আয়না
সকাল সাড়ে সাতটা। শওকত সাহেব বারান্দায় উবু হয়ে বসে আছেন। তার সামনে। একটা মোড়া, মোড়ায় পানিভর্তি একটা মগ। পানির মগে হেলান দেয়া ছোট্ট একটা আয়না। আয়নাটার স্ট্যান্ড ভেঙে গেছে বলে কিছু একটাতে ঠেকা না দিয়ে তাকে। দাঁড়া করানো যায় না। শওকত সাহেব মুখ ভর্তি ফেনা নিয়ে আয়নাটার দিকে তাকিয়ে আছেন। দাড়ি শেভ করবেন। পঁয়তাল্লিশ বছরের পর মুখের দাড়ি শক্ত হয়ে যায়। ইচ্ছা করলেই রেজারের একটানে দাড়ি কাটা যায় না। মুখে সাবান মেখে অপেক্ষা করতে হয়। এক সময় দাড়ি নরম হবে, তখন কাটতে সুবিধা।
দাড়ি নরম হয়েছে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হবার পর শওকত সাহেব রেজার দিয়ে একটা টান দিতেই তার গাল কেটে গেল। রগ-টগ মনে হয় কেটেছে, গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। শওকত সাহেব এক হাতে গাল চেপে বসে আছেন। কিছুক্ষণ চেপে ধরে থাকলে রক্ত পড়া বন্ধ হবে। ঘরে স্যাভলন-ট্যাভলন কিছু আছে কিনা কে জানে। কাউকে ডেকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করছে না। সকাল বেলার সময়টা হল। ব্যস্ততার সময়। সবাই কাজ নিয়ে থাকে। কি দরকার বিরক্ত করে?
এই এক মাসে চারবার গাল কাটল। আয়নাটাই সমস্যা করছে। পুরানো আয়না, পারা নষ্ট হয়ে গেছে। কিছুই পরিষ্কার দেখা যায় না। একটা ছোট আয়না কেনার কথা তিনি তার স্ত্রী মনোয়ারাকে কয়েকবার বলেছেন। মনোয়ারা এখনো কিনে উঠতে পারেনি। তার বোধহয় মনে থাকে না, মনে থাকার কথাও না। আয়নাটা শওকত সাহেব একাই ব্যবহার করেন। বাসার সবাই ড্রেসিং টেবিলের বড় আয়না ব্যবহার করে। কাজেই হাত-আয়নাটার যে পারা উঠে গেছে মনোয়ারার তা জানার। কথা না। আর জানলেও কি সব সময় সব কথা মনে থাকে?
শওকত সাহেব নিজেই কতবার ভেবেছেন অফিস থেকে ফেরার পথে একটা আয়না কিনে নেবেন। অফিস থেকে তো রোজই ফিরছেন, কই, আয়না তো কেনা। হচ্ছে না। আয়না কেনার কথা মনেই পড়ছে না। মনে পড়ে শুধু দাড়ি শেভ করার সময়।
শোবার ঘর থেকে শওকত সাহেবের বড় মেয়ে ইরা বের হল। সে এ বছর ইউনিভার্সিটিতে ঢুকেছে। সে জন্যেই সবসময় এক ধরনের ব্যস্ততার মধ্যে থাকে। শওকত সাহেব বললেন, মা, ঘরে স্যাভলন আছে?
ইরা বলল, জানি না বাবা।
সে যে রকম ব্যস্তভাবে বারান্দায় এসেছিল সে রকম ব্যস্ত ভঙ্গিতেই আবার ঘরে ঢুকে গেল। বাবার দিকে ভালমত তাকালোও না। তার এত সময় নেই।
রক্ত পড়া বন্ধ হয়েছে কিনা এটা দেখার জন্যে শওকত সাহেব গাল থেকে হাত সরিয়ে আয়নার দিকে তাকালেন। আশ্চর্য কাণ্ড! আয়নাতে দেখা যাচ্ছে ছোট একটা মেয়ে বসে আছে। আগ্রহ নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটার গায়ে লাল ফল আঁকা সুতির একটা ফ্রক। খালি পা। মাথার চুল বেণী করা। দুদিকে দুটা বেণী ঝুলছে। দুটা বেণীতে দুরঙের ফিতা। একটা লাল একটা শাদা। মেয়েটার মুখ গোল, চোখ দুটা বিষণ্ণ। মেয়েটা কে?
এ শওকত সাহেব ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন দিকে তাকালেন। তার ধারণা হল, হয়ত টুকটাক কাজের জন্যে বাচ্চা একটা কাজের মেয়ে রাখা হয়েছে। সে বারান্দায় তার পেছনে বসে আছে তিনি এতক্ষণ লক্ষ্য করেননি।
বারান্দায় তার পেছনে কেউ নেই। পুরো বারান্দা ফাঁকা। তাহলে আয়নায় মেয়েটা এল কোত্থেকে? শওকত সাহেব আবার আয়নার দিকে তাকালেন। ঐ তো মেয়েটা বসে আছে, তার রোগা রোগা ফর্সা পা দেখা যাচ্ছে। পিট পিট করে তাকাচ্ছে তার দিকে। ব্যাপারটা কি?
মেয়েটা একটু যেন ঝুকে এল। শওকত সাহেবকে অবাক করে দিয়ে মিষ্টি গলায়। বলল, আপনার গাল কেটে গেছে। রক্ত পড়ছে।
শওকত সাহেব আবারও ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন দিকে তাকালেন। না, কেউ নেই। তার কি মাথাটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে? একমাত্র পাগলরাই উদ্ভট এবং বিচিত্র ব্যাপার ট্যাপার দেখতে পায়। এই বয়সে পাগল হয়ে গেলে তো সমস্যা। চাকরি চলে যাবে। সংসার চলবে কিভাবে? শওকত সাহেব আয়নার দিকে তাকালেন না। আয়না হাতে ঘরে ঢুকে গেলেন। নিজের শোবার ঘরের টেবিলে আয়নাটা উল্টো করে রেখে দিলেন। একবার ভাবলেন, ঘটনাটা তার স্ত্রীকে বলবেন, তারপরই মনে হল–কি দরকার! সবকিছুই সবাইকে বলে বেড়াতে হবে, তা তো না। তা ছাড়া তিনি খুবই স্বল্পভাষী, কারো সঙ্গেই তার কথা বলতে ভাল লাগে না। অফিসে যতক্ষণ থাকেন। নিজের মনে থাকতে চেষ্টা করেন। সেটা সম্ভব হয় না। অকারণে নানান কথা বলতে হয়। যত না কাজের কথা–তারচে বেশি অকাজের কথা। অফিসের লোকজন অকাজের কথা বলতেই বেশি পছন্দ করে।
শওকত সাহেব ইস্টার্ন কমার্শিয়াল ব্যাঙ্কের ক্যাশিয়ার। ক্যাশের হিসাব ঠিক রাখা, দিনের শেষে জমা-খরচ হিসাব মেলানোর কাজটা অত্যন্ত জটিল। এই জটিল কাজটা করতে গেলে মাথা খুব ঠাণ্ডা থাকা দরকার। অকারণে রাজ্যের কথা বললে। মাথা ঠাণ্ডা থাকে না। কেউ সেটা বোঝে না। সবাই প্রয়েজন না থাকলেও তার সঙ্গে কিছু খাজুরে আলাপ করবেই।
কি শওকত সাহেব, মুখটা এমন শুকনা কেন? ভাবীর সঙ্গে ফাইট চলছে নাকি?
আজকের শার্টটা তো ভাল পরেছেন। বয়স মনে হচ্ছে দশ বছর কমে গেছে। রঙে আছেন দেখি।
শওকত ভাই, দেখি চা খাওয়ান। আপনার স্বভাব কাউটা ধরনের হয়ে গেছে। চা-টা কিছুই খাওয়ান না। আজ ছাড়াছাড়ি নাই।
এইসব অকারণ অর্থহীন কথা শুনতে শুনতে শওকত সাহেব ব্যাঙ্কের হিসাব মেলান। মাঝে মাঝে হিসাবে গণ্ডগোল হয়ে যায়। তার প্রচণ্ড রাগ লাগে। পুরো হিসাব আবার গোড়া থেকে করতে হয়। মনের রাগ তিনি প্রকাশ করেন না। রাগ। চাপা রেখে মুখ হাসি-হাসি করে রাখার ক্ষমতা তার আছে। মনের রাগ চেপে রেখে অপেক্ষা করেন কখন সামনে বসে থাকা মানুষটা বিদেয় হবে, তিনি তার হিসাব আবার গোড়া থেকে করতে শুরু করবেন। খুবই সমস্যার ব্যাপার। তবে মাসখানিক হল শওকত সাহেব আরো বড় ধরনের সমস্যায় পড়েছেন। ব্যাংকে কম্পিউটার চলে এসেছে। এখন থেকে হিসাবপত্র সব হবে কম্পিউটারে। চেংড়া একটা ছেলে, নাম সাজেদুল করিম, সবাইকে কম্পিউটার ব্যবহার করা শেখাচ্ছে। সবাই শিখে গেছে, শওকত সাহেব কিছু শিখতে পারেননি।
যন্ত্রপাতির ব্যাপার তার কাছে সবসময়ই অতি জটিল মনে হয়। সামান্য ক্যালকুলেটারও তিনি কখনো ঠিকমত ব্যবহার করতে পারেন না। একটা বেড়াছেড়া হয়ে যায়ই। তাছাড়া যন্ত্রের উপর তার বিশ্বাস নেই। তিনি যত দায়িত্বের সঙ্গে একটা যোগ করবেন যন্ত্র কি তা করবে? কেনই বা করবে? ভুল-ভ্রান্তি করলে বড় সাহেবদের গালি খাবেন, তার চাকরি চলে যাবে। যন্ত্রের তো সেই সমস্যা নেই। যন্ত্রকে কেউ গালিও দেবে না বা তার চাকরিও চলে যাবে না। তারপরেও কেন মানুষ এত যন্ত্র-যন্ত্র করে? কম্পিউটার তার কাছে অসহ্য লাগছে। অনেকটা টেলিভিশনের। মত একটা জিনিশ। হিশাব-নিকাশ সব পর্দায় উঠে আসছে। এমিতেই টেলিভিশন তার ভাল লাগে না। বাসায় তিনি কখনো টিভি দেখেন না। যে যেটা অপছন্দ করে তার কপালে সেটাই জোটে, এটা বোধহয় সত্যি। তিনি টিভি পছন্দ করেন না। এখন টিভির মত একটা জিনিশ সবসময় তার টেবিলে থাকবে। অফিসে যতক্ষণ থাকবেন। তাকে তাকিয়ে থাকতে হবে টিভির পর্দার দিকে। যে পর্দায় গান-বাজনা হবে না, শুধু হিসাব-নিকাশ হবে। কোন মানে হয়?
অফিস শুরু হয় নটার সময়। শওকত সাহেব নটা বাজার ঠিক দশ মিনিট আগেই অফিসে ঢোকেন। তার টেবিলে পিরিচে ঢাকা এক গ্লাস পানি থাকে। তিনি পানিটা খান। তারপর তিনবার কুল হু আল্লা পড়ে কাজকর্ম শুরু করেন। এটা তার নিত্যদিনকার রুটিন। আজ অফিসে এসে দেখেন কম্পিউটারের চেংড়া ছেলেটা, সাজেদুল করিম, তাঁর টেবিলের সামনের চেয়ারে বসে ভুরু কুঁচকে সিগারেট টানছে। পিরিচে ঢাকা পানির গ্লাসটা খালি। সাজেদুল করিম খেয়ে ফেলেছে নিশ্চয়ই। সাজেদুল করিম শওকত সাহেবকে দেখে উঠে দাঁড়াল। হাসিমুখে বলল, স্যার, কেমন আছেন?
ভাল আছি।
আজ আপনার জন্যে সকাল সকাল চলে এসেছি।
ও, আচ্ছা।
জিএম সাহেব খুব রাগারাগি করছিলেন। আপনাকে কম্পিউটার শেখাতে পারছি না। আজ ঠিক করেছি সারাদিন আপনার সঙ্গেই থাকব।
শওকত সাহেব শুকনো মুখে বললেন, আচ্ছা।
আমরা চা খাই, চা খেয়ে শুরু করি। কি বলেন স্যার?
শওকত সাহেব কিছু বললেন না। বেল টিপে বেয়ারাকে চা দিতে বললেন। সাজেদুল করিম হাসি হাসি মুখে বলল, গতকাল যা যা বলেছিলাম সে সব কি স্যার আপনার মনে আছে?
শওকত সাহেবের কিছুই মনে নেই, তবু তিনি হা-সূচক মাথা নাড়লেন।
একটা ছোটখাট ভাইবা হয়ে যাক। স্যার বলুন দেখি, মেগাবাইট ব্যাপারটা কি?
মনে নাই।
র্যাম কি সেটা মনে আছে?
না।
মনে না থাকলে নাই। এটা এমন কিছু জরুরী ব্যাপার না। ম্যাগাবাইট, র্যাম সবই হচ্ছে কম্পিউটারের মেমরির একটা হিসাব। একেক জন মানুষের যেমন একেক রকম স্মৃতিশক্তি থাকে, কম্পিউটারেরও তাই। কিছু কিছু কম্পিউটারের স্মৃতিশক্তি থাকে অসাধারণ, আবার কিছু কিছু কম্পিউটারের স্মৃতিশক্তি সাধারণ মানের। মেগাবাইট হচ্ছে স্মৃতিশক্তির একটা হিসাব। মেটা হল টেন টু দ্যা পাওয়ার সিক্স আর বাহঁট হল টেন টু দ্যা পাওয়ার সিক্স ভাগের এক ভাগ। র্যাম হচ্ছে র্যানডম একসেস মেমরি। স্যার, বুঝতে পারছেন?
শওকত সাহেব কিছুই বোঝেননি। তারপরেও বললেন, বুঝতে পারছি।
একটা জিনিশ খেয়াল রাখবেন–কম্পিউটার হল আয়নার মত।
আয়নার মত?
হ্যাঁ স্যার, আয়নার মত। আয়নাতে যেমন হয়–আয়নার সামনে যা থাকে তাই আয়নাতে দেখা যায়, কম্পিউটারেও তাই। কম্পিউটারকে আপনি যা দেবেন সে তাই আপনাকে দেখাবে। নিজে থেকে বানিয়ে সে আপনাকে কিছু দেবে না। তার সেই ক্ষমতা নেই। বুঝতে পারছেন?
হ্যাঁ।
স্যার, এখন আসুন মেমরি এবং হার্ড ডিস্ক এই দুয়ের ভেতরের পার্থক্যটা আপনাকে বুঝিয়ে বলি। আমার কথা মন দিয়ে শুনছেন তো?
হ্যাঁ।
শওকত সাহেব আসলে মন দিয়ে কিছুই শুনছেন না। আয়নার কথায় তার। নিজের আয়নাটার কথা মনে পড়ে গেছে। ব্যাপারটা কি? আয়নার ভেতরে ছোট মেয়েটা এল কি ভাবে? মেয়েটা কে? তার নাম কি? চোখ পিট পিট করে তার দিকে তাকাচ্ছিল।
বেয়ারা চা নিয়ে এসেছে। শওকত সাহেব চায়ের কাপে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে চুমুক দিচ্ছেন। সাজেদুল করিম বলল, স্যার!
হ্যাঁ।
আপনি কি কোন কিছু নিয়ে চিন্তিত?
না তো।
তাহলে আসুন কম্পিউটারের ফাইল কি ভাবে খুলতে হয় আপনাকে বলি। শুধু মুখে বললে হবে না। হাতে-কলমে দেখাতে হবে। হার্ড ডিস্ক হল আমাদের ফাইলিং ক্যাবিনেট। সব ফাইল আছে হার্ড ডিস্কে। সেখান থেকে একটা বিশেষ। ফাইল কিভাবে বের করব? …
বিকেল চারটা পর্যন্ত শওকত সাহেব কম্পিউটার নিয়ে ঘটঘট করলেন। লাভের মধ্যে লাভ হল–তার মাথা ধরে গেল। প্রচণ্ড মাথাধরা। সাজেদুল করিমকে মাথা ধরার ব্যাপারটা জানতে দিলেন না। বেচারা এত আগ্রহ করে বোঝাচ্ছে। তার ভাব। ভঙ্গি থেকে মনে হচ্ছে কম্পিউটারের মত সহজ কিছু পৃথিবীতে তৈরি হয়নি।
স্যার, আজ এই পর্যন্ত থাক। কাল আবার নতুন করে শুরু করব।
আচ্ছা।
অফিস থেকে বেরুবার আগে জিএম সাহেব শওকত সাহেবকে ডেকে পাঠালেন। শওকত সাহেবের বুক কেঁপে উঠল। জিএম সাহেবকে তিনি কম্পিউটারের মতই ভয় পান। যদিও ভদ্রলোক অত্যন্ত মিষ্টভাষী। হাসিমুখ ছাড়া কথাই বলতে পারেন না। জিএম সাহেবের ঘরে ঢুকতেই তিনি হাসিমুখে বললেন, কেমন আছেন শওকত সাহেব?
জি স্যার, ভাল।
বসুন, দাঁড়িয়ে আছেন কেন?
শওকত সাহেব বসলেন। তার বুক কাঁপছে, পানির পিপাসা পেয়ে গেছে।
আপনার কি শরীর খারাপ? জি না স্যার।
দেখে অবশ্যি মনে হচ্ছে শরীর খারাপ। যাই হোক, কম্পিউটার শেখার কতদূর হল?
শওকত সাহেব কিছু বললেন না। মাথা নিচু করে বসে রইলেন। জিএম সাহেব বললেন, আমি সাজেদুল করিমকে গতকাল কঠিন বকা দিয়েছি। তাকে বলেছি–তুমি কেমন ছেলে, সামান্য একটা জিনিশ শওকত সাহেবকে শেখাতে পারছ না?
তার দোষ নেই স্যার। সে চেষ্টার ত্রুটি করছে না। আসলে আমি শিখতে পারছি না।
পারছেন না কেন?
বুঝতে পারছি না স্যার।
কম্পিউটার তো আজ ছেলেখেলা। সাত-আট বছরের বাচ্চারা কম্পিউটার দিয়ে খেলছে। আপনি পারবেন না কেন? আপনাকে তো পারতেই হবে। পুরানো দিনের মত কাগজে-কলমে বসে বসে হিসাব করবেন আর মুখে বিড়বিড় করবেন–হাতে আছে পাচ, তা তো হবে না। আমাদের যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। যা হবে সব কম্পিউটারে হবে।
জ্বি স্যার।
নতুন টেকনোলজি যারা নিতে পারবে না তাদের তো আমাদের প্রয়েজন। নেই। ডারউইনের সেই থিয়েরি–সারভাইল ফর দি ফিটেস্ট। বুঝতে পারছেন?
জ্বি স্যার।
আচ্ছা আজ যান। চেষ্টা করুন ব্যাপারটা শিখে নিতে। এটা এমন কিছু না। আপনার নিজের ভেতরও শেখার চেষ্টা থাকতে হবে। আপনি যদি ধরেই নেন কোনদিন শিখতে পারবেন না, তাহলে তো কোনদিনই শিখতে পারবেন না। ঠিক না?
জ্বি স্যার, ঠিক।
আচ্ছা, আজ তাহলে যান।
বেরুবার সময় তিনি দরজায় ধাক্কা খেলেন। ডান চোখের উপর কপাল সুপুরির মত ফুলে উঠল। মাথাধরাটা আরো বাড়ল।
শওকত সাহেব মাথাধরা নিয়েই বাসায় ফিরলেন। বাসা খালি, শুধু কাজের বুয়া আছে। বাকি সবাই নাকি বিয়েবাড়িতে গেছে। ফিরতে রাত হবে। আবার না ফেরার সম্ভাবনাও আছে। কার বিয়ে শওকত সাহেব কিছুই জানেন না। তাকে কেউ কিছু বলেনি। বলার প্রয়েজন মনে করেনি। তিনি হাত-মুখ ধুয়ে বারান্দার ইজিচেয়ারে চোখ বন্ধ করে বসে রইলেন। এতে যদি মাথাধরাটা কমে। ইদানীং তার ঘন ঘন মাথা ধরছে। চোখ আরো খারাপ করেছে কি না কে জানে। চোখের ডাক্তারের কাছে। একবার গেলে হয়। যেতে ইচ্ছা করছে না। ডাক্তারের কাছে যাওয়া মানেই টাকার। খেলা। ডাক্তারের ভিজিট, নুতন চশমা, নতুন ফ্রেম।
কাজের বুয়া তাকে নাশতা দিয়ে গেল। একটা পিরিচে কয়েক টুকরা পেঁপে, আধবাটি মুড়ি এবং সরপড়া চা। পেঁপেটা খেতে তিতা তিতা লাগল। মুড়ি মিইয়ে। গেছে। দাতের চাপে রবারের মত চেপ্টা হয়ে যাচ্ছে। তার প্রচণ্ড খিদে লেগেছিল। তিনি তিতা পেঁপে এবং মিয়ানো মুড়ি সবটা খেয়ে ফেললেন। চা খেলেন। গরম চা খেলে মাথাধরাটা কমবে ভেবেছিলেন। কমল না। কারণ চা গরম ছিল না। এই কাজের বুয়া গরম চা বানানোর কায়দা জানে না। তার চা সবসময় হয় কুসুম গরম।
শওকত সাহেব মাথাধরার ট্যাবলেটের খোঁজে শোবার ঘরে ঢুকলেন। টেবিলের ড্রয়ারে প্যারাসিটামল ট্যাবলেট থাকার কথা। কিছুই পাওয়া গেল না। ড্রয়ারের ভেতর হাত-আয়নাটা ঢুকানো। মনোয়ারা নিশ্চয়ই রেখে দিয়েছে। আচ্ছা, আয়নার ভেতর মেয়েটা কি এখনো আছে? শওকত সাহেব আয়না হাতে নিলেন। অস্বস্তি। নিয়ে তাকালেন। আশ্চর্য! মেয়েটা তো আছে। আগেরবার বসেছিল, এখন দাঁড়িয়ে আছে। আগের ফ্রকটাই গায়ে। মেয়েটা খুব সুন্দর তো। গোল মুখ, মায়া-মায়া চেহারা। বয়স কত হবে? এগারো-বারোর বেশি না। কমও হতে পারে। মেয়েটার গলায় নীল পুঁতির মালা। মালাটা আগে লক্ষ্য করেননি। শওকত সাহেব নিচু গলায় বললেন, তোমার নাম কি?
মেয়েটা মিষ্টি গলায় বলল, চিত্রলেখা।
বাহ, সুন্দর নাম!
মেয়েটা লাজুক ভঙ্গিতে হাসল। শওকত সাহেব আর কি বলবেন ভেবে পেলেন না। মেয়েটাকে আর কি বলা যায়? আয়নার ভেতর সে এল কি করে এটা কি জিজ্ঞেস করবেন? প্রশ্নটা মেয়েটার জন্যে জটিল হয়ে যাবে না তো? জটিল প্রশ্ন। জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। তিনি কিছু জিজ্ঞেস করার আগে মেয়েটা বলল, আপনার কপালে কি হয়েছে?
ব্যথা পেয়েছি। জিএম সাহেবের ঘর থেকে বের হবার সময় দরজায় ধাক্কা খেলাম।
খুব বেশি ব্যথা পেয়েছেন?
খুব বেশি না। তুমি কোন ক্লাসে পড়?
আমি পড়ি না।
স্কুলে যাও না?
উহুঁ।
আয়নার ভেতর তুমি এলে কি করে?
তাও জানি না।
তোমার বাবা-মা, তারা কোথায়?
জানি না।
তোমরা মা-বাবা আছেন তো? আছেন না?
জানি না।
তুমি কি একা থাক?
হুঁ।
শওকত সাহেব লক্ষ্য করলেন মেয়েটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। বুকের উপর দুটা হাত আড়াআড়ি করে রাখা। মনে হয় তার শীত লাগছে। অথচ এটা চৈত্র মাস। শীত লাগার কোন কারণ নেই। তিনি নিজে গরমে সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছেন। মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে, তার বাতাসটা পর্যন্ত গরম।
কাঁপছ কেন? শীত লাগছে নাকি?
হুঁ, এখানে খুব শীত।
তোমার কি গরম কাপড় নেই?
না।
তোমার এই একটাই জামা?
হুঁ।
আমাকে তুমি চেন?
চিনি।
আমি কে বল তো?
তা বলতে পারি না।
আমার নাম জান?
আপনি তো আপনার নাম বলেননি। জানব কিভাবে?
আমার নাম শওকত। শওকত আলি।
ও আচ্ছা।
আমার তিন মেয়ে।
ছেলে নাই?
না, ছেলে নাই।
আপনার মেয়েরা কোথায় গেছে?
বিয়েবাড়িতে গেছে।
কার বিয়ে?
কার বিয়ে আমি ঠিক জানি না। আমাকে বলেনি।
আপনার মেয়েদের নাম কি?
বড় মেয়ের নাম ইরা, মেজোটার নাম সোমা, সবচে ছোটটার নাম কল্পনা।
ওদের নামে কোন মিল নেই কেন? সবাই তো মিল দিয়ে দিয়ে মেয়েদের নাম রাখে। বড় মেয়ের নাম ইরা হলে মেজোটার নাম হয়–মীরা, ছোটটার নাম হয়। নীরা .. .
ওদের মা নাম রেখেছে। মিল দিতে ভুলে গেছে।
আপনি নাম রাখেননি কেন?
আমিও রেখেছিলাম। আমার নাম কারো পছন্দ হয়নি।
আপনি কি নাম রেখেছিলেন?
বড় মেয়ের নাম রেখেছিলাম বেগম রোকেয়া। মহিয়সী নারীর নামে নাম। তার মা পছন্দ করেনি। তার মার দোষ নেই। পুরানো দিনের নাম তো, এই জন্যে পছন্দ হয়নি।
বেগম রোকেয়া কে?
তোমাকে বললাম না মহিয়সী নারী। রংপুরের পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মেছিলেন। মেয়েদের শিক্ষা বিস্তারের জন্যে প্রাণপাত করেছিলেন। তুমি তার নাম শুননি?
জি না।
কলিংবেল বেজে উঠল। শওকত সাহেব আঁৎকে উঠলেন। ওরা বোধহয় চলে এসেছে। তিনি আয়না ড্রয়ারে রেখে দরজা খোলার জন্যে গেলেন। ওদের সামনে আয়না বের করার কোন দরকার নেই। তারা কি না কি মনে করবে–দরকার। কি? অবশ্যি আয়নায় তিনি নিজেও কিছু দেখছেন না। সম্ভবত এটা তার কল্পনা। কিংবা তিনি পাগল হয়ে যাচ্ছেন। ছোটবেলায় তিনি যখন স্কুলে পড়তেন তখন তাদের অবনী স্যার স্কুলের সামনের বড় আমগাছটার সঙ্গে কথা বলতেন। কেউ দেখে ফেললে খুব লজ্জা পেতেন। এক বর্ষাকালে তিনি স্কুলের পাশ দিয়ে যাচ্ছেন, হঠাৎ দেখেন অবনী স্যার আমগাছের সঙ্গে কথা বলছেন। অবনী স্যার তাকে দেখে খুব লজ্জা পেয়ে বললেন, সন্ধ্যাবেলা এমন ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে হাঁটবি না। খুব সাপের উপদ্রব। তারপরের বছরই স্যার পুরোপুরি পাগল হয়ে গেলেন। তার আত্মীয়স্বজন তাকে নিয়ে ইন্ডিয়া চলে গেল।
কে জানে তিনি নিজেও হয়তো পাগল হয়ে যাচ্ছেন। পুরোপুরি পাগল হবার পর তার স্ত্রী ও মেয়েরা হয়ত তাকে পাবনার মেন্টাল হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে আসবে। পাবনায় ভর্তি হতে কত টাকা লাগে কে জানে। টাকা বেশি লাগলে ভর্তি নাও করাতে পারে। হয়ত নিজেদের বাড়িতেই দরজায় তালাবন্ধ করে রাখবে, কিংবা অন্য কোন দূরের শহরে নিয়ে ছেড়ে দিয়ে আসবে। পাগল পুষতে না পারলে দূরে ছেড়ে দিয়ে আসতে হয়। এতে দোষ হয় না। পাগল তো আর মানুষ না। তারা বোধশক্তিহীন জন্তুর মতই।
মনোয়ারা বিয়েবাড়ি থেকে মেয়েদের নিয়ে ফেরেননি। মেজো মেয়ের মাস্টার এসেছে। শওকত সাহেব বললেন, ওরা কেউ বাসায় নেই। বিয়েবাড়িতে গেছে। আপনি বসেন, চা খান।
মাস্টার সাহেব বললেন, আচ্ছা চা এক কাপ খেয়েই যাই। শওকত সাহেব বুয়াকে চায়ের কথা বলে এসে শুকনো মুখে মাস্টারের সামনে বসে রইলেন। তার মেজাজ একটু খারাপ হল। মাস্টারের চা খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত সামনে বসে থাকতে হবে। টুকটাক কথা বলতে হবে। কি কথা বলবেন?
মাস্টার সাহেব বললেন, আপনার গালে কি হয়েছে?
দাড়ি শেভ করতে গিয়ে গাল কেটে গেছে। আয়নাটা খারাপ, ভাল দেখা যায় না।
নতুন একটা কিনে নেন না কেন?
ইরার মাকে বলেছি–ও সময় করতে পারে না। আপনার ছাত্রী পড়াশোনা। কেমন করছে?
ভাল। ম্যাথ-এ একটু উইক।
আপনি কি শুধু ম্যাথ পড়ান?
আমি সায়েন্স সাবজেক্ট সবই দেখাই–ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি।
বুয়া চা নিয়ে এসেছে। শুধু চা না, পিরিচে পেঁপে এবং মুড়ি। মাস্টার সাহেব আগ্রহ করে তিতা পেঁপে এবং মিয়ানো মুড়ি খাচ্ছেন। প্রাইভেট মাস্টাররা যে কোন খাবার আগ্রহ করে খায়। শওকত সাহেব কথা বলার আর কিছু পাচ্ছেন না। একবার ভাবলেন আয়নার ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলবেন, নিজেকে সামলালেন। কি দরকার?
মাস্টার সাহেব!
জ্বি।
আপনি তো সায়েন্সের টিচার, আয়নাতে যে ছবি দেখা যায়, কিভাবে দেখা যায়?
আলো অবজেক্ট থেকে আয়নাতে পড়ে, সেখান থেকে প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসে।
শওকত সাহেব ইতস্তত করে বললেন, কোন বস্তু যদি আয়নার সামনে না থাকে তাহলে তো তার ছবি দেখার কোন কারণ নেই, তাই না?
মাস্টার সাহেব খুবই অবাক হয়ে বললেন, তা তো বটেই। এটা জিজ্ঞেস করছেন কেন?
এম্নি জিজ্ঞেস করছি। কোন কারণ নাই। কথার কথা। কিছু মনে করবেন না।
শওকত সাহেব খুবই লজ্জা পেয়ে গেলেন।
পরদিন অফিসে যাবার সময় শওকত সাহেব আয়নাটা খবরের কাগজে মুড়ে সঙ্গে নিয়ে নিলেন। কেন নিলেন নিজেও ঠিক জানেন না। অফিসের ড্রয়ারে আয়না রেখে সাজেদুল করিমের সঙ্গে কম্পিউটার নিয়ে ঘটঘট করতে লাগলেন। কিভাবে উইন্ডাে খুলে সেখান থেকে সিস্টেম ফোল্ডার বের করতে হয়, ডাটা এন্ট্রি, ডাটা প্রসেসিং–চৌদ্দ রকম যন্ত্রণা। তিনি মুগ্ধ হলেন ছেলেটার ধৈর্য দেখে। তিনি যে সব গুবলেট করে দিচ্ছেন তার জন্যে সাজেদুল করিম একটুও রাগ করছে না। একই জিনিশ বারবার করে বলছে। এমনভাবে কথা বলছে যেন তিনি বয়স্ক একজন মানুষ না, বাচ্চা একটা ছেলে। সাজেদুল করিম বলল, স্যার, আসুন আমরা একটু রেস্ট নেই। চা খাই। তারপর আবার শুরু করব।
শওকত সাহেব বললেন আমাকে দিয়ে আসলে কিছু হবে না। বাদ দাও।
বাদ দিলে চলবে কি করে স্যার? কম্পিউটার চলে এসেছে। এখন তো আর আপনি লম্বা লম্বা যোগ-বিয়েগ করতে পারবেন না। ব্যালেন্স শীট তৈরি হবে কম্পিউটারে।
শওকত সাহেব ক্লান্ত গলায় বললেন, আমি পারব না। যারা পারবে তারা করবে। চাকরি ছেড়ে দেব।
কি যে স্যার বলেন! চাকরি ছেড়ে দেবেন মানে? চাকরি ছাড়লে খাবেন কি? আপনি মোটেই ঘাবড়াবেন না। আমি আপনাকে কম্পিউটার শিখিয়ে ছাড়ব। আমার সাংঘাতিক জেদ।
চা খেতে খেতে শওকত সাহেব ছেলেটার সঙ্গে কিছু গল্পও করলেন। গল্প করতে খারাপ লাগল না। তবে এই ছেলে কম্পিউটার ছাড়া কোন গল্প জানে না। কোন এক ভদ্রলোক তার কিছু জরুরী ডাটা ভুল করে ইরেজ করে ফেলেছিলেন। প্রায় মাথা খারাপ হবার মত জোগাড়। সেই ডাটা কিভাবে উদ্ধার হল তার গল্প সে এমনভাবে করল যেন এটা এক রোমহর্ষক গল্প।
বুঝলেন স্যার, দুটা প্রোগ্রাম আছে যা দিয়ে ট্রেস ক্যান-এ ফেলে দেয়া ডাটাও উদ্ধার করা যায়। একটা প্রোগ্রামের নাম নর্টন ইউটিলিটিজ, আরেকটার নাম কমপ্লিট আনডিলিট। খুবই চমৎকার প্রোগ্রাম।
শওকত সাহেব কিছুই বুঝলেন না তবু মাথা নাড়লেন যেন বুঝতে পেরেছেন। চা শেষ হবার পর সাজেদুল করিম বলল, স্যার আসুন বিসমিল্লাহ বলে লেগে পড়ি।
শওকত সাহেব লজ্জিত গলায় বললেন, আজ থাক। আজ আর ভাল লাগছে। না।
জিএম সাহেব শুনলে আবার রাগ করবেন।
রাগ করলে করবে। কি আর করা! আমাকে দিয়ে কম্পিউটার হবে না। শুধু শুধু তুমি কষ্ট করছ।
আমার কোন কষ্ট হচ্ছে না। ঠিক আছে, আজ আপনি রেস্ট নিন, কাল আবার। আমরা শুরু করব। আমি তাহলে স্যার আজ যাই।
একটা জিনিশ দেখ তো।
শওকত সাহেব ড্রয়ারে থেকে খবরের কাগজে মোড়া আয়না বের করলেন। খুব সাবধানে কাগজ সরিয়ে আয়না বের করলেন। সাজেদুল করিমের হাতে আয়নাটা দিয়ে বললেন, জিনিশটা একটু ভাল করে দেখ তো।
জিনিশটা কি?
একটা আয়না।
সাজেদুল করিম ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আয়না দেখল। শওকত সাহেব কৌতূহলী গলায় বললেন, দেখলে?
সাজেদুল করিম বিস্মিত হয়ে বলল, দেখলাম।
কি দেখলে বল তো?
পুরানো একটা আয়না দেখলাম। পারা নষ্ট হয়ে গেছে। আর তো কিছু দেখলাম। আর কিছু কি দেখার আছে?
না, আমার শখের একটা আয়না।
শওকত সাহেব আয়নাটা কাগজে মুড়তে শুরু করলেন। সাজেদুল করিম এখনো তার দিকে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে। শওকত সাহেবের মনে হল তিনি ছোটবেলায় অবনী স্যারকে গাছের সঙ্গে কথা বলতে দেখে এই ভাবেই বোধহয় তাকিয়েছিলেন।
সাজেদুল করিম চলে যাবার পর তিনি তার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলেন। আয়নাটা বের করলেন–ঐ তো, মেয়েটাকে দেখা যাচ্ছে। মেয়েটাকে কেমন দুঃখী দুঃখী লাগছে। শওকত সাহেব মৃদু গলায় বললেন, কেমন আছ চিত্রলেখা?
ভাল।
তোমার মুখটা এমন শুকনা লাগছে কেন? মন খারাপ?
হুঁ।
মন খারাপ কেন?
একা একা থাকি তো এই জন্যে মন খারাপ। মাঝে মাঝে আবার ভয় ভয় লাগে।
কিসের ভয়?
জানি না কিসের ভয়। এটা কি আপনার অফিস?
হুঁ।
আপনার টেবিলের উপর এটা কি? বাক্সের মত?
এটা হচ্ছে একটা কম্পিউটার। আইবিএম কম্পিউটার।
কম্পিউটার কি?
একটা যন্ত্র। হিসাব-নিকাশ করে। আচ্ছা শোন চিত্রলেখা, তোমার বাবা-মা আছেন?
জানি না তো।
তুমি আজ কিছু খেয়েছ?
না।
তোমার খিদে লেগেছে?
হুঁ।
তুমি যেখানে থাক সেখানে কোন খাবার নেই?
না।
জায়গাটা কেমন?
জায়গাটা কেমন আমি জানি না। খুব শীত।
শওকত সাহেব দেখলেন মেয়েটা শীতে কাঁপছে। পাতলা সুতির জামায় শীত মানছে না। তিনি কি করবেন বুঝতে পারলেন না। এই শীতার্ত ও ক্ষুধার্ত মেয়েটার জন্যে তিনি কিই বা করতে পারেন। তিনি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আয়নাটা কাগজে মুড়ে ড্রয়ারে রেখে দিলেন। তার নিজেরও খিদে লেগেছে। বাসা থেকে টিফিন কেরিয়ারে করে খাবার এনেছেন। কোন উপায় কি আছে মেয়েটাকে খাবার দেয়ার? আরে, কি আশ্চর্য! তিনি এসব কি ভাবছেন? আয়নায় যা দেখছেন সেটা মনের ভুল ছাড়া আর কিছুই না। এটাকে গুরুত্ব দেয়ার কোন মানে হয় না। আসলে আয়নাটা তার দেখাই উচিত না। তিনি টেফিন কেরিয়ার নিয়ে অফিস ক্যানটিনে খেতে গেলেন। কিন্তু খেতে পারলেন না। বারবার মেয়েটার শুকনা মুখ মনে পড়তে লাগল। তিনি হাত ধুয়ে উঠে পড়লেন।
বাসায় ফিরতে ফিরতে তার সন্ধ্যা হয়ে গেল। সাধারণত অফিস থেকে তিনি সরাসরি বাসায় ফেরেন। আজ একটু ঘুরলেন। সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের বেঞ্চিতে বসে রইলেন। তার ভালই লাগল। ফুরফুরে বাতাস দিচ্ছে, চারদিকে গাছপালা। কেমন শান্তি-শান্তি ভাব। দুপুরে কিছু খাননি বলে খিদেটা এখন জানান দিচ্ছে। বাদামওয়ালা বুট-বাদাম বিক্রি করছে। এক ছটাক বাদাম কিনে ফেলবেন নাকি? কত দাম এক ছটাক বাদামের? তিনি হাত উঁচিয়ে বাদামওয়ালাকে ডাকলেন। তারপরই মনে হল বাচ্চা একটা মেয়ে না খেয়ে আছে। তার মনটা খারাপ হয়ে। গেল। বাদাম না কিনেই তিনি বাসার দিকে রওনা হলেন।
বাসায় ফেরামাত্র তাকে নাশতা দেয়া হল–তিতা পেঁপের টুকরা, মিয়ানো মুড়ি। মনে হয় অনেকগুলি তিতা পেপে কেনা আছে এবং টিন ভর্তি মিয়ানো মুড়ি আছে। এগুলি শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাকে খেতেই হবে। ঘরের ভেতর থেকে হারমোনিয়ামের শব্দ আসছে। অপরিচিত একজন পুরুষ নাকি গলায় সা-রে-গা-মা করছে। ইরার গলাও পাওয়া যাচ্ছে। ইরা গান শিখছে নাকি?
সারেগা রেগামা গামাপা মাপাধা পাধানি ধানিসা ..
মনোয়ারা চায়ের কাপ নিয়ে শওকত সাহেবের সামনে রাখতে রাখতে বললেন, ইরার জন্যে গানের মাস্টার রেখে দিলাম। সপ্তাহে দুদিন আসবে। পনের শ টাকা সে নেয়, বলে-কয়ে এক হাজার করেছি। তবলচিকে দিতে হবে তিন শ। মেয়ের এত শখ। তোমাকে বলে তো কিছু হবে না। কার কি শখ, কি ইচ্ছা, তুমি কিছুই জান না। যা করার আমাকেই করতে হবে।
শওকত সাহেব নিঃশব্দে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। এক হাজার যোগ তিনশ–তের শ। বাড়তি তের শ টাকা কোত্থেকে আসবে? সামনের মাস থেকে বেতন কমে যাবে। প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে দশ হাজার টাকা লোন নিয়েছিলেন, সামনের মাস থেকে পাঁচশ টাকা করে কাটা শুরু হবে। উপায় হবে কি? তিনি কম্পিউটারও শিখতে পারছেন না। সত্যি সত্যি যদি এই বয়সে চাকরি চলে যায়, তখন?
মনোয়ারা বললেন, সোমাদের কলেজ থেকে স্টাডি ট্যুরে যাচ্ছে। তার এক হাজার টাকা দরকার। তোমাকে আগেভাগে বলে রাখলাম। কি, কথা বলছ না কেন?–এ শওকত সাহেব স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে ফ্যাকাসে ভাবে হাসলেন। কিছু বললেন না।
তোমার সঙ্গে বসে যে দুটো কথা বলব সে উপায় তো নেই। মুখ সেলাই করে বসে থাকবে। আশ্চর্য এক মানুষের সঙ্গে জীবন কাটালাম!
মনোয়ারা উঠে চলে গেলেন। ঘরের ভেতর থেকে এখন গানের কথা ভেসে আসছে। মনে হচ্ছে ওস্তাদ টিচার প্রথম দিনেই গান শেখাচ্ছেন–
তুমি বাস কিনা তা আমি জানি না
ভালবাস কি না তা আমি জানি না
আমার কাজ আমি বন্ধু করিয়া যে যাব
চিন্তা হইতে আমি চিতানলে যাব
…
শওকত সাহেব একা বসে আছেন। রাতে ভাত খাবার ডাক না আসা পর্যন্ত একাই বসে থাকতে হবে। আয়নাটা বের করে মেয়েটার সঙ্গে দুটা কথা বললে কেমন হয়? কেউ এসে দেখে না ফেললে হল। দেখে ফেললে সমস্যা।
কেমন আছ চিত্রলেখা?
জি, ভাল আছি। কে গান গাচ্ছে?
আমার বড় মেয়ে।
ইরা?
হ্যাঁ ইরা। তোমার দেখি নাম মনে আছে।
মনে থাকবে না কেন? আমার সবার নামই মনে আছে–ইরা, সোমা, কল্পনা। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনার খুব মন খারাপ। আপনার কি হয়েছে?
কিছু হয়নি রে মা।
শওকত সাহেবের গলা ধরে এল। দিনের পর দিন তার মন খারাপ থাকে। কেউ জানতে চায় না তার মন খারাপ কেন–আয়নার ভেতরের এই মেয়ে জানতে চাচ্ছে। তার চোখে প্রায় পানি আসার উপক্রম হল। তিনি প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্যে বললেন, তুমি কি গান জান?
জি না।
আচ্ছা শোন, তুমি যে বলেছিলে খিদে লেগেছে। কিছু কি খেয়েছ? খিদে কমেছে?
মেয়েটা মিষ্টি করে হাসল। মজার কোন কথা বলছে এমন ভঙ্গিতে বলল, আপনি কি যে বলেন! খাব কি করে? আমাদের এখানে কি কোন খাবার আছে?
খাবার নেই?
না। কিচ্ছু নেই। এটা একটা অদ্ভুত জায়গা। শুধু আমি একা থাকি। কথা বলারও কেউ নেই। শুধু আপনার সঙ্গে কথা বলি।
শওকত সাহেব লক্ষ্য করলেন, মেয়েটা আগের মত দুহাত বুকের উপর রেখে থরথর করে কাঁপছে। তিনি কোমল গলায় বললেন, শীত লাগছে মা?
লাগছে। এখানে খুব শীত। যখন বাতাস দেয় তখন প্রচণ্ড ঠাণ্ডা লাগে। আমার তো শীতের কাপড় নেই। এই একটাই ফ্রক।
দুঃখে শওকত সাহেবের চোখে প্রায় পানি এসে গেল। তখন মনোয়ারা বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। শীতল গলায় বললেন, আয়না হাতে বারান্দায় বসে আছ কেন? কলপনার পাশে বসে তার পড়াটা দেখিয়ে দিলেও তো হয়। সব বাবারাই। ছেলেমেয়ের পড়াশোনা দেখিয়ে দেয়, একমাত্র তোমাকে দেখলাম অফিস থেকে এসে বটগাছের মত বসে থাক। বাবার কিছু দায়িত্ব তো পালন করবে।
শওকত সাহেব আয়নাটা রেখে কল্পনার পড়া দেখানোর জন্যে উঠে দাঁড়ালেন।
২.
সাজেদুল করিম অসাধ্য সাধন করেছে। শওকত সাহেবকে কম্পিউটার শিখিয়ে ফেলেছে।
কি স্যার, বলিনি আপনাকে শিখিয়ে ছাড়ব?
শওকত সাহেব হাসলেন। তার নিজের এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না তিনি ব্যাপারটা ধরে ফেলেছেন। সাজেদুল করিম বলল, আর কোন সমস্যা হবে না। তাছাড়া আমি আপনার জন্যে আরেকটা কাজ করেছি–প্রতিটি স্টেপ কাগজে লিখে এনেছি। কোন সমস্যা হলে কাগজটা দেখবেন। দেখবেন, সব পানির মত পরিষ্কার।
থ্যাংক য়্যু।
আর স্যার, আমার ঠিকানাটা কাগজে লিখে গেলাম। কোন ঝামলো মনে করলেই আমার বাসায় চলে আসবেন।
আচ্ছা। বাবা, তুমি অনেক কষ্ট করেছ।
আপনার অবস্থা দেখে আমার স্যার মনটা খারাপ হয়েছিল। রাতে দেখি ঘুম আসে না। তখন একের পর এক স্টেপগুলি কাগজে লিখলাম। সারারাত চিন্তা করলাম কিভাবে বোঝালে আপনি বুঝবেন।
শওকত সাহেবের চোখে প্রায় পানি আসার উপক্রম হল। তিনি ভেবে পেলেন। এ রকম অসাধারণ ছেলে পৃথিবীতে এত কম জন্মায় কেন?
স্যার, আমি যাই। জিএম সাহেবকে বলে যাচ্ছি আপনি সব শিখে ফেলেছেন, আর কোন সমস্যা নেই। আরেকটা কথা স্যার, কম্পিউটারকে ভয় পাবেন না। তাকে ভয় পাবার কিছু নেই। কম্পিউটার হচ্ছে সামান্য একটা যন্ত্র। এর বেশি কিছু না।
শওকত সাহেবের চোখে এইবার সত্যি সত্যি পানি চলে এল। ছেলেটা যেন চোখের পানি দেখতে না পায় সে জন্যে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলেন। মনে মনে ঠিক করলেন, আজ অফিস থেকে ফেরার পথে ছেলেটার জন্যে একটা উপহার কিনবেন। দামী কিছু না, সেই সামর্থ তার নেই, তবু কিছু কিনে তার বাসায় গিয়ে তাকে দিয়ে আসবেন। একটা কলম বা এই জাতীয় কিছু। শদুই টাকার মধ্যে কলম
পাওয়া গেলে সুন্দর কিছু গোলাপ। তার সঙ্গে পাঁচশ টাকা আছে। টেবিলের ড্রয়ারে খামের ভেতর রাখা।
শওকত সাহেব একশ পঁচাত্তর টাকা দিয়ে একটা ওয়াটারম্যান কলম কিনলেন। তারপর কোন কিছু না ভেবেই চিত্রলেখার জন্যে একটা স্যুয়েটার কিনে ফেললেন। গরমের সময় বলেই ভাল ভাল স্যুয়েটার সস্তায় বিক্রি হচ্ছিল। স্যুয়েটার কিনতে তিনশ চল্লিশ টাকা খরচ হয়ে গেল। শাদা জমিনের উপর নীল ফুল আঁকা। সিনথেটিক উল। দোকানদার বলল, সিনথেটিক হলেও আসল উলের বাবা। শুধু স্যুয়েটার গায়ে দিয়েই তুন্দ্রা অঞ্চলে বরফের চাইয়ের উপর শুয়ে থাকা যায়। শওকত সাহেব জানেন স্যুয়েটার কেনাটা তার জন্যে খুবই বোকামি হয়েছে। চিত্ৰলেখাকে এই স্যুয়েটার তিনি কখনো দিতে পারবেন না। কারণ চিত্রলেখা বলে কেউ নেই। পুরো ব্যাপারটা তার মাথার অসুস্থ কোন কল্পনা। সংসারের দুঃখ-ধান্ধায় তার মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে বলে এইসব হাবিজাবি দেখছেন। তারপরেও মনে হল–মেয়েটা দেখবে জিনিশটা তার জন্যে কেনা হয়েছে। বেচারি খুশি হবে।
সাজেদুল করিমকে তিনি বাসায় পেলেন না। দরজা তালাবন্ধ। দরজার ফাঁক দিয়ে তিনি কলমটা ঢুকিয়ে দিলেন। তার মনে হল, ভালই হয়েছে, সাজেদুল করিম জানল না উপহার কে দিয়েছে। মানুষের সবচে ভাল লাগে অজানা কোন জায়গা থেকে উপহার পেতে।
শওকত সাহেব গভীর আনন্দ নিয়ে বাসায় ফিরলেন। আজকের পেঁপে খেতে আগের মত তিতা লাগল না। চা-টাও খেতে ভাল হয়েছে। তিনি মনোয়ারাকে আরেক কাপ চা দিতে বলে ড্রয়ার থেকে আয়না বের করতে গেলেন। আয়না পাওয়া গেল না। ড্রয়ারে নেই, টেবিলের উপরে নেই, বাথরুমে নেই, বারান্দায় নেই। তিনি পাগলের মত আয়না খুঁজছেন। মেয়েরা কেউ কি নিয়েছে? তিনি। মেয়েদের ঘরে ঢুকে টেবিলের বইপত্র এলোমেলো করতে শুরু করলেন।
ইরা বলল, বাবা, তুমি কি খুঁজছ?
আয়নাটা খুঁজছি। আমার একটা হাত-আয়না ছিল না? ঐ আয়নাটা।
ঐ আয়না তুমি কোথাও খুঁজে পাবে না। মা তোমার জন্যে নতুন আয়না কিনেছে। ওটা ফেলে দিয়েছে।
শওকত সাহেব হতভম্ব গলায় বললেন, এই সব কি বলছিস? কোথায় ফেলেছে?
পুরানো একটা আয়না ফেলে দিয়েছে। তুমি এ রকম করছ কেন বাবা?
শওকত সাহেব বিড়বিড় করে কি যেন বললেন, কিছু বোঝা গেল না। ইরা ভয় পেয়ে তার মাকে ডাকল। মনোয়ারা এসে দেখেন শওকত সাহেব খুব ঘামছেন। তার কপাল বেয়ে ফোটা ফোটা ঘাম পড়ছে। তিনি ধরা গলায় বললেন, মনোয়ারা, আয়না কোথায় ফেলেছ?
রাত এগারোটা বাজে। শওকত সাহেব বাসার পাশের ডাস্টবিন হাতড়াচ্ছেন। তার সারা গায়ে নোংরা লেগে আছে। তার সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি দুহাতে ময়লা ঘেটে যাচ্ছেন। একটু দূরে তার স্ত্রী ও তিন কন্যা দাঁড়িয়ে। তাদের চোখে রাজ্যের বিস্ময়। বড় মেয়ে কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, তোমার কি হয়েছে। বাবা?
শওকত সাহেব ফিসফিস করে বললেন, চিত্রলেখাকে খুঁজছি রে মা। চিত্রলেখা।
চিত্রলেখা কে?
আমি জানি না কে?
শওকত সাহেবের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। তিনি কাপা কাপা গলায় ডাকছেন–চিত্রা মা রে, ওমা, তুই কোথায়?
কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, চলচ্চিত্র নির্মাতা, গীতিকার, শিক্ষক। হুমায়ূন আহমেদের জন্ম ১৩ নভেম্বর ১৯৪৮ সনে, নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জে তাঁর মাতামহের বাড়িতে। তাঁর পৈত্রিক বাড়ি নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার কুতুবপুর গ্রাম। তাঁর পিতা ফয়জুর রহমান আহমেদ এবং মা আয়েশা আখতার খাতুন (বর্তমানে আয়েশা ফয়েজ নামে পরিচিত)। ফয়জুর রহমান আহমেদ পুলিশ বিভাগে চাকরি করতেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি পিরোজপুর মহকুমার এসডিপিও হিসেবে কর্মরত ছিলেন এবং কর্তব্যরত অবস্থায় পাকবাহিনীর হাতে শহীদ হন। সঙ্গত কারণেই হুমায়ূন আহমেদ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জ্বীবিত ছিলেন। ১৯৭১ সালে পাকবাহিনী তাঁকে ধরে নিয়ে কিছুদিন আটক করে রাখে এবং দৈহিক নির্যাতন করে।
পারিবারিক পরিমন্ডলে সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার অনুকূল আবহে হুমায়ূন আহমেদের শৈশব জীবন অতিবাহিত হয়। তাঁর পিতার সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ ছিল। তিনি সমকালীন পত্র-পত্রিকায় লেখা প্রকাশ করতেন। বগুড়ায় অবস্থানকালে দীপ নেভা যার ঘরে শিরোনামে তাঁর একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। সন্তানদেরও তিনি পড়াশোনার পাশাপাশি সাহিত্যচর্চার জন্য উৎসাহ দিতেন। হুমায়ূনের অনুজ মুহম্মদ জাফর ইকবাল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং একজন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক। তিনি মূলত শিশু-কিশোরদের জন্য কল্পবিজ্ঞান গল্প ও কাহিনী রচনা করেন। তাঁর সর্বকনিষ্ঠ ভ্রাতা আহসান হাবীব রম্যলেখক ও কার্টুন ম্যাগাজিন ‘উন্মাদ’-এর সম্পাদক। তাঁদের মা আয়েশা ফয়েজও লেখালেখি করতেন। জীবন যেরকম শিরোনামে তাঁর একটি আত্মজৈবনিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ২০০৮ সালে। শৈশবে হুমায়ূন আহমেদের নাম ছিল শামসুর রহমান। তাঁর একটি লেখা থেকে জানা যায়, তাঁদের পিতা ছেলেমেয়েদের নাম পরিবর্তন করতেন। তাই তিনি নিজেই পুত্রের আগের নাম পরিবর্তন করে রাখেন হুমায়ূন আহমেদ। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে হুমায়ূন ছিলেন সবার বড়।
পিতার সরকারি চাকরির সুবাদে হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের সিলেট, জগদ্দল, পঞ্চগড়, রাঙামাটি, চট্টগ্রাম, বগুড়া, কুমিল্লা ও পিরোজপুরে অবস্থান করেন। সিলেট জেলা শহরের কিশোরীমোহন পাঠশালায় তাঁর শিক্ষাজীবনের সূচনা। ১৯৬৫ সালে তিনি বগুড়া জেলা স্কুল থেকে বিজ্ঞান বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন (রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান) ১৯৬৭ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ১৯৭০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন শাস্ত্রে প্রথম শ্রেণিতে বিএসসি (সম্মান) এবং ১৯৭২ সালে এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সময় তিনি মহসিন হলে অবস্থান করতেন। পরবর্তী পর্যায়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পলিমার রসায়ন বিষয়ে গবেষণা করে ১৯৮২ সালে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (ময়মনসিংহ) প্রভাষক হিসেবে শুরু হয় হুমায়ূন আহমেদের কর্মজীবন। ১৯৭৪ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দেন। ১৯৯০ সালের মাঝামাঝি সময়ে তিনি অধ্যাপনা পেশা থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং সার্বক্ষণিক সাহিত্যর্চ্চায় মনোনিবেশ করেন। এর পাশাপাশি চলে নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মাণ।
বাংলা কথাসাহিত্যে হুমায়ূন আহমেদ একজন ব্যতিক্রমী লেখক। রচনার ব্যাপ্তি, বিষয়ের বৈচিত্র্য, চরিত্র নির্মাণ, রচনাশৈলী, সংলাপ প্রভৃতি মিলিয়ে তিনি এক অভিনব ধারা সৃষ্টি করেন, যা একান্তই তাঁর নিজস্ব শৈলী হিসেবে স্বীকৃত। তাঁর উপস্থিত বুদ্ধিজাত প্রকাশ ও রসবোধের কারণে তাঁর রচনা সহজেই পাঠকের চিত্ত স্পর্শ করে। বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের গতানুগতিক ধারাকে অতিক্রম করে হুমায়ূন আহমেদ নির্মাণ করেন এক স্বতন্ত্র ভুবন। একজন সফল লেখক হিসেবে সাহিত্য-শিল্পের বিভিন্ন শাখায় স্বচ্ছন্দ বিচরণ তাঁকে এনে দেয় বিপুল জনপ্রিয়তা। বহুমাত্রিকতা তাঁর রচনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ।
ছাত্রজীবনে লেখা নন্দিত নরকে শিরোনামের নাতিদীর্ঘ উপন্যাসের মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যে হুমায়ূন আহমেদের আবির্ভাব। ১৯৭২ সালে তিনি উপন্যাসটি রচনা করেন এবং সে বছরই উপন্যাসটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। নন্দিত নরকে বাংলাদেশের পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগায়। তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস শঙ্খনীল কারাগার (১৯৭৩)। গল্প, উপন্যাস, সায়েন্স ফিকশন, শিশুতোষ গ্রন্থ, নাটক, প্রবন্ধ, আত্মজৈবনিক রচনা প্রভৃতি মিলিয়ে তাঁর গ্রন্থের সংখ্যা তিন শতাধিক। তাঁর শেষ উপন্যাস দেয়াল (অপ্রকাশিত-পটভূমি ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকান্ড ও তৎকালীন রাজনৈতিক ঘটনা)। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে লেখা জনপ্রিয় উপন্যাস জোছনা ও জননীর গল্প। হুমায়ূন আহমেদকে বাংলাদেশের সায়েন্স ফিকশনের পথিকৃৎ বলা যায়। তাঁর অন্যতম সায়েন্স ফিকশন তোমাদের জন্য ভালোবাসা। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রচিত উল্লেখযোগ্য উপন্যাস মধ্যাহ্ন এবং বাদশাহ নামদার। আত্মজৈবনিক রচনায়ও তিনি স্বচ্ছন্দ। তাঁর স্মৃতিকথাগুলো সুখপাঠ্য।
বিষয়বস্ত্তর দিক থেকে হুমায়ূন আহমেদের গ্রন্থসম্ভার কয়েকটি শ্রেণিতে বিন্যাস করা যায়। যেমন: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: শ্যামল ছায়া (১৯৭৪), আগুনের পরশমণি (১৯৮৬), অনিল বাগচীর একদিন (১৯৯২), ১৯৭১ (১৯৯৩), জোছনা ও জননীর গল্প (২০০৪) প্রভৃতি। স্থান-কাল ও বিষয়ভিত্তিক প্রধান গ্রন্থ: শঙ্খনীল কারাগার (১৯৭৩), আনন্দ বেদনার কাব্য (১৯৮৪), যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ (১৯৮৪), আমার আছে জল (১৯৮৫), ফেরা (১৯৮৬), নক্ষত্রের রাত (১৯৮৭), প্রিয়তমেষু (১৯৮৮), বাসর (১৯৮৮), এলেবেলে (১ম পর্ব-১৯৯০), এলেবেলে (২য় পর্ব-১৯৯০), সাজঘর (১৯৮৯), ছায়াসঙ্গী (১৯৯০), এই সব দিনরাত্রি (১৯৯০), বহুব্রীহি (১৯৯০), অয়োময় (১৯৯০), গৌরীপুর জংশন (১৯৯০), শ্রাবণ মেঘের দিন (১৯৯০), আশাবরী (১৯৯১), অমানুষ (১৯৯১), চাঁদের আলোয় কয়েকজন যুবক (১৯৯১), দুই দুয়ারী (১৯৯১), নৃপতি (১৯৯১), নী (১৯৯২), কোথাও কেউ নেই (১৯৯২), মন্দ্রসপ্তক (১৯৯৩), কবি (১৯৯৬), মহাপুরুষ (১৯৯৬), আমাদের সাদা বাড়ি (১৯৯৬), মেঘ বলেছে যাব (১৯৯৭), দূরে কোথায় (১৯৯৭), বৃষ্টিবিলাস (২০০০), মৃন্ময়ী (২০০১), হুমায়ূন আহমেদের হাতে ৫টি নীল পদ্ম (২০০১), বৃষ্টি ও মেঘমালা (২০০১), আজ চিত্রার বিয়ে (২০০৩), এপিটাফ (২০০৪), লীলাবতী (২০০৫), তিন পুরুষ (২০০৫), মধ্যাহ্ন-১ (২০০৭), মধ্যাহ্ন-২ (২০০৮), বৃক্ষকথা (২০০৯), বাদশাহ নামদার (২০১১), মেঘের ওপর বাড়ি (২০১২) প্রভৃতি।
সায়েন্স ফিকশন: তোমাদের জন্য ভালোবাসা (১৯৭৩), তারা তিনজন (১৯৮৪), ইরিনা (১৯৮৮), কুহক (১৯৯১), ফিহা সমীকরণ (১৯৯২), শূন্য (১৯৯৪), ইমা (১৯৯৮), অনন্ত নক্ষত্র বীথি (১৯৯৮), ওমেগা পয়েন্ট (২০০০), দ্বিতীয় মানব (২০০২) প্রভৃতি। তাঁর বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ কোয়ান্টাম রসায়ন। রহস্যধর্মী ও ভূত বিষয়ক: বোতল ভূত (১৯৮৯), ভূত ভূতং ভূতৌ (১৯৯১), ভয় (১৯৯১), একি কান্ড (১৯৯৩), চেরাগের দৈত্য এবং বাবলু (১৯৯৭), বোকাভু (১৯৯৭), কানী ডাইনী (২০০০), ভূতসমগ্র (২০০২), মজার ভূত (২০০৫), ভয়ংকর ভূতুড়ে (২০০৮), অতিপ্রাকৃত (২০০৮), নির্বাচিত ভূতের গল্প (২০০৯), ভূতমন্ত্র (২০১০) প্রভৃতি।
শিশু-কিশোর গ্রন্থ: নুহাশ এবং আলাদিনের আশ্চর্য চেরাগ (১৯৯২), ছোটদের সেরা গল্প (১৯৯৫), পরীর মেয়ে মেঘবতী (১৯৯৭), তোমাদের জন্য রূপকথা (১৯৯৮), কালো জাদুকর (১৯৯৮), কাক ও কাঠগোলাম (২০০২), ছোটদের জন্য এক ব্যাগ হুমায়ূন (২০০৩), বোকা রাজার সোনার সিংহাসন (২০০৩), নীল মানুষ (২০০২), কুহুরানী (২০০৬), হলুদ পরী (২০০৯), বনের রাজা (২০১০) প্রভৃতি।
আত্মজৈবনিক গ্রন্থ: হোটেল গ্রেভারইন (১৯৮৯), আমার ছেলেবেলা (১৯৯১), কিছু শৈশব (২০০৭), বলপয়েন্ট (২০০৯), কাঠপেন্সিল (২০০৯), ফাউন্টেন পেন (২০১১), রঙ পেন্সিল (২০১১), নিউইয়র্কের নিলাকাশে ঝকঝকে রোদ (২০১২)।
হিমু সিরিজ: ময়ূরাক্ষী (১৯৯০), দরজার ওপাশে (১৯৯৩), হিমু (১৯৯৩), পারাপার (১৯৯৩), এবং হিমু (১৯৯৫), হিমুর হাতে কয়েকটি নীল পদ্ম (১৯৯৬), হিমুর দ্বিতীয় প্রহর (১৯৯৭), হিমুর রূপালী রাত্রি (১৯৯৮), একজন হিমু কয়েকটি ঝিঁঝিঁ পোকা (১৯৯৯), তোমাদের এই নগরে (২০০০), সে আসে ধীরে (২০০২), চলে যায় বসন্তের দিন (২০০২), হিমু মামা (২০০৪), আঙুল কাটা জগলু (২০০৫), হলুদ হিমু কালো র্যাব (২০০৬), আজ হিমুর বিয়ে (২০০৭), হিমু রিমান্ডে (২০০৮), হিমুর একান্ত সাক্ষাৎকার ও অন্যান্য (২০০৮), হিমুর মধ্যদুপুর (২০০৯), হিমুর বাবার কথামালা (২০০৯), হিমুর নীল জোছনা (২০১০), হিমু এবং একটি রাশিয়ান পরী (২০১১), হিমুর আছে জল (২০১১), হিমু এবং হার্ভার্ড পিএইচ.ডি বল্টু ভাই (২০১২) প্রভৃতি।
মিসির আলি সিরিজ: দেবী (১৯৮৫), অন্যভুবন (১৯৮৭), বিপদ (১৯৯১), মিসির আলির অমীমাংসিত রহস্য (১৯৯৪), তন্দ্রাবিলাস (১৯৯৭), আমিই মিসির আলি (২০০০), বাঘবন্দি মিসির আলি (২০০১), নিশীথিনী (২০০৪), নিষাদ (২০০৪), বৃহন্নলা (২০০৪), কহেন কবি কালিদাস (২০০৫), মিসির আলির চশমা (২০০৮) প্রভৃতি।
শুভ্র সিরিজ: দারুচিনি দ্বীপ (১৯৯১), রূপালী দ্বীপ (১৯৯৪), শুভ্র (১৯৯৮), এই শুভ্র ! এই (২০০৩), শুভ্র গেছে বনে (২০১০) প্রভৃতি।
আশির দশকে বাংলাদেশের টেলিভিশন নাটক ও ধারাবাহিক নাটকের ইতিহাসে তিনি আলোড়ন সৃষ্টি করেন। হুমায়ূনের প্রথম টেলিভিশন নাটক প্রথম প্রহর (১৯৮৩, পরিচালনা- নওয়াজেস আলী খান)। তাঁর প্রথম ধারাবাহিক নাটক এইসব দিনরাত্রি বাংলাদেশের দর্শকদের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়। এ ছাড়া অন্যান্য জনপ্রিয় ধারাবাহিকের মধ্যে আছে: বহুব্রীহি (কমেডি), অয়োময় (সামাজিক-ঐতিহাসিক), কোথাও কেউ নেই (নাগরিক জীবনভিত্তিক), আজ রবিবার (পারিবারিক-সামাজিক), নক্ষত্রের রাত (আধুনিক জীবনসমস্যা) এবং অসংখ্য একক ও ধারাবাহিক নাটক।
হুমায়ূন আহমেদ চলচ্চিত্র নির্মাণেও সার্থক। তাঁর প্রথম ছবি আগুনের পরশমণি (১৯৯৫) এবং শেষ ছবি ঘেটুপুত্র কমলা (২০১২)। তাঁর উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র শ্যামল ছায়া ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি অবলম্বনে নির্মিত। এটি ‘অস্কার একাডেমী পুরস্কার’-এর জন্য ‘সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র’ বিভাগে বাংলাদেশ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য নির্বাচিত হয়। অন্যান্য চলচ্চিত্র : শ্রাবণ মেঘের দিন (২০০০), দুই দুয়ারী (২০০১), চন্দ্রকথা (২০০৩), নয় নম্বর বিপদ সংকেত (২০০৭) এবং আমার আছে জল (২০০৮)। ৮৫তম অস্কার বাংলাদেশ কমিটি ৮৫তম একাডেমী অ্যাওয়ার্ড (অস্কার) প্রতিযোগিতার জন্য ঘেটুপুত্র কমলা ছবিটি মনোনীত করে। সুস্থ ধারার চলচ্চিত্র উপহার দিয়ে হুমায়ূন আহমেদ মধ্যবিত্ত দর্শকদের হলমুখী করে তোলেন। তাঁর উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয় কয়েকটি চলচ্চিত্র। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য মোরশেদুল ইসলাম পরিচালিত দূরত্ব (২০০৬), সুভাষ দত্ত পরিচালিত আবদার, বেলাল আহমেদ পরিচালিত নন্দিত নরকে, আবু সাইদ পরিচালিত নিরন্তর, শাহ আলম কিরণ পরিচালিত সাজঘর (২০০৭) এবং তৌকির আহমেদ নির্মিত দারুচিনি দ্বীপ ।
বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার গল্প হুমায়ূন আহমেদ তুলে ধরেন সহজ সাবলীল ও হূদয়গ্রাহী ভাষায়। ব্যক্তি-মানুষের আনন্দ-বেদনা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, আবেগ-অভিমান, হতাশা-বঞ্চনা, মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা আর অন্যদিকে সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত- সবকিছুই অসাধারণ নৈপূণ্য প্রতিভাত তাঁর রচনায়। ব্যক্তিজীবনের নিতান্ত সাদামাটা ঘটনা থেকে শুরু করে পারিবারিক জীবনের বহুমাত্রিক অনুষঙ্গ, মানুষের দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সম্পর্কের টানাপোড়েনের চিত্র সুনিপুণভাবে উঠে আসে তাঁর গল্প-উপন্যাস ও নাটকে। ঐতিহাসিক ঘটনা ও চরিত্র অবলম্বনে লেখা উপন্যাসেও তিনি অত্যন্ত পটু।
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্প-উপন্যাসে তাঁর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বেদনা প্রবলভাবে ফুটে ওঠেছে, যা সমগ্র জাতির দুঃখ, বেদনা ও সংগ্রামের সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী লেখকের বর্ণনার কৌশলে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। অতিপ্রাকৃত ঘটনাবলি তিনি উপস্থাপন করেন বাস্তবতার আবরণে, যা পাঠক সানন্দে গ্রহণ করে। তাঁর শিশুতোষ রচনা নির্মল আনন্দের পরিবেশ তৈরি করে। ভূতের গল্পগুলো আকর্ষণীয় এবং রোমাঞ্চকর।
হুমায়ূন আহমেদের রচনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য চরিত্র নির্মাণ। তাঁর গল্প-উপন্যাস-নাটকের চরিত্রদের প্রায় সকলেই যেন পরিচিত মানুষ। পারিপার্শ্বিকতার অতি চেনা সাদামাটা মানুষ থেকে শুরু করে খেয়ালি, মনস্তাত্ত্বিক – সব ধরনের চরিত্রের সমাবেশ ঘটান তিনি। কিছু চরিত্র আছে প্রতীকী। এদের কেউ কেউ খ্যাপা, পাগলাটে। তাঁর কল্পনাশক্তি এক একটি চরিত্রকে পাঠকের অন্তরে ঠাঁই করে দেয়। হিমু, মিসির আলি, শুভ্র, বাকের ভাই – এরা এই শ্রেণির চরিত্র। এদের মধ্যে আছে প্রগাঢ় মানবিক মূল্যবোধ ও বৈশিষ্ট্য। হিমু বেকার যুবকের প্রতিভূ একটি খেয়ালি চরিত্র। হলুদ জামা পরে, খালি পায়ে ঘুরে বেড়ায়, কথাবার্তা ও চিন্তাভাবনায় কিছুটা উদ্ভট, যুক্তি মানে না। তবে সে সৎ ও বিবেকবান। কখনো মিথ্যা কথা বলে না, কারও ক্ষতি করে না; বরঞ্চ মানুষের উপকার করতে ভালোবাসে। হিমুর মধ্যে একটি সূক্ষ্ম ও প্রবল চেতনাবোধ কাজ করে। হিমু বিশ্বাস করে, সব মানুষের মধ্যেই একটা ইতিবাচক দিক থাকে এবং শেষ পর্যন্ত সকল অন্ধকারের মধ্যেও মানুষের শুভবোধেরই জয় হয়। প্রকারান্তরে এটা লেখকেরই অন্তর্নিহিত জীবনদর্শন।
অন্যদিকে মিসির আলি একজন যুক্তিবাদী মনস্তত্ত্ববিদ, যিনি আবেগের চেয়ে যুক্তিকে প্রাধান্য দেন এবং চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনার রহস্য উন্মোচন করেন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও যুক্তি দিয়ে। মিসির আলি সত্যসন্ধানী এবং ভালো মানুষ। হিমু ও মিসির আলি যেন লেখকেরই দুই সত্তা। শুভ্র চরিত্রটিও বিবেকী মানুষেরই প্রতিভূ। কোথাও কেউ নেই নাটকের ’বাকের ভাই’ চরিত্রটি প্রবল জনপ্রিয়তা লাভ করে । একটি নাটক ও তার চরিত্র কতটা বস্ত্তনিষ্ঠ ও জীবনধর্মী হলে দর্শক এ ধরনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে পারে, তা একমাত্র হুমায়ূন আহমেদের নাটকেই প্রতীয়মান হয়ে ওঠে। এ ঘটনা আমাদের সামাজিক অবক্ষয় এবং তার বিপরীতে বিবেকবানদের প্রতিবাদের প্রতীকী চিত্র। অধিকাংশ নাটকেই তিনি সমাজের বিরাজমান অন্যায়, অবিচার ও সামাজিক অসঙ্গতিগুলো স্পষ্টভাবে তুলে ধরেন। চরিত্রচিত্রণের ভিতর দিয়ে প্রকাশ পায় লেখকের সুগভীর জীবনবোধ। শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে স্বাধীনতা-বিরোধী রাজাকারদের প্রতি তাঁর ঘৃণা অবশ্যই ছিল। একজন সাহিত্যিক হয়ে তা তিনি সরাসরি ব্যক্ত না করে নাটকের মাধ্যমে বার্তাটি টিয়া পাখির মুখ দিয়ে এভাবে প্রকাশ করেন- ‘তুই রাজাকার’। মাত্র দুটি শব্দের মধ্য দিয়ে রাজাকারদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশের এই অভিব্যক্তি অসাধারণ।
বাংলাদেশের লোকায়ত জীবন ও লোকজ সংস্কৃতির প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল গভীর। এই মনোভাবের প্রতিফলন ঘটে তাঁর গল্প-উপন্যাস-নাটকের বিষয়বস্ত্ত, আবহ ও চরিত্র নির্মাণে। নেত্রকোনা ও বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের সমাজজীবনের প্রেক্ষাপট নানাভাবে এসেছে তাঁর রচনায়। সামন্ততান্ত্রিক সমাজের প্রতিনিধিত্বশীল জমিদার চরিত্র তাঁর অধিকাংশ নাটকের প্রধান কুশীলব হয়ে ওঠে। ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ভাষা বিশেষ ব্যঞ্জনা পায় তাঁর নাটকে। এ ছাড়া তাঁর মনোজগতে অধ্যাত্মচেতনাও প্রবল ছিল। এ কারণেই হয়ত তাঁর রচনায় বাউল, ফকির ও সাধক শ্রেণির মানুষের বিচরণ লক্ষণীয়।
কাহিনী বলার ধরন, বিষয়ের বৈচিত্র্য, বর্ণনায় পরিমিতিবোধ, নাটকীয় চমক সৃষ্টি, ভিন্নধর্মী চরিত্র নির্মাণ, প্রাঞ্জল ভাষা প্রয়োগ হুমায়ূন আহমেদের রচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য। সংলাপ রচনায় তিনি সিদ্ধহস্ত ও কালজয়ী। তিনি নিজের মতো করে সাহিত্যের ভাষা ও সংলাপ তৈরি করেন, যা পাঠককে আকৃষ্ট করে।
হুমায়ূন আহমেদের বহুমাত্রিক সৃজনকর্মের মধ্যে সঙ্গীত একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। তিনি কেবল নিজের নাটক ও চলচ্চিত্রের জন্য গান রচনা করেছেন। স্বল্পসংখ্যক গান রচনা করলেও এসব গান ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং অ্যালবাম আকারে প্রকাশিত হয়। উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে রয়েছে: মরিলে কান্দিস না আমার দায়, আমি আজ ভেজাব চোখ সমুদ্রের জলে, চাঁদনি পসর রাতে যেন আমার মরণ হয়, আমার আছে জল, মনে বড় আশা ছিল প্রভৃতি। তাঁর রচিত শেষ গান: ঠিকানা আমার নোট বুকে আছে/নোট বুক নেই কাছে। মৃত্যুর প্রায় একমাস আগে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এ গানটি রচনা করেন তাঁর চিত্রনাট্য অবলম্বনে নির্মিতব্য ‘যদি ভালো না লাগে তো দিও না মন’ টেলিছবির জন্য। হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের লোকসঙ্গীতকেও সার্থকভাবে প্রয়োগ করেছেন নাটকে ও চলচ্চিত্রে। রবীন্দ্রসঙ্গীত থেকে আরম্ভ করে হাছন রাজা, লালন শাহ ও অন্যান্য লোকশিল্পীর গান এমনকি লোকশিল্পীকে তিনি অনায়াসে ব্যবহার করেছেন তাঁর নাটকে।
সৃজনশীলতার স্বীকৃতিস্বরূপ হুমায়ূন আহমেদ বহু পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য: লেখক শিবির পুরস্কার (১৯৭৩), বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৮১), মাইকেল মধুসূদন দত্ত পুরস্কার (১৯৮৭), হুমায়ূন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯০), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার [শ্রেষ্ঠ কাহিনী – ১৯৯৩, শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র- ১৯৯৪, শ্রেষ্ঠ সংলাপ – ১৯৯৪], একুশে পদক (১৯৯৪), শেলটেক পুরস্কার (২০০৭)। বাংলাদেশের বাইরেও তিনি সম্মাননা পেয়েছেন। জাপান টেলিভিশন NHK তাঁকে নিয়ে পনের মিনিটের একটি প্রামান্যচিত্র প্রচার করে Who is who in Asia শিরোনামে।
লেখক হিসেবে তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব বিশাল পাঠকসমাজ তৈরি এবং তরুণ প্রজন্মকে বই পাঠে আগ্রহী করে তোলা। বছর বছর তাঁর রচনার কলেবর বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পাঠকের সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। তাঁর রচনার পাঠকদের অধিকাংশই তরুণ- স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং সর্বস্তরের মানুষ। একসময় পশ্চিমবঙ্গের গল্প-উপন্যাসের দিকে তাকিয়ে থাকতে হতো এদেশের পাঠকদের। সেই পাঠকশ্রেণিকে হুমায়ূন আহমেদ গৃহমুখী অর্থাৎ দেশমুখী করে তোলেন তাঁর যাদুকরি সাহিত্যসম্ভার দিয়ে। সাহিত্য-শিল্পের একটি মুখ্য উদ্দেশ্য মানুষকে বিনোদন ও আনন্দ দেওয়া। এ কাজটি তিনি অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন করেন। উনিশ শতকের সমকালীন পটভূমিতে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। জনপ্রিয়তার দিক থেকে হুমায়ূন আহমেদ শরৎচন্দ্রকে ছাড়িয়ে যান। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য-সমালোচক এবং পাঠকদের কাছেও তিনি শক্তিমান লেখক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন।
বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের অগ্রগতির ক্ষেত্রে হুমায়ূন আহমেদের অবদান অতুলনীয়। এদেশের সৃজনশীল প্রকাশনা শিল্পকে ম্রিয়মাণ অবস্থা থেকে গতিশীল পর্যায়ে নিয়ে আসেন তিনি। তিনি এককভাবেই বইয়ের বাজার তৈরি এবং প্রকাশনা শিল্পে পুঁজির প্রবাহ সৃষ্টি করেন। তাঁর সৃষ্টিশীল লেখার কল্যাণে বাংলাবাজারের অসংখ্য পুস্তক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান একটি শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াতে সক্ষম হয়। প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে আয়োজিত বাংলা একাডেমীর বইমেলায় বিক্রি হওয়া সৃজনশীল গ্রন্থের একটি বড় অংশ হুমায়ুন আহমেদের। তিনি ছিলেন বাংলা একাডেমীর বইমেলার প্রধান আকর্ষণ।
সাহিত্য জগতের সংকীর্ণ দলাদলি বা রাজনীতির সঙ্গে হুমায়ূন কখনো জড়িত হননি। তবে দেশ ও জাতির সমস্যার ব্যাপারে উদাসীন ছিলেন না। তাই দেশের যে কোনো সংকটময় মূহুর্তে তিনি সুচিন্তিত মতামত ও বক্তব্য প্রকাশ করতেন। নিজের সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে পিতৃভূমি নেত্রকোনায় তিনি একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এ স্কুল নিয়ে তাঁর অনেক স্বপ্ন ছিল, যা জীবদ্দশায় পূরণ করে যেতে পারেননি।
নিসর্গ-প্রেমিক হুমায়ূন আহমেদ নাগরিক জীবনের কোলাহল থেকে দূরে প্রকৃতির কোলে সময় কাটাতে ভালোবাসতেন। তাই গাজীপুরের পিরুজালি গ্রামে স্থাপন করেন ‘নুহাশ পল্লী’ (তাঁর প্রথম পুত্র নুহাশ-এর নামে এই নামকরণ) এবং সেন্ট মার্টিনস দ্বীপে ‘সমুদ্র বিলাস’ নামে বাড়ি। নুহাশ পল্লীকে সাজিয়েছেন নয়নাভিরাম বৃক্ষ, দিঘি ও ভাস্কর্য দিয়ে। প্রায় দু’শ প্রজাতির ঔষধি গাছ রোপন করে নির্মাণ করেন একটি উদ্যান এবং তাঁর অকাল প্রয়াত সন্তানের নামে তার নামকরণ করেন ‘রাশেদ হুমায়ূন ঔষধি উদ্যান’।
১৯৭৩ সালে প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খানের নাতনি গুলতেকিন খানকে বিয়ে করে হুমায়ূন আহমেদ সংসার জীবন আরম্ভ করেন। এই দম্পতির তিন মেয়ে ও এক ছেলে। ২০০৩ সালে গুলতেকিনের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটার পর হুমায়ূন আহমেদ ২০০৫ সালে বিয়ে করেন অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওনকে। হুমায়ূন-শাওন দম্পতির দুটি পুত্র সন্তান। মৃত্যু নিউইয়র্কে, ১৯ জুলাই ২০১২। গাজীপুরের ‘নুহাশ পল্লী’-তে তাঁকে সমাহিত করা হয়।