়ে কেন যে মনে পড়ে!
আমরা সেই ছিয়ানব্বই সালে ছয় সেপ্টেম্বর সালমান শাহের মৃত্যুর পর দেখেছিলাম অসংখ্য সালমানপ্রতিমের উদয়। ফেরদৌসের প্রথম পর্দা আবির্ভাব তো সালমানের বডিডাবল হয়ে ‘বুকের ভেতর আগুন’ ছবিতে। তাঁর হত্যাকান্ডের পর প্রযোজকের পক্ষে জরুরি ছিলো, পয়সা তুলে আনা। 
হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর বাংলাদেশের পপুলার সাহিত্য বাজার সংকটে পড়েছে। আমরা দেখতে হুমায়ূনপ্রতিম অনেকে এ-ই বাজারঘাটতি মেটানোর চেষ্টায় আছেন।  যিনি সবসময় জললগ্ন মানুষের কথা লিখতেন তিনিও এই বাজারের অংশ নিতেই মধ্যবিত্ত জীবন নিয়ে লেখা শুরু করলেন। এসব-ই ঠিকঠাক হয়তো। কিন্তু বাজারবাস্তবতাকে মান্য করে যে নানাবিধ ভুল স্বপ্নের অনুপ্রেরণামূলক, বিদেশী বইয়ের কপিপেস্টমার্কা বইয়ের বিশাল বাজার গড়ে উঠেছে, আমার শৈশব কৈশোরের প্রেমিক লেখক হুমায়ূন আহমেদ দেখলে কী ভাবতেন এখন মাঝে মাঝে চিন্তা করি।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>