| 25 অক্টোবর 2024
Categories
এই দিনে কবিতা পাঠ প্রতিক্রিয়া সাহিত্য

পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ ধ্বংস! চুমু আঁক ও তিনটি কবিতা

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

আজ ১৫ জুন কবি শুভদীপ ঘোষের জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার কবিকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা। ইরাবতীর পাঠকদের জন্য রইলো কবি ও সম্পাদক শৌভিক রায়ের লেখা শুভদীপ ঘোষের কাব্যগ্রন্থ ধ্বংস! চুমু আঁক’র পাঠপ্রতিক্রিয়া।


দশক দিয়ে কবি ও কবিতা বিচারের একটি প্রবণতা আছে। যাঁরা সেটা করেন নিশ্চয়ই সঙ্গত কারণেই করেন। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমি এভাবে দশক মেপে কবিতার বিচারের পক্ষপাতী নই। একজন কবির রচনায় সমকাল ছাড়াও অতীত প্রভাব ফেলতে পারে আর কবি দ্রষ্টা বলে ভবিষ্যতকে নিজের মতো দেখতে পারেন। ঠিক এই জায়গায় দাঁড়িয়ে দশকের সাহায্যে কবিকে চিহ্নিত করা ঠিক নয় বলেই মনে করি।

শুভদীপ ঘোষের ‘ধ্বংস! চুমু আঁক’ কাব্যগ্রন্থের পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখতে বসে একথাই মনে এলো সর্বাগ্রে। কেননা শুভদীপকে ঠিক কোন দশকের কবি বলব সে বিষয়ে আমার ধন্দ রয়েছে। কাব্যগ্রন্থের শুরুতে ‘বিবর্তনবাদ’ কবিতায় যখন শুভদীপ বলছেন ‘কবিতার পাতা ছিঁড়ে উড়ে যাক/হাওয়ার কাগজ/শঙ্খচিল কাগজের নৌকো’ তখন রচনাটিকে বর্তমান থেকে বেশ খানিকটা পিছিয়ে পঞ্চাশ ষাট দশকের লেখার মতো মনে হতে পারে। আবার ‘ব্লাউজের হুকের ভিতর হরিণের মাংস/আর লালাতে জড়িয়ে/বাঘের চ্যাট চ্যাটে/হা ক্ষিদে’ যেন শূন্য দশকের পরবর্তী সময়ের উচ্চারণ।

আসলে একজন কবির দেখাটা এতটাই বহুরৈখিক যে কোন নির্দিষ্ট সময়ের গন্ডিতে তাকে বোধহয় আটকে রাখা ঠিক নয়। কবির বয়সকাল বা লেখার সময়কাল বোঝাতে দশকের ব্যবহার আলাদা ব্যাপার কিন্তু নির্দিষ্ট সময় ফ্রেমে কবিকে আটকে রাখলে তা বোধহয় কবির প্রতি অবিচার করা হয়।

সেই দৃষ্টিকোণ থেকে শুভদীপের প্রথম কাব্যগ্রন্থকে কোনো সময়কালে বাঁধতে চাইছি না। কবিতাগুলি আমাকে বিভিন্ন সময়ে পরিভ্রমণ করিয়েছে নিজের মনের টাইমমেশিনে। তবে শুভদীপের গদ্যের যে ধার, তা সব কবিতায় পাই নি। এটা অকপটে স্বীকার করছি। গদ্য লিখিয়ে শুভদীপকে কবিতা লিখিয়ে শুভদীপ তার প্রথম কাব্যগ্রন্থে, অন্তত আমার কাছে, অতিক্রম করতে পারে নি। অবশ্য মনে রাখতে হবে যে এটি শুভদীপের প্রথম কাব্যগ্রন্থ। কবি হিসেবে সবে যাত্রা শুরু। আগামীতে শুভদীপ আমাকে ভুল প্রমাণ করলে সবচাইতে খুশি আমি নিজেই হব।

‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে’ শীর্ষক দুটি কবিতা শুভদীপের অন্তর্ভেদী দৃষ্টির পরিচয় দিয়েছে। শুধু একটাই মজা। যে তৃতীয় নয়ন অপরিহার্য বলে কবি ঘোষণা করছেন সেই তৃতীয় নয়নই তাকে দেখাচ্ছে ‘পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায়/অহংকারের ফাটল ধরে/হু হু করে ঢুকে পড়ে জল/বহুতল বাড়ি তলিয়ে যেতে যেতে/ছাদের উপর লাইফ জ্যাকেট আগলে রাখে/রাজা;/আর/আকাশ থেকে খসে পড়ে/বিদূষক’। এই শ্লেষ চরমে পৌঁছচ্ছে ‘চুমু খেতে খেতেই মানুষ সর্বভূক’ উচ্চারণে।

এরকম আরও অনেক স্মার্ট, টানটান উচ্চারণ আছে কাব্যগ্রন্থের আটাশটি কবিতার অনেকগুলিতে। ‘যেমন খুশি সাজো’, ‘সিলিং ফ্যান আর সুইসাইড’কে স্বতন্ত্র ধারার রচনা বলে মনে হয়েছে। ভাল লেগেছে ‘হিউম্যান সং আর বিষন্ন পাপ’ এবং বাবার স্মৃতিতে লেখা ‘চন্দ্রবোড়া’। ভীষণ স্পর্শ করে ‘সাপ খোলস ছেড়ে ঈশ্বর রূপ লাভ করে/ আর কোটরের ভিতর দেখছি কেবল/ বাস্তু চন্দ্রবোড়া সাময়িক ঘুমিয়ে আছে’। বড় মেদুর করে তোলে এই লাইনগুলি।

‘মুজনাই, তোমাকে’ কবিতাটি কাব্যগ্রন্থের শেষ কবিতা। কোন পক্ষপাতিত্বে নয়, কাব্যগ্রন্থের অন্যতম সেরা বলে হয়েছে এই কবিতাটিকে। এখানে চিত্রকল্প অন্য মাত্রা পেয়েছে শেষ দু’লাইনে-
‘জলের মত কতটা সহজ তরল হলে
নদীর দর্শন বুকের ভিতর বইতে দেওয়া যায়।’
সহমত কবির কথায়। তবে একটু বলি, জলের মতো সহজ তরল হওয়া কিন্তু সহজ নয়…সকলে পারে না।

গ্রন্থটির বাঁধাইয়ে যত্নের প্রচন্ড অভাব মন খারাপ করে দেয়। কিছু মুদ্রণ বিভ্রান্তি চোখে পড়লো। কাগজ চলনসই।

শুভদীপের আগামী সুন্দর হ’ক কবিতা-সহ সৃষ্টির অন্য ধারায়।

ধ্বংস! চুমু আঁক

শুভদীপ ঘোষ

প্রকাশক: বার্তা

প্রকাশনমূল্য: ৫০ টাকা

শুভদীপের কবিতাঃ

 

আগুনের ডাইরি থেকে

বিশ্বাস করো সুলগ্না ; আমি জানি ।
…আমি বুঝি।

শরীরের ভিতর গা গুলিয়ে উঠছে ক্রমশ।
…কিন্তু হসন্ত আমার গলা টিপে ধরেছে।

এমন নয় যে ঈশ্বর কিংবা তুমি প্রশ্ন করোনি !

– নাভির চারপাশে ব্যথা হলে বুঝি
বড্ড অপাচ্য হয়ে যাচ্ছে সমাজ।
ধ্যানস্থ প্রকৃতি ক্লোরোফিলের সবুজ
পাতাদের রান্নাঘরে
খিদের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে।

কিন্তু বোধের প্রথম উচ্চারণ
সাপের জিভের ভিতর থেতলে দিচ্ছে আমাদের সন্তাপ।

চৌকিদার স্বপ্ন দেখাচ্ছে
দেওয়ালের লিখন পাল্টে দিচ্ছে
বর্ণমালার শোকার্ত শরীর ,
একটা একটা ইটে লেগে আছে পোড়া মাটির দাগ।

আমার ভিতর কতশত ছাব্বিশ দিন অনশন ক’রে
রাস্তায় রাস্তায় জেব্রাক্রশ
না দেখে পার হতে গিয়ে পিষে গেছে।
লাল আলোয় উপুড় হয়ে পড়ে গেছে শরীর।

দ্যাখো আবহাওয়া দপ্তর থেকে চিঠি এসেছে !
বিশ্বাস করো সুলগ্না পূর্বাভাসে ঘনিয়ে আসছে
বিপ্লব ! বিপ্লব ! বিপ্লব !

সুলগ্না তুমি ঘুঙুর বাধো পায়ে–
প্যারেড গ্রাউন্ডের পাঁচিল গুঁড়িয়ে দেবার সময় এসেছে।

 

 

 

পুরুষ হতে চাইছি

লম্পের আগুন
বায়ুঘর
আল জিবের আড়ষ্ঠতা
জলবায়ুর কবিতা ছেড়ে

চাঁদ তুমি আজ আমলকি বনে
নেমে এসে দেখো

চন্দ্রমাস নখ কাটিনি
বীর্য পাত করি নি

লিঙ্গ বাদ দিয়ে

ভীষণ ভাবে পুরুষ হতে চাইছি ।

 

 

স্বপ্নের রং

আস্তাবলের ভিতর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে
ঘুমিয়ে আছে
আস্ত শহর

বেজে যাচ্ছে চন্দ্রবিন্দুর রিংটোন
বালিশ চাপার ভিতর

পাথর ভাঙছে নদী
মোহনার রাস্তায় নদীর শরীর ফুলে যেতে দেখছি

আমি ফেরি করি স্বপ্নের রং

অনিবার্য বৃষ্টির আগে
বুকের উপর ঝরে পড়ে
ময়ূর পালক ।

 

 

 

 

.

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত