| 6 অক্টোবর 2024
Categories
উপন্যাস সাহিত্য

সম্পূর্ণ উপন্যাস: হারবার্ট । নবারুণ ভট্টাচার্য

আনুমানিক পঠনকাল: 64 মিনিট

এক

“চরণে বন্ধন নাই, পরাণে স্পন্দন নাই,
নির্বাণে জাগিয়া থাকি স্থির চেতনায়।”

-বিজয়চন্দ্র মজুমদার

.

-ভালো করে ঘুমোক। ঘুমোলেই ঠিক হয়ে যাবে।

২৫মে। ১৯৯২। ‘মৃতের সহিত কথোপকথন’-এর অফিস বা হারবার্টের ঘর থেকে অনেক রাত্তিরে বমি বমি ধুনকিতে গলির বাড়ি, রাস্তার বাড়ি, কোথায় বাড়িতে ফেরার সময় কথাটা বলেছিল বড়কা। সেই রাত্তিরের মালের আসরের পর বাড়ি ফেরাটা কোটন, সোমনাথ, কোকা, ডাক্তার, বড়কা এদের যেমন মনে আছে এখনও, সেটা এলোমেলো। চাঁদের গায়ে স্যাঁতলা। রাস্তার আলোগুলোর পাশে ফেনা ফেনা  আলোর গুড়ো। গরমে সব হড়কে যাচ্ছে। পেটের অভেরা থেকে চপ, চানা আর হুইস্কি, রাম, বরফ  জল সব গাজর্গেজিয়ে উগরে আসছে। নর্দমার ঝাঁঝরি দিয়ে ভুরভুর করে আরশোলা বেরিয়ে রাস্তার আলো তাক করে উড়ে যাচ্ছিল। কোকা দত্তদের বাড়ির গেটের গায়ে বমি করেছিল। গরম, টক, হড়হড়ে সেই বমির ঝাঁঝটা কোকা আজও ভোলেনি। ডাক্তার আর কোটন তখন পেচ্ছাপে পেচ্ছাপে কাটাকুটি খেলছিল। বস্তার মতো একটা তেলচিটে মেঘ আকাশেরচাঁদে ঠুলি পরিয়ে দিল। গয়লাবস্তির মুখে সরকারি কল। সেখানে কানিপরা পাগলীবুড়ি পা ছেতরে বসে জল ছেটাচ্ছিল। পাচার কর কক্কর ডাক শুনে গা-পচা কুকুরগুলো ঘুমের মধ্যে গুমরে গুমরে উঠছিল। হারবার্ট সরকারের চিলছাদের ওপরে স্টার টিভি ধরার বাটি অ্যান্টেনা খসা-তারা ধরবে বলে হাঁ করে তাকিয়েছিল। ডাক্তার কাটাকুটি খেলা শেষ করে গেট ধরে দাঁড়িয়ে থাকা কোকাকে বলেছিল, খেলেও উটি। না খেলেও উলটি। এই জন্যে তোদের সঙ্গে মাইরি মাল খেতে ভালো লাগে না। ঝিম বিলা! নেশা বিলা! খালি বাওয়াল করবে!

কোটন চিৎকার করল, হারবার্টদা বিলা! হারবার্টদা ভোগে।

কোকা ভাবার চেষ্টা করছিল যে সে জন্মে আর কখনও মাল খাবে না। কিন্তু সেও বমির সুতো সুতো লালা ঝুলিয়ে দৌড় দিল কারণ পাড়া জাগিয়ে সোমনাথ চেঁচাচ্ছিল, খোড়োরবি আসছে। তোদের মাছ খাওয়াবে বলে খোঁৰ্ডোরবি আসছে।

জলে ডুবে কবে মরে গেলেও খোড়োরবি আসতেই পারে। হারবার্টদা ডাকলে তো আসবেই।

সেই রাত্তিরে এইরকমই ছিল বন্দোবস্ত। একে বলে সাঙঘাতিক বা খতরনাক গুগলি। সচরাচর নেশায় নেশায় এইসব রাতগুলো কেটে যায়। তৎসহ মরা বাতাসও থাকে।

দোতলার বারান্দায় বড় ঘড়িতে রাত একটার ঘন্টা বাজল। শালপাতার প্লেটের ওপরে ভাঙা চপের টুকরো, ভাড়ের তলায় গুজরাটি দোকানের চানার ঝোল সব গোটা আটেক আরশোলা তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছিল। তাদের কাউকে ধরবে বলে রাস্তার দিকের দেওয়ালের মোটা টিকটিকি দেওয়াল থেকে নেমে, খাটের পায়া বেয়ে উঠে একবার চুপ করে বুঝে নিল হারবার্ট ঘুমোচ্ছে কি না। সে দেখল হারবার্ট নিথর। তখন টিকটিকিটা হারবার্টের বুকের ওপর দিয়ে গিয়ে তার বাঁ হাত বরাবর নেমে গিয়ে দেখল যে হাতটা রক্তের গন্ধওলা ঠাণ্ডা জলে ডুবে রয়েছে। সবুজ চোখে সে অন্ধকারের মধ্যে হাত থেকে বালতির কানা মাপ করে নিয়ে লাফ মেরে বালতির কানায় উঠেছিল। সেখান থেকে বালতির গা বেয়ে তরতরিয়ে নেমে কোন আরশোলাটাকে ধরবে এটা ঠিক করার সময় নীল একটা আশ্চর্য আলোয় সকলের চোখ ধাঁধিয়ে যায়। টিকটিকি ও আরশোলারা দেখেছিল সেই আশ্চর্য দৃশ্য। বাইরের দেওয়ালে, গলির দিকে যে বন্ধ কাচের জানালা তার ধুলোময়লায় মুখ ঘষে, ডানা ঝাঁপটে, একটা পরী ঘরে ঢুকে হারবার্টের কাছে আসার চেষ্টা করছে। তার নীলচে মুখের ভাপ কাচের ওপর পড়ছে, তার চোখের জলে ধুলো ধুয়ে যাচ্ছে। হারবার্টের চোখ দুটো তখন আধখোলা। যদিও পরে বুজিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই রাতে এরকমই ছিল বন্দোবস্ত। এরপর ভোররাতে পিঁপড়েরা আসতে শুরু করে। পিঁপড়েরা ঝগড়াবিবাদ না করে ভাগাভাগি করে নিতে জানে। কালো পিঁপড়েরা খাবারের টুকরো, দাঁতের ফাঁকে আটকে যাওয়া ও খুঁচিয়ে ফেলা ডালের দানা বা গুড়ো খাবার, শুকনো খাবারের দিকে যায়। লাল ও তেঁও পিঁপড়েরা সরাসরি মৃতের নাসারন্ধ্র শ্লেষ্ম, চোখ, থুথু মারফৎ ঠোঁটের কোনা, জিভের গোড়া, দুর্বল মাড়ি ইত্যাদি পছন্দ করে। এতসব আমিষবিলাসী পোকা ও কীটের ভিড়ে সরব মুষ্টিমেয় ঝিঁঝিপোকা অবশ্যই অকিঞ্চিৎকর। কারণ সুদিনে, দুর্দিনে তারা যুগ যুগ ধরে না সভ্যতার, না অসভ্যতার জয়গান গেয়ে আসছে। কেউ শুনুক আর না-শুনুক।

দেওয়ালে পোঁতা মরচে-ধরা লোহার গজাল। তার ভেতর দিকে ঝুলছে হারবার্টের বাঁটওলা ছাতা। ছাতাটা দেখা যায় না কারণ তার ওপর দিয়ে ড্রাকুলার জোব্বার মতো ঝুলছে হারবার্টের অলেস্টার। হারবার্টের মাথার কাছে খোদল করা তাকে রয়েছে হারবার্টের দুটি অতীব প্রয়োজনীয় বই–

১) শ্রীমৃণালকান্তি ঘোষ ভক্তিভূষণ প্রণীত ‘পরলোকের কথা’–সংশোধিত ও পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ। মূল্য দুই টাকা মাত্র। বইটি রয়েছে ১৭১ পাতা থেকে। তাই শুরুতেই দেখা যায় মহারাজ বাহাদুর সার যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর কে. সি. এস. আই.-এর ফটো। ছবিতে প্রদত্ত তথ্য থেকে জানা যায় যে ১৯০৮ সালের ১৪ জানুয়ারি তিনি ৭৭ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন-বইটি এইভাবে শুরু “লিখিলেন,–‘মা, তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়াছি, আমাকে ক্ষমা কর। আমিও অনেক যন্ত্রণা ভোগ করিয়া এখন কেশ শান্তিতে আছি।’ এইরূপ আরও অনেক কথা  লেখার পর শিবচন্দ্রের স্ত্রীর আবেশ ভাঙিয়া গেল। তিনি কন্যার জন্য কাঁদিতে লাগিলেন….” ইত্যাদি।

২) কালীবর বেদান্তবাগীশ প্রণীত ‘পরলোক-রহস্য’।

এই দুটি বই হারবার্ট তার দাদু বিহারীলাল সরকারের সংগ্রহ থেকে পেয়েছিল। ‘পরলোক-রহস্য’ বাদে কোনো বই-ই আস্ত সে দেখেনি। অবশ্য আর একটি আস্ত বই ছিল শ্রীগুরুপদ হালদার রচিত ‘ব্যাকরণ দর্শনের ইতিহাস’, প্রথম খণ্ড। এই বইটি স্বাভাবিক কারণেই হারবার্ট কখনও খোলেনি। তবে জরাজীর্ণ, বাঁধানো নাট্যমন্দির পত্রিকা থেকে সে ‘সার্কাসে ভূতের উপদ্রব’ পড়েছিল। এর থেকে সে আউট নলেজ সংগ্রহ করেছিল যে দুই সহোদরা অভিনেত্রী সুচিন্তা ও সুকুমারীর ডাকনাম ছিল শুচি ও ডুদি, শ্রীমতী সুশীলাসুন্দরী ‘প্রফেসর বোসের গ্র্যাণ্ড সার্কাস’–এ প্লে করিতেন এবং আরও দুই অভিনেত্রী হিরন্ময়ী ও মৃন্ময়ী ওরফে ভূতি ও ভোমা বিডন স্ট্রিটে থাকতেন। একভাবে দেখলে এদের প্রতি হারবার্টের একটি টান ছিল, ছিল এঁদের সঙ্গে একজাতীয় সখ্য যা ঠিক প্রত্যক্ষ আলাপ বা সমসাময়িকতার অপেক্ষা রাখে না। “রমণীগণের ভীতিজনক চিৎকার ও পুরুষগণের হৈচৈ শব্দে সেই ঘোরা দ্বিপ্রহর রজনীযোগে পিথাপুরের রাজবাড়ী যথার্থই কম্পান্বিত হইতে লাগিল। আবার বুঝি কি এক অভিনব ভৌতিক কাণ্ড হইল ভাবিয়া, প্রাণভয়ে গোপাল ডুরিয়া ও সহিসগণ বহির্ভাগের আস্তাবল বাটী হইতে দৌড়িয়া আসিল!” হারবার্টের-এ ঘটনা প্রায় দেখা ছিল বললে অত্যুক্তি হবে না।

জানালার কাছে অনেকক্ষণ ধরে ডানা ঘষে কিছু হল না দেখে আকাশ ফিকে হবার ভয়ে পরী এক সময় শেষরাতের মধ্যে দোকানে ফিরে গেল। টিকটিকি ও আরশোলারা পরীর দিকে আর মন দেয়নি। হারবার্টের ঘরে আটকে পড়া একটা মাছি রাত ১২টা নাগাদ হারবার্টের বাঁ হাতের শিরা কাটার সময়ে সমুদ্রের মধ্যে অন্ধ হাঙরের মতো রক্তের গন্ধ পেয়েছিল। কিন্তু কানা বলে সে সেখানে পৌঁছতে পারেনি। ঘরে যখন একটু একটু করে  আলো ঢুকছে তখন সে উড়ে গিয়ে মেঝেতে পড়ে থাকা একটি ব্লেডের ওপরে গিয়ে বসেছিল যায় গায়ে রক্ত আর চটচটে নয়, কালচে হয়ে শুকিয়ে গিয়েছিল। হারবার্টের বাঁ হাতটা শিরা কাটা অবস্থায় লোহার বালতিতে বরফজলে ডোবানো ছিল। চোখ দুটো অল্প খোলা। মুখটা অবশ্য অন্য সময়ের মতো ফরসা আর চোখা চোখা ছিল না। কালি পড়ে গিয়েছিল। মুখটা একটু ফাঁক করা। ডান হাতটা বুকের ওপরে ভাজ করে রাখা। অত মদ আনিয়েছিল ছটফটানিটা কম হয় যাতে তার জন্যে।

যারা চিঠি দিয়েছিল তারা, তারপর খবরের কাগজের ফটো-রিপোর্টার, কলেজের ছেলেমেয়ে–ওরা চলে যাবার পরে কোটন, বড়কা, কোকা, জ্ঞানবান, বুদ্ধিমান, সোমনাথ, অভয়, খোড়োরবির ভাইঝাপি, গোবিন্দ-সব ছেলেরা ঢুকে দেখল হারবার্ট থরথর করে কাঁপছে। হাঁসফাস করছে, ঘামছে। জামা খুলে ফেলেছে। টেবিলফ্যানটা এমাথা ওমাথা করছিল আর হারবার্ট তার সঙ্গে সরে সরে হাওয়ার সামনে থাকার চেষ্টা করছিল। ওরা ফ্যানটাকে একমুখো করল। হারবার্টের খাটে তাকে বসিয়ে জল খাওয়াল। চা আনল স্পেশাল। আস্তে আস্তে ধাতস্থ হল হারবার্ট। চোখ থেকে ভয় যায়নি। বারবার বলছিল, সব গুগলি হয়ে গেল! সব গুগলি হয়ে গেল! ওফ … ধুকপুক করচে, ধুকপুক ধুকপুক করছে। এ কী বন্দোবস্ত রে বাবা!

–ওস্তাদ! তুমি একটু চুপ করে বসো তো। থিতিয়ে বসো। আর একটু চা খাবে?

–না। সব খাওয়ার শেষ খাওয়া হয়ে গেছে আজ। কেবল মারচে। কেবল মারচে! হামা দিচ্চে, তবু মারচে! পাটবন শুয়ে পড়েছে, তবু মারচে! কিল, চড়, লাতি, ঝাটা ….

হারবার্ট ককিয়ে কেঁদে ওঠে, চুল টানতে থাকে। লাথি মেরে বালিশ ফেলে দেয়। উঠে খোদলে রাখা ছোট আয়নায় নিজেকে দেখে, কাঁদতে কাঁদতে হঠাৎ সোজা হয়ে দাঁড়ায়, মুখে হাসি, বলে, বাপমা মরা, খানকির ছেলে, ভূতের পাইন মেরে টাকা কামাবে না? জীবন্তে কুলোলো না, মড়া মারাতে গিয়ে হল তো। কেমন লাগচে এখন কাবলে ঠাপ খেতে? টাকরায় ঠেকচে, কেমন লাগচে, হারবার্ট, হার … বার্ট, হা…র… বার্ট।

নিজের গালে এলোপাথাড়ি চড় মারতে থাকে আর লাফায়। ওরা হারবার্টকে টানাহ্যাঁচড়া করে বসায়। ধুতি খুলে যায়। শুধু আণ্ডারওয়্যার পরা। বসে দুলতে থাকে সামনে পেছনে। চোখ বন্ধ।

-আর তো কতা বলব না, আর কতা বলছি না। ভুড়ভুড়িটুকুও দেখতে পাবে না। যতই পাড়ে বসে থাকো আঁশবটি নিয়ে, টেরটি দেব না। পিউ কাহা, পিউ কাঁহা!

-একটু সামালাও গুরু নিজেকে। শুয়ে থাকো না একটু।

ওরা জোর করে শোয়াতে যায় হারবার্টকে।

–না ছাড়, পেটটা কেমন গুলোচ্চে। অসোয়াস্তি!

–পায়খানা করবে?

–হবে বোধয়। ঘুরে আসি।

হারবার্টকে পায়খানায় বা কলে যেতে হলে রাস্তা দিয়ে ঘুরে পেছনদিকে মেথর ঢোকার দরজা দিয়ে ঢুকতে হয়–কাজের লোকদের ওখানেই ব্যবস্থা। আণ্ডারওয়্যার পরা হারবার্টকে যেতে দেখে কয়েকটা বাচ্চা “বাঁটপাখি! বাঁটপাখি!” বলে চেঁচায়। কোটন বেরিয়ে গিয়ে বাচ্চাগুলোকে বলে–এক লাথ মারব পেটে, ইয়ার্কি মারা বেরিয়ে যাবে। বাচ্চাগুলো দৌড়ে পালায়।

ওরা ঘরে হারবার্টের জন্যে অপেক্ষা করে। কথা বলে-পায়খানাটা হলে দেখবি গুরু আবার ফিট হয়ে যাবে।

ডাক্তার যার নাম তার ওষুধের দোকান আছে। ক্লাস সেভেন অব্দি পড়লেও ডাক্তার অনেক জানে।

–আমি ভাবছি অন্য কথা। অনেক সময় হার্ট চোক হওয়ার আগে হাগা, বমি এইসব পায়।

–আমি দেখেচি গলায় দড়ি দিলে হেগে ফ্যালে।

–থামতো। হচ্চে শালা হার্টচোকের কথা তার মধ্যে কোত্থেকে গলায় দড়ি নিয়ে এল।

–ওই জন্যেই তো ওর বাবা জ্ঞানবান নাম রেখেছিল।

–বাপ তুলবি না কোকা! পিন মেরে দেব।

এইভাবে কথা চলছিল ওদের। বাইরে তখন রোদ্দুরে বিকেলের মায়া জড়াতে শুরু করেছে। কমজোরী সোনালী আলো। ওরা হঠাৎ দেখতে পেল সেই আলো মাথায় মেখে রূপবান হারবার্ট দাঁড়িয়ে। তার মাথা, গা ভিজে, বুকের লোম ভিজে, চুল ভিজে লেপটে আছে। আণ্ডারওয়্যারটা  জল সপসপে। টপটপ করে জল ঝরছে এবং হারবার্ট হাসছে। দরজা থেকে নাচের ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকে হারবার্ট দড়ি থেকে গামছা নিয়ে গা মুছতে মুছতে বলল

দেখলাম চৌবাচ্চা উজলে জল পড়ে যাচ্চে, চানের লোভ হল।

০-এখন কেমন লাগচে গুরু?

–হেভি আমেজ আসছে। মনে হচ্ছে বেড়াতে যাই।

–গুরু, আজ মাল খাবে না?

–খাবো না মানে? আজকে তো গ্যালাখালা হবে। মালটা যা জমবে না আজকে! ফুরফুর করবে। নসলিয়া!

–যাক, তোমার মুডটা ঠিক হয়েছে তাহলে।

হারবার্ট কাঁচা ধুতি পরে। পরতে পরতে কথা বলে। চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে কথা বলে। হাতে কাঁচা একটা ফুলসার্ট পরে। তারপর তোরঙ্গটা খোলে। টাকা গোনে। অনেক টাকা। থুথু লাগিয়ে লাগিয়ে গোনে।

–আমাদের আবার মুড। খানকির ছেলেদের জানবি মুডফুড নিয়ে কোনো চুদুরবুদুর নেই। খালি আছে মজা। বাবলাগাছে কাতলামাছে কী খেলা যে জমেছে কী বলব। টুনুক টুনুক ঘন্টা বাজছে। লাল নীল  আলো মারচে–ডান্স পার্টিতে যেমন থাকে। ওদিকে আবার ডালে ডালে রুইমিরগেলের চকচকি, পাতায় পাতায় মৌরলা মাছের বাহার। চিকমিক চিকমিক! চিকমিক চিকমিক। বাওয়াল কেউ থামাতে পারবে না বাবা। সায়েবরা তো রাতদিন ধরে মারল। পারল? সায়েবরা হেদিয়ে গেল তো এরা এলআরে বাবা ইংরিজি ঝাড়লে যদি বাওয়াল ঠেকানো যেত তাহলে আর দেখতে হত না …

টাকার গোছটা নিয়ে এবার ব্যাণ্ড দিয়ে জড়ায়। তারপর গোছটা ছুঁড়ে দেয় গোবিন্দর কোলে।

–তিন হাজার আচে। পোর্টেবল হয়ে যাবে।

–ক্লাবের টিভি গুরু?

–আবার কি? সবাই যখন জালি ব্যবসা, জালি ব্যবসা বলচে তকন আর ওর টাকা শালা ঘরেই রাখব না। আর কোকা, এই নে চারশো। মাল কিনবি।

–চারশো টাকায় তো কুড়িটা বোতল হবে শুরু।

–কুড়িটা বোতল! আরে ফোঁটা! ও বাংলাফাংলা নয়। ইংলিশ, ইংলিশ–ফরেন লিকার শপ।

–কী আনব হারবার্টদা! আজ তো তবে বাঘের খেলা।

–একটা হুইস্কি নিবি বড়। একটা রাম নিবি বড়। তিন কিলো বরফ নিবি নতুন বাজার থেকে। যারা মাল খায় না তাদের জন্যে চপ, ঝাল ঝাল চানা তারপর চিংড়ির কাটলেট, ঐ যে ন্যাজ বেরিয়ে থাকে। তারপর সল্টেড বাদাম নিবি, সিগারেট নিবি–দূর, অত কি বলা যায় নাকি? ওড়াতেও শিকলি না! আজ হল একেবারে যাকে বলে মেমফুর্তি।

হারবার্ট ওদের বলেছিল সাড়ে আটটা নাগাদ চলে আসতে। তারপর হারবার্ট ঘুমিয়েছিল কিছুক্ষণ। ঘুম থেকে উঠেছিল সাতটায়। দরজার বাইরে, চেয়ার নিয়ে গিয়ে সাইনবোর্ডটা নামিয়ে এনেছিল। তাতে লেখা ছিল ‘মৃতের সহিত কথোপকথন’—’প্রোঃ হারবার্ট সরকার।’ সাইনবোর্ডটা দেওয়ালের দিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছিল। খোঁদলের তাকের বই দুটোর তলায় একটা নতুন ব্লেড ছিল। সেটা আছে কিনা দেখেছিল। তারপর দরজা টেনে ভেজিয়ে দিয়ে দোতলায় জ্যাঠাইমার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। জ্যাঠাইমা মন দিয়ে টিভি দেখছিলেন। কিছুক্ষণ পাশে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে চলে এসেছিল হারবার্ট। খাতার একটা পাতার আধখানায় ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ করে কী লিখে বুকপকেটে রেখেছিল। মালের পার্টি খুব জমেছিল। বালতির মধ্যে অনেকটা বরফ গলে জল জমছিল। হারবার্ট ওদের বলল পাখার হাওয়ায় ঠাণ্ডাটা ছড়িয়ে ঘর শেতল হবে। হারবার্ট বলেছিল, যা ঘাবড়ে দিয়েছিল। ঐ যে ঘোষ, যে চিঠি দিয়েছিল–শালা তাকিয়ে আছে গোঁয়াড়গেলের মতো। আর খালি ইংরিজি বলচে, খালি ইংরিজি বলচে। যত বলচে তত সব আমার গোলটুলি হয়ে যাচ্চে।

-আর খবরের কাগজের মেয়েটা কি আজব মাল গুরু! পুকপুক করে সিগারেট খাচ্চে, আবার এই দেখি ফ্ল্যাশ মেরে মেরে ফটো তুলছে।

-আচ্ছা হারবার্টদা, তোমার এই মরার সঙ্গে কথাটথা–সবটাই কি ঢপের কেত্তন ছিল।

-তোর কি মনে হয়?

-ঢপ হলে অত লোক আসত তোমার কাছে? অত লোক, অত কথা সব ফ্যানা?

-তবে এ ব্যবসা আর করব না। বদনাম যখন রটবেই তখন আর এসব লাইনে হারবার্ট সরকার নেই।

-তাহলে কী করবে গুরু?

-ভাবছি। ভাবতে ভাবতে লাইন একটা ঠিকই বেরোবে। ও, দেখেচিস, সাইনবোর্ডটা খুলে ঘরে নিয়ে এসেচি! কোকা, একবার ঐটে দেখিয়ে দে তো বাবা।

কোকা দুটো জিনিস দারুণ দেখায়। একটা হচ্ছে কোন একটা ইসবগুলের বিজ্ঞাপন যার নাম ‘চেয়ার পায়খানায় বসে হনুমান হাগচে’–এটা ও টিভি থেকে তুলেছিল। অন্যটা হচ্ছে–কৃশানু আর বিকাশ মোহনবাগানে সই করার সময় গজু বোসের মুখ।

কোনটা গুরু? চেয়ার পায়খানা?

-না, না, গজু বোস।

কোকা দেখাল। খুব রগড় হল। ধুম নেশা হয়েছিল। বালতি ভরতি বরফগলা জল। বোতলে একটু রাম থেকে গেল। ঘর থেকে ওরা যখন বেরোয় তখন হারবার্ট জানালা বন্ধ করছে। অনেক রাত্তিরে বমির ধুনকিতে গলির বাড়ি, রাস্তার বাড়ি, কোথায় বাড়িতে ফেরার সময় কথাটা বলেছিল বড়কা।

–ভালো করে ঘুমোক। ঘুমোলেই ঠিক হয়ে যাবে।

দুই

“বিদেশে, প্রাণেশ, তুমি করিয়া ভ্রমণ,
দেখিবে নূতন দৃশ্য প্রত্যেক দিবস।”

–বলদেব পালিত

হারবার্ট জ্যাঠাইমার সঙ্গে পুরী বেড়াতে যাবার সময় যে খাতাটি কিনেছিল তার থেকে জানা যায়,

হারবার্ট

যা হারবার্টের খাতা থেকে জানা যায়নি তা মোটামুটি,

হারবার্ট সরকার। পিতা ললিতকুমার। মাতা শোভারাণী। হারবার্টের আবির্ভাব ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৪৯। ললিতকুমার যুদ্ধের বাজারে কামানো টাকা ফিল্মে লড়িয়ে বুরক বনে যান। ১৯৫০এ হারবার্টের এক বছরের জন্মদিনের পরে পরেই চলচ্চিত্রে ব্যর্থ নায়িকা মিস রুবীর সঙ্গে দার্জিলিং-কার্শিয়াং রুটে জিপ দুর্ঘটনায় আরও দুই আরোহী ও ড্রাইভার সমেত খতম। মা শোভারাণী শিশু হারবার্টকে বিডন স্ট্রিটে মাতুলালয়ে নিয়ে যান। সেখানে মাস আটেক পরে ছাদে ধাতব তারে ভিজে কাপড় মেলার সময় শোভারাণী বিদ্যুৎস্পৃষ্টা হন। শিশু হারবার্ট ‘মা যাব, মা যাব’ বলে যেতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে কাঁদতে থাকে এবং চিত হবার সঙ্গে সঙ্গে আকাশে একটি মুখপোড়া ও একটি পেটকাট্টির মারাত্মক টিলি প্যাঁচ দেখে বিভোর হয়ে থাকে এবং এই ভাবেই তার প্রাণরক্ষা পায়। শিশু হারবার্ট পুনরায় পিতৃগৃহে ফিরে আসে এবং যেনতেন প্রকারেণ বড় হতে থাকে-জ্যাঠাইমাই যা কিছুটা আদর দিত।

জ্যাঠামশাই গিরীশকুমার বেশ্যাসক্ত ছিলেন। ফলে তার অবশ্যম্ভাবী ব্যাধি হয় যার পরিণতি জেনারেল প্যারালিসিস অফ দা ইনসেন। ইনি, ছোটবেলা থেকেই হারবার্ট দেখে আসছে, দোতলায় থাকেন, ঘরবারান্দা করেন এবং ঘন্টাখানেক পরে পরে মোরগ যেমন ডাকে তেমনই নিয়মিতভাবে পিউ কাঁহা! পিউ কাঁহা!’ বলে চেঁচান। আগে আগে রান্নাঘরে বা একতলার উঠোনের পাশে সদর কলঘরে জ্যাঠাইমা থাকলে ‘এখেনে, আসছি গো!’ বলে সাড়া দিতেন। গিরীশকুমারের দুই পুত্র–ধর্মনাথ, হারবার্টের ধন্‌নাদাদা ও কৃষ্ণলাল। কৃষ্ণলাল ইংরিজির অধ্যাপক, প্রগতিশীল ও অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির অতীব নিকট ছিলেন এবং এখনও তাই বিশ্বাস করেন-বহরমপুর কে. এন. কলেজে পড়াতেন। ওখানেই ছোটখাটো বাড়ি করেছেন। পৈতৃক বাড়ির অংশ ছেলে বিনুর মৃত্যুর পরে ধন্‌নাদাদাকে লিখে দেন। ধন্‌না শিশুকাল থেকেই খচ্চরের আঁদি ও লোভী। মিন্টে অর্থাৎ টাকশালে চাকরি জুটিয়েছিল। আগে তো এত কড়াকড়ি ছিল না, হয়তো ঘুষও কিছু দিত-বোজ ধনা টিফিনবাক্স ভরে সিকি, আধুলি ঝেড়েআনত। ধরা যখন পড়ল তখন ক’বছর ধরে ঝেড়েছে বোঝার উপায় নেই। চাকরি গেল, জেলে গেল–যদিও সাজা কিছুটা : মকুব হয়। বেরিয়ে ধন্‌না নাদুবাবুর বাজারে তালাচাবির মস্ত দোকান দিল, বিয়ে–করল। তিন ছেলের বাপ হল। তিনটির মধ্যে বড়টি গৌহাটিতে থাকে। ভ্যাবলা। গোবলা, বৌ-এর ন্যাওটা। ঐটে তাও ভালো। বাকি দুটো লাফাঙ্গা–কেঁদো কেঁদো, হাড়বদমাইশ। মেজটি বাড়ির চিল ছাদে কেবল টিভির অ্যান্টেনা বসিয়েছে-স্টার টিভি, এম. টিভি, বিবিসি এইসব লোকে তো আজকাল হামলে দেখছে। ছোটটি এক ব্ল্যাক বেল্টকেকাবু করে তার সঙ্গে শেয়ারে কারাটে–কুংফু-র ইস্কুল খুলেছে যদিও নিজে ধুড়ের ধুড়–এসবের কিছু জানে না। ধনাদাদার বৌ কাজের লোক, ইংরিজি ইস্কুলে পড়া। বাড়িতে রান্না শেখায়–তিন মাসের কোর্স স্ন্যাক-এর যার মধ্যে পার্টি লোফ থেকে রিবন স্যাণ্ডউইচ এইসব আছে আর আছে মোগলাই, সেটাও তিন মাসের কোর্স-রেইনবো পোলাও, মুর্গ ইরানী ও আরও কত কি! আগে অর্ডার দিলে বার্থডে কেকও পাওয়া যায়। ধন্‌নাদাদার বৌ এর ক্লাসে অনেক বৌ আসে। হারবার্ট গলির ওপরে, বলতে গেলে বাড়ির বাইরে, যে ঘরটায় থাকে সেখান থেকে এই বৌদের আসা যাওয়া দেখা যায় না। হারবার্টের খাতায় এই গোটা ব্যাপারটা সম্বন্ধে দুটি লাইন রয়েছে,

ধন্‌নাদাদার হলঘরে
কেন্নীরা খলবল করে।

হারবার্ট সরকার। নন্দকুমার ইনস্টিটিউশনে ক্লাস থ্রি-তে ভর্তি এবং ক্লাস ফাইভ থেকে সিক্সে ওঠার পর যায়নি। বাড়িতেই যা টুকটাক পড়ত। হারবার্ট যে স্কুলে যাচ্ছে না সেটা প্রথম কয়েকমাস কারো চোখেও পড়েনি। যখন জ্যাঠাইমার চোখে পড়ল তখন বেশ কিছুদিন ধরে নিজেই তার হারবার্টকে মুদির দোকানে ও বাজারে পাঠানো হয়ে গেছে। অবশ্য ইস্কুলে তাকে ধাদাদার টিফিন, পরীক্ষার সময় চোতা, বই এইসব নিয়ে যেতে হত। ধন্‌না যেহেতু সব সাবজেক্টে টুকত তাই তার বই লাগত বেশি। বাইরে থেকে অঙ্ক করে পাতা সাপ্লাই দেওয়াটা এ পাড়ার রেওয়াজ। সবাই ঘরের ছেলে বলে মাস্টাররাও এ ব্যাপারে মাথা ঘামাতেন না। গত একত্রিশ বছরে নন্দকুমার ইনস্টিটিউশন থেকে মাত্র তিনজন সেকেন্ড ডিভিশন পেয়েছে।

হারবার্টের বয়স যখন আঠারো তখন জ্যাঠাইমা তাকে নিয়ে পনেরো দিনের জন্য পুরী গিয়েছিলেন। হারবার্ট সঙ্গে একটি খাতা ও কলম নিয়েছিল। ওরা উঠেছিল ভারত সেবাশ্রম সঙেঘর আশ্রমে। সেখানে হারবার্টের কবি-প্রতিভা জাগ্রত হয় ধাপে ধাপে। যে হারবার্ট পুরীতে নেমেই লিখেছিল,

বাংলার পরে আছে উড়েদের দেশ
রোজ রাতে যায় তথা পুরী এক্সপ্রেস

সেই হারবার্টই চারদিন পরে লেখে,

ঐ এল ঢেউ
ঐ গেল ফিরে
অবিরাম আসা যাওয়া
সাগরের তীরে

এবং তারই তিনদিন বাদে, জটিলতর,

স্থলবায়ু বহে বেগে
জলবায়ু ভালো নয়
অক্টোপাসের ভয়,
কি হয়, কি হয়

হারবার্ট পাড়ার দর্জির দোকানে গিয়ে নিয়মিত বাংলা কাগজ পড়ত। সেলুনে ‘শুকতারা’ ও ‘নব কল্লোল’ পড়ত। হারবার্ট-এর ছন্দজ্ঞান ও উপলব্ধি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিয়েছিল যদিও শেষ অবধি কিছুই ঘটেনি। পুরী থেকে ফিরে হারবার্ট লিখেছিল,

টুপিধারী নুলিয়ার রগুড়ে জীবন
কোনোই খরচ নাই প্যান্ট ও জামায়
সারাদিন  জলে নেমে করে হুটোপুটি
লুটোপুটি করে আর পয়সা কামায়

কাব্যবোধ ও কাব্যদক্ষতা যে কিভাবে হ্রাস পেতে পারে তারও এক মৃত উদাহরণ হারবার্ট। যার কলম দিয়ে এইসব বেরিয়েছে তারই  লেখা এগুলি পড়লে কে না মর্মাহত হবে–

ফুটপাথে ফুটফাট
ভুট-ভাট-ভুট
ধন্‌না অপিসে যায়
পায়ে গামবুট

বা,

কী গরম পড়েছে যে উঃ
আরশোলা কানে করে কুঃ

এই হাস্যকর স্টুপিডিটির পর, ভালগারধর্মী হলেও, ঝি-দের দলবদ্ধ বৃষ্টি ভেজা দেখে লেখা এই গানের মধ্যেও যেন ভরসা পাওয়া যায়, হয়তো বা কিছুটাই,

–তোমরা ভিজচ কেন গা
ভিজে গা
তোরা ভিজবি কেন লো
গা এলো

কিন্তু শেষটায় যা হতাশাই শুধু নয়, করুণারও উদ্রেক করে, তা হল, আর কিছু না পেরে, অমৃক সিং অরোরার গানের লাইন টুকে দেওয়া (এটিই হারবার্টের খাতায় তার শেষ হাতের লেখা)–

আমায় তোমার
কাজললতার কালি করো।

ধন্‌নাদাদাদের বাড়িটা খুব বড়ও নয়, ছোটও নয়। দোতলার ওপরে ছাদ। সেখানে ঠাকুরঘরের ওপরে চিলছাদ। তার ওপরে গঙ্গাজল আসার ট্যাঙ্ক ছিল। এখন যেখানে স্টার টিভির অ্যান্টেনা। বাড়ির সদর গেটের দিকে নয়, গলির মধ্যে একটা ছোট ঘর আছে। এই ঘরটি একাধারে পুরনো বইপত্র, সেভেন্টি এইট রেকর্ড, দলিল দস্তাবেজ এবং ইলেকট্রিক মিটারের ঘর। এই ঘরটিতে যখন কলকাতায় বিনু পড়তে আসে, ১৯৬৯ সালে, তখন একটি ছোট তক্তপোষ ও টেবিলফ্যানের ব্যবস্থা করা হয়। বিনুর মৃত্যুর পরে ঘরটি কয়েকবছর বন্ধ ছিল। পরে এটি হারবার্টের অফিস এবং শেষ রাত অবধি তারই ঘর ছিল।

এর আগে হারবার্ট দোতলার ভেতরের বারান্দায় শুত। ওখানে বৃষ্টির ছাট আসত না। হারবার্টের জামা কাপড় থাকত ছাতে ওঠার সিঁড়ির পাশে দড়িতে ঝোলানো। চিলছাদে ওঠার জন্য আগে একতলা থেকে সটান একটা ধচাপচা কাঠের সিঁড়ি ছিল। কিন্তু সেটা দিয়ে উঠলে পাশের বাড়ির ভাড়াটেদের শোবার ঘর দেখা যেত। ওরা চেঁচামেচি করাতে সিঁড়িটির ব্যবহার প্রায় বাতিল হয়ে যায়। বিনুর মৃত্যুর কয়েকদিন পরে একদিন খুব ঝড়জল হয়। সেই বৃষ্টির রাতেই সিঁড়িটার নীচের দিকটা ভেঙে পড়ে। ওপর দিকটা তখনও চিলছাদে আটকে ঝুলছিল। ওপর থেকে

খুঁচিয়ে তখন বাকিটা ফেলে দেওয়া হয়।

ধন্‌নাদাদাদের বাড়ির সামনের মোড়ে পাড়ার কালীপুজো হয়। দুর্গাপুজোটা হয় একটু এগিয়ে, বারোয়ারি মোড়ে। ওখানে ব্যাচাদার মিষ্টির দোকান আছে। সারাবছর একই খাবার কিন্তু দোলের সময়ে ওখানে দোলবড়া বানানো হয়।

ললিতকুমারের একটি ফটো এলবাম উত্তরাধিকার সূত্রে হারবার্টের পাওয়ার কথা ছিল। এতে ছিল প্রথম দিকে, রুডল ভ্যালেন্টিনো, লন চ্যানি (নানা ধরনের চরিত্রে), ডগলাস ফেয়ারব্যাংকস, চ্যাপলিন, গ্রেটা গার্বো, লিলিয়ান গিশ, মেরি পিকফোর্ড, এরল ফ্লিন থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ের ক্লার্ক গেবল, রবার্ট টেলর, ভ্যান হেফলিন, হামফ্রে বোগার্ট, বেটি ডেভিস, ভিভিয়ান লেই, ক্যাথরিন হেপবার্ন প্রমুখের রঙীন ফটো। একটি ফটোতে দেখা যায় ললিতকুমার ও শোভারাণী একটি সানবিম ট্যালবট মোটরযানের সামনে। মধু বোস ও সাধনা বোসের মধ্যে ললিতকুমার। ব্যর্থ নায়িকা মিস রুবী ও ললিতকুমার। শিশু হারবার্ট কোলে শোভারাণী। শিশু হারবার্ট।

এলবামটি হারবার্ট কোনোদিন চোখেও দেখেনি। কারণ ধনা এলবামটি মেরে দেয় এবং তার আলমারির তলায় পুরনো জামাকাপড়ে জড়িয়ে রেখে দেয়। ললিতকুমারের আর একট সংগ্রহ ছিল–নানা ধরনের সিগারেট হোল্ডার। সেটি অবশ্য ধ নয়, অন্য কেউ লোপাট করেছিল। বহু সন্ধান করেও ধনা সেই চুরুটের বাক্সটি খুঁজে পায়নি যার মধ্যে ললিতকুমার তার সিগারেট হোল্ডারগুলি রাখতেন। ললিতকুমারের সাহেবিয়ানার দৌলতে ধনাও মাঝে মধ্যে বিলিতি সিগারেট ও স্কচ হুইস্কি ঝেড়ে মেরে দিত। টাকাও সরাত। হিসেব করে কিছু করার লোক ললিতকুমার ছিলেন না। অতএব ওসব ছুটকো-ছাটকা ব্যাপার কোনোদিন তার চোখেও পড়েনি। ললিতকুমার যুদ্ধের বাজারে ছাঁট লোহা ও তামার কারবার করে যে বিপুল অর্থ কামিয়ে ছিলেন তা সিনেমার মাধ্যমে ভোগে না গেলে হারবার্টের জীবনকাহিনী যে অন্যবিধ হত সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশই থাকতে পারে না।

হারবার্ট সরকার। পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি লম্বা। ফরসা। চোখা, সাহেবি গড়ন। রোগা। ললিতকুমার নিশ্চয়ই ভেবেছিলেন ছেলের চেহারার সঙ্গে কোথাও একটা লেসলি হাওয়ার্ড মার্কা হলিউডী চেহারার মিল আছে। সাহেবি নাম হয়ে গেল হারবার্ট। হারবার্টের মা উত্তর কলকাতার ছায়া ছায়া বাড়ির প্রায় শ্বেতাঙ্গিনী সুন্দরী। ললিতকুমারও কম সুপুরুষ ও কেতাদুরস্ত ছিলেন না। যেভাবেই হোক হারবার্টের চলাফেরা ও কানোর মধ্যে সুন্দর একটা হিরো হিরো ভাব বরাবরই ছিল। তাকে আরও সাহেবি লাগত কারণ বেশির ভাগ সময়েই তার ভয় করত। ভয়ের ফ্যাকাশেটা ফরসা ভাবটা আরও বাড়িয়ে দিত। বাবা মার কারণে মোটরগাড়ি ও বিদ্যুতের ভয় তো ছিলই। পরে এর সঙ্গে ধনার মারের ভয় ছিল। জ্যাঠামশাই-এর যখন তখন পিউ কাহা, পিউ কাহা’ চিৎকারের ভয় ছিল। বিনু আবার নতুন এক ধরনের ভয় নিয়ে এসেছিল।

এর মধ্যে অবশ্য বছর চোদ্দ বয়সে হারবার্টের এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা হয়। পুরনো বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে তার তলার, ঐ শেষ ঘরেই, একদিন দুপুরে সে একটি টিনের ভোরঙ্গ পায়। সেই তোরঙ্গের মধ্যে একটি মড়ার মাথা ও কয়েকটা লম্বা হাড় পেয়েছিল হারবার্ট। এ বাড়ির ঝাড়েগুষ্টিতে কেউ কখনও ডাক্তারি পড়েনি। ম্যাজিকও দেখায়নি। আচমকা তোরঙ্গ খুলে ঐ খুলি, চোখের কন্দর ও দাঁত দেখে প্রথমটায় ভয় তো পেয়েইছিল হারবার্ট। পরে বারবার, যেন নেশার ভরে, এসে তোরঙ্গটা খুলে খুলি আর হাড়গুলো দেখত হারবার্ট। ভাবতে চেষ্টা করত এটা যার খুলি সেই লোকটা কে হতে পারত। যেই হোক, তার জন্যে অসম্ভব কষ্ট পেত হারবার্ট। বছর দুয়েক পরে একদিন হাড়গুলো আর ঐ কঙ্কালের মুণ্ডুটা হারবার্ট একটা থলিতে ভরে ভোরবেলা কেওড়াতলায় আদিগঙ্গাতে ফেলে দিয়ে এসেছিল। ঐ তোরঙ্গটিতে সে তার জিনিসপত্র রাখত। পরে টাকাপয়সাও রাখত।

গঙ্গায় সেই হতভাগ্য অজ্ঞাতপরিচয় মানুষটির অবশেষ বিসর্জন দেওয়ার পরে। হারবার্টের মধ্যে চরম দুর্মদ মৃত্যুচেতনা জেগে ওঠে। তার মনে হত সে ঐ ফাঁকা দুটি চোখের কোটরের মধ্যে যেন তলিয়ে যাচ্ছে আর তার চারপাশে নাগরদোলার মতো তারা বা জোনাকির  আলো ঘুরছে।

… এবং এরই পরে সে পূর্বকথিত “অতীব প্রয়োজনীয়” দুটি বই আদ্যোপান্ত খুঁটিয়ে পড়া শুরু করে।

এরপর হারবার্টের কমবয়সী বন্ধুদের মধ্যে সুইসাইড করে খোড়োরবি। তখন হারবার্টের বয়স উনিশ। খড়কাটার কল বাড়িতে ছিল বলে নাম ছিল খোড়োরবি। খোড়োরবি ছেলেটা ছিল ভালো। পেছনের পাড়ার জয়া বলে একটা বেঁটে মেয়েকে খুব ভালোবেসে ফেলেছিল খোড়োরবি। জয়ারা রোজ বিকেলে দল বেঁধে পাক মারতে বেরোত, এসে এপাড়ার মেয়েদের সঙ্গে গল্প করত। জয়াকে দেখলেই খোড়োরবি যে কেমন একটা করত সেটা সবাই জানত। অবশ্য খোলোরবির সাহস ছিল না। দঙ্গল ছেড়েও বেরোত না। কিন্তু পুজোর অষ্টমীর দিন মাথায় যে কী খেয়াল চাপল খোড়োরবির তা সেই একা জানত। পুজোর বেমক্কা ভিড়ে, ওদের পাড়ার প্যাণ্ডেলে গিয়ে খোড়োরবি, তখন পুঁচকে পুঁচকে ফাউন্টেন পেন বাজারে এসেছিল, সেই একটা কলম আর একটা কাগজ জয়াকে ধরিয়ে দিল। কাগজে এঁকাবেঁকা কাগের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং হাতের লেখায়—”জয়া, দেবীর পদতলে ভক্তের এ ক্ষুদ্র পূজা উপহার-ইতি রবি।” ওপাড়ার ছেলেরা হাতেনাতে ধরল রবিকে। জয়া হুড়মুড় করে বাড়িতে পালাল। রবি ওদের হাত ছাড়িয়ে পালাল। জাপটাজাপটিতে রবির পুজোর জামা ছিঁড়ল। রাতে খোড়োরবির বাড়িতে জয়ার কাকা এল। দুই পাড়াতে টেনশন হল। নবমী, দশমী খোড়োরবি বেপাত্তা। ভাসানের জের কাটেনি, একাদশীর দিন শেষদুপুরে হৈহৈ কাণ্ড। করপোরেশনের ঘেরা পুকুরে আত্মঘাতী খোড়োরবির মড়া ভাসছে।

খোড়োরবির মৃতদেহ পশ্চিমপাড়ের কাছে, দু-মানুষ  জলে ভাসছে আর দুলছে। পাড়ে পাড়ার সব ছেলেরা, হারবার্ট। বরাদুর কিছুটা স্বচ্ছ করেছে, তলায় দামের ঝক দেখা যায়, তারপরে গাঢ় শ্যাওলার সবুজ হয়ে অন্ধকার। পাড়ের কাছে একটা সাইকেল দাঁড় করানো। লম্বা বাঁশ বাড়াচ্ছে কেউ। সুইমিং ক্লাবের দুজন ছেলে সাঁতরে এগোয়। ডাইভিং বোর্ডের কাছ থেকে বাঁশের খোঁচা খেয়ে উল্টোনো খোড়োরবি ঘোলা জলে আসে। রোদ্দুর দ্রুত পালাচ্ছে। পুলিশ এসে গেছে। সার্জেন্ট এগোতে এগোতে বলে—”লাশ উঠেছে?” কেউ জবাব দেয় না। দুই সাঁতারু খোড়োরবির কাছে এসে ছুঁতেই সে যেন ছোট ছোট ঢেউতে ভর করে সরে যেতে চায়। ওরা দুপাশ থেকে কাঁধের কাছে জামা খামচে ধরে ফেলে। খোড়োরবি আটকা পড়ে যায়। ওরা পা দিয়ে জল কেটে কেটে পাড়ের দিকে এগোয় আর খোড়োরবির একমাথা চুল জলে টান টান হয়ে যায়। খোড়োরবিকে হারবার্টের শেষ রোদে মনে হয় এক ঝাক বাধ্য মাছ হয়ে ফিরে আসছে। এই দৃশ্যটি একটি ফটো হতে পারত। হলেও কবে হলদেটে কোনা খাওয়া হয়ে শেষে তুলোটে অস্পষ্ট হয়ে গেছে। অথচ শত শত বছর ধরে চাঁদের আলোয় বা শীতের ভোরে কুয়াশায় তার প্রেম নিয়ে খোড়োরবি ঐ মরণজলে ভেসে থাকবে। তাকে ঘিরে মৎস্যকন্যারা ওলটপালট করবে যারা কাঁদলেও তাদের চোখের জল কেউ দেখতে পাবে না।

“আমার নাম হারবার্ট। আমি বাঁট। বাঁট দেখেচো। এবার লাট দেখবে।”

“মখমোলায়েম ঘাসফুলেল মাঠে বিপরীদের খেলা।”

“ঘুড়ি, এরোপ্লেন, বেলুন, ঝুলঝাড়ু, মানুষ, প্যারাসুট, পাখি–সবই একসময় নেমে আসে। অথচ তার আগে ওঠে। ওটাও ওঠে। নেমে আসে।”

“মানুষ যদি ১ হয় তাহলে ০ হল মরা মানুষ। মানুষ + মরা মানুষ = ১+০= ১=খোড়োরবি।”

“ফাঁকফোকরে জলের হেঁয়ালি
ঢাকনাপেড়ে শাড়ির খেয়ালী।”

-হারবার্ট

তিন

“মানব-জীবন ছাই বড় বিষাদের!”

–মানকুমারী বসু

রাব্বা! রাব্বা! রোদ পেটে মেখে যে ঘুড়িটা উঠছে তো উঠছেই তার গোঁত্তা খাওয়ার সময় চোখ সরিয়ে নিলে ঐ, ও ….ই তেরোতলা বাড়ির ওপারে সেদিন অব্দি হাওড়া ব্রিজ দেখা যেত …ভিক্টোরিয়ার চূড়া ….ঐ সাহেবপাড়া ….সিনেমাপাড়া …. নতুনবাজার টেলিফোন অপিস ….আরও কাছে শীলদের ছাদ, তারপর হাঁড়িফাটা পালদের ….. কেষ্টান বাড়ির পাঞ্জাবি ভাড়াটেদের জামাকাপড় শুকোচ্চে …. তারপর দীর্ঘনিঃশ্বাস মাখা হালদারদের ছাদ যেখানে বুকি, সুন্দর, রং ময়লা, নরম, ঈষৎ উদ্ধতবুক বুকি আর কখনও বিকেলে ইস্কুল থেকে ফিরে এমাথা ওমাথা হেঁটে হেঁটে পড়বে না, হাতে ভোলা বই, জোরে হাওয়া দিলে ওদের ছাদের টবের গাছগুলো নুয়ে পড়ছে, বুকির চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, বই-এর পাতা উড়ে যাচ্ছে …

চিলছাদটাই ছিল হারবার্টের জায়গা। ঐ চিলছাদেই হারবার্ট সবকিছু উপলব্ধি করেছিল। যে আশ্চর্য স্বপ্ন তাকে সামাজিক প্রতিষ্ঠা ও খ্যাতি দিয়েছিল অথচ প্রকারান্তরে যা ছিল তার সমূহ বিনাশের কারণ সেই স্বপ্নও হারবার্ট দেখেছিল এই চিলছাদেই। চিলছাদে ছিল গঙ্গাজলের ট্যাংক। আগে হারবার্ট এই ট্যাংকের ভেতরে নেমে মিহি কাদা সাঁতলে সাঁতলে জ্যান্ত সাদা কুচো চিংড়ি ধরত-তিরতির করে ঠ্যাংগুলো ছুঁড়ছে। ট্যাংকের ভেতরের গায় গোল গোল পেঁড়ি লেগে থাকত। পরে  জল আসা বন্ধ হয়ে গেল। তলার কাদা শুকিয়ে গেল। পাইপটা ভেঙে গেল। পরে বৃষ্টির জল জমত। তখন ভেতরে একটু হয়তো শ্যাওলার মতো হত বা জলে ফেনা জমে দু-একটা ডিগবাজি খাওয়া জলপোকা বা মশার বাচ্চা জন্মাতো কিন্তু ঐ পর্যন্তই। গঙ্গাজল আসা বন্ধ হয়ে গেল বলে ট্যাংকটাও মরে গেল। তখন কিন্তু হারবার্টের কাছে মরা ট্যাংকটা অন্যভাবে প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছিল। হারবার্ট তখন হেঁচড়ে ছেচড়ে ট্যাংকের তলায় ঢুকে ঠাণ্ডা ছায়ায় গরমকালে ঘুমোত। আচার বা লজেন্স পেলে নিয়ে যেত। লজেন্সটা কয়েকবার চুষে একটা কাগজের ওপর রেখে ‘পরলোকের কথা’ পড়ত। পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়ত। ঘুম থেকে উঠে যদি দেখত গোটা তিন বা চার (তার চেয়ে বেশি পিঁপড়ে চিলছাদে উঠত না) পিঁপড়ে লজেন্সটা খাচ্ছে তাহলে টোকা দিয়ে দিয়ে তাদের তাড়াত। আর একরকম ছোট ছোট অনেক পা-ওলা নিরীহ পোকা চিলছাদের ফাটলে থাকত-এদের মতো নির্বিরোধী ও অহিংস পোকা ভূভারতে আর আছে কিনা সন্দেহ। কলকাতায় যেবার আকাশপথে লক্ষ লক্ষ পঙ্গপাল আসে তখন ট্যাংকের গায়ে তাদের ক্রমাগত ঠোক্কর খাওয়ার শব্দ হারবার্টকে বিস্মিত করেছিল। বৃষ্টির শব্দের থেকে একদম আলাদা। শীতকালে কৃষ্ণদাদার দেওয়া সোয়েটার আর জ্যাঠাইমার দেওয়া ব্যাপার নিয়ে বোদগরম চিলছাদে উঠে যেত হারবার্ট। বিশ্বকর্মার আগে থেকে চলতে থাকে ঘুড়ির মরশুম। সে সময়ে একদিন বিকেলে হারবার্ট ফাঁকা ছাদে ঘুমোচ্ছে, হঠাৎ পেটে সুড়সুড়ি। জেগে দেখে পেটের ওপর দিয়ে কাটা ঘুড়ির হাপতা সুতে চলেছে। শিশুকালে মৃতা মার অনতিদূরে শুয়ে দিলি প্যাঁচ দেখেছিল হারবার্ট। সে কথা তার মনে না থাকলেও ঢিলি প্যাঁচের প্রতি তার অদম্য এক আকর্ষণ ছিল। কিন্তু চিলি প্যাঁচ খেললে লাটাইতে অনেক সুতো রাখতে হয় কারণ দেদারে সুতো ছাড়তে হয়–ছাড়তে ছাড়তে সাদা সুতো এসে গেলে বিপদ। টেনে প্যাঁচ খেলাতে ভায়োলেন্স : বেশি। ঘুড়িও তখন বেহাওয়া না থাকলে ওড়নদারের মনের কথা কিড়মিড় করে বলে। হারবার্টের হতভম্ব লাগত অসভ্য টানামানি দেখতে-আকাশ পথে ঘুড়ি ছিনতাই-এর ধান্দা, এর মধ্যে যে করে সে সম্ভবত বলাৎকারের আনন্দ পায়। হারবার্টের সবচেয়ে ভলো লাগত হাই অলটিচুড দিয়ে আপনমনে কোনো কাটা ঘুড়িকে চলে যেতে দেখতে। ঘুড়িটা যদি একটু বেশি নাচানাচি করে, ওলট-পালট করে তাহলে বুঝতে হবে প্রায় কলের তলা দিয়ে কাটা পড়ায় সুতো খুবই কম। আর যদি মন্দ্র গম্ভীর ঢঙে পয়সার মতো ভারি হয়ে যায় তাহলে বোঝা যাবে বিস্তর সুতো তলায় রয়েছে–ঐ ঘুড়ি যে ধরবে তার লাটাই-এরও সুদিন। ধন্‌না র তিন ছেলে বড় ছাদ থেকে ঘুড়ি ওড়াত। ওদের চিলছাদে ওঠা ছিল বারণ। চিলছাদে ঘুড়ি পড়লে হারবার্ট জমিয়ে রেখে ওদের দিয়ে দিত।

ঘয়লা, মোমবাতি, পঙ্খীরাজ, চৌরঙ্গি, পেটকাট্টি, চাপরাস, সতরঞ্চি, মুখপোড়া, পান ও অন্যান্য বেনামা ঘুড়ির নক্সাদার জেল্লা যতই হোক না কেন গাঢ় রঙের বুলুম হল ঘুড়ির রাজা। মেঘলা আকাশে অনেক ওপর দিয়ে কেটে যাওয়া একটা কালো বুলুম দেখে হারবার্টের প্রায় ভয় করেছিল। এত গম্ভীর শেষযাত্রা হারবার্ট আগে বা পরে কখনও দেখেনি। এমনকি তার নিজের শেষ যাত্রায়ও এতটা গাম্ভীর্য ছিল না।

এই চিলছাদেই হারবার্ট তার কিশোর জীবনে একদিন নিজের শরীরের মধ্যে থেকেই আশ্চর্য আনন্দ ও ইন্দ্রিয়সুখের সন্ধান পেয়েছিল। তখন তার চোখে কালো রোদ্র, চারপাশে দেড় হাত উঁচু পাঁচিলের গায় উজ্জ্বল সবুজ শ্যাওলার ঢল। এখান থেকে কত কত বছর ধরে হারবার্ট দেখেছিল বিকেল হলে ওপর দিয়ে বকেরা লাইন দিয়ে ফিরে যায় ঘরে। সন্ধ্যার মুখে চামচিকে ও সন্ধ্যার পরে বাদুড় ওড়ে। এরোপ্লেনের  আলো জ্বলে নেভে। চোখের পলক পড়ার আগে অগণিত তারার মধ্যে একটি খসে পড়ে। ফানুস ভেসে যায়। হারবার্টঘুড়িলণ্ঠনও দেখেছিল–ঠোঙার মধ্যে কাঠির ফ্রেম করে মোমবাতি বসিয়ে ঘুড়িতে বেঁধে ওড়ানো। একবার ফানুসে টান আসা অব্দি ধরেছিল সে।

ছোটবেলা রাস্তায় কমিউনিস্ট পার্টির অনুষ্ঠানে কৃষ্ণদাদার সঙ্গে গিয়ে হারবার্ট ‘ফল অব বার্লিন’, আরও কি সব যুদ্ধের ডকুমেন্টারি দেখেছিল। একবার দেখেছিল বরফের চাঙড় উল্টে যোদ্ধাদের অতল  জলে তলিয়ে যেতে। হারবার্টকে কেউ বলেনি যে ওটা আইজেনস্টাইনের ‘আলেকজান্দার নেভস্কি’। আর অনেক আগে একবার ইন্দিরা হলে দেখেছিল একটা বাংলা বই যাতে শ্বশুরবাড়ির উঠোনে সাবিত্রী চ্যাটার্জি মাথায় চটি নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। আর পাড়ার পুজোয় অন্যান্য সিনেমার মধ্যে দেখেছিল ‘ফির সুবাহ হোগী’। পরে পয়সা কামাবার পরে ক্যাওড়া পাব্লিকের অনুরোধে ভাড়া করা ভিডিও-তে অবশ্য অনেক ছবি দেখেছিল হারবার্ট। কিন্তু তার যা কিছু শেখার তার অর্ধেকটা যদি পূর্বকথিত দুটি বই থেকে হয় তাহলে বাকিটা ঐ চিলছাদে। চিলছাদ থেকেই হারবার্ট ও বুকি পরস্পর আকৃষ্ট হয়। রোজ বুকি বিকেলে ছাদে আসত। হারবার্ট তো চিলছাদে থাকবেই। এই সময়ে দুজনে দুজনকে নিবিড়ভাবে পেত যদিও মধ্যে দুটো বাড়ির ফারাক থাকত। বুকি যতক্ষণ না আসত ততক্ষণ রোদে মেলা বুকির ফ্রকগুলো হারবার্টকে সঙ্গ দিত। বুকি ইস্কুলে যেত-আসত রিক্সায়। বুকিরা হালদার বাড়িতে ভাড়া এসেছিল। বছর দুয়েক ছিল। তারপর চলে যায়। হারবার্টের তখন ষোলো-বুকির বছর এগারো হবে। চলে যাবার আগের সরস্বতী পুজোয় পাড়ার লাইব্রেরি ঘরের পাশে ওদের প্রথম কথা হয়। ব্যানার্জিদের গেটের থামের পাশে প্রায় লুকিয়ে ফিসফিস করে হারবার্ট বলেছিল,-আমি চিঠি দিলে নেবে?

বুকি মাথা নেড়ে বলেছিল, হ্যাঁ।

–তুমি কোন ক্লাসে পড়?

–সিক্স। তুমি?

–আমি পড়ি, তবে ইস্কুলে পড়ি না

–বাড়িতে মাস্টার আসে?

হারবার্ট মাথা নেড়ে বলেছিল, হ্যাঁ। যদিও এটা বলতে তার ভালো লাগেনি। বুকিরা চলে যাবার পরে হারবার্ট কয়েক মাস চিলছাদে ওঠেনি। পরে গিয়েছিল ঠিকই। হারবার্ট দেখতে পেত বিকেল ফুরিয়ে গেলে যখন ছায়া ছায়া হতে থাকে, একটা দুটো করে আলো জ্বলে, উনুনের ধোঁয়া নদীর মতো ভেসে যায়, তারও একটু পরে ঐ ছাদটাকে আর কঁকা বলে মনে হয় না। হয়তো ঐ অস্পষ্ট অবুঝের মধ্যে বুকি দাঁড়িয়ে আছে, হাসছে, হাত নাড়ছে। চোখ কচলে দেখলে ঠিক যেন মনে হয় তাই। চোখটাও তো তখন একটু ঝাপসা থাকে। পরে তো ঐ ছাদটুকুও চলে গেল যখন হালদাররা দোতলা ওঠাল। চিলছাদের পাঁচিলের গায় হারবার্ট ইট দিয়ে ঘষে ‘ব’ লিখে রেখেছিল। গভীর করে। লেখাটার ওপরে শ্যাওলা হয়ে গেলেও হারবার্ট বুঝতে পারত যে ওর তলায় সেই অক্ষরটা তাকে মাথা নেড়ে নেড়ে বলছে, হ্যাঁ।

চিলছাদ কোনোদিনও হারবার্টের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। কিন্তু দুটো ঘটনা ঘটেছিল যার থেকে বিপদ হতে পারত। একবার সন্ধেবেলা তুমুল বৃষ্টিতে আটকে গিয়েছিল হারবার্ট। সে জলের কী ভোড়। তার ওপরে ট্যাংকের ওপরে শিল পড়ার শব্দ। ট্যাংকের তলায় ঢুকে গিয়েছিল হারবার্ট। কয়েকটা শিল ধাক্কা খেয়ে ছিটকে তার কাছে আসছিল। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। মেঘের গর্জন। বাজ পড়েছিল কয়েকটা। হারবার্ট ভেবেছিল সে আর নামতে পারবে না। নামতে পারছিলও না। এত বৃষ্টি। দিক ভুল হয়ে যদি রাস্তার দিকে বা গলির দিকের ফঁকাতে পা রাখে। আর একবার কালীপুজোর আগে দিনেরবেলায় কেউ উড়ন তুবড়ি টেস্ট করছিল। তার তেতে ওঠা খোলটা ফেটেছিল চিলছাদে। হারবার্টের গলায়, চিবুকের সটান তলায়, কণ্ঠার ওপরে একটা সাদা দাগ ছিল।

ধন্‌নাদাদা, ধনাবৌদি, তাদের তিনটে বাড়ন্ত ছেলে–এদের সঙ্গে হারবার্টের মানসিক দূরত্ব বাড়তেই থাকল। সাহেবপাড়ায় অর্থাৎ আধাঘন্টা হেঁটে ভিক্টোরিয়া স্কোয়ার থেকে গভীর অভিনিবেশময় ভ্রমণ ও তৎসহ সাহেবি হাবভাব পরের ব্যাপার। এই ভ্রমণ আশি দশকের মধ্যভাগে শীত থেকে শুরু হয় যখন হারবার্টকে জ্যাঠাইমা জ্যাঠামশাইয়ের অলেস্টারটি দিয়েছিলেন। যদিও এতে কয়েকটি জায়গা পোকা খাওয়া ও রোঁয়াওঠা ছিল এবং কোমরের বেল্ট ছিল না তবু ধন্‌নাদাদা তার মা অর্থাৎ জ্যাঠাইমাকে শুনিয়ে বলল–বাড়ির সব পুরনো, ভালো ভালো জিনিশ, সব ঐ বসে খাওয়াটার পেটে পুরচে। বাপের একটা জিনিশ। বড় ছেলেকে একটিবার জিজ্ঞেস অব্দি করলে নাকো।

জ্যাঠাইমাও. দুকথা শুনিয়ে দিলেন। “দ্যাখ ধন, আধবুড়ো হলি তবু হিসকুটেপনা গেল না। হেয্যাহেয্যির জ্ঞান তো খুব দেখছি, কী হয়েছে ওকে একটা গরম কাপড় দিলে? ঐ কি তুই পরতিস।

-দ্যাকো মা, যা বোজো না তাই নিয়ে কই কই মোট্টে করবে না। আমি কি স্বার্থ থেকে বলছি। আমি বলচি অব্যেসের কথা। খেতে পরতে পাচ্ছে। তার ওপর এটা ওটা তো আছেই। তার ওপর যদি ওপরঝোঁকা হয়ে আজ টিয়া, কাল কাকাতুয়া এনে দাও পরে সামলাবে কে? এরপর বাড়ির ভাগ চাইবে, ঘরদালান চাইবে।

-সে ওতো ভালো বলে কখনও বলে না। চাইলে কী দোষেরটা শুনি? ওর বাপের ভাগ কি নেই?

-এই দ্যাকো, মাতাগরম করে দিলে তো। বাপের ভাগ মারাচ্চে। বলি বিষয়সম্পত্তি সাইজ করার মতো বুদ্ধি আছে ঐ ঘটে? ভাগ চাইবে। ভাগ চাচ্চে।

-চাইলে কী বলবিটা কী শুনি।

-পেঁদিয়ে তাড়াব, বলব কী? এত বছরের ভাতকাপড়-হিসেবটা হোক না! খাল খিচে দেব না বাঞ্চতের।

“ইন্দ্রিয়ারাম দেহাত্মবাদীদিগের মন পরলোক বুঝিতে অক্ষম। পরলোক কেন, ইহলোকেরও অনেক সূক্ষ্ম বিষয় বুঝিতে অক্ষম। ইহাদের মনে শরীর, ইন্দ্রিয় ও ভোগ্য বিষয় লইয়াই সর্বদা ব্যতিব্যস্ত ও ব্যাসক্ত অবস্থায় অবস্থান করে; সেই কারণে ইহাদের মনে পরলোক বিষয়ক প্রমাদজনিত নির্মল সত্যজ্ঞান জন্মে না। মন যে বিষয়ে একাগ্র হয়, সে বিষয় তাহাদের নিকট স্ফূর্তি পায় এবং যে বিষয়ে একাগ্র না হয়, সে বিষয় স্ফূর্তি পায় না। মনের এই স্বভাবশক্তি বা স্বধর্ম, আবালবৃদ্ধবণিতা সকলেরই নিকট পরিচিত রহিয়াছে।”

অলেস্টার পর্বের পর হারবার্টের দুই ভাইপো প্রসেনজিৎ (ফুচকা) ও ইন্দ্রজিৎ (বুলান) একতলায় খাওয়ার জায়গায় অতর্কিতে হারবার্টকে আক্রমণ করে। অজুহাত ছিল হারবার্ট নাকি তাদের পড়ার সময় পুরনো ডাবের খোলা কেটে জ্বালানী বানাবার অছিলায় শব্দ করে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিল। জ্যাঠাইমা তখন পুজোয় বসেছেন। ওপরে আওয়াজ যায়নি। ধনা দোকানে। বৌদিও বাড়িতে ছিল না। বড় ছেলে অর্থাৎ প্রিয়জিৎ তখন স্নানের ঘরে। হারবার্টের আর্তচিৎকার শুনে সে গামছা পরে বেরিয়ে আসে এবং চেঁচিয়ে ভাইদের থামতে বলে। হারবার্টের তখন ঠোঁট ফেটে গেছে। রক্ত পড়ছে। চোখের তলায় ফুলে গেছে। দাঁত ব্যথা করছে। এই ঘটনার আর এক সাক্ষী ছিল ধাদাদার ঝি নির্মলা। হারবার্ট, মার খাওয়ার পরে যখন উঠোনে নেমে মুখ থেকে রক্ত ধুচ্ছে, প্রিয়জিৎ ঘটি থেকে  জল ঢেলে দিচ্ছে, মাথা ঘুরছে হারবার্টের তখন মনে আছে ওপর থেকে জ্যাঠামশাই-এর গর্জন শোনা যাচ্ছে

“পিউ কাঁহা, পিউ কাঁহা’!

এই ঘটনার ফলে মর্মাহত হারবার্ট কিন্তু স্বর্গের চাবি পেয়ে গেল। দর্জির দোকানে দুলাল, রাখালবাবু ওদের তো বলেছিল উঠোনে পা পিছলে পড়ে এই কাণ্ড। কিন্তু নির্মলা মারফত সারা পাড়ায় ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগেনি। নির্মলা টিউবওয়েল, মুদির দোকান, মিষ্টির দোকান–সর্বত্রই বলেছিল–কী নিদয়া গো ছেলেগুলো! ভালোমানুষ কাকাটাকে অমন করে মারতে পারল! ধনাকে অব্দি গাঙ্গুলী বাড়ির বড় ভাই, বড়িলাল একদিন অনেকের সামনেই বলে বসল, ধনা! বাড়িতে এসব কী হচ্ছে শুনচি! এপাড়ায় তো বাবা এমন ঘটনা শুনিনি। ভাইপোরা শেষে কাকাকে ধরে পেটাচ্ছে!

পাড়ার যুবক ও হারবার্টের জুনিয়ার যে গ্যাংটি একদিন তাকে দেখলেই “বাঁটপাখি! বাঁটপাখি”! বলে ক্ষেপাত তারাও আর না ক্ষেপিয়ে ও কাছে ঘেঁষে এসে তাদের সমবেদনা জানাল। এবং এরা হারবার্টের কাছে এসেছিল বলে দুই ভাইপো বেজায় কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল।

এভাবে হারবার্ট যেমন অনেকের কাছে আপন হয়ে উঠল তা ছাড়াও একটি ঘটনা ঘটেছিল যার কারণ অবশ্যই বিশদ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে। সামনে পেছনে ঘুষি খেয়ে হারবার্টের অপরিণত ব্রেন বোধ হয় নড়ে গিয়ে থাকবে কারণ তা না হলে পনেরো বছর আগের ঘটনা আশ্চর্য এক স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে ফিরে আসবে কী করে? লৌকিকের এই হস্তক্ষেপের ফলে হারবার্টের জীবনচরিত নতুন একদিকে মোড় নিল এবং কাকতালীয় হলেও যা অধিকতর আশ্চর্যের বিষয় যে ১৯৭১-এ পুলিশের গুলিতে নিহত নকশালপন্থী ভাইপো বিনুর বাবা, হারবার্টের কৃষ্ণদাদা তখনই কলকাতায় কাজে এসেছিলেন এবং ঐ বাড়িতেই ছিলেন।

“আমি বললাম দেখ দীননাথ, কল্যকার ব্যাপারটাই মনে মনে আলোচনা করেছ কিনা-তাই বোধহয় স্বজ্ঞানে এরকম বিভীষিকা দেখেছ। এখন সকলে নিশ্চিন্ত। মনে ঘুমাবার চেষ্টা কর।

“গর্জন করিয়া দীননাথ বলিয়া উঠিল কী বলছেন মশাই? আমার কথা আপনি মিথ্যে বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন? আমি মিথ্যা বলিনি, আমি স্বপ্ন দেখিনি-চোখের ওপর যা যা দেখেছি, তাই আপনাকে বললুম; আমার কথা বিশ্বাস না হয়, ওঁদের সকলকে জিজ্ঞাসা করুন, সকলে তো আর এক সঙ্গে স্বপ্ন দেখিনি।”

এই অংশটি ‘সার্কাসে ভূতের উপদ্রব’ ও আগেরটি ‘পরলোক রহস্য’ থেকে। হায়, সেই বুকি আজ কোথায়? সেই চিলছাদে শোভা পাচ্ছে ডিশ অ্যান্টেনা। হারবার্ট নেই। সোভিয়েত ইউনিয়ন নেই। হিপোড্রোম সার্কাস নেই। সিমলা স্ট্রিটে প্রসিদ্ধ গোঁসাই বাড়ির পাশে দীনুর হোটেল নেই। “শ্রীযুক্ত সুরেশচন্দ্র বসুর চক্ষুদ্বয় প্রায় সর্বক্ষণ মুদিত থাকিত বলিয়া সকলে তাহাকে আঁজুবাবু বলিত।” তিনিও নেই।

রাব্বা! রাব্বা!

চার

“অই শুন! অই শুন। ভেরীর আওয়াজ হে,
ভেরীর আওয়াজ”

-রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়

বিনু কলকাতায়, আশুতোষ কলেজে জিওলজি অনার্স নিয়ে পড়তে এসেছিল। বিনু আরও, অনেক আগে ছোটবেলায় একটা ছড়া শিখিয়েছিল হারবার্টকে পুলিশের লাঠি, ঝাঁটার কাঠি/ভয় করে না, কমিনিস্ট পার্টি। বিনু এসে রাস্তার ধারের ঘরটায় উঠল। কৃষ্ণলাল নিজে এসেছিলেন। বিনুর জন্যে ছোট একটা তক্তপোষ এল। তোষক এল। জ্যাঠাইমা দোতলার বারান্দার ছাদ থেকে ঝোলা বিছানার বাণ্ডিল খুলে বিনুকে বালিশ দিলেন। দেওয়ালে খোদল করা বাঁধানো তাকে উইনচেল হোমস ইত্যাদি সাহেবদের বই শোভা পেতে লাগল। বিনু সিরিয়াস। দোহারা গড়ন। মিষ্টি করে কথা বলে। বিনু একদিন সকাল নটা নাগাদ খাটে উপুড় হয়ে বুকের তলায় বালিশ দিয়ে মন দিয়ে কী লিখছিল। দরজাটা একটু ফাঁক করে হারবার্ট ভেতরে তাকিয়েছিল। একগাল হেসে বিনু বলেছিল, ও কী হারবার্টকাকা। ভেতরে এসো। কী দেখছ দাঁড়িয়ে?

হারবার্টের সঙ্গে বিনুর বেশ অন্তরঙ্গতা গড়ে ওঠে। বিনুর বন্ধুদেরও বেশ লাগত হারবার্টের। হারবার্টকে ওরা সিগারেট খাওয়াত। গল্প করত। আবার এক এক সময় ঐ বিনুই বলত, হারবার্টকাকা, এবার তোমাকে একটু … হারবার্ট বুঝত যে বিনু ওকে এখনকার মতো চলে যেতে বলছে। কিন্তু সেটা খারাপভাবে নয়। বিনু তাকে একটা ফুলপ্যান্ট কিনে দিয়েছিল। সঙ্গে একটা বেস্ট।

–ওফ্‌, হারবার্টকাকা, তোমায় না ঠিক অ্যামেরিকান ফিল্মস্টারদের মত লাগছে।

ধন্‌না হারবার্টের প্যান্ট দেখে চমকে গিয়েছিল। পরে তাজ্জব হয়ে গিয়েছিল শুনে যে টিউশনির টাকা থেকে বিনু এটা হারবার্টকে কিনে দিয়েছে।

জ্যাঠাইমা বলেছিলেন, দেখেচিস তো! দেখে শেখ। আকুটেপনা করে তো জীবন কাটালি।

ধন্‌না বলেছিল, ফ্যাচফ্যাচ করোনা তো। ওপরপড়া আদিখ্যেতা থেকে শিখবটা কী শুনি? তবে হ্যাঁ, আমারগুলো যদি বিনুটাকে দেখে বোজে–না করল লেখাপড়া, না হল ভব্যসভ্য।

জ্যাঠামশাই বলেছিলেন, পিউ কাঁহা! পিউ কাঁহা।

বিনু পরলোকে আগ্রহী হারবার্টকে মৃত্যুর একটা অন্য মানে বুঝিয়েছিল।

–ও কি সব আগডুম বাগডুম পড় বলল তো। ওসব ধাপ্পা। রিডিকিউলাস। এ মরল, ভূত হয়ে এল, ও মরল ভূত হয়ে গেল–এই যে পাতায় পাতায় ভূত কিলবিল করছে, বলো, নিজে কখনও দেখেছ? লোক তো আর মরেনি এমন নয়? এ বাড়িতেই ক’জন মরেছে কে জানে?

-আমি দেকিনি বলেই সবটা মিথ্যে হয়ে যাবে?

-শুধু তুমি দেখনি না, কেউ দেখেনি।

-তাহলে প্ল্যানচেটে যেটা হয়?

-কী হয়? বহরমপুরে নিজে আমি দেখেছি।

-দেখেচিস? এল?

-আসবে না কেন? নিজেরাই তো হয় অক্ষরের কাছে গেলাশ টেনে আনছে নয় তো পেন্সিল কাঁপাচ্ছে। অবশ্য তোমাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। যতদিন হাতে গোনা কয়েকটা লোক লাখ লাখ মানুষকে বোকা বানিয়ে খাঁটিয়ে মারবে, তাদের ঠকাবে, ততদিন ভূত, তারপর তোমার গিয়ে ঠাকুর-দেবতা-ধর্ম–এই সবই চলবে। শোনো, একটা  লেখা শোনো, (বিনু একটা ছোট বই খোলে, পাতা ওল্টায়)

-আমাদের সামনে হাজার হাজার শহীদ মৃত্যুবরণ করেছেন, তাঁদের কথা মনে পড়লেই আমাদের প্রতিটি জীবিত লোকের হৃদয় বেদনায় ভরে ওঠে, এমন কী স্বার্থ আছে যা আমরা ত্যাগ করতে পারব না অথবা এমন কী ভুল আছে যা আমরা শুধরে নিতে পারব না?–কথাটা কার লেখা বলতে পারবে?

হারবার্ট মাথা নাড়ে। এসবের কিছুই সে জানে না।

-মাও-সে-তুং।

১৯৭০-এর ১৯ নভেম্বর বারাসতের কুখ্যাত হত্যাকাণ্ড ঘটে। যতীন দাস, কানাই। ভট্টাচার্য, শংকর চট্টোপাধ্যায়, সমীর মিত্র, স্বপন পাল, সমীরেন্দ্রনাথ দত্ত, তরুণ দাসও গণেশ ঘটককে গভীর রাতে পুলিশ নৃশংসভাবে হত্যা করে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)-র সাধারণ সম্পাদক চারু মজুমদারতার ২২ নভেম্বর, ১৯৭০-এর ইস্তেহারে আহ্বান জানালেন,

-আজ প্রত্যেকটি ভারতবাসীর পবিত্রতম কর্তব্য এইসব কাপুরুষ বিদেশীদের আজ্ঞাবহ খুনেদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা সৃষ্টি করা। এটা আজ দেশবাসীর দাবী, দেশপ্রেমিকের দাবী। প্রত্যেক বিপ্লবী কর্মীকে এই বীর শহীদদের হত্যার বদলা নেবার প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করতে হবে। এই জল্লাদরা ভারতবাসীর শত্রু, প্রগতির শত্রু এবং বিদেশীর অনুচর। এদের শেষ না করলে ভারতবর্ষের মুক্তি নেই।

বিনু এই ডাকে সাড়া দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। কোনো কোনো রাতে ফিরত না। ধনাদাদার পাড়াটা কিন্তু পাঁড় কংগ্রেসী। বামপন্থার ছিটেফোঁটা থাকলেও বোঝ যেত না। বড়িলাল ছিল ইনফর্মার। হারবার্টকে একদিন বেশ কিছু টাকা আর মাও সে-তুং-লিন পিয়াও-এর ছবি ছাপা রসিদ বই দিয়ে বিনু পাঠাল লেক মার্কেট এলাকায় কোনো এক বিজয়-কে পৌঁছে দেবার জন্যে। বিজয় তাকে নিয়ে গেল কালীঘাটের গ্রীক চার্চের পেছনে। সেখানে খোঁচা খোঁচা দাড়ি গাল ভাঙা চশমা পরা একজন লোক আবছা অন্ধকারে হারবার্টকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল—”অভিনন্দন কমরেড। বিনয় আপনার কথা অনেক বলেছে। আপনার মতো বিশ্বস্ত বন্ধুর আমাদের দরকার। চা খান।”

ফেরার রাস্তায় মনোহরপুকুর মোড়টা ওকে পার করে দিয়েছিল দুটি ছেলে। কোথাও বোমা পড়েছিল। হারবার্ট আর খবর পায়নি যে ঐ বিজয় পরে বরানগরে আত্মগোপনে থাকাকালীন ১৯৭১ সালের ৯ মে সকালে বাজারের খাবারের দোকানের সামনে পুলিশের গুলিতে মারা যায়।

বিনু একটানা অনেকদিন বাড়িতে ছিল না। ধাদাদা কৃষ্ণলালকে চিঠি দিল। কৃষ্ণলাল জবাবে লিখলেন।

-বিনু এখন যুবক। সে বোঝে কী করছে। আর, এটা তো আর সে নিজে বোঝে নি, অনেকের সঙ্গেই সে একই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অতএব, আমার তরফ থেকে তাকে নিবৃত্ত করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। উপরন্তু বিনুর মাও এ বিষয়ে আমার সঙ্গে সহমত পোষণ করেন। তবে, তোমাদের অসুবিধা হচ্ছে জানলাম। অন্য ব্যবস্থা করছি। কিন্তু তার জন্য তোমাকে আমার কলকাতা যাওয়া অবধি অপেক্ষা করতে হবে। বাবা ও মা আশা করি ভাল আছেন। হারবার্ট ও তোমার পুত্রদের আমার ….

অবশ্য কৃষ্ণলালের কলকাতায় এসে অন্য ব্যবস্থা করার দরকার হয়নি। রাত্তিরে, এলগিন রোডের জাহাজবাড়ির কাছে একটা দেওয়ালে স্টেনসিল থেকে মাও-সে তুং-এর মুখ আঁকছিল তিনটি ছেলে। উল্টোদিকের ফুটে মুখ ঢেকে যারা শুয়েছিল তাদের মধ্যে একজন চাদর সরিয়ে গুলি চালায়। একটি ছেলে দুজনের কাঁধের ওপর পা রেখে স্টেনসিলের ওপরে কালি বোলাচ্ছিল। সে পড়ে যায়। অন্যরা তাকে টেনে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে। তখন অনেক পায়ের শব্দ ছুটে আসছে। হুইসল বাজছে। আহত ছেলেটির কথাতেই তাকে রেখে তখন দুজনে পালায়। আহত ছেলেটি উল্টে বুকের উপর ভর করে কনুই দিয়ে হেঁচড়ে চেড়ে হাত পাঁচ বা ছয়েক যেতে পেরেছিল। ফুটপাথে রক্তের ঘষটানো দাগ হয়েছিল। তারপর সে জ্ঞান হারায়।

এস. আই. সন্তোষ দেখল প্রাইজক্যাচ। বিনয়কে পায়ের ওপর দাঁড় করালে অনেক কিছু জানা যাবে। পিজির কেবিন। ডাক্তার।

-লাংফিল্ড পাঙচার হয়ে গেছে। কিছু করার নেই। এনি টাইম। জানলে বাড়িতে খবর দিন। বাড়িতে খবর এসেছিল। ধন্‌না কৃষ্ণলালকে তার করে। হারবার্ট দুবেলা হাসপাতালে পড়ে থাকত। শরীরের বেশির ভাগ রক্ত রাস্তায় ও ভ্যানের মেঝেতে ঢেলে দেওয়ার পরেও অদম্য এক প্রাণশক্তি বিনুকে দুদিন বাঁচিয়ে রেখেছিল। কৃষ্ণলাল এসেছিলেন। ওদিকে বাড়িতে, বিশেষত বিনুর ঘরে সব ওলটপালট করে, তোষকের তলায় বা কোথাও পুলিশ কিছু পায়নি। এর অনেক আগেই বিনুর কথামতো চিলছাদে হারবার্ট অনেক কিছু পুড়িয়েছে। দেশব্রতী, দক্ষিণ দেশ, চট্টগ্রামে ছাপানো একটি গেরিলা যুদ্ধের বাংলা ম্যানুয়াল, কিউবার ট্রাইকন্টিনেন্টাল পত্রিকা থেকে সংগৃহীত মলোটভ ককটেলের নকশা, রেডবুক, কিছু চিঠি। একটু একটু করে পুড়িয়েছে যাতে ধোঁয়া কম হয়। কেউ বুঝতেও পারেনি।

কৃষ্ণলালকে তার বন্ধু অধ্যাপক প্রফুল্লকান্তি বাইরে চা খাওয়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন। হারবার্টকে বন্দুকধারী দুই গার্ড দয়াপরবশ হয়ে বলেছিল–ভেতরে যান, ভুল বকচে। বাপটা আবার কোথায় গেল?

হারবার্ট বিনুর কাছে গিয়েছিল। বুক অবধি কম্বলে ঢাকা। উল্টোনো বোতলের থেকে রবারের নল হাতে। একটা জিনিস হারবার্ট দেখতে পায়নি। পায়ের দিক থেকে কম্বলের তলা দিয়ে একটা শেকল বেরিয়েছে। সেটা লোহার খাটের সঙ্গে দুপাক জড়িয়ে তালা আটকানো। গলায় ট্রাকশন লাগানো একটা ছেলে পালাবার পরে এই ফুলফ ব্যবস্থা করা হয়।

বিনুর চোখদুটো বন্ধ কিন্তু ঠোঁটদুটো নড়ছিল আর যেটাকে দুজন পুলিশ প্রলাপ বলে ভুল করেছিল সেটা ছিল বারাসাতের শহীদ সমীর মিত্র-র  লেখা কবিতা, অনেক চেষ্টা করে, মনে করে শব্দগুলো বলা, ঠিক কবিতা বলার মতো নয়,

-আমি দেখতে পাচ্ছি,
আমার চোখের সামনে, আমার এতকালের দেখা
পুরনো দুনিয়াটা পাল্টে যাচ্ছে,

(বিনু পরপর কয়েকবার ‘পাল্টে যাচ্ছে, পাল্টে যাচ্ছে’ বলে চলে, পরের কথাগুলো মনে আসে পরে, কাশির মতো হয়, ঠোঁটের কোনা দিয়ে রক্ত মেশা ফেনা ফেনা থুথু চলে আসে, হারবার্ট মাথার কাছে রাখা রক্ত মাখানো তোয়ালেতে মুছিয়ে দিতে যাবে, নার্স এসে যায়। নার্স মুছিয়ে দেয়, দিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে যায়।)

ভেঙেচুরে, তছনছ হয়ে, গুঁড়ো গুঁড়ো
হয়ে ঝরে পড়ছে
পুরনো দিনগুলো।
ঝড় আসছে একটা

(কয়েকবার ‘আসছে, আসছে’ বলে। চোখদুটো বড় করে তাকায়। মুখের ওপরে। হারবার্ট ঝুঁকে। তার চোখে জল। বিনুর চোখ এদিক ওদিক তাকায়। সে আসলে কাউকে খোঁজেনি। দেখছিল পুলিশরা তার শেষ কথা শোনার চেষ্টা করছে কি না।)

-কিছু বলবি, বিনু?

-হারবার্টকাকা, পুজোর ঘরে, ডায়রি…হারবার্ট…কাকা….ডায়রি..কালীর ফটোর পেছনে…ডায়রি… বিনু তাকিয়ে থাকে। একটু ওপর দিকে। এভাবে মানুষ সবসময় তাকায় না। কিছু দেখার জন্যে না হলেও তাকিয়ে থাকা।

ডাক্তার এসে ঢোকে। হারবার্টকে বলে সরে যেতে। পুলিশরা ঢোকে। নার্স। এক্সপায়ার।

এরপর পুলিশ-ফৈজৎ কাঁটাপুকুর ঘুরে ক্যাওড়াতলা। বিনুর দেহ বিদ্যুৎ-চুল্লিতে ঢুকে যায়। শ্মশান ঘিরে অত রাতেও পুলিশের কড়া পাহারা। কৃষ্ণদাদা কি বিড়বিড় করছিলেন এক দৃষ্টিতে চুল্লির দিকে তাকিয়ে। চুল্লির দরজার ওপরে লেখা ‘পুলিশের কুত্তা দেবী রায় হুঁশিয়ার সি.পি. আই. (এম. এল.)’। জনৈক বুদ্ধিজীবী পুলিশ অফিসার অধস্তন একটিকে বলেন—’ঐ দেখুন, নকশালের বাবা, ছেলে পুড়ছে বলে মন্তর পড়ছে। কথাটা শুনে হারবার্ট কৃষ্ণদাদার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল। চোখ দিয়ে  জল পড়ছে। কৃষ্ণদাদা আবৃত্তি করছেন,

ওরা বীর ওরা আকাশে জাগাতো ঝড়
ওদের কাহিনী বিদেশীর খুনে,
গুলি, বন্দুক, বোমার আগুনে
আজও রোমাঞ্চকর।

বিনু পুড়ছিল তখন।

এই ঘটনার পরে পচা, বদ্ধ, অকিঞ্চিৎকর যে কালপর্ব চলেছে তা এতই ক্লান্তিকর যে এর তুলনা অন্তত ইতিহাসে মেলা ভার। এবং হারবার্ট কলকাতা শহরের যে খণ্ডের বাসিন্দা সেখানে যুগযুগান্তেও কিছু পাল্টায় কিনা সন্দেহ। বনেদী বাড়িগুলোর মধ্যে চিলচিৎকারের মধ্যে দিয়ে যে ভাগাভাগি হয়েছে তার ফলে অভাবনীয় সব জায়গাতে দেওয়াল ও দরজা এসেছে। অবশ্য কিছুটা মুখ পান্টানোর স্বাদ এনেছে পুরনো বাড়ির জায়গায় তৈরি প্রোমোটারদের মালটিস্টোরিড। ভিডিও-র দোকান হয়েছে। জ্ঞানবান ও বুদ্ধিমান দুই ভাই প্রথম বিপ্লবী পদক্ষেপ নিয়ে দোকানটি খোলে। মোড়ে রোলের দোকানও হয়েছে। বড় রাস্তায় আগে বড় বড় গাছের ছায়া ছিল। তার তলা দিয়ে ছায়াস্নিগ্ধ দোতলা বাস যেত। এখন গাছ নেই। উন্মত্ত যানবাহন। পাড়ায় ঠেলাওলাদের আড্ডাটা উঠে গেছে। হারবার্টের মনে পড়ে একবার মাঝরাত্তিরে ভূমিকম্প হয়েছিল। দোতলার বারান্দার ঝোলানো বিছানার বান্ডিল পেন্ডুলামের মতো দুলছিল। রাস্তায় ভীত এক বৃদ্ধ ঠেলাওলা তার ঘুমন্ত স্বদেশীদের—”ভূঁইডোলারে ভূঁইড়োলা!” বলে সতর্ক করছিল। অথচ, পরদিন সকালে ডেকাডেন্ট রাস্তায় সেই গত রাতের মাতাল ও গতকালের রেসুড়েদের ফোলা ফোলা চোখ নিয়ে বাজার করতে যাওয়া, সেলুনের মেঝেতে গুচ্ছ গুচ্ছ চুল, রিক্সার শব্দ-সব দেখলে শুনলে কার বাপের সাধ্যি বলে যে এই শহরে গতরাতে একটা ছোট মাপের হলেও ভূমিকম্প হয়ে গেছে। অবশ্য কয়েকবার ভোটহয়েছিল। হারবার্টের তাতে কিছু যায় আসে না। সে কখনও ভোট দেয়নি। প্রত্যেকবার ভোটের দিন ও যখন কোথাও না যেয়ে চিলছাদে বসে থেকেছে। সেটা ওর কাছে বিনুর প্রতি ট্রিবিউট বলে মনে হয়েছে। কিন্তু বিনুর বেশি কথা তার মনে পড়ত না।

অলেস্টারের ঘটনায় ভাইপোদের হাতে কর্দর্যভাবে মার খাওয়ার পরে একদিন দুপুরবেলা চিলছাদে আরাম করে ঘুমোচ্ছিল হারবার্ট। কৃষ্ণদাদা এসেছিলেন সে সময়। বিনুর মৃত্যুর পর ধন্‌নাকে তার নিজের অংশ লিখে দেওয়ার পরে সেই যে ফিরে গিয়েছিলেন তিনি, তারপর এই প্রথম আসা। বিনর মৃত্যুর বছর পাঁচেক পরে বিনুর মা মারা যান। প্রায় তেরো চোদ্দ বছর পরে আসা। আগের মতো এবারেও হারবার্টকে নিয়ে হকার্স কর্নার থেকে দুটো ধুতি আর দুটো ফুলশার্ট কিনে দিয়েছিলেন।

নতুন ধুতি আর শার্ট পরে ঘুমোচ্ছিল হারবার্ট। আকাশে সাদা পালক মেঘের ফঁক দিয়ে সূর্যের ছটা বেরিয়েছিল। আধভিজে নিশ্বাসের মতো হাওয়া দিচ্ছিল। হারবার্ট স্বপ্নটা দেখেছিল।

“কেন গো নরের বেশে এ খেলা তোমার?
তারা কি তোমার ওগো বড় আপনার!”

–নগেন্দ্রবালা মুস্তোফি

বিরাট, কতদুর ছড়ানো একটা কাচের পর্দা। তার এপারে একটা এবড়োখেবড়ো মাটির রাস্তা যেটা কাচের পর্দার পাশ দিয়ে সমান্তরাল ভাবে চলেছে। ওপারে একটা সোনালী পাহাড়ের তলার দিকে বিরাট গুহা দেখা যাচ্ছে যার মধ্যে সরু পাথর ওপর থেকে ঝুলছে, বরফের ঝালরের মতো, আবার নিচের থেকেও ওরকম উঠে গেছে–বিনুর আওয়াজ স্পষ্ট শুনতে পায় হারবার্ট–ওপর থেকে যেগুলো ঝুলছে সেগুলো স্ট্যালাকটাইট, তলা থেকে যেগুলো উঠেছে সেটা স্ট্যালাগমাইট–ঠিকই তো, বই থেকে বিনু তো দেখিয়েছিল। তারপর পাহাড় ফুরিয়ে গেল। আবার চলছে, আবার চলছে। কখনো কাচের ওপারে জল। কখনো আকাশ।  আলো কমছে। ফিরতে হবে অতটা পথ। কোথায় ফিরতে হবে। এই ভয়টা আসার সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার কাকের একটা মেঘ ওপারে কাচের কাছে ছুটে আসে। কাচে ঠোকরায়। ডানা ঝাঁপটায়। অথচ কোনো শব্দ নেই। কাকের রক্ত, কাকের গু ছেবড়ে ছেবড়ে কাচটাকে নোংরা করে দিচ্ছে। সেই অসংখ্য কাকের ফাঁকে বিনুকে দেখতে পায় হারবার্ট। ৮০ দশকের মধ্যভাগ। বিনুর মৃত্যুর পর এই প্রথম বিনু। বিনু স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে। বিনু কিছু বলছে। কাকের ঢেউ এসে বার বার বিনুকে আড়াল করে। কাচের তলায়, ওপারে, মরা কাক জমছে। বিনু একটু এগিয়ে আসে। বিনু হাসছে। হারবার্টও হাসে। হাত নাড়ে। কথাগুলো, বিনুর কথাগুলো কাচের এপারে ইকো হচ্ছে অনেক দূরের ভেসে আসা মাইকের গানের সঙ্গে–

–হারবার্টকাকা, পুজোর ঘরে, ডায়রি …হারবার্ট … কাকা ডায়রি কালীর ফটোর পেছনে… ডায়রি …।

কাচের কাছে এসেছে বিনু। বিনু তাকিয়ে আছে। একটু ওপর দিকে। এভাবে মানুষ সবসময় তাকায় না। কিছু দেখার জন্যে না হলেও তাকিয়ে থাকা।

হারবার্ট ধড়মড় করে উঠে বসেছিল। মুখের গড়ানো লালা শার্টের আস্তিনে মুছেছিল। ঘুমচোখে দেখেছিল আকাশে রামধনু। রামধনুর ওপরে কারা যেন হাঁটছে। বুকের মধ্যে রেলগাড়ি চলার মতো শব্দ। শহরের অপ্রয়োজনীয় শব্দ। হারবার্ট নেমে এসেছিল। ঠাকুরঘরে ঢোকেনি। সোজা দোতলার বারান্দায়। জ্যাঠাইমা মাদুরে বসে। কৃষ্ণদাদা, ধাদাদা, ধনাবৌদি চা খাচ্ছিল। ধন্‌না কী একটা বলতে যাচ্ছিল, হারবার্ট চিৎকার করে উঠল।

-জ্যাঠাইমা। স্বপ্ন পেয়েছি। স্বপ্নে বিনু এসেছিল। বলল…

(আবার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। মনে পড়ছে, আবছা আবছা, ধন্দ…)

কৃষ্ণন্দাদা স্মিত হাসেন, বিনুকে স্বপ্ন দেখলি?
এবার পর পর মনে পড়ে।

-দেখব কী। এত কাক যে দেখাই দুষ্কর। বিনু, বিনু, বলল–চলো-দেখবে চলো জ্যাঠাইমা …

ধন্‌নাদাদা বলে,–যা বলল মাথা ঠাণ্ডা করে বল। গুলিয়ে না যায়। স্বপ্ন তো!

-বলল; জ্যাঠাইমার-ঠাকুর ঘরে, কালী ঠাকুরের যে ফটোটা আছে (হারবার্ট মাথায় হাত ঠেকায়) তার পেছনে বিনুর ডায়রি অছে।

জ্যাঠাইমা উঠতে চেষ্টা করেন–ধর, আমায় ধরে ওঠা। মা, মাগো!

হারবার্টের স্পষ্ট মনে ছিল আগে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে জ্যাঠাইমা, তার পরে হারবার্ট, ধন্‌নাদাদা-বৌদি, শেষে কৃষ্ণলাল প্রায়ান্ধকার সিঁড়ি বেয়ে উঠছে। শেকল খুলে ঠাকুরঘর খোলা হল। ঠাকুরঘরের টিমটিমে আলো জ্বালানো হল। মা কালীর ফটোটি দেওয়ালের মাঝামাঝি ঝোলানো। জ্যাঠাইমা ঠাকুর প্রণাম করে ফটোর তলার দিকটা সামনে টানতে একটা টিকটিকি দৌড়ে দেওয়ালের ওপর দিকে গেল। ভারি ফটো। জ্যাঠাইমা বললেন—ধন্‌না, টান তা অত ভারি ঠাকুর, আমি কি পারি?

ফ্রেম বাঁধানো বড় ছবি কালীর। তলাটা সামনে টানতে কিছু হল না।

-কিছু থাকলে তো বেরোত।

জ্যাঠাইমা বললেন—ধরাধরি করে ঠাকুরটা নামা না, নামিয়ে উল্টো দিকে দ্যাখ।

ফ্রেমটা উল্টে দেওয়ালের গায়ে দাঁড় করাবার সময়েই সকলে দেখতে পেয়েছিল। ফ্রেমের কাঠের ওপরে রেখে কাটাপেরেক ঘুরিয়ে আটকানো মাকড়সার জাল ও ধুলো মাখা ছোট একটা ডায়রি। নীচ থেকে ফোকলা চিৎকার শোনা গেল,–“পিউ কাঁহা! পিউ কাঁহা!”

-ওঃ সে কত কাগরে বাবা। কাচের এমুড়ো ওমুড়ো টুকরোচ্চে আর ডানা ঝটকাচ্চে। তার মধ্যে আবার গান হচ্চে। বিনু ঠায় হাসছে। কিছু শুনতে পাচ্চি না। তারপর কানে এল, ফাঁকায় কতা বলার মতো। পষ্ট শুনলাম … বলেই সেবারের মতো মরে গেল …

হারবার্ট হদিশ পাচ্ছে। এবার তাকে দাপাতে হবে। বিনুর সময় এসছিল। এবার তার সময়। সব লণ্ডভণ্ড করে দিতে হবে। নকড়াছকড়া করে ফারাফাই করে বিশ্ব সংসারে একটা তাণ্ডব লাগিয়ে দিতে হবে।

“পুরাকালে এ দেশে অনেক ভূতবিদ্যাবিৎ ঋষি ছিলেন। শুনিতে পাই, বিদ্যমানকালেও, অন্য ভূখণ্ডেও অনেক ভূতবিদ্যাবিশারদ জন্মগ্রহণ করিয়াছেন। কিন্তু তাহাদের সহিত ঋষিদিগের মতবৈষম্য দেখা যায়। ঋষিদিগের মতে যাবৎ প্রেত অবস্থা, তাবৎ তাহাদিগকে আহ্বান বা আকর্ষণ করা যায় এবং দেব গন্ধৰ্বাদি দেবযোনি-প্রাপ্তদিগকেও আকর্ষণ বা আহ্বান করা যায়। …শুনিতে পাই, বর্তমান কালের ভূতবিদ্যাবিশারদেরা মৃতমাত্রকেই আহ্বান করিতে পারেন বা করেন; এমন কি, বুদ্ধদেবের আত্মাকেও নাকি কোনো পণ্ডিত আহ্বান করিয়াছিলেন।”

(পরলোক রহস্য)

‘কম্পিত হৃদয়ে স্পন্দিত বক্ষে গবাক্ষের দিকে অগ্রসর হইলাম, সবে মাত্র শয্যাত্যাগ করিয়াছি–এমন সময় কক্ষতলে আমার দৃষ্টি পতিত হইল, আমি সবিস্ময়ে দেখিলাম-পাঁচ সাতটা সদ্যচ্ছিন্ন নরমুণ্ড কক্ষতলে গড়াইয়া বেড়াইতেছে! সে মুণ্ডের বিকট দশন পাটি ভীষণ ভুকুটি-ভ্ৰভঙ্গ লক লক রসনা আমার হৃদয়ে মহা আতঙ্কের সঞ্চার করিল–আমি পুত্তলিকাবৎ স্থির হইয়া দাঁড়াইলাম-পদমাত্র অগ্রসর হইতে সাহস করিলাম না। পরক্ষণে আবার গগনভেদী চিৎকার!”

(সার্কাসে ভূতের উপদ্রব)

পিউ কাঁহা! পিউ কাঁহা।

কৃষ্ণলাল ফিরে যাওয়ার পরে হারবার্ট জ্যাঠাইমাকে জানিয়ে দিল যে, নীচের ঘরে সে ব্যবসা শুরু করবে।

পাঁচ

“তোরা না করিলে এ মহাসাধনা,
এ ভারত আর জাগে না জাগে না।”

–দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়

ধন্‌না মারফতই অলৌকিকভাবে স্বপ্নের মাধ্যমে বিনুর ডায়রি পাওয়ার ঘটনাটি পাড়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল। করপোরেশন পার্কের ধারে রবিবার সন্ধেবেলার আড্ডায় ধনা কথাটা বলতে বড়িলাল, ক্ষেত্র, গোবী, উঞ্জে, হরতাল ইত্যাদি পাড়ার সিনিয়াররা তাজ্জব হয়ে গেল।

গোবী পাঁড়মাতাল। সে লাল চোখে  জলের দিকে তাকিয়ে ভাবুকভাবে বলল, আসলে কী জানিস। সবই মায়ের খেলা। কাকে যে কখন কোথায় মাথায় একটু টুক করে ছুঁয়ে দেবে তা কে বলতে পারে! হারবার্ট এ করতে পারে কেউ ভেবেছিল কখনও?

-অনেকে বলে তারাপীঠে এক কী যেন বাবার সমাধি আছে। সেখানে এক বোতল মাল ঢাললে নাকি দেবদিষ্টি পাওয়া যায়।

-অতদূরের কী দরকার। যা না, ঐ ঘুটিয়ারি শরিফ ঘুরে আয়না। দেখবি কত রকমের কাও।

বড়িলাল বলেছিল-হারবার্টের কাছে যাব তত একবার। নিজের কানে শুনতে হবে গোটাটা।

আসলে বড়িলাল অন্য কারণে যাবে, ভেবেছিল। তার ভাই গামা গত বছর লিভার পচে মরেছে চোলাই খেয়ে খেয়ে। মরেছে, মরেছে, তারপর থেকে বাড়িতে আজ এর জ্বর, কাল ওর পেটখারাপ, পরীক্ষায় ফেল লেগেই আছে। হারবার্ট কি কোনো হদিশ দিতে পারবে?

হারবার্টের ঘরে তখন পাড়ার অন্য ছেলেরাও ছিল। হারবার্ট মনে অন্য জোর পেয়ে গেছে তখন। একদৃষ্টে সে কিছুক্ষণ বড়িলালের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর বলল–একবছর হল, না?

–ঠিক ঠিক ধরলে এগারো মাস। শ্রাদ্ধশান্তি তো সবই করেচি। বাৎসরিকও হবে।

-সে সব তো করলে বুঝলাম, কিন্তু  জল না পেয়ে যে মরাপানা হয়ে যাচ্চে গো …

–কে?

–কে আবার? চাঁপাগাছ গো, চাঁপাগাছ।

বড়িলাল বেজায় ঘাবড়ে যায়। ছাদের বাগান ছিল গামার একমাত্র শখ। সেখানে কাঠের বাক্সে চাঁপাগাছ লাগিয়েছিল গামা। সত্যিই তো।

হারবার্টও ছাদ থেকে দেখত গামা সারা বিকেল গাছের যত্ন করছে, মাটি খুঁচোচ্ছে, জল দিচ্ছে।

এটাও হারবার্ট দেখেছিল যে ডাগরভোগর চাঁপাগাছটা হাড়কাঁটা হয়ে যাচ্ছে। বডিলাল তড়িঘড়ি উঠে রওনা দেয়। এবারে মোক্ষম খেলাটা খেলে দেয় হারবার্ট।

-যদি দেখ গাছটা মরে গেছে তাহলে ওটাকে তুলে ফেলে ভালো একটা ডাল সামনের বর্ষায় পুঁতে দিও। আর বেঁচে থাকলে কতাই নেই। দিনকয়েক গোড়া ভিজোলেই জানান দেবে।

বড়িলালের পা কাঁপছে। হারবার্ট থামে না, থামলে এখন চলবে না, থামা যায় না।

-আসলে কী জানো? টান! টান! মরে গেলাম। পুড়িয়ে দিল। কিন্তু যেখানে টাক সেখানে তো মন সারাক্ষণ পড়ে থাকবে। যাবে কোথায়। সবই অন্তরালের খেলা। অন্তরালের লীলা! কতরকমের যে বন্দোবস্ত। পরে একদিন বলবোখন বড়িদা। এখন যা বললাম করো দিকিনি।

বড়িলালের সেবায় শুকনো ডালে কয়েকদিন পরে পাতা বেরোল। নতুন ডাল ছাড়ল ফেকড়ি দিয়ে। ধন্‌না আর ক’জনকে বলেছিল। বড়িলালের অক্লান্ত প্রচার, নানাদিকে ছড়াতে শুরু করল। থানার বড়বাবু অবধি শুনে বিস্ময় প্রকাশ করলেন,

-বলো কী? এ যে দেখছি প্রায় নস্ত্রাদামুস। মালটাকে তো দেখতে হচ্ছে একবার।

কোটন আর সোমনাথ একদিন সকালে রিক্সা করে বাটম-বাঁধানো টিনে হলদের ওপরে লাল দিয়ে লেখা ঝর্মকে একটা সাইনবোর্ড নিয়ে এল—’মৃতের সহিত কথোপকথন’–প্রোঃ হারবার্ট সরকার।

কৃষ্ণদাদা বিনুর ডায়রি নিয়ে ফিরে যাবার সময়ে হারবার্টকে একশো টাকা দিয়ে গিয়েছিলেন। তাই দিয়েই হারবার্ট ব্যবসা শুরু করে। কৃষ্ণদাদাও হারবার্টের স্বপ্নের ব্যাপারটা অনিচ্ছা ও ঘোর আপত্তি থাকলেও বিশ্বাস করতে, বলতে গেলে, বাধ্য হয়েছিলেন। সত্যি বলতে বিনু যে হাসপাতালে তাকে ঐ কথাগুলো বলেছিল সেটা হারবার্টের মনে ছিল না। বিনুকে দাহ করার সময় অত পুলিশ, ভ্যান, বন্দুক দেখে তার ভয়েতে প্রাণ উড়ে গিয়েছিল।

‘শ্রীমৃণালকান্তি ঘোষ ভক্তিভূষণ প্রণীত “পরলোকের কথা” পাঠ করিলে পরলোক-তত্ত্ব ও আত্মার অস্তিত্ব সম্বন্ধে বিশ্বাস বদ্ধমূল হইবে, এবং পরলোকগত প্রিয়জনের সহিত কথাবার্তা বলিবার এবং তাহাদের দর্শনলাভের উপায় জানা যাইবে।

মৃত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথাবার্তা ও ভাবের আদান-প্রদানের জন্য হারবার্টের অনুসৃত পদ্ধতিটি স্পিরিচুয়ালিস্ট দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করলে একটি জগাখিচুড়ি বলে মনে হতে পারে। টক্ টক শব্দ দ্বারা আত্মার সঙ্গে যোগাযোগের যে পদ্ধতি আমেরিকার ফক্স ভগিনীরা অবলম্বন করে সবিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন অর্থাৎ ব্যাপিংস’ নামে যে পদ্ধতি পরিচিত তার কোনো প্রভাব হারবার্টের মূতের সহিত কথোপকথনে পড়েনি। শ্লেট বা কাগজে অদৃশ্য হস্তে  লেখা যে পদ্ধতি এগলিন্টন সাহেব ১৮৮১ সালে কলকাতায় দেখিয়েছিলেন বলে শোনা যায় তাও হারবার্ট কখনো করেনি। বা সোজা বাংলায় করতে পারেনি। একদিক দিয়ে হারবার্টকে আমরা একধরনের মিডিয়াম বলতে পারি। এ বিষয়ে পরলোকের কথা’ থেকে হারবার্ট জেনেছিল, “এতদ্ভিন্ন অপর যে সকল উপায়ে মৃতব্যক্তির আত্মার সহিত কথাবার্তা বা ভাবের আদান-প্রদান চলিতে পারে, তাহাতে একজন মধ্যবর্তী লোকের আবশ্যক। এই মধ্যবর্তী লোককে ইংরাজীতে মিডিয়াম বলে। মিডিয়াম হইবার শক্তি সকলের আছে কিনা ঠিক বলা যায় না। তবে সকলের যে সমান শক্তি নাই, তা প্রমাণিত হইয়াছে। এরূপ দেখা গিয়াছে, বিশেষ বিদ্যাবুদ্ধি না থাকিলেও কেহ কেহ শৈশবাবধি, সম্ভবত জন্মাবধি, এই ক্ষমতা লাভ করিয়াছেন। আবার কেহবা বিশেষ চেষ্টা করিয়াও কৃতকাৰ্য্য হইতে পারেন নাই। কাহারও কাহারও মতে, যাঁহারা তুলারাশির ও শান্ত প্রকৃতির লোক, যাঁহাদিগের মন-সংযম করিবার ক্ষমতা আছে, তাহারাই ভালো মিডিয়াম হইতে পারেন, অর্থাৎ তাহাদিগকে মৃতব্যক্তির আত্মা স্ববশে সহজে আনিতে সমর্থ হন। এইজন্য স্ত্রীলোকদিগের মধ্যেই মিডিয়ামের সংখ্যা অধিক দেখা যায়।” সহসা, এক স্বপ্নে, হারবার্টের মতো পরলোকের সহিত যোগাযোগ স্থাপনের ক্ষমতা অর্জনের উদাহরণ স্পিরিচুয়াল বিশ্বে বিরল। হারবার্ট কখনো প্ল্যানচেটে  লেখার চেষ্টা করেনি। বরং বলা যায় যে কিয়দংশে সে স্বৈরলিপি বা অটোমেটিক রাইটিং পদ্ধতি কাজে লাগিয়েছিল। অবশ্য হারবার্টের কখনো কখনো খাপছাড়াভাবে ব্যবহৃত অটোমেটিক রাইটিং-এর উদাহরণ যদি কেউ স্টেড সাহেবের বর্ডারল্যাণ্ড’ পত্রিকার রচনাবলী (বিশেষত মিস জুলিয়াসের আত্মার লেখাপত্র) বা ডবলিউ স্টেনটন মোজেজ সাহেবের কর্মকৃতির সঙ্গে তুলনা করতে যান তাহলে অবশ্যই হাস্যরসের উদ্রেক ঘটবে। হারবার্ট কখনো কখনো অবশ্য ট্রান্স মিডিয়াম বা মোহাবিষ্ট মিডিয়ামের ভাব দেখিয়েছিল। দিব্যদৃষ্টি বা ক্লেয়ারভয়্যান্স তার মধ্যে কখনো দেখা যায়নি। আরোগ্যকারী মিডিয়াম বা হিলিং মিডিয়াম সে কখনো হতে পারেনি। মেসমেরাইজ করার ক্ষমতা তার ছিল না। আত্মার জড়ীয় মূর্তিধারণ বা মেটেরিয়ালাইজেশন ছিল তার সাধ্যের অতীত। রিচেট, ক্রুকস, কোনান ডয়েল, মায়ার্স–এই মহান ঐতিহ্যের মধ্যে হারবার্টকে স্থান দেওয়ার চেষ্টা করা যায় না। সে একটি ‘ফ্রিক’। কলকাতায় যাঁরা গভীরভাবে প্রেতযোনি ও মুক্তাত্মা নিয়ে চর্চা করেন, যাঁদের মধ্যে সংস্কৃতি জগতের এক প্রবাদ-পুরুষও ছিলেন, তাদের সঙ্গে ও হারবার্টের কোনো যোগাযোগ ছিল না। সর্বোপরি, ব্যবসা জমে ওঠার পরে তার সাধারণ জ্ঞান লোপ পেয়েছিল। টাকার লোভে যা খুশি তাই সে করত। কখনো মৃতের ব্যবহৃত কোনো জিনিস বা হস্তাক্ষর কিছু নিয়ে ভাব দেখাত যে সাইকোমেট্রির সহায়তা নিয়ে হদিশ চালাচ্ছে। এ ছাড়াও অনেকেই জানেন যে প্রকৃত স্পিরিচুয়ালিস্টরা ঠিক দুপুরে বা গভীর রাতে, অতিরিক্ত ঠাণ্ডায় বা গ্রীষ্মে কিংবা ঝড়, বৃষ্টি, বাজ পড়ার সময় অপরলোকের সঙ্গে যোগাযোগ করা পছন্দ করেন না কারণ এরকম সময় ভূত-প্রেতই বেশি আসে। মুক্ত আত্মারা প্রায় আসে না বললেই চলে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। তাছাড়া হারবার্টের তখন থামার সময় ছিল না।

একেবারে প্রথম দিকেই এসেছিলেন বিনয়েন্দ্র চৌধুরী, সঙ্গে তাঁর স্ত্রী অতসী। বিনয়েন্দ্রবাবুর একমাত্র ছেলে ছিল পাইলট। এয়ারবাস দুর্ঘটনায় হায়দরাবাদে মারা যায়। বছরখানেক হয়েছে। ছেলে রাহুলের বিয়ের কথা হচ্ছিল। সেই থেকে অতসী প্রায় উন্মাদ। বিনয়েন্দ্রবাবু একের পর এক সিগারেট খাচ্ছিলেন। অতসী অপলকভাবে হারবার্টের দিকে তাকিয়ে ছিলেন এবং হারবার্ট শিরদাঁড়া সোজা করে বসে অপলকভাবে রাহুলের ফটোটি অনেকক্ষণ দেখার পর চোখ বন্ধ করেছিল। দরজার বাইরে কোটনরা দাঁড়িয়েছিল। একবার চোখ খুলে হারবার্ট সামনে রাখা কাগজে ডটপেন দিয়ে লিখলম, ৪-তারপর স্মিত হেসে ফটোটা বিনয়েবাবুর দিকে এগিয়ে দিল। হারবার্ট বলতে থাকে,

-অকালমৃত্যু, আয়ু ছিল, কর্মশক্তি ছিল কিন্তু কী করে কী হল, উপচ্ছেদ • হয়ে গেল। শোক! দুকখু! হুতাস। শুধু তাই নয়। সমষ্টি মৃত্যু! উঃ কী করে যে এ সহ্যশক্তি পেলেন আপনারা! গড় করি! অমন সহ্য শক্তিতে গড় করি।

অতসী সরবে কেঁদে ওঠেন। হারবার্টও নিজের চোখের  জল মোছে। স্মিত হাসি ফুটে ওঠে তার মুখে।

-তবে আর তো দুঃখের কিছু নেই। দুঃখের কী আছে। কালরাজ্য, মৃত্যুরাজ্য এ তো থাকবেই। ছেলেটির মন বড় ধার্মিক ছিল দেখছি।

বিনয়েন্দ্র ও অতসী চমকে উঠেছিলেন কারণ দোতলা থেকে গর্জন শোনা গিয়েছিল-পিউ কাঁহা! পিউ কাঁহা।

বিনয়েই বললেন—আমি তো যতদুর জানি ধর্ম-কর্ম নিয়ে খোকা একেবারেই মাথা ঘামাত না।

-ঘামাত না?

-বরং তর্কই করত। উনি তো আবার সাঁই বাবার…

হারবার্ট চেঁচিয়ে ওঠে,-থাক, আর বলতে হবে না। আমি শুনব না, শুনব না, শুনব না … (কানে হাত চাপা দেয়)।

দুজনেই অপ্রস্তুত। কী করবেন ভেবে উঠতে পারেন না। কান থেকে হাত সরিয়ে হেসে ফেলে হারবার্ট।

-মাপ করবেন। মুখ মানুষ তো, রেখে ঢেকে কতা আসে না। আচ্চা, ধরুন আপনার কতাই ঠিক। তা যদি হবে তাহলে এমনটি কী করে হল বলুন তো?

-কী হল?

হারবার্ট কাগজের দিকে দেখায় যেখানে ম, ৪ লেখা।

-এর মানে?

-মানে? মানে শুনলেই তো আমার খেলা শেষ, ওফ্‌ ঐ ঐ শিবদুর্গা আসছে, কতবড় বন্দোবস্ত। আমি বলি এই হালফ্যাশানের যুগে কজন মধ্যমধার্মিক হয়? কজন চতুর্থ স্তরে থাকতে পারে? আমি মরলে পারব? স্থূলপাপী হব, নরকের কীট কেন্নো চিবিয়ে চিবিয়ে খাবে। আপনাদের ছেলের তো আনন্দ এখন, নন্দনকাননাদি স্থান, যক্ষকিন্নরাদি শরীর ও তদুপযুক্ত সুখ-দুখ ভোগ।

অতসী যেন ভাবের ঘোরে শুনে যান।

-বলেচে কি জানেন, বলেচে-জপ-তপ সবই বৃথা মরতে জানলে হয়। মূরণকালে ভালো চিন্তা ছিল, তারই সুফল ভোগ করছে। কী আনন্দ, কী আনন্দ মা, মাগো, কেন লুকিয়ে রেখেছিলি মা …. কেন?

মৃত বৈমানিক পুত্র মধ্যমধার্মিক অবস্থায় চতুর্থ স্তরে প্রভূত সুখে বিরাজ করছে। জেনে শান্ত, নিথর অতসীকে নিয়ে বিনয়েন্দ্রবাবু গম্ভীরমুখে অ্যাম্বাসাডরের পেছনে বসে বাড়ি গেলেন এবং ওয়ালেটে দুটি পঞ্চাশ টাকার নোট কম ছিল।

-আপনার …

-কী আপনার?

-মানে কী দেব।

-দেবেন? দেবেন। দেবেন না? দেবেন না। ভিক্ষে যার সম্বল, লাতিঝাটা যার মাথায় নিত্যি ঝরচে সে কি দরদাম করবে। তাও যদি দুটো ডিগ্রি থাকত, বলতে পারতুম।

বিনয়েন্দ্রবাবু নোট দুটো বালিশের তলায় খুঁজে রেখে চলে গিয়েছিলেন। সেই দিনই রাতে কুড়ি টাকার বিনিময়ে এক বোতল বাংলা আসে এবং আশি টাকা তোরঙ্গে সঞ্চিত হয়।

এর কিছুদিন পরে হারবার্ট দোতলায় গিয়ে জ্যাঠাইমার কাছে একশো টাকা ও ধনাবৌদিকে এক বাক্স মিষ্টি দিয়ে এল–বলল, ফুচকা-বুলানকে দিও। কাকা হয়ে কখনও কি খাওয়াতে পেরেছি?’ ঘুষির জবাবে বড় বড় সন্দেশ। পরে ধনাকেও জুতোতে ছাড়েনি। ‘দাদা, মিষ্টি খেয়েছিলে?’ ধনা বলল। কিছুদিন পরে ধবৌদি বলল,-ঠাকুরপো, বাইরের কাজের লোক আসে। তুমি বরং ভেতরের কল-বাথরুমটাই ইউজ করো না। কেউ কি বলেছে কিছু কোনোদিনও তোমাকে?

-না, বৌদি। অব্যেস হয়ে গেছে তো। আর আমার তো সময়ের ঠিক নেই। আমার তো কোনো অসুবিদে হচ্ছে না।

-মানে, তোমার দাদাই বলছিল বলে কথাটা বল্লুম।

সবচেয়ে খুশি হয়েছিলেন জ্যাঠাইমা। হারবার্টের মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন প্রাণটা যেন জুড়িয়ে দিলি যে হারু। অত অত্যেচার, অত অনাচার, ভাবিসনি আমার কিছু নজর এড়ায়। মুখ বুজে থাকলে কী হবে, আমি সব জানি। পুণ্যকাজ করচ বাবা, সবই মায়ের আশীৰ্বাদ।

-জ্যাঠাইমা।

-উঃ।

-সেই গপ্পোটা বলো না?

-কোনটা?

-তোমার বিয়ের সেই ..

-কদমা। হিহিহিহি। সে তো বাসররাতের আগে। নতুন জামাই তো কুঁতে কুঁতে খেল–এই লুচিটা ধরে তো ঐ আলুটা পড়ে যায়। ঢলে ঢলো ভাব।

-কেন গো?

-ওমা, সঙ্গে যে বন্দুগুলো গিয়েছিল ওগুলো তো লুকিয়ে মদ নিয়ে গিয়েছিল। নিত্যি খেত তো৷ পলকাটা কত রকমের বোতল। তারপর বুজলি,

–ও জ্যাঠাইমা, ঢুলচ কেন?

-হ্যাঁ, তারপর হল কী এয়োরা খিলখিল করচে। কেন? জামাইকে একটা কদমা দিয়েচে খেতে সে একেবারে হাতির মাতার মতো।

-তারপর?

-তোর জ্যাঠা তো তকন রসে টইটম্বুর। তবে হ্যাঁ, আড়াখানা ছিল বলরামের মতো। যেই না কামড় দেওয়া, অমনি, ছিছি কী কাণ্ড, হিহিহিহি।

-কেন গো জ্যাঠাইমা?

-কদমার ভেতরে জুতো। একপাটি জুতো গো। জুতো পাতে। চোখ গোল্লা গোল্লা করে এদিক ওদিক তাকাচ্চে। আর মেয়েরা চেঁচাচ্চে–‘জামাই, জুতো কামড়াচ্চে গো। এ কেমন জামাই গো। সে যে কী বটকেরা হয়েছিল!

নিজের বাসররাতের স্মৃতি কি মনে পড়ে যায় গিরীশকুমারের? তাই কি তারস্বরে স্বগতোক্তি করে ওঠেন তিনি—’পিউ কাঁহা! পিউ কাঁহা!’

জ্যাঠাইমা বলেন,-ঐ এক হয়েছে বাবা পিউ কাঁহা। ধনা, কেষ্ট-ছোটবেলা। অশৈলপনা করলে বলতেন শূয়ার কাহাকার! ওরা নীচু গলায় জবাব দিত কলকাতাকার। সব বিস্মরণ। ঐ দাপট, ঐ ঝাঁপট। সব গিয়ে ঐ পিউ কাহা, পিউ কাঁহা! একটা গান মনে এল রে হারু, গাইব?

-গাও না। তুমি তো ভালো গাইতে আগে।

-শো। সুর ধরতে পারব?

-পারবে। ঠিক পারবে।

চাঁদের আলোয় জ্যাঠাইমা গান ধরেন,

সখি!

কেমনে যমুনাজলে যাই!
 জল আনিবার পথে,        যে রূপ দেখিনু লো,
তুলনা তাহার কোথা নাই।।
 জিনি নব জলধর,         কান্তি মনোহর লো,
শুন শুন পরাণের সই।।
মনে মন নাহি মোর,         হরে নিল মনচোর,
সরমের কথা কারে কই।।
অবলা রমণী আমি,         সে, রূপ হেরিয়ে লো
হই যেন আপনারে হারা।।
জল নিতে ভুলে যাই,         শুধু তারি পানে চাই,
বল সই এ কেমন ধারা।।
ঘরে মন নাহি সরে         বাঁশীরব শুনে লো,
ঘটিল যে এ বড় বালাই।।
শাশুড়ী ননদী সবে,         গঞ্জনার কথা কবে,
কেমনে যমুনা  জলে যাই!!

গান শেষ হয় না। জ্যাঠাইমা ফুলে ফুলে কাঁদতে থাকেন। তেরচা চাঁদের আলো ঢুকে আলমারির এক পাল্লায় পড়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে। তার সঙ্গে ধনার ঘরের টিভির আলো বারান্দায় মিলেমিশে নীলছে একটা দপদপে আলেয়া তৈরি করেছে। সেই আলোয় জ্যাঠাইমাকে রেখে চলে আসতে গিয়ে হারবার্ট দেখেছিল দেওয়ালে ঠেস দিয়ে গভীর মমতার সঙ্গে গান যেখান থেকে আসছিল সেদিকে চেয়ে আছেন জ্যাঠামশাই। কাঁদতে কাঁদতে নেমে এসেছিল হারবার্ট।

মন কেমন করে। চিলছাদ, ছায়া, রাত, সকাল, কাকের ডাক সব কিছুর জন্যে মন কেমন করে। বাবার জন্যে মন কেমন করে। মার জন্যে মন কেমন করে। জ্যাঠামশাই-এর জন্যে মন কেমন করে। জ্যাঠাইমার জন্যে মন কেমন করে। সব কিছুতে মায়া, টান থেকে যায়। সব কিছুর জন্যে মন কেমন করে।

নিজের ঘরে খাটের ওপরে উপুড় হয়ে বালিশ ভিজিয়ে হাউ হাউ করে কাঁদে হারবার্ট। বিনুর জন্যে কাঁদে। নিজের জন্যে কাঁদে হারবার্ট। বুকির জন্যে কাঁদে। মিথ্যে কথা বলার জন্যে কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের মধ্যে ফেঁপায়। চিৎ হয়ে শোয়। ঘুমের মধ্যে হাসতে থাকে। আবার ফোপায়। হাসে।

পিতা ললিতকুমার ও মাতা শোভারাণী শিশুপুত্রের এই বিচিত্রভাব দেখিতেছিলেন। বিস্মিত ললিতকুমার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে শোভারাণীর দিকে তাকাইতে শোভারাণী ঈষৎ মায়াময় হাসি হাসিয়া বলিলেন—’দ্যায়লা করচে।’

হারবার্টের ব্যবসা চলতে শুরু করল। একজন ডাক্তার এসেছিলেন তার ভাই এর বৌকে নিয়ে। ভাই আমেরিকায় ক্যানসারে মারা গেছে। একজন এয়ার হোস্টেস এসেছিল। সে তার বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চায়। দোহারা চেহারার একটি ছেলে এসেছিল একদিন। তার মা-র জন্যে। সদ্য বোধহয় কলেজে ঢুকেছে। যাবার সময় বলে গেল–যা কিছু আপনি বলছেন সবই ভেগ। একটা কংক্রিট কথাও বলতে পারেননি। আসলে আমার আসাটাই উচিত হয়নি।

ছেলেটিচলে যাবার পরে হারবার্ট কিছুক্ষণ চুপ করেছিল। তারপর বলেছিল,–আসাটাই উচিত হয়নি! বাপের বানচোৎ ছেলে। আমি আসতে বলেছিলুম?

ছয়

“আপনারে গেছি ভুলে, চাও গো মুখানি তুলে
ধর সখি দুইটি চুম্বন”।

–সরাজকুমারী দেবী

১৯৯১-এর শীতে, কোনো এক বিকেলে, কালো অলেস্টার ও বিনুর দেওয়া প্যান্ট পরে, গত তিন-চার বছরের শীতকালে যেমন হয়েছিল আয়নায় নিজেকে দেখে মোহিত হয় হারবার্ট ও বলে ক্যাট, ব্যাট, ওয়াটার, ডগ, ফিশ!

কী করবে এখন হারবার্ট? সেই অ্যাডভেঞ্চার সম্বন্ধেও একটা অস্পষ্ট ধারণা ছিল তার। এদিক থেকে মিনিট কুড়ি হাঁটলে সায়েব পাড়ার এলাকা-রাস্তার নামগুলো শুনলেই কেমন লাগে-লাউডন, রডন, রবিনসন, শর্ট, উট্রাম, উড, পার্ক…

উপর্যুপরি কয়েকদিন এভাবে অদ্ভুত চেহারার এই মানুষটিকে দেখে দারোয়ান বা কোনো আয়ার হয়তো মনে হয়ে থাকবে নোকটা পাগল এবং চেহারাটা ভালো করে দেখলে মনে হয় ওর গায়ে হয়তো সত্যি সায়েবের রক্ত আছে। তা না হলে ওরকম রং, ওরকম তাকানো, একটু নীলচে চোখে….

হারবার্ট হাঁটছে। হঠাৎ ‘প্যাকার্স এণ্ড মুভার্স’-এর দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে গেল। কিছু বলবে? কী যেন বলার ছিল। থাক, এখন না বললেও চলে। হারবার্ট বিড়বিড় করে ক্যাট, ব্যাট, ওয়াটার, ডগ, ফিশ!

কেকের দোকান থেকে গন্ধ বেরোচ্ছে। কালো কাচ দিয়ে দোকানটা সাজানো। ঢুকবে? উরে বাবা, কতটা জায়গা নিয়ে বাড়িটা।বিরাট গেট। ভেতরে একটা মারুতি ব্যাক করছে পেছনে সাদা  আলো জ্বেলে। যারা গাড়িতে তাদের থেকেও কিন্তু বাড়িটাকে ভালো চেনে হারবার্ট। ভেতরে একটা কাঠের সিঁড়ি থাকতেই হবে। সিঁড়িটা উঠে দুভাগে ভাগ হয়ে ডানদিকে বাঁদিকে উঠে গেছে। যেখানে ভাগ হয়েছে সেখানে একটা আয়না কালো কাঠের ফ্রেমে আটকানো, ফ্রেমটা আটকানো একটা স্ট্যাণ্ডে যার পা-গুলো বাঘের থাবার মতো ডুমোডুমো। দুপাশে দুটো পেতলের বড় ফুলরাখার পাত্র। ডানদিকের সিঁড়িটা দিয়েই হারবার্টের ওপরে ওঠার অভ্যেস। কিন্তু ওপরের ঘরগুলো কী রকম, কটা ঘর আছে, সেই ঘরে কী হয়েছিল, কে থাকত? মাথাটা ব্যথা করে হারবার্টের। একটা সিগারেট ধরায়। ফুটপাথে একটা পুরনো দিনের ঘোড়ার  জল খাবার লোহার চৌবাচ্চা। তার কিনারে বসে। মুখে যদিও বলে-ক্যাট, ব্যাট, ওয়াটার, ডগ, ফিশ।

কিন্তু আবছা করে যেন সাদা পোশাকের, ফিনফিনে, সাদা গা দেখা যাচ্ছে, সোনালী চুল ….. চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকে হারবার্ট … মোমবাতি জ্বলছে আর সেটা নিভিয়ে দেবার জন্যে ফুঁ দিতে, এগিয়ে আসছে কেউ নিচু হয়ে, কাচের গেলাসের শব্দ …..হারবার্ট চোখ খোলে। অন্ধকার ছড়িয়েছে। রাস্তায় আলোগুলো জ্বলেনি। গাড়ির আলো। হারবার্টের একই সঙ্গে মনে হয় কিছু একটা যেন বলার ছিল আর এই বাড়িতে ঐ চিলছাদটা নেই।

বিখ্যাত জুয়েলারের ছেলে তার কর্মচারিদের নিয়ে এসেছিল এবং হারবার্টের কথায় সে বেজায় অপ্রস্তুত হয়ে যায়। মুখ লাল হয়ে ওঠে।

-কী এসব বলছেন। আমার বাবা দেবতুল্য লোক ছিলেন। এঁদের-ই বলুন না, দীর্ঘদিন বাবার কাছে কাজ করেছেন এঁরা-বলুন না, দাসবাবু …।

-কী বলেছি যে আমায় ওদের কাছে জানতে হবে। কী বলেচি যে গিলতে পাচ্ছেন না। বিষম ঠেকচে। গালাগালমন্দ কিছু করেছি?

-ঐ যে বললেন বাবা পাপী।

হারবার্ট হা হা করে হেসে ওঠে–বলেচি যে সামান্য পাপী, তৃতীয় স্তরে বিরাজমান। মানে কিছু বোজেন যে প্যাক প্যাক করছেন?

ছেলেটি এবার চুপ করে থাকে। শুনে যায়-ব্যবসায়ী লোক। বিস্তর বড় জাল ফেলচে, জাল গুটোচ্চে, মাছ খামচাচ্চে, আবার এ পুকুরের এঁড়ে মাছ ও পুকুরে ছেড়ে দিচ্চে-কী বুঝলেন?

-আজ্ঞে, ওঁর তো মাছ-ফাছের ব্যবসা কখনও ছিল না, আমাদের তো জুয়েলারি…

-আরে বাবা, এগুলো হল হেঁয়ালি। বুঝতে হবে। বলচি যে ব্যবসায়ী মানে বিষয়-সম্পত্তির বন্দোবস্ত তো, মরণমূছা কাটতে একটু সময় লাগে। তবে খুব বেশি টানলে ঐ দেড় বছর … তারপর ছাড়া পেয়ে যাবে। দিব্যি উড়ে বেড়াবে। ওঃ কী যে লীলা।

-আমাদের কী করণীয় তাহলে?

-আপনাদের? কিচ্ছু না। মন দিয়ে ব্যবসা করুন। তবে হ্যাঁ, জমির ব্যাপারটা নিয়ে অতিপ্তি একটা আচে?

-জমি?

-হ্যাঁ, হ্যাঁ, জমি। বলচে বড় দুশ্চিন্তা, বড় অতিপ্তি। কী লটঘট আচে নাকি কোথাও?

-আজ্ঞে, ঐ বারাসাতের একটা জমি নিয়ে যে মামলাটা চলছিল ..

-থাক থাক ও আমার শুনে কাজ নেই। পারলে মিটিয়ে নিন। আমার কী!

-আমরা তাহলে আসি। আপনার দক্ষিণাটা …।

-রাখুন না, এখানেই রেখে দিন। আপনাদের আর কী, পাপ জমচে তো আমার। আসুন ভাই। দুগগা দুগগা।

আর একটা লোক বাইরে দাঁড়িয়েছিল। বড় বড় চুল। চশমা। বেশ স্মার্ট। ঘিয়ে ঘিয়ে রঙের র-সিল্ক-এর বুশ শার্ট আর চকোলেট রঙের ফুলপ্যান্ট-লোকটা জুয়েলাররা চলে যাবার পর ভেতরে এল কবে আপনাকে একটু ফাঁকায় পাওয়া যাবে বলুন তো।

-বলুন না। এখন তো ফাঁকাই আচি।

-না, এখন আবার আমার সময় নেই। ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে। বিকেলে আপনি কেস দেখেন?

-আজ্ঞে না, বিকেলে একটু বেড়াই।

-বেড়ান? একদিন না হয় নাই বেড়ালেন। ব্যাপারটা ইমপরট্যান্ট।

হারবার্ট ঘাবড়ে যায়, ঝামেলাটামেলা কিছু নয় তো?

-ঝামেলা। একভাবে দেখলে ঝামেলা বৈকি। হেভি ঝামেলা। ঠিক আছে, আমি একসময় ঠিক এসে যাব। সন্ধেবেলা কী করেন।

-চলে আসি সাড়ে সাতটার মধ্যে।

-তারপর পাড়ার ঐ লুম্পেনগুলোর সঙ্গে ড্রিংক করেন। দেখুন, আমি সব জানি। ঠিক আছে, দেখা হবে। চলি।

-খোলসা করে কিছু বললেন না। খটকা লাগচে কেমন।

-লাগুক। আমি আসব। এসে খটকাটী ভাঙব। চলি।

রবিনসন স্ট্রিটের নার্সিং হোম থেকে একটা গাড়িবেরোচ্ছিল। ড্রাইভারের মাথায় সাদা টুপি। সেই গাড়িটাতে সুন্দরী ববচুল এক লেডি ডাক্তাকে দেখে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল হারবার্ট। গাড়িটা বিদেশি। টয়োটা বা ডাটসুন কিছু হবে। এইসব গাড়িতে সাসপেনশন এত ভালো যে ঝকানি প্রায় হয় না, ঢেউএর মতো গাড়িটা চলে যায়। এরকমই একটা ঢেউ-তে লেডি ডাক্তার যখন মাথাটা একটু ঝাঁকি দিয়ে চুল ঠিক করছিল তখনই হারবার্ট তাকে দেখে হাঁ-মুখ স্ট্যাচু হয়ে যায়। কাচের মধ্যে দিয়ে দেখা ঐ মুখ। চেনা তো বটেই। কিছু অসম্ভব দরকারি কথা বলার ছিল। লেডি ডাক্তার শুনল না। ড্রাইভার গাড়ি চালিয়ে দিল। চলে গেল লেডি ডাক্তার। কাঠের সিঁড়ি দিয়ে কে নেমেছিল?

ফ্রেমে বাঁধানো আয়নার ডানদিকের সিঁড়ি দিয়ে হারবার্ট নামছিল আর বাঁদিকের সিঁড়ি দিয়ে যে উঠছিল, যার পিঠ, ববচুল, কাধ, কোমর, সাদা পোশাক পরা, জামার সঙ্গে ঝালর, গাড়ির মধ্যে লেডি ডাক্তারকে পাশ থেকে দেখা ১৯৯১-এর শীতে হারবার্টের এক আশ্চর্য আবিষ্কার, লেডি ডাক্তার, দাঁড়াও, ওভাবে চলে যেও না। হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে ছুটলেও আমি তোমার গাড়ির নাগাল পাব না–দাঁড়াও শোনো-কথাটা শুনলে কী এমন দোষ হবে, যদি একবার আয়নাটার সামনে গেলে একটাও কথা মনে পড়ে যায়–উঃ।

মাথাটা দপদপ করছে। অলেস্টারের মধ্যে গরম লাগছে। বড় বড় বোতাম। হঁচকা মেরে খুলতে গিয়ে একটা বড় কালো মেডেলের মতো বোম ছিঁড়ে ছিটকে পড়ে গেল। হাতড়ে কুড়িয়ে নেয় হারবার্ট। বোতামটা পকেটে রাখে। লেডি ডাক্তারকে কী বলবে হারবার্ট? হারবার্ট হাঁটতে থাকে। ফিসফিস করে বলে যায় ক্যাট, ব্যাট, ওয়াটার, ডগ …।

বেড়ানোর সময় বার বার, বিকেলের পর বিকেল ঐ নার্সিং হোমের সামনে এসে অনেকবার দাঁড়ালেও হারবার্ট আর ঐ লেডি ডাক্তারকে দেখতে পায়নি। খুব রাগ হয়েছিল। অভিমান হয়েছিল। শুনছে কে? লেডি ডাক্তার তো চলে গেল। শুনলই না। হারবার্ট হাঁটতে থাকে। মুখ দিয়ে মেশিনগানের শব্দ করে। মেশিনগান দেখেছিল হারবার্ট। সিনেমায়। রাষ্ট্রটাটাইটাট!

একটা আধপাগলা লোক এসে হাজির। তার বোন পালিয়ে যায়। কয়েকমাস পরে হাওড়া স্টেশনে ট্রাংকের মধ্যে বোনের টুকরোগুলোকে সনাক্ত করার পর তার মাথা বিগড়ে গেছে। সে এসেছিল হারবার্টের কাছে।

-আমি ট্রাংক, সুটকেস, কোনো বন্ধ বাক্স দেখতে পারি না। আমার শুধু মনে হয় বন্ধ ডালার ফাঁক দিয়ে চুল বেরিয়ে ঝুলছে। ডালাটা খুললেই দেখতে পাব..

লোকটা ময়লা শার্ট আর প্যান্ট পরা। ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে আর ‘না’ বলার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে-পারছি না। কিছুতেই স্ট্যাণ্ড করতে পারছি না, একটু হেলপ করুন, আই শ্যাল ডাই, দোহাই আপনার, একটু হেলপ করুন, আপনি তো পারেন ডেডদের সঙ্গে কমিউনিকেট করতে, আমার বোনটা …

এবার প্রায় চিৎকার করে কাঁদতে থাকে নোকটা। অনেকক্ষণ ধরে কাঁদে। পকেট থেকে নোংরা রুমাল বের করে মুখ মোছে, চশমা মোছে।

-আপনার বোনের নাম কী ছিল?

-শান্তা।

-হারবার্ট কাগজে লেখে–সানতা। তারপর নামটার তলায় একটা লাইন দেয়।

-ফটো-টটো কিছু আছে আপনার বোনের?

-ফটো তো আনিনি। তবে চলে যাবার পরে একটা চিঠি এসছিল ওর। তার জেরক্সটা আছে। দেব?

-জেরক্স কেন?

-ওরিজিনালটা লালবাজারে।

-বাবা! পুলিশ, ফৈজত, আচ্ছা দিন। আমার পড়ার দরকার নেই। একটু ছুঁয়ে থাকতে হবে। বসতে হবে কিন্তু আপনাকে। একটু ঘুরে আসুন না বরং। একা থাকলে কাজটা আর কী ভালো হয়।

-হ্যাঁ, ঘুরে আসছি। আপনি দয়া করে আমাকে হেলপ করুন। বিশ্বাস করুন আমি পাগল হয়ে যাব।

একে কি বলবেহারবার্ট ভেবে পায়নি। ঘরের দরজা বন্ধকরে জানালা দিয়ে আসা আলোয় হাঁচড়-পাঁচড় করে ‘পরলোকের কথা’ খুলেছিল। ভেবেছিল ‘ভ্রাতৃস্নেহেমৃতা ভগিনীর আবির্ভাব’ থেকে কিছু একটা দাঁড় করাতে পারবে—’সে ১৮৭২ সালের কথা। যশোহরের চাঁচড়ারাজ সরকারের প্রধান কর্মচারি ঁনবীনচন্দ্র বসু মহাশয় তখন সপরিবারে কলিকাতা সুকিয়া স্ট্রীটের ৩নং বাড়িতে বাস করিতে ছিলেন …তবে কি সে পেত্নী হইয়াছে?” এর থেকে কিছু পাওয়া সম্ভব নয়। ‘মৃতপত্নীর প্রতিহিংসা’ বা ‘সতীনের উপর আবির্ভাব’ থেকেও কোনো রাস্তা বেরোল না। ‘আমার হারানো মেয়ে জ্যোৎস্না’ থেকে বরং পাওয়া গেল উচ্চস্তরের আত্মা উজ্জ্বল হয়। তাতেই বা কী? হারবার্টের ভয় ভয় করেছিল। গোটাটাই। এ কী এলরে বাবা। হঠাৎ দরজায় টক্ টক শব্দ। দুরু দুরু বুকে দরজা খুলে দেখে চায়ের দোকানের ছেলে পাঁচু গেলাস নিতে এসেছে। পাঁচ বলল যে চায়ের দোকানে কেউ তো বসে নেই। তখন চটি গলিয়ে বেরিয়ে হারবার্ট সিগারেটের দোকান, বাস স্টপ সব দেখল। কোথাও নেই। লোকটা আর আসেনি। হারবার্টের কাছে অন্যান্য ঠিকানা  লেখা কাগজের সঙ্গেশান্তার চিঠির জেরক্স কপিটা থেকে গিয়েছিল।

লোকটিকে যা বলা যেতে পারত সেইগুলো বরং কাজে লেগে গেল। এক ছোকরা ডাক্তার, বাচ্চাদের স্পেশালিস্ট, সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল বেলজিয়ামের সুন্দরী অভিনেত্রী টিনাকে। টিনা ইন্ডিয়া দেখতে এসেছে। টিভি ও স্টেজে অভিনয় করে। ওকে দেখার জন্য হারবার্টের ঘরের সামনে ভিড় জমে গিয়েছিল। ডাক্তারটি হারবার্টের কথা ইংরিজি করে বলে দিচ্ছিল। টিনার মা-ও অভিনেত্রী ছিলেন। কিন্তু গাড়ির একসিডেন্টে পঙ্গু হয়ে যান। টিনার বাবা আবার বিয়ে করেছে। সেই মা মারা গেছেন। বড় দুঃখ টিনার। সস্নেহ মাতার আত্মার অনেক কার্যকলাপ হারবার্টের জানা-বিদেশী বলে একটু বেসিক থিওরিও প্রয়োগ করেছিল অব্যর্থ-মৃত্যুর পরে ছ’রকম প্রেত হয়–সেগুলো কী কী-কে কোন স্তরে থাকে-মার স্নেহ কীভাবে বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করে। টিনা বলেছিল সে একজন তিব্বতী লামার কাছে গিয়েছিল, লণ্ডনে। সেও বলেছিল-প্রেত ছয় রকমের কিন্তু তার মা কোথায় থাকতে পারে, কীভাবে আছে কিছুই বলতে পারেনি। মেমসাহেব একশ টাকা দিয়ে গিয়েছিল হারবার্টকে। পাড়ায় হারবার্টের ইজ্জৎ আরও দশগুণ বেড়ে গেল। ডাক্তার একটা রসিদেও সই করিয়েছিল হারবার্টকে।

-গুরু! তুমি তো ক্যান্টার করে দিচ্চ। মেমটা আবার কবে আসবে গো?

-দরকার পড়লেই আসবে। যা ডোজ দিয়েছি।

-বস্, তুমি নাকি মেমটাকে নিয়ে দরজা বন্ধ করে ভূত দেখিয়েচ।

-এই এক ক্যাওড়ামি তোদের গেল না। ওসব ফুটি মারার ধান্দা জানবি হারবার্ট করে না। মেম দেখাচ্চে! কত মেম বলে দেখলাম।

লেডি ডাক্তারের দেখা না পেলেও হারবার্ট পার্ক স্ট্রিটের এক বন্ধ অ্যান্টিকের দোকানে কাচের মধ্যে পরীকে দেখেছিল। এবং সঙ্গে সঙ্গে সে বুঝতে পেরেছিল যে ঐ পরীই লেডি ডাক্তার বা সিঁড়ি দিয়ে যে উঠে গিয়েছিল তার ছোটবেলা। পরীর থেকে একটু বড়ই ছিল বুকি। কিন্তু চিলছাদ থেকে দেখা বুকি অন্যরকম। মেলানো যায় না। কিন্তু পরীকে দিয়েই শুরু। সোনালী চুল, হলদেটে পাথর দিয়ে তৈরি। গায়ে পাথরের কাপড় জড়ানো। বাঁ হাতটা ভাজ করে মাথার পেছনে রাখা। ডান হাতটা উঁচু করে একটা  আলো ধরে আছে। আলোটা জ্বালানো যায়, কারণ একটা কালো ইলেকট্রিকের তার নেমে গেছে। ইলেকট্রিকের তারটা দেখতে অস্বস্তি হয় হারবার্টের। পরীর আশপাশে কত কী! পাথরের ফুলদানি, পাথরের চেয়ার, পেছন ফিরে থাকা কাঠের হাতি, পাথরের টেবিলের ওপরে রাখা মস্ত একটা পুরনো জাহাজের আলো।

-ক্যাট, ব্যাট, ওয়াটার, ডগ, ফিশ!

ঐ পরীর দিকে তাকিয়ে হারবার্ট কানে মৃতা পশ্চিমী নারীদের গান শুনতে পেয়েছিল। সেই গান দল বেঁধে বিলাপ করতে করতে এসে ধোঁয়াধুলো মাখা দোকানের কাচে ধাক্কা মারে। হায় নগ্ন পরী! জার্মান মেশিনগানের সামনে সেই রুশী যুবতী যেননগ্ন, দুহাত দিয়ে বুক ঢেকে দৌড়চ্ছে কালো মাটির ওপর। শুনতে সে কোনো কথাই চাইছে না। ব্যস্ত পথচারীরা দাঁড়িয়ে চুপ করে থাকলে শুনতে পেত যে হারবার্ট গুমরে গুমরে মুগ্ধ হয়ে কাঁদছে এবং সেই পরী ক্রমশ ওপরে উঠছে–তার গাল ঘষে দিচ্ছে দড়ি মইতে বাধা বিরাট বেলুন। শীতের পার্ক স্ট্রিটে এক ঝলক রেফ্রিজারেটরের হাওয়া এসে হারবার্টকে জড়িয়ে ধরে। হারবার্ট অলেস্টারের কলারটা তুলে দেয় এবং তাকে হলিউড ছাড়া এখন অন্য কিছু ভাবা অসম্ভব। এখনও বিকেল আছে। তখনও বিকেল ছিল। এরপর অন্ধকার ছেয়ে এলে পরীও লুকোতে শুরু করবে। গাড়ির আলো কখনো কখনো তাকে চমকে দেবে। মনে হবে তার ঠোঁট নড়ছে। অন্ধ দুটো চোখে হলুদ আলো জ্বলছে। হারবার্ট ফিসফিস করে বলেছিল,-জেপটে জুপটে থাকো এখন। ফের আসবখন।

ফেরার রাস্তায় গাছ, পরিচিত কুষ্ঠরোগী, বারান্দার থাম, সাইনবোর্ড, চায়ের দোকান, ডিউটি সেরে বাড়িতে ফেরা আয়া, নার্স, বেশ্যা, পার্কের রেলিং, জলাধারের গায়ে আঁকা সিংহ ও মিকিমাউসের ছবি, শহরের পাতাল থেকে উঠে আসা জল–প্রত্যেককে আলাদা করে কিছু না কিছু বলার ছিল। বিজ্ঞাপনের বিরাট হোর্ডিং এর ওপরে গাড়ির  আলোর চলাফেরা দেখে হারবার্টের মনে হয় সে সিনেমার পর্দার দিকে তাকিয়ে আছে। রাস্তার ভিড়ে, কৃষ্ণদাদার পাশে দাঁড়িয়ে হারবার্ট ফল অব বার্লিন দেখেছিল। তার সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আরও ডকুমেন্টারি ছিল। নগ্ন একটি রুশী যুবতী দুহাতে বুক ঢেকে কালো মাটির ওপর দিয়ে দৌড়চ্ছে আর কয়েকজন জার্মান সেনা মেশিনগান তুলে ধরছে। সেই যুবতী ছুটছে তো ছুটছেই। শুনতে সে কোনো কথাই চাইছে না। রাষ্ট্র টা টা টাট..

বছরের চাকা ঘুরল। ১৯৯২ এল দেদার কেচ্ছা-ফেচ্ছা, চুরিচামারি আর হারামিপনার ফিরিস্তি নিয়ে। বছরের শুরুটা হারবার্টের খারাপ হয়নি। কয়েকটা বাংলা কাগজে দু-একটা লেখাও বেরিয়েছে। জানুয়ারিতে বিশেষ কিছু হল না, ফেব্রুয়ারিতেও না-টুকটাক কেস অবশ্য আসছিল। মার্চেও বিশেষ কিছু না। পয়সা যা আসছিল তাতে হারবার্ট খুশিই ছিল। তবে মাল, সিগারেটের খরচাটা বড় বেড়ে গিয়েছিল। হারবার্ট ঠিক করল দোল যখন ১৮ তারিখে পড়েছে তখন রংবাহারী খরচ খরচা যা হবার হয়ে যাক। এরপর সব ছেড়েছুঁড়ে, সাত্ত্বিক টাইপের হয়ে যাবে। সাহসটাও কেমন যেন কমে যাচ্ছিল হারবার্টের। আসলে গণ্ডগোল হয়েছিল মেশিনে-সাউণ্ড আছে, পিকচার নেই। পিকচার আছে, সাউণ্ড নেই। মানুষও তো টিভি। হারবার্টের শরীরটা এখানে ওখানে কাঁ কে করছিল কিছুদিন ধরে। জ্যাঠাইমা বলেছিল,-ারে পয়সাকড়ি আসছে, শরীরটা অমন মাছের কাটার মতো হচ্ছে কেন রে? বেশি নেশাভাং করচিস তাহলে।

যাঃ কী যে বলল জ্যাঠাইমা। আসলে হয়েছে কী জানো, ধকল যাচ্চে তো খুব, একেবারে হাড়কালি করা ধকল, তাই সব বসা শুকিয়ে যাচ্চে, মাসে জমচে না।

-বসা টানা তো সাধুপুরুষের লক্ষণ রে। আমার হারুর সাধু হয়ে কাজ নেই। তোকে আমি বিয়ে দেব। সংসারে বাঁধতে হবে।

-কে আমাকে বিয়ে করবে জ্যাঠাইমা।

-শোন কতা। রোজগেরে ছেলে। এমন দেবকান্তি দেকতে। কত ছুঁড়ি বলে পুঁতি খুঁজতে খুঁজতে বরের ঘরে ছুটবে

পুঁতি গড়িয়ে যায়। সেই পুঁতি খুঁজতে খুঁজতে কেউ তো হারবার্টের কাছে আসেনি। না বুকি। না লেডি ডাক্তার। আর পরী? না, পরীকে কিছুতেই হারবার্ট বৌ বলে ভাবতে পারে না। দোলের দিন খুব রং খেলা হল। মাথার চুলের মধ্যে কী একটা দিয়েছিল কেউ যত  জল ঢালে ততই রং বেরোয়। ততই রং বেরোয়। গলগল করে।

দোলের পরের দিন। খোঁয়ারি কাটেনি। ভরদুপুর বেলায় ভেজানো দরজা খুলে সেই বানচোৎ এসে হাজির যে ঘিয়ে রঙের র-সিল্কের বুশ শার্ট পরে এসে বলে গিয়েছিল যে সময়মতো এসে খটকা ভেঙে দেবে। হারবার্ট তখন স্বপ্ন দেখছিল সে হাসপাতালের দরদালানে বড় বড় কাচের বয়ামে রাখা মানুষের নানা রকম শরীরের টুকরো, গাদা বাচ্চা, মুখ চোখ হয়নি, এই সবের মধ্যে দিয়ে সে একটা ন্যাংটো মেয়েকে নিয়ে পালাচ্চে। ল্যাংটো মেয়েকে নিয়ে বেরোবে কী করে? উপায় ছিল। হাসপাতালের চত্বরে ছায়া ছায়া জায়গায় খানকিরা মরা মেয়েদের কাপড় বিক্রি করছিল। সস্তায় একটা নাইলনের কাপড় হারবার্ট সেইন্যাংটো মেয়েকে কিনে দিল। কাপড়টা পরে হারবার্ট আর মেয়েটা হাসপাতালের গেট থেকে বেরিয়ে দেখল ট্রাম-ডিপো। কিন্তু ট্রামে না চড়ে তারা একটা রিকসাতে উঠল। রিকসাটা চলছে। হারবার্ট নিচে তাকিয়ে দেখে তো অবাক–আরে, মেয়েটার পায়ে একটা হাইহিল জুতো সে তো খেয়াল করেনি। মেয়েটার বগল এই তো পাশে। নাইলন ঢাকা দেওয়া বুক শুরু। সেই সময় চোখ খুলল হারবার্ট। ঝুঁকে র-সিল্ক ঘিয়ে ঘিয়ে বুশ শার্ট তাকিয়ে।

-ঘুম হচ্ছে? ঘুমিয়ে থাকলে খটকা ভাংবে?

হারবার্ট ধড়মড় করে উঠে বসে।

-বলেছিলাম না, সময়মতো আসব। ওঠো, জাগো, হারবার্ট সরকার, তোমার সঙ্গে আমার ভীষণ দরকার।

লোকটা ব্রিফকেস খুলে একটা চ্যাপটা মদের বোতল বের করেছিল। বের করেছিল দুটো ফিনফিনে গেলাশ। এক প্যাকেট ক্লাসিক সিগারেট। লাইটার। হারবার্টকে বলেছিল,–যাও পাঁচু, গিয়ে মুতে এসো, এসে, গাট হয়ে বসো। অবাধ্য গর্দভের মতো চেয়ে থেকো না। যা বলছি তাই করো। এতে তোমারও মোঙ্গল, আমারও চেংগিশ খান।

হারবার্ট ঘেবড়ে যেয়ে দুদ্দাড় করে হিসুফি সেরে ফিরে দেখল লোকটা দুটো গেলাস ভরতি করে সাজিয়ে বসে আছে। দুজনে গেলাস ধরল, সিগারেট ধরাল, লোকটি বলল,-চিয়ার্স নয়, স্কুল নয়, আমরা বাঙালি, বাংলাদেশে এখন সবাই বলছে–উল্লাস! হারবার্টও বলল,-উল্লাস!

লোকটির নাম সুরপতি মারিক। বাড়ি, জমি, ভেড়ি, কয়লা, মোপেড-নানা বিষয়ে মধ্যস্থতা করে প্রভূত অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে। কমপিউটারাইজড় হরোস্কোপ এদেশে যাঁরা প্রথম চালু করেন তাদের মধ্যে নাকি শ্রীমারিকও ছিলেন। বড় মাপের প্রফেশনাল ফুটবল কলকাতায় চালু করার জন্যে হন্যে হয়ে যাচ্ছে সুরপতি। রুসি মোদি, রতন টাটা, ছাবারিয়া, আমবানি–এদের সকলের সঙ্গেই বিগত তিন বছরে ফুটবলের ব্যাপার নিয়ে সুরপতির কথা হয়েছে। কিন্তু এখন তার নজর হারবার্টের দিকে পড়েছে। নেক নজরে তাকিয়ে থেকে সুরপতি বলে যায়–দ্যাখো ভাই, তোমার ঐ ভূতফুৎ আমি মানি না। ওদের সঙ্গে তোমার কেমন দহরম মহরম তাতে আমার বিশ্বাসও নেই, অবিশ্বাসও নেই। আমি শুধু একটা ব্যাপার বুঝিতেলাপিয়া যদি চৌবাচ্চায় থাকে তার সাইজ বাড়ে না।

-মানে ভাই, তুমি বলতে চাই আমি চৌবাচ্চার তেলাপিয়া?

-তা নয়তো কী? ঝিলের গজাল না সাগরের তিমি। স্পেডকে স্পেড় আমি বলবই।

-তা তোমার মোদ্দা কতাটা কী সেটা ঝেড়ে কাশলেই তো হয়। এরপর নেশা চেপে ধরবে, মাথা গুলোবে।

সুরপতি মারিক চোখ বন্ধ করে। বলে চলে–গুড! গুড, ওসব গ্যাঁজাগেঁজি আমিও ডু নট লাইক! মোদ্দা কথাটা হল তোমাকে আমি টপ লেভেলে নিয়ে যাব। তাতে আমারও স্বার্থ থাকবে। মিনিমাগনা এই হুইস্কিটা তাহলে কিনতুম না। আর যাই। করো, আমাকে চোদু ভেব না। তোমার মতো কাঁড়ি কাঁড়ি হারবার্ট আমি ফেলেছি। আবার হেঁকে তুলেছি।

সুরপতি মারিক চোখ খোলে। বলে চলে,-একটা কাচফাচ লাগানো, এ.সি. লাগানো ঘ্যাম অফিস। দেওয়ালে নানা রকম ছবি। একটা মেয়ে কম্পিউটার চালাচ্ছে। তাকে ঝকঝক করছে এ লাইনের দামী দামী বই। বাজনা বাজছে আস্তে আস্তে। ঢিমে আলো। কার্পেট। পাঁচশো টাকা ভিজিট। মিনিমাম। স্পেশাল কেস হলে আরো বেশি। এরপর বম্বে, দিল্লি। মরা পলিটিশিয়ান কী মেসেজ পাঠাচ্ছে সেটা জ্যান্ত পলিটিশিয়ানের কানে একবারটি তুলে দেওয়া। এই ভাবে ফাটকার কিং পিন, বিগ বুলদের কয়েকটাকে বশ করে ফেলা। তার সঙ্গে নির্লিপ্তি, শ্মশানবৈরাগ্য। তারপর দুবাই। বাহরিন। মরা শেখ, জ্যান্ত শেখ। এয়ার ইন্ডিয়া। টাটা সিয়েরা। বলহরি হরিবোল। রাম নাম সত্য হ্যায়। আর বলতে পারছি না। দাঁড়াও, আর এক পাত্তর ঢালি। মালটা কিন্তু সুন্। কী বলো? হারবার্ট জমতে থাকা নেশার থেকে ভরসা জোটায় ঠিকই কিন্তু মনের মধ্যে কোথাও যেন হবে না হবে না ভাব, কিন্তু এসব করতে গেলে তো ইংরিজি না জানলে চলবে না। ওখানেই তো আমাকে মেরে রেখেছে কিনা।

-বাল হবে ইংরিজি দিয়ে। শালা, ইন্টারপ্রেটার থাকবে তোমার, যা বলবে স্যাটাসাট বলে দেবে। পার্টি বেগড়বাই করলে দাঁত চিপে শুনিয়ে দেবে–ফাঁক ইউ! টিট। কান্ট! প্রিক!

-তাহলে হবে বলচ, পারব? আমার ভয় একটা কেচ্ছা না করে ফেলি।

-দূর! তোমার মনে খালি ভয়। আমার আবার অভয়, বরাভয়। ব্যবস্থা তো আমার। ফিফটি-ফিফটি। মারিক সরকার এন্টারপ্রাইজ।

পেটেতে পুরিয়া পাঁট
রাজী তবে হারবার্ট …
কি ঠিকতো?

-তুমি আবার কবে আসচ ভাই।

-ঐ তো। কবে, কখন আসব সেটা আমার ব্যাপার। মারিক এলোন উইল ডিসাইড। এখন আমার কাজ তোমাকে একটু তুলে ধরা। একটু সুগন্ধ নাকে নাকে পৌঁছে দেওয়া। ওয়াশিং পাউডার নিরমা।

-মানে?

-এ শালা তো দেখছি স্প্যাসটিক। তোমাকে যে বাচ্চারা বাটপাখি! বাটপাখি! বলে, আই সাপোর্ট দেম। এখন আমার একনম্বর কাজ হবে তোমার জন্যে পাবলিসিটির ব্যবস্থা। সাঁড়াশি স্ট্রাটেজি। একদিকে চলবে হুইস্পর ক্যাম্পেন… গুজগুজ ফুশফুশ। অন্যদিকে ইংরিজি কাগজে দু-একটা মাল ভিড়িয়ে দেওয়া। যাই হোক, আমাদের কারবার শুরু হয়ে গেল। আমি চললুম। আর হ্যাঁ, সিগারেটের প্যাকেটটা রেখে দাও। আর ঐ পাড়ার বংকা-ললটো-মদনাদের সঙ্গে বাংলা খেয়ে খেয়ে লিভারটার বারোটা বাজিও না। এর পরে এ.সি. ঘরে বসে ডিম  আলো জ্বেলে তুমি আর আমি ব্ল্যাক ডগ খাব!

সুরপতি মারিক যাবার আগে হারবার্টের গাল ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলে যায় গুলু গুলু গুলু গুলু!

সন্ধ্যা ঘনায়। অন্ধকারে ক্লাসিক সিগারেট ধরায় হারবার্ট। বুকি, লেডি ডাক্তার, পরী … দীর্ঘশ্বাস আসেই কিন্তু এদিকে স্বর্গের দরজা যে একটু একটু করে খুলছে। সুর করে করে হারবার্ট বলে চলে,

ক্যাট, ব্যাট, ওয়াটার, ডগ, ফিশ …
ক্যাট, ব্যাট, ওয়াটার, ডগ, ফিশ …
ক্যাট, ব্যাট, ওয়াটার ডগ, ফিশ …

অন্ধকারের মধ্যে সিগারেটের ধোঁয়া নানারকমের নকশা তৈরি করে যদিও তা দেখা যায় না। গোল আগুনটা শুধু বাড়ে, কমে।

সাত

“ওই শোন সমস্বরে    বলিছে হেথায় নাহি
বিলাপের স্থান।”

–হিরন্ময়ী দেবী

নিষ্ঠুরতম এপ্রিলে কলকাতায় পুঞ্জ পুঞ্জ হিংস্র ভাইরাস দাপিয়ে দাপিয়ে ঘুরে বেড়ায়। একেবারে রাস্তায় বা ঝোঁপড়িতে যারা থাকে তারা এইসব ভাইরাসের সঙ্গে মহাযুদ্ধ করে, নিগুঢ় দক্ষতায় প্রতিষেধক অ্যান্টিবডি তৈরি করতে পেরেছে বলে বিশ্বাস কারণ তা না হলে এদের স্টোনম্যানের হাতে পাঁচ-সাতটি করে মরতে হত না, ভাইরাসের কামড়েই তারা বাল-বাচ্চা সমেত ঝাড়েগুষ্টিতে ফৌত হয়ে যেত। এই অজানা, বিকট, পিশাচসিদ্ধ ভাইরাসেরা অক্লেশেই ফতে করে মধ্যম বর্গকে, যাদের ঋতু পরিবর্তনের সময় শরীরে ভিটামিন-সি কমে যায়। যে যুবতীরা বসন্ত সমাগমে পুংকেশরের রোঁয়ার সুখময় স্পর্শের কথা ভেবে দেহবল্লরীতে টক আগুন জ্বালিয়েছিল তারাও অশ্লীল স্বপ্নের মধ্যে ফুলে ফুলে এই ভাইরাসকে “নাথ, নাথ?” বলে ডাকে এবং সেই ভাতঘুম থেকে প্রভূত শ্লেষ্ম-বিজড়িত অবস্থায় জেগে ওঠে। যুবকেরা জাগরণেই ভাইরাল কুস্তির বগলী প্যাঁচে অজান্তে কোতল হয়। এই ভাইরাসপুঞ্জই নির্ভাবনায় বসে থাকা হাঁসের মতো হারবার্টকে পেয়ে গেল। সবাই জানে যে দারোগারাই ডিম খায় হাঁসের অক্লান্ত ফাকিং-এর পরিশ্রম থেকে। এক্ষেত্রে কিন্তু ডিম খায় ডাক্তাররা। কারণ এই ভাইরাস মারার অস্ত্র তাদেরই কুক্ষিগত।

শুরু হয়েছিল পিঠ কোমর ঘাড়ে ব্যথা আর নাক দিয়ে  জল ঝরা দিয়ে। ভেবেছিল ঝাল চর্বির বড়া আর বাংলা (“খালি বোতল আস্ত অবস্থায় ফেরৎ দিলে বোতলের দাম ২০৫ পয়সা ফেরত দেওয়া হইবে”) কড়া করে মেরে দিলে ম্যাজম্যাজানি পালাতে পথ পাবে না কিন্তু রেজাল্ট হল একেবার উল্টো। অঘোর জ্বর এল। সঙ্গে বমি। দুদিনের পর অচৈতন্য হারবার্টকে দেখে জ্যাঠাইমা ধনাকে বলল। ধনা গজগজ করতে করতে সেলুনের পাশে হোমিওপ্যাথ শেতল ডাক্তারকে ডাকল। ফল কী হল বোঝা গেল না। জ্বর আরও বেড়ে গেল। শুরু হল ভুল বকা।

-“আধলা ঝাড়ব। আধলা ঝাড়ব।” চেঁচিয়ে উঠে হারবার্ট আবার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিল। তখন সে দেখছিল একটা জায়গায় সে আটকে গেছে। গলির মধ্যে। ওখানে ভীষণ নোংরা আর পেছল। কিন্তু ফিরতে পারছে না। কারণ ময়লার মধ্যে এক চোখ কানা একটা ঘেয়োবেড়াল বসে আছে। গেলেই কামড়াবে। তাকে মারবে বলে হারবার্ট একটা আধলা ইট তুলে চেঁচায়,-ঘেয়োবেড়াল কামড়ালে আধলা মারব। আধলা ঝাড়ব।

ডাক্তার, সোমনাথ ওরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। কোকা জলপট্টি দেয়। কী আরাম। দোতলায়, কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উঠে, ওপরের কোথায় ঘরে, মোমবাতি নিভিয়ে দেবার জন্যে যে নিচু হয়েছিল সে ঝুঁকে দেখছে কিন্তু তাকে দেখা যাচ্ছে না..আবার ঘেয়োবেড়ালটা তেড়ে আসে …

-আধলা ঝাড়ব! আধলা! ঝাড় …

একবার জ্ঞান ফেরে হারবার্টের। যেন জলের তলা থেকে ঘরটাকে দেখছে। জ্যাঠাইমা, সোমনাথ, বুলান, কোকা … জানলা …

-জ্যাঠাইমা, জ্যাঠাইমা!

-বল বাবা। আমি শুনছি।

-বড় দুব্বল লাগচে।

-জ্বর হয়েছে তো। সেরে যাবে বাবা।

-বার বার ঘেয়োবেড়াল কামড়াতে আসছে।

-আর আসবে না। আমি তাড়িয়ে দেব এলেই।

-আসবে না?

-না, আসবে না।

ঘেয়োবেড়াল আর আসেনি। কিন্তু সেই রাতেই হারবার্টের চোখে শুধু তলার দিকের আধখানা আছে এরকম কয়েকটা মানুষ চিৎকার করে দৌড়ে বেড়াচ্ছিল। কোমরের ওপর থেকে কিছু নেই। ঘরে চেয়ারে বসে ঢুলছিল সোমনাথ। হারবার্টের গোঙানি শুনে সে  আলো জ্বেলেছিল। হারবার্টের চোখগুলো এদিক ওদিক করছিল। পরে একটু ঘাম হল। হারবার্ট আবার ঘুমিয়ে পড়ল। সোমনাথও ঘুমিয়ে পড়ল। বাকি রাতটুকু শোভারাণী ছেলের কপালে হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন। বিলিতি ইউডিকোলনের কী সুগন্ধ!

পরের দিন সুধীর ডাক্তারকে খবর দেওয়া হল। বাড়িতে এলে কুড়ি টাকা ভিজিট। অনেকক্ষণ ধরে দেখলেন। শেষে বললেন, বিশ্রী একজাতের ডেঙ্গু খুব হচ্ছে আজকাল। অবস্কিওর ভাইরাল অরিজিন। ধরে যাবে, টাইম নেবে। একটা অ্যান্টিবায়োটিক ক্যাপসুল দিলাম। দিনে তিনবার করে অন্তত দশ দিন চলবে। সঙ্গে একটা ভিটামিনও দিলাম। তা না হলে আরও দুর্বল হয়ে পড়বে। হাল্কা খাবার চলবে। ম্যাক্সিমাম রেস্ট।

ধন্‌না জিজ্ঞেস করল, ভাত খাবে কবে ডাক্তারবাবু?

-এখনই খাক না। একটু পেস্ট করে খাইয়ে দিন না। লাইট খাবার, সুপ … দিন সাতেক পরে হারবার্ট একটু সুস্থ বোধ করতে শুরু করল। অসম্ভব ঘুমোত। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি হয়ে গিয়েছিল। ওষুধ, তারপর মাগুরমাছ, মুসাম্বি–এসবের খরচ জ্যাঠাইমাই দিয়েছিল। হারবার্টের তোরঙ্গ খুলতে হয়নি। হারবার্ট যখন অচেতন তখন একদিন সুরপতি মারিক এসেছিল। তার কাজ কিছুটা এগিয়েছে সেটা জানাতে। হারবার্টের শরীরের খোঁজখবর ছেলেদের কাছ থেকে নিয়ে গিয়েছিল। ভালো ডাক্তার দেখেছেন শুনে আশ্বস্তও হয়েছিল। ছেলেদের বলেছিল–যাই হোক, একটু সুস্থ হলে বলবেন একেবারে চিন্তা না করতে একদম প্ল্যানমাফিক কাজ এগোচ্ছে। ওঁর বিষয়ে দুটো ইংরিজি লেখা বেরোবার কথা আছে। কিছুদিনের জন্যে আমি একটু সাউথে যাচ্ছি। সেই সময় যদি লেখাগুলো বের হয় তাহলে ফিরে এসে, সেগুলোর কাটিং নিয়ে আমি আসব বলবেন। চলি ভাই। খুব করছেন আপনারা যা হোক। এরকম আজকাল তো দেখাই যায় না। পাড়ার ব্যাপারটাই তো লোপাট হয়ে যাচ্ছে। কলকাতা থেকে। বড় ভালো লাগল ভাই। বলবেন কিন্তু মনে করে। গুড নাইট। গুড নাইট।

ওদের সকলকে ক্লাসিক সিগারেট খাইয়েছিল মারিক। এবং কথাগুলোও সে ফালতু বলেনি। এপ্রিলের শেষ রবিবার আর তার আগের সপ্তাহের শনিবার দুটো ইংরিজি কাগজে দু-দুটো লেখাই বেরোল-ডেড স্পিকন্স ইন দা ডিভাইন সুপারমার্কেট এবং মেসেজেস ফ্রম দা আদার সাইড। ঠিক লোকদের নজরে লেখাগুলো ঠিকই পড়েছিল। এ ছাড়াও হারবার্ট সম্বন্ধে আরও বিশদ খবরাখবর চেয়ে ঐ দুটি কাগজের দপ্তরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ফেট’, ‘জেটেটিক স্কলার’ ও ইংল্যাণ্ডের ‘ফর্টিয়ান টাইমস’ এবং ‘আনএক্সপ্লেইন’ পত্রিকা থেকে চিঠি এসেছিল।

সারাদিন প্রায় অকাতরে ঘুমোত হারবার্ট। জেগে থাকলে যদি পড়তে ভালো লাগে তাই ডাক্তার ওকে কান্তি পি. দত্তের  লেখা ভূতের জলসায় গোপাল ভাঁড় দিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কয়েকটা লাইনের বেশি ও পড়তে পারত না। ঘুমিয়ে পড়ত। ঘুম ভাঙতে দেখত বিকেলের আধমরা আলো বন্ধ জানালার শার্সিতে লেপটে আছে। ঘরের মধ্যে তারপর আলো আরও কমত। কোনো বাড়ি থেকে রেডিওর গান হয়তো আসছে না আসছে না। শালিখ পাখিগুলো গলির কার্নিসের ফাঁকফেঁকরে ফিরে আসছে। ঘরে আলো জ্বালিয়ে দিয়ে যেত কেউ। আবার ঘুম। ঘুম ভাঙতে দেখল ঘরে দু-চারজন পাড়ার ছেলে। চুপ করে বসে আছে।

-রোজগারপাতি তত বন্ধ হয়ে গেল রে! এ শালা কী জ্বররে বাবা। হাড়মজ্জা সব যেন কাঁকলাসে শুষে খেয়েছে।

-কদিনের মধ্যেই তাগড়া হয়ে যাবে হারবার্টদা। আর আমরা তো আচি।

-হারবার্টদা, একটা কতা, সাহস করে বলব গুরু? আগে বলো রাগ করবে ।

হারবার্ট জানত ওরা কী বলবে। বলত, তোরঙ্গ খুলে নে না। তবে হ্যাঁ, উকিলের ছেলেকে চাইলেও কোনো পয়সা দিবিনি।

-না, গুরু। আমরা শুধু নিজেদের জন্যে কুড়ি নেব।

-নে না। কুড়ি, পঁচিশ যা দরকার নে। ওঃ শীত করচে রে।

-চাদরটা টেনে দিচ্চি।

-কেউ ঘরে থাকবি তো?

-সে কি গুরু! একজন শুদু যাবে আর আসবে।

যাবে আর আসবে। সে বরং ভালো যাবে আর আসবে। .. যাবে… আর… হারবার্ট আবার ঘুমিয়ে পড়ে।

“যাঁহারা সামুদ্রবিদ্যায় বিশারদ, ভঁহারা বলেন, প্রত্যেক মানুষই আপন আপন কর্তব্যকর্মের ও কর্মফলভোগের তালিকা বা বিবরণসহ জন্মগ্রহণ করে। সে তালিকা তাহাদের পূর্বকর্মানুসারে বিধাতা কর্তৃক অথবা নিয়তি কর্তৃক প্রস্তুত হয়। সে তালিকা কী?”

ঘুমন্ত হারবার্টকে দেখতে অপূর্ব লাগে। সে যদি জলেও নিমজ্জিত থাকে সেই জলাকাশেও চাঁদ ও সূর্য ওঠে। তারকারা বিস্ফারিত চোখে আলোকবর্ষ দূরে  আলো পাঠায়। সেই আলো চোখের পাতায় লাগলে জন্মান্ধও চমকিত ও শিহরিত হয়।

“যেমন মনুষ্য এক জাতি, ইহার অবান্তরজাতি অনেক, তেমনি, ভূত এক জাতি, ইহার অবান্তরজাতি অনেক। অপিচ, ভূত জাতীয় জীব সমস্তই যে তুল্যধর্মা বা তুল্য স্বভাবসম্পন্ন, তাহা নহে। ইহাদের মধ্যেও বিশেষ ভাব বা তারতম্য ভাব প্রচুর পরিমাণে আছে। উহাদের মধ্যে জ্ঞানী ভূত ও মুখ ভূত, শান্ত ভূত ও অশান্ত ভূত, সমস্ত ভেদই আছে, ইহা ভূতবিদ্যাবিশারদদিগের মধ্যে অত্যন্ত প্রসিদ্ধ।”

(পঃ রঃ)

জাহাজের আলো জ্বলে ওঠে। পেছন ফিরে থাকা কাঠের হাতি এপাশে মুখ ঘুরিয়ে শুড় দোলায়। ঘেয়োবেড়াল আসতে চেষ্টা করেছিল, হাতি পা ঠোকাতে পালিয়ে যায়। মামদো ভূতের সঙ্গে গোপালের মোলাকাৎ হয়। হারবার্ট কাচের মিছরি চেটে চেটে গলিয়ে দেয়। ‘গোপাল কাঁপতে কাঁপতে জিগ্যেস করল : আপনি কে? আমি মামদো ভূত।’ পাথরের চেয়ারটেবিল হাওয়ায় ওড়াউড়ি করে। পরী প্রজাপতি বা মথের মতো কাচের ঘরে উড়ে বেড়ায়। ঘুমের মধ্যে চমকে, চমকে জেগে উঠেছিল হারবার্ট। ১৯৯২ সালের মে দিবস। রাশিয়াতে বরিস ইয়েলৎসিন জব্বর ভুতের জলসা বসিয়েছেন। লাখ লাখ কমিউনিস্ট ক্যাপিটালিজমের ভূত দেখছে। সলঝেনিৎসিনের ছদ্মবেশে রাসপুটিন ফিরে আসছে। যুগোশ্লাভিয়া ভেঙে পড়ছে। ক্রোশিয়ান টেনিস খেলোয়াড় গোরান ইভনিসেভিচ ভাবছে প্রচণ্ড গতিতে সার্ভ করে জিম কুরিয়ার বা আন্দ্রেই আগাসিকে পুঁতে ফেলবে। শেষবার এক দেশের দল হিসেবে সুইডেনে খেলতে যাবে বলে তৈরি হচ্ছিল কমনওয়েলথ অফ ইণ্ডিপেনডেন্ট স্টেটস বা প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন। একীভূত জার্মানি ভেবে পাচ্ছে না কাদের দিয়ে দল গড়বে-পূর্ব না পশ্চিম? বম্বেতে বসে হরশদ মেহতা বলে একটা লোক দিল্লি থেকে ছক অনুমোদনের টেলিফোন পাবে বলে অপেক্ষা করছিল। পোল্যাণ্ড, চেকোশ্লোভেকিয়া, বুলগেরিয়া, রুমানিয়া, আলবেনিয়া জুড়ে মহা হট্টগোল। কমিউনিজম কেলিয়ে পড়েছে। এরকম সময়েই হারবার্ট, কলকাতায়, ১৯৯২ সালের মে দিবসের রণধ্বনি শুনে ভেবেছিল যে রায়ট লেগেছে না দেশ স্বাধীন হল না তেরো জন অশ্বারোহী অবলীলাক্রমে …।

১৬ মে হারবার্ট অপেক্ষাকৃত সুস্থ বোধ করে ছাদে উঠেছিল এবং সন্ধ্যায় ছাদে সে অবসন্ন ও আধা-অজ্ঞান হয়ে পড়ে। সে সময় আকাশে সপ্তর্ষি, মৃগশিরা, কোয়াসার, পালসার, ব্ল্যাক হোল, হোয়াইট ডোয়ার্ফ, রেড জায়েন্ট-সব শালাই ছিল। ঈষৎ চৈতন্য ফিরতে হারবার্ট দেখেছিল যে দশটি নখ সহ দুটি বিশাল পা এর সামনে নতজানু হয়ে আছে যাঁর হাঁটু তিন তলা, তারও ওপরে তার বিশাল লিঙ্গ, দোদুল্যমান অণ্ডকোষ, জাম্বো যৌনকেশ ও তারও ওপরে, এতই গগনচুম্বী যে প্রায় ধোঁয়া ধোঁয়া। সে গগনবিদারী স্বরে বলেছিল, হাঃ হাঃ হারবার্ট, ললিতকুমারের ঔরসে ও শোভারাণীর গর্ভে নির্মিত, স্কাউন্ডেল, হতভাগ্য বানচোৎ হারবাট গড় কর, গড় কর …

-আপনি কে?

-শূওরের বাচ্চা! আমি কে? আমি ধুঁই।

-আপনি ধুঁই? আপনিই।

-চোপ। একটা কথা বললে মুখে পা ভরে দেব। ঐ দেখ আমার বাপ লম্বোদর। মেঘ নয় রে, ঐটাই। ঐ দ্যাখ, নিশাপতি। তার পেছনে ঐ যে চিল্লোচ্চে, ঐটে শ্ৰীধর।

-আজ্ঞে, চিল্লোচ্ছে কেন?

-কর্মদোষে ভগন্দর। চিল্লোবে না তো কী গান করবে? যা হোক, অ্যাণ্ডায়। গণ্ডা মেরে তো ভালোই চালাচ্চিস! শালা খচ্চর!

ধুঁই হুহুংকার করে। হারবার্ট গড় করে কিন্তু পরপর অন্য কত ফটো মানুষ ত্রিমাত্রিক হয়ে তাকে নিয়ে লোফালুফি করে যেন সে বল। অপুত্রক কেশব ও হরিনাথ অবিরাম রক্তবমন প্রতিযগিতায় মেতে ওঠে। ধুঁই বলেন, এ বলে চাপার গন্ধওলা মদ এক হাঁড়ি খাব তো ও বলে কলার সেন্ট ওলা মদ দু হাঁড়ি খাব। ওদের মদ আসত চন্দননগর থেকে। লিবার্টি, ইকুয়্যালিটি, ফ্র্যাটানিটি।

-তারপর?

-চোপ। মালের কম্পিটিশন একবার শুরু হলে কখনও থামবে না। কল্পান্ত অবদি চলবে। কপাৎ।

-দোহাই আপনার, কপাৎ বলে মুখ বন্ধ করবেন না।

-তোর তো দেখছি খুব জানার ইচ্ছে। তবে দ্যাখ-ঐ যে সাধুঁকে দেখছিস, লিঙ্গে লোহার কড়া পরে লাফাচ্ছেন, ওঁকে চিনিস?

-আজ্ঞে না তো!

-তা চিনবে কেন? চিনবে তো যত নষ্টা বেবুশ্যে লেডি ডাক্তার। ও হল সংসারত্যাগী গোপাললাল। প্রশ্ন থাকলে কর!

-উনি সংসারত্যাগ করলেন কেন?

-কেন? কেন? শুনবি?

-শুনব।

–গৃহে আশ্রিত পাচকের মেয়ের পেট হয়েছিল বলে।

মুণ্ডহীন কেউ হা হা রবে রোদন করতে করতে এসে সরবে পর্দন ও বিষ্ঠাত্যাগ করে।

-উনি কে?

-উনি নয়। ঐ বানচোৎ কে বল্। ঐ হল পুষ্যিপুত্তুর ঝুলনলাল। ওরই গলা কেটে তো বিহারীলাল পিউ কাহা আর তোর বাপের জন্ম দিয়েছিল। আর ঐ যে দেখছিস দূরে বসে রানী ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে একমনে লুডো খেলছে ওর ঠ্যাঙের নখগুলো একবার মাথায় ঠেকা। এ হল বারাণসীলাল। ব্যবসায় মেতেছিল ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে। কামুক সাহেবদের নেটিভ মাগী সাপ্লাই দিত।

-তারপর?

-তারপর? তারপর সব বোকাচোদা। তবে হ্যাঁ আমাদের গিন্নিগুলো ভালো ছিল। শনিী বা পদ্মিনী কম, দু-একটা, হস্তিনীই বেশি। ওদের আর একদিন দেখাব।

লম্বোদর হঠাৎ লাফিয়ে নামে। সে উদরই শুধু। হারবার্ট গড় করে।

-মুক্তি চাস? হারবার্ট। হারা! আত্মহারা! শ্যামা বা দক্ষিণা কালিকার ধ্যান কর। ক্রীং ক্রীং ক্রীং হুঁ হুঁ হ্রীং হ্রীং …

শ্রীধর বলে, ওসব ভাট বুকনি ছাড়। আদ্যকালী বাদে কেউ নেই রে। হারু, হারাধন … ।

হ্রীং ক্রীং ক্রীং পরমেশ্বরী স্বাহা!

হারবার্ট টাল খায়। ক্রীং ক্রীং, গুহ্যকালিকে ক্রী দ্রুী শ্রী শ্মশানকালিকে ওঁ কালী করালবদনা নিমগ্নরক্তনয়না চামমাংসচব্বণ তৎপরম! পোষ্যপুত্র, নিহত ঝুলনলাল হেগো পোঁদে মুণ্ডহীন নাচ নেচে চলে। কোথা হতে আবার সুট পরা ললিতকুমার এসে ‘লাইট! লাইট!’ বলে চেঁচায় এবং দোতলায় জ্যান্ত জ্যাঠামশাই যথারীতি ‘পিউ কাঁহা, পিউ কাঁহা’ বলে যেতে থাকেন এবং এই পর্ব যখন শেষ হয় তখন গগনচুম্বী ধুঁই ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে মারাত্মক পরমাণুতে পরিণত হচ্ছেন অথচ তাঁর কণ্ঠস্বর ক্রমেই কানের সহ্য করার ডেসিবেল সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে-

-হারবার্ট, তুই কাঠের চিতায় পুড়বি… হারবার্ট, তুই কাঠের চিতায় পুড়বি … হারবার্ট, তুই কাঠের চিতায় পুড়বি …

১৭ মে, ১৯৯২, হারবার্ট একটি চিঠি পেয়েছিল। চিঠিটি সাদা কাগজে টাইপ করা। তার বয়ান ছিল এইরকম :

মহাশয়,

সংবাদপত্র ও লোকমুখে আপনার ‘অলৌকিক’ ক্ষমতার সম্বন্ধে জানতে পেরে এই চিঠি আপনাকে দেওয়া হল। আমরা, যুক্তিবাদী সঙেঘর কর্মীরা, বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে বহু জ্যোতিষ ও বাবাজী-র লোক ঠকানো ভণ্ডামির মুখোশ খুলে দিয়েছি। এ বিষয়ে আপনি কতদূর জানেন আমরা খবর রাখি না। তবে আপনার ব্যাপারে আমাদের বক্তব্য এই যে মৃত আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন নিছকই ভণ্ডামি, মানুষের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে আপনি যেটা করছেন সেটা জালিয়াতির ব্যবসা ছাড়া আর কিছুই নয়। আগামী ২৫মে, আমি ও আমাদের সঙেঘর কর্মীরা বেলা ২টো নাগাদ আপনার দপ্তরে যাব। যে সংবাদপত্রে আপনার সম্বন্ধে রচনাদি প্রকাশিত হয়েছে সেই সংবাদপত্রের সাংবাদিক প্রতিনিধিরাও থাকবেন। এই চিঠি পাওয়ার পরে, তিন দিনের মধ্যে আপনি যদি আমাদের দপ্তরে যোগাযোগ করে অবিলম্বে এই জাল ব্যবসা বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি না দেন এবং আপনার ‘অলৌকিক’ কার্যকলাপ যে নিছক ভণ্ডামি তা লিখিতভাবে স্বীকার না করেন তাহলে ধরে নেওয়া হবে যে আমাদের চ্যালেঞ্জ আপনি গ্রহণ করছেন।

ইতি
প্রণব ঘোষ
সাধারণ সম্পাদক, পশ্চিমবঙ্গ যুক্তিবাদী সঙঘ

হারবার্ট চিঠিটা ছুঁড়ে তাকে ফেলে দিয়েছিল।

-ইল্লি! বইতে সব বড় বড় লোক, কত উকিল মোক্তার মেনে নিল আর কোত্থেকে উড়ে এসে বলচে কিনা এসব ঢপবাজি। আবার কোতাকার কে আঁটের লোম, তার কাছে গিয়ে কিনা বলতে হবে। মামাবাড়ির আবদার-রে আমার! ওরে কেরে? দুটো আমড়া ভাতে দেরে! হরিনাম খাবলা খাবলা। আয় না গুখেকোরা, এমন বেত্তান্ত শুনিয়ে দেব যে ধুড়ধুড়ি নড়ে যাবে। কোনো ঝামেলায় নেই, ঘর থেকে বেরোচ্চি না, কাউকে খুঁসলোচ্চি না, স্বপ্ন পেয়ে কারবার খুলেচি আর শালাদের জ্বালা ধরেছে খুব। এই করে বাঙালিরা মরল। মরগে যা।

হারবার্ট সোৎসাহে ‘ভূতের জলসায় গোপাল ভাড়’ পড়তে থাকে।

আট

“দুরন্ত ঠগীর মত, কণ্ঠ তার চাপি অকস্মাৎ,
মুহূর্তে পাঠায়ে দাও পিপাসীরে মৃত্যুর সাক্ষাৎ।”

-প্রমথনাথ রায়চৌধুরী

সোমবার, ২৫মে, ১৯৯২। হারবার্ট চায়ের দোকানে বলে রেখেছিল যে চা লাগবে কয়েকটা। সকালে একটা লোকও এসেছিল। বর্ধমান থেকে। তাকে বলেছিল যে আজকে হবে না। পরের সপ্তাহে আসতে। তাকগুলো ঝেড়েঝুড়ে বইগুলো সাজিয়ে রেখেছিল। নির্মলাকে বলতে ঘরটা ঝাট দিয়ে দিয়েছিল। মারিক অবশ্য বলে গেছে। যে মাদ্রাজ থেকে ফিরে আসবে। কাজটা তবে এগোচ্ছে। মারিক লোকটা বেশ দিলদরিয়া। কিছু না হতেই মেন মদ-সিগারেট খরচা করে গেল। দিল না থাকলে হয়? হারবার্ট ভাবতেও পারেনি যে দুপুরবেলা কতজন আসবে। তাড়াতাড়ি স্নান খাওয়া সেরে ভেবেছিল একটু গড়িয়ে নেবে। কিন্তু ঘুম এল না। ওদের পাঠানো চিঠিটা নিয়ে আবার পড়েছিল। পড়তে পড়তে মুখে একটা অবজ্ঞার হাসি ফুটেছিল। একটা মাছি ঢুকেছিল ঘরে। শার্সির গায়ে ভভন্ করছে। কয়েক পা হাঁটছে। আবার উড়ে দুপাক খেয়ে ফিরে আসছে। মাছিরা মরলে কী হতে পারে ভাবছিল হারবার্ট। এমন সময় চায়ের দোকানের পাঁচু ওদের নিয়ে এল।

-এইতো ঘরটা। কাকাবাবু, আপনাকে খুঁজচে। নাম বলতে নিয়ে এলাম।

এত লোক! পাঁচ-সাতটা ছেলে। কয়েকজনের চশমা। দাড়ি। কাঁধে ব্যাগ ঝোলানো। দুটো মেয়ে। বলা কওয়ার তোয়াক্কা না করেই ওরা ঢুকতে থাকে। হারবার্ট দেখল বাইরে ভারি চশমা পরা লম্বা একটা লোক সালোয়ার কামিজ পরা একটা মেয়েকে আঙুল দিয়ে তার সাইনবোর্ডটা দেখাচ্ছে। মেয়েটা কাঁধে ঝোলানো ক্যামেরা তুলে সামনের নলের মতো কালো কাচটা ঘোরাল, ছবি তুলল। একটি ছেলে বলে-আপনিই হারবার্ট সরকার। প্রণবদা ভেতরে আসুন।

ঘরে একটাই চেয়ার। তাতে বসে প্রণব ঘোষ। এই লোকটাই তাহলে চিঠি দিয়েছিল। সালোয়ার কামিজ পরা মেয়েটা ঘরে ঢুকল। ঢুকেই ফ্ল্যাশ জ্বেলে কয়েকটা ছবি তুলল হারবার্টের, ঘরের। হারবার্ট খাটের কোণের দিকে সরে যায়। বালিশ সরায়। ওদের খাটের ওপরেই বসতে বলে। দু-একজন বসে। কেউ দেওয়ালে ঠেশ দিয়ে দাঁড়ায়। জিনস প্যান্ট আর শার্ট পরা যে একটু পরে ঢুকেছিল তাকে প্রথমে ছেলে ভেবেছিল হারবার্ট। সে একটা ক্যাসেট টেপ রেকর্ডার রেকর্ডিং-এর নব টিপে খাটের ওপর রেখেছিল। প্রণব ঘোষ চশমাটা খোলে। হাই পাওয়ার চশমা খুললে চোখটা কেমন ভাবলেশহীন হয়ে থাকে। গলার আওয়াজটা ভারি

-আপনি যখন এলেন না তখন বোঝাই গেল যে আমাদের চ্যালেঞ্জ আপনি অ্যাকসেপ্ট করেছেন।

চ্যালেঞ্জ শব্দটা চিঠিতে ছিল। কিন্তু শব্দটা প্রণব ঘোষের মুখ থেকে এত ধারালোভাবে বেরিয়ে আসে যে হারবার্টের বুকটা কেমন করে ওঠে।

-না মানে, চিঠিফিঠি তো লিকি না অত। আর কোথায় যে আপনাদের দপ্তর। ভাবলুম সে কী আর হবে গিয়ে। আর তাছাড়া কী অন্যায়টা করেছি যে যেতে শরীরটাও ভালো নেই। ডেঙ্গু হয়েছিল। সবে উঠেছি।

-সে না হয় হল। কিন্তু এই যে বললেন অন্যায় করেননি সেটা কিন্তু ডাহা মিথ্যে কথা। সাঙঘাতিক অন্যায় করেছেন আপনি। করে চলেছেন।

-কী অন্যায়টা করেছি, যদি করেই থাকি তো বলুন না। দাঁড়ান, দাঁড়ান, জানলাটা খুলে দি। গরম হচ্চে ঘরে।

-অন্যায় মানে? প্ল্যান করে লোক ঠকিয়ে চলেছেন, কতগুলো আজগুবি ননসেন্স শুনিয়ে টাকা নিচ্ছেন লোকের কাছ থেকে আর বলছেন কিছু করেননি।

-কাকে ঠকিয়েচি? কোনো শালা এসে বুক ঠুকে বলুক না, কাকে ঠকিয়েছি? হারবার্ট রেগে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিল। একটা ছেলে ঠাণ্ডা গলায় বলে-এই, একদম গলা তুলবেন না। স্ল্যাং ইউজ করবেন না। বলেই ছেলেটা ক্যামেরা কাঁধে মেয়েটাকে বলে-এদের এক্সপোজ করলেই দেখবেন গলাবাজি শুরু করে দেয়। ভাবে এইসব মেলোড্রামা করলে পার পাওয়া যাবে।

মেয়েটা বলে–বাট হি সিস টু বি এ ডাড। মিকি, প্রোফাইলটা কিন্তু অনেকটা মন্টি ক্লিফটের মতো না।

মিকি নামক মেয়েটি খিলখিল করে হেসে ওঠে।

-ও, হি ইজ এ সুইট, কিউট স্মল টাইম ক্রুক।

প্রণব ঘোষও হেসে ফেলে-একস্যাক্টলি!

হারবার্ট রেগে যায় আরো।

-ও ইংরিজি করে বলে ভেবেচেন ভেবড়ে দেবেন সেটি হবে না। ইংরিজি মারাচ্চে।

প্রণব ঘোষ একটু গলা তোলে-প্রমাণ দেব? কীভাবে আপনি তোক ঠকিয়েচেন?

-দিন না, ক্ষ্যামতা থাকে তত দিন না।

-আপনার কাছে টিনা বলে একটি বিদেশী মেয়ে এসেছিল না?

সুন্দরী যুবতী বেলজিয়ান অভিনেত্রী টিনা। কী সুন্দর দেখতে। কটা কটা চোখ। খালি খিল খিল করে হাসে। শুধু মা-র কথা বলার সময় মুখটা কেমন ভার হয়ে গিয়েছিল, চোখ দুটো ছলছল করে উঠেছিল–বড় মায়া হয়েছিল হারবার্টের।

-হ্যাঁ, এসেছিল তো। সঙ্গে একটা ডাক্তার ছিল, কী যেন নাম।

-টিনাকে আপনি কী বলেছিলেন। আমার কাছে ক্যাসেট আছে, শুনবেন? হারবার্ট এসবের কোনো থই পায় না। কী যে সব হচ্ছে! কেন হচ্ছে! প্রণব ঘোষ যে ক্যাসেটটা ভরা ছিল সেটা বার করে। অন্য একটা ক্যাসেট বসায়। প্লে করে তার ওপরেই ফাস্ট ফরোয়ার্ড করে ফলে কিচকিচ প্যাক প্যাক নানারকমের উদ্ভট শব্দ হয়। স্টপ করে চালায়। টিনার হাসি। হারবার্টের গলা-ভেরি গুড! ভেরি গুড! ডাক্তারের হাসি, রাস্তার শব্দ। স্টপ। ফাস্ট ফরোয়ার্ড। ঘ্যার ঘ্যার করে ক্যাসেট ছোটে। স্টপ। প্লে। হারবার্ট নিজের গলার আওয়াজ শোনে-হা, এরকমই সব আজব বন্দোবস্ত। ওর মা তো ভালো আচে দেখচি। পঞ্চম স্তরে, মধ্যমধার্মিকরা যেখানে থাকে। ও ডাক্তারমশাই, ওকে বলো, একেবারে যেন মন খারাপ না করে। ক’জুন যেতে পারে ঐ পাঁচতলায়। বেশির ভাগই তো এক বা দোতলার বাসিন্দা ওর মা তো দেখচি মেরে দিয়েচে গো ডাক্তার। আর একটা তলা উঠলে তো মহা আনন্দ–ওঃ সে তো মুক্ত হয়ে যাবে গো!

ডাক্তারের গলা।

-যা বললেন ওকে একটু বলে দিই।

হারবার্ট–হ্যাঁ ভাই, বলে দাও। শুনে মন প্রফুল্ল হোক।

ডাক্তার-হি ইজ সেয়িং দ্যাট ইওর মাদার ইজ নাউ ইন দ্য ফিফথ প্লেন হুইচ ইজ দা রেল্ম অফ বিংস উইথ মধ্যম ধার্মিক’-বিংস উইথ মডারেট ভারচুস

টিনা–হোয়াট, ও ইয়েস, হাউ এক্সাইটিং, টেল হিম দ্যাট হি ইজ মার্ভেলাস, আ মাস্টার …

ডাক্তার-টিনা বলছে যে আপনি খুব অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী।…

স্টপ। প্রণব ঘোষ ক্যাসেটটা বার করে। যে ক্যাসেটটা চলছিল সেটা ফের বসায়। চশমাটা রুমালে মুছে পরে। তারপরে, রেকর্ডিং-এর নব্‌ টেপে–আপনি জানেন টিনা কে ছিল। ও হচ্ছে জেনিভা বেসড ইন্টারন্যাশনাল র‍্যাশনালিস্ট মুভমেন্টের মেম্বার। লন্ডনের ঐ টিবেটান লামাটা, যেটার কাছে পলিটিশিয়ানগুলো কেনা ছিল, সে এখন ঐ টিনার ফাঁদে পড়ে জেল খাটছে জানেন? মেক্সিকো, ব্রেজিল, ফিলিপাইন যত সব মিরাকল হিলারকতজনকে ও ফ্রড বলে প্রমাণ করেছে জানেন? আমরাই টিনাকে পাঠিয়েছিলাম–এখানকার একটা টিপিক্যাল স্যাম্পল দেখতে।

-সে কী করে হবে? সঙ্গে যে একজন ডাক্তার ছিল, আমার কতার তজজমা করচিল।

-ডাক্তার? হ্যাঁ, অলোক ডাক্তার ঠিকই। ও আমাদের সংগঠনের একজন ফাউণ্ডার মেম্বার।

-তাতে করে হলটা কীরে বাবা!

-কী হল? ধরা পড়ে গেল যে আপনি ঠক। বুজরুক। টিনার মা বহাল তবিয়তে জীবিত। আর আপনি একেবারে ফিফথ প্লেনে পাঠিয়ে দিলেন? অ্যাপার্ট ফ্রম দ্যাট আপনি তো অশিক্ষিত-এগুলো এফিসিয়েন্টলি করতে হলে যে সফিস্টিকেশন লাগে সেটা আপনার নেই। থাকলে ‘স’ দিয়ে শান্তার নাম লিখতেন না। বিমলেন্দু নাম করা একটা থিয়েটার গ্রুপ-এ আছে। যে এসেছিল আর কী আপনার কাছে-হ্যাঁ, হ্যাঁ ঐ ট্রাংকের মধ্যে বোনের বডি ইন সো মেনি পিসেস। ও তো ক্লিয়ারলি মার্ক করেছিল যে আট দা মেনশন অফ লালবাজার আপনি অস্বস্তি বোধ করছিলেন। বলুন। নিজেকে কী বলবেন আপনি। মৃতের সহিত কথোপকথন।

দাড়িওলা একটি ছেলে বলে ওঠে–ঢপ কম্পানির মেজর জেনারেল।

সবাই হো হো করে হেসে ওঠে। হারবার্ট ঘামছে। লাল হয়ে গেছে। তাক থেকে টেনে ‘পরলোকের কথা’ ও ‘পরলোক রহস্য’ বের করে।

-এগুলোর নাম জন্মে শুনেছেন? ভাবছেন সব জালিয়াতি? পড়ুন, তবে তো বুজবেন কীরকম কাণ্ড, কীরকম বন্দোবস্ত।

-আমাদের ওগুলো পড়ার দরকার নেই।

ক্যামেরাসহ যুবতীটি ‘পরলোকের কথা’ উল্টে দেখে বলেছিল–সেই প্ল্যানচেট আর স্পিরিট। বুলশিট।

হারবার্ট চেঁচায়–বুজবেন না, জানবেন না, বাড়ি বয়ে ঝগড়া করতে বেরোন দুপুরবেলা, লজ্জা করে না।

-লজ্জাটা কার করে সেটা বুঝবেন যখন পুলিশ এসে কোমরে দড়ি দিয়ে নিয়ে যাবে।

-কেন পুলিশে নিয়ে যাবে কেন? নিলেই হল?

-হ্যাঁ, নিলেই হল। কারণ আপনি টিনাকে যেমন বলেছেন সেইসব আগডুম বাগড়ম অন্য লোকেদের কাছে বলে পয়সা কামিয়েছেন। এটাও এক ধরনের চিটিং। চুরি। আমাদের রিপোর্টটা গেলে কী হয় দেখবেন?

-কী হবে?

-পুলিশ আসবে। আপনাকে অ্যারেস্ট করবে।

-না! পুলিশ আসবে না। আমি স্বপ্ন পেয়েছিলুম। বিনুকে পুলিশ মেরেছিল। গুলি করে।

হারবার্ট প্রচণ্ড চেঁচাতে আর কাঁদতে থাকে–পুলিশ আসবে না। আমি মিথ্যে বলিনি। ভূত আচে। ভূত থাকবে।

প্রণব ঘোষ মেয়েটিকে ইঙ্গিত করতে সে এই অবস্থায় একের পর এক ফটো তোলে। মেয়েটা সিগারেট ধরায়। দরজার বাইরে পাড়ার ছেলেদের ভিড়। ওরাও সামনে থাকছে না। পুলিশের কথা শুনে সরে গিয়েছিল।

দেওয়ালের গায়ে ঠেশ দিয়ে যে ছেলেটা দাঁড়িয়েছিল সে বলে-এইসব মালের ওষুধ হল স্ট্যালিন। পড়ত স্ট্যালিনের হাতে। স্ট্রেট ফায়ারিং স্কোয়াড।

হারবার্ট ভয় তো পেয়েইছে, তবু চেঁচায়ও লেলিন-স্ট্যালিন আমরাও নাম করতে পারি। পুলিশ আসবে না। নিদ্দোষকে পুলিশ কিছু করে না। পুলিশ তোদের ধরবে। তোদের গায়ের কাচে যমদূত ঘুরে বেড়াচ্ছে।

-ঠিক আছে, আমরা চললাম। টিনার রিপোর্টটা পেলেই আমরা মুভ করব।

-চোপরাও। ইংরিজি মারাচ্চে। আমিও দেখে নেব। খালি ইংরিজি বলচে। দোবেড়ের চ্যাং দেকেচো? দোবেড়ের চ্যাং দেকবি?

-ওসব করছেন করুন। তবে আমরা জানবেন, শুধু আপনাকে কেন, আপনার মতো একটা জোচ্চোরকেও ছাড়বনা। সব তান্ত্রিক বাবাজীর বারোটা বাজাব আমরা। ছাড়ব না।

-ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমরাও দেখে নেব।

আমরা বলতে কাদের বুঝিয়েছিল হারবার্ট সেটা স্পষ্ট নয়। ওরা যখন বেরিয়ে চলে যাচ্ছিল তখন হারবার্ট নৈচে নেচে বলছিল-হায়, হায়, আমি কী দিনু। ক্যাট, ব্যাট, ওয়াটার, ডগ, ফিশ। ক্যাট, ব্যাট, ওয়াটার ডগ, ফিশ।

নাচতে নাচতে মাথা ঘুরে যায় হারবার্টের। খাটের গায়ে ধাক্কা খায়। মেঝেতে পড়ে যায় হারবার্ট। আবার ওঠে। যত ভয় করে তত দাপাতে থাকে। ঘামছে দরদর করে। হঠাৎ থেমে গিয়ে বিনুর খাট, তোষক, বালিশ দেখে। বিনুকে গুলি করে মেরেছিল পুলিশ। পুলিশ কি তাকেও মারবে। আর টিনা। এইরকম ধৰ্মঘাতক মেয়ে হয় কে জানত? কী পাপিষ্ঠ নারী! এই, এই ছিল তোর মনে।

-ক্যাট, ব্যাট, ওয়াটার, ডগ, ফিশ, ক্যাট, ব্যাট, ওয়াটার, ডগ, ফিশ, ক্যাট, ব্যাট…

রাস্তায় বেরিয়ে প্রণব ঘোষকে মাঝখানে রেখে ওরা হাঁটছিল। মিকি বলল লোকটা কিন্তু ভীষণ ক্রুড প্রণবদা।

-তাতে কী? এ দেশে যতই ক্রুড হোক না কেন ক্লায়েন্টের অভাব নেই।

একটি ছেলে বলল–বারুইপুরের লেভিটেশন-এর সেই কেসটা। কি যেন নাম ছিল লোকটার?

-মোসলেউদ্দিন?

-হ্যাঁ, হ্যাঁ, মোসলেউদ্দিন। ও লোকটা কিন্তু ট্রিমেণ্ডাস চালাক ছিল।

-তা যদি বলল তাহলে রিয়্যালি ক্লেভার প্যাক ছিল ঐগুলো।

-কোনটা প্রণবদা! সেই তারাপীঠ?

-না না, ঐ যে, সাতটা অ্যাস্ট্রোলজার, টিভিতে হল না।

-তবে প্রণবদা, ওরা হচ্ছে টোটালি আরবান। চালু তো হবেই।

-কেন, হারবার্ট আরবান নয়?

ওরা চুপ করে থাকে। প্রণব ঘোষও কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে এক একসময় আই ওয়াণ্ডার যে কেন এগুলো লোকে করে। তোমরা যদি মনে কর প্রত্যেকেই ছক করে এগোয়, লাইক ক্যাসানোভা, ভুল করবে।

মিকি অবাক হয়।

-কোন্ ক্যাসানোভা প্রণবদা?

-যে ক্যাসানোভাকে তুমি চেন, দা গ্রেট লেডি কিলার। সে না হয়, খুব চালাক ছিল। মেয়েদের ইমপ্রেস করার জন্যে অকাটিস্ট বলে নিজেকে চালাত। কিন্তু ক্যাগলিওস্ত্রো কেন করত? রাসপুটিনকে এক্সপ্লেন করা তো সোজা। লোকটা গেটে কেও ইমপ্রেস করেছিল। গ্রেট রাসক্যাল। অথবা দা কাউন্ট অফ সাঁ-জরমে। ফ্যাসিনেটিং। ইন কমপ্যারিজন এই এক্ষুনি যাকে দেখলে তাকে কী বলা যায় বল তো? গোপাল ভাঁড়!

যারা চিঠি দিয়েছিল তারা, তারপর খবরের কাগজের লোক, কলেজের ছেলেমেয়ে–ওরা চলে যাবার পরে কোটন, বড়কা, কোকা, জ্ঞানবান, বুদ্ধিমান, সোমনাথ, অভয়, খোঁড়ারবির ভাই ঝাপি, গোবিন্দ-সব ছেলেরা ঢুকে দেখল হারবার্ট থরথর করে কাঁপছে। হাঁসফাস করছে, ঘামছে।

জামা খুলে ফেলেছে। টেবিলফ্যানটা এমাথা ওমাথা করছিল আর হারবার্ট তার সঙ্গে সরে সরে যাওয়ার সামনে থাকার চেষ্টা করছিল। ওরা ফ্যানটাকে একমুখো করল। হারবার্টের খাটে তাকে বসিয়ে  জল খাওয়াল। চা আনল স্পেশাল। আস্তে আস্তে ধাতস্ত হল হারবার্ট। চোখ থেকে ভয় যায়নি। বারবার বলছিল-সব গুগলি হয়ে গেল! সব গুগলি হয়ে গেল! ওফ্‌ ….ধুকপুক করচে, ধুকপুক ধুকপুক করচে। এ কী বন্দোবস্ত রে বাবা!

নয়

‘‘দুর্ভেদ্য দুস্তর শুন্য, ক্ষুদ্রদৃষ্টি নর;
ওই বহ্নি, ওই ধুম! কিবা তারপর?”

-অক্ষয়কুমার বড়াল

.

সকাল ন’টা। সাড়ে ন’টা। দশটা। সাইনবোর্ড-বিহীন ঘর খুলছে না দেখে ধাক্কাধাক্কি। কোকা, বড়কা, সোমনাথও খবর পেয়ে ঘুমনেশা চোখে ছুটে এসেছে মুখে গন্ধ নিয়ে।

–হারবার্টদা! হারবার্টদা!

ডাকাডাকি আর দরজা ধাক্কানোর শব্দ দোতলার থেকেও পাওয়া গিয়েছিল। ধন্‌না তখন ফুচকাকে বলল–নীচে গিয়ে দেখনা একবার।

ফুচকা আধখানা গালে সাবান নিয়ে নেমে এল। ব্যবসা করে। আঁচ করল কিছু গড়বড় হবে। ফুচকাই ওদের বলে দরজা ভাঙতে। দরজা ভাঙা হল। ঘরে জমে থাকা মরার গন্ধটা হুশ করে বেরিয়ে আসে। ফুচকা দৌড়ে ওপরে চলে যায়। ধনাকে বলে। হতভম্ব ধন্‌না দিশেহারা হয়ে চিৎকার করতে থাকে, আত্মঘাতী হয়েছে। ভাই আমার আত্মঘাতী হয়েছে।

ধন্‌নার বৌ আর নির্মলা নেমে এসেছিল। কাঁদতে কাঁদতে তারা ওপরে উঠে যায়। জ্যাঠাইমা বুঝতে পারেনি প্রথমে। তারপর মূর্ছা গেল। বাড়ির তলায় ভিড় জমছে দেখে কী সুখকর স্মৃতি গিরীশকুমারের মনে জাগ্রত হয়েছিল বোঝার উপায় নেই। তিনি নিজের উপস্থিতি জানান দিয়ে বললেন—”পিউ কাঁহা! পিউ কাঁহা।”

গোবি, হরতাল ইত্যাদি ধার বন্ধুরা এসে গেল।

-এই, কেউ মড়া ধরবি না। ঘরের কিছু খুঁবি না।

-জানলাটা খুলে দেব হরতালদা?

-বললাম না কুটোটা অব্দি ‘বি না। সুইসাইড কেস। যে ঘাঁটাঘাঁটি করতে যাবে পুলিশ তার হালুয়া টাইট করে দেবে।

ধন্‌না কাঁদতে কাঁদতে নেমে আসে। সাইকেল নিয়ে পাড়ার ছেলেদের একটা দঙ্গল ছুটল থানায়। থানার অন-ডিউটি অফিসার শুনল। শুনে বলল, যাঃ শালা। দিনটা ভোগে গেল।

হারবার্ট নির্বিকার। নির্লিপ্ত। ইহলোকের এসব ঝুটঝামেলা নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথাই আর ছিল না। লোকের ভিড় আরও বাড়তে লাগল। কোকা, সোমনাথ, গোবিন্দ–সব হাউ হাউ করে কাঁদছিল।

-কালকেই ক্লাবের টিভি কেনার টাকা দিল। কত খরচ করল। একটুও যদি বুঝতে পারতাম।

মেন্টালি কিছুটা আনস্টেবল দেখাচ্ছিল খোড়োরবির ভাই ঝাপিকে। নিজের দাদার কেসের পর থেকেই ও যেন কেমন কেমন। ও ফুটপাথে উবু হয়ে বসে থেকে থেকে চেঁচিয়ে উঠছিল, হয়ে গেল! হয়ে গেল!

একটু পরেই পুলিশের গাড়ি এল। অফিসার আর জনা তিনেক কনস্টেবল। ভিড় সরে জায়গা করে দিল।

সব দেখেটেখে অফিসার বলল, সুইসাইড নোট ফোট কিছু রেখে গেছে। কেউ কিছু বলতে পারে না। অফিসারটিই তখন কাছে গিয়ে একহাতে নাক টিপে অন্য হাতে চিত হয়ে শুয়ে থাকা হারবার্টের বুকপকেট থেকে এক টুকরো ভাজ করা কাগজ বের করল।

সেই কাগজে  লেখা ছিল,

চৌবাচ্চার তেলাপিয়া গঙ্গাসাগরে চলল।
দোবেড়ের চ্যাং দেকবি? দোবেড়ের চ্যাং
দেকাব? ক্যাট ব্যাট ওয়াটার ডগ ফিশ

–হারবার্ট সরকার

পুলিশ অফিসার নোটটি পড়ে বলল, বাপের জন্মে এমন সুইসাইড নোট কেউ দেখেনি। লোকটা কি পাগলটাগল ছিল নাকি।

হরতাল বলেছিল, ঠিক পাগল নয়। একটু ছিটিয়াল বলতে পারেন।

পাড়ার সুধীর ডাক্তার কিছুতেই ডেথ সার্টিফিকেট লিখতে রাজী হল না। বলল, হ্যাঁ, আমার পেশেন্ট ঠিকই। কিন্তু সে তো ডেঙ্গুতে মরেনি। আমার ট্রিটমেন্টেও মরেনি। মরেছে সুইসাইড করে অ্যাণ্ড দ্যাট টু ইন এ ঘাস্টলি ম্যানার। পুলিশ এসেছে। কাইলি, আমাকে ভাই আর রিকোয়েস্ট করো না। পাড়ার লোক। দুলাইন লিখে দিলে যদি ল্যাঠা চুকে যেত আমি কি করতাম না।

পাড়ার ছেলেরা এরপর থেকে সুধীর ডাক্তারকে হারামী ডাক্তার বলে অভিহিত করতে শুরু করে। সব শুনে পুলিশ অফিসার বলল, ঠিক আছে। আমি থানায় গিয়ে লাশের গাড়ির ব্যবস্থা করছি। কেউ একজন সঙ্গে চলুন। কনস্টেবলরা থাকবে।

-আপনি কি সার আর আসবেন না।

–আসব না মানে? দেখি শম্ভুনাথে যদি লিখিয়ে দিতে পারি তাহলে ওখান থেকে কাঁটাপুকুর …

-সার, আমরা বডি পাব কখন?

-লাশ, এখন কটা বাজে, পৌনে বারোটা। এই ধরুন ..সাতটা নাগাদ কাঁটাপুকুরে চলে আসুন না … তবে মর্গের ব্যাপার তো, যদি টাইম লাগে আরও?

-ও আপনি আমাদের ওপর ছেড়ে দিন। কাঁটাপুকুরে আমাদের লাইন করতে অসুবিদে হবে না!

-তাহলে তো কথাই নেই!

পুলিশের কালো মুদাভ্যানে চড়ে হারবার্ট বাড়ি থেকে চলে গেল। দোতলার বারান্দায় জ্যাঠাইমাকে দুপাশ থেকে ধরে দাঁড়িয়েছিল নির্মলা আর ধার বৌ। কড়া রোদ ছিল তখন। এমন কড়া রোদ যে কাকের গলা দিয়ে শুকনো ডাক বেরোয়।

ছাদে, প্রখর রৌদ্রে দণ্ডায়মানা শোভারাণীকে ললিতমোহন বলিলেন, শোভা! ভাবচি ছবিটা লেগে যাবে না ফ্লপ করবে। তুমি যা বলবে তাই হবে। তাই আমি মেনে নেব।

উত্তরে শোভারাণী খিলখিল করিয়া হাসিয়া কুটিপাটি।

নীচে মেথর এসে বালতির বরফগলা রক্তগোলা  জল নিয়ে গিয়ে নর্দমাতে ঢালল। বোতল, কাটলেটের হাড়, মরা আরশোলা, ব্লেড, সিগারেটের টুকরো, ছাই সব ফেলল। বাকি রামটুকু চুক করে মেরে দিল। ঘর ধোয়া হল। জানালা খুলে দেওয়া হল। জানালাটা খোলার পরে ভেতরে কাল থেকে যে মাছিটা আটকে ছিল সেটা উড়ে এসে প্রথমে জানালার শিকের গায়ে বসেছিল। তারপর বাইরে ঘুরপাক খেয়ে উড়ে গিয়েছিল।

পাড়ার ছেলেরা মিটিং করে ঠিক করল যে হারবার্টের খাট তোষকেই তাকে নিয়ে যাওয়া হবে। শ্মশানে সাহাদা-স্বপন কেসের পরে মড়ার বিছানা-বালিশ পোড়ানো হচ্ছে। হারবার্টদার বিছানাও তার সঙ্গে চলে যাক। কিন্তু এ ব্যাপারে ধন্‌নাদাদার অনুমতি নেওয়া একান্তই প্রয়োজন।

ধন্‌না গম্ভীর মুখে শুনল।

-আমিও অমনটিই ভাবছিলাম। ওর মায়া জড়ানো তো, ওর সঙ্গেই চলে যাওয়া ভালো।

ধন্‌না স্মৃতিচারণ করে।

-ঐ খাট, তোষক–সব এসেছিল বিনুর জন্যে–বিনুও চলে গেল অপঘাতে। হারুও চলে গেল। কী হবে। সব নিয়ে যা। তবে তক্তপোষটা কিন্তু শক্তপোক্ত ছিল। ওটা নিবি?

–ও কত তক্তপোষ আসবে যাবে ধাদা। ওটাকেও যেতে দাওনা। সারাক্ষণটি থাকত ওর ওপরে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধা বলেছিল, নিয়ে যা। আমরাও তো শ্মশানে যাব। তা তোরা কিছু টাকাকড়ি নে, খরচ-খরচা তো হবেই।

-ও তুমি কিছু ভাববে না ধাদা। হারবার্টদা আমাদেরও তো ভাই ছিল বলল। ও আমরা গাড়িটাড়ি সব করব। দোহাই তোমার, ব্যাগড়া দিও না।

ধন্‌না পুনরায় কাঁদতে থাকে। ওরা ব্যবস্থাপনার কাজে মেতে ওঠে।

পাড়ার লালার লরির ব্যবসা। লরি, ড্রাইভার তুড়ি মারতে হয়ে যায়। ফুল, ধূপ, সেন্ট, কাপড় সব এসে যায়। লরির ওপর তক্তপোেষ ওঠানো হয়। তোষকটি বড়ই ভারি ছিল। হিমসিম খেয়ে যায় ওরা।

-পুরনো দিনের মাল তো। ভালো ছোবড়া দিত। ওয়েট দেখেচিস।

তক্তপোষের চারকোণে রজনীগন্ধা বাঁধা হয়। তোষকের ওপরে বালিশ দিয়ে তার ওপরে নতুন চাদর দেওয়া হয়। শেষে এত ছেলে হয়ে যায় যে আর একটা টেম্পো নিতে হয়। পাড়া থেকে আর যারা যাবে তারা সোজা শ্মশানে যাবে। এরা চলল কাঁটাপুকুর। পাড়ায় বিশাল জনতা লরি ও টেম্পোর শোভাযাত্রাকে বিদায় জানায়। চালাও পানসি-রিমাউন্ট রোড, কাঁটাপুকুর। এর মধ্যেই চুক চুক করে বাংলা খাওয়া শুরু হয়ে যায়। ফাট করে র’ মাল একটু গলায় ঢেলে বোতলটা কোমরে পেটের কাছে গুঁজে রাখা। গামছাটা ওপর দিয়ে শক্ত করে বাঁধা।

“…পরন্তু প্রেতেরা আপনদিগের দুঃখনিবারণে সম্পূর্ণ পরবশ বা অস্বাধীন। এই কারণে কোন কোন প্রেত অসহ্য যাতনা সহ্য করিতে না পারিয়া সুহৃদ স্বজনদিগকে পিণ্ডদানাদি ক্রিয়ায় উত্তেজিত করিবার জন্য দেখা দেয় এবং কেহ বা আত্মগোপন করতঃ অর্থাৎ অদৃশ্য থাকিয়া নানা আকারের সংকেত প্রদর্শন করে… ভূতের ঐ শক্তি ভূতচালকদিগের মধ্যে অতি প্রসিদ্ধ। ভূতচালক ইংরাজ ও ভূতচালক বাঙ্গ লী, সকলেই ভূতদিগের ঐ শক্তি থাকার কথা বলেন, জল্পনা করেন ও নানাপ্রকার পুস্তক লিখিয়া প্রচারিত করিতেও উদাসীন নহেন।” (পঃরঃ)

কাঁটাপুকুরে ফাঁড়াই, রক্ত শূন্যতা প্রদর্শন ও সেলাইয়ের পরে কাপড় মুড়ি দিয়ে হারবার্ট যখন বেরিয়ে এল তখন তাকে বেশ ফিটফাট দেখাচ্ছিল, অধিকাংশ আত্মঘাতীদের মতো আচাভুয়া নয়। পশ্চিমে এর আগে, সূর্য লাট খাওয়ার মনোমুগ্ধকর রক্তিমাভা মেঘে মেঘে মমতা বিস্তার করেছিল। পাশেই যে জলাভূমি তার পেছনে রেললাইন এবং মাঠ দিয়ে ওয়াগনব্রেকাররা ছিল হরিণের মতো ধাবমান। পাড়ার গোবিন্দ বড় ঘরের ছেলে। সে হারবার্টের মড়ার ওপরে এক শিশি সেন্ট ছড়ায় ও চিল্লাতে থাকে, ‘পাতি মড়া যাবে অগুরু মেখে। গুরুর জন্যে ইন্টিমেট।’

লরি চলতে থাকে। এবং সহসা স্লোগান শুরু হয়,

হারবার্টদা, যুগ যুগ জীও
যুগ যুগ জীও, যুগ যুগ জীও
হারবার্টদা, তোমায় আমরা ভুলছি না, ভুলব না
-ভুলছি না ভুলব না।

ট্রাফিকে লরি দাঁড়াতে কেউ কেউ জিজ্ঞেস করে, কোন্ পার্টির লিডার ভাই? জবাব দেয় কেউ, ব্যাণ্ড পার্টির!

হঠাৎ তালে তালে হাততালি দেওয়া শুরু হয়। সঙ্গে সিটি ও নানারকম বিদঘুঁটে আওয়াজ। এইভাবে শোক অন্তিম রিচুয়ালের মাধ্যমে ব্যাপকতর আনন্দময় কোলাহলে পরিণত হতে থাকে। কেউই খেয়াল করেনি। করবার কথাও নয়। কেওড়াতলার বড় গেটের সামনে লরি যখন এসে থেমেছিল তখন রাতের  আলো জ্বলেছে। গেটের পাশেই ক্রন্দনশীলা শোভারাণীর পাশে বিমূঢ় ললিতকুমার দাঁড়িয়েছিলেন। আনন্দধ্বনি শুনে তিনি বলে উঠলেন, শোভা, তুমি কাঁদছ? এ তো দেখছি কার্নিভাল!

ধন্‌না, ফুচকা-বুলান, পাড়ার বড়রা–সব আগে থেকেই এসে গিয়েছিল। কাগজ লেখাতে গেল কেউ। শ্মশানে লাশের সঙ্গে যারা আসে তাদের মধ্যে কেউ কেউ অন্যান্য লাশের পেছনে কী মৃত্যুর কারণ রয়েছে সে সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হতে চায়। এমনই একজন কোকাকে জিজ্ঞেস করেছিল এবং কিঞ্চিৎ নেশার ঘোরে কোকা জবাব দিয়েছিল এইভাবে, কী হয়েছিল দাদা?

-কিসের কী হয়েছিল?

-বলচি, কি হয়েছিল, আপনাদের দাদার?

-মার্ডার।

কোকা যে কোনো মৃত্যুরই ইংরিজি ‘মার্ডার’ বলে জানত। মানুষ বাংলায় মরে, ইংরিজিতে ‘মার্ডার’ হয়। এই বার্তা রটে যাবার ফলে, মার্ডার কেসের ভিকটিমকে দেখার জন্য ভিড় হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল। যাদের অন্যান্য লাশ ছুঁয়ে থাকতে হচ্ছিল তারাও কখন দেখতে যাবে তার জন্যে উশখুশ করছিল। ধনা, বিধ্বস্ত ও শোকস্তব্ধ ধনা বলল তার দ্বারা এ কাজ হবে না। তখন ভাইপো বুলানই কাকার মুখাগ্নি করে। শ্মশানে কড়া পুলিশী ব্যবস্থা। কিছু টুকরো সংলাপ, সজোরে স্লোগান, কান্নার শব্দ!

-হ্যাঁ, হ্যাঁ তোষক বালিশ সুষ্ঠুই যাবে!

-হারবার্টদা, যুগ যুগ জীও …

-শুরু, তুমি চলে যাচ্চো।

-যুবতক সূরজ, চাঁদ রহেগা, হারবার্ট তেরা নাম রহেগা!

-সরে যান, সরে যান, লাশ ঢুকবে।

ঘাড় ঘ্যাড় ঘ্যাড় ঘ্যাড় করে চুল্লির দরজা উঠে গেল। শেষ শয্যায় হারবার্ট কয়েক সেকেণ্ড অপেক্ষমাণ। স্লোগান তুঙ্গে উঠেছে। গমগম করছে কেওড়াতলা। চুল্লির অভ্যন্তরে অগ্নিশয্যা দেখে বিমোহিত ললিতকুমার বলিয়াছিলেন, ফ্যাসিনেটিং।

সঙ্গে সঙ্গে কড়া ধমক, চোপ্ শালা!

যুগপৎ চমকিত ও শিহরিত ললিতকুমার মাথা ঘুরাইয়া দেখিয়াছিলেন তাঁহার নিকটে ধুঁই এবং অনতিদূরে লম্বোদর, শ্রীধর, নিশাপতি, কেশব, মুণ্ডহীন ঝুলনলাল–সকলেই দণ্ডায়মান।

সশব্দে হারবার্ট চুল্লিতে প্রবেশ করল। প্রবেশ করা মাত্র তার দেহের আচ্ছাদন, চুল ও চাদর দপ্ করে জ্বলে উঠেছিল। ঘ্যাড় ঘ্যাড় ঘ্যাড় ঘ্যাড় শব্দে চুল্লির দরজা বন্ধ হয়ে গেল। তারপরে ভেতরে একটানা গোঁ করে একটা শব্দ।

ভিড়ের একটু পেছনে উদাস মুখে দাঁড়িয়েছিল সুরপতি মারিক। তার পকেটে ইংরিজি কাগজের কাটিং। সিগারেট ধরিয়ে সে মনে মনে বলেছিল ‘বিদায়, বন্ধু, বিদায়।’ ওপর থেকে লোক নামতে থাকে। নেমে আসে। গো-ও-ও-ও….

এমন সময়ে সকলকে সচকিত করে প্রথমে একটি ছোট বিস্ফোরণ শোনা যায়। বালতি চাপা দিয়ে চকোলেট বোমা ফাটালে যেমন হয় তেমন–ডুম!

এর রেশ কাটতে না কাটতে আরও বড় একটি। তারপর ক্রমাগত। আরও জোরে আরও জোরে। চুল্লির দরজা ধড়মড় করছে, লোক ছোটাছুটি করতে শুরু করে। অন ডিউটি পুলিশরা দৌড়ে আসে। …টি…গুম..

চুল্লির ওপর থেকে দেওয়ালের কিছুটা উড়ে গিয়ে ইট, বালি, চাঙড় ছিটকে বেরোয় ও সেখান দিয়ে বিস্ফোরকের গন্ধকগন্ধ মাখা নানা বর্ণের ধুম নির্গত হয়। লোকাল এক রংবাজ গজায়, মাল চার্জ করচে! মাল চার্জ করচে।

একজন পুলিশ যথোপযুক্ত উপস্থিত বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে শেষ অবধি ঠিকই চেঁচিয়েছিল, চুল্লি অফ করে দে! ভেতরে ফাটচে!

কিন্তু তারপরেই গগনবিদারী এক বিস্ফোরণ ঘটে চুল্লির পাশের ও পেছনের দেওয়াল ধ্বসে পড়ে। গরম কয়েলের টুকরো হবিষ্যি রান্নার  জলে পড়ে ভস্ করে ধোঁয়া ওঠে। পুরো শ্মশানে পাওয়ার অফ হয়ে যায়। ভাঙা চুল্লির ধকধকে লাল আভা। বিকট কাণ্ড। অন্ধকারে লোক ছোটাছুটি করে। শ্মশানের উল্টোদিকের কোনো বাড়ি থেকে হয়তো ফোন গিয়েছিল। পুলিশ আসে। আরও পুলিশ। পুরো শ্মশান কর্ডন করে ফেলা হয় সেই রাতে। অনেক পরে এমারজেন্সি লাইনে সি. ই. এস. সি কোনোমতে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করলে দেখা যায় চুল্লিটি কেউ যেন ভেতর থেকে ফাটিয়ে চুরমার করে দিয়েছে। শেষে কড়া পুলিশ প্রহরাতেই হারবার্টের মাথা, নাড়িভূঁড়ি, পা,হাত, পেট-বুক, টুকরো–এইসব নিয়ে গিয়ে, অধিক রাত্রে, পাশে ম্যানুয়েল পদ্ধতিতে কাঠে পোড়ানো হয়।

হারবার্টের দেহাংশ একত্র করে পুড়িয়ে দেওয়ায় প্রথমদিকে ইনভেস্টিগেশনে তর্ক-বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল। খুবই স্বাভাবিক। কারণ ১৯৯১-এর ২১মে যে ঘটনা ঘটেছিল তার থেকে এমনভাবে যথেষ্ট ভাবার কারণ আছে যে এল, টি. টি, ই-র লাইভ হিউম্যান বম্‌ব্‌ ধানুর সঙ্গে তুলনীয় হারবার্ট ছিল একটি ডেড হিউম্যান বম্ব। অবশ্য মোটিভটা স্পষ্ট নয়। আপাতদৃষ্টিতে কোনো কারণও নেই। কারণ শ্মশানে ঐ সময় গণ্যমান্য কারও আসার কথা ছিল না। থাকলেও… এই হাইপথে সিসটি পুঁদে তদন্তকারীরা বাতিল করে দেন। আসলে, কোনো একটি ঘটনা এমনই প্রভাব বিস্তার করে যে তার পরবর্তী প্রত্যেকটি ঘটনাই অনুরূপভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়। এটা মানুষের ধর্ম।

হারবার্টের সুইসাইড নোট,

চৌবাচ্চার তেলাপিয়া গঙ্গাসাগরে চলল।
দোবেড়ের চ্যাং দেকবি? দোবেড়ের চ্যাং
দেকাব? ক্যাট ব্যাট ওয়াটার ডগ ফিশ

–হারবার্ট সরকার

থেকেও মনে হয় না এর মধ্যে কোনো কোড নিহিত যদিও “চ্যাং দেকবি?” ও “চ্যাং দেকাব?”-র মধ্যে একটা শাসানি দেওয়ার মনোভাব সুস্পষ্ট। প্রকাশ থাক যে হাওড়ার কোনো এলাকায় অতীব খচ্চর ও হারামী লোকেদের ‘দোবেড়ের চ্যাং’ বলা হয়। কিন্তু ‘ক্যাট, ব্যাট, ওয়াটার ডগ, ফিশ!’ সম্ভবত নিছকই উন্মত্ততা। লোকটা তখন এক্সপোজড়। সিভিয়ার শকের পরে অবশ্যম্ভাবী ডিপ্রেশান। আর বরাবরই অ্যাবনর্মাল।

যাই হোক, কোনো বারুদগন্ধী রহস্যই শেষ অবধি অসমাধিত ও অসম্যক থাকতে পারে না। দেশ-কাল-জাতির স্বার্থে তা অভিপ্রেত নয় পরন্তু একান্তই অনভিপ্রেত।

শ্মশান-বিধ্বংসী এই হামলার জন্য দায়ী হল বিনু। হ্যাঁ, মৃত নকশালপন্থী বিনু। সেই রাতের পর রাত, তার কমরেডদের সঙ্গে তোষকের পরতে পরতে পোমিয়ার আই. সি. আই. কারখানা থেকে চোরাপথে সংগৃহীত পাথর ফাটানোর নানা মাপ ও ক্ষমতার প্রভূত ডিনামাইট স্টিক ঢুকিয়ে রেখেছিল। উন্নতমানের এই ডিনামাইট স্টিকগুলি যথেষ্ট মাত্রায় শক গ্রহণ করতে পারে; পাতি পেটো নয় যে চাপ পড়ল কী ফাটল। দেশের অগ্রগতিতে ডিনামাইটের সদর্থক ভূমিকার কথা কে না জানে?

হয়তো বিনুদের প্ল্যান ছিল বিকট প্রলয়ঙ্কর কিছু ঘটাবার। হয়তো, হয়তো কোনো মহতী প্রাণনাশের। হয়তো আরও অভাবনীয় কোনো অঘটনের। তা হতে পারেনি। হতে পারেনি ঠিকই কিন্তু গত দুই দশক ধরে এই বিস্ফোরক সমাহার তোষকের মধ্যে শীতঘুম ঘুমোচ্ছিল যা চুল্লির উত্তাপে জেগে ওঠে। এবং কী আশ্চর্য হতে হয় ভাবলে যে ১৮মে, ১৯৯২ থেকে বৈদ্যুতিক চুল্লিতে শবের সঙ্গে শয্যা পোড়ানো শুরু না হলে এ ঘটনা ঘটতেই পারত না। কী বিচিত্র এ ডিটোনেশন।

হারবার্টের রক্তহীন মৃতদেহ দাহ করার সময় যে জঘন্য ঘটনা ঘটেছিল তা অবধারিতভাবে এই ইঙ্গিতই দিয়ে চলে যে কখন, কীভাবে বিস্ফোরণ ঘটবে এবং তা কে ঘটাবে সে সম্বন্ধে জানতে রাষ্ট্রযন্ত্রের এখনও বাকি আছে।

দশ

“বৃথা আসি, বৃথা যাই
কিছুই উদ্দেশ্য নাই”

–অক্ষয়কুমার বড়াল

হারবার্টের ঘর থেকে তক্তপোষ বিছানা বেরিয়ে যাওয়ার ফলে ঘরটি বড়ই ফাঁকা ও বড় লেগেছিল। কেউ যদিও সেটা দেখেনি কারণ তারপর ঐ ঘরে তালা দিয়ে দেওয়া হয় এবং অনেকদিন অবধি কেউ ঢোকেনি। এরপরে, একদিন রাতে, লোডশেডিং-এর অন্ধকারে প্রচণ্ড ঝড় হয়। যে জানালা খোলার জন্যে মাছিটা বেরোতে পেরেছিল সেই জানালাটা খোলাই ছিল। উন্মত্ত, দুর্বার ঝোড়ো বাতাস ঢুকে ১৭১ থেকে শুরু করে ‘পরলোকের কথা’-র পাতাগুলো উড়িয়ে উড়িয়ে ঘরময় ছড়িয়ে দিয়েছিল। খোঁদলের তাকে রাখা হারবার্টের আয়নায় বিদ্যুৎ চমকানোর  আলো ঝলসে উঠেছিল। হাওয়ার দাপটে দুলে দুলে উঠেছিল অলেস্টার। ‘পরলোক রহস্য’, ‘ভূতের জলসায় গোপাল ভাঁড়’, হারবার্টের কবিতার খাতা, শান্তার ও পশ্চিমবঙ্গ যুক্তিবাদী সঙেঘর চিঠি তাকে থাকলেও এলোমলো হয়ে গিয়েছিল। দড়িতে ঝোলানো গামছা, শার্ট, ধুতি উড়ে মেঝেতে পড়েছিল। তার কিছুদিন পরে, ধন্‌নাদাদা, কোনো এক রবিবার, এই ঘর খুলে সব বই, বই-এর পাতা, খাতা, টিনের বোর্ড সব বিক্রিওলাকে বেচে দেয়। টেবিলফ্যান, তোরঙ্গ ও চেয়ার দোতলায় চলে যায়। তোরঙ্গের মধ্যে একটা ভাঙা ডটপেন ও কিছু খুচরো পয়সা ছিল। হারবার্টের ছাতা ও অলেস্টার যথাক্রমে বাড়ির মেথর ও এক ভিকিরিকে দিয়ে দেওয়া হয়। গরমকালে শীতের ঐ কম্বলের মতো জোব্বা নিতে তার আপত্তি ছিল কিন্তু ভবিষ্যতের কথা ভেবে সে শেষ অবধি রাজী হয়েছিল। ঐ ভিকিরিকে হারবার্টের শার্ট, ধুতি ও গামছাও দিয়ে দেওয়া হয়। সাইনবোর্ডটি কিনে বিক্রিওলা ফাঁপরে পড়েছিল। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে নতুন বাজারের এক বেলুন-বন্দুকওলা সেটি কিনে নেয় এবং এর ওপরে কাটা পেরেক বসিয়ে বেলুন ঝোলাবার এক বিশদ ব্যবস্থা রচনা করে। অতএব, হারবার্টের সাইনবোর্ড ছররার চাঁদমারি হয়ে গেল। সব বেলুন ফেটে চুপসে গেলে, কাটা পেরেকের জঙ্গলের মধ্যে, হয়তো বা চোখে পড়বে, উল্টো হরফ,

মৃতের সহিত কথোপকথন

–পোঃ হারবার্ট সরকার

হয়তো বা এরও অনেকদিন পরে, কিংবা হয়তো অনেক অনেক বছর পরে, কোনো একটি বাচ্চা ছেলে তার বাবা, মা-র হাত ছাড়িয়ে, দৌড়ে গিয়ে, কোনো অ্যান্টিকের দোকানের ধুলোমাখা কাচের ভেতরে হাতে আলো নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পরীকে দেখে তন্ময় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে চাইবে। তাকে তার বাবা ও মা জোর করে নিয়ে আসার পর তার ঠোঁট হয়তো, থরথর করে কাঁপবে অভিমানে। এরকম অবশ্য নাও হতে পারে।

যদি হয়, তাহলে হয়তো, এরও পরে, সেই বাচ্চা ছেলেটা যদি ঘুমের মধ্যে কেঁপে কেঁপে ওঠে, তাহলেও কারও চোখে পড়বে না। এরকম তো হয়েই থাকে।

এরও পরে, কোনো একটি কাটা ঘুড়ি, হয়তো, এ আকাশ সে আকাশ ঘুরে হারবার্টের সেই চিলছাদে এসে পড়বে। কেউ হয়তো জানতেই পারবে না। ভোরের কুয়াশায় চিলছাদ বড়ই অস্পষ্ট ও অবুঝ।

অথবা, সেই বাচ্চা ছেলেটার যদি জ্বর হয়, সে ভুল বকে, ভুল বকতেই পারে, তাহলে তার কথায় কেউ পরীর হদিশ হয়তো পাবো না পাওয়ার সম্ভাবনাও থেকে গেল।

হারবার্টের ফাঁকা ঘরে, জানালাবন্ধ, ঝড় এলেও কিছু উড়বে না। তাই হয়।

লাল বেলুন, নীল বেলুন-সব ফেটে যাবে। আবার নতুন বেলুন ফুলিয়ে লাগানো হবে। আবার ফেটে যাবে। সেরকম হওয়ারই কথা।

হয়তো, ছোট্ট ছেলেটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ঘুমের মধ্যে কাঁদবে। তারপর হাসবে। এরকম শিশুকে দেখেই বলা হয় যে শিশুটি দেয়ালা করছে।

রোজ ঘুমের মধ্যে কথা বলে। ডাক্তার হয়তো ওষুধ দেবেন। এবং আশ্বস্ত

-কে বলবেন, ভালো করে ঘুমোক। ঘুমোলেই ঠিক হয়ে যাবে।

ভালো করে ঘুমোল যে কিছুই ঠিক হয় না সেটা সবচেয়ে ভালো করে জানতেন ললিতকুমার ও শোভারাণী। কারণ তাদের নিরবচ্ছিন্ন, সুখময় ঘুমের পরে, হারবার্টের জন্মের পরে, নানাবিধ সুখসুখের পরে, অন্তিমে, ছবিটি ফ্লপ করেছিল।

ফ্লপ ছবিতে পিকচার নেই। কেবলই সাউণ্ড। তাও কমতে কমতে অস্ফুট উচ্চারণ বা প্রায় শোনাই যায় না,

ক্যাট, ব্যাট, ওয়াটার, ডগ, ফিশ …
ক্যাট, ব্যাট, ওয়াটার, ডগ, ফিশ …
ক্যাট, ব্যাট, ওয়াটার, ডগ, ফিশ …

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত