| 26 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক লোকসংস্কৃতি

নারী পুরুষের মিলন কাহিনী (পর্ব-২৩)

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

বিবাহ  মানব সমাজের প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান। যুগে যুগে প্রতিষ্ঠানটি এর আদি রূপ থেকে বর্তমান কাঠামোয় উপনীত হয়েছে। বিবাহপ্রথাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে প্রধানত ধর্ম। বিয়েসংক্রান্ত সকল নিয়মকানুন বিধিবদ্ধ হয়েছে ধর্মীয় অনুশাসনে। প্রাচীনকাল থেকে বাংলায় ধর্মীয় শাস্ত্রের বিধানই ছিল সামাজিক আইন, ধর্মীয় আইনের দ্বারাই শাসিত হতো সমাজ-সংসার। ধর্মীয় এবং রাষ্ট্রীয় আইনের পাশাপাশি লোকজ সংস্কৃতিও বৈবাহিক জীবনকে প্রভাবিত করেছে নানাভাবে। মনুস্মৃতি এবং অর্থশাস্ত্রে আট প্রকারের হিন্দু-বিবাহ পদ্ধতির উল্লেখ আছে। ‘ব্রাহ্ম’, ‘দৈব’, ‘আর্য’, ‘প্রজাপত্য’, ‘অসুর’, ‘রাক্ষস’, ‘পৈশাচ’ ও ‘গান্ধর্ব’ এই আট ধরনের বিবাহের মধ্যে ব্রাহ্ম বিবাহই শুধু গ্রহণযোগ্য ছিল। দায়ভাগ গ্রন্থে জীমূতবাহন উল্লেখ করেছেন যে, ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, প্রজাপত্য এবং গান্ধর্ব বিবাহ অনিন্দনীয়। ধর্মশাস্ত্রের বিধান অনুযায়ী নিজ বর্ণের মধ্যে বিবাহ ছিল সাধারণ নিয়ম। সবর্ণে বিবাহ উৎকৃষ্ট হলেও মনু ব্রাহ্মণ পুরুষকে নিজ বর্ণ ছাড়া নিম্নতর তিন বর্ণে বিবাহের অধিকার দিয়েছিলেন। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে, যেমন চন্ডীমঙ্গলে, মুসলমানদের নিকা বিবাহের কথা বলা হয়েছে। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, এমনকি বিশ শতকেও মুসলমানদের মধ্যে বহুবিবাহ ব্যাপক হারে প্রচলিত ছিল। উচ্চশ্রেণীর অবস্থাপন্ন মুসলমানদের একাধিক স্ত্রী থাকত। বিশ শতকের শুরুতে কুলীনদের বাইরে হিন্দু সমাজে বহুবিবাহ তেমন প্রচলিত ছিল না। বিয়ের এমন অনেক জানা অজানা বিষয়ে আলো ফেলেছেন ড. রোহিণী ধর্মপাল তাঁর এই ধারাবাহিক ‘নারী-পুরুষের মিলন কাহিনী’-তে। আজ থাকছে নারী-পুরুষের মিলন কাহিনীর ২৩পর্ব।


রামায়ণ প্রকৃতপক্ষে সমাপ্ত বলে ধরা হয়, লঙ্কাযুদ্ধের শেষে, রাম সীতা ও লক্ষ্মণের অযোধ্যায় ফিরে আসা এবং রাম-সীতার অযোধ্যার রাজা-রাণী হওয়ার পরেই। যেভাবে যুদ্ধ কাণ্ডের শেষে এই মহাকাব্য শুনলে কি কি ফল লাভ হয়, তা বলা আছে; তাতে মনে হয় এইই শেষ। আর তাই ধরে নিলে বহু বিতর্কিত অংশ চাপাই পড়ে যায়। তবে যেহেতু এর পরের অংশ প্রক্ষিপ্ত অর্থাৎ পরবর্তী সংযোজন ধরে নিলেও তার গুরুত্ব ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতিতে প্রবল, তাই আমরাও সেই অংশটিকে নিয়ে আলোচনায় ঢুকব। বিশেষ করে যেহেতু এই উত্তর কাণ্ডেই আছে সীতার নির্বাসন, অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায়।
দিব্যি ছিলেন কিন্তু রাম সীতা অযোধ্যায় ফিরে। সেই আগের প্রেমের দিনগুলো যেন নতুন করে জেগে পাপড়ি মেলে ধরছিল একের পর এক। সারা দিন রাজ কার্য সেরে রাম আসতেন সীতার কাছে, নিজের হাতে তাঁর হাতে তুলে দিতেন সুরার পাত্র (ভক্তগণ চমকাবেন না প্লিজ)! সঙ্গে থাকত ফল আর মাংস। বনবাসকালের খাদ্যাভ্যাস রয়ে গেছিল বজায় মনে হয়! তারপর শুরু হত নাচ গান। হাত ধরাধরি করে বসে সেই সব উপভোগ করতেন স্বামী স্ত্রী। তারপর শুতে যাওয়া। 
একদিন রাম বললেন, তোমার মধ্যে তো গর্ভবতীর লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, বলো তোমার কি ইচ্ছে হচ্ছে! সেই সাধ আমি পূরণ করব! সীতা বললেন, কোন কূক্ষণে যে বললেন, আমি গঙ্গার তীরে কোনো তপোবনে গিয়ে এক রাত থাকতে চাই।
এই সাধ বা দোহদের অদ্ভুত সব গল্প আছে। কতটা সত্যি কতটা মনগড়া, তা জানি না। একটা পড়েছিলাম রাহুল সাংকৃত্যায়নের ভোল্গায় থেকে গঙ্গায়। মল্লবীর বন্ধুল মল্লের প্রিয়া মল্লিকার অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় সাধ হল অভিষেক   সরোবরে স্নান করার, যে সরোবরে নামার অধিকার আর কারুর ছিল না, একমাত্র যখন কোনো লিচ্ছবী পুরুষ লিচ্ছবী প্রজাতন্ত্রে প্রবেশের দুর্লভ অধিকার লাভ করত, তখন, জীবনে মাত্র একবার সেই সরোবরে স্নান করার সৌভাগ্য লাভ করত আর সেই সরোবরে সর্বদা কড়া পাহারা থাকত। সেই ইচ্ছে পূরণ করিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে ফিরছেন যখন, তখন পাঁচশ লিচ্ছবী রথী তাঁর পিছু ধাওয়া করল। বন্ধুল একটি মাত্র তীর ছুঁড়লেন আর বললেন বাড়ি যাও। সবার থেকে বিদায় নিয়ে তবেই কোমরবন্ধনী খুলবে! আসলে তাঁর ছোঁড়া তীর পরপর পাঁচশ’জনের মধ্যদেশ বিদ্ধ করে চলে গেছিল!(পৃ: ১১১-১২২) আরেকটি গল্প বিম্বিসার পত্নী, অজাতশত্রুরকে মাকে নিয়ে, ইনিও কিন্তু কৌশল্যা, কোশলদেবী। গর্ভবতী অবস্থায় তাঁর সাধ হল বিম্বিসারের পিঠের মাংস খাওয়ার। আর এই ভয়ানক সাধ মেটাতে একটি সদ্য কাটা ছাগলের মাংসসহ চামড়া বিম্বিসারের পিঠে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল আর রাণী সেটাই কামড়েছিলেন! এই বিকট ইচ্ছে থেকেই পণ্ডিতেরা বুঝতে পেরেছিলেন এই অজাত সন্তান পিতৃঘাতক হবে!
সীতার সাধ অবশ্য নেহাতই নিরীহ ছিল, বরং সেই নির্বিষ অতি সাধারণ সাধ অযোধ্যার প্রজাদের কলুষতা আর রামের প্রজারক্ষার তাগিদে বিষময় হয়ে উঠল! কী সব বিশ্রী কথাই না প্রজারা বলতে আরম্ভ করল! অত সুখে থেকেও! কথায় বলে না, সবাইকে সুখী করা যায় না! তারা নাকি বলাবলি করত,
কীদৃশং হৃদয়ে তস্য সীতাসম্ভোগজং সুখম্।
অঙ্কমারোপ্য তু পুরা রাবণেন বলাদ্ধৃতাম্।। 
লঙ্কামপি পুরা নীতামশোকবনিকাং গতাম্।
রক্ষসাং বশমাপন্ন কথং রামো ন কুৎস্যতি।। 
উ: কা: ৪৩|১৭|১৮
অর্থাৎ, সীতার সঙ্গে সম্ভোগের সুখ রামের এতোই বেশি যে রাবণ যাকে কোলে তুলে নিয়ে গেছি, রাম তাকে ঘেণ্ণা না করে আছেন কি করে! কী ভীষণ নোংরা ইঙ্গিত! ভালোবাসা তো দূর অস্ত, সীতাকে দেবী পরবর্তী জনগণ বানিয়েছে, যেমন প্রয়োজনে মেয়েদের বানানো হয়, আবার মুহূর্তে বেশ্যা বানাতেও সময় লাগে না; সীতাকেও তাইই বানিয়েছিল সেই সময়ের সাধারণ মানুষ! একটা শরীর, যাকে রাবণ কোলে নিয়েছে, যেন সীতা স্বেচ্ছায় রাবণের কোলে গিয়ে উঠেছিলেন; সেই শরীর যা এখন রামকে যৌনসুখ দিচ্ছে! একবারও রাণীমা বলেও ভাবছে না তো! কী নোংরা ভাবনা! আর রামকে ভাবছে ঠিক দশরথের অনুরূপ। দশরথ যেমন কৈকেয়ীর রূপমুগ্ধ হয়ে যা তা সব কাণ্ড করেছেন, এইবার এই রামও তাই করবে! এই হল মোদ্দ্ কথা! রামের সবচেয়ে দুর্বল জায়গায় তীব্র আঘাত করল প্রজারা, যারা নাকি রামসীতার সন্তানতুল্য। মহাকাব্যে  নাকি সাধারণ স্থান পায় নি! এমন স্থান করে নিল সাধারণে, যে রাজারাণীর ঘর তছনছ হয়ে গেল!
যেদিন সীতা নিজের ইচ্ছের কথা জানালেন, তার ঠিক পর দিনই ভদ্র নামে সভাসদ রামের প্রশ্নের উত্তরে সাধারণ্যে রাম-সীতাকে নিয়ে যে সব আলোচনা হচ্ছে, তা জানালেন। রাম পরক্ষণেই সভাসদদের বিদায় দিয়ে তিন ভাইকে ডেকে পাঠালেন এবং নিজের সিদ্ধান্ত জানালেন। স্পষ্ট বললেন, “অপবাদ বা লোকনিন্দার ভয়ে আমি নিজের প্রাণ বা তোমাদেরকেও ত্যাগ করতে পারি! তাই সীতাকে ছাড়তে যতো কষ্ট হোক, আমি নিরুপায়, কারণ যে কথা রটেছে, তা বন্ধ করার এই একটাই উপায়! সীতা গতকালই তপোবন দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন,  সুতরাং, লক্ষ্মণ, এই কাজটি তোমাকে কালই করতে হবে”। এই বলে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে তিনি চলে গেলেন!
বেচারা লক্ষ্মণ! ততোধিক বেচারী সীতা! রথ প্রস্তুত জেনে মুনিপত্নীদের জন্য দামী কাপড়চোপড় আর গয়নাগাঁটি নিয়ে, মানে মুনিঋষিদের বউরাও সাজতে গুজতে ভালোই বাসতেন, রথে উঠলেন। কিন্তু মেয়েদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়টি একটু প্রবল তো! তিনি ঠিক বুঝলেন, যে কিছু গোলমাল আছে। যেমনটি সব হওয়ার, তেমনটি যেন হচ্ছে না! চারিদিকে অমঙ্গলের চিহ্ন! অর্ধেক দিন রথ চালিয়ে গিয়ে গঙ্গার তীরে এলেন তাঁরা। এইখানে এসে লক্ষ্মণ নিজেকে আর সামলাতে পারলেন না, একেবারে গলা ছেড়ে বাচ্চাদের মত কেঁদে উঠলেন! সীতা তো অবাক। বললেন, “একী লক্ষ্মণ, এমন আনন্দ মুহূর্তে তুমি কাঁদছ কেন? আমরা তো এক রাত্তির কাটিয়েই ফিরে যাব! রাম তো আমার প্রাণাধিক প্রিয়, কিন্তু তোমার মত কান্নাকাটি করছি কি? তুমি শান্ত হও!” লক্ষ্মণ চোখের জল মুছলেন। এইখানে একটা কথা বলি। রামায়ণে কিন্তু দশরথ থেকে রাম, ভরত থেকে লক্ষ্মণ, সবারই বেশ কান্নাকাটির উদাহরণ আছে; মানে একেবারে চোখের জল ফেলে। এইটে বেশ গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। যাক্, সীতাকে নিয়ে লক্ষ্মণ নদী পার হয়ে এলেন। এইবার লক্ষ্মণকে ফিরতে হবে সীতাকে একা রেখে, সব বলে। তিনি আর stress নিতে পারলেন না, হাত জোড় করে সব বলে একেবারে মাটিতে পড়ে গেলেন!
এই জায়গায় আর বাড়াবো না। সবাই জানেন, সীতাকে ঋষি বাল্মীকি পরম স্নেহে পরম যত্নে আশ্রয় দিলেন আশ্রমে। ওই আশ্রমেই জন্ম নিলো লবকুশ, সীতার দুই যমজ সন্তান। হ্যাঁ, সীতার সন্তানই বলব, কারণ বীর্য ছাড়া রাম কোথায়! যে সময় একটি মেয়ের তার পুরুষ সঙ্গীকে সবচেয়ে বেশি দরকার হয়, মনের দিক থেকে, আবেগের দিক থেকে; ঠিক সেই সময়ে সবথেকে বড় আঘাতটা পেলেন সীতা! এত বছর যাকে ছেড়ে থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাঁর থেকে আবার দূরে যেতে হলো, আর এই অবস্থায়।
লবকুশ জন্মালো, বড় হয়ে উঠতে লাগল মা আর ঋষিমুনিদের স্নেহচ্ছায়ায়। মা খেয়াল রাখলেন যাতে তাদের ক্ষত্রিয়সত্ত্বার পূর্ণ বিকাশ হয়, আবার শাস্ত্রশিক্ষার দিকে খেয়াল রাখলেন স্বয়ং বাল্মীকি। তার সঙ্গে দুই ভাইকে শেখালেন রামায়ণ-গান। মিষ্টি রিনরিনে গলায় ছোট্ট দুই সুকুমার বালকের মুখে এই গান যেই শুনত, অবাক আর মুগ্ধ হয়ে যেত!
এর পরের অংশটা যখন পড়ি, রামের স্বপক্ষে হাজার যুক্তি ভাবার চেষ্টা করলেও সমস্ত মন রাগে-ক্ষোভে জ্বলতে থাকে! মনে হয়, এই ভয়ানক অসভ্যতার কি কোন প্রতিবাদ হয় না! এই লোকটাকে কেউ কি নেই জব্দ করার!! এ এমনিই ছাড়া পাবে! তারপর এগোতে থাকি, আর দেখি, অবতার হলে কী হবে, দেবতা বানালে কী হবে; শাস্তি পেতে হয়েছে রামকেও। বড় জবর শাস্তি। সবার সামনে। আড়ালেও।
[চলবে]

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত