| 26 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক সাহিত্য

ইন্দু বিন্দু (পর্ব-১১)

আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিট

শ্রীচৈতন্যের জীবনী নিয়ে মধ্যযুগেই কয়েকটি গ্রন্থ লেখা হয়েছিল। তবে বাংলা সাহিত্য-আসরে আত্মজীবনী সাহিত্য এসেছিল বেশ চমক দিয়ে। চমক এ জন্য যে, আধুনিক যুগ ইংরেজ এবং ইংরেজি সাহিত্যনির্ভর হয়ে উঠেছিল। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিতরাই সমাজ-সাহিত্য-রাজনীতিতে অবদান রেখেছিলেন। কিন্তু বাংলায় ‘আত্মজীবনী’ লেখার ইতিহাস একেবারেই ভিন্নভাবে এসেছে। কোনো ইংরেজ প্রভাবিত বা কোনো শিক্ষিত লোক আত্মজীবনী লেখেননি। লিখেছেন অজপাড়াগাঁয়ের প্রায় অশিক্ষিত এক মেয়ে। তাঁর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, কেউ তাঁকে পড়তে বা লিখতে শেখাননি। লেখাপড়া অর্জন করেছিলেন তিনি নিজে, সম্পূর্ণ একাকী। তাই সাহিত্যের আঙ্গিনায় তিনি একটি বিস্ময়। তাঁর নাম রাসসুন্দরী। তাঁর বইয়ের নাম ‘আমার জীবন’। তারপরে আত্মজীবনী অনেক পেয়েছে বাংলা সাহিত্য ও বাংলা সাহিত্যের পাঠক।

আরও একটি আত্মজীবনী ইন্দু বিন্দু’র সাক্ষী হতে যাচ্ছেন আপনি। আদরের নৌকা,শব্দের মিছিল-এ বিক্ষিপ্তভাবে নিজের জীবন নিয়ে লিখেছেন, ইরাবতীর পাঠকদের জন্য ধারাবাহিকভাবে নিজের জন্মতিথিতে নিজের আত্মজীবনী লেখা শুরু করলেন ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়। আজ রইলো আত্মজীবনী ইন্দু বিন্দুর একাদশ পর্ব।


 


মায়ের বারোমেসে ব্রত বিলাস

বৈশাখেতে পুণ্যিপুকুর, অক্ষয়তৃতীয়া  
জ্যৈষ্ঠ্যমাসে মঙ্গলচন্ডী বিষম রৌদ্রে পুড়িয়া  
আষাঢ়ে নামিল বর্ষা রথের রশি টানি,
মনে মনে জাগ্রত মা বিপত্তারিণি  
শ্রাবণে ঝুলন পূর্ণিমা আর লোটনষষ্ঠীর ব্রত  
ভাদ্রে জন্মাষ্টমীর সাথে চাপড়াষষ্ঠীতে রত    
আশ্বিনে দুর্গাপূজা, দেবীর আবাহন।    
কোজাগরী পূর্ণিমায় লক্ষ্মীদেবীর বরণ  
কার্তিকে দীপান্বিতা, কালীপূজার দিনে  
ইতুপূজা, কুলুইচন্ডী আসে অগ্রহায়ণে ।
পৌষের শীতে নবান্ন নলেন গুড়ের ঘ্রাণে  
সংক্রান্তিতে পিঠেপার্বণ আর মকরস্নানে।  
বাঘের গায়ে মাঘের শীতে ভীমএকাদশী  
শ্রীপঞ্চমী শেষে খাই গোটাসিদ্ধ বাসি।
ফাল্গুণে হোলিকা পোড়ে, শিবরাত্রি আসে  
বাসন্তী-অন্নপূর্ণা-চড়ক হয় চৈত্রমাসে ।  
আরো এমন কত পার্বণে বাঙালীর মনভাসি
সম্বচ্ছরে এটাই রীতি মানতে ভালোবাসি।  

মোটামুটি স্বরচিত এই কবিতাটির মধ্যে দিয়েই আমার জানা সব ব্রতগুলিকে এক সুতোয় বেঁধে রেখেছি আমি।
ছোটবেলা থেকে বেশ লাগত মা, ঠাম্মা আর দিদিমার এই ব্রত বিলাস।

ঘটিবাড়ির মেয়ে ঘটিবাড়ির বউ হয়ে আসার পর শাশুড়িমাকেও দেখলাম এসব ব্রত পালনে তত্পর। অতএব আর কি? আমার বারব্রত আমার আধার হয়ে রইল সারাজীবনের মত। আমি আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গেলাম এই সংস্কারের সঙ্গে। লালন করতে লাগলাম সম্বচ্ছরি এই পাল পার্বণ। উপোসের অজুহাতে হেঁশেলে বেশ মুখ বদলানোর সব উপায় বাতলে দিয়েছেন পূর্বসুরীরা। শরীরের দিনভর সুপার ক্লিনিং চলে। তবে খাওয়াদাওয়া কিছু কম হয় বলে মনে হয়না। মুখরোচক সব খাদ্য জোটে সেটাই বড় কথা।
আমার মায়ের ঝরঝরে ব্রতকথার বইখানি বিশেষ ব্রতর দিনগুলোয় তাকের ওপর থেকে নামিয়ে আইবুড়োবেলায় কোনো কোনোদিন পাঠ করার দায়িত্ব পড়ত আমার ওপরে। তখন তলিয়ে সেসব নিয়ে ভাবতাম না।
পরে বুঝেছি, সে যুগ ছিল চরমভাবে পিতৃতান্ত্রিক। তবুও সেখানে মেয়েদের পুজোআচ্চা, বারব্রত পালনে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছিল দেবীরা। তাই বুঝি তেরোমাসের অগণিত পালপার্বণে দেবীদের পাল্লাই বেশী। যেন মাতৃস্বরূপা দেবীই নারীশক্তির মূর্ত প্রতীক রূপে সকলের মঙ্গলকামনায় বিরাজমানা। আর আদতে সকলের তেমনি বিশ্বাস জন্মেছিল। সবসময় দেবীমূর্তি গড়ে নিয়ে, প্রাকৃতিক শিলাখন্ডকে মাতৃজ্ঞানে পূজা তখনই প্রচলিত হয়েছিল সমাজে। সেই সমাজে শিশুদের ধারণ, পালন এবং রক্ষায় মা দুর্গার স্বরূপিণী ষষ্ঠীদেবীর মাহাত্ম্য প্রচলিত হয়। তিনি বৈদিক দেবী নন। তবে বাংলার লোকসংস্কৃতির ধারাটি বজায় রাখতে লোকসমাজে বহুল প্রচলিত ষষ্ঠীর ব্রতকথাগুলি আজো সমাদৃত। এখনো সেগুলি মানুষের কথা বলে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজের কথা বলে। লিঙ্গবৈষম্যের কথা জানায়। তার ফাঁকে ফাঁকে দেবীরা নিজেদের মাহাত্ম্য প্রচার করে সমাজে স্থায়ী আসন পেতে নেন।  

কৃষ্ণরামদাসের ষষ্ঠীমঙ্গলকাব্যেই তো আছে  

বারোমাসে বারো ষষ্ঠী যে বা নারী করে
রোগ শোক দুঃখ কভু নাহি তারে ধরে।

মূলতঃ প্রজনন শক্তির দেবীরূপে ষষ্ঠী প্রাধান্য পেতে থাকেন। বৃন্দাবন দাসের “চৈতন্য ভাগবত”, মুকুন্দরাম দাসের “কবিকঙ্কণ চন্ডী” তে  ষষ্ঠীর বর্ণনা আছে। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে স্বয়ংভর মনুর পুত্র প্রিয়ব্রত নামে রাজা ষষ্ঠীর পুজো করে  দেবীকে তুষ্ট করে পুত্রলাভ করেন। সেইথেকে জনসমাজে প্রতিমাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠীতিথিতে দেবীর পুজো চালু হয়। ষষ্ঠীপুজোয় যে ব্রতকথাগুলি লোকমুখে আজো প্রচলিত সেগুলি কিছুটা লোকশিক্ষার বাণী, কিছুটা দেবী মাহাত্ম্য প্রচারের কথা বলে। কোথাও সন্তানলাভের আশায় কোথাও সন্তান পালনের উদ্দেশ্যে, কোথাও সন্তান রক্ষার্থে আর কোথাও সন্তানের সার্বিক মঙ্গল কামনার্থে এই ব্রতকথাগুলি আজো সমুজ্জ্বল।  

“বারোমাসে তেরো ফুল ফোটে’…প্রতিমা বড়ুয়ার ভাওয়াইয়া গানের বিখ্যাত সুর মনে পড়ে যায় ।
ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, বাউল, কীর্তণ, ঝুমুর, ভাদু-টুসু ইত্যাদি লোকগানের মত বিচিত্র বাংলার পার্বণ সম্ভার।  যেন পার্বণের বরণডালা সাজানোই থাকে বাঙলামায়ের হাতে। যার যেমন ইচ্ছে মেতে ওঠো। যেমন ইচ্ছে উপভোগ করো। কোনো বাধা নেই। বাঙলামায়ের অপার স্নেহ, অবারিত দ্বার সকলের জন্য খোলা।  
ঋতু বৈচিত্র্যের খেলায় নানান ফুল ফোটারপাশাপাশি নানা রকমের পার্বণ বাংলার বুকে।    
“বারোমাসে তেরো পার্বণ” বাঙলার ঋতু বৈচিত্র্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অগুন্তি পাল পার্বণের ঘটা।

ঠাম্মা ছোট্টপুকুর খুঁড়ে তার পাশে তুলসী চারা লাগিয়ে সারা বৈশাখমাস পুণ্যিপুকুর ব্রত করত। মা কে দেখতাম বৈশাখে তুলসীচারায় জল দিতে দিতে বলতে,

তুলসী তুলসী নারায়ণ, তুমি তুলসী বৃন্দাবন
তোমার শিরে ঢালি জল, পুণ্য হোক দেহ স্থল।
অন্তিমকালে দিও স্থল।
  

মদ্যা কথা হল বৈশাখের শুরুতে বৃষ্টির আবাহন এবং সবুজ ও সজীবকে প্রাণ দান। আর তুলসীর ভেষজ গুণ সর্বজনবিদিত। ঘরে এই গাছ থাকলে গৃহস্থের সুবিধে বই ক্ষতি হবে না।হলুদ, নিমগাছের মত তুলসীর গুণ অপরিসীম। চর্মরোগ, শ্লেষ্মাই হোক কিম্বা শরীরের ডি টক্সিং এ তুলসী পাতার রসের জুড়ি মেলা ভার।

আমাদের ঘটি বাড়ীতে দেখেছি অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে গঙ্গার ঘাটে ফুল, দূর্বা, বেলপাতা, সিঁদুর, সরষের তেল প্রভৃতি উপকরণ নিয়ে সূর্য এবং মা গঙ্গাকে আবাহন করে “সরিষা ধোয়ার’ প্রথা। কালো সরষে জলে ধুয়ে তা শুকিয়ে নিয়ে শুকনো বাটা হবে এই দিনে। সদ্য ওঠা কাঁচা আম ছাড়িয়ে শিলনোড়ায় থেঁতো করে নুন হলুদ মাখিয়ে রোদে দিয়ে শুকিয়ে নিতে হবে । তারপর কাঁচের শিশিতে ভরে নেওয়া হবে সেই জারানো আম, সরষে গুঁড়ো, তেঁতুলের ক্বাথ, চিনি আর সর্ষের তেল। দিন কয়েক রোদে ফেলে রাখলেই তৈরী হবে সমবচ্ছরি আম কাসুন্দি। চলতি কথায় বলে আমের কাসন।
জৈষ্ঠ্যমাসে মঙ্গলবারে জয় মঙ্গলবারে মা কে দেখেছি সকালবেলায় খালি পেটে গদ গিলতে। কলাপাতায় থাকত যব, কলা অথবা টক দই।
আমি ঘটের মত চুপটি করে বসে শুনতাম জয় মঙ্গলবারের ব্রতকথায় জয়দেব জয়াবতীর গল্প।
মা তিনবার বলত,  

আটকাটি, আটমুঠি সোনার মঙ্গলচন্ডী রূপোর পা, কেন মাগো মঙ্গলচন্ডী হল এত বেলা?
হাসতে খেলতে, তেলহলুদ মাখতে, আঘাটায় ঘাট করতে, আইবুড়োর বিয়ে দিতে,
অন্ধের চক্ষু দিতে, বোবার বোল ফোটাতে, ঘরের ঝি বৌ রাখতে ঢাকতে হল এত বেলা।

তারপর মা ব্রতকথা পড়ে জল খেত।
আষাঢ়ে বিপদতারিণী, শ্রাবণে লোটন ষষ্ঠী আর ভাদ্রে চাপড়া ষষ্ঠী এসব দেখতে দেখতেই আমার কুমারীবেলা কাবার হল। আমি মা হবার পর সেই সংস্কার মাথায় তুলে নিলাম।

কুমারীবেলায় অঘ্রাণের রবিবারে স্নান করে ইতুর ঘট পাতা আর পঞ্চশস্য সরায় ফেলে লকলকে সবুজ গাছ গজিয়ে একমাস ধরে তাকে লালন করা, এও ছিল মস্ত আনন্দের। বিয়ের পরে আর হয় নি আমার ইতুর জন্য ছড়া বলা বা সংস্ক্রান্তির দিনে দলবেঁধে সেই ইতুর ঘট গঙ্গায় গিয়ে বিসর্জন দিয়ে আসা। মায়ের সঙ্গে আমিও বলতাম মহা উত্সাহে।

অষ্টচাল, অষ্টদূর্বা কলসপাত্রে থুয়ে
শুন একমনে ইতুর কথা সবে প্রাণ ভরে ।
ইতু দেন বর !
ধনধান্যে পুত্র-পৌত্রে ভরে উঠুক ঘর ।

কৃষিপ্রধান দেশে ইতুদেবীর পুজো বোধহয় দুর্গাপুজোর নবপত্রিকার মত ।
এখনো অঘ্রাণমাসের রবিবারে নদীর তীরে গেলে শোনা যায় বাংলার মেয়ে বৌদের মুখে ইতুর পাঁচালিঃ

কাঠিমুঠি কুড়োতে গেলাম, ইতুর কথা শুনে এলাম
এ কথা শুনলে কি হয়, নির্ধনের ধন হয়
অপুত্রের পুত্র হয়, অশরণের শরণ হয়
অন্ধের চক্ষু হয়, আইবুড়োর বিয়ে হয়,
অন্তকালে স্বর্গে যায় ।  

আমাদের বাড়িতে দুনিয়ার সব নিয়ম পালন, স্ত্রী আচার আছে। তা সে বিয়ের দিন গঙ্গায় জল সইতে যাওয়া থেকে বিয়ের রাতে হাই আমলা বাটা থেকে শোলার মোনামুনি ভাসানো বা বাচ্ছা হলে শুভ অশৌচ পালন। সদ্য পোয়াতি আঁতুড় ঘরে সিঁদুর ছোঁবেনা। আটদিনের দিন তার প্রথম শুদ্ধিকরণ হবে। ছেলের জন্য সেদিন মহাধূম করে আটকড়াই হবে। প্রসূতি তার অস্পৃশ্যকালীন শুভ অশৌচ কাটিয়ে নখ কেটে স্নান করে সিঁদুর ছোঁয়াবে। শিশুর জন্মের ছ’দিনের মাথায় আগেই হয়ে গেছে ষেঠেরা পুজো বা “ঘাটষষ্ঠী’। কথায় বলে ষষ্ঠী ঠাকরুণ সেদিন এসে শিশুর শিয়রে বসে তার ভাগ্যলিপি লিখে দিয়ে যান । আর  আটদিনের দিন আটকড়াই তো রীতিমত যজ্ঞ যাকে বলে। প্রতিবেশীদের আটটি বাচ্ছাছেলে যোগাড় করে এনে তাঁদের দিয়ে কুলো বাজিয়ে গাওয়া হাবে ছড়ার গান…

আটকড়াই, বাটকড়াই ছেলে আছে ভালো ?
ছেলের বাপের দাড়ি ধরে টানাটানি করো।

ধুমধাম করে নবজাতকের মঙ্গল কামনা আর কি। আটজন ছেলের হাতে আটকড়াই বা আটকলাই (মুগ কলাই, ছোলা, মটর, খেসারি ভাজা ও চালভাজা, চিড়ে, মুড়ি, খই) এবং মিষ্টি আর পয়সা দেওয়ার রীতি। আট রকমের ভাজা খাওয়ানো হয় বলে এ অনুষ্ঠানের নাম হয়েছে আটকড়াই, আটকলাই বা আটকৌড়ে। অশুচিকালীন এসব কৃত্যকর্মের বিধি-বিধান রঘুনন্দনের শুদ্ধিতত্ত্ব, কৃত্তিবাসের  রামায়ণ, মুকুন্দরামের  চন্ডীমঙ্গল  প্রভৃতি গ্রন্থেও নাকি আছে বলে শুনেছি।

এরপর ছেলেমেয়ে উভয়ের জন্যই আছে প্রসূতির এলাহি শুদ্ধিকরণ। যার নাম একুশদিনের ষষ্ঠীপুজো বা একুশ্যা।  
শিশুর জন্মের দু’দিন পর ‘সূতিকাষষ্ঠী’, এবং শিশুর বারো বছর বয়স পর্যন্ত প্রতি জন্মতিথিতে “জলষষ্ঠী’র পুজো অবিশ্যি নেই আমাদের বাড়িতে তবে আটকড়াই আর একুশের ষষ্ঠীপুজোর খুব ধূম দেখেচি। সকালবেলায় মা, বাচ্ছা দুজনেই স্নান করে নতুন কাপড় পরে পুজোয় বসবে। পুরোহিত এসে ষষ্ঠীর ঘটের পাশে বটগাছের ডাল রেখে ষষ্ঠীপুজো করে গায়ে জল ছিটিয়ে তাদের শুদ্ধ করবেন। পুজোর নৈবেদ্য বলতে অন্যান্য জিনিষের সঙ্গে একুশটি বেতের চুবড়িতে খই, কড়ি, পয়সা, বাতাসা, লাড্ডু, শুকনো হলুদ, সুপুরি, কাঁঠালি কলা রেখে সেগুলি মা ষষ্ঠীকে উত্সর্গ করে সেটাই প্রসাদ হিসেবে বিলি করার নিয়ম।

এছাড়া বিয়ে, পৈতে, অন্নপ্রাশনের মত শুভ অনুষ্ঠানে আমাদের অবশ্য কর্তব্য আনন্দনাড়ু।
আনন্দনাড়ুর জোগাড় যেন বিশাল কাজ একটা। এটি মূলতঃ ঘটিবাড়ির আরেক রীতি। শুভকাজে আনন্দনাড়ু বানানো। আত্মীয় স্বজন মুখিয়ে থাকেন সেই নাড়ুর জন্য। সত্যনারায়ণের শিরণির মত মাপ তার। যত প্রিসিশন তত সুস্বাদু হবে সেই নাড়ু। আমার মায়ের মাপ মুখস্থ। সেইমত বাজার করানো হয়। সে এক যজ্ঞ আমাদের। বিয়ের আগের দিন বিশাল পরাতে নারকোল কোরা হবে। চারটে বড় বড় নারকোলের জন্য এক কিলো আটশো আতপচালের মিহি গুঁড়ো, আটশো গ্রাম সাদা তিল আর দেড়কিলো শুকনো আখের গুড় লাগবে। আর ভাজার জন্য সরিষার তেল।

এবার আয় তবে সহচরী হাতে হাতে ধরি ধরি, মাখিব নাড়ু সবে ভাজিব তায়।

প্রথমে নারকোলের ওপর চালের গুঁড়ো আর গুড় দিয়ে ঠাসা। ভাগে ভাগে পেতলের গামলায় এক একটি অংশ নিয়ে ঠাসবে বাড়ির মেয়েরা, বৌয়েরা। তারপর তিল ছড়িয়ে আবার ঠাসো। মোলায়েম করে, মসৃণ করে। এবার পাকানোর পালা। ঘন্টা তিনেক কাবার এই ঠাসাঠাসিতে। বিশাল পেতলের কড়াইতে খেলিয়ে ভাজার পর্ব অনেকক্ষণ ধরে। সরষের তেলে ধোঁয়া উঠতেই প্রথম খোলায় একুশটা নাড়ু যার শুভ কাজ তার মা’কে ভেজে তুলে রাখতে হবে মাটির হাঁড়িতে। এর নাম শ্যামের হাঁড়ি। নারায়ণের পুজোয় এই নাড়ু নিবেদন করতে হবে। এই একুশটি নাড়ুর অদ্ভূত সব আকার প্রকার। জ্যামিতিক আকৃতি। কোনটা গোলক, কোনটা চৌকো, কোনটা ত্রিকোণ, কোনটা তারা, কোনটা আবার চোঙাকৃতি। গনগনে আঁচে গরম তেলে নাড়ু ভাজা শুরু হবে শাঁখ বাজিয়ে। এয়োস্ত্রীদের প্রত্যেকের হাতে পানের ওপর নাড়ু, সুপুরি দিতে হবে।

এই আনন্দ নাড়ু আবার কাজে লাগবে বিয়ের পরে অষ্টমঙ্গলায় যখন নবদম্পতি জোড়ে আসবে তখন। সুবচনী পুজো হবে সেইসময়।
নববিবাহিত দম্পতির মঙ্গলকামনায় এই ব্রত পালন হয়ে থাকে। মেয়েদের একান্ত আপনার এইসব ব্রত। একুশটা চুবড়ি সাজিয়ে একুশটা হাঁস আঁকতে হবে পিটুলি গোলা দিয়ে। সেই আল্পনায় ঝুড়িগুলো বসানো হবে। এর মধ্যে একটা খোঁড়া হাঁস থাকবে। মাটি দিয়ে পুকুর কেটে দুধ ঢেলে দিতে হবে।
এছাড়াও মামাবাড়িতে প্রত্যেক পূর্ণিমায় সত্যনারায়ণ পুজো হতে দেখেছি। প্রতি বৃহস্পতিবার মা কে লাক্ষ্মীর পাঁচালি পড়তে দেখেছি।

 

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত