| 27 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক সাহিত্য

হিম(পর্ব-২২)

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট
রুখসানা একেবারে চুপ হয়ে আছে। তিতুমীর চলে যাওয়ার পর আট মাস চলে গিয়েছে। এই আট মাসে সে একবারও সুপ্রতিমের কাছে আসেনি। সুপ্রতিম নিয়ম করে চেম্বার, ক্লিনিক করে গিয়েছে৷ রুকু দিদির এই টালমাটাল দশা বুঝতে পেরেছে বিমলা। রান্নার দায়িত্ব নিজের উপর তুলে নিয়েছে পুরোপুরি৷ এই পরিবারটির উপর বিপন্নতার এক আলতো চাদর। বউয়ের মন ভালো করবার অনেক চেষ্টা করেছে ডাক্তার। রুখসানার কবিতার বই বেরিয়ে গিয়েছে৷ সুধন্য নিজের উৎসাহে একটা আলোচনাও লিখে দিয়েছে৷ তিনশো কপির দশ বারোটি এদিক সেদিন গিয়েছে৷ বাকি সবটাই স্টোররুমে। রুখসানা ঘর থেকে বের হয় না৷ সুপ্রতিম নিজের কাজে ব্যস্ত- কেউই বইয়ের দোকানগুলোতে দিতে চায়নি৷ আর এই শহরে বইয়ের দোকানই বা কয়টি-বই দিলেও টাকা তোলার সময় দোকানের লোকজন প্রচুর ঘোরায়। এসব তথ্য  একদিন সুপ্রতিমের চেম্বারে বসে সুধন্য বলে গিয়েছে চা খেতে খেতে৷ রকমারিতে দেয়ার ব্যাপারেও মানা করে গিয়েছে৷ এটা ঠিক বিক্রির সুবিধে৷ কিন্তু কোথাও একটা আটকায়, অভিজিৎ রায় হত্যার পর অভিজিতের বইগুলো তারা রাতারাতি সরিয়ে ফেলেছিলো। 
আজ বৃহস্পতিবার। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এলো। তীব্র এক অবসাদে সুপ্রতিমের ভেতরটা অন্ধকার হয়ে আছে৷ যৌনতার অভাবও একটা কারণ অবশ্য। অবিবাহিত ডাক্তার বন্ধু খুলশীর ওদিকে এক ফ্ল্যাটে যাওয়ার বুদ্ধি দিয়েছে৷ সেটি জুতসই মনে হয়নি তার। অল্প কিছু পয়সা দিয়ে একটা আস্ত মানুষ কেনার চেষ্টা কোনো কাজের কথা নয়৷ সুপ্রতিমের শিক্ষা সে কথা বলে না৷ রুখসানার মা এসেছেন, মেয়েকে দেখতে, সময় দিতে। এক ছুটির দুপুরে দেখেছিলো সুপ্রতিম, বারান্দায় রোদে বসে মা মেয়ের চুলে তেল দিয়ে দিচ্ছেন। কতো নরম এক দৃশ্য! অথচ,বিয়ের সময় মা-ই সবচেয়ে বেশি আপত্তি তুলেছিলেন৷ রুখসানার ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। আজকাল নক করলেও দরজা খোলে না৷ ঘরে কখনো মুখোমুখি পড়ে গেলে ম্লান হাসে৷ ড্রইংরুমে বড়ো পর্দায় একটা সিনেমা চালিয়ে দিয়ে অনেকদিন পর হুইস্কি নিয়ে বসলো৷ বিমলা দাদাকে গম্ভীর দেখে অন্য ঘরে চলে গিয়েছে। বৃন্দাবতীর কথা মনে পড়লো সুপ্রতিমের। বাল্যবান্ধবী৷ মানুষ হিসেবে সুপ্রতিম খাঁটি নয়। চিকিৎসা শাস্ত্রে পাঠ নেবার শেষ দিনটি পর্যন্ত সে দুই নৌকায় পা রেখে গিয়েছে। গ্রামে বেড়াতে গেলে কিশোরী বৃন্দাবতী আর শহরে রুখসানা। বৃন্দাবতী নামটি পুরনো ধরণের, ডাক নাম বিন্দু৷ বিন্দুদের বড়ো ঘরের খানিকটা দূরে বিন্দুর দাদার পড়ার ঘর। তখন সে শহরে হোস্টেলে থেকে পড়তো৷ ঐ ঘর বিন্দু দখল করেছে। গ্রামে সুপ্রতিমের ভালো ছেলে বলে সুনাম আর ওর মুখেও নিষ্পাপ এক ছাপ। যে সব মানুষকে দেখলে মনে হয়, ভাজা মাছ উলটে খাওয়া কি মাছ জিনিসটাই কখনো দেখেনি তাদেরই একজন সুপ্রতিম। শীতের ছুটি সে গ্রামের কাটাতো। বিন্দুর বাবার অনুরোধে অংক আর ইংরেজি দেখিয়ে দেয়ার ফাঁকে খোদ ছাত্রীটিকেও এক গা ছমছমে, মেঘলা বিকেলে দেখে নিয়েছিলো। ‘তুমি আমায় বিয়ে করবে সুপ্রতিম দা?’ গভীর শ্বাসপ্রশ্বাস ফেলতে ফেলতে অস্ফূটে বলেছিলো,’নিশ্চয়ই’, যেন মহাভারতের অশ্বত্থামা হত ইতি গজ!  এতোটাই নরম স্বরে৷ মেধাবী ছাত্র। মানবসংস্থান বিদ্যাদ অন্ধিসন্ধি সব জানে। শীতের বিকেলগুলো নিরাপদ ও উষ্ণ করে তুলবার সব আয়োজন যেন বিধিপ্রদত্ত৷ সুপ্রতিমের চরিত্রে সন্দেহ করবে এমন মানুষ কে! রুখসানার সাথে পরিচয়ের পর খোলনলচেসহ বদলে গেলো যেন সে। বদলে যেতে হলো তাকে। মাটির গন্ধ মাখা বিন্দুর চেয়ে অনেক স্মার্ট মনে হলো রুখসানাকে। মেডিকেল হোস্টেলের ঘরে অষ্টাদশীর শরীরকে ফলের খালি প্যাকেটের মতো দুমড়ে তার অনেক বেশি উষ্ণ মনে হয়েছিলো। 
শেষের সে দিন, গ্রীষ্মকালের এক বিকেল। ইন্টার্নির শেষ বছরের এপ্রিল। সত্যিই এপ্রিল ইজ দ্য ক্রুয়েলেস্ট মান্থ। ‘তুমি কখন বাবাকে বলবে সুপ্রতিম আমাদের কথা?’ প্রশ্ন সরলা কিশোরী বিন্দুর। সুপ্রতিম নিজের প্রাপ্যটুকু বুঝে নিয়ে টেবিলে রাখা ফ্লাস্ক থেকে গরম জল ঢেলে নিয়ে কফি মিশিয়ে চামচ নাড়ছিলো। প্রশ্নের উত্তর দিলো না৷ বরং চামচটা থামিয়ে হাসলো ওর দিকে তাকিয়ে। খাটের একটু দূরে সোফায় বসে কফিতে চুমুক দিলো, সিগারেট ধরালো। এই প্রথম বিন্দুর জন্যে কফি বানাতে ভুলে গেলো। ‘কি বলছিলে আরেকবার বলো।’ সুপ্রতিমের গলার এই স্বর বিন্দু চেনে না৷ ‘আমাদের বিয়ের কথা বাবাকে কখন বলবে তুমি?’ সিগারেটে টান দিতে সেদিন ভালো লেগেছিলো। কেন না সব চুকিয়ে ফেলার পালা সেদিনই। কিন্তু তার আগে নিজেরটুকু বুঝে নেয়া গেলো। ‘শোনো বিন্দু, আমি তোমাকে বিয়ে করছি না।’ ছাইটা সামনের এস্ট্রেতে ফেলে নিষ্কম্প স্বরে বললো সে। হিম হয়ে এলো সরলার সর্বস্ব৷ ‘মানে?’ এক শব্দের প্রশ্নে প্রশ্ন যতো বিস্ময় তারো বেশি। ‘কোনো মানে নেই। সব ভেবে দেখলাম। আমাদের সম্পর্কটা আর চালিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। কথাটা তোমায় বলবো বলবো করে বলতে পারছিলাম না৷ আজ বললাম। ‘ সিগারেটটা মাত্র অর্ধেক খাওয়া হয়েছে, টিপে নিভিয়ে দিলো, সম্পর্কের ঔজ্জ্বল্যকেই যেন সে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করতে চাইছে। সুপ্রতিম বিন্দুর প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করছে৷ মগে এখনো অনেকটাই কফি৷ চুমুক দিয়েই যাচ্ছে চোখে চোখ রেখে। বিন্দুর চোখ জলে ভরে এলো। কিন্তু একটুও উপচে পড়লো না। দ্রুত চোখ মুছে নিজেকে সামলে নিলো সে। নরম গলায় বললো,’কারণটা বলবে সুপ্রতিম দা?’ ‘কোনো কারণ নেই৷ আমার আর ইচ্ছে করছে না।’  উত্তর শুনে একবার শুধু বিন্দু বলেছিলো,’তোমায় আমি কোনোদিন ক্ষমা করবো না।’ ‘ক্ষমা কেন চাইবো বিন্দু? অপরাধ তো করিনি। আনন্দ তো দুজনেই পেয়েছি। নাকি পাওনি?’ কাটা কাটা গলায় কথাটা বলে সেদিন ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলো সে। ইন্টার্নির পর দেশের বাইরে থাকার সময়েই বিন্দুর বিয়ের খবর পেয়েছিলো৷ ঠিকানা জেনে নিয়ে চিঠিও একটা লিখেছিলো বিন্দু। একদিন, প্রবল তুষারপাতের দিন মেইলবক্সে পড়ে থাকা চিঠিটা পড়ে ফেলতে পেরেছিলো। 
হুইস্কি খেতে খেতে ঝিমুনি পেয়ে যাচ্ছিলো। চোখ খুলে দেখে স্টাডিরুমে বসে আছে৷ ড্রইং রুম থেকে স্টাডি রুমে কখন এলো! একটু ভয় পেলো সে। মদ খাওয়াটা এবার না কমালেই না। স্টাডিরুমে একান্ত ব্যক্তিগত লকার খুলে চিঠিটা বের করলো। বিন্দুর জাগতিক স্মৃতি বলতে এইটুকুই। পড়তে ইচ্ছে করলো। অনেকদিন পর মনে মনে। ছোটো চিঠি- ‘সুপ্রতিম দা, ভালো আছো নিশ্চয়ই? আমিও ভালো আছিম বিয়ের পর নতুন পরিবেশ আর তার অস্বস্তি বাদ দিলে আমি সুখে আছি। মাসীর কাছে তোমায় নিয়ে অশান্তির কথা শুনলাম৷ শুনেছি রুখসানার কথাও। তোমরা নিশ্চয়ই সুখী হবে। নিজেদের মনের মিল থাকলে ধর্মটা কোনো বড়ো বিষয় নয় আজকাল। আমি ফেরা যাত্রায় এসে মাসীকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম।  তুমি চিঠিটা দেখে কিছুটা বিস্মিত হবে জানি৷ তোমার ফিরিয়ে দেয়াটা এতো সহজ করে নিলাম কেমন করে ভেবে নিজেই আশ্চর্য হই মাঝে মাঝে।  আসলে জীবনটা খুব সহজ সু। আমরা অকারণে জটিল করি। আমার বর তোমার মতো পড়ুয়া নয়। ওদের বাড়িতে পঞ্জিকা আর গীতা ছাড়া কোনো বইও নেই৷ তবে মানুষটা বড়ো ভালো। আমি ওকে কিছু লুকাইনি৷ কিচ্ছুটি না। এমনকি আমাদের যেসব শীতের দুপুরের কথা ভাবলে আজো আমার ভেতরটা কাঁদে, একথাও তাকে বলেছি। সে চুপচাপ শুনেছে। আশীর্বাদের পর একটা কফিশপে বসে আমরা কথা বলছিলাম। সব শোনাবার পর সে খালি একটা কথা বলেছে,’বাকি জীবন আমাকে ভালোবাসতে পারবে?’- আমি তাকে এমনকি এ প্রশ্নের উত্তরও দিইনি, তার বাড়িয়ে দেয়া হাত ধরেছি কেবল। আমরা এখন ভালো আছি৷ সে কোনোদিন মুহূর্তের ভুলেও তোমার কথা তুলে আমাকে আহত করবার চেষ্টা করে না যা কি না বাঙালি পুরুষের চিরন্তন স্বভাব৷ উদয়াস্ত খাটতে পারে আমার বর। আর বোধহয় আমাকে ভালোওবাসে। দেশে ফিরলে এসো,আমাদের বাড়ি৷ আর সত্যিই তুমি কোনো অপরাধ করোনি, ক্ষমা চাওনি তাই। দুজনের কাছেই সে দুপুরগুলো গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। ভালোবাসা জেনো৷ কোনো অপরাধবোধ রেখো না৷ রুখসানার ডাক নাম শুনলাম রুকু। তোমার রুকুকে ভালো রেখো। ইতি তোমার বিন্দু যে নিজের বৃত্তে নিতে পারেনি তোমায়।’ 
চিঠি পড়া শেষ করে টলতে টলতে ওয়াশরুমের দিকে গেলো সে। স্টাডিরুমেরটা বাদ দিয়ে একেবারে বাড়ির শেষ মাথার ওয়াশরুমের দিকে হাঁটা দিলো দেয়াল ধরে ধরে। নেশার ঘোরে মানুষ দূরের পথ বেছে নেয়। সকল রকম নেশার ক্ষেত্রেই সত্যি।  মাথা টলছে। নাহ! মদ খাওয়া কমাতে হবে। কালকে একটা জরুরি অপারেশন আছে। হাত কাঁপে যদি৷ হালকা হয়ে আবার ফিরছিলো সুপ্রতিম। দেখলো রুখসানার বাবা বিমলার ঘর থেকে বেরোচ্ছেন৷ ঠিক তখন ঘড়িতে দুইবার শব্দ করে রাত দুটা বাজলো। সুপ্রতিম ‘বাবা’ বলে ডাকলো আস্তে, তিনি ফিরে তাকিয়ে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন৷ তারপর দ্রুত হাঁটতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন৷ আবার উঠে নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন৷ সুপ্রতিম পরিস্থিতিটা কয়েক সেকেন্ড ভাবলো। বিমলার ঘরে নক করলো তারপর। দরজা খুলে গেলো বিমলার। সুপ্রতিম ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত