Irabotee.com,শৌনক দত্ত,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,iraboti,irabotee.com in

শুভ জন্মদিন গানওয়ালা

Reading Time: 3 minutes

 

বাংলা ভাষাভাষি মানুষ মাত্রই জানেন শিল্পী কবীর সুমনের মানে কি! আজ তাঁর ৭১তম জন্মদিন। পা ফেলবেন বাহাত্তরে। ১৯৪৯ সালের ১৬ মার্চ তিনি ভারতের ওড়িশায় জন্মেছিলেন। ২০০০ সালে ধর্মান্তরিত হয়ে সমস্ত বাংলায় হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন। সুমন চট্টোপাধ্যায় থেকে হয়েছিলেন কবীর সুমন। পরবর্তীতে বাংলাদেশের কিংবদন্তিতুল্য শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিনকে বিয়ে করেছিলেন।

প্রচলিত গানের বাজারে নব্বইয়ের দশকে কলকাতায় এক আলাদা সুর আর কথায় গেয়ে উঠলেন এক গায়ক। তার গানে প্রথমবার মানুষ শুনতে পেলো এক অন্যরকম সুর। ‘প্রথমত আমি তোমাকে চাই,দ্বিতীয়ত আমি তোমাকে চাই, তৃতীয়ত আমি তোমাকে চাই, শেষ পর্যন্ত আমি তোমাকে চাই’। অসাধারণ এই গায়কী শক্তির প্রতি মানুষের আগ্রহ জন্মালো। বলতে গেলে মানুষকে সম্মোহনের বন্ধনে আবদ্ধ করে দিলেন প্রথম অ্যালবাম তোমাকে চাই’ দিয়েই। নাম তার কবীর সুমন। শুধু তার গানের জন্য সমস্ত বাংলায় বিখ্যাত নন, একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও মানবিকতার জীবন্ত এক মূর্তি হিসেবেও তিনি অতি পরিচিত একটি নাম।



বাংলা গানের মানে যাঁরা বদলে দিলেন কবীর সুমন তাদের একজন। কবীর সুমনের স্পর্শে বাংলা গান শুধু সমৃদ্ধই হয় না, বরং খুঁজে পায় নতুন দিশা। তার গানের বিষয়বস্তু হয় রাজনীতি, ধর্ম,দর্শন, সমাজ। যা আগে কেউ ভাবেওনি হয়তো। অনায়াসে শাসক আর শোষকদের নির্মম সত্য বলে দিতে পারেন গানের মাধ্যমে। সীনা টানটান করে সমাজের সঙ্গতি আর অসঙ্গতিগুলিও চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে পারেন এই গানের মাধ্যমেই। তার গানের মাধ্যমে বাংলা গানে সূচনা হয় এক নতুন ধারার। সুমনের গানের মাধ্যমে মানুষ আরাম খুঁজে পায়, শ্রান্তি খুঁজে পায়,মনকে হারিয়ে ফেলার উন্মাদনা খুঁজে যায় তার গানে। তার গান মানুষের হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়। অনুভূতিকে স্পর্শ করে। কন্ঠ,সুর আর গানের কথায় মগ্ন হয় মানুষ।

তাই দেখা যায়, ভিন্ন ধারার এই শিল্পীর গান শুধু কলকাতাতেই জনপ্রিয়তা পায় না। বরং দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সমস্ত বাংলা ভাষাভাষি মানুষের কাছে। তার আগমনে বাংলা গানের কথায় ক্রমশ পরিবর্তন আসে। সমস্ত সংগীতের দুয়ারে সাধিত হয় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন। তার হাত ধরেই বাংলা সংগীতে নব ধারার সুচনা করে অঞ্জন দত্ত আর নচিকেতার মতো অসম্ভব মেধাবী শিল্পীরা। কন্ঠ আর সুরে তাদের অন্যরকম এক ফ্লেভার! প্রকৃতপক্ষে বাংলা গানের মানেই বদলে দিয়েছেন কবীর সুমন। যেখানেই অনাচার, সেখানেই প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের বাণী নিয়ে হাজির হয়েছেন কবীর সুমন। একজন শিল্পীর এই সামাজিক দায়বোধ বিস্মিত করার মতো!

তিনি বাংলাদেশ নিয়েও লিখেছেন। গেয়েছেন বিস্তর। ২০১৩ সালে শাহবাগের প্রতিবাদী তরুণদের উদ্দেশ্যে বেধেছেন নতুন গান, ‘বিমানে উড়তে তিরিশ মিনিট/এত কাছে তবু দূর/বিলকুল নেই পাসপোর্ট ভিসা/সীমানা চেনে না সুর।/সীমানা চিনি না আছি শাহবাগে/আমার গিটারও আছে,/বসন্ত আজ বন্ধুরা দেখো/গণদাবি হয়ে বাঁচে।/বাঁচো গণদাবি, বাঁচো গণদাবি/আসল বিচার চাই,/যার যা পাওনা তাকে সেটা দাও/গণদাবি একটাই’। শুধু তাই নয়, সর্বশেষ রোহিঙ্গা সংকট নিয়েও গান বেঁধেছেন তিনি।

পৃথিবীতে শিল্পীরা বরাবরই মানবিক। যখনই মানবতার বিপর্যয় তখনই সবার আগে শিল্পীরা দাঁড়িয়ে যান। আর কবীর সুমন যেনো তার থেকেও একটু বেশী মানবিক। মানবতার বিপর্যয়ে যেনো তিনি নিজেই বিপন্নবোধ করেন। তাই তার গান অন্যদের থেকে আলাদা। তার গান প্রতিবাদের কথা বলে। প্রতিরোধের কথা বলে। বিপ্লবের কথা বলে। বৈষম্য আর নিপীড়নের কথা বলে। ভাঙ্গনের কথা বলে। নতুনকে গড়ার কথা বলে। পরিবর্তনের কথা বলে। সর্বোপরি মানবতার কথা বলে। ১৬ মার্চ জীবন্ত এই কিংবদন্তির জন্মদিন।



২০১৫ সালে নিজের জন্মদিনে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন কবীর সুমন। যেখানে জন্মদিন পালন এবং মানবিক হয়ে উঠার ঘটনা বর্ণনা করেছিলেন এভাবে: অদ্ভূত এক পরিবারে আমার জন্ম। আমাদের পরিবারে কখনও কারুর জন্মদিন পালিত হতো না। আমার বাবা মা দাদা- কার যে কবে জন্মদিন আমি জানিনি। আমার জন্মদিনও কেউ মনে রাখতেন না। ছেলেবেলায় মা’কে দু-একবার দোল পূর্ণিমা তিথিতে বলতে শুনেছি- আজ তোর জন্মতিথি। ব্যাস! ঐ পর্যন্তই! পায়েস বা বিশেষ কোনও রান্না- ওসবের বালাই ছিল না। ঈশ্বর বা ধর্মের বিন্দুবিসর্গও যেমন ছিলেন না তেমনি ছিল না জন্মদিনের উল্লেখ। তেমনি কোনোদিন শুনিনি আমার বাবা মা কোনও ধর্ম বা সম্প্রদায় সম্পর্কে কুকথা বা কুমন্তব্য করছেন। এমনকি, তাঁদের নিরীশ্বরবাদ তাঁরা তাঁদের দুই ছেলের ওপর চাপিয়ে দিতেও চেষ্টা করেননি কখনও। একবার পাড়ায় সরস্বতী পুজোয় অঞ্জলি দিতে যাওয়ার আগে বাড়িতে কিছু খাইনি। খাইনি তো খাইনি। ব্যাপারটা জানতে পেরে বাবা মা কোনও মন্তব্যই করেননি তেমন। মৃত্যুর আগে জ্ঞান হারানোর মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁর ঈশ্বর বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন ছিলেন। তেমনি আমার ৫১ বছর বয়সে আমি আইনের সাহায্য নিয়ে আমার নাম পাল্টানোর সময়ে আমার মা আমায় বলেছিলেন,‘বেশ করছিস, ঐ পদবীটা ত্যাগ করছিস। আমার সমর্থন রইল।’ বাবা তার আগে মারা গেছেন। পরে কতো ‘হিন্দু’ নামধারী আমার মা’কে ফোন করে বলেছেন, ‘আপনার ছেলে তো মুসলমান হয়ে গেল।’ আমার মা জবাব দিয়েছেন: ‘তাতে তোমার বাপের কী?’ এইরকম এক মহিলার পেটে আমি এসেছিলাম। এইরকম এক মহিলা আমায় এই পৃথিবীতে এনেছিলেন’।

তথ্যে কবীর সুমন:
একজন ভারতীয় বাঙালি গায়ক, গীতিকার, অভিনেতা, বেতার সাংবাদিক ও গদ্যকার। তাঁর পূর্বনাম সুমন চট্টোপাধ্যায়। ২০০০ সালে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে তিনি তাঁর পুরনো নাম পরিত্যাগ করেন। সুমন একজন বিশিষ্ট আধুনিক ও রবীন্দ্রসংগীত গায়ক। ১৯৯২ সালে তাঁর ‘তোমাকে চাই’ অ্যালবামের মাধ্যমে তিনি বাংলা গানে এক নতুন ধারার প্রবর্তন করেন। তাঁর স্বরচিত গানের অ্যালবামের সংখ্যা পনেরো। সংগীত রচনা, সুরারোপ, সংগীতায়োজন ও কণ্ঠদানের পাশাপাশি গদ্যরচনা ও অভিনয়ের ক্ষেত্রেও তিনি স্বকীয় প্রতিভার সাক্ষর রেখেছেন। তিনি একাধিক প্রবন্ধ, উপন্যাস ও ছোটোগল্পের রচয়িতা এবং হারবার্ট ও চতুরঙ্গ প্রভৃতি মননশীল ছবিতে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের রূপদানকারী।

 

কৃতজ্ঞতা: চ্যানেল আই

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>