| 19 মার্চ 2024
Categories
বিনোদন

মহীনের ঘোড়াগুলি ও ম্যাজিসিয়ান গৌতম চট্টোপাধ্যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

সাইফুল ইসলাম



রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র অমিত রায়ের একটি উক্তি “ফ্যাশনটা হলো মুখোশ, স্টাইলটা হলো মুখশ্রী”। লাইনটি উল্লেখ করার অন্তর্নিহিত তাৎপর্যের সাথে যোগ সাযুজ্য আছে সত্তর দশকের গতানুগতিক শিল্পীদের সংগীত এবং প্রবাদপ্রতিম বাংলা গানের দল ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’-র গানের মাঝে। সেই সময়টিতে শ্রোতারা রোম্যান্টিক আর ক্ল্যাসিকাল ধারার সঙ্গীতে সম্মোহিত ছিল। ঐ সময়ে বাংলা গানের আকাশে ধ্রুবতারা হয়ে আবির্ভাব ঘটে এই গানের দলটির। স্বাধীনতা, রাজনীতি, ভালোবাসা, দারিদ্র্য, অন্যায়-অবিচার, একাকিত্বের মত ধারনাগুলো বারবার তাদের গানে উঠে এসেছে। তাঁরা গতানুগতিক সংগীতবোধের বাইরে নতুন ধারার বাংলা গানের স্টাইলের সাথে শ্রোতাদের পরিচয় করিয়ে দেন। সে জন্য সমালোচনাও কম হয়নি ব্যান্ডটিকে নিয়ে।


মহীনের ঘোড়াগুলি (Mohiner Ghoraguli)
মহীনের ঘোড়াগুলি ; Source: Wikipedia)


গৌতম চট্টোপাধ্যায়; যার হাতে বাংলা ব্যান্ড সংগীতের ভিত গড়ে ওঠে। স্বতন্ত্র এবং সৃজনশীলতা দুয়ের এক অদ্ভুত মিলন দেখতে পাই তাঁর মাঝে। আমাদের মাঝে তিনি নেই কিন্তু কেন এই দীপ্তিমান মানুষটি এখনও বাংলা সঙ্গীতের অনেকটা অংশ জুড়ে রেয়েছে ? কেন বর্তমান রক সঙ্গীতের অনুসারীরা তাকে পথপ্রদর্শক হিসেবে দেখে? সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা এখন শুধু সময়ের দাবী। বাংলা গানের স্থিতাবস্থা ভাঙার যে ইশতেহার নিয়ে পথচলা “মহীনের ঘোড়াগুলি” ব্যান্ডিটির তার অন্যতম অগ্রদূত গৌতম চট্টোপাধ্যায়। ছোটবেলা থেকে সংগীত আবহে তাঁর বড় হওয়া। তাঁর ভাই এবং মহীনের ঘোড়াগুলি অন্যতম সদস্য প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, “মণিদা (গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের ডাক নাম) সবই বাজাতে পারত। যে কোনও ইনস্ট্রুমেন্টই খুব সহজে বাজিয়ে ফেলত তালিম ছাড়াই। নিজে নিজেই শিখে ফেলত বাজানোর আদবকায়দা।” প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় বাড়ির হাওয়াইয়ান গিটারটি স্প্যানিশ গিটারে রূপান্তরিত করে এবং প্রচুর ইংলিশ গান শুনে নিজেকে বিশ্বসঙ্গীতের সাথে পরিচয় করানোটা বোধহয় সময়য়ের চাইতে অগ্রসর চিন্তার বহিঃপ্রকাশ। কাউন্টার কালচারের বিদ্রোহের যারা আদর্শ ছিলেন, যেমন- বিটলস্, রোলিং স্টোনস্, বব ডিলান, জিম মরিসনদের গান তিনি অনুপ্রাণিত হয়েছেন। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বন্ধুদের নিয়ে তৈরি করলেন ‘আর্জ’ নামের একটি ব্যান্ড। নাইটক্লাব আর রেস্তোরাগুলোতে ইংরেজি গান কাভার (অন্য শিল্পীর গান করা) করেছেন তিনি।

মণিদা সবই বাজাতে পারত। যে কোনও ইনস্ট্রুমেন্টই খুব সহজে বাজিয়ে ফেলত তালিম ছাড়াই। নিজে নিজেই শিখে ফেলত বাজানোর আদবকায়দা।প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়


গৌতম চট্টোপাধ্যায়
গৌতম চট্টোপাধ্যায়; Source: livemint.com


একসময় গৌতমের মনে হল যেসব অডিয়েন্স তাদের শুনছে তথাকথিত প্রিভিলেজড শ্রেণীর। ব্যান্ডটি পরে আর বেশি দিন টেকেনি। সত্তরের দশকের সংগ্রামের আগুন ছড়িয়ে পরল পশ্চিমবঙ্গের নকশালবাড়িতে যা নকশাল আন্দোলন নামে পরিচিত। দরিদ্র কৃষকদের ওপর ভূস্বামীদের অত্যাচার দানা বাধতে থাকল উগ্র রাজনীতিতে । গৌতম চট্টোপাধ্যায় আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। তাই বিপ্লবের ডাকে শহর ছেড়ে গ্রামে পারি জমালেন। গ্রামের শ্রমজীবি মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম গানের মাধ্যমে পৌছে দিয়েছেন আমদের কাছে।



মহীনের ঘোড়াগুলি প্রথম অ্যালবাম ‘সংবিগ্ন পাখিকূল ও কলকাতা বিষয়ক’ একটা বিখ্যাত গান ‘হায় ভালোবাসি’ । এই গানের মাধ্যমে তাঁর জীবনের কথাগুলো অদেখা শ্রোতাদের মুখোমুখি দাঁড় করান-

“ভালো লাগে ডিঙ্গি নৌকায় চড়ে ভাসতে
প্রজাপতি বুনোহাঁস ভালো লাগে দেখতে
জানলার কোণে বসে উদাসী বিকেল দেখে
ভালোবাসি একমনে কবিতা পড়তে
যখন দেখি ওরা কাজ করে গ্রামে বন্দরে
শুধুই ফসল ফলায় ঘাম ঝরায় মাঠে প্রান্তরে
তখন ভালোলাগেনা লাগে না কোন কিছু
সুদিন কাছে এসো ভালোবাসি একসাথে আজ সব কিছু……”


গৌতম চট্টোপাধ্যায়
গৌতম চট্টোপাধ্যায়; Source: anandabazar.com


জীবনে বৈপরীত্য দেখে বেড়ে ওঠা মানুষটি সংগীতে মাঝে জীবনের পরিপূরক রূপ খুঁজে পায়। পরবর্তি সময়ে বিপ্লব ছেড়ে নিজস্ব সংগীতে মননিবেশ করেন । তথাকথিত বিপ্লবীদের সমাজ সংস্কার পরিকল্পনা প্রতি তাঁর আস্থা ছিলনা। মহীনের ঘোরাগুলি ব্যান্ডের গিটারিস্ট, গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের বন্ধু তাপস দাস বলেছেন, “তথাকথিত বিপ্লবের প্রতি অনাগ্রহ থেকে সঙ্গীতকে হাতিয়ার হিসেবে নিয়ে ছিলেন।” আবার বছর কুড়ি পরে অ্যালবামের ‘কথা দিয়া বন্ধু’ গানটির লাইনগুলো তাঁরই প্রতিছব্বি-

“কথা দিয়া বন্ধু ফিরা না আইলা
এ কেমন কথা হায় কি দশা
কানে বাজে তোমার কথা
বুকে বাজে তাই ব্যথা
কানের কথা বুকের ব্যথা হইয়া
আমার প্রাণে জাগায় যে হতাশা”



গৌতম চট্টোপাধ্যায় এবং তাঁর ভাই প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়সহ আরো পাঁচজন তপেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, রঞ্জন ঘোষাল, তাপস দাস, এব্রাহাম মজুমদার, বিশ্বনাথ চট্টোপাধ্যায় মিলে তৈরি করলেন একটি নামহীন গানের দল। সাতজন থেকে সপ্তর্ষি নামে চলতে থাকে দলটি। মাঝে মাঝে মিউজিকাল শো গুলোতে নিজেদের গৌতম চ্যাটার্জি বিএসসি অ্যান্ড সম্প্রদায় বলে পরিচয় দেন। এভাবে ঠাট্টা-ইয়ার্কি চলছে, এর মাঝে মহীনের ঘোড়াগুলি’র একজন সদস্য রঞ্জন ঘোষাল, জীবনানন্দ দাশের ‘ঘোড়া’ কবিতাটির লাইনগুলো আবৃতি করে শোনালেন সবাইকে –

আমরা যাইনি মরে আজো– তবু কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়ঃ
মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে…

বলে বসলেন আমাদের দলের নাম ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ রাখলে কেমন হয়। সবাই তাতে রাজি হয়ে গেলেন। আর আজও বদলায়নি সেই নাম।


১৯৮৭ সালে, রেকর্ডিংয়ে সলিল চৌধুরীর ছেলের সঙ্গে গৌতম চট্টোপাধ্যায়
১৯৮৭ সালে, রেকর্ডিংয়ে সলিল চৌধুরীর ছেলের সঙ্গে গৌতম চট্টোপাধ্যায় (বামে); Source: anandabazar.com


১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৮১ সালের মাঝে মহীনের ঘোড়াগুলি দর্শকদের তিনটি অ্যালবাম উপহার দিয়েছে। সেগুলো হল-

  • সংবিগ্ন পাখিকূল ও কলকাতা বিষয়ক (১৯৭৭)
  • অজানা উড়ন্ত বস্তু ও অ-উ-ব (১৯৭৮)
  • দৃশ্যমান মহীনের ঘোড়াগুলি (১৯৭৯)

এই তিনটি অ্যালবামে সর্বমোট আটটি গান আছে।


মহীনের ঘোড়াগুলির অ্যালবাম তিনটির প্রচ্ছদ
অ্যালবাম তিনটির প্রচ্ছদ; Source: Wikipedia.org (compiled)


ব্যান্ড ভাঙ্গার পর চারটি সম্পাদিত অ্যালবামের কাজ হয়। অ্যালবামগুলো হল-

  • আবার বছর কুড়ি পরে (১৯৯৫)
  • ঝরা সময়ের গান (১৯৯৬)
  • মায়া (১৯৯৭)
  • ক্ষ্যাপার গান (১৯৯৯)

মহীনের ঘোড়াগুলির অ্যালবাম চারটির প্রচ্ছদ
অ্যালবাম চারটির প্রচ্ছদ; Source: (compiled)


ব্যান্ডের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছিলেন গৌতম চট্টোপাধ্যায়। শুরুর দিকে ব্যান্ড তথাকথিত জনপ্রিয়তা পায়নি। পরবর্তী সময়ে গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে নব্বইের দশকে বিপুল জনপ্রিয়তা পায় ব্যান্ডটি। যার মূল কারণ ছিল গান নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট আর সংগীতের সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র খুঁজে বের করা। নব্বইের দশকে বিশ্বায়নের পর নগরকেন্দ্রিক এবং যান্ত্রিকতায় আবর্তিত হতে থাকে আমাদের জীবন যা আমরা তাঁর লিখা ‘পৃথিবীটা নাকি’ শিরোনামের গানে পাই। এটি আজও সর্বাধিক জনপ্রিয়।



পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে
স্যাটালাইট আর কেবলের হাতে
ড্রইংরুমে রাখা বোকা-বাক্সতে বন্দি
আহা-হা-হা আহা আহা-হা-হা
আহা আহা-হা-হা………..

ঘরে বসে সারা দুনিয়ার সাথে
যোগাযোগ আজ হাতের মুঠোতে
ঘুঁচে গেছে দেশ-কাল-সীমানার গন্ডি
আহা-হা-হা আহা আহা-হা-হা
আহা আহা-হা-হা………..


বিখ্যাত সেই গানের লিরিক্স
বিখ্যাত সেই গানের লিরিক্স;Source: jyotirjagat.wordpress


সত্তরের দশকে পশ্চিমা রক এবং সাইকেডেলিক কালচারে উৎসাহিত হয়ে কলকাতা তথা ভারতেও অনেক সাইকেডেলিক রক ব্যান্ডের জন্ম হয়। সেসময় খোদ কলকাতাতেই অনেক রক ব্যান্ডের জন্ম হয়। কিন্তু এই ব্যান্ডগুলোর সাথে মহীনের ঘোড়াগুলির মূল পার্থক্য ছিল যে এই ব্যান্ডগুলোর শ্রোতা ছিল হাতেগোনা এলিট শ্রেনী। কারণ এরা গান করত ইংরেজীতে, আর এরা ছিল স্বাধীনতা আন্দোলন আর নকশাল আন্দোলনের মাঝের প্রজন্ম। তাই কোন সংগ্রাম বা আন্দোলন না দেখে নিজেদের তৈরি কল্পনার ভেতর নিয়ে বসে ছিল তারা। এখানেই মহীনের ঘোড়াগুলির সার্থকতা। গৌতম এইটা ভালভাবেই বিশ্বাস করতেন যে বাংলা গান ছাড়া কলকাতার সাধারন মানুষ গান শুনবে না। আর নকশাল আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত থাকার কারনে তার লিরিক্স গড়ে ওঠে নিজের জীবনে দেখা অভিজ্ঞতা থেকে। বাংলায় রক, ব্লুজ আর জ্যাজ ধারার গানকে সাধারনের মাঝে নিয়ে যান। সেসময়ের তাদের চিন্তা চেতনা দেখলে আজও অবাক হতে হয় তারা কতটা যুগের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। এজন্য আজও ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ ব্যান্ডটি বটবৃক্ষের মতো। বাংলা রক মিউজিশিয়ানরা চলার পথে যার ছায়ায় বসে ক্লান্তি দূর করে, অনুপ্রেরণা নিয়ে আবার পথচলা শুরু করে।

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত