| 29 মার্চ 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

বদ্বীপ                  

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

                                           

পাশের বাড়ির ছাদেও সন্ধ্যা নামছে, তার পাশের বাড়ির ছাদেও …তার পাশের বাড়ি…গোটা শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামছে। তিনতলার উচ্চতা থেকে শুনশান শহরের রাস্তা দেখতে দেখতে সৃঞ্জয়ের মনে হলো সব কিছু থেমে রয়েছে কারও ইশারায়, আবার ইশারা হলেই বুঝি চলতে শুরু করবে! একটা নেড়ি নিশ্চিন্তে ধীরেসুস্থে রাস্তা পেরিয়ে গেল, ওদের শহরে নীলগাই নেই,  হরিণ নেই। খবরে দেখেছে, সোশ্যাল মিডিয়াতেও, কোনো কোনো শহরে কোনঠাসা বন্যরা নিরুপদ্রব রাস্তা পেরিয়ে যাচ্ছে। স্ত্বব্ধ হয়ে যাওয়া শহর এখন ঘরে বন্দী, তাদের বিরক্ত করার কেউ নেই, দুরন্ত বেগে কোনো এস ইউ ভি এসে থেঁতলে দেওয়ার জন্য রাস্তায় ছুটে আসবে না। তারা বুঝে গেছে মানুষ এখন নিজেই ভিষণ কোনঠাসা হয়ে ঘরে ঢুকে গেছেভিষণ ভিষণ ভয় পেয়ে গেছে তারা। 

ছাদের পাঁচিলে রাখা চা জুড়িয়ে গেছে। ঠান্ডা হয়ে যাওয়া চা তিন চুমুকে শেষ করে নিস্তব্ধ সন্ধ্যার অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকে সৃঞ্জয়। আজ নিয়ে সাতদিন হয়ে গেল গৃহবন্দী সে, শুধু কি সে! গোটা পাড়া, গোটা শহর। ইতিউতি দু একজন বেপরোয়া মানুষজন, কিংবা খুব প্রয়োজনের তাড়নায় বেরিয়ে এসেছে বাড়ি থেকে।

মাইকে রোজ বলে যাচ্ছে “ বাড়ি থেকে বেরবেন না, ঘরেই থাকুন, সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখুন- এই কথাটা এরকম আনুষ্ঠানিক ভাবে এই প্রথম শুনছে সৃঞ্জয়- সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখুন!

সবার মতোই কিছু রসদ মজুত করেছে সৃঞ্জয় , চাল , ডাল, আনাজ- কতদিনের জন্য জানে না! যতদিন চলে চলবে , তারপর আবার জোগাড় করতে হবে। এই প্রথম চাল নিতে গিয়ে , মুদিখানায় গিয়ে লাইনে দাঁড়াতে হলো সৃঞ্জয়কে ! গোল গোল দাগ কাটা রয়েছে দোকানের সামনে। মানুষে মানুষে দুরত্ব এখন অন্তত এক মিটার নির্ধারিত করা হয়েছে ! সবাই মুখোস পরে রয়েছে , সৃঞ্জয়ও …

 এর থেকে বেশি  কাছে আসার , দেখার, কথা বলার মাধ্যম এখন  একমাত্র ভিডিও কল। সৃঞ্জয়ের বন্ধু অনিমেশ ব্যাঙ্গালুরু থেকে কাল ভিডিও কল করেছিলো , জানালো গত চোদ্দোদিন সে বাড়িতেই , বাড়িতে বসেই কাজের নির্দেশ আছে এখন তাদের। পাশের ছটা বাড়ি পরে পাড়ার বন্ধু অরিন্দমকে ভিডিও কলে সৃঞ্জয়ের ছেলে দেখাচ্ছে ডাউনলোড করা এ এস এল ভি রকেটের ছবি। আজ সাত দিন যে সেও বেরোয়নি বাড়ি থেকে! সেও জানে সবার বারণ বাড়ি থেকে বেরনো এখন, কতদিন! সেটা ঠিক মতো শুধু কেউ বলে উঠতে পারছে না তাকে।

অন্ধকার আরও গাঢ় হচ্ছে। আশেপাশের বাড়ির আলো জ্বলে উঠেছে, প্রতিটা বাড়ি যেন এক একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ এখন , এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে যাওয়া নিষেধ, আসা নিষেধ।  আকাশের দিকে একবার তাকায় সৃঞ্জয় , পরিষ্কার আকাশ জুড়ে তারারা জেগে উঠেছে। আগের থেকে কি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে তাদের সৃঞ্জয় ! নাকি ভালো করে বহুদিন আকাশ দেখাই হয়নি ! শুনেছে সারা পৃথিবীর এই গভীর অসুখে নাকি- নাঃ ভুল হল- সারা পৃথিবীর মানুষের গভীর অসুখে নাকি বাতাসে কার্বন জমা নাটকীয় ভাবে কমে গেছে ! মানুষের যান্ত্রিক অত্যাচার থেকে পৃথিবী এখন মুক্ত অনেকটাই। পৃথিবীর বাতাসে এখন বিষ উদগীরণ বন্ধ।

যতবার জরুরী দরকারে বেরতে হয়েছে , ততোবারই নিজেকে অশুচি মনে হয়েছে সৃঞ্জয়ের। সর্বত্র বুঝি জীবানু লেগে আছে, রাস্তায়, দোকানির হাতে, কাঁচের শোকেসে, গ্রিলের রড়ে, দরজার ছিটকিনিতে!-বিকারগ্রস্থের মতো এখন শুধু হাত ধুয়ে যেতে হবে বারংবার !- এরকমই বলছে ওরা। হাত ধুয়েছে , হাত ধুয়েছে,হাত ধুয়েছে …কতবার মনে নেই ! হাতের চামড়া সাদা হয়ে কুঁচকে আছে। হাত ধুতে ধুতে মনে হয়েছে, এই তো জীবানু ধুয়ে ফেললাম ! আর ভয় নেই … শুধু কি জীবানু? আর কিছু কি ধুয়ে ফেলছে না বার বার! ধুতে ধুতে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সৃঞ্জয় … ওই তো কিছু স্মৃতি ধুয়ে গেল, ওইতো নিঃস্বার্থভাবে পাশে গিয়ে দাঁড়ানো ধুয়ে গেল, বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গদোষ ধুয়ে গেল … আত্মবিশ্বাস ধুয়ে গেল… ফ্যাকাসে হাতের চামড়ায় শুধু জেগে আছে শুধু নিজে আর তার পরিবার।

মেয়ে হোয়টস এপে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করছে ,টিউশন বন্ধ, আগামী পরাশুনা কি , আর কোন পথে তা থমকে রয়েছে। টিভিতে উল্লাস ভেসে আসছে সিনে এওয়ার্ডের…

-আর এক কাপ চা খাবে? ওটা তো জুড়িয়েই গেল! কখন অন্ধকারে পাশে একটু তফাতে এসে দাঁড়িয়েছে মানবী সৃঞ্জয় টেরই পায়নি ।আত্মমগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সৃঞ্জয় চমকে ওঠে মানবীর কন্ঠস্বরে। এত নিস্তব্ধতা চারিদিকে যে সামান্য শব্দের ধ্বনিও চমকে দিচ্ছে তাকে।  কয়েক হাত দূরে দাঁড়ানো মানবীর মৃদু স্বর যেন ভেসে আসছে অনেক দূর থেকে মনে হচ্ছে ! এ কদিনে যতক্ষন, যত ঘন্টা সৃঞ্জয় মানবীর সঙ্গে কাটিয়েছে এক ছাদের নিচে, দেখেছে মানবী ঘরের কাজে ব্যাস্ত, একবার ছাদে যাচ্ছে কাপড় মেলতে তো একবার রান্নাঘরে হিসেব করে আনাজ তুলে রাখছে…তা বোধহয় বহু বহুদিন লক্ষ্যই করেনি সৃঞ্জয় !সারাক্ষন ব্যাস্ত মানবী ,সংসারের খুটিনাটি সব সামলে রাখতে সদা ব্যাস্ত। এমনিতে কম কথার মানুষ মানবী , আরও যেন একটু গুম মেরে আছে। উদ্বেগ স্পষ্ট তার চোখে মুখে , উদ্বিগ্ন সৃঞ্জয় নিজেও , কিন্তু কেউ কাউকে তা প্রকাশ করছে না। ইদানীং সাংসারিক দরকারের কথা ছাড়া আর কতটুকুই বা কথা হতো তাদের! ছেলে মেয়ের প্রয়োজন, সংসারের রোজকার গর্ত বোজানোর হিসেব নিকেশ ছাড়া তাদের কথাবার্তা ছিলোই বা কতটুকু! কবে যে নিঃশব্দে শীত নেমেছে ওদের দাম্পত্যে নিজেরাও বলতে পারবে না। একটা অভ্যাস আর একটা অলিখিত চুক্তির উপর দুদিকে দুটো ব্র্যাকেটের মতো সংসার আগলে শুধু দিনযাপন।

 নাঃ… ওই খেয়ে নিয়েছি … সৃঞ্জয় উত্তর দেয় মৃদুস্বরে। এর থেকে জোরে বলার দরকার নেই এখন মাঝে থেকে যাওয়া শব্দরা এখন ছুটি নিয়েছে। একবার এক ঝলক দেখে নেয় মানবীকে সে , অন্ধকারে দুরবর্তী আলোয় মানবীর অবয়বের রেখা দেখা যাচ্ছে, ভাবলেশহীন মুখে নিচে জনশূন্য রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে মানবী। মৃদু হাওয়ায় আলোগোছে বেঁধে রাখা চুল উড়ছে। মানবী ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকায় সৃঞ্জয়ের দিকে , তারাদের ছায়া কি পড়ছে মানবীর চোখে মুখে! …সৃঞ্জয় চেষ্টা করেও দেখতে পায় না।

এভাবে সপ্তম দিনের রাত গভীর হয়,  দিন শেষ হয় আরও একটি ক্যালেন্ডারের পাতায়।

সংক্রমণসূচীতে সংক্রামিত দেশ গুলির রঙ লালচে। গ্রাফের কেঁচোটা উর্ধমুখি , সংখ্যাগুলো জানান দিচ্ছে আজ কত সংক্রামিত নতুন, কতজন চিকিৎসাধীন, কতজন সুস্থ এবং কতজন আর শেষ পর্যন্ত ফিরতে পারেনি ! ক্রিকেট ম্যাচের স্কোরবোর্ডের মতো এক টোকায় জানা যাচ্ছে বিশ্বব্যাপী মৃত্যু মিছিলের পরিসংখ্যান! দেখতে দেখতে শুনতে শুনতে কেমন অবশ হয়ে আসছে বেঁচে থাকার মুহুর্তগুলো। বহির্মূখি পৃথিবীর জনতাকে সুচীর ওই লালচে ঝড় এক লহমায় ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছে, অনিশ্চয়তার ছায়া মুখে একে অপরের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

নাঃ … এসব চিন্তা থেকে বেরতেই হবে সৃঞ্জয়কে! এত নঙ্গর্থক চিন্তাকে ওর মনকে গ্রাস হতে দেবে না কিছুতেই।সক্কাল সক্কাল তাই সৃঞ্জয় বেরিয়ে এসেছে বাড়ি থেকে কিছু দরকারি জিনিস কিনতে হবে , কত মানুষ ছুটে চলেছে দরকারে, অদরকারেও …ভিড় বাঁচিয়ে সৃঞ্জয় কাজ সারে। ফেরার পথে চোখে পড়ে এক অদ্ভুত দৃশ্য ! এই দুর্যোগের সময়েও বাজারের এক কোনে রাস্তায় যে বুড়ি মাসি ফুল মালা বেল পাতা নিয়ে বসে সে বসে আছে ফুল নিয়ে। দু একজন ফুল কিনছেও তার কাছে। সৃঞ্জয় তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আঁচলে মুখ ঢেকে রেখেছে ফুলের মাসি, তার সৃঞ্জয়ের মতো মুখোস জোটেনি বোধহয়।

আজ কত তারিখ! আজ কি মানবীর জন্মদিন? নাঃ …তবে কি ওদের বিবাহবার্ষিকি! না তাও তো নয়। তবু সৃঞ্জয়ের ইচ্ছে হয় একগুচ্ছ রজনীগন্ধা কিনতে। মাসি সাবধানে কাগজে মুড়ে দেয় ফুলের গুচ্ছ।

বাড়ি ফিরে এ কদিনের নিয়ম মতো ভালো করে হাত পা ধুয়ে জামাকাপড় ছেড়ে শোবার ঘরে ব্যাস্ত মানবীর সামনে গিয়ে দাঁড়ায় সৃঞ্জয়। হাতের রজনীগন্ধার গুচ্ছ বাড়িয়ে দেয় মানবীর দিকে। মানবী থমকে তাকিয়ে থাকে কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে, সৃঞ্জয় বুঝতে পারেনা মানবীর কি ভালো লাগল! নাকি লাগল না …শেষ যে কবে …!

“ ভালো লাগল তাই নিয়ে এলাম …রেখে দাও কোথায় রাখবে ” মৃদু হাসার চেষ্টা করে সৃঞ্জয়।

“ হঠাৎ ফুল! … তাও সোজা ঘরে নিয়ে এলে? আমি দুবেলা ব্লিচিং দিয়ে ঘর মুছি সে কথা জানো তো!” সৃঞ্জয় নিভে আসে । ফুল দেখেও মানবী অনেকটাই দূরে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলে যায় , মানবী কি শুনেছে সেই মাইকে বলে যাওয়া কথাগুলো …দুরত্ব বজায় রাখুন …

 ওহ… তাও ঠিক …বাইরের জিনিস …
এনেইছো যখন বাইরে নিয়ে গিয়ে স্যানেটাইজার দিয়ে স্যনেটাইজ করো

স্যানেটাজার স্প্রে দিয়ে রজনীগন্ধার গুচ্ছের জীবানুমুক্তি ঘটে … তারপর তার স্থান হয় শোবার ঘরের ফুলদানীতে। মানবী নিজেই অল্প জল দিয়ে স্টিকগুলো বিন্যস্ত করে রাখে ।  

সেদিনও সন্ধ্যা নামে একটু অন্য রকম। রজনীগন্ধা তার মাদকতাময় সুবাস ছড়িয়ে ঘরের বাতাস মাতিয়ে রেখেছে। সৃঞ্জয় শোবার ঘরের বিছানায় আড় হয়ে শুয়ে বই পড়ার আছিলায় মশগুল হয়ে থাকে এক অন্যরকম সংক্রমণের অপেক্ষায়।

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত