| 27 এপ্রিল 2024
Categories
এই দিনে কবিতা সাহিত্য

অরণ্য আপনের কবিতাগুচ্ছ

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

আজ ২৭ ফেব্রুয়ারি কবি,গদ্যকার,অনুবাদক অরণ্য আপনের শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।


 

মা

মা আমার পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ছিল

মা চলে গেল

তারপর অনেকে ধূসর মেঘের মতো এল

আবার পাল তোলা নৌকার মতো চলেও গেল

শুধু জুহিতাই থেকে গেল এ পৃথিবীর মতো

মায়ের কবরে আজান হয়, আমি শুনি

মায়ের কবরে যাবার জন্য আমি স্বপ্ন বুনি

এ কবর জেগে থাকে আমার মাথার শিয়রে

মগজের ভেতর এক নিঃশ্বাস দুঃখ অন্ধকার করে।

রক্তে

পাঞ্জাবিটা ভিজে গেছে বুকের কাছে

রক্তে

জুহিতা কখন এসেছিল জানি না

বেগার পড়ে আছি এ পৃথিবীতে

কবিতা নেই কোনো হাতে

দিনটা ঘুরিয়ে দিলে রাত হয়ে যায়

আকাশের কাছে আকাশ রেখে কতদূর যাওয়া যায়

জীবনটা উলটে দিয়েছি

চোখ পিছনে চলে গেছে

সামনে আমি শুধু

মানুষ, রাস্তা, খোদা পিছনে পড়ে গেছে

অপেক্ষা কর শবের মতো

আকাশ ডুব দিতে গেছে

অদেখা এক পৃথিবী রোদ থেকে বের হয়েছে

বিষ হয়ে গেছে জীবনের সমস্ত ভাষা

বিষ হয়ে গেছে জীবনের সমস্ত আশা

জলের স্তনে ডুবে গিয়ে

জীবন হলুদ ঘাসের মতোই দুঃস্বপ্ন খায়

পরের পাতান রাস্তা খায়

পরের জ্বালান বিড়ি খায়

পরের বাসি রাত খায়

পরের দুর্গন্ধ জ্ঞান খায়

তারপর জীবন অযু নিয়ে শেষ হয়ে যায়

হাত আমাকে ঘুসি দেখায়

পা আমাকে লাত্থি দেখায়

হৃদয় শুধু আমাকে প্রেম দেখায় না

চোখ শুধু আমাকে জুহিতাকে দেখায় না

ঠোঁট শুধু আমাকে চুমু দেখায় না

তোমরা হাতে মাটি নিয়ে থাকো

দূরে দূরে কে কে আছে, ডাকো

একটা জীবনপাখি ডানা ঝাপ্টে ঝাপ্টে মরে যাচ্ছে

মরার পর হয়তো দেখব আমি জমিনে নয় আকাশে ঘুমিয়ে আছি

হৃদয় দিতে গিয়ে যারা পাথর দিয়েছে তাদের দেখব ভুলে গেছি

চোখটা জলে পুড়ে গেল

হৃদয়টা হৃদয়ে থেকে গেল।

বার্তা

তোমার সাথে দেখা হলে ধান খাওয়াব পাখিদের

একটা পাখি জানালার কার্নিশের ডালে বসে থেকে গেল

ঠোঁট নড়াল

ইতিউতি তাকাল

তুমি কি ওকে আমার কাছে পাঠিয়েছিলে

দাঁড়িয়ে থাকা ভোর

খুলে দিয়েছিল দোর

তারপর বসে পড়ল চোখের ভিতর

চোখের জল খেয়ে বুকের খবর নিল

তারপর ফরফরে করে উড়াল দিল

তুমি কি বার্তা পেয়েছিলে

এখনো চাকরিটা হয়নি আমার

এখনো ঘুম কাটেনি খোদার

বৃষ্টি পাঠিয়ে দিও, আজকাল বড্ড খিদে পায়

চোখের জল ছাড়া আর কিছু পাই না ভাগ্যের থালায়।

মাছের চোখে

অনেকদিন পর একটা সকাল ঠোঁট খুলে কথা বলল

ভালো লাগল এ জীবন অনেকদিন পর

ভালো লাগল এ পৃথিবী ঢেকে দিল কবর

এ জীবন গাছের তলায় বসে থাকল সময় ছেড়ে

ঝরে পড়ল চোখে একটা গাছের হাসি

একটা মেয়ে খলসে মাছের মতো হেসে বলল আমি মাছ ভালোবাসি

হাতের রেখায় ছিল সীতার ধৈর্যের মতো নদী

ছেড়ে দিল

সহসা ডুবে গেল মৃত্যু ও খরা

একটা ফর্সা গাছ খুলে দিল বুকের পাড়া

হনহন করে হেঁটে গেল অন্ধকার জল বেয়ে

পুরো পৃথিবীটা একটা মাছের চোখে আছে চেয়ে।

 

আমি ভুলে যাব

আমি তোমাকে ভুলে যাব

বাংলা বর্ণমালা ভুলে যাওয়ার মতো

আমি ভুলে যাব

তুমি কতটা অর্ধমাত্রার

কতটা পূর্ণমাত্রার

আমি ভুলে যাব তুমি কতটা মাত্রাহীন

আমি ভুলে যাব তুমি কতটা ছিলে আমিহীন

ভুলে যাওয়াটাই আমার জন্য সমীচীন

ভুলে তো যাব, কিন্তু কীভাবে

তুমি তো ৭ই মার্চের ভাষণের মতো বাস্তব

মোটা চাল পঞ্চাশ টাকা কেজি

ভোলা যায়? 

তোমাকে কেমনে ভুলব?

তুমি তো মধ্যবিত্তের টানাপোড়নের সংসারের মতো সত্য

তোমাকে কেমনে ভুলব? 

তুমি তো স্বপ্ন নও যে ভুলে যাব

ঘুম ছুটে গেলে চোখে পানি ছিটাব

তুমি কেন বুঝছ না আপন

আমি তাকে ভুলতে পারি না

যে আমার মধ্যে ছিলই না

তাকে কেমনে আমি ভুলব? 

সে তো কল্পনা ছিল

যার শরীর হয়নি

আওয়াজ হয়নি

বাক্য হয়নি

বাক্যবন্ধন হয়নি

সে এক কথা ছিল

যা তাকে বলাই হয়নি

সে এক সম্পর্ক ছিল

যা আমার মধ্যে ছিলই না

আমার মনে বুদবুদ করে সেসব

যা কখনো ঘটেই ছিল না।

 

 

এ জীবন আমার না

আমি যে বেঁচে আছি

বা একটা জীবন দখল করে আছি

আমার এমন কিছু মনে হয় না

আমার জীবনের প্রদীপের মেজাজ আমি জানি

এই আলো, এই অন্ধকার

এই চকচকে আকাশ,এই অন্ধকার বাতাস

না জ্বলে, না নিভে।

আমার পরাণের শত্রু হিসেবে

যাদের পেয়েছি

তারা অনেক চতুর

আমাকে হৃদয় দেখিয়ে করেছে ফতুর

তাদের  একটা চোটও ভুল জায়গায় পড়েনি

তাদের একটা তীরও লক্ষ্যচ্যুত হয়নি

তারা সফল

যারা আমাকে মৃত্যু নিয়ে করেছিল দখল

কেন তুমি আমাকে বুঝতে পারলে না

তোমার মনকে জিজ্ঞেস করো

আমার জীবনের গল্পের প্রতিটা পৃষ্ঠা তো খোলা ছিল

এই যে লোকজন যারা আমাকে অতিক্রম করে গেল

আমারই ঘরের সাথে তাদের ঘর

তবুও আমি তাদের কত পর

আমার জীবন এমন এক বন্ধু মতো

যার সাথে আমার

না দেখা হয়েছে

না বিচ্ছেদ হয়েছে

আমি রাস্তায় চিপায়

এমন এক দুর্ভাগার চিঠি পেয়েছি

যা হৃদয়ের রক্ত দিয়ে লেখা হয়েছে

যা চোখের জলে মুছে দেওয়া হয়েছে।

আমার জীবনটা এরকম কয়েকটা চিঠি দিয়ে লেখা

ঘর থেকে বের হয়ে একটা জীবন চলে গেল

না কারো দেখা পেয়েছি

না কারো সঙ্গি হয়েছি

আর হয়তো পাবও না কারো দেখা।

এ জীবন আমার ছিল না

এ জীবনে আমার কোনো পদচিহ্ন নেই।

 

 

 

মেয়ে

মেয়ে তোর প্রেমিক হতে ইচ্ছে করে

তোর কবিতা কবিতা মুখটা

আয়না হয়েছে আমার ঘরে।

তোর পূর্ণ মাত্রার চোখ

আমার সুখ এবং শোক

তুই যেন অক্ষরে অক্ষরে গাঁথা শব্দ

কবিতা হয়ে চেয়ে থাকিস

শুয়ে থাকিস

বসে থাকিস

মনের ভেতর

তোকে নিয়েই আমার রাত দিন

তুই আমার গোপন ঘর

আমার বুক জুড়ে দুপদাপ হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেড়াস

মেয়ে তুই আমার বুকে অজস্র রাতের

ধুকপুকানি এক ইতিহাস।

মেয়ে তোর ঈশ্বর হতে ইচ্ছে করে

যে তোর সব জানে

যে তোর সব দেখে

যে তোর সব ছোঁয়

মেয়ে তোর আকাশ হতে ইচ্ছে করে

খুব ইচ্ছে করে

আমি থাকব তোর দুচোখ ভরে।

মেয়ে তোর পথে হৃদয় বিছিয়ে দিতে ইচ্ছে করে

পুলিশের টহল

একশ চুয়াল্লিশ ধারার মহল

কেউ আমাকে আটকাতে পারবে না

তোর নামে সব প্রেমিক গোলাপ

স্লোগান ধরে।

মন খারাপের দিনে তোর চোখের জল

একলা চলার পথে তোর বুকের বল

হতে ইচ্ছে করে

কাঙালের মতো ইচ্ছে করে।

মেয়ে তোর নামটা পাঠিয়ে দিয়েছি

ঈশ্বরের দরবারে।

 

 

 

মধ্যবিত্ত প্রেম 

আমার মধ্যবিত্ত রক্ত চিৎকার করে

সে তোমাকে চায়

তুমি আসবে আমার সন্ন্যাসী ঘরে?

তুমি এমন ভাষাহীন চোখে

চেয়ে থাকো

মন বলে, আমি চাঁদের দেশ থেকে

চীনের মহাপ্রাচীর না দেখে

তোমাকে দেখতে পাব

আমি হাশরের ময়দানে

স্বর্গ না চেয়ে তোমাকে চাব।

 

 

সর্বস্ব শূন্য

এ জীবনে আর তুমি এসো না গো কুলকুল করে

এ জীবনের জলে তুমি পুড়ে যাবে

তোমার সাথে আরেক জীবনে দেখা হবে

এ জীবনে আমার যুদ্ধ চলে

আমি শুধু বেদনা স্পর্শ করতে পারি

আমি শুধু দূরত্ব বুকে চেপে ধরতে পারি

আমার সংসার একাকিত্বের সাথে

আমার পরিচয় শুধু দুঃখের সাথে

শরীরের যেখানে স্পর্শ করার শক্তি নেই

আমি তোমার সেখানে স্পর্শ করেছি

আর কি চাই গো! 

যেখানে ঘুট অন্ধকার ছিল

সেখানে আমি আলো জ্বেলে দিয়েছি

যেখানে ব্যথার খানাখন্দ জমি ছিল

সেখানে আমি ঠোঁট ভরা চুমুর স্পর্শ বুনেছি

আমার কথা হিসেব করে দেখো

আমার স্পর্শ পড়ে দেখো

আমার অভিমান ছুঁয়ে দেখো

সবখানে তুমি আছ বেহিসেবি

তুমি নেই অথচ তুমি কত চমৎকারভাবে আছ

বোজা চোখের হয়ে গেছ ছবি

আমার ভালোবাসা নিয়ে প্রশ্ন তুলো না

সব গাছের পাতা হলুদ হয়ে যাবে

আমার ভালোবাসা নিয়ে সন্দেহ করো না

সব নদীর পাড় ভেঙে যাবে

আমার ভালোবাসা ছোটো করো না

পায়ের তল থেকে পথিকের পথ হারিয়ে যাবে।

মেঘের সাথে আমার সম্পর্কের কথা

আমি হয়তো ভুলে যেতে পারি

জলের সাথে আমার মুখ দেখাদেখির কথা

আমি হয়ত ভুলে যেতে পারি

গাছের সাথে আমার লুকোচুরি খেলার কথা

আমি হয়তো ভুলে গেলেও যেতে পারি

আমি সব ভুলে যাই

কিন্তু চোখের পুকুরে তোমার সাথে স্নান করার কথা

কেমনে আমি ভুলে যেতে পারি!

আমার আর বেশিদিন নেই দেরি

আমি চলে যাব, তুমি এসো

তোমার জন্য হাঁ করে থাকবে

তোমার গন্ধে ভরা আমার সর্বস্ব শূন্য মনের বাড়ি

তুমি পরো তাঁতের একটা নীল পাড়ের শাড়ি

আলতা পরা তোমার খালি পায়ে

ঝুন ঝুন করে বাজে যেন নূপুর

তোমাকে দেখে অবাক তাকিয়ে রয় যেন

আমার চোখ ফোলান সকাল আর ব্যথা ভরা দুপুর।

আমি চলে যাব, তুমি এসো

মাছেরা যেখানে যায়, আমি সেখানে চলে যাব

তারপর ঠিক ভুলে যাব

আমি মেঘের সাথে ভাব জমিয়ে ছিলাম

আমি  ভুলে যাব

আমি জলের সাথে বুক লাগিয়ে শুয়েছিলাম

আমি হয়ত আরও ভুলে যাব

আমি সবুজ গাছের ঘ্রাণে দীর্ঘকাল ডুবে ছিলাম

আমি শুধু ভুলব না

আমি তোমার শরীরে জল ঢালার শব্দ শুনেছিলাম

তারপর অনেকদিন আমি শরীরের ফাঁক দিয়ে

তোমার মনের দরজায় এসে দাঁড়িয়ে ছিলাম

আমি তো ভুলতে পারব না কখনো

তোমার শাদা নগ্ন পা দেখে

ঠোঁটের কাছে চুমুর জন্য বায়না ধরেছিলাম।

তুমি এসো, তোমার জন্য দুটো কথা রেখে গেলাম

স্বর্গ বা নরকের জন্য আমার জন্ম হয়নি

আমার জন্ম হয়েছিল এই পৃথিবীর জন্য

যে পৃথিবীতে তুমি ছিলে, আর কেউ না,  আর কেউ না।

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত