জলসা সিনেমায় সময় কাটিয়ে খুব বেশি আনন্দ পেয়ে সুধন্য পাশেই কারেন্ট বুক সেন্টারে ঢুকে পড়লো। শাহীন ভাই যথারীতি ওকে দেখে হাসলেন- এখন, অন্যদের মতো তাকে টুল দেয়া হয় বসার। আরো কতো আগে বালক বয়সে, হাফ প্যান্ট পরে সে এখানে কমিকস পড়তে আসতো-পরে একদিন আনন্দমেলা শারদ কিনলো। অনেক উপন্যাস একসাথে। বিমল কর, সুনীল, দুলেন্দ্র ভৌমিক, মতি নন্দী সবাই বেঁচে ছিলেন। সত্যজিৎ রায় তো ছিলেন-ই। বড়ো হবার পর সুবিমল মিশ্র পড়ে বুঝলো, আনন্দবাজার মানেই আনন্দের বাজার, বুর্জোয়া সাবানে পুঁজিবাদী বুদ্বুদ। তা বলে প্রথম শারদ সংখ্যা পাঠের আনন্দ ম্লান হবার নয়। ‘নতুন কি পড়লে?’- শাহীন ভাইয়ের প্রশ্নে সুধন্য হাসে-‘ শেষের কবিতাটা আবার পড়লাম। সংলাপ কেমন যেন বানানো মনে হলো।’ শাহীন সিঙ্গারা আর চা আনালেন। মাত্র বিকেল ঘনিয়ে আসছে। বারোটা তিনটা শোতে হল প্রায় ফাঁকা। দূরের কোণায় সুস্মিতা দি বাঁধন দার সাথে খুনসুটি করছিলো। সুধন্যর খুব ইচ্ছে করে কেউ থাক, মাত্র একুশ তার এখন। ‘ শোনো, তখন তো বাংলা গদ্যের উন্মেষকাল, সেইজন্য রবীন্দ্রনাথকে অনেক অলংকার ব্যবহার করতে হয়েছিলো।’-পাশ থেকে একজন অধ্যাপক বললেন। তিনি সিটি কলেজে বাংলা পড়ান। ‘ তা ঠিক, কিন্তু পাঠক হিসেবে আনন্দ পাইনি এইটুকু বলার। আমি তো আর গবেষক নই।’ সুধন্যের কথায় ওরা হেসে উঠলেন। আরো আলাপ গড়ায়। কাছেই মেশিনারী মার্কেটের ভেতর ডালিম ভাইয়ের আব্বার কাছে যেতে হবে একবার। এদিকে আর কারো কাছে পুরনো থ্রিলারের এতো ভালো সংগ্রহ নেই। বালক বয়সে এক লোকের দেখাদেখি বলে বসেছিলো, ‘ আমাকে একটা চিকন বই দেন।’ চিকন বই- কথাটা গুপ্ত সংকেত, জানা ছিলো না, তিনি চমকালেন, এইটুকুনি বাচ্চা চিকন বই কেন চাইছে! অনেক দ্বিধার পর পঞ্চাশ টাকা জমা রেখে দিলেন একটা বই। এটা তো শত হলেও তাঁর ব্যবসা। পাবলিক লাইব্রেরির পেছনে বসার একটা জায়গা ছিলো। সেখানে বসে কাগজের মোড়ক খুলতে দেখে বইয়ের নাম- যৌবনের মৌবন। ভেতরের গল্পগুলোর শেষ পরিণতি শুয়ে পড়া। গুপ্ত সংকেত উদ্ধারের পর বইটা ফিরিয়ে দিয়ে তার কৌতুহল আরো বাড়লো। কিন্তু সেসব কথা এখন থাক। মেশিনারী মার্কেটের ভেতর সাইড বিজনেস হিসেবে বই ভাড়া দেয়াটা তাঁর অনেক বছরের ব্যবসা, এমনকি কাজী আনোয়ার হোসেনের সাথে যোগাযোগ ছিলো এক সময়। আর ঐ যে স্টেশন রোডের মিশকা হোটেল দেখলেই মনে হয় রুশ রুশ নাম আর কে না জানে কিংবদন্তী স্পাই মাসুদ রানা একবার ঐ হোটেলেই উঠেছিলো। মেশিনারী মার্কেটের গলির গন্ধটা ভালো লাগে, পুরনো লোহা- তেল মোবিল গ্রিজের মিলমিশ এক গন্ধ। ডালিম ভাইয়ের আব্বা টিফিন ক্যারিয়ারের বাটিগুলি টেবিলে বিছানো পত্রিকার উপরে গুছিয়ে রাখছিলেন। আজ ভাত খেতে তাঁর খানিকটা দেরিই হয়ে গেলো। হাত ইশারা করে বসতে বললেন। হাসলো সে-‘ না,না এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, আপনাকে একটু দেখে গেলাম।’ বেরিয়ে পড়ে গলি থেকে। ততোক্ষণে গভীর প্রাণের সুরে বিসমিল্লাহ বলে তিনি খেতে শুরু করে দিয়েছেন। মানুষটির খাওয়া বড়ো পরিপাটি।একদিন দেখেছে সুধন্য।
রাস্তার উল্টোদিকে, নিউমার্কেটের ঢোকার মুখের ফুটপাথে নাদুস নুদুস বাশার ভাই বসেন। অনেক সিনিয়র মানুষ। দেশ, রিডার্স ডাইজেস্ট, রহস্য পত্রিকা সব গুছিয়ে রাখা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুই চারখানা পত্রিকা উল্টেপাল্টে দেখলেও তিনি কিছু মনে করেন না। এক কোণায় ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পত্রিকা স্তূপ করে রাখা। একটা সংখ্যায় দেখলো, কিউবা নিয়ে লেখাপত্র। বাবার জন্যে নেবে কি না ভাবলো একবার। আরেকটা সংখ্যায় ব্রাজিলের রেইন ফরেস্ট নিয়ে পরপর দুটো লেখা। রেইন ফরেস্টের ইসুটা সত্তর টাকা দিয়ে কিনে জেনারেল পোস্ট অফিসের উল্টোদিকে মালঞ্চে গিয়ে দুটো ডিম বার্গার দিয়ে দিব্যি লাঞ্চ হয়ে গেলো তার। সকালে ব্রেকফাস্ট তেমন জমেনি। বাসায় সবাই বেড়াতে যাওয়ার খানিক বাদে বিশাল এক তালা লাগিয়ে বেরিয়ে পড়েছে সুধন্য নিজের মতো করে দিন কাটাবে বলে।
রোদ এখন হুইস্কি কালার। খুবই সম্প্রতি মদ খাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে। কবি আবু রবিউল খন্দকার দীক্ষা দিয়েছেন। শহরের কোনো চুদুরবুদুরে নেই তিনি, নিজের মতো থাকেন, নিজের অর্থায়নে বই প্রকাশ করেন, সাথের ঝোলা ব্যাগে আরো নানা কিছুর সাথে বই থাকে, বিক্রি করেন পরিচিতদের। বোহেমিয়ান এই যাপনের জন্যেই বোহেমিয়ান এই কবিকে সুধন্য ভালোবাসে। তাদের বাসার এতো কাছেই যে মদ খাওয়ার বিরাট আয়োজন, সে জানতো না। তিনিই ডাকলেন এক দুপুরে। প্রশস্ত জায়গা, সবাই যে যার মতো লম্বা বেঞ্চিতে বসে। গিট লাগানো পলিথিন ফুটো করে পান করছে। কারো কারো সামনে প্লাস্টিকের প্লেটে ছোলা রাখা পেঁয়াজ কাঁচা মরিচ দিয়ে। একজন খালি গলায় গান করছিলেন, সম্ভবত স্বরচিত- মন জানে না মনের ঠিকানা,
মনের ভেতর টুকরো কাগজ লিখে রাখো না। লাইন দুটিই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। রবিউল দা কানে কানে চিনিয়ে দিচ্ছিলেন, ঐ গায়ক ভদ্রলোক এক সময় খাতুনগঞ্জের নাম করা ব্যবসায়ী ছিলেন, নিজের ভাগ্নে মামার সব হাপিস করে দিয়েছে। আরেকজন সম্ভবত প্রচুর খেয়ে ফেলেছেন। তিনি চিৎকার করছেন বেঞ্চির উপর দাঁড়িয়ে –বেশি পানি ন হাইয়ো ,হাইলে লিভার ফডত ( বেশি পানি খেয়ো না, খেলেই লিভার নষ্ট)। এক ভদ্রলোক স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন কেউ ভালোবাসা জিনিসটা যেহেতু বোঝে না তিনি সেই জিনিস দুনিয়ার লোককে বোঝানোর স্কুল খুলবেন। মূল মন্ত্র ঠিক করেছেন, বেশ গরি ফানি হাইলে ব্যাক ঠিক ( বেশি করে পানি খেলে সব ঠিক)। মজাই লাগছিলো। বিচিত্র কার্নিভাল পরিবেশ। তাদের সামনে চারটে পোটলা এলো
পলিথিনের। রবিউল দা চট করে ফুটো করে প্রায় এক দমে সাবড়ে দিলেন এক পলিথিন, যেন অনেক কালের তৃষ্ণার্ত বেদুইন। তারপর সামনে রাখা গরম ডিম মামলেটের অর্ধেকটা মুখে পুরে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। তাঁর হাতের ইঙ্গিতে সে প্রথমে ফুটো করে গ্লাসে ঢালে, গন্ধটা নাকে যেতে মনে হয় অন্নপ্রাসনের ভাত উঠে আসবে। খানিক জল মেশায়। জল মেশাবার পর গন্ধ একটু কমে। কয়েক চুমুকে শেষ করে- জীবনে প্রথম মদে চুমুক দেয়ার সময় তার মনে প্রশ্ন জেগেছিলো, এমন বিশ্রি স্বাদের জিনিস মানুষ কেমন খায়? খেতে খেতে সময় বইতে লাগলো। এক পর্যায়ে রবিউল দা খাতা বের করে নতুন কবিতা শোনাতে লাগলেন। প্রথম কয়েকটা শেষ হলে সুধন্যের জড়তা কেটে গেলো। নিজেকে নভোচারী মনে হয় উঠে পেচ্ছাপ করতে যাবার সময়। বাসায় ফোন করে বলে দিলো আজ এক বন্ধুর বাসায় পড়াশোনা করবে, এই ছিলো তার বাসায় বলা প্রথম সচেতন মিথ্যে। বিকেল ঘনিয়ে আসার আগে পন্টি দা এসে উঠলো। এমন নামের কারণ, ছাত্র বয়স থেকে তিনি সোফিয়া লরেনের প্রেমিক। তিনি আসতে আসর আরো জমে উঠেছিলো। কিন্তু সন্ধ্যা গড়াতেই তিনি কান্নাকাটি শুরু করলেন। কালুরঘাট ব্রিজের ঐপারে তাঁর স্ত্রী থাকেন, তার জন্য নাকি প্রাণ কাঁদছে। ফলে তারা তিনজন ওখান থেকে বেরিয়ে বাসে ওঠার চেষ্টা করছিলো, তিনজন তিনজনকে ধরে রেখেছিলো। তিনজনই খানিক বাদে বাদে দুলে উঠছিলো আর বাসের হেল্পাররা অসম্ভব সম্ভব সব খিস্তি করে চলে যাচ্ছিলো। শেষে একজনের মায়া হলো। বাসে উঠতে সহযাত্রীরা মা মাসী করতে থাকলেন। প্রবল ঘোরে থাকলেও সুধন্যের খারাপ লাগছিলো। গালি খাওয়ার অভ্যাস নেই তার। কালুরঘাট ব্রিজের এ মাথা থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় উঠতেই হুহু বাতাসে নেশাটা চড়ে উঠলো সবার। পন্টি দা খানিক বাদে বাদে নদীর জল নিয়ে নিজের মুখে মাখছিলেন। রবিউল দা পুরো চুপ যেন ধ্যানস্থ, একবার খালি সুধন্যকে বললেন-ছোটো ভাই, চাঁদ স্টাডি করবার জিনিস। যদি করতে পারো লিখতে পারবে। ওপারে পৌছে পন্টি দার মনে পড়লো, শ্বশুর বাড়ির জন্য বাজারের কথা। কিনলেন অনেক কিছু। জ্যান্ত মুরগি দুখানা। এদের নিয়ে পারা যায় না। নিজে হাঁটতে পারছে না। মুরগি খালি পালাতে চায়। ওখানে ওরা খুব যত্ন করলেন, দুইজন সিনিয়র মানুষের মধ্যে পুচকে মাতাল সুধন্য। ভাত খাওয়ার পর রবিউল দা কেমন করে ঝোলা থেকে দুটো পলিথিন বের করলেন, ফলে আরেক প্রস্থ চললো। রাত এগারোটার পর রবিউলদার স্ত্রী ফোন করলেন, তিনি ধরিয়ে দিলেন সুধন্যকে। ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে – ঐ শুয়োরের বাচ্চা, তোর বাপ কই? শুনে বেশ মিহি করে উত্তর দিলো- মা, উনি তো ঘুমাচ্ছেন। স্ত্রী আরো ক্ষেপে গেলেন-মা মানে কি রে? সুধন্য আরো মিষ্টি করে বললো, উনি বাপ হলে আপনি তো মা-ই। ফোন কেটে গেলো। তিন মাতাল হাহা করে ঘর ফাটিয়ে হাসলো। ঘুমিয়ে পড়লো খানিক বাদে, সবাই।
পরদিন ভোরে উঠে সুধন্য দেখলো পুকুর ঘাটের বাঁধানো বেঞ্চিতে বসে রবিউল দা কি একটা লিখছেন। সেদিন সে বুঝেছিলো যা-ই করুক, লেখাটাই লেখকের কাজ। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে এসব মনে পড়ায় সুধন্য একা হেসে ফেললো।
কবি,কথাসাহিত্যিক