| 27 এপ্রিল 2024
Categories
এই দিনে গল্প সাহিত্য

শাড়ি

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

আজ ০৩ মার্চ কবি, কথাসাহিত্যিক ও সম্পাদক চন্দ্রাণী বসুর শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।


– হ্যালো মা, ডেলিভারি হয়েছে ?
– হ্যাঁ, এই তো সন্ধ্যেবেলা দিয়ে গেছে।
– পছন্দ হয়েছে ?
– এখনো খোলার সময় পাই নি রে, পুজো প্যান্ডেলে এত কাজ ছিল। আর তুইও এবার আসতে পারছিস না, আমার ভালোও লাগছে না।
– এই জন্য বলি একটা বয়ফ্রেন্ড জোটাও। কথা তো শুনবে না। “তোমায় কি সুন্দর লাগছে “… কথাটা শোনার মধ্যে বাঁচার ইচ্ছে থাকে। বুঝলে মাই সুইট মা ?
– এক থাপ্পড় খাবি। ফাজিল মেয়ে কোথাকার। হ্যাঁ রে কালও কি ছুটি দেয় নি তোর ? নিজের জামাকাপড় কিছু কিনেছিস ?
– হ্যাঁ , হ্যাঁ কিনেছি। কাল ছুটি। আমি আর স্যান্ডি বেরোবো এখানে। শোনো মা কাল অষ্টমী, শাড়িটা পরে ছবি পোষ্টিং চাই … আর এখন প্যাকেটটা খুলে দেখো। আমি পরে ফোন করে নেব তোমায়। কারণ এখন স্যান্ডি ফোন করবে …এক ঘন্টার আগে ফোন ছাড়বে না।
– আচ্ছা। বাবা আচ্ছা।
———-
মেয়ের পাঠানো প্যাকেটটা সন্ধ্যে নাগাদই দিয়ে গেছে কুরিয়র বয়। কিন্তু পুজোর মন্ডপে আজ একগাদা প্রতিযোগিতা ছিল, তার দায়িত্বে আবার সুলেখা। তাই তখন আর খুলে দেখবার সময় হয় নি। শোবার ঘরে রেখেই বেড়িয়ে গেছিল। ফ্রিজ থেকে খাবার বের করে গ্যাসে গরম করতে দিয়ে প্যাকেটটা নিয়ে এল পাশের ঘর থেকে। তিন- স্তর প্যাকেজিং ফুঁড়ে যখন শাড়িটা চোখের সামনে এল চলচ্চিত্রের ফ্ল্যাশব্যাকের মতো সাদা-কালো হয়ে গেলো মুহূর্তটা। ফোন করল রিম কে। ফোন বিজি।
ফ্ল্যাশব্যাকে বছর দশ আগের সাদা- কালো সময় ক্রমশ স্পষ্ট হতে লাগল সুলেখার।
রাসবিহারী ফর্টিস হসপিটালের সামনের ফুটপাত… অনীশ আর ওর হেঁটে যাওয়া বিকেল…সিগারেটের জন্য অনীশের বায়না…সুলেখার চোখ পাকানো…শাড়ির দোকান…
– ধুর ! তোমার ডাক্তার আসতে ঢের দেরী, চল একটু সামনের রাস্তাটায় হেঁটে আসি।
– বৃষ্টি আসবে কিন্তু মেঘ করেছে।
– একটু ভিজলে কি হবে ? বাইরে কি সুন্দর ভেজা হাওয়া। আজ কিন্তু একটা সিগারেট খাব… প্লিজ।
– উফফ। আবার !! অনি ??
– চল না বাইরে। খাই না তো সিগারেট। একটা তো।
– এই করেই বাড়াবে তুমি, আমি জানি।
– না রে বাবা, না ! কি হল ? চল হাঁটি ওদিকটায় একটু।
– শাড়িটা কি সুন্দর দেখো ওই দোকানে। সাদা-কালো-লাল তোমার ফেভারিট কম্বিনেশন।
– দেখেছি, আমারও চোখে লেগেছে। এখন একদম টাকা নেই, তুমি তো জানোই সব। সামনের মাসে কাজটা সেরে ফিরি, ঠিক কিনে দেবো তোমাকে।
– ধুর ! বাবা ! মুখটা অমন দুঃখী টাইপ করলে কেন ? আমি চেয়েছি নাকি ? আর আমি শাড়ী যেন কত পরি ? ওসবে আমার লোভ নেই তুমি জানো। আমার লোভ কিসে তাও জানো।
– না চাও না তো কিছুই, আমি কী জানিনা পাগলী তোমার লোভ কিসে ? সব জানি। কিন্তু পেট নামক যন্ত্র…
– জানো যখন, সেদিকেই মন দাও। শাড়িতে নয়।
– না, এটা কিনে দেব ঠিক, তোমায়, দেখো‌। কিছু টাকা হাতে এলেই…
পোড়া গন্ধে হুঁশ ফিরল সুলেখার, অনীশের গায়ের গন্ধটা মুহূর্তে সরে গেল। তাড়াতাড়ি উঠে গ্যাস নিভিয়ে দিল, তরকারিটা একদম পুড়ে গেছে।
শাড়িটা বুকে জড়িয়ে ধরতেই কতদিনের জমা কান্নায় ভিজে যেতে লাগল শাড়ির ভাঁজ। অনীশ হারিয়ে গেল। যার জীবনে সুলেখা একটাই চাঁদ ছিল, যাওয়ার দিন বলে গেছিল সুলেখা নাকি তার জীবনের গ্রহ। সেদিন কাঁদতেও পারে নি সুলেখা…
ফোন করল রিমকে আবার, ফোন সুইচ অফফ। রাত প্রায় একটা।
ভোর বেলা রিমের ফোন।
– শুভ অষ্টমী মা। শাড়িটা পরেছ ?
– রিম। তুই এটা কি করেছিস ?
– যা করেছি, বেশ করেছি। আধ ঘন্টার মধ্যে শাড়িটা পরে রেডি হয়ে হোয়াটস অ্যাপে ছবি দাও দেখি।
– এই শাড়ি আমি পরতে পারব না বাবু‌ … তুই তো জানিস।
– হ্যাঁ। জানি বলেই তো। সত্যি করে বল মা, একদিনও কি তুমি তাঁকে ছাড়া বেঁচেছ ?
– কিন্তু সে তো …
– হ্যাঁ। সে চলে গেছে। তুমি ? একদিনও পারো নি। আমি ছোটো ছিলাম না মা। প্রতিটা দিন আমি দেখেছি মা। তাকে তোমার চোখে।
– আমি তো তার জীবনে গ্রহ রিম। আমি এ শাড়ি কি করে পরি ? সেই তো একদিন এ শাড়িতে আমায় দেখতে চেয়েছিল, সব তো এলোমেলো হয়ে গেল।
– বেশ পরো না তবে। যতবার ওই দোকানের সামনে দিয়ে তুমি গেছ, আমি তোমার চোখে জল দেখেছি, মা। আমার খুব কষ্ট হত। কিছুই তো চাও নি তুমি তার কাছে। সে দেখতে চেয়েছিল, আর আমি ? আমি চাই নি মা ?
– রাগ করছিস কেন ?
– রাগ করছি না। সে দেখতে চেয়েছিল। সেটা ভেবেই না হয় একবার নিজেকে এই শাড়িতে দেখো। তার দেখানো পথ ছেড়ে আর তো কিছুই দেখো নি এতদিন। আজ না হয় সেই শাড়িতেই নিজেকে দেখলে। বিশেষ তফাৎ কি ?
– নিজেকে দেখব ?
– হ্যাঁ দেখবে। পর এখুনি, পর না মা, প্লিজ।
ফোনটা রেখে সুলেখা শাড়িটা পরে। এখনো অনীশের গন্ধটাও ভোলে নি সে। কি স্পষ্ট। জড়িয়ে থাকা শাড়ির প্রতিটা ভাঁজে এখনো অনীশকেই….
ডোর বেল বাজল। কে আবার এই সাত সকালে ? কাজের মেয়ের তো ছুটি …
– আরে ! রিম ! তুই ? বলিস নি তো !
– সারপ্রাইজ !
মা আর মেয়ের চিবুক আর বুক ভিজছে। ওদিকে ঢাকের আওয়াজ আর মাইকে প্রথম দফা অঞ্জলী শুরু….
নমঃ মহিষগ্নি মহামায়ে চামুন্ডে মুন্ডমালিনি আয়ুরারোগ্য বিজয়ং দেহি দেবী নমোস্তুতে …

 

 

কৃতজ্ঞতা: মায়াজম

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত