| 27 এপ্রিল 2024
Categories
খেলাধুলা ফুটবল সাক্ষাৎকার

চুনী গোস্বামীর সঙ্গে কিছুক্ষণ

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

ক্রিকেট তাঁর প্রিয় খেলা। জীবন ফুটবল। মোহনবাগান তাঁর দেশ। ক্লাবের জন্য ছাড়তে পেরেছেন বিদেশে খেলার সুযোগ। তাঁর খেদ আছে। আক্ষেপ নেই। চুনী গোস্বামীর সাথে কথা বলেছিলেন  স্যমন্তক ঘোষ। আড্ডাটি ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬ তে প্রকাশিত হয়েছিল এবেলায়। চুনী গোস্বামীর প্রয়াণে সেই আড্ডাটি ইরাবতীতে পুনঃপ্রকাশ করা হলো।


 

ফ্লাডলাইটের আলোয় ঝলমলে চারদিক। খুদে খেলোয়াড়ের দল আপ্রাণ যুদ্ধ চালাচ্ছে র‌্যাকেটের ওজনের সঙ্গে।আরেকটু দূরে ক্লে-কোর্টে অনুশীলনরতা তরুণী। কঠোর অনুশীলন। কে বলতে পারেন, আগামী কয়েকবছরে তিনিই হয়ে উঠবেন না পরবর্তী সানিয়া মির্জা?
ঘড়িতে সন্ধে ৭টা বাজতে ৫। মূল ফটকে তাঁর নাম বলতেই ক্যালকাটা সাউথ ক্লাবের নিরাপত্তারক্ষী সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন সাংবাদিককে। বারান্দা ধরে খানিক এগনোর পর বাঁ-হাতে দরজা। ক্লাবের বার। রকমারি পানীয়ের কাউন্টারের উল্টোদিকে এক কাপ চা নিয়ে টেলিভিশনের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে তিনি। সাংবাদিককে দেখেই দ্বিতীয় কাপ চায়ের অর্ডার। চোখ মুহূর্তের মধ্যে ঘুরে গেল টেলিভিশনে। ১৫ মিনিট সময় নেব কিন্তু। নিউজটা দেখে নিয়ে আড্ডায় ঢুকব।’’ পায়ের উপর পা তুলে বসলেন প্রবাদপ্রতিম ফুটবলার চুনী গোস্বামী। এখনও দূরদর্শনের খবরে তাঁর আস্থা। খুব কাজ না-থাকলে সন্ধে ৭টার বুলেটিন মিস করেন না। খবর দেখতে দেখতে মাঝে মাঝে উত্তেজিতও হয়ে পড়ছিলেন। পাশে বসা বন্ধুর দিকে ছুড়ে দিচ্ছিলেন টিপ্পনী। খবর শেষ করে চা-সহ আড্ডা পৌঁছল বাইরের লনে। কোর্টের চেহারা বদলায়নি। খুদে ক্রীড়াবিদেরা তখনও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। অনুশীলন চালিয়ে যাচ্ছেন সেই তরুণীও। ফ্লাডলাইটের আলোয় ঘামে ভেজা শরীর চকচক করছে। 
গোড়ায় গলদ। অঙ্কে ডিগবাজি— ৭৯কে ৮৯ বললে চটে যাওয়াই স্বাভাবিক। চটে গেলেন চুনী। প্রশ্ন ছিল, প্রায় ৯০-এ পৌঁছে নিজেকে এতটা ফিট রেখেছেন কীভাবে? ফুটবলার দ্বিতীয়বার সুযোগ দিলেন। অঙ্ক বদলালো না। এবং তিনি যারপরনাই অসন্তুষ্ট হলেন।
রাগ করাই স্বাভাবিক ! বয়স ১০ বছর বাড়িয়ে দিলে কে-ই বা খুশি হন? চুনীও ব্যতিক্রম নন। ধমক খেতে হল ভরপুর। এবং সেই সুযোগে ঢুকে পড়া গেল ফুটবলারের ছেলেবয়সের গল্পে। এবং দ্বিতীয়বার ধমক খাওয়ার সতর্কতা নিয়ে প্রশ্ন করতে হল, তাঁর জন্ম কোথায়? এপারে, না ওপারে? আড্ডার আগে তাঁকে নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে চোখে পড়েছিল বিষয়টি। কখনও তিনি কলকাতায় জন্মানোর কথা বলেছেন। কখনও আবার ওপার বাংলায়। রহস্যটা কী?

এবার আর ধমক নয়। বরং হেসে ফেললেন চুনী। বললেন, ‘‘সে একটা লিখে দিলেই হল! সে আবার কী? এত রহস্য কেন?
শেষপর্যন্ত চুনী অবশ্য স্বীকার করলেন, বাংলাদেশেই তাঁর জন্ম। তবে বেশিদিন থাকেননি। ১৯৪৬ সালে এপারে চলে এসেছেন। তবু রহস্যটা স্পষ্ট হচ্ছিল না। হল আড্ডার একেবারে অন্তিমে। চুনী যখন মোহনবাগানের কথা বলছেন। যখন বলছেন, মোহনবাগান ছেড়ে আর কোথাও কোনওদিন যেতে ইচ্ছে করেনি। পয়সার জন্য খেলেননি কখনও। ক্লাবের কাছ থেকে খেলার জন্য এক পয়সাও নিতেন না। তাই বেশি টাকার লোভে কখনও ক্লাব বদলাতে হয়নি। ক্লাবকে এতটাই ভালবাসতেন যে, ইংল্যান্ডে যাওয়ার সুযোগ পেয়েও যাননি। থেকে গিয়েছিলেন মোহনবাগানেই। সেই মোহনবাগান— ময়দানের ফুটবলপাগলদের কাছে যার অর্থ, ঘটির ক্লাব। ওপার বাংলার জন্মবৃত্তান্ত কি সেইজন্যই প্রকাশ্যে আনেন না চুনী? পাছে বাঙাল প্রমাণিত হয়ে যান !
ক্লাবের কথা বলতে বলতে সামান্য ভিজে এসেছিল তাঁর গলা। আবেগ-ভালবাসার রঙে রঙিন হয়ে উঠেছিল মুখ। প্রশ্ন শুনে আবার চেনা হাসিটা ফিরিয়ে আনলেন। মানলেন, আবার মানলেনও না। উত্তর হাওয়ায় ভাসিয়ে রাখলেন। আপাদমস্তক মোহনবাগানি নিজেকে বাঙাল বলতে পছন্দ করেন না। শুধু তাই নয়, প্রসঙ্গ উঠতেই সরাসরি গোষ্ঠ পালকে টেনে আনলেন। বললেন, উনিও ওপার বাংলার মানুষ। কিন্তু টানটান মোহনবাগানি। মোহনবাগান সবসময়ই ভাল ফুটবলারদের বেছে নিয়েছে। এপার-ওপার ভাগ করেনি। সত্যি বলতে কী, যে সময়ের কথা তিনি বলছেন, সেই সময় এপার-ওপার ভাগ করা সম্ভবও ছিল না। দেশটাই তো ভাগ হয়নি তখনও !
চুনী গোষ্ঠ পালের কথা বললেন। বাংলা ফুটবলের স্বর্ণযুগ সেটা। তাঁর সময়েও বাংলার ফুটবলে কম সোনা ছিল না। মোহনবাগান জুনিয়র থেকে সিনিয়র টিমে যখন তিনি ঢুকলেন, ময়দানে তখন নামের ছড়াছড়ি। পি কে-চুনী-বলরামদের রাজত্ব। তাঁর আগের প্রজন্মে ময়দান দাপিয়েছেন শৈলেন মান্নারা। পরের প্রজন্মে এসেছেন নঈমেরা। পি কে-চুনীরা এশিয়ান গেমসে সোনা এনে দিয়েছেন দেশকে। রুপো জিতেছেন। অলিম্পিক্সে পৌঁছে দিয়েছেন ভারতীয় ফুটবলকে। হঠাৎ কী হল? কোথায় হারিয়ে গেল সেই ফুটবল? গ্রামে গ্রামে ছেলেরা কি ফুটবল খেলা বন্ধ করে দিয়েছে?

আক্ষেপ। শুধুই আক্ষেপ ঝরছে ফুটবলারের কণ্ঠে। বলছেন, বিশ্বকাপেও যেতে পারতাম আমরা। ’৬২ সালে সেই সুযোগও তৈরি হয়েছিল। দক্ষিণ কোরিয়াকে হারিয়ে তাঁরাই তখন এশিয়ার এক নম্বর দল। অথচ ফুটবল কর্তারা তাঁদের বিশ্বকাপে পাঠানোর ব্যবস্থাই করে উঠতে পারেনি। চুনী বলছেন, এটা শুধু দুঃখের নয়, হতাশারও। সামান্যতম দূরদর্শিতা ছিল না তাঁদের। 
সে সময় ভারত বিশ্বকাপে গেলে এখন হয়তো ফুটবলের চেহারাটাই অন্যরকম হতো ! ফুটবলের জন্য আরও উন্নত পরিকাঠামো পাওয়া যেত। গ্রামে গ্রামে ছেলেদের খুঁজে বার করে উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হতো। চুনী মানছেন। মানছেন, এ দেশে ফুটবল নিয়ে পাগলামো থাকলেও গরিব ঘরের ছেলেদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকাঠামো ঠিকমতো গড়ে ওঠেনি। আরও বেশি অ্যাকাডেমি দরকার। ফুটবলার তৈরির পেশাদার মানসিকতাটাই ঠিকমতো তৈরি হয়নি। কারণ, সেই এক্সপোজারটাই নেই।

তিনি তো এক্সপোজার পেয়েছিলেন! সুযোগ পেয়েছিলেন ইংল্যান্ডের প্রথম শ্রেণির ক্লাবে গিয়ে ফুটবল খেলার। রাজি হননি। কেউ কেউ বলেন, চুনী নাকি বুঝতেই পারেননি যে, কত বড় ক্লাবে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন ! তাই গুরুত্ব দেননি। চুনী একেবারে অস্বীকার করলেন না কথাটা। তবে একইসঙ্গে জানিয়ে দিলেন, যাননি বলে কোনও আফসোস নেই। তিনি বাংলাতেই থাকতে চেয়েছিলেন। মোহনবাগানেই। কারণ, ওটাই তাঁর কাছে ফুটবলের স্বর্গ।
তবে তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের অভিযোগ, চুনীকে দ্রোণাচার্য হিসেবে পাওয়া গেলে ভাল হতো। কিন্তু তিনি কোচিংয়ে সময় দেননি। চাইলে তো তিনি ভাল কোচ হতেই পারতেন ! অনেকেই জানেন না, সেই প্রশিক্ষণও তাঁর ছিল। চুনী ফিফার ট্রেনিংপ্রাপ্ত ফার্স্টক্লাস কোচ। 
চুনী বলছেন, কোচিংয়ে কোনওদিন আগ্রহ পাননি তিনি। ফুটবল ছাড়ার পর ক্রিকেটে মনোযোগ দিয়েছিলেন। তাই কোচিংয়ের সময়ও পাননি। তবু কোচিংয়ের ট্রেনিং নিয়েছিলেন। কারণ, মাঠের বাইরে থেকে ফুটবল খেলার টেকনিক্যাল বিষয়গুলো জানতে ইচ্ছে হয়েছিল। পরবর্তীকালে ফুটবলের কলাম লিখতে যা সাহায্য করেছে।
ক্রিকেটের কথা উঠল। অমোঘ প্রশ্নটাও চলে এল গায়ে গায়ে। ক্রিকেট খেললে কি আরও সফল খেলোয়াড় হতে পারতেন চুনী গোস্বামী? শুধু বাংলা নয়, শুধু দেশ নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খ্যাতি অর্জন করা সহজ হতো?
চুনী বলছেন, গড়ে ছ’টা দেশ যে খেলাটা নিয়ে লাফালাফি করে, তার চেয়ে ফুটবলের আমেজ অনেক বেশি। ক্রিকেটকে তিনি ছোট করছেন না। ক্রিকেট খেলতে তিনি ভালবাসেন। তবে ফুটবল অন্যরকম ব্যাপার। দু’য়ের মধ্যে তুলনা চলে না। এবং নিজেকে একজন ফুটবলার বলতেই তিনি গর্ববোধ করেন। এই খেলাটার জন্যই তো একসময় বিস্তর ধমক খেয়েছেন বাড়িতে ! মধ্যবিত্ত বাবা চিরকালই চেয়েছিলেন যে, পড়াশোনা করে, স্নাতক হয়ে ভাল চাকরি করুক ছেলে। খেলা নিয়ে বকাঝকাও করতেন। তবু পালিয়ে পালিয়ে খেলে বেড়াতেন চুনী। মায়ের প্রশ্রয়ে। এশিয়ান গেমসে সোনা জেতার পর অবশ্য বাবা বলেছিলেন— ‘‘চুনী মুখ উজ্জ্বল করেছে !’’
ওই দিনগুলোই সম্পদ। ওই দিনগুলোকে সম্বল করেই এখনও নিজেকে ফিট রেখেছেন চুনী। 

ঘণ্টাখানেক গড়িয়ে গিয়েছে আড্ডা। পাশের টেবিলে বসে বন্ধুরা উসখুস করছেন। চুনীও। এবার তাঁদের আড্ডা শুরু হবে। দূরে ক্লে-কোর্টে তখনও একইভাবে প্রশিক্ষণ চালিয়ে যাচ্ছেন ওই তরুণী। সেদিকে দৃষ্টি রেখে অলিম্পিক্সে দেশের প্রতিনিধিত্ব করা কতটা গর্বের, সে গল্প শোনাচ্ছিলেন চুনী। কত বাধা অতিক্রম করে ওই পর্যায়ে পৌঁছতে হয়, বলছিলেন সে কথা। বলছিলেন, ফুটবল কর্তাদের হতবুদ্ধির কথা। 
হয়তো এই মেয়েটিও কোনওদিন সেসব বলার সুযোগ পাবেন। হয়তো সিন্ধু, দীপা, সাক্ষীর মতো তিনিও সবচেয়ে বড় খেলার মঞ্চ জয় করে ফিরবেন। দেশ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করবে। এবং বরাবরের মতো হয়তো তখনও অবহেলিত থেকে যাবে পরিকাঠামোর দিকটা ! যুগে যুগে চুনী গোস্বামীদের একই বঞ্চনার কথা বলে যেতে হবে হয়তো !চেয়ার ঠেললেন ফুটবলার। পাশের টেবিলে যেতে যেতে শেষ ইচ্ছের কথাটা বললেন।

মৃত্যুর পর দেশ আর ক্লাবের পতাকাটা যেন তাঁর মরদেহের উপর রাখা হয়।

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত