বিপুলা এই পৃথিবীর কতটুকু জানি। কখনো কি জানার চেষ্টা করেছি? হয়তো করেছি। আর করেছি বলেই আজ আমরা কিছু কিছু জানতে পেরেছি। জেনেছি এই পৃথিবীর বয়স প্রায় ৫০০ কোটি বছর। তার মধ্যে বেশির ভাগ সময় পৃথিবীতে কোন প্রাণের অস্তিত্ব ছিল না। আর প্রাণের জন্মের অনেক পরে মানুষের জন্ম। পৃথিবীতে মানুষের প্রথম দেখা পাওয়া যায় ২০ লক্ষ বছর আগে।
জীবনধারণের জন্য মানুষ ফল-মূল ও পশু শিকার করত। যখন পশু-শিকারে যেত তখন ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে যেত। এই ভাগ হওয়া মানুষের সাথে যোগযোগের জন্য কিছু একটা প্রয়োজন। এজন্য তারা প্রতীক ব্যবহার শুরু করল একেকটা সময় ও কাজের জন্য নির্দিষ্ট প্রতীকের ব্যবহার হত। এই প্রতীক এক সময় ছবিতে রূপ নেয়। অন্যদিকে বিভিন্ন প্রাণীর আওয়াজ শুনে মানুষও আওয়াজ করতে লাগলো। ধীরে ধীরে আওয়াজ আর প্রতীকের সমন্বয় শুরু হলো। আর এখান থেকেই বর্ণ। বর্ণ এবং আওয়াজ মিলে কথা। এই কথাই ভাষা। এখন কথা তো একা একা বলা যায় না। সঙ্গী প্রয়োজন। তাই একজনের মুখের কথা অন্যজন শুনে অনুকরণ করতো। যেহেতু মানুষের মধ্যে ভিন্নতা আছে সেহেতু একটি কথা অন্যের মুখে কিছুটা বদলে গেলো। এভাবে যতদূর যায় তত বদলায়। এক সময় আর আগের রূপ চেনা যায় না। এভাবেই জন্ম নেয় নতুন ভাষা। যাকে ভাষাবিদরা আলাদা আলাদা নামে সূচিত করেছেন।
দীর্ঘ ব্যাখা বিশ্লেষণের মাধ্যমে ভাষা বিজ্ঞানীরা একটি জায়গায় উপনীত হয়ছেন। তাহলো আজ থেকে প্রায় খ্রী: পূ: ৫০০০ বছর আগে সব মানুষ একটি ভাষায় কথা বলতো, ইন্দো-ইউরোপীয়। এই ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার দুইটি ভাগ একটি কেন্তম্ আরেকটি শতম্। শতম্ ভাষার একটি শাখা আর্য। আর্য ভাষার তিনটি ভাগ ইরানী, দারদিক ও ভারতীয়। প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষা ভারতীয় ভাষার একটি শাখা। প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষা বিভিন্ন সময় পরিবর্তন বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে রূপ নেয় আজকের এই বাংলা ভাষায়।
ভাষার জন্মের অনেক পরে লিখিত রূপ এসেছে। তার আগ পর্যন্ত শুধু বদলেছে। লিখিত রূপের আগে বিদ্যার্জন, সাহিত্য চর্চা বা ধর্মীয় ইত্যাদি যাবতীয় মানুষ জানত গুরুর মুখে শুনেশুনে। আবার সেও যখন অন্যকে শেখাতো তখন বারে বারে বলে মুখস্ত করিয়ে দিতো। এই মুখস্ত করে বলা থেকেই আবৃত্তির সূচনা। প্রাচীনকালের যত শাস্ত্র বা সাহিত্য যা কিছুই দেখি না কেনো তা সবই দারুণ ছন্দে রচিত যা সুর করে পড়া হতো। খুব সহজেই মনে রাখার জন্য শাস্ত্রকার সুর ও ছন্দ ব্যবহার করতো। আবার বৈদিক যুগের যে সব ধর্মগ্রন্থ দেখতে পাই তা সবই ছোট ছোট শ্লোকে রচিত।
শ্লোকগুলো এতো ছোট হওয়ার মূল কারণ, লোকে শুনে যাতে সহজেই মনে রাখতে পারে। যখন নাটক বা গান কি জানতো না তখন থেকেই মানুষ আবৃত্তি করে আসছে। ধর্ম যুগের আগে যাদু যুগেও মানুষ মন্ত্র আবৃত্তি করতো। তার মধ্যে একটা সুর থাকত কিন্তু তাকে কোনভাবেই সঙ্গীত বলা যাবে না। সেটাও আবৃত্তি। আর এই আবৃত্তির সুর থেকেই সঙ্গীতের সৃষ্টি। তারও অনেক পরে আসে নাটক। সেই ক্ষেত্রে আবৃত্তিকে আমরা বলতে পারি ধ্রুপদী কলা। যাবতীয় কলার মধ্যে অন্যতম প্রাচীন কলা এই আবৃত্তি। তবে প্রথম কলা হিসেবে নৃত্যকে ধরা হয়। কারণ শিকারের পর সমবেত মানুষ উল্লাস করে তা-ব নৃত্য করতো। এরপর বলি মাধ্যমে সেই মাংস সবাই মিলে খেতো।
কিন্তু সেই প্রাচীনকলা আবৃত্তিকেই বলা হয় কিনা, ‘আবৃত্তি কি শিল্পকলা’? কেন আবৃত্তি শিল্পকলা নয়?
‘আবৃত্তিতে কবির লেখা কবিতাই মূল। আবৃত্তিকারের তেমন কোন ভূমিকা নেই।’ তাহলে আমি বলবো নাটক কি? গান কি? নাটক কি নাট্যকার লিখেন না? সে কি সংলাপ, মঞ্চের কী রূপ তখন রাত না দিন এসব নির্দিষ্ট করে দেন না?
হ্যাঁ তারপরও নির্দেশকের শিল্পীর কিছু ভূমিকা থাকে। সেটা আবৃত্তিতেও থাকে। গানের ক্ষেত্রে গীতিকার গান লেখেন, সুরকার সুর দেন, যন্ত্রশিল্পী বাজান সেই সাথে শিল্পী তাঁর সুরেলা কণ্ঠে গান করেন। আর আবৃত্তিশিল্পী শুধু লেখকের লেখাটুকু নিয়ে তাঁর মনের মাধুরী মিশিয়ে রঙিন করে শ্রোতাকে উপহার দেন।
এখানে একটি কথা বলে রাখা দরকার কবি যখন কবিতা লেখেন তখন তিনি তাঁর মনের রঙে নির্দিষ্ট ভাবনা থেকে লিখেন। এখন কবি যে ভাবনা থেকে লিখেছেন পাঠক কি তাঁর সেই ভাবনা নিয়ে পড়তে পারবে? আমার উত্তর সম্পূর্ণ রূপে পারবে না। অনেক সময় কাছাকাছি গেলেও একই রকম হবে না। সেই জন্য আবৃত্তিশিল্পী যখন কবিতাটি শ্রুতিপোযোগি করে অন্যকে শোনান, তখন তার মধ্যে যে ভাবটা উদয় হয় সেই ভাবটাই শ্রোতার মধ্যে সঞ্চারিত হয়। [ছাপার অক্ষর প্রাণহীন তাতে প্রাণ সঞ্চার করে শিল্পী তা সে যাই হোক আবৃত্তি, গান বা নাটক। প্রাচীনকালে যেমন শিল্পী বা শ্রোতা সুর-লয়-ছন্দ সহকারে গুরুর থেকে পেতো এখন তেমন নেই।]
আর সঞ্চালনের মাধ্যম পাঠকের কণ্ঠস্বর ভাব-আবেগ উপস্থাপন রীতি-গতি-ছন্দ ইত্যাদি বিষয়। সব মিলিয়ে এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি যাতে শ্রোতা নিজেকে আবৃত্তিকার বা পাঠকের সাথে জড়িয়ে নেয়। শিল্পী যা ভাবে, যা দেখে শ্রোতাও তাই ভাবে দেখে। আর এটাই আবৃত্তির মূল কথা।
আবার যদি দেখি, একজন আবৃত্তিকার অনেক বেশি বোধের কাজ করেন কারণ একজন সঙ্গীতশিল্পীর মতো তাঁর যন্ত্র সুর নেই বা অভিনেতার মতো আঙ্গিক ব্যবহার নেই। আছে শুধু কণ্ঠস্বর ও বোধদায়ক ভাব-আবেগ। যেমন- নাটকে একজন অভিনেতা কার সঙ্গে কোন অবস্থায় কি কথা বলছে তা দর্শক দেখেই বুঝতে পারে কিন্তু আবৃত্তিকারকে সব কিছু স্বরের মধ্যে দিয়ে বোঝাতে হবে।
এতোক্ষণ যে আবৃত্তির কথা বলছি সে কোন আবৃত্তি? কেমন তার ধরণ? হ্যাঁ আবৃত্তির কিছু ধরণ আছে যা একেকজন তাঁদের নিজের মতো করে তৈরি করে নিয়েছেন। আবৃত্তির কোন ধরা-বাঁধা নিয়ম নেই। অতীতে আমাদের দেশে যে সব লোকজ অনুষ্ঠান হতো পুঁথিপাঠ, পালাগান, কবির লড়াই, রূপকথার গল্প, লোকছড়া, কবিতা ইত্যাদি সবই মূল আবৃত্তি। যার মধ্যে আমরা একটা বাক্য শোনার সাথে সাথে সেই চিত্রটিও দেখতে পাই, যে ছবি এঁকেছেন আবৃত্তি শিল্পী। আর এজন্যেই হয়তো শাস্ত্রকার বলে গেছেন।
‘আবৃত্তি সর্বশাস্ত্রানাং বোধাদপী গরিয়সি’
অর্থাৎ সকল শাস্ত্র পড়ে যে বোধ বা জ্ঞান লাভ হয় আবৃত্তি করলে তার চেয়ে বেশি হয়।
এই ধারাই আবৃত্তির মূল ধারা।কিন্তু যদি আধুনিক আবৃত্তির কথা বলি- তাহলে বলবো শ্রোতা ছবি দেখতে পায় না। সে শুধু শোনে। আর এ জন্যই শাস্ত্রকারের সেই কথা আজ অনেকটাই শিথিল হয়ে গেছে। একে বলবো আবৃত্তির আধুনিক ধারা। আঠারো শতকের দিকে উপমহাদেশে আধুনিক আবৃত্তির সূচনা হয় ইংরেজ ও আধুনিক কবিদের হাত ধরে। সেই ধারা এখনো চলছে তবে কোনোকালেই মূল ধারার আবৃত্তি বিলুপ্ত হয় নি।

জন্ম ১৬ ই বৈশাখ, ১৩৯৪ মাদারীপুরের শিবচরে। বাবা ইন্দ্রজিৎ মালো পেশায় ছিলেন শিক্ষক। বোনহীন বড় দুই দাদার স্নেহে মায়ের ভালোবাসায় কেটেছে শৈশব। ছোটবোলা থেকেই খেলায় বলায় ডানপিটে। প্রতিবেশী স্বজনেরা আদর করে ডাকতেন তপু। উমেদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ভদ্রাসন জি সি একাডেমিতে স্কুল শেষ করেছেন। ড. নুরুল আমিন কলেজে থাকাকালীন শিল্পসাহিত্যর সাথে পথচলা শুরু হয়। রাজধানী ঢাকায় এসে সরকারি তিতুমীর কলেজে গণিতে স্নাতক করেন। এসময় সাহিত্যে বাচিক চর্চা ও প্রসার প্রতিষ্ঠান কন্ঠশীলন চতুরমাসিক আবর্তন করেন। কন্ঠশীলন কোর্স চলাকালীন সত্য ও সুন্দরের আরাধনায় ‘উদ্ভাসন’ প্রতিষ্ঠিত করেন। এরপর মীর বরকত তামান্না তিথিকে নিয়ে ‘কল্পরেখা’ কোমল প্রাণের প্রদীপ প্রতিষ্ঠিত করেন। এছাড়া বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র পরিচালিত পাঠচক্রের সভ্য ছিলেন। খামখেয়ালী সভায় রবীন্দ্রচর্চায় যুক্ত ছিলেন। আবৃত্তিশিল্পী চন্দ্র তাপস শিশুরাই স্বপ্ন নিয়ে ‘প্রজাপতির মেলা’ নামে একটি স্কুল শুরু করে অর্থাভাবে বেশি দূর যেতে পারেনি। ছায়ানট পরিচালিত স্কুল নালন্দা এবং ফুলকির সম্বন্বিত শিক্ষা সাংস্কৃতিক কর্যক্রমে শিক্ষাকর্মী হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি ‘কথা কবিতার ঘ্রাণ’ নামক একটি শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি বিষয়ক অনলাইন পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০ প্রকাশিত যৌথ কাব্যগ্রন্থ “কবিতা ও প্রেম”। কর্মজীবনে শিক্ষকতা, সাংবাদিকতা, ব্যাংকিং একের পর এক চাকরি ছেড়ে ব্যাবসায় যুক্ত হন। বর্তমানে প্রবাসে ভবঘুরে জীবনযাপন করছেন।