| 14 ডিসেম্বর 2024
Categories
ধারাবাহিক লোকসংস্কৃতি

নারী-পুরুষের মিলন কাহিনী (পর্ব-৪)

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

বিবাহ  মানব সমাজের প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান। যুগে যুগে প্রতিষ্ঠানটি এর আদি রূপ থেকে বর্তমান কাঠামোয় উপনীত হয়েছে। বিবাহপ্রথাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে প্রধানত ধর্ম। বিয়েসংক্রান্ত সকল নিয়মকানুন বিধিবদ্ধ হয়েছে ধর্মীয় অনুশাসনে। প্রাচীনকাল থেকে বাংলায় ধর্মীয় শাস্ত্রের বিধানই ছিল সামাজিক আইন, ধর্মীয় আইনের দ্বারাই শাসিত হতো সমাজ-সংসার। ধর্মীয় এবং রাষ্ট্রীয় আইনের পাশাপাশি লোকজ সংস্কৃতিও বৈবাহিক জীবনকে প্রভাবিত করেছে নানাভাবে। মনুস্মৃতি এবং অর্থশাস্ত্রে আট প্রকারের হিন্দু-বিবাহ পদ্ধতির উল্লেখ আছে। ‘ব্রাহ্ম’, ‘দৈব’, ‘আর্য’, ‘প্রজাপত্য’, ‘অসুর’, ‘রাক্ষস’, ‘পৈশাচ’ ও ‘গান্ধর্ব’ এই আট ধরনের বিবাহের মধ্যে ব্রাহ্ম বিবাহই শুধু গ্রহণযোগ্য ছিল। দায়ভাগ গ্রন্থে জীমূতবাহন উল্লেখ করেছেন যে, ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, প্রজাপত্য এবং গান্ধর্ব বিবাহ অনিন্দনীয়। ধর্মশাস্ত্রের বিধান অনুযায়ী নিজ বর্ণের মধ্যে বিবাহ ছিল সাধারণ নিয়ম। সবর্ণে বিবাহ উৎকৃষ্ট হলেও মনু ব্রাহ্মণ পুরুষকে নিজ বর্ণ ছাড়া নিম্নতর তিন বর্ণে বিবাহের অধিকার দিয়েছিলেন। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে, যেমন চন্ডীমঙ্গলে, মুসলমানদের নিকা বিবাহের কথা বলা হয়েছে। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, এমনকি বিশ শতকেও মুসলমানদের মধ্যে বহুবিবাহ ব্যাপক হারে প্রচলিত ছিল। উচ্চশ্রেণীর অবস্থাপন্ন মুসলমানদের একাধিক স্ত্রী থাকত। বিশ শতকের শুরুতে কুলীনদের বাইরে হিন্দু সমাজে বহুবিবাহ তেমন প্রচলিত ছিল না। বিয়ের এমন অনেক জানা অজানা বিষয়ে আলো ফেলেছেন ড. রোহিণী ধর্মপাল তাঁর এই ধারাবাহিক ‘নারী-পুরুষের মিলন কাহিনী’-তে। আজ থাকছে নারী-পুরুষের মিলন কাহিনীর ৪র্থ পর্ব।


কন্যাটির আর কি হবে!  যে ধীবরটি তুলেছিল মাছটিকে, তার হাতেই অর্পণ করা হল “– এই কন্যাটি তোমারই হউক” একথা বলে, আর পুত্রটিকে নিয়ে রাজামশাই  চলে গেলেন ।
এইবার সেই মেয়ে জেলেদের পাড়ায়, জেলেদের আদরে যতনে বড় হয়ে উঠতে লাগল।  পরমা সুন্দরী, সপ্রতিভ, উদ্যমী। শুধু তাই নয়, তাদের আবাসের পাশেই তো নদী, যেখানে জাল ফেলে তার মাছ-মাকে পাওয়া গেছিল, সেই নদী পারাপার করিয়ে দিলে কিছু পয়সাকড়ি  পেলে বাবার সুবিধা হবে, এই ভেবে সে বাবারই একটি নৌকা নিয়ে মানুষ পারাপার শুরু করে দিল।
 ভাবুন, কি রোমাঞ্চকর । যমুনা নদী, পাড়ে বৈঠা হাতে প্রতীক্ষারত সুন্দরী ড্রাইভার, শুধু আপনার নৌকায় ওঠার অপেক্ষা  ! এই women  empowerment এর সময় আমরা মহিলা রিক্সাচালক বাস ড্রাইভার দেখে কত কি স্তুতিবাক্য বলি, ওদের ছবি তুলে power point presentation বানাই। মেয়েরা এই রকমই । সংসারে সুসার করতে ভেতরেও যেমন, বাইরেও তেমন; আজ নয়, চিরকালই ।
কিন্তু ওই, মেয়েদের বাইরে বেরোলে (ঘরে থাকলেও কিছু কম নয় অবশ্য ) যে সব বিপদ এখনও আসে, তখনও আসত । সত্যবতীরও জীবনে বিপদ এল একদিন। ও, বলি নি বুঝি মেয়েটির নাম? সত্যবতী । আরেক নাম মৎস্যগন্ধা; মাছের পেটে জন্মানো আর সারা দিন রাত জেলেদের ঘরে মাছেদের সঙ্গে গা ঘষাঘষি, গায়ে মেছো গন্ধ তো হবেই, তাই এমন নাম! তবে হয়ত সেই কারণেই বিপদ আগে আসে নি, মেয়েটি সুন্দরী হলে হবে কী, গায়ে বড্ড বিটকেল গন্ধ যে!
অবশ্য পরাশর মুনির তাতে কিছু আটকায় নি। অনেক রকম জানতেন তো, দুর্গন্ধ দূর করার উপায়ও জানতেন। তিনি তো মেয়েটিকে দেখেই কামার্ত হয়ে পড়লেন। বস্তুত যৌন প্রবৃত্তি এমন তীব্র এক প্রবৃত্তি, যে তাকে পুরোপুরি সংযত করা সহজ নয়, তা করতে গেলে অনেকের অনেক রকম বিকৃতিও আসে, বিশেষ করে মনের দিক থেকে, শরীরের দিক থেকেও।
 সত্যবতীকে তিনি যখন দেখলেন, দেখলেন তার হাসিভরা মুখটি,  দেখলেন তার অপার্থিব সৌন্দর্য্য, দেখলেন তার রম্ভোরু দুটি অর্থাৎ কলাগাছের মত চকচক সুগোল সুডৌল উরুদুটি। আর তাঁর সংযম টংযম মাথায় উঠল! তিনি তাড়াতাড়ি নৌকায় উঠলেন, বললেন, “দেরি করো না, নৌকা বাইতে থাকো”। আসলে ঘাটের কাছে জেলেদের বাস তো, মেয়েটি চিৎকার টিৎকার করে বসলে মুশকিল!! সুতরাং যতটা সরিয়ে নেওয়া যায় জনবসতি থেকে। সত্যবতী তো নৌকা ছাড়ল, আর পরাশর চোখ দিয়েই নিজের কামেচ্ছা মেটাতে শুরু করে দিলেন। সেটা স্পষ্ট বুঝল সত্যবতী । পুরুষের উদগ্র বাসনা বুঝতে মেয়েদের সময় লাগে না। কিন্তু পরাশর উঠেই ওকে “বসুনন্দিনী” বলে সম্বোধন করায় ওর কৌতূহল হল আর তাঁর কাছ থেকে নিজের মৎস্য দ্বারা জন্মের কাহিনীর সঙ্গে সঙ্গে পূর্বজন্মের কথা শুনল, সঙ্গে নিজের ভবিষ্যতের কথাও জানল। তারপর পরাশর সত্যবতীর কাছে সেই প্রার্থনা জানালেন, যে প্রার্থনা যুগে যুগে পুরুষ নারীর কাছে করে এসেছে, দৈহিক মিলনের প্রার্থনা । সত্যবতী লজ্জা পেল, খানিক ভয়ও। নদীর পাড় থেকে খুব দূরে তো নয়,  কী হবে যদি লোকে দেখে ফেলে! আর এই সংসর্গের ফলে তার কুমারীত্ব নষ্ট হবে, তাতেও তো সমস্যা হতে পারে!এখানে বলার একটিই কথা, লোকে না দেখলে অর্থাৎ লোক-জানাজানি কথা-কানাকানি না হলে আর virginity র সমস্যা না হলে সত্যবতীর খুব আপত্তি নেই!
এই যে সত্যবতী নিজের সমস্যার কথাটি খোলাখুলি বলল, তার অবশ্য একাধিক কারণ থাকতে পারে। এক, নিজেকে বাঁচানোর সেই মুহূর্তে আর কোনো উপায় ছিল না। দুই, পরাশর যে বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন, তা বুঝেছিল সে; আর তাঁকে রাগিয়ে দিলে যেমন বিপদ হতে পারে, খুশি রাখলে সুবিধাও হতে পারে। তিন, সত্যিকারের পুরুষ বিদ্বান পুরুষ গুণী পুরুষ যখন মেয়েদের কাছে নত হয়ে কিছু চান, সেটা মেয়েদের ভালোই লাগে। কারণ বিপরীতেও কথাটা সত্যি । কোনো গুণবতী রূপবতী উচ্চ স্তরের মেয়ে যদি তুলনায় সাধারণ বা কুরূপ বা তার থেকে নিম্নস্তরের কোনো ছেলের প্রতি প্রেমাসক্ত হয়, সেই ছেলেটি কি তা উপভোগ করবে না! কথাটা মেয়েদের ক্ষেত্রেও সমান সত্যি । সুতরাং একজন জেলের মেয়েকে দেখে যদি ঋষিমুনি গোত্রের কারুর মাথাটি ঘুরে যায়,  সেই মেয়েটির তো তা উপভোগ কথারই কথা! আজকালকার দিনে অবশ্য একথা আমরা লুকিয়ে রাখি, মেয়েদের আবার এসব উপভোগ করতে আছে নাকি!!!! ছিছিঃকার পড়ে যাবে যে! তখন মেয়েরা আলাদা করে এত কিছু লুকোতে শেখে নি। আমাদের সত্যবতীও লুকোল না। যা নিয়ে ওর আসল শঙ্কা, তা পরিষ্কার করে বলে দিল।
সব শুনে পরাশর প্রথমে সত্যবতীর virginity অক্ষুণ্ণ থাকবে, এই কথা দিলেন। কি করে সেই কথা দিলেন, জানি না। তবে নিশ্চয়ই virginity নিয়ে উপরে উপরে চর্চা হলেও সত্যি সত্যি তেমন কথা হত না। তাহলে সত্যবতী থেকে কুন্তী, কারুরই তো বিয়ে হত না! 
আর সত্যবতীর দ্বারা অনুরুদ্ধ হয়ে তাকে বর দিলেন, যাতে তার গায়ের মেছো গন্ধ দূর হয়ে যায়। সেই দিন থেকে সত্যবতী গন্ধবতী হয়ে গেল। এমনকী এক যোজন দূর থেকে তার শরীরের সৌরভ পাওয়া যেত বলে লোকে তাকে যোজনগন্ধা নাম দিল।
যাক্, এই সব বোঝানো টোঝানো বর টর দেওয়ার পর পরাশর  দুজনের চারপাশে তৈরি করলেন  নীহার, কুয়াশা। পুরো জায়গাটাই আঁধার হয়ে গেল। সেই আঁধারের আড়ালে এক মুনি এক জেলেকন্যার শরীরে প্রবেশ করলেন, নিজের যৌন বাসনার সাধটি মেটালেন। তবে আমার ধারণা সত্যবতীও ভালো ভাবেই সাড়া দিয়েছিল। কারণ সে যেমন সুন্দরী ছিল, তেমন তেজস্বীও ছিল। তেমন অনিচ্ছে হলে সে বাধা দিতোই। কথা শোনাতই। কিন্তু শুধু মিলনটিকে উপভোগ করল, তাইই নয়; পরাশরের বীর্য ধারণ করে সে অন্তঃসত্ত্বা হল। মনে রাখতে হবে, পরাশর কিন্তু নিজের সন্তানের জননী হতেও তাকে অনুরোধ করেছিলেন। অর্থাৎ শুধু নিজের ক্ষণিকের খিদে মেটানোর ইচ্ছে নিয়ে তিনি আসেন নি। জেলের মেয়ে বলে অবজ্ঞাও করেন নি। 
যথাসময়ে সত্যবতী সেই যমুনা দ্বীপেই সন্তানের জন্ম দিলেন। মহাভারতে অবশ্য সবটাই  সঙ্গে সঙ্গে হয়েছিল বলে লেখা আছে। তবে একথা অনুমান করাই যায়, জেলেদের মধ্যে এই নিয়ে খুব কিছু হইচই হয় নি, যেহেতু সত্যবতী নিজেও খুব গররাজি ছিল না। আর একটি মেয়ে একটি পুরুষের সঙ্গে মিলিত হয়েছে, গর্ভধারণ করেছে এবং পুরুষটি অত্যন্ত উচ্চস্তরের সম্মানীয় মানুষ। আর তাদের মেয়েটির সঙ্গে শুধু সঙ্গম করে তাকে ফেলে যান নি, তাকে স্ত্রীর মতোই মর্যাদা দিয়েছে, তাঁর সন্তানের জননী হতে অনুরোধ করেছেন।
সেক্ষেত্রে কেউই খুব একটা আপত্তি করেন নি। সুতরাং সত্যবতী এবং পরাশরের সন্তান জন্মালো, পুত্র সন্তান। দ্বীপে জন্ম বলে নাম হল দ্বৈপায়ন, যাকে আমরা চিনি ব্যাসদেব নামে; মহাভারতের রচনাকার।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত