| 26 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

কেশবতী

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

সব স্মৃতিই প্রিয়নাথের ক্রমে ধূসর হয়ে আসছে, তবু কিছু মুখ ও মানুষ আকাশ-বাতাসের মতোই সজীব, নদীর জলধারার মতো স্বচ্ছ। রাতে ঘুম না এলে, কিংবা ব্যালকনিতে সাঁঝবেলায় একা বসে থাকলে, কখনও সন্ধ্যা হয়ে যায়, কেউ আলো জ্বেলে দেয়, তবু তিনি তাঁর সেই সন্ধ্যাতারা কেশবতীকে আর খুঁজে পান না। কেমন ছিল তার মুখ, মুখের অবয়ব খুঁজে খুঁজে সহসা বিদ্যুৎলতার মতো জেগে ওঠেন— বাবু!
—কে?
—আমি কেশব।

কোনও এক দুপুরে কেশব তার মেয়ে কেশবতীকে নিয়ে বোধ হয় হাজির হয়েছিল। হাতে একখানা চিঠি কেশবের। একতলার বসার ঘরে, বোধহয় ছুটির দিন ছিল, ছেলে স্কুলে যায়নি। নিরুপমা আর ঠিকা কাজের মেয়ে হেঁসেলের কাজে ব্যস্ত— চিঠিটি খুলে পড়তে পড়তে কেশবতীকে মাঝে মাঝে দেখছিলেন। মেয়েটি বড়ই কৌতূহল নিয়ে তাঁকে দেখছে। কেশবের আড়ালে সে বাড়িটার চার পাশ উঁকিঝুঁকি মেরে দেখারও চেষ্টা করছে। কেশব বুঝ প্রবোধ দিচ্ছে, থাক এখানে, বাবু ভাল মানুষ, আমাদের গাঁয়ের মানুষ, থাক। বাড়ির জন্য মন খারাপ করিস না।

প্রিয়নাথ চিঠিটি পড়ে বুঝল, তার পিতৃদেবই কেশবকে পাঠিয়েছেন। চব্বিশ ঘণ্টার একটি কাজের মেয়ে বাড়িতে খুবই দরকার, তবে এই মেয়ে কি পারবে! কিশোরী কেশবতীর গায়ে ফ্রক, বগলে পুঁটুলি।
—তুমি বসো কেশব। ও কি থাকতে পারবে! ছেলেমানুষ, বাবা যে কী করেন!
—বাবু, পারবে। কর্তাবাবু যে বললেন, বাড়িতে কাজকামের চাপ বিশেষ নেই, বউমার ফুট-ফরমাসের জন্যই দরকার। রান্নার লোক, ঠিকা কাজের লোক আছে, ভাল লাগলে বাড়ির মেয়ের মতো থেকে যাবে।

তিনি কেন যে কেশবতীর দুটো সুন্দর চোখের মায়ায় জড়িয়ে গেলেন, তবু বলেছিলেন, কী রে, থাকতে পারবি তো? ভাগু অর্থাৎ ভাগীরথীর কথাও মনে হয়। সেই মেয়েটা বছর তিন-চার এই বাড়িতেই কাটিয়ে গেছে, তার পর বিয়ের নাম করে নিয়ে গেল। যাবার সময় নিরুপমা ফুঁপিয়ে কেঁদেছে, কিছু করার নেই। ভাগুর তো বিয়ের বয়সও হয়নি, তবু নিয়ে গেল। গরিব পরিবারগুলো মেয়ে বড় হলে যে বিক্রিও করে দেয় এমন খবরও ছিল তাঁর কাছে।

তাঁর মনে হল, কেশবতীকে ফ্রকে মানায় না। মেয়েটা বয়সে না বাড়ুক, বাতাসে বাড়ছে।

কেশবকে বলেছিলেন, দু’এক দিন থেকে যাও। কেশবতীর মন বসতে নাও পারে। ও তো ভিতরে ঢুকতেই চাইছে না। তোমাকেও ছাড়তে চাইছে না। কিন্তু কেশব রাজি নয়। সে না গেলে গানের আসর খালি, সাধুবাবার কেত্তনের আসর জমে না, সে থাকে কী করে।

কেশবতীও বলল, বাবা থেকে যাও। একটা দিন তো! কিন্তু রাজি নয়। কেশব কি এই মেয়েটাকে গছিয়ে দিতে এসেছে! পিতৃদেবের কাছ থেকে চিঠি লিখিয়ে এনেছে। একটা পেটের খোরাক বেঁচে যাবে, এমনও ভাবতে পারে কেশব।
তখনই নিরুপমা হাজির।
কেশব বলল, বউদিমণি। প্রণাম কর।
কেশবতীকে নিরুপমারও খুব পছন্দ হয়ে গেল।
নিরুপমার এই একটা দোষ আছে, সে কোনও প্রশ্ন করে না। প্রিয়নাথ বাধ্য হয়ে বললেন, যা ভিতরে যা। ভয় কী।
আর বিকেল বেলায় কেশব চলে গেলে নিরুপমা কেশবতীকে নিয়ে দোকানে গেল। শাড়ি সায়া ব্লাউজ কিনে দিল। আর মুহূর্তে কেশবতীর আনন্দ দেখে কে। বাড়িতে শাড়ি পরবার সখ থাকলে কী হবে, তার বাবার কিনে দেবার মুরদ নেই— তবু কেন যে বনজঙ্গল এবং নদীর পাড় তার সব দুঃখ ভুলিয়ে দেয়!

দোকান থেকে টিপও কিনে দেওয়া হল। পাউডার-স্নো কাচের চুড়ি, সব। তার যে আলতা পরার শখ, এক বার কোথায় বেড়াতে গিয়ে পায়ে আলতা পরেছিল, তার কথা বলতেই নিরুপমা একটা আলতার শিশিও কিনে দিল। ঠিক থাকল মাসের মাইনে কেশব এসে নিতে পারবে না, মানি-অর্ডারে পাঠিয়ে দিতে হবে।

কেশবতী যে খুবই চঞ্চল, বাড়ির ভেতর ঢুকতেই টের পাওয়া গেল। বাড়িটা সে সেজেগুজে বিকেলবেলায় ঘুরে দেখল। এবং এই বাড়ির এখানে-সেখানে কিছু বনজঙ্গলও আছে দেখতে পেয়ে বলল, আমি কোথাও আর যাব না। তোমরা আমাকে রাখবে তো?

এর আগেও কলকাতার বাবুদের বাড়িতে কেশবতী যে কাজ না করেছে তা নয়। তবে তার বেশি ক্ষণ মন টেকে না। দু-দিন যেতে না যেতেই বাড়ির জন্য মন খারাপ। বাড়ি বলতে খালপাড়— ভিটেমাটি বলতে কাঠা দুই জমি, সরকারের খাস থেকে পাওয়া। ভাই-বোনগুলির জন্য মন পোড়ে। খড়ের চাল, মাটির দেয়াল, আর যে দিকে চোখ যায় বনজঙ্গল গাছপালা। খালের জল নদীতে গিয়ে পড়ে— নদী থেকে সমুদ্রে।

নদীর পাড়ে গেলেই ঝোড়ো হাওয়া, চুল ওড়ে, সে দৌড়ায়। বনজঙ্গল পার হয়ে নদীর ধারে চলে যায়। ও-পার দেখা যায় না। নদীর ঢেউ, ভটভটির শব্দ, নীল খোলামেলা আকাশের নীচে সে যেন সন্ধ্যাতারা। কিংবা দূরের বটগাছ, বটগাছের নীচে সাধুবাবার আশ্রম। মেলার সময় কী ভিড় কী ভিড়!

প্রিয়নাথ ক’দিনের মধ্যেই টের পেয়েছিলেন, মেয়েটার মধ্যে আছে প্রকৃতির সুষমা। ছেলেরা স্কুলে, নিরুপমা অফিসে। তাঁর অফিস তিনটেয়। মেলা কাগজ আর তার কাটিং কেশবতী পায়ের কাছে বসে জড়ো করত। খবরের অফিসের কাজ, সারা সকাল রাজ্যের খবর তাকে পড়তে হয়, কোনও খবর যদি বাদ যায়, আর কেশবতী, পায়ের কাছে বসে নাছোড়বান্দার মতো তার দেশের গল্প বলে যেত।

—এই কেশবতী, চা দিতে বল।
—আবার চা! চা বেশি খেও না বাবু, চা খেলে খিদে মরে যায়। পেটে চরা পড়ে যায়।
—ইশ্‌, কী শুরু করলি!
—আবার সিগারেট খাচ্ছ, বউদিমণি এলে বলে দেব।
—দিস। সকালে কী খেলি?
—ভাত, নুচি ভাল লাগে না। জান বাবু, ফসলের দিনে সবুজ গন্ধে আমাদের বাড়িটা ডুবে থাকে। যত দূর চোখ যায়, ধানের জমি সবুজ হয়ে থাকে। নদী থেকে পাখিরা উড়ে আসে। সাধুবাবার আশ্রম থেকে কাঁসর-ঘণ্টা বাজলেই বুঝি সাঁঝ লেগে গেছে।

কত কথা যে বলতে পারে মেয়েটা!
—জানো বাবু, তোমাদের শহরে দু-দুবার কাজ নিয়েছিনু। টিকতে পারিনি। একাই এক বার দেশে পালিয়েছিলাম। দেশ তো কাছে না! রাস্তাখান তো সোজা লম্বা না! শ্যামবাজার থেকে বাস। বাসে বারাসাত, আবার বাস। বাসে মহেশখালি। মহেশখালি থেকে ভটভটিতে পাক্কা দু-ঘণ্টা। তার পর ঘাট।

কেশবতীর কথার শেষ থাকে না— জানো তো বাবু, আমাদের দিকটা বড়ই দুর্গম অঞ্চল। শাকপাতা, বনআলু, খালে বিলে মাছ আর নদী ধরে যায় হাড়ি-পাতিলের নৌকা। আমার ওই একটা নেশা, নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে হাড়ি-পাতিলের নৌকা দেখা।

তবে কেশব তার মেয়েকে রেখে যাওয়ার সময় প্রিয়নাথকে সতর্ক করে দিয়ে গেছে—কেশবতী কারও কাঠকুটো সরায় না, তবে বদভ্যাস আছে।
—বদভ্যাস মানে!
—মানে নেশা।

প্রিয়নাথ ভেবেছিলেন, মেয়েটি কি বিড়ি-টিড়ি খায়। গাঁয়ের মেয়ে, খোলামেলা পরিবেশে মানুষ।
—কীসের নেশা?
—বনজঙ্গলের, নদীর পাড়ের। খোলা আকাশের।
—নেশা বলছ কেন?
—ওই তো যেখানে যে গাছ পায়, বাড়িতে তুলে এনে লাগিয়ে দেয়। পেয়ারা গাছের চারা, কুমড়োর চারা, দোপাটি ফুলের গাছ, লঙ্কা গাছ, যা পায় তাই লাগায়। কার গাছ কার বাড়ি থেকে চুরি করা গাছ, কোনওই প্রশ্ন করা যাবে না।

তিনি এক দিন প্রশ্ন না করে পারেননি।
—তুই গাছ চুরি করিস?
—চুরি করব কেন! গাছের চারা কি কারও বাপের? যে লাগায়, যে বড় করে, তারই গাছ।
—তা অবশ্য ঠিক।
মেয়েটির সঙ্গে কখনও তিনি কথায় পেরে উঠতেন না।
—আমার বাবার অবস্থাখান দ্যাখো বাবু, শহরে তার মন টেকে না।

বাপের তো এক কথা, কেশবতীর দোষ দিয়ে কী হবে! বাপের স্বভাবখানা দেখতে হবে না! সেও কি শহরে থাকতে পেরেছে? কেত্তনের গলাখানাই তার যত—
—তার যত কী?
—কেত্তনের গলাখানা তারে খেয়েছে। তা বাপ খোলে চাপড় মেরে যখন গায়, ও রাই নিশি যে পোহায়, শহরে কে বোঝে তার মর্ম!
নিশি যে পোহায়! খুবই দামি কথা। প্রিয়নাথ তখন ঝিম মেরে থাকতেন। কথা বলতেন না, শুধু মাথা ঝাঁকাতেন— নিশি যে পোহায়।

সে দিন সকালে উঠেই দেখেন প্রিয়নাথ, কেশবতীর ঘর খালি। কেশবতী বিছানায় নেই। গেল কোথায়। আজ তাঁর একটু বেলা হয়ে গেছে উঠতে। আকাশ ফর্সা। রোদ উঠে গেছে। প্রিয়নাথ দেখলেন সদর দরজা খোলা। কেশবতীর মন না টিকলে পালায়। সে কি পালাল! শত হলেও পরের মেয়ে, চিন্তা হয়। নিরুপমাকে ডেকে বললেন— শুনছ, কেশবতী দরজা খোলা রেখে কোথায় পালিয়েছে! পালাবে কোথায়! দ্যাখো খুঁজে এ দিক-ও দিক কোথাও গেছে। সদর ধরে বাইরে বের হয়ে এলেন প্রিয়নাথ— বুক ধড়াসধড়াস করছে। আর তখনই দেখলেন পাঁচিলের ঝোপ-জঙ্গলে কেশবতী উঁকি দিয়ে কী দেখছে।
—এই কেশবতী, দরজা খোলা রেখে বের হয়ে এলি! তুই কী রে!
কেশবতীর কোনও হুঁশ নেই।

একটা কলমিলতায় কলমিফুল। এসো না বাবু, দেখবে এসো। কলমিফুল কী সুন্দর না? বাড়িটার চার পাশে কিছু ঝোপজঙ্গল আছে, সামান্য এক খণ্ড জলাও আছে। সেখানে কলমিফুল আবিষ্কার করে কেশবতীর আনন্দের সীমা নেই। কলমিলতায় ফুল এয়েছে। কেশবতী ফুল দেখে কী খুশি।

কেশবতীই বটে। সারা পিঠ ছড়িয়ে কোঁকড়া চুল কোমরে নেমে গেছে। সে দিন ছাদে উঠে অবাক প্রিয়নাথ। ছাদে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে, নৈঋত কোণে মেঘ জমেছিল। চুলের খোঁপায় কলমিফুল গুঁজে দিলে মেয়েটা তার কাছে মেঘবতী হয়ে গেল। ঝড় উঠে গেছে, কিন্তু কিছুতেই ছাদ থেকে নেমে আসছে না।
—এই ছাদে দাঁড়াবি না। নেমে আয়।

কে কার কথা শোনে।
কী হাওয়া গো, নদী থেকে উঠে আসছে হাওয়া, বোঝো না! নদী তার গন্ধ নিয়ে হাওয়ায় হাজির। নদীরও মায়া আছে জানো! আমি যাই কী করে। ও নদীর ঘেরানই আলাদা। তুমি দাঁড়াও, ঠিক টের পাবে। আমি না থাকলে নদী যে বড় একা হয়ে যায়।

কলমিফুলের তো কোনও গন্ধ নেই, মেয়েটা হাওয়ায় তার নদীর খোঁজ পেয়ে গেল!

কেশবতী কই রে?
—যাই দাদাবাবু।

কেশবতী থাকতে থাকতে তিনি তার দাদাবাবু হয়ে গেলেন, আর নিরুপমা বউদিমণি। মেয়েটা দুপুরে ঘুমায় না। বাড়ির চার পাশে পাঁচিল তোলা, ঝোপজঙ্গলেরও শেষ নেই, সে ঘাসে জঙ্গলে বসে থাকলে বোধ হয় আরাম পায়।
—তুই কোথায়?
—কলপাড়ে, যাই দাদাবাবু।
—কলপাড়ে কী করছিস, তোর বউদিমণিকে চা দিলি না।
কেশবতী দৌড়ায়।

কলপাড়টা কী হয়ে আছে। বর্ষাকাল। ঝুপঝাপ বৃষ্টি নামে। ঝমঝম করে আকাশ মেঘলা হয়ে যায়। ঘোর অন্ধকারে কেশবতী জানালায় দাঁড়িয়ে থাকে। আর, কেন যে মনে হয় তার, জমি পরিষ্কার করে দুটো কুমড়োর চারা পুঁতে দিলে হয়? তার চোখ পাঁচিলের আনাচে-কানাচে ঘোরে। সে দেখে এঁটোকাঁটা ফেলার জায়গায় দুটো কুমড়োর চারা বর্ষার জলে লক লক করছে। সে ফাঁক খুঁজছিল—দাদাবাবু অফিসে, অরুণ বরুণ স্কুলে, বউদিমণি দিবানিদ্রা দিচ্ছে।

এই সুযোগ। সে চুপি চুপি খুরপি হাতে বের হয়ে আসছে।

আর দাদাবাবু এত সকাল সকাল বাড়ি ফিরবেন বুঝতে পারেনি। জিভ কেটে সে দৌড়াল। সে আঁচলে হাত মুছে এক লাফে রান্নাঘরে ঢুকে বাসন সরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। না হলে দাদাবাবু যে বকবেন, ঘরে তোর মন টেকে না, টো-টো করে ঘুরে বেড়াতে পারলে আর কিছু চাস না। এত ডাকলাম, কোনও সাড়া নেই তোর!

এক ফাঁকে কুমড়োর চারা পুঁতে দিয়েছে। মাটিতে লেগে গেলেই ডগা মেলাতে শুরু করবে। বাড়ির কেউ টেরই পেল না। সে বাজার করেও আনে।

লোকজনের সঙ্গে মিশতে শিখে গেছে।
—ও মাসি, আমাকে দুটো লঙ্কার চারা দেবে?
—কী করবি?
—বা রে! কত জমি আমাদের বাড়িতে। গাছ হলে লঙ্কা হয় তাও বুঝি জান না!

দাদাবাবুর এক অভিযোগ, তুই একদম ঘরে থাকতে চাস না কেশি। তোর যে কী হবে রে! তুই যে আর ছোট নেই রে কেশি, ঘরে না থাকলে চলবে! বাড়াবাড়ি করলে ঠ্যাং ভেঙে ফেলে রাখব, তখন বুঝবি।

থাকবে কী, খোলামেলা আকাশ যে তার প্রিয়। ঘরের মধ্যে কাঁহাতক বন্দি থাকা যায়।
—ও মাসি, আমাকে দুটো লঙ্কার চারা দেবে?
—কী করবি? রোজ ঘ্যানরঘ্যানর করিস।
—বা রে! গাছ হলে লঙ্কা হয়, তাও জানো না? গাছ হলে লঙ্কা হয় খবরটা সে ছাড়া আর কেউ যেন জানে না।
—এই কেশি নিরুপমা ডাকছে। সাড়া নেই, নিরুপমা বাইরে বের হয়ে দেখল পাঁচিল বরাবর ফাঁকা জায়গায় আবার একটা কী গাছ লাগাচ্ছে।
—কী করছিস?
—এই হয়ে গেল, যাচ্ছি।
—কটা বাজে জানিস?

তা অনেক বেলা। তার তো জমির আগাছা দেখতে ভাল লাগে না। সে যে বাড়িটায় নিজের মেলা জমি পেয়ে গেছে। কুমড়ো গাছ, লঙ্কা গাছ, কটা বেগুনের চারা পর্যন্ত পুঁতে দিয়েছে সে, তাও হাতের গুণ আছে। কে যে মাথার দিব্যি দিয়েছে সে তাও জানে না। তবে দাদাবাবু খেতে বসে এক দিন খুবই প্রশংসা করেছে তার।

তোর হাতে গুণ আছে রে, কেশি। কুমড়ো ফুলের বড়া খেতে খেতে দাদাবাবু এখন বলেছেন। তার পর বড় বড় কুমড়ো ধরল, গাছে লঙ্কা হল— দাদাবাবু দেখেন আর অবাক হন। সে কোত্থেকে দোপাটি ফুলের চারা নিয়ে এল এক দিন। কিছু রজনীগন্ধার মূল। এবং বছর শেষ না হতেই ফাঁকা জায়গাগুলি গাছে গাছে ভরে গেল। পেঁপে গাছ, আম-জামের চারা, লেবু গাছ, একটা আমলকির চারাও পুঁতে দিয়েছে, সঙ্গে দুটো আমের আঁটি, এখন কিছুটা গাছ হয়ে গেছে। এত ফাঁকা জমিন, শুধু আগাছা থাকবে, হয়!

হঠাৎ এক দিন বিকেলে সেই কেশবতী উধাও। গেল কোথায়! না বলে তো কোথাও যায় না। বড় রাস্তা, বাজার, ওদিকে হানাপাড়া পর্যন্ত চেনে, তার বেশি না।

সে বাজারের পয়সা বাঁচিয়ে এক বার একটা কাগজি লেবুর কলম কিনে এনেছিল। লোকটা তাকে চেনে। প্রিয়নাথবাবুর কাজের মেয়ে। কাজের মেয়ে কাগজি লেবুর কলম দিয়ে কি করবে? মনে তার সংশয় হতেই পারে।

এত বেলা হল, মেয়েটা ফিরছে না, দাদাবাবুর মাথা গরম। কেশবতীর গায়ে কি শহরের জল লেগে গেল! সে যদি পালায়! তা কেশবতীর মিষ্টি মুখখানি উঠতি ছোকরাদের মাথা ঘুরিয়ে যে দিতে পারে। আর বুদ্ধির দৌড়েও সে কম যায় না, তাকে জব্দ করা সহজ না, এই বিশ্বাসও আছে দাদাবাবুর।

—জানো দাদাবাবু, লোকটা ভাল না। লোকটাই তো দেরি করিয়ে দিল, কিছুতেই ছাড়ে না। কোন বাড়িতে থাকিস, কার বাড়ি, গন্ধরাজ ফুলের কলম দিয়ে কি হবে? আমিও ছেড়ে কথা কলুম না। আমার গাছ কোথায় লাগাব তাতে তোমার কি গো! জায়গা না থাকলে গাছ কেউ কেনে! গাছ না থাকলে বাড়ি হয়?

—জানো দাদাবাবু, লোকটা ভাল নয়। ফের সেই এক অভিযোগ।
—ভাল নয় কেন, তোকে কিছু বলেছে? তার পরই দাদাবাবুর কেমন মাথা গরম হয়ে যায়। —কোন লোকটা, চল তো। কী বলেছে, দেখি।
—ওই যে গাছের চারা নিয়ে বসে থাকে বাজারে।
—ওতো আমাদের সুজন। তিন নম্বর ক্যাম্পে থাকে। ওর মা আমাদের বাড়ি কাজ করত। লোকটা হবে কেন, ও তো সে দিনের ছেলে!
—তোমার কাছে ছেলে হতে পারে, আমার কাছে লোকটাই। লোকটা ভাল না।
—তোকে কি বলেছে, বলবি তো?

কী বলবে, ও আমাদের দেশে গেছে, নদী নালা চেনে। ভটভটিতে যেতে হয় তাও জানে। সাধুবাবার আশ্রমেও গেছে।

—দেশের খবর পেয়ে লেপ্টে গেলি, এত দেরি, আমাদের চিন্তা হয় না!
—লেপ্টে গ্যালাম কি গো, দেশের খবর পেলে কার না মন খারাপ হয় বল?
দাদাবাবু ছাড়বার পাত্র নন।—বল, লোকটা ভাল না কেন? তোকে কিছু বলেছে?
—বলল তো।
—কী বলল?
—তোমাকে বলা যাবে না। এর পর কী ভেবে মাথা নিচু করে বলল, নদী দেখতে চায়।
—কোথায়?
—জানি না। বলে ছুটে ভিতরে ঢুকে গেল সে।

নদীর কথায় মেয়েটা লজ্জায় শরমে মরে যাচ্ছিল। আবার আশ্চর্য এক মাধুরীতে মুখ তার উদ্ভাসিত। পলকে দেখা মুখটি সম্পূর্ণ এক নারীর।

শেষে সেই নদীর টানে মেয়েটা ভেসে গেল— এক সকালে প্রিয়নাথ দেখলেন, কেশবতীর ঘর খালি। তার শখের আলমারি আয়না, স্নো, পাউডার, কাচের চুড়ি সব পড়ে আছে। বাইরে থেকে তালা দিয়ে চাবিটা ভিতরে ফেলে রেখে গেছে। তবু এক বার খুঁজে দেখা দরকার। চেনাজানা সব জায়গায় গেলেন। সুজনের খোঁজেও গেলেন।

না, তাকে আর পাওয়া গেল না। সুজনের বয়সি এক ছোকরা পাড়ার চায়ের দোকানে বসে তাঁকে খবরটা দিল। সুজনকে কেশবতী নদী দেখাতে নিয়ে গেছে। তারা আর ফিরবে না। অচেনা এক নদীতীরে সন্ধ্যাতারার মতো কেশবতীকে বড় রহস্যময়ী মনে হয়েছিল প্রিয়নাথের। কারও দোষ নেই, বয়সের দোষ। নদীর খোঁজেই তো সারা জীবন মানুষ ঘোরাফেরা করে। পালায়। বেঁচে থাকে। যার নদী নেই সে বেঁচেও নেই।

তাঁর মন খারাপ। নিরুপমার মন আরও খারাপ।

মেয়েটা যে নিরুপমাকে বলেছিল, জানো বউদিমণি, গাছ না থাকলে বাড়ি, বাড়ি হয় না। তোমরা বাড়িটাকে ভালবাস, গাছ লাগলে বাড়িটাও তোমাদের ভালবাসবে। তার লাগানো গাছগুলোর দিকে তাকালে মন আরও খারাপ হয়ে যায়। গাছগুলি কত বড় হয়ে গেছে, অথচ মেয়েটা নেই, পালিয়েছে।

প্রিয়নাথ রাতে অফিস থেকে ফিরলে নিরুপমা কেমন জোর দিয়ে বলত, তুমি মন খারাপ করে বসে থেকো না। সে কোথাও থাকতে পারবে না। গাছের মায়ায় ঠিক চলে আসবে।

এলও ঠিক। অন্ধকার রাতে কড়া নাড়ল।
—তুই!

কেশবতীর কোলে একটি বাচ্চা। কেমন জরাজীর্ণ অবস্থা। আবছা অন্ধকারে দেখলেন, চোখ থেকে তার অশ্রুপাত হচ্ছে। অসহায় মেয়েটাকে একলা ফেলে সুজন কোথাও বোধ হয় পালিয়েছে। জীবন পরীক্ষিত না হলে সত্য প্রকাশ হয় না— বললেন, তোর কী দোষ। ভিতরে যা। কাঁদবার সময় মেলা পাবি। চানটান করে কিছু আগে মুখে দে।

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত