| 26 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক সাহিত্য

হিম (পর্ব-১০)

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

– বাবা, তোর কি মন খারাপ?
– না
বাবার প্রশ্নে দু’ পাশে মাথা নাড়ে তৃষা৷
– তাহলে?
চুপ করে আছে কন্যা। মাঝে মাঝে তার মনের ভেতর কি ঘটে কিছু বুঝে উঠতে পারেন না শুভ্রশংকর। অনেকদিন পর একটা ছুটির দিন পেয়ে বাবা মেয়ে ঘুরতে বেরিয়েছিলেন৷
– আইসক্রিম খাবি?
এতোক্ষণে মেয়ের মুখে হাসি ফোটে। আরেকটি মেয়ে আছে তাঁর। একদম ছোটো। কোলে নিতে ভয় করে। হাতের ফাঁক দিয়ে পড়ে যায় যদি! তৃষার জন্ম গ্রামে৷ যখন শুনলেন পৃথিবীতে আত্মজা এসেছে, তখন ঝড়ের বেগে টাইপ করছিলেন৷ গ্রাম থেকে ফোন শুনে, টাইপ থামিয়ে শুনতে গেলেন। হেমেন্দ্র টেইলার্সের হেমেন দা ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে মেয়ে হবার খবর দিলেন, হাসছিলেন। শুভ্রশংকরের মাথা শান্ত হয়ে গেলো। অথচ, একটু আগেও ভাবছিলেন কেমন করে দুপুরের মধ্যে কাজ তুলবেন। পরে জেনেছেন, সকাল সাড়ে নয়টার দিকে তৃষার জন্মের পর সুপ্রভার ভাই রমেন্দ্র প্রায় মাইল দেড়েক ছুটে চাপরাশীর হাট বাজারের হেমেন্দ্র টেইলার্সে গিয়ে ওঠে। হেমেন দা’র দোকানের অল্প দূরে পোস্ট অফিস। মানুষজন দরকারে চিঠি লেখে তখন, খুব দরকারে টেলিফোন না হয় টেলিগ্রাম। হেমেন দা’কে বলে দিলেন, সন্ধ্যার পর পর বাড়ি পৌঁছাবেন৷ প্রায় নতুন চাকরি। ছুটি না পেলে চাকরিকে টাটা করে দেবেন দরকার হলে। তিনি হাতের কাজ নামালেন পরের ঘন্টা দেড়েক সময়ে। সুপ্রভাকে দেখবার জন্য তাঁর মনের ভেতরটা প্রবল জ্যান্ত কই মাছের মতো ছটফট করছিলো। কাজ নেমে গেলে বেয়ারাকে ডেকে রং চা খেলেন৷ চকচকে বিশ টাকার নোট দিলেন একটা তাকে৷ নিমাই অবাক হয়ে গেলো আস্ত বিশ টাকা পেয়ে। আস্তে আস্তে বললেন, ‘ আমার প্রথম সন্তান হয়েছে, মেয়ে।’ চুপ করে গেলেন। সামনে টাইপ রাইটার, টেবিলে ফাইলের গাদা, রং চা অর্ধেক খাওয়া হয়েছে, বাকিটা এক চুমুকে শেষ করলেন। নিমাই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। হয়তো স্যার আরো কিছু বলবেন৷ ‘আপনি যান’, আবারো আস্তে বললেন শুভ্র। তাঁর কণ্ঠ চিরকালই নামানো, নরম। চিৎকার দিয়ে কখনো কিছু বলেছেন এমনটা মনে পড়ে না৷ কাছে দূরে সহকর্মীরা বসে আছে৷ কেউ আয়েস করে পানে চুন লাগিয়ে পাশের জনকে জিয়াউর রহমানের প্রশংসা করে কিছু একটা বলছেন। একটু দূরে আরেকজন কথাটা শুনে সায় দিচ্ছেন। এসব লোকজন, আধাসরকারি অফিস, টাইপের খটখট, বহুযুগ পুরনো ফ্যানের খটাংখট ছাপিয়ে শুভ্রশংকরের চোখে ভাসে দিগন্ত বিস্তীর্ণ সবুজ, টলটলা দীঘি। রমেন্দ্র তার সরু দুটি পায়ে  তরতর করে গাছে উঠে যাবে, পেড়ে আনবে ডাব৷ বাড়ির পেছনে টিউবওয়েলে হাত পা ধুয়ে আসার পর কাঁচের গেলাসে ডাবের জল দেয়া হবে। খেতে খেতে সর্বস্ব শীতল হয়ে যাবে৷ চেয়ার থেকে উঠে হাঁটতে হাঁটতে অফিস বিল্ডিং এর ছাদে উঠলেন। এখানে হেলিপ্যাড আছে৷ ক’দিন আগেই কারখানার উৎপাদন বিভাগ উদ্বোধন করে গেলেন  প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। হেলিপ্যাড তখন করা। পকেটে দু’টি সিগারেট। তিনি আস্তে আস্তে আরাম করে দু’টি সিগারেট খেলেন। দু’টির-ই পেছনটা পায়ে মাড়িয়ে নেভালেন। ‘ অনেকদিন বাঁচতে হবে, আর নয়। মেয়েকে বড়ো করতে হবে।’ নিজেকে কথাটা বলে অফিস থেকে বেরিয়ে পড়লেন৷ বড়ো কর্তা মেয়ের কথা শুনেই বললেন, ‘যান যান, মেয়েকে দেখে আসুন, আসার সময় আমাদের জন্য মিষ্টি নিয়ে আসবেন৷

বসুরহাটে নামতেই বেলা পড়ে এলো। তারপর চাপরাশীর হাটের দিকে রিক্সা। তারপর আবার রিক্সা। অনেকক্ষণ সিগারেট না খাওয়ায় চারদিকের গাছগাছালির বন্য গন্ধ নাকে আসছে৷ রিক্সা যিনি চালাচ্ছেন, অতি পরিচিত, সুহৃদ। ‘রাস্তাটা আর ঠিক হইল না দাদাভাই।’ – খানাখন্দে ভরা গ্রাম্য রাস্তা আবছা আলোতে বড়ো ভালো লাগছে৷ রাস্তার পাশেই অস্থায়ী ছাপরার দোকান৷ চা, বিস্কুট, কলা ঝুলছে। মনে পড়লো, উত্তেজনাবশত দুপুরে খাওয়া হয়নি। সে-ই কোন সকালে হোটেলের ডাল পরটা আর দশটার দিকে দু’খানা সিঙ্গারা অফিস ক্যান্টিনে৷ ‘রিক্সা থামান ভাই’, রিক্সা থামিয়ে দু’জনে কলা বিস্কুট খেলেন৷ চায়ের মধ্যে এরা প্রচুর দুধচিনি দেয়৷ অভ্যাসবশত একটা রমনা সিগারেট নিয়ে দড়ির আগুন দিয়ে ফেলার ঠিক আগের মুহূর্তে টের পেলেন দুপুরে এ জিনিস ছেড়ে দিয়েছেন৷ ফেলে দিলেন আর না ধরিয়ে৷ আবার রিক্সা। অস্বস্তি হচ্ছিলো। অনেকদিনের অভ্যাস। অন্তত চৌদ্দ বছর ত হবেই। মন ঘোরাতে তিনি কথা বলতে লাগলেন- ‘গ্রামের সব ঠিকঠাক আছে তো ভাই?’ প্রশ্ন শুনে চালক মাথা ঘোরান। ‘সব কি আর ঠিকঠাক থাকে! ‘ স্পষ্ট টের পান শুভ্র, দীর্ঘশ্বাস। ‘নন্দীপাড়ার বড়ো নন্দীর মেয়েটারে তুলে নিয়ে গেলো। তিন দিন পর মেয়ে পড়েছিলো, ঘরের সামনে। ‘

চুপ, চরাচর।

শুধু রিক্সার ক্যাচকোচ আর ঝিঁঝিঁ। রিক্সার নিচে লাগানো হ্যারিকেন চলার গতি আর বাতাসে দোলে। ‘যুদ্ধ করে কি লাভ হলো কন দেখি, সব তো একই রইলো।’ কথাটা বলার সুর এতোই তীব্র যে কেউই বুঝতে পারবে কথাটার পেছনে একটা কোনো দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস না থাকলে যে কোনো মানুষের মুখ থেকে অমন একটা বাক্য বেরিয়ে আসতে পারে না৷ সে সব কথা জানে শুভ্র। কিন্তু এখন এসব উচ্চারণ বারণ৷ সিরাজ শিকদার খুন হয়ে যাওয়ার পর এসব কথা সাত বাঁও জলের নিচে তলিয়ে গেছে। তবে পরিস্থিতি তো চিরকাল একই থাকে না!  নন্দী পাড়ার বড়ো নন্দী মানে তিমিরবরণ নন্দী, নামে তিমিরবরণ হলেও পাকা টমেটোর মতো গায়ের রং। তাঁর একটাই মেয়ে। মনে পড়ে, তাঁদের বিয়েতে সপরিবার এসেছিলেন৷ সুপ্রভার এক বছরের ছোটো। বাড়ি আর বেশি দূরে নেই। ‘দাদা, নন্দী দাদারা সব ঐদিকে চলে যাবেন। জলের দরে সব জমিজমা বিক্রি করা শুরু করেছেন৷ মজাটা কি জানেন- যারা তুলে নিয়ে গিয়েছিলো ওরা-ই সব বেনামে কিনে নিচ্ছে। সবাই সব জানে, সবাই সব জেনে চুপ। ‘ রিক্সা বাড়ির রাস্তায় চলে এসেছে। এখন হেঁটে ঢুকতে হবে। হাঁটা পথে মিনিট দশ। টাকা নিতে না চাইলেও জোর করে কিছু টাকা গুঁজে দিলেন শুভ্র- ফিসফিস করে বললেন- ‘কমরেড মন্ডল, আমার সব মনে আছে, আমি কিছুই ভুলি নাই। ‘ আন্ডারগ্রাউন্ড বিপ্লবী, কমরেড সূর্য মন্ডল হেসে ফেললেন। বছর সাত জেল খেটে এই কিছুদিন হলো রিক্সা চালাচ্ছেন। রিক্ত, শুন্য তিনি। সব বেদখল, জমি ত বটেই, স্ত্রী কাউকে না বলে কোথায় চলে গেছে। খালি বইগুলোর জন্যে দুঃখ হয়৷ রেয়ার সব বই। ‘কখনো দরকার হলে খবর দেবেন৷ ‘- কথাটা বলে শুভ্রসংকর আর ফিরে তাকালেন না।

বাড়ির উঠোনে পাটি পেতে সুপ্রভার মা বসেছিলেন। আকাশে অসংখ্য তারা, এ তো আর শহরের দূষিত আকাশ নয়। মেয়ে জামাইকে দেখে হাসিমুখে উঠে দাঁড়ালেন৷ রমেন্দ্র ছোঁড়া কাছেই ছিলো, জামাইবাবুকে দেখে লাফিয়ে উঠলো – ‘ হেমেন দা’র কাছ থেকে শুনে সে তখন থেকে ঘর বার কইত্তেছিলাম। এখন-ই বের হইতাম আবার। ‘ রমেন-ই হাত থেকে দই আর মিষ্টির বাক্সগুলো নিলো। আসার পথে, চাপরাশীরহাট বাজারে ভালো ফল পাওয়া যায়নি৷ মা’কে প্রণাম করে ভেতরের ঘরে গেলেন৷ মেয়ের কাছাকাছি যাওয়ার স্মৃতির পূর্বাপর বাম দিকে এক দাঁতে ব্যথা করে ওঠায় কেটে গেলো। আইসক্রিমের ঠান্ডায় এই বিপত্তি। সামনে তৃষা মন দিয়ে আইসক্রিম খাচ্ছে৷ নিউমার্কেট লিবার্টির ঝকঝকে দোকান৷ খাওয়া শেষে বাবার হাত ধরে ‘বইঘর’ দোকানটায় গেলো মেয়ে। আঙুল দিয়ে পছন্দের বইগুলো দেখাতে লাগলো৷ সব এখলাসউদ্দিন আহমেদের। সেদিন শফি সাহেব ছিলেন৷ অনেকদিন ধরে শুভ্রকে চেনেন। তাঁদের দি আর্ট প্রেসের অফিস ঘরেও গিয়েছে কয়েকবার।  একবার শামসুর রাহমানকে সামনাসামনি দেখেছেন শুভ্র। রং চা খাচ্ছিলেন৷ এক কবিতাসংকলনে শুরুর কবিতা ছিলো শামসুর রাহমানের আর শেষের শুভ্র’র। কী অদ্ভুতভাবেই না মনে রেখে দিয়েছেন কবি- অফিস ঘরে শফি সাহেবের মুখে নামটা শুনে নিজেই আগ্রহী হয়ে কথা বললেন, পরম বিনয় ছিলো কবিদের। ‘বইঘর’ থেকে শুভ্রশংকরের একটা বই হবে হবে করেও আর হয়নি- মাঝে মাঝে সেলাই করা খাতায়, সেঁটে রাখা প্রকাশিত কবিতার পেপার কাটিং, চার ফর্মা হিসেবে, দেখেন আলমারি থেকে।

শফি সাহেব বসালেন বাবা মেয়েকে। মেয়ের জন্য কেক আর ফান্টা৷ ‘আপনি আর বইটা দিলেন না আমাদের ‘, শফি সাহেব বই চেনেন- পাণ্ডুলিপিটা পড়েছিলেন, কেন যে শুভ্র তুলে নিয়ে গেলো আজো বোঝেন না৷ ‘না দাদা, একদিন মনে হলো কি হবে বই করে! আবহমান বাংলা কবিতার পাশে বসলে নিজেকে ছোটো লাগে। ‘- শফি সাহেব শুনে হাসলেন। ‘দেখুন, আমি একটা কথা গভীরভাবে বিশ্বাস করি, একটা গোটা বইতে যদি  একটা মনে রাখার মতো বাক্য থাকে, সেটাই যথেষ্ট আর তাছাড়া-‘ পকেট থেকে একটা চকোলেটের র‍্যাপিং পেপার খুলে মুখে পুরে দিলেন- ‘ বই জিনিসটা কিন্তু থেকে যায়৷ কেউ না কেউ অনেক বছর পর হলেও – একটা ভালো বই খুঁজে বের করবে৷ বই ভালো হলে,  সে নিজের তাগিদেই ভেসে ওঠে।’ বাবা-মেয়ে ‘বইঘর’ থেকে কয়েকটা বই কেনে। শফি সাহেব দু’টি বই মেয়েকে উপহার দেন৷ ছোটো চিরকুটে লিখে দিলেন -‘ বই-কে কখনো ভুলে যেও না। ‘

***

সেন্ট স্কলাস্টিকা। ক্লাস থ্রি৷ মেয়েদের হল্লা। একটি মেয়ে অনেকটাই চুপচাপ। হাতে বই। ক্যালেন্ডারের পাতা কেটে মলাট দেয়া। বইয়ের নাম দেখা যাচ্ছে না৷ তৃষা’র আগ্রহ হলো। মেয়েটা নতুন এসেছে। কিন্তু পড়ার মধ্যে কথা বললে যদি বিরক্ত হয়! মেয়েটি-ই বই থেকে মাথা তুলে তাকালো। চোখে এই পৃথিবী নয়, পড়তে পড়তে কেউ মাথা তুলে তাকালে তার চোখে অন্য পৃথিবীর আলো। ‘তোমার নাম কি ভাই?’ তৃষা-ই কথা শুরু করে। মেয়েটি হাসে। বললো, ‘আমার নাম মণীষা।’ দু’টি মাত্র পারস্পরিক উচ্চারণে একটি অপূর্ব বন্ধুত্বের সূচনা হলো, এমন বন্ধুত্ব সাধারণত কোনো একজনের মৃত্যুর পরেও অন্যজনের মনে বেঁচে থাকে, অন্যজনের জীবৎকাল অন্তত-

[চলবে] আগের পর্ব ও লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত