| 27 এপ্রিল 2024
Categories
গীতরঙ্গ

গীতরঙ্গ: ঢাকার জামদানি শাড়ির ইতিবৃত্ত । মাজেদুল হাসান শিশির

আনুমানিক পঠনকাল: 12 মিনিট

শাড়ি বাংলার রীতি ঐতিহ্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। খ্রিস্টপূর্ব যুগ থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশে নারীদের শাড়ি পরার প্রচলন ছিল। যদিও নাম ও পরার ধরন ছিল অন্যরকম এবং সেই প্রাচীন কাল থেকে ভারতীয় উপমহাদেশের একেক অঞ্চলের নারীরা একেকভাবে শাড়ি পরে আসছেন।

পন্ডিতদের মতে-প্রাকৃত ভাষার ‘সাট্টিকা’ শব্দ থেকে শাড়ি শব্দের উদ্ভব। আদি বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্যে ‘সাট্টিকা’ শব্দটি পাওয়া যায়। প্রাচীন সিন্ধুসভ্যতার অধিবাসীদের পোশাকের যে বর্ননা পাওয়া যায় – তা অনেকটা শাড়ির মতোই, বিশেষ করে পুরোহিতদের পরিধেয় বসনের বর্ননা থেকে আমাদের সেরকমই মনে হয়। দক্ষিণ ভারতের ক্ষেত্রেও ঐ একই কথাই প্রযোজ্য। দক্ষিণ ভারতে প্রাপ্ত প্রাচীন লেখনীতে শাড়ির মতন বস্ত্রের কথা উল্লেখ রয়েছে। প্রাচীন ভারতের একজন অন্যতম বিদগ্ধ মানুষ ছিলেন ভরত। তিনি ‘নাট্যশাস্ত্র’ নামে একখানা বই লিখেছিলেন। সে বইতেও এক ধরনের দীর্ঘ সূক্ষ্মবস্ত্রের কথা রয়েছে যা আমাদের শাড়ির কথাই মনে করিয়ে দেয়। প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রে আর প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে যে সেলাইবিহীন দীর্ঘ সূক্ষ্ম বস্ত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়, তা শাড়ি বলেই ধারণা জন্মায়। রামায়ণ-মহাভারতে তো শাড়ির আকছার ব্যবহার স্পষ্ট।

প্রাচীনবঙ্গেও নারীর পোশাক ছিল বর্তমান কালের শাড়ির অনুরুপ অর্থাৎ, সেলাইবিহীন দীর্ঘ বস্ত্র খন্ড। কালে কালে অবশ্য শাড়ি পরার ধরন বদলেছে-যা স্বাভাবিক। শাড়ি নিয়ে গবেষনা করেছেন বিশিষ্ট ফরাসী নৃতাত্ত্বিক চানতাল বোউলানঞ্জার। তিনি ভারতীয় উপমহাদেশে শাড়ি পরার ধরনকে কয়েক ভাগে ভাগ করেছেন। এর মধ্যে অতি অবশ্যই বাঙালি নারীর শাড়ি পরার ঢংটিও রয়েছে এবং কে না জানে বাংলার সংস্কৃতির ইতিহাসে কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির অবদান কত গভীর। সে বাড়ির মেয়েরাই উনিশ শতকে শাড়ি পরার একটি ঢং ঠিক করে দিয়েছিল। সম্ভবত কলকাতার উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণী সেটির অনুসরণ করেছিল। গ্রামের চিত্র সম্ভবত অন্যরকম ছিল।

শ্রী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা চমৎকার কথা আছে, কায়া অতিক্রম করেছে মায়া দিয়ে আপনার বাঁধা রূপ। এ কথাটি আমাদের লোকশিল্পীদের জন্য বড্ড বেশি খাটে যেন। শিশুর আঁকা নকশা অভিজ্ঞদের চোখে যেমনই ঠেকুক, তা কিন্তু শিশুর মনে বাস্তব দৃশ্যটির প্রভাব বিস্তারকারী রূপ। কাজেই সে নকশাকে অবাস্তব বলে উড়িয়ে দেয়ার জো নেই। একজন শিল্পীও যেকোনো কিছুর বাস্তব কায়াকে নিজের মায়ায় ভিন্নরূপে দেখেন এবং রূপ দেন। যেমন শিল্পী সুলতানের আঁকা কৃষকের পেশিবহুল কায়া শিল্পীর মায়ায় সৃষ্টি। সাধারণের চোখে তা প্রায় অবাস্তব। আমাদের লোকশিল্পেও আমরা এ রকম অনেক নকশা পাই, যেগুলো শিল্পীর মায়ায় সৃষ্টি। এ লোকশিল্পে শাড়ি একটি বিশেষ শাখা।

আজকাল বাজারে যত নামের শাড়ি পাওয়া যায়, তা আসলে শাড়িগুলোর ‘ব্র্যান্ড নেম’ মাত্র। আমরা জামদানি, বেনারসি, কাতান ইত্যাদি নামেই ডাকি বা চিনি। অথচ আমাদের লোকসাহিত্যে পাওয়া হরেক শাড়ির বাহারি নাম প্রমাণ দেয় যে, আমাদের শাড়ি আমাদের প্রাচীন তাঁতশিল্পীদের মায়ায় তৈরি হতো। কবি জসীমউদ্দীন তাঁর ‘পূর্ববঙ্গের নক্সীকাঁথা ও শাড়ী’ প্রবন্ধে তাঁর সংগৃহীত কিছু শাড়ির নাম তুলে ধরেছেন— কালপিন, বাঙ্গনীগরদ, জলেভাসা, একপাছুন্না, কাচপাইড়, জামদানি, জামের শাড়ি, রাসমণ্ডল, সোনাঝুরি, কুসুমফুল, বাঁশিপাইড়, লক্ষ্মীবিলাস, কৃষ্ণনীলাম্বরী, মধুমালা, কুনারি, কলমিতলা… আরো কত মন দোলানো নামের শাড়ি ! একেক শাড়ির একেক রূপ।

এ কথা সত্য যে, প্রাচীন ইতিহাস বলে, বিশ্বজয়ী ঢাকার শাড়ি বলতে সর্বাগ্রে আসে মসলিনের নাম। কিন্তু মসলিনের খ্যাতি তার সূক্ষ্মতার মাঝে, মিহি বুনটের মাঝে। আর এই যে নকশাদার বস্ত্র, মসলিনের ওপর এই জ্যামিতিক বুটিদার কারুকাজ— সাধারণভাবে একে আমরা জামদানি বলি, যা আজ আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।

মূলত মসলিনের একটি ধরন হলো জামদানি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এটি শাড়িকে বোঝালেও প্রকৃতপক্ষে ঐতিহ্যবাহী নকশাসমৃদ্ধ ওড়না, কোর্তা, পাগড়ি, রুমাল, পর্দা সবই জামদানির আওতায় পড়ে। যদিও বর্তমানে জামদানি নানা স্থানে তৈরি করা হয়, কিন্তু ঢাকাই এর আদি জন্মস্থান বলে গণ্য করা হয়।

ভারতীয় উপমহাদেশে যত রকম শাড়ি তৈরি হয় তার মধ্যে জামদানি, তার বুনন ও সৌন্দর্য্যের জন্য বিখ্যাত। বঙ্গদেশের বাইরে এমন তাৎপর্যময়ভাবে আর কোনও পরিধেয় বস্ত্র সম্ভবত বিকাশ লাভ করেনি। নকশি কাঁথার মতোই জামদানি শাড়ি আজ বাংলার সংস্কৃতির অনিবার্য প্রতীক হয়ে উঠলেও এটি ঠিক নকশি কাঁথার মতন একান্ত দেশিও নয়, রহস্য এখানেই, এটি বরং মুঘল – পারসিক ঐতিহ্যের এক সুন্দর নান্দনিক উত্তারাধিকার। পারস্য কিংবা উত্তর ভারতে জামদানির উদ্ভব সম্ভব ছিল না। রহস্য এখানেও।

জামদানি কার্পাস তুলা দিয়ে প্রস্তুত একধরনের পরিধেয় বস্ত্র যার বয়ন পদ্ধতি অনন্য। জামদানী বুননকালে তৃতীয় একটি সূতা দিয়ে নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়। মসলিন বয়নে যেমন ন্যূনপক্ষে ৩০০ কাউন্টের সুতো ব্যবহার করা হয়, জামদানি বয়নে সাধারণত ৭০-৮০ কাউন্টের সুতো ব্যবহৃত হয়। হালে জামদানী নানা স্থানে তৈরী করা হয় বটে কিন্তু ঢাকাকেই জামদানির আদি জন্মস্থান বলে গণ্য করা হয়। জামদানী বয়নের অতুলনীয় পদ্ধতি ইউনেস্কো কর্তৃক একটি অনন্যসাধারণ ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেইজ হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে।

প্রাচীনকালের মিহি মসলিন কাপড়ের উত্তরাধিকারী হিসেবে জামদানি শাড়ি বাঙালি নারীদের অতি পরিচিত। মসলিনের উপর নকশা করে জামদানি কাপড় তৈরি করা হয়। জামদানি বলতে সাধারণত‍ঃ শাড়িকেই বোঝান হয়। তবে জামদানি দিয়ে নকশী ওড়না, কুর্তা, পাগড়ি, রুমাল, পর্দা প্রভৃতিও তৈরি করা হত। ১৭০০ শতাব্দীতে জামদানি দিয়ে নকশাওয়ালা শেরওয়ানির প্রচলন ছিল। এছাড়া, মুঘল নেপালের আঞ্চলিক পোশাক রাঙ্গার জন্যও জামদানি কাপড় ব্যবহৃত হত।

জামদানির নামকরণ নিয়ে বিভিন্ন ধরণের মতবাদ রয়েছে। একটি মত অনুসারে ‘জামদানি’ শব্দটি ফার্সি ভাষা থেকে এসেছে। ফার্সি ভাষায় ‘জামা’ অর্থ কাপড় এবং ‘দানা’ অর্থ বুটি, সে অর্থে জামদানি অর্থ ‘বুটিদার কাপড়’। একারণে মনে করা হয় মুসলমানেরাই ভারত উপমহাদেশে জামদানির প্রচলন ও বিস্তার করেন। আরেকটি মতে, ফারসিতে ‘জাম’ অর্থ এক ধরনের উৎকৃষ্ট মদ এবং ‘দানি’ অর্থ পেয়ালা। জাম পরিবেশনকারী ইরানী সাকীর পরনের মসলিন থেকে জামদানি নামের উৎপত্তি ঘটেছে। নকশা অনুযায়ী জামদানীর নানা নাম হয়ে থাকে যেমন তেরছা, জলপাড়, পান্না হাজার, করোলা, দুবলাজাল, সাবুরগা, বলিহার, শাপলা ফুল, আঙ্গুরলতা, ময়ূরপ্যাচপাড়, বাঘনলি, কলমিলতা, চন্দ্রপাড়, ঝুমকা, বুটিদার, ঝালর, ময়ূরপাখা, পুইলতা, কল্কাপাড়, কচুপাতা, প্রজাপতি, জুঁইবুটি, হংসবলাকা, শবনম, ঝুমকা, জবাফুল ইত্যাদি।

আজকাল আমরা জামদানি বলতে যা বুঝি তার প্রাথমিক বিকাশ হয়েছিল সেই খ্রিস্টপূর্ব যুগেই যেহেতু জামদানি আর মসলিনের সম্পর্ক ঘনিষ্ট আর মসলিনের ইতিহাস সেরকমই পুরনো। জামদানির প্রাচীনতম উল্লেখ পাওয়া যায়, আনুমানিক ৩০০ খ্রিস্টাব্দে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে, পেরিপ্লাস অব দ্য এরিথ্রিয়ান সি বইতে এবং বিভিন্ন আরব, চীন ও ইতালীর পর্যটক ও ব্যবসায়ীর বর্ণনাতে। প্রাচীন ভারতের চিন্তাবিদ কৌটিল্য ‘অর্থশাস্ত্র’ নামে একটি বই লিখেছিলেন। অনুমামিক ৩০০ খ্ৰীস্টাব্দে লিখিত সেই বইয়ে প্রাচীন বঙ্গ ও পুন্ড্রে (বর্তমান বগুড়া) এক ধরনের মিহিন কাপড়ের কারখানার কথা উল্লেখ করেছেন কৌটিল্য। পেরিপ্লাস শব্দটি গ্রিক। এর মানে: ‘সমুদ্রের বুকে পাল তুলে ভেসে বেড়ানো।’ পেরিপ্লাস আসলে নৌপথে বানিজ্যিক বিবরণ। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে রচিত হয়েছিল: “পেরিপ্লাস অভ দ্য ইরিথ্রিয়ান সি” নামে একটি গ্রন্থ। সে গ্রন্থেও বঙ্গের মিহিনবস্ত্রের কথা রয়েছে। তা ছাড়া আরব, চিন ও ইটালিয় পর্যটকর ও ব্যবসায়ীদের বৃত্তান্তেও বঙ্গের সূক্ষ কাপড়ের কথা বারবার উল্লেখিত হয়েছে। যা থেকে বোঝা যায় প্রাচীন কাল থেকেই বাংলার সূক্ষ্ম মিহিবস্ত্র সমাদৃত হয়ে আসছিল।

জানা যায় যে-সেই সময়ে পুন্ড্র ও বঙ্গে চার ধরনের বস্ত্রের প্রচলন ছিল: ক্ষৌম, দুকুল, পত্রোর্ণ ও কার্পাসী। দুকুল নামের কাপড়ের বিবর্তনই মসলিন। এবং জামদানি নকশার প্রচলন ও মসলিনের বিকাশ পাশাপাশি শুরু হয়েছিল। অবশ্য আরও পরে। মুসলিম আমলে।

নবম শতাব্দীতে আরব ভূগোলবিদ সোলায়মান তাঁর গ্রন্থ স্রিল সিলাই-উত-তওয়ারিখে রুমি নামের রাজ্যে সূক্ষ্ম সুতি কাপড়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। তাঁর বর্ণনা অনুসারে বোঝা যায়, রুমি রাজ্যটি আসলে বর্তমানের বাংলাদেশ। চতুর্দশ শতাব্দীতে বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা বাংলাদেশ পরিভ্রমণ করেন এবং সোনারগাঁও এলাকাস্থিত সুতিবস্ত্রের প্রশংসা করেছেন। যোড়শ শতাব্দীর শেষের দিকে ইংরেজ পর্যটক র‌্যালফ ফিচ ও ঐতিহাসিক আবুল ফজলও ঢাকার মসলিনের প্রশংসা করেছেন।

আরেক ঐতিহাসিক টেলরের জামদানির বর্ণনা দিয়েছেন। তাঁর বর্ণনানুসারে সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে ১০ × ২ হাত মাপের ও ৫ শিক্কা ওজনের একটুকরা আব-ই-রওয়ান এর দাম ছিল ৪০০ টাকা। সম্রাট আওরঙ্গজেবের জন্য তৈরি জামদানির দাম ছিল ২৫০ টাকা। ১৭৭৬ সাল পর্যন্ত ঢাকায় সবচেয়ে উৎকৃষ্টমানের জামদানির মূল্য ছিল ৪৫০ টাকা।

ঐতিহাসিক বর্ণনা, শ্লোক প্রভৃতি থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় দুকূল বস্ত্র থেকে মসলিন এবং মসলিনে নকশা করে জামদানি কাপড় তৈরি করা হত। মূলতঃ বাংলাদেশের ঢাকা জেলাতেই মসলিন চরম উৎকর্ষ লাভ করে। ঢাকা জেলার সোনারগাঁও, ধামরাই, তিতাবাড়ি, বাজিতপুর, জঙ্গলবাড়ি প্রভৃতি এলাকা মসলিনের জন্য সুবিখ্যাত ছিল। ইউরোপীয়, ইরানী, আর্মেনিয়ান, মুগল, পাঠান প্রভৃতি বণিকেরা মসলিন ও জামদানি ব্যবসায়ের সাথে যুক্ত ছিলেন। এ কারণে তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধানেরাও এই শিল্প বিকাশে ভূমিকা রেখেছেন।

ঢাকাই মসলিনের স্বর্ণযুগ বলা হয় মুঘল আমলকে। এ সময় দেশে-বিদেশে মসলিন, জামদানির চাহিদা বাড়তে থাকে এবং শিল্পেরও ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়। আঠারো শতকে ইংরেজ দলিল থেকে জানা যায় মলমল খাস ও সরকার-ই-আলি নামের মসলিন সংগ্রহ করার জন্য দারোগা-ই-মলমল পদবীর উচ্চ পর্যায়ের রাজ কর্মচারী নিযুক্ত ছিলেন। প্রতিটি তাঁতখানায় একটি দপ্তর ছিল এবং এখানে দক্ষ তাঁতি, নারদিয়া, রিপুকার প্রভৃতি কারীগরদের নিবন্ধন করে রাখা হত। দারোগার প্রধান কাজ ছিল মসলিন ও জামদানি তৈরির বিভিন্ন পদক্ষেপে লক্ষ্য রাখা। তৎকালীন সময়ে ঢাকা থেকে প্রায় একলক্ষ টাকা মূল্যমানের মলমল-খাস মোঘল দরবারে রপ্তানি করা হত।

১৭৪৭ সালের হিসাব অনুযায়ী দিল্লীর বাদশাহ, বাংলার নবাব ও জগৎ শেঠের জন্য প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ টাকার জামদানি কেনা হয়। এছাড়া ইউরোপীয় ব্যবসায়ীগণ প্রায় নয় লাখ টাকার মসলিন কেনে। তবে আঠারো শতাব্দীর শেষের দিকে মসলিন রপ্তানি অনেকাংশে হ্রাস পায়। ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার শাসনভার গ্রহণ করে। এদের নিযুক্ত গোমস্তারা নিজেদের স্বার্থে তাঁতিদের উপর নির্যাতন শুরু করে। তাঁতীরা কম মূল্যে কাপড় বিক্রি করতে রাজী না হলে তাদের মারধোর করা হতো। অবশ্য তাঁতীদের উপর অত্যাচার ঠেকাতে কোম্পানি আইন প্রণয়ন করেছিল।

জামদানি শাড়ির প্রকৃত অগ্রযাত্রা সূচিত হয়েছিল মধ্যযুগের মুসলিম আমলেই। জামদানি শাড়ি আসলে পারস্য ও মুঘল -এই দুটি মিশ্র সংস্কৃতির ফসল। যার রসদ যুগিয়েছিল বাংলার উর্বর মাটি।

জামদানি বলতে এখন শাড়ি বোঝালেও সে সময়টায় অর্থাৎ মুসলিম আমলে জামদানি বলতে স্কার্ফ ও রুমালও বোঝাত। জামদানির ব্যবসা মুসলমানরাই করেছেন। দীর্ঘদিন এবং একচেটিয়াভাবে।

কোনওই সন্দেহ নেই যে-পূর্ববাংলায় জামদানি শাড়ির উৎকর্ষতা তুঙ্গে উঠেছিল মুঘল আমলেই। মিহিন কাপড়ের ওপরের চমৎকার নকশাগুলি ছিল আসলে মুঘল-পারসিক শিল্পরীতিরই প্রভাব। জামদানির উদ্ভব ও বিকাশ হয়েছিল অধুনা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ঢাকা জেলার আশেপাশেই।

গবেষক ফোরবেস ওয়াটসন, ‘টেক্সটাইল মেনুফ্যাকচারাস্ অ্যান্ড কসটিউমস অভ দ্য পিপল অভ ইন্ডিয়া’ নামে একটি বই লিখেছিলেন। সে বইয়ে ওয়াটসন লিখেছেন,‘নকশাদার মসলিন, জটিল ছাপচিত্রের কারণে, ঢাকার বস্ত্রপন্যের মধ্যে সবচে দামী ছিল।’ তখন ঢাকার জেলায় এমন কোনও গ্রাম ছিল না যে গ্রামে একটিও তাঁত ছিল না। গ্রামের তাঁতীরা ইউরোপ, ইরান, আর্মেনিয়া আর মুগল-পাঠান ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ব্যবসা করত। মুঘল সম্রাট, বাংলার নবাবরা ও অন্যান্য অভিজাতরা এজেন্ট নিয়োগ করতেন এসব ঢাকাই মসলিন ও জামদানি পন্য কেনার জন্য। মুঘল শাসনের সময় থেকেই ঢাকার মসলিনের স্বর্ণযুগ সূচিত হয়। তারপর থেকে দেশে-বিদেশে জামদানি ও মসলিনের চাহিদা বেড়ে যায়। এভাবে মসলিন ও জামদানি নির্মাতার উন্নতি হয়।’

ঢাকা সোনার গাঁও, ধামরাই, বাজিতপুর ছিল জামদানি ও মসলিন কাপড়ের জন্য বিখ্যাত।

কিন্তু, ঠিক কখন জামদানির ওপর আমরা এখন যে রকম দেখি সেরকম ফুল ফুল নকশা তোলার কাজ শুরু হল? ঠিক জানা যায় না। তবে, অনেকেরই অনুমান, মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময় থেকেই ফুলের মসলিনের প্রচলন আরম্ভ হয়েছিল। আমরা জানি, ১৬০৮ সালের পর থেকে বাদশা জাহাঙ্গীরের মৃত্যুকাল অবধি ঢাকার নাম ছিল জাহাঙ্গীরনগর। জাহাঙ্গীরনগর তখন ছিল সুবা বাংলার রাজধানী।

জামদানির রং ও বুনন ও নকশা অবশ্যই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গিয়েছে। যেমন, ১৯৬০এর দশকে নাকি লাল জামদানি জনপ্রিয় হয়েছিল। জামদানি নকশার প্রধান বৈশিষ্ট হচ্ছে এর জ্যামিতিক অলঙ্করণ। নকশা কাগজে আঁকা হত না। দক্ষ কারিগর স্মৃতি থেকে নকশা আঁকতেন।

১৭৮৭ সালে জেমস ওয়াইজ এর মতে ৫০ লাখ এবং জেমস টেইলরের মতে ৩০ লাখ টাকার মসলিন ইংল্যান্ডে রপ্তানি করা হয়েছিল। কিন্তু ১৮০৭ সালে এই পরিমাণ ৮.৫ লাখ টাকায় নেমে আসে এবং শেষ পর্যন্ত ১৮১৭ সালে রপ্তানি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে ব্যক্তিবিশেষের মাধ্যমেই কেবল ইউরোপে মসলিন পাওয়া যেত।

উনিশ শতকের মাঝামাঝি জামদানি ও মসলিনের এক হিসেব থেকে দেখা যায় সাদা জমিনে ফুল করা কাজের ৫০,০০০ টাকার জামদানি দিল্লী, লক্ষ্মৌ নেপাল, মুর্শিদাবাদ প্রভৃতি এলাকার নবাবরা ব্যবহার করতেন। এই শিল্প সংকুচিত এবং পরে বিলুপ্ত হওয়ার পেছনে কিছু কারণ ছিল, যার মধ্যে প্রধান কারণ ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লব। এর ফলে বস্ত্রশিল্পে যন্ত্রের আগমন ঘটে এবং কম মূল্যে ছাপার কাপড় উৎপাদন শুরু হয়। এছাড়া দেশী সুতোর চেয়ে তখন বিলাতি সুতোর দাম কম ছিল। তৎকালীন মোঘল সম্রাট ও তাদের রাজ কর্মচারীরা এ শিল্পের প্রতি অমনোযোগী হয়ে পড়েন। ফলে ধীরে ধীরে মসলিন ও জামদানি শিল্প কালের গহ্বরে হারিয়ে যায়।

জামদানী শাড়ী অনেক প্রকার হয়। তবে প্রাথমিক ভাবে জামদানী শাড়ীর উপাদান অনুযায়ী এটি দুই প্রকার।

১) হাফ সিল্ক জামদানী – যার আড়াআড়ি সুতাগুলো হয় রেশমের আর লম্বালম্বি সুতাগুলো হয় তুলার।

২) ফুল কটন জামদানী- যা সম্পূর্ণ তুলার সুতায় তৈরি।

জামদানির বিশেষ অলঙ্কৃত বয়ন কৌশল এখনো ধরে রেখেছেন বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জ জেলার, আরো বিশেষভাবে বলতে গেলে ডেমরা ও রূপগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্পীরা। এদের অন্যত্র নিয়ে এ শিল্পকে ছড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু সুফল আসেনি। কারণ শীতলক্ষ্যার জল থেকে উত্থিত বাষ্প সুতো প্রস্তুতি ও কাপড় বোনার অনুকূল। এর দ্বারা এটিই প্রতীয়মান হয় যে, পরিবেশ আর প্রকৃতির প্রভাব অন্যতম প্রধান শর্ত এ শিল্পের জন্য। এটি সুবিদিত যে, কাপড়ে নকশা তোলার জন্য আধুনিক আবিষ্কার জালা, জ্যাকার্ড বা ডবি বয়নশিল্পকে আরো সহজ করে দিয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, জামদানির নকশা তৈরিতে এসব পদ্ধতির ভূমিকা নেই, বরং আদি পিটলুম বা গর্ততাঁতে কাপড় বোনার সময়ই বয়নশিল্পীরা এর নকশাগুলো ফুটিয়ে তোলেন। আর এ নিপুণতার পেছনে তাঁদের নেই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক বা তাত্ত্বিক শিক্ষা, বরং পুরোটাই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে চলা শ্রুতি ও স্মৃতিনির্ভর এক আশ্চর্য অনুশীলন! আর এ স্বাতন্ত্র্যই এদের তাঁতি থেকে বয়নশিল্পীতে পরিণত করেছে। আর এ অতুলনীয় বয়ন পদ্ধতির কারণেই জামদানি ইউনেস্কো কর্তৃক ‘ইনট্যাঞ্জিবল কালচারাল হেরিটেজ’-এর স্বীকৃতি পেয়েছে।

মূলত বাঁশ আর সামান্য কাঠের দণ্ডের সাহায্যে গড়ে ওঠা এক ছোট্ট তাঁতেই রচিত হয় এ অপূর্ব সৃষ্টি। দুজন কারিগর বসে এ কাজ করেন, যাদের মধ্যে সাধারণত একজন হন অভিজ্ঞ বা ওস্তাদ আর অন্যজন সাগরেদ, যিনি তাকে সহযোগিতার মাধ্যমে ভবিষ্যতের জন্য হাতে-কলমে তৈরি হচ্ছেন। দুটো সুচের মতো বাঁশের কাঠিতে নকশার সুতা জড়ানো থাকে। সুচ দুটি দিয়ে অভ্যস্ত হাতের মাপের টানায় সুতার মধ্যে নির্দিষ্ট স্থানে রঙিন সুতা চালিয়ে দেয়া হয়। এরপর পাশের সুতার মাকু একজন তাঁতি পাশ থেকে অন্যজনের কাছে দিলে তা সেদিক থেকে বের করে দেয়া হয়। এভাবে ধীরে ধীরে তৈরি হয় জামদানি আর নকশা।

অতীতে তাঁতি নিজেই ছিলেন বয়নশিল্পী আর নকশাবিদ। রঙ, প্যাটার্ন, সুতার ধরন সবই হয়েছে তার একক সিদ্ধান্তে। তাঁদের মনের মাধুরী আর শিল্পিত মানসে গড়ে ওঠা পুরনো জামদানিগুলো এখনো বিস্ময় আর গর্বের উদ্রেক করে। এখন বাজার আর ক্রেতার ধরন পাল্টেছে, পরিবর্তন এসেছে রুচিতেও। তাই হাল আমলের ফ্যাশনকেও বিবেচনায় নিয়ে কাজ করতে হয়, যাতে প্রভাব ও সিদ্ধান্ত থাকে পৃষ্ঠপোষকের, ক্রেতার। আর তাই বর্তমানে জামদানির পুরো নির্মাণকাজে বয়নশিল্পী বা তাঁতি ছাড়াও আরো দুটি দল কাজ করে— উপকরণের সঠিক প্রস্তুতি ও কাপড় বোনার সব প্রয়োজন গুছিয়ে দেয়ার জন্য একটি দক্ষ দল বা টিম থাকে, আবার তৈরি কাপড় বাজারজাতের জন্য থাকে আরেক দল। কখনো আবার একই দল এ ভাগ দুটোর দায়িত্ব পালন করে। তবে সবচেয়ে বড় কাজ ওই নকশা, যা জামদানির প্রাণ। এ নকশাগুলো আগে কোথাও খসড়া করা থাকে না বা এঁকে রাখাও হয় না। পুরোটাই থাকে তাঁতির মনে, মাথায় আর আঙুলের ডগায়। এ নকশার কিছু নামও আছে। যেমন— শাড়ির পাড়ে ময়ূর প্যাঁচ, কলমিলতা, কাটিহার, কলকা পাড়, কাঠ পাড়, পুইলতা ইত্যাদি; আবার জমিনে গোলাপ ফুল, জুই ফুল, পদ্ম ফুল, কলার ফানা, সাবু দানা ইত্যাদি। ছোট ছোট বিভিন্ন ফুলের কুঁড়ি তোলা জামদানি বুটিদার নামে পরিচিত। ছোট ছোট ফুল, ময়ূর বা লতাপাতার ডিজাইনগুলো যদি বাঁকা বা তেরছাভাবে সারিবদ্ধ থাকে, তবে তার নাম তেরছা জামদানি, আর এ ডিজাইন যদি হয় জালের মতো সমস্ত জমিনে, তবে তার নাম জালার নকশা। সারা জমিনে সারিবদ্ধ ফুলকাটা জামদানি হলো ফুলওয়ার আর ডোরাকাটা হলে ডুরিয়া। নাম বা নকশা যা-ই হোক, এগুলো ফুটিয়ে তোলার নির্দিষ্ট কোনো পদ্ধতি নেই, শুধু আছে কিছু নির্দিষ্ট বুলি। যেমন— হইরে বাড়ে / গ্যাডে বাড়ে / গ্যাডের খেও বাধে গ্যাডে / গ্যাডের খেও বোধে প্যাচে / প্যাডে বাড়ে… ইত্যাদি। এগুলোতেই আছে কোথাও নকশার পদ্ধতি।

সুতা কাটার ওপর নির্ভর করে জামদানি মসলিনের সূক্ষ্মতা। সুতা কাটার উপযুক্ত পরিবেশ ভোরবেলা, যখন বাতাসের আর্দ্রতা বেশি থাকে। তাঁতিরা টাকু, বাঁশের ঝুড়ি, শঙ্খ ও পাথরের বাটি ব্যবহার করতেন। জামদানি তৈরির আগে তাঁতিরা সুতায় মাড় ও রঙ করে নিতেন। মাড় হিসেবে ব্যবহার হতো খই, ভাত বা বার্লি আর রঙ হিসেবে বনজ লতাপাতা ফুলের রঙ। বর্তমানে আধুনিক জিনিসপত্র আর কৃত্রিম রঙও ব্যবহার করা হয়। জামদানির প্রথম দিকে ধূসর জমিনে জাম নকশা করা হতো। পরে অন্য রঙের জমিনে নকশা তোলা হয়। ষাটের দশকে জমিনে লাল সুতার নকশা বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

জামদানির একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, জমিনের সুতার ঘনত্ব ও সূক্ষ্মতার চেয়ে নকশায় ব্যবহৃত সুতোর আনুপাতিকভাবে ঘনত্ব বেশি আর সূক্ষ্মতা কম। আবার কাপড়ের মানের ওপর নির্ভর করে নকশার সুতা জমিনের সুতোর চেয়ে চার গুণ বেশিও হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে শাড়ির জমিনে অলঙ্করণের মোটিফগুলো খুবই জোরালো আর অলঙ্করণে ব্যবহৃত সুতোর উপস্থিতি খুবই স্পষ্ট হয়ে থাকে। এসব নকশা আর মোটিফের উপস্থিতি আর বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা জামদানিকে ভৌগোলিক বিশেষত্বে চিহ্নিত করে দেয়া হয়। বেনারসি, টাঙ্গাইল, রাজশাহীর গরদ, পাবনার শাড়ি, সাউথ কটন, মুর্শিদাবাদী সিল্ক ইত্যাদি স্থানের নামে আর গাদোয়াল, জামদানি, চুন্দ্রি, মহেশ্বরী ইত্যাদি বয়নশিল্পীদের দেয়া নামেই প্রচলিত। অতীতে জামদানি তৈরিতে একটা বিষয় খুব গুরুত্ব পেত, তা হলো জমিনের স্বচ্ছতা আর নকশা বা অলঙ্করণের ঘনত্ব। সে সময়ের মসলিন জামদানি কাপড়ের নিচে যদি হাতের তালু প্রসারিত করে রাখা হয়, দেখা যাবে, নকশার নিচের অংশটুকু ছাড়া বাকি জমিনের অংশের নিচের হাতের তালু প্রায় দৃশ্যমান।

জামদানি তৈরিতে সুতো একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। অতীতে কার্পাস তুলা থেকে হাতে কাটা সুতো ব্যবহার করা হতো। ১৮-১৯ শতকে উচ্চমানসম্পন্ন তুলা থেকে হাতে কাটা সুতোর প্রচলন ঘটে। বর্তমানে মিলের সুতার সহজলভ্যতার কারণে হাতে কাটা সুতোর প্রচলন নেই বলা যায়। আগে যেখানে ভালো জামদানি তৈরির জন্য ২০০-২৫০ কাউন্টের সুতো ব্যবহার হতো, সেখানে এখন তাঁতিরা বাজার থেকে নির্ধারিত কাউন্টের সুতো কিনে ব্যবহার করেন। জামদানি বয়নকালে প্রথমে বয়ন করা হতো আঁচল, যা চওড়ায় ছিল ৬ থেকে ১২ ইঞ্চি, তারপর জমিনের বিস্তৃত অংশ। শেষে বোনা হতো ভেতরের দিক। বর্তমানে প্রথমে বোনা হয় গুড়ি বা শুরুর দিক, এরপর পাড়, আঁচল, পাট্টা, ছিলাই। আগে শাড়ির মাপ হতো সাড়ে ১০ হাত পর্যন্ত। তখন ব্লাউজ পিসের প্রচলন ছিল না। ব্লাউজ পিসের সংযুক্তি ঘটেছে ৩০-৪০ বছর আগে মাত্র। বর্তমানে এ দৈর্ঘ্য প্রায় ১২ হাত হয়ে থাকে।

ধরনে, আকারে ও বিপণনে যতই পরিবর্তন বা বিবর্তন আসুক, জামদানি শুরু থেকেই ছিল অভিজাত ঘরানার এবং এখনো তাই। বহু বাধা অতিক্রম করে এ শিল্প এখনো টিকে আছে। তবে কতদিন সংগ্রাম করে টিকে থাকবে, তা বলা মুশকিল। এর মূলে আছে প্রধানত সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উৎপাদনশীলতার প্রশ্নটা। কারণ একটা শাড়ি তৈরিতে যে দেড়-দুই মাস সময় লাগে, সে সময়ের উপযুক্ত মূল্য বা মজুরি তাঁতিরা পান না। আবার এ সময়ের মধ্যে আধুনিক কারখানায় আরো অনেক সস্তা শাড়ি উৎপাদন করা যায় অনেক গুণ বেশি পরিমাণে। ফলে ক্রেতাদের শৌখিনতা ছাড়া জামদানির প্রতি আকর্ষণ বা চাহিদা কম। বর্তমানে ঢাকার অদূরে রূপগঞ্জের তারাবো ইউনিয়নের ১৪টি গ্রাম আর সিদ্ধিরগঞ্জ ইউনিয়নের একটি গ্রামে জামদানি শিল্প কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে। এর বাইরে আরো কোথাও কোথাও বিচ্ছিন্নভাবে এর উৎপাদন হলেও তার ব্যাপকতা কম। তবে বোয়ালমারী উপজেলার কথা আলাদাভাবে বলতেই হয়। সেখানে উন্নত মানের জামদানি তৈরি হচ্ছে। মোঘল আমলে যে পরিমাণ পৃষ্ঠপোষকতা এ শিল্প পেয়েছে, তার সঙ্গে তুলনা না করেও এটুকু বলা যায় যে, এ শিল্পের জন্য সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায়ে আনুকূল্য প্রয়োজন। ১৯৮২ সাল থেকে এ শিল্পকে আরো উন্নত ও লাভজনক করার জন্য বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প (বিসিক) নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। পরে ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁতি তথা কারুশিল্পীদের প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে, যার মধ্যে রয়েছে কারুশিল্পীদের অন্য পেশায় চলে যাওয়া রোধ, নতুন প্রজন্মের কারুশিল্পীদের উত্সাহ প্রদান, বাজারের চাহিদা অনুযায়ী নকশা ও নমুনা সরবরাহ, জামদানি উদ্যোক্তাদের পুনর্বাসন, অবকাঠামোগত সুবিধাদি প্রদান ইত্যাদি। এ লক্ষ্য সামনে রেখে বিসিককে দায়িত্ব দেয়া হয় এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে বিসিক ১৯৯৩-এর জুলাই থেকে ১৯৯৯-এর জুন মেয়াদে নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার তারাবো ইউনিয়নের নোয়াপাড়া গ্রামে জামদানি শিল্পনগরী ও গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করে। এ শিল্পনগরীর বর্তমান আয়তন প্রায় ২০ একর। এসবই আশার সঞ্চার করে সত্য, কিন্তু এ কথা অনস্বীকার্য যে, জামদানির তথা এ পেশায় নিয়োজিত শিল্পীদের আগেকার সুদিন বা নিশ্চিন্ত সময় এখনো আসেনি। এজন্য শুধু সরকারি উদ্যোগ যথেষ্ট নয়, বরং দরকার ব্যক্তি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এমনকি ক্রেতাপর্যায়ে পৃষ্ঠপোষকতা ও উন্নত মানসিকতা। আর তবেই এ শিল্প আবার বিশ্বের বুকে নিজের ও দেশের পরিচিতি উজ্জ্বল করে তুলবে।

বাংলাদেশ স্বাধীনতা পাবার পরে ঢাকার ডেমরায় জামদানি পল্লীর তাঁতিদের আর্থিক সাহায্য দেওয়া হয়। তবে মেধা ও পারিশ্রমিকের অভাবের কারণে তাঁতীরা আর এ পেশায় আসতে চাইছেন না। কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার অচল তাঁতগুলো প্রাচীন গৌরবগাঁথার নীরব সাক্ষী হয়ে রয়েছে। কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়িরও একই দশা। বর্তমানে ঢাকার মিরপুরে জামদানি পল্লী স্থাপিত হয়েছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে জামদানির চাহিদা এখনও রয়েছে। বর্তমান বাজারে জামদানির উচ্চমূল্য ও বিপুল চাহিদার কারণে বাংলাদেশের এই শিল্পে নতুন গতি সঞ্চার হয়েছে। জামদানির পুনরুজ্জীবনের পথে প্রধান অন্তরায় হলো দক্ষ ও আগ্রহী তাঁতশিল্পীর অভাব। এই শ্রম নিবিড় হস্তশিল্পে উপযুক্ত মজুরি নিশ্চিত না করা গেলে তাঁতিরা আগ্রহী হবে না। জামদানি শাড়ির আগের সব বিখ্যাত ও অবিস্মরণীয় নকশা ও বুননের অনেকগুলোই বর্তমানে বিলুপ্ত। নবীন কারিগররা অধিকাংশ নকশা সম্পর্কে অবহিত নয়। আদি জামদানির নকশা ও বুনন কৌশল নতুন প্রজন্মের কাছে স্থানান্তর একটি চ্যালেঞ্জ।

 

 

 

তথ্যসূত্র:
১- শিল্প ও শিল্পতত্ত্ব, জনাব তারিক ফেরদৌস খান, আফসার ব্রাদার্স।

২- ঢাকার মসলিন( ইতিহাস ঐতিহ্য), জনাব মুনতাসীর মামুন, আগামী প্রকাশনী।
৩- বাংলার তাঁত শিল্প, শ্রী শুভাশিস চক্রবর্তী, সেতু প্রকাশনী।
৪- ঢাকাই মসলিন, ড. আবদুল করিম, জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন।
৫- উইকিপিডিয়া।
৬- http://bonikbarta.net/bangla/magazine-post/1210

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত