Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

নারী পুরুষের মিলন কাহিনী (পর্ব-১০)

Reading Time: 4 minutes

বিবাহ  মানব সমাজের প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান। যুগে যুগে প্রতিষ্ঠানটি এর আদি রূপ থেকে বর্তমান কাঠামোয় উপনীত হয়েছে। বিবাহপ্রথাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে প্রধানত ধর্ম। বিয়েসংক্রান্ত সকল নিয়মকানুন বিধিবদ্ধ হয়েছে ধর্মীয় অনুশাসনে। প্রাচীনকাল থেকে বাংলায় ধর্মীয় শাস্ত্রের বিধানই ছিল সামাজিক আইন, ধর্মীয় আইনের দ্বারাই শাসিত হতো সমাজ-সংসার। ধর্মীয় এবং রাষ্ট্রীয় আইনের পাশাপাশি লোকজ সংস্কৃতিও বৈবাহিক জীবনকে প্রভাবিত করেছে নানাভাবে। মনুস্মৃতি এবং অর্থশাস্ত্রে আট প্রকারের হিন্দু-বিবাহ পদ্ধতির উল্লেখ আছে। ‘ব্রাহ্ম’, ‘দৈব’, ‘আর্য’, ‘প্রজাপত্য’, ‘অসুর’, ‘রাক্ষস’, ‘পৈশাচ’ ও ‘গান্ধর্ব’ এই আট ধরনের বিবাহের মধ্যে ব্রাহ্ম বিবাহই শুধু গ্রহণযোগ্য ছিল। দায়ভাগ গ্রন্থে জীমূতবাহন উল্লেখ করেছেন যে, ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, প্রজাপত্য এবং গান্ধর্ব বিবাহ অনিন্দনীয়। ধর্মশাস্ত্রের বিধান অনুযায়ী নিজ বর্ণের মধ্যে বিবাহ ছিল সাধারণ নিয়ম। সবর্ণে বিবাহ উৎকৃষ্ট হলেও মনু ব্রাহ্মণ পুরুষকে নিজ বর্ণ ছাড়া নিম্নতর তিন বর্ণে বিবাহের অধিকার দিয়েছিলেন। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে, যেমন চন্ডীমঙ্গলে, মুসলমানদের নিকা বিবাহের কথা বলা হয়েছে। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, এমনকি বিশ শতকেও মুসলমানদের মধ্যে বহুবিবাহ ব্যাপক হারে প্রচলিত ছিল। উচ্চশ্রেণীর অবস্থাপন্ন মুসলমানদের একাধিক স্ত্রী থাকত। বিশ শতকের শুরুতে কুলীনদের বাইরে হিন্দু সমাজে বহুবিবাহ তেমন প্রচলিত ছিল না। বিয়ের এমন অনেক জানা অজানা বিষয়ে আলো ফেলেছেন ড. রোহিণী ধর্মপাল তাঁর এই ধারাবাহিক ‘নারী-পুরুষের মিলন কাহিনী’-তে। আজ থাকছে নারী-পুরুষের মিলন কাহিনীর ১০ম পর্ব।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com
শুক্রাচার্য্য যযাতিকে কি অভিশাপ দিয়েছিলেন এবং তার পরিণাম কি হয়েছিল, সেই গল্প আমরা আগেই জেনেছি। এখানে বিশেষ করে বলার বিষয়টি হল শুক্রাচার্য্যের কাছে যযাতি কিভাবে নিজেকে defend করছিলেন । তিনি শুক্রাচার্য্যের সামনে দক্ষ উকিলের মত self defence এ একাধিক point তুলে ধরলেন । প্রথমত যযাতির কাছে কেউ কিছু চাইলে তিনি সেই যাচককে ফেরান না, শর্মিষ্ঠা তাঁর কাছে দৈহিক মিলন যাচনা করেছিলেন  । এটা একটা point। শুক্রাচার্য্য দেবযানীর সঙ্গে শর্মিষ্ঠাকেও যযাতির কাছেই দিয়েছিলেন ( সঙ্গের সাবধানবাণীর উল্লেখ অবশ্য যযাতি আর করেন নি!), সুতরাং এক অর্থে শর্মিষ্ঠা তো তাঁরই, শর্মিষ্ঠাও বা অন্য কাউকে বরণ করেন কি করে!!! এইটে দ্বিতীয় । আর সবচেয়ে জোরালো point, যে কথা বারবার আমাদের মহাকাব্যে, পুরাণে উঠে এসেছে, তা হল নারীর কামেচ্ছা এবং তা পূরণ করার বিষয়টি । এখানেও যযাতির মুখে মহাভারতকার সেই কথাটিই আবার বলালেন। 
ঋতুং বৈ যাচমানায়া ন দদাতি পুমানৃতুম্।
ভ্রূণহেত্যুচ্যতে ব্রহ্মণ্! স ইহ ব্রহ্মবাদিভিঃ।।
হে মহর্ষি, যে পুরুষ ঋতু সফল করার প্রার্থনা নিয়ে আসা নারীর ঋতুরক্ষা না করে, তাকে বেদবাদী ঋষিরা ভ্রূণহত্যাকারী বলেন। 
অভিকামাং স্ত্রীয়ং যশ্চ গম্যাং রহসি যাচিতঃ। 
নোপৈতি স চ ধর্মেষু ভ্রূণহেত্যুচ্যতে বুধৈঃ।।
অর্থাৎ,  যে পুরুষ নির্জনে শরীরী মিলনের জন্য প্রার্থিত হয়েও, সেই মিলনের জন্য অত্যন্ত কামুকী নারীর সেই প্রার্থনা পূরণ না করে, তাকেও ভ্রূণ হত্যার পাতকী বলে গণ্য করা হয় ।
এখানে এই “অত্যন্ত কামুকী” শব্দবন্ধটি সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ । বহু যুগ ধরেই এ কথা সমাজ মেয়েদের মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে, যে মেয়েদের যৌন আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করাই অপরাধ । যেভাবে যুগের পর যুগ ধরে মেয়েদের বৈধব্য পালনের নাম করে তাদের উপর যা যা অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হল যৌনতার অবদমন। এমনকী স্বামী মারা যাওয়ার পর চুল কেটে নেওয়া, সমস্ত সাজগোজ বন্ধ করে একটা সাদা শাড়ি পরিয়ে দেওয়ার মূলেও সমাজের এই বিকৃত চিন্তাই কাজ করেছে। কেশবতী সাজুনে কন্যার যৌবনের জ্বালা আরোও বেশি হবে। তাই দে মুড়িয়ে মাথা, টেনে ফেলে দে রঙিন বেশভূষা, ভেঙে ফেলে দে সব গয়নাগাঁটি । আর হ্যাঁ, প্রোটিন জাতীয় সব খাদ্যে বন্ধ কর। মাছ মাংস মসুর ডাল পেঁয়াজ রশুন এমনকী অনেকে লাল নটে পর্যন্ত খেতেন না, লাল রঙ দেখলে  যদি লাল পরার ইচ্ছে জাগে! একটা সত্তাকে ডলে দুমড়ে মুচড়ে কীভাবে তিলে তিলে মারতে হয়, তার জলজ্যান্ত উদাহরণ হয়ে উঠেছিল আমাদের সমাজ। সাধে কী বিদ্যাসাগরকে মেয়েদের ঈশ্বর বলা হয়!!!!  কাশীর বিধবাপুরীর কথা নিশ্চয়ই জানেন। কত শত বালবিধবাকে কাশীতে এনে মাসান্তে সামান্য কিছু অর্থসাহায্যের বিনিময়ে ফেলে যেত তাদের বাড়ির লোক। তারপরে বেশ্যাবৃত্তি আর ভ্রূণহত্যা অথবা আত্মহত্যা ছাড়া আর কী বা উপায় থাকত সেই সমাজখেদানো মেয়েগুলো! এর চেয়ে বোধহয় সত্যি আগুনে পুড়িয়ে মরা সহজ ছিল!!!  এখনও কি খুব বেরোতে পেরেছে মেয়েরা সেই সঙ্কীর্ণ চিন্তাধারা থেকে!!!  ছেলেদের তো কথাই নেই!! আমি নিজে বহু মেয়ে, বিশেষ করে বিবাহিত, মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়েদের থেকে জেনেছি, তাদের যৌন ইচ্ছে বলে কিছু আছে, তা তাদের পতিদেবতারা জানতেও চান না। সেই সিনেমাটা দেখেছেন তো? Lipstick under my burkha!!! সেখানে কঙ্কণা অভিনীত মুসলিম মেয়েটিকে মনে করুন । তার স্বামীর যখন শরীরী মিলনের ইচ্ছে জাগ্রত হত, মেয়েটিকে শুইয়ে তার পাজামার দড়ি খুলে শিশ্নটি স্রেফ ঢুকিয়ে দিত। এ যে কতখানি মনের অপমানের সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক যন্ত্রণা, তা একমাত্র মেয়েরাই জানে । এই গল্প ঘরে ঘরে। কয়েকজন আমাকে এমনও বলেছে, যে ছি, মেয়েদের আবার ওইসব ইচ্ছের কথা বলতে আছে নাকি!!!! তবে স্বামীর ইচ্ছে হলে চরম ক্লান্ত অবস্থাতেও মেলে ধরতে হয় শরীর, স্বামীর কামনা মেটাতেই তো আছে স্ত্রীরা। আমাদের দেশে সত্যিই বহু মেয়েকে বিছানায় স্রেফ ডাস্টবিনের মত ব্যবহার করা হয়! তার বিশেষ ভালো লাগা, আদর পাওয়ার ইচ্ছে, বা শরীরী মিলনের অনিচ্ছের কোনো দাম নেই!!! 
কিন্তু আমরা বলতাম। মানে মেয়েরা বলত। আমাদের পূর্বনারীরা বলতেন। বলতেন বলেই “অত্যন্ত কামুকী নারী” কথাটা লিখতে মহাভারতের রচয়িতার কোনো সমস্যা হয় নি। যদিও এতসব বলেও যযাতি অভিশাপ এড়াতে পারেন নি, তবে তা থেকে মুক্তির উপায় পেয়েছিলেন এবং ছেলের থেকে যৌবন ধার নিয়ে আরোও দেদার যাকে বলে মস্ত্ জীবন কাটিয়েছেন। এত কিছুর পরেও তাঁর আবার নতুন নারীসঙ্গ দরকার হল। তিনি স্বর্গের অপ্সরা ঘৃতাচীর সঙ্গে নন্দনবনে অলকানগরীতে উত্তর মেরুশৃঙ্গে বিহার করে বেড়ালেন! একবার দেবযানীর কথাটা ভাবুন, প্রথম প্রেমে প্রত্যাখ্যান । কী নিষ্ঠুর প্রত্যাখ্যান । কচ তো পুরোটাই পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করেছেন, তাই কখনোই ভালোবাসেন নি তিনি দেবযানীকে, পুরোটাই একটা অভিনয় ছিল। দ্বিতীয় যে পুরুষটিকে ভরসা করলেন, তিনি সেই ভরসা শুধু ভাঙলেন না, তাঁকে চরম অপমানের যন্ত্রণা দিলেন। দেবযানী যখন শর্মিষ্ঠার সঙ্গে যযাতির সম্পর্ক জানলেন এবং বুঝলেন তাঁর থেকেও শর্মিষ্ঠাই তাঁর বেশি আদরের, তখন কতটা ধাক্কা খেয়েছিলেন দেবযানী!!!! 
দেবযানীর কাহিনী থেকে আসব মহাভারতের আরেকটি পুরুষ চরিত্রে। যেমন সত্যবতীকে ঘিরে তৈরি হয়েছিল নানা ধরণের মিলন কাহিনী, তেমনই অর্জুনকে ঘিরেও বা বলা ভালো কেন্দ্রে রেখে নানা মিলন কাহিনী রচনা করেছেন ব্যাসদেব। সেখানেও প্রেম বিরহ কাম থেকে অপহরণ পর্যন্ত সব মশলাই উপস্থিত । এই যে যৌন মিলনের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আসা নারীকে ফেরানো যায় না, বা উল্টো দিক থেকে বললে মেয়েরাও কামেচ্ছুক হয়ে পুরুষের কাছে এসে মিলন চায়; তার একটা বড় উদাহরণ অর্জুন আর উলুপীর মিলন। হ্যাঁ, অর্জুন আর দ্রৌপদীর কথাও আসবে বইকী । কিন্তু একটু অন্য দৃষ্টিতে। তবে আগে অর্জুন-উলুপী-কথা হোক ।
.
.

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>