| 27 এপ্রিল 2024
Categories
এই দিনে গদ্য সাহিত্য

কবিতা বিষয়ক গদ্য: নূন্যতম কবিতা

আনুমানিক পঠনকাল: 10 মিনিট

আজ ২৮ জানুয়ারী কবি অনিন্দ্য রায়ের শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।


lighght
শুধুমাত্র এই সাতটি অক্ষর লেখার জন্য কবিকে দেওয়া হল ৭৫০ ডলার। আজ নয়, গত শতকের ষাটের দশকের মাঝামাঝি। পৃথিবীর সব চে দামী শব্দ। আর বিতর্ক এখানেই। শব্দ? কী অর্থ এর? আবার যিনি লিখেলেন তিনি তো একেই বলছেন কবিতা, এই কটি অক্ষরসমষ্টিকে। তা প্রকাশিতও হচ্ছে, সংকলনে নির্বাচিত হচ্ছে। একটা সাদাপৃষ্ঠার মাঝখানে lighght এইটুকু ছাপা, এইটুকুই, একে বলে কবিতা ?
ম্যানহাটন শহরে তখন শরৎকাল।  সালটা ১৯৬৫। সে এক সন্ধ্যা। বছর  বাইশের এক যুবক নিজের টাইপ রাইটারে 

lighght

এইটুকুই টাইপ করেন। কী এটা? বানান ভুল, হ্যাঁ,  light  শব্দটির মাঝে এই দুটি ব্যঞ্জনবর্ণকে ঢুকিয়ে দেওয়া, আর তাতেই নাকি  ব্যঞ্জনা । শিকাগো রিভিউ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় কবিতা হিসেবে। এবং তা স্থান পায় The American Literary Anthology-র দ্বিতীয় খণ্ডে, অবশ্যই কবিতা হিসেবে। এই সংকলন সম্পাদনা করেন National Endowment of the Arts(NEA) –এর পক্ষে George Plimpton। NBA-এর সিদ্ধান্ত মতো সংকলনটির প্রত্যেক কবিই পান ৭৫০ ডলার। সেই হিসেবে lighght-এর রচিয়তাও।  শিকাগো রিভিউ নিজে২৫০ ডলার রেখে দেয় আর বকিটা পেলেন কবি। মানে ৫০০ ÷ ৭= ৭১. ৪৩ ডলার একেকটি অক্ষরের  জন্য। আর বিতর্ক এখানেই। আইওয়ার রিপাবলিকান সদস্য William Scherle দেশজোড়া প্রচারে নামলেন এই নিয়ে। lighght- যা একটি মাত্র শব্দ, তাও আবার ভুল বানানে, তার জন্য খরচ হয়েছে ৭৫০ ডলার।  শিল্পের নামে এসব সরকারী অর্থের, জনগনের অর্থের অপচয়। বিতর্ক আর বিতর্ক।“আমরা জনগণের ট্যাক্স কমাতে পারি না,কিন্তু একটা শব্দের পেছনে ৭৫০ ডলার খরচ করতে পারি” কথা উঠল এমনও।  NEA –এর ডেপুটি চেয়ারপার্সন Michael Straight কে মুখোমুখি হতে হয় কংগ্রেসের  ৪৬ সদস্যের  সামনে। প্রচুর কথাবার্তা, রাজনৈতিক বাকবিতণ্ডা চলতে থাকে একে ঘিরেPlimptonও দমে যাওয়ার পাত্র নন। তিনি প্রবলভাবে কবি ও কবিতাটির পাশে দাঁড়ান। Scherle বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রচারের জন্য আইওয়া ছুটে যান । ১৯৭৪-এর  নির্বাচনে পরাজিত হন Scherle । Plimpton নাকি কেন  lighght কবিতা তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন,”You are culturally deprived, so you would not understand it anyway’। 
সেই কবির নাম Aram Saroyan । তাঁর বাবা আমেরিকার পরিচিত কবি ও নাট্যকার Willium Saroyan ।
বিতর্ক কিন্তু থামে না এখানেই। পরবর্তীতে তাঁর নির্বাচনী প্রচারে Ronald Reagan আবার এই প্রসঙ্গ তোলেন এবং তিনি শিল্পের নামে এইসব আলতুফালতু খরচা বন্ধের প্রতিশ্রুতি দেন।
১৯৮১ সালে  Aram Saroyan লেখেন,’The Most Expensive Word in History’. একটি শব্দের একটি কবিতার নিয়ে তিনি  লেখেন একটা গদ্য। তাঁর Complete Minimal Poems বইটিতে স্বাভাবিকভাবেই স্থান পায় lighght। George Plimpton এটি বিংশ শতাব্দীর সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য কবিতা হিসেবে অভিহিত করেন। Saroyan  নিজেই বলেন পরে,” So apparently the crux of the poem is to try and make the ineffable, which is light—which we only know about because it illuminates something else—into a thing. An extra ‘gh’ does it. Embossing it does it. Engraving it in stone, and letting the light play off the actual word, does it, too. It’s sculptural on that level.”
Bob Grumman ব্যাখ্যা করেন এইভাবে  “Saroyan brings us face-to-face with the ineffability of light, a mysterious substance whose components are somehow there but absent, as “ghgh” is there (and delicately shimmering) but unpronounced in the word, “lighght.” And he leaves us with intimations of his single syllable of light’s expanding, silently and weightlessly, “gh” by “gh,” into . . . Final Illumination..” কতোভাবে দেখা হল lighght-কে, কত কথা, কত পাতার পর পাতা লেখা হল একে নিয়ে।
এটি শুধুমাত্র একটা ভুল বানানে থাকা শব্দ থাকে না, কবিতাও থাকে না, রাষ্ট্র ও শিল্পের সম্পর্কের এক আধুনিক মেটাফর হয়ে ওঠে।
  হ্যাঁ, সামান্য একটি শব্দ দিয়ে কবিতা, সম্ভব? তাকে কবিতা বলব আমরা? Aram Saroyan চালিয়ে গেলেন তাঁর নিরীক্ষা, একটি মাত্র অক্ষর দিয়ে তিনি লিখলেন কবিতা।  এবং তাও লিখলেন ভুল ভাবে। 
      

M –এই অক্ষরটির চারটি পা। Guinness Book of Records-এ এটি স্থান পেল পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট কবিতা হিসেবে। Bob Grumman লিখলেন এর সম্পর্কে ‘snaps us visually into the center of an alphabet just starting to form, between its m and n. And it brings to mind the way a doubled u becomes a w. The poem also comes across as a pun for the word, “am,” to suggest some kind of superior, or perhaps gross, state of being–an “am” times one-and-a-half.’
শুধু কি Aram Saroyan ? সারা পৃথিবীর কবিরা মেতে উঠলেন সবচেয়ে কম শব্দে, অক্ষরে, ,ন্যূনতমে কবিতাকে প্রকাশের চেষ্টায়। কবিতার নতুন অভিব্যক্তি এল আমাদের সামনে, minimalist poetry,নুন্যতম কবিতা।
George Swede লিখলেন এই কবিতাটি
M SS NG
Thiiief!
এক চোর যেন missing শব্দটি থেকে দুটি অক্ষর, দুটি i সরিয়ে তা নিজের করে করে নিয়েছে।
Geof Huth লিখলেন এইভাবে

ইকোইক E –র ভেতর দিয়ে অক্ষরের প্রতিধ্বনিময়তা ফুটিয়ে তোলেন।
Karl Kempton-এর কবিতা শব্দের ভেতর ধ্বনির অবস্থাঙ্কে , ধ্বনির প্রশ্নকে অনাবৃত করল
                                                  

                                               
ANTIQUE QUESTION
anti quest ion
a we
awe
Bob Grumman এর সম্পর্কে লিখলেন,’ t is vital to read this poem both as words and letters, and to watch as well as read it. In such a reading, and watching, the poem should make almost tangible the idea of a question’s congealing into a serenity beyond irritable answer-seeking. And the subsequent parallel drawing together of “a we” (or group of individuals associating to the degree of we-ness but not any transcendentally further) into “awe,” or some higher Oneness, should have an even more electrically almost-tangible impact. (Listen, too, to the sound of “a we” become the sound of “awe!”) How a poem could better celebrate that sense of achieving Final Sharedness than this one, I don’t know.’

George Swede  লিখলেন graveyard/ dusk/ killdeer এই তিনটি শব্দকে একসাথে, তৈরি করতে চাইলেন গোরস্থানে আগত সন্ধ্যার আবহ

graveyarduskilldeer

কাহিনীর উদ্ভাস নিয়ে লেখা হল এওমন কবিতাও, একটিমাত্র শব্দে 
বিখ্যাত দার্শনিকের অন্তিম শ্বাস                

কেন  . . .
(The Last Breath of a Famous Philosopher
Why . . .)
লিখলেন Douglas A. Mackey ।
একটি বড় শিরোনামের কবিতা একটি মাত্র শব্দে এবং তা এতটাই অমোঘ ।
পৃথিবীর অন্যান্য ভাষাতেও ফুটে উঠতে দেখি এই ফর্ম। ফরাসী কবি ব্লেইজ সন্‌দ্রাঁ লেখেন

আমি কেন লিখি

 কারণ . . .
কবিতা ছাড়াও উপন্যাসে, নাটকে মিনিমালিজম প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে।  আর মিনিমালিস্ট বা ন্যূনতমের ধারণা ভিস্যুয়াল আর্ট , সঙ্গীত এবং স্থাপত্যে বিশেষ প্রভাব ফেলে। এবং ফ্যাশনে, ডিজাইনিং-এ, বেঁচে থাকায়। একটা দর্শন হিসেবে প্রতিষ্টা পায় এই ভাবধারা।
কাকে বলে মিনিমালিজম? যেখানে সমস্ত রকম অতিরিক্তকে পরিহার করা হয়েছে, যেখানে রয়েছে শুধু নির্যাসটুকু, এসেন্সিয়ালটুকু, যেখনে ন্যুনতম মানে সত্যিই সেটুকু যা না হলে হয় না।
একটি মিনিমালিস্ট স্থাপত্য হচ্ছে তাই , যেখানে বাসযোগ্যতার মিনিমামটুকু রয়েছে।
আর কবিতায় এর কোনো লিখিত ম্যানিফেস্টো নেই, দিনক্ষণ ঘোষণা করে কোনো সূচনা নেই। তবে এই জাতীয় রচনাগুলি দেখলে কিছু সাধাণ বৈশিষ্ট চোখে পড়ে ।
               সব ধরণের ব্যাথ্যা, বিবরণ, বর্ণনা, যুক্তিক্রম বাদ দেওয়া হয়েছে
    শব্দের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, বিশেষভাবে অক্ষরের বিন্যাস ও গঠনগত নির্মিতির ওপর
    মুদ্রিত লিপির দৃশ্যময়তাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে
    প্রকাশমাধ্যমের চূড়ান্ত কার্পণ্য বজায় রাখা হয়েছে ।
  দৃশ্য কবিতার সাথে মিশে গেল অক্ষরসজ্জার ভাবনা। ভিস্যুয়াল পোয়েট্রির নানা আঙ্গিকে প্রকাশিত হতে থাকল ন্যূনতম কবিত।
  অঙ্কের ভাষা ও রূপক ব্যবহৃত হল ম্যাথেমেটিক্যাল কবিতায়। Karl Kempton-এর রচনায় দেখলাম

অথবা, একেবারেই অঙ্কের ভাষায়  Karl-এরই রচনা 

টাইপ রাইটার কবিতা, ক্যালিগ্র্যাফিক কবিতা – এইসব ফর্মে মিনিমালিস্ট কবিতার চর্চা চলতে থাকে।সারা পৃথিবী জুড়ে।
কোনো অলংকার নেই, জামাকাপড় নেই, চামড়া নেই, অস্থি নেই, ফুসফুস- হৃদপিণ্ড- কিডনি- লিভার- ব্রেন কিচ্ছু নেই।
তবে কী আছে?
প্রাণ্টুকু আছে, কবিতাটুকু আছে, কবিতার প্রাণ্টুকু আছে।
আর ইতিহাস?
হ্যাঁ, গ্রিক শহর আলেকজেন্দ্রিয়ায় খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয়-দ্বিতীয় সময়কালে শব্দকে বিভিন্ন আকৃতিতে সাজিয়ে কবিতা লেখার চল ছিল। সেই শহরের মতো সেইসব  রচনাও হারিয়ে গেছে। যেটুকু টিকে আছে তার মধ্যে রোডোস-এর  Simmias   -এর  ডিম, ডানার আকৃতির কবিতা,Theocritus রচিত  প্যানপাইপের আকৃতির কবিতা উল্লেখযোগ্য। বিভিন্ন সময়ে ফরাসী, জার্মান , ইংরেজী ও অন্যান্য ইউরোপীয় সাহিত্যে এর ছোঁয়া পাওয়া যায়।
ফরাসী কবি Guillaume Apollinaire-এর ভূমিকা এ ব্যাপারে আকর্ষণীয়। তাঁর মৃত্যুর পরে প্রকাশিত Calligrammes বইটিতে কবিতার আকৃতিগত ভাবনার প্রভাব পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার কবিদের ওপর পড়ে। 

                ( Apollinaire-এর Calligrammes থেকে) 

কবিতার বিন্যাসে আমেরিকান কবি e e cummings ও নতুন ভাবনার সূচনা করেন।
গত শতকের পঞ্চাশের দশকে ব্রাজিলে চিত্রশিল্পী ও কবিদের যৌথ প্রয়াসে তৈরি হয় কনক্রিট পোয়েট্রি  আন্দোলন। Augusto de Campos, Haroldo de Campos ও Décio Pignatari এই তিন কবিকে পুরোধা বলা যায়। ইয়রোপে Ian Hamilton Finlay, Edwin Morgan  প্রমুখ কবিরা । মুলত শব্দের দৃশ্যময়তা ও সাজানোর কৌশল ছিল কনক্রিট বা প্যাটার্ন বা শেপ কবিতার বিশেষত্ব, যেখানে কবিতা সাজানো হয় নির্দিষ্ট আকৃতিতে।  শব্দ সাজানোর অভিনবত্বের খেলা ছিল ডাডাইস্ট কবিদের মধ্যে।
লুই আরগঁর কবিতার গঠনেও ছিল নতুন চিন্তাভাবনার ছাপ।
বিংশ শতাব্দীতে William Carlos Williams-এর কবিতাকে বলা যায়  মিনিমালিস্ট কবিতার পূর্বসূরি । অভিজ্ঞতার অরৈখিকতা এবং জাস্টাপজিশন টেকনিকের ব্যাবহার তাঁর কবিতাকে বিশিষ্টতা দেয়।
উত্তর ক্যারোলিনার ব্ল্যাক ম্যাউন্টেন কলেজকে কেন্দ্র করে আগের গড়ে ওঠে ব্ল্যাক ম্যাউন্টেন কবিতা আন্দোলন ১৯৫০ সালে।Charles Olson  প্রকাশ করেন  Projective Verse শিরোনামে একটি প্রবন্ধ। যা এই আন্দোলনের ইস্তেহার বলা যায়। Olson-এর সাথে Larry Eigner, Robert Duncan,Ed Dorn,Paul Blackbur প্রমুখেরা যোগ দে্ন এই আন্দোলনে । কবিতাকে কোনো বদ্ধ আঙ্গিক হিসেবে না দেখে এক মুক্ত প্রকাশের ‘হয়ে’ ওঠা ছিল এদেঁর তাত্বিক ভিত্তি, পঙ্‌ক্তি ও শব্দকে উচ্চারণ সাপেক্ষে ছোট করে আনা ছিল এঁদের স্টাইল।
এইরকম ঐতিহ্যের প্রেক্ষাপটে ন্যূনতম কবিতার বেড়ে ওঠা।
আর পৃথিবীর যে কোনো ছোট কবিতা আন্দোলনের অনুপ্রেরণা হিসেবে আসে হাইকুর নাম। বিভিন্ন মিনিমালিস্ট কবি হাইকু লিখেছেন, হাইকু নিয়ে অভিনিবেশের কথা জানিয়েছেন।
হাইকু হচ্ছে তিন পঙ্‌ক্তির জাপানি কবিতা, এর ইতিহাস বেশ পুরোনো আর এ হল ৫+৭+৫ এই মাত্রা বিভাজনে তিন পঙ্‌ক্তিতে মোট ১৭ মাত্রার এক বিশেষ কবিতা আঙ্গিক। এই মাত্রা বা সিলেবলের জাপানি নাম’ মোরেই’। প্রথাগত কবিতা ‘তনকা’(যার প্রচলন নবম শতাব্দী থেকে)- র সূচনাভাগে এই মাত্রা অনুসারে লিখিত হোক্কূ থেকেই উনবিংশ শতাব্দীর শেশভাগে হাইকু উদ্ভব। মাৎসুয়ো বাশো, ওনিৎসুরা, বুসান, মাসাওয়া সিকি হাইকু রচয়িতা হিসেবে জগৎ বিখ্যাত, যদিও এঁরা হোক্কূ-র সময়ের মানুষ। সারা পৃথিবীতেই একটি সংহত, , বাহির বর্ণনা থেকে অন্তরযাত্রা,ব্যঞ্জনামুখর প্রকাশমাধ্যম হিসেবে হাইকু জনপ্রিয়তা অর্জন করে। সব ভাষাতেই লেখা হতে থাকে এই ফর্ম আর চিরাচরিত কাঠামোর মধ্যে ও বাইরে একে নিয়ে চলতে থাকে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা।
বাংলাভাষাতেও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কবি হাইকু নিয়ে আগ্রহী হন।

                                 চঞ্চল পোকা
টিকটিকির ধৈর্য
দেয়াল খাড়া ।
     (বাংলা হাইকু/ দেবব্রত সরকার)
১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁর জাপান ভ্রমণকালে এই তিন লাইনের জাপানি কবিতার প্রতি আকৃষ্ট হন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
“ এই যে নিজের প্রকাশকে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত করতে থাকা, এ ওদের কবিতাতেও দেখা যায়। তিন লাইনের কাব্য জগতের আর কোথাও নেই । ওই তিন লাইনই ওদের কবি, পাঠক, উভয়ের পক্ষেই যথেষ্ট। …. এদের সঙ্গে আমাদের নিছক সৌন্দর্যভোগের সমন্ধ – এরা আমাদের কোথাও মারে না, কিছু কাড়ে না, এদের দ্বারা আমাদের জীবনে কোথাও ক্ষয় ঘটে না। সেইজন্যেই তিন লাইনেই এদের কুলোয়, এবং কল্পনাটাতেও এরা শান্তির ব্যাঘাত করে না।
  এদের দুটো পুরোনো কবিতার নমুনা দেখলে আমার কথাটা স্পষ্ট হবেঃ
পুরোণো পুকুর,
         ব্যাঙের লাফ,
                                             জলের শব্দ।
….
আর- একটা কবিতা
পচা ডাল,
     একটা কাক,
শরৎকাল।
….
  যাইহোক, এই কবিতাগুলির মধ্যে কেবল যে বাক্‌সংযম তা নয়, এর মধ্যে ভাবের সংযম। এই ভাবের সংযমকে হৃদয়ের চাঞ্চল্য কোথাও ক্ষুন্ন করছে না।…  এক কথায় বলতে গেলে, একে বলা যেতে পারে হৃদয়ের মিতব্যয়িতা ।“
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাপান-যাত্রী
ছোট কবিতার প্রতি তাঁর আগ্রহ আমরা দেখি স্ফুলিঙ্গ কাব্যগ্রন্থে।
     কোন্‌ খ’সে-পড়া তারা
        মোর প্রাণে এসে খুলে দিল আজি
                                     সুরের অশ্রুধারা ।
                           (স্ফুলিঙ্গ, ৬১)
অথবা
সন্ধ্যাদীপ মনে দেয় আনি
পথ-চাওয়া নয়নের বাণী।
                                                 (স্ফুলিঙ্গ, ২৩৪)
ছোট কবিতার প্রতি বাঙালি কবিদের ঝোঁক যথেষ্টই । এবং, অণুকবিতা  একটি বিশেষ কাব্যধারা হিসেবে গড়ে ওঠে বহুজনের অংশগ্রহণে , কেবল অণুকবিতা চর্চার জন্য পত্রপত্রিকা আমরা দেখতে পাই। ভাবনা ও প্রকাশের সংক্ষেপ, আবেগের নিয়ন্ত্রণ,মুহুর্তজাপন প্রকাশভঙ্গির চমৎকারিত্ব – এই সব মিলে নিজের অবস্থান চিহ্নিত করে এই কবিতাগুলি।
চোখ
নীচে ক্লান্তি
ভেতরে ভয়
পাতায় ভালোবাসা।
( ঋক্‌ অথবা শায়েরী, ১ / ঈশ্বর ত্রিপাঠী)

আরো ছোট, আরো গভীরে, পরমাণুতে পৌঁছতে চাইলেন কেউ কেউ। বাংলাদেশের আশির দশকের কবি সমরেশ দেবনাথের একটি কাব্যগ্রন্থের নাক, “পরমাণু কবিতা”।
কেউ কেউ বললেন যে, কবিতা ছোট হতে পারে, কিন্তু তা হবে একটি কবিতা, কোনো খণ্ড কাব্য নয়, একটি সম্পূর্ণ কবিতা। বাংলা কবিতায় এল কমপ্লিট পোয়েট্রি বা পূর্ণ কবিতার ধারণা। যেমন

সাদা
আমি অন্যকারও কাছে      আমি অন্যকোনওদিন    আমি অন্যকোনওখানে    আমি অন্যকোনওবিষয়ে

কালো
আমি সবার কাছে        আমি প্রতিদিন          আমি সবখানে                আমি সব বিষয়ে    
(কবিতাফিল্ম/ প্রবীর রায়)

ওরা প্রতিদিন   নদী খুঁড়ে বালি তোলে
ওরা প্রতিদিন   নদী খুঁড়ে পাথর তোলে

   ওরা প্রতিদিন
                                    বালি আর পাথরের গন্ধ মাখামাখি করে
                              (রায়ডাকচরের রোজনামচা/ শমীক ষাণ্নিগ্রাহী)
এক লাইনে ভাবনাকে ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস থেকে এল ‘ এক পঙ্‌ক্তির কবিতা ‘ ।

   কবিতা লিখলেই মানুষ, গণিত আবিষ্কার করলেই বিশ্বের মালিক
                          ( এক পংক্তির কবিতা, ১ / বিনয় মজুমদার)

               সমস্ত জীবন ধরে মৃত্যুদণ্ড আমার
                                 (মুক্তি/ পরেশ মণ্ডল )
শুদ্ধসত্ত্ব বসু তাঁর ‘ বংলা সাহিত্যের নানা রূপ’ বইটিতে ‘ছবিতা’র উল্লেখ করেন,যা ছবি ও কবিতার মিশে যাওয়া, যা  শব্দকে কোনো নির্দিষ্ট আকৃতিতে সাজিয়ে কবিতপ্রকাশের এক রূপ। কনক্রিট পোয়েট্রির সাথে তার মিল লক্ষ্যনীয়। এই ছবিতা বা আকৃতি-কবিতা বাংলাভাষায় ‘শ্রুতি’ আন্দোলনের অবদান।
  ১৯৬৫-র এপ্রিলে প্রথম প্রকাশ পায় শ্রুতি প্ত্রিকা। মোট ১৪টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকাকে কেন্দ্র করে পুষ্কর দাশগুপ্ত, সজল বন্দ্যোপাধ্যায়, পরেশ মন্ডল, মৃনাল বসু চৌধুরী, অশোক চট্টোপাধ্যায় ও অন্যান্যরা বাংলা কবিতার এক গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন গড়ে তোলেন। ইস্তেহারে নিজের কবিতা বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করে দলবদ্ধভাবে তাঁদের কবিতাচর্চা । তাঁদের কাবদর্শন আমাদের সামনে তুলে ধরেন পুষ্কর দাশগুপ্ত
“ উপলব্ধির গভীরতলে,  নব নব আত্মিক অভিজ্ঞতাকে ভাষায় যথাযথ প্রকাশ করতে না পারা অতৃপ্তি এবং সংশ্লিষ্টভাবেই ব্যবহৃত ভাষাপদ্ধতির জীর্ণতা সম্পর্কে অনুভব প্রত্যেক সচেতন কবির মনে সদাজাগ্রত ।
   মুদ্রণের উন্নত অবস্থায় কবি সম্ভাব্য উপায়ে এবং প্রয়োজন অনুসারে কবিতার বিন্যাসে দৃষ্টিগ্রাহ্য ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করতে পারেন। ….     বিশেষ কোন ছক বা আকার কবিতাকে বিন্যস্ত করে কবি তার মানসিক অনুষঙ্গকে সাংকেতিক করতে পারেন । “
  তাঁদের কবিতায় আমরা দেখতে পাই

                           ( সূর্যস্তোত্র/  পুষ্কর দাশগুপ্ত)

                            ( কবিতা ৩/ পরেশ মন্ডল)

          (কারা কথা বলতে বলতে/সজল বন্দ্যোপাধ্যায়)

  নব্বই দশকে জলপাইগুড়ি শহরে ‘এরকা’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে দানা বাঁধে ‘ সংহত কবিতা’ আন্দোলন। রীতিমতো ম্যানিফেস্টো প্রকাশ তাঁদের শুরু। দেবাশীষ কুন্ডু, অতনু বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলাদ্রি বাগচী, শুভ্র চট্টোপাধ্যায়, সুবীর সরকার, শৌভিক দে সরকার ছিলেন এই অন্দোলনে শরিক। ‘ভাবের চাহিদা মতো অমোঘ শব্দ ব্যবহার সংহত কবিতা’ এই ছিল তাঁদের কবিতা।
                              

                                চোখ দুটো
                                কুয়াশার আড়ালে
                                    হলুদে মাখানো
( প্রেরণা/ অতনু বন্দ্যোপাধ্যায়)  

  এই প্রেক্ষিত, এই পটভূমিকায় বাংলা কবিতায় ন্যূনতম কবিতার চর্চা । যেখানে প্রকাশমাধ্যমের ওপর চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ আর কার্পণ্য কবিতাকে ন্যূনতম করে তুলবে।
সুজিত পাত্র একটিমাত্র অক্ষরে প্রকাশ করেন কবিতা
অ-ক্ষ-র –মালা থেকে যে কবিতাটি ঝরে পড়েছে


ভজন দত্ত palindrome ব্যাবহার করে লেখেন
                      দর্পণ কবিতা

          থা
             ক
                 না
       না
                   ক
                      থা
    খা
      দে
         দে 
            খা
  ন
    র
        ম
          ম
             র
                   ন
  তা
    লা 
         ক
               ক
                লা
                  তা
  স
     ব
        ভা
            বি
                   বি
                 ভা
                     ব
                       স

এবং এই ধারা বাংলা কবিতার স্রোতে মিশে যেতে থাকে। বিশ্ব মিনিমালিস্ট কবিতার ইতিহাসেও বাংলাভাষায় এর চর্চা মিশে যায়।
কিন্তু একে কি কবিতা বলব? যদি তা গিমিকমাত্র না হয়ে, ইয়ার্কিমাত্র না হয়ে পাঠক হিসেবে আমাকে অন্য যে কোনো ফর্মের কবিতা পাঠের সমান অনুভূতি দিতে পারে, তো, একে কেন কবিতা বলব না?

( প্রথম প্রকাশঃ কবিতানগর, প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা) 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত