আজ ১২ জানুয়ারী সাংবাদিক ও কবি চঞ্চল আশরাফের শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার কবিকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।
জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ পড়ে প্রথমেই আমার মনে হয়েছিল, কথক অনেকের কাছেই শান্তি খুঁজেছে, অনেকেই তাকে সেটি দিয়েছে বা দেয়নি; কিন্তু বনলতা সেনের দেয়া শান্তির কথা তার স্মৃতিতে রয়ে গেছে। অনেকেই তাকে শান্তি দিয়ে থাকতে পারে; কিন্তু তার মনে ধরেছে বনলতা সেনের দেয়া শান্তি। ফলে তাকে সে ভুলতেই পারেনি। না-পারার কারণ, সম্ভবত, তার সৌন্দর্য। এই সৌন্দর্য চেহারায় সীমাবদ্ধ নয়। এর সঙ্গে রয়েছে মানুষ, রাজনীতি ও শিল্পকলার ইতিহাসের সম্পর্ক। তবে এর সুস্পষ্ট চিহ্নায়ন খুব কঠিন ও জটিল। ফলে তার রূপের যে বর্ণনা, তাতে রহস্যের পর রহস্য সৃষ্টি হয়ে চলে। বনলতা সেন নামটি উচ্চারণমাত্র তাকে যত পরিচিত মনে হয়, তার চেয়ে হাজার গুণ অচেনা, দুর্বোধ্য, দূরবর্তী ও অগম্য মনে হয়।
“চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ‘পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতোদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।”
বনলতা সেনের এই বর্ণনায় রয়েছে হাইপারবৌল বা অতিশয়োক্তি :চুলের গভীর কালোর সঙ্গে অন্ধকারের মিল কল্পনাযোগ্য; কিন্তু প্রাচীন ভারতের লুপ্ত নগরীর রাতের তুলনা স্বাভাবিক কল্পনার সীমা ছাড়িয়ে যায়। আমরা ইতিহাসের এমন একটা অধ্যায়ে প্রবেশের প্ররোচনা বোধ করি, যা চরিতার্থের কোনো সুযোগ বা উপায় নেই। অতিশয়োক্তির লক্ষ্য পাঠকের কল্পনার ওপর প্রভুত্ব বিস্তার করা; তার অভিজ্ঞতা, চিন্তা, জ্ঞান, ইন্দ্রিয়কে সক্রিয় করে তোলা; কিন্তু উচ্চাভিলাষী রোমান্টিকরা চান আরও বেশি :পাঠকের অনুভব, মনোযোগ আর কা জ্ঞানের জগৎকে বিস্রস্ত-বিপন্ন করার অভিপ্রায় থেকে তারা এমন সব তুলনা হাজির করেন, যা রীতিমতো আগ্রাসন হয়ে ওঠে। ‘মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য’- উচ্চারণ যতটা পাঠসুখকর, তার চেয়ে বেশি পাঠককে এলোমেলো ও বিপন্ন করে ফেলে। কেননা, শ্রাবস্তী বা তার কারুকার্য সম্পর্কে জানার উদ্যোগ নিয়ে তেমন কিছুই পাঠকের অধিকারে আসে না, যা দিয়ে সে ওই মুখের সঙ্গে তার অর্জিত ধারণাকে মিলিয়ে নিতে পারে। ফলে উচ্চারণটির ধ্বনি-শব্দগত প্রাথমিক ও তাৎক্ষণিক আনন্দ নিয়েই তাকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। কবিতার সঙ্গে পাঠকের এ ধরনের আপস রোমান্টিকরা চান; বেশি চান প্রতীকবাদীরা। অতিশয়োক্তি এভাবেই আপসের কাজটি করিয়ে নেয়। নইলে সেটি অতিশয়োক্তিই নয়, রোমান্টিকের তো নয়ই। ‘পাখির নীড়ের মতো চোখ’ কোনো সুস্থ ও কা জ্ঞানসম্পন্ন পাঠকের পক্ষে মেনে নেয়া কঠিন। কিন্তু কবিতাটি পড়তে পড়তে যে পাঠক শুরু থেকে আপস করে এসেছে, সে তো নিজের বুদ্ধি, চিন্তা ও যুক্তিশৃঙ্খলা থেকে সরে গেছে; ঢুকে পড়েছে কবিতাটির নিজস্ব নৈয়ায়িকতায়। এই নৈয়ায়িকতা নির্মিত হয়েছে অতিশয়োক্তির পর অতিশয়োক্তিতে এবং এতে বনলতা সেনের উত্তরণ ঘটেছে রক্ত-মাংসের নারী থেকে ট্রান্সেন্ডেন্টাল বা জগততিরিক্ত, বিমূর্ত, অধিবাস্তব সত্তায়। কবিতার শুরুতে যে ‘হাজার বছর ধরে’ হাঁটার উল্লেখ রয়েছে, তাও সম্ভব নয় স্বাভাবিক কিংবা কা জ্ঞানসম্পন্ন কারও পক্ষে মেনে নেয়া; কিন্তু রোমান্টিকের কল্পনার যে সার্বভৌমত্ব, তা পাঠকের কা জ্ঞানকে গ্রাস করতে চায়; করেও থাকে। বিশ্বস্ততার কোনো মানদ, চেনা পৃথিবীর কোনো ছক, সামাজিক রীতি-বিশ্বাস-সংস্কার সবই এখানে অর্থহীন। এ হলো একটা প্রতিপৃথিবী, যেখানে প্রবেশমাত্র আত্মসমর্পণ ছাড়া পাঠকের করার কিছু নেই। এই আত্মসমর্পণ ধাপে ধাপে ঘটে :প্রথমত, ধ্বনিবিস্তারে, যা পাঠককে প্ররোচিত করে আবৃত্তির মতো পড়তে; দ্বিতীয়ত, শব্দরাশির নিকট ও দূরের বিন্যাসে, যাতে একটা সাঙ্গীতিক বহির্স্বর তৈরি হয়ে যায়; তৃতীয়ত, চিত্রসৌন্দর্যে, যে অভিজ্ঞতা পাঠকের কাছে নতুন ও রহস্যময়; এ সবই এমন এক আবহ সৃষ্টি করে, যার সঙ্গে পাঠকের চেনা জগতের কোনো মিল নেই, কিন্তু এর প্রতি আকর্ষণ ইতিমধ্যে তৈরি হয়েছে; সম্পর্কও নেই, কিন্তু আপ ঘটে গেছে।