আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিটটুং টুং! ঘটর্ ঘটর্ ঘটর্ ঘটর্ ঘচ্…
এই পর্যন্ত একটা ট্রিপের জার্নি শেষ। বালিগঞ্জে দুটো কামরা দেড় মিনিটে খালি। ভোঁ ভাঁ। ট্রাম খালি হতে সময় বেশি লাগেনা। সময় লাগে ভর্তি হতে। তবে , একটু বেশি টাইম নিলেও ভর্তি কিন্তু হয়।পুরোপুরি হাউসফুল না হলেও মোটামুটি ছড়িয়ে ছিটিয়ে সব সিটই ফুল থাকে। হ্যাঁ আজও, আজও এই মেট্রো সিটিতে কিছু লোক ট্রাম চড়ে বৈকি!
আমি ২৪/২৯ চালাই। বরাবরই চালাতুম। মধ্যিখানে বেশ কিছুদিন রুটটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল কিনা! সবাই তো একরকম ভেবেই নিয়েছিল কলকাতার বুকে ট্রামের পার্ট চুকে গেল বুঝি!। পাতাল ফুঁড়ে বেরিয়ে এসে ছেয়ে ফেলেছে মেট্রো রেল। ওদিকে বাইপাস কানেক্টরেও তো নাকি লাইন বসছে। মেট্রো তবে গোটা কলকাতাই কভার করে ফেলবে প্রায়, আর সাউথ নর্থ তো আছেই। ট্রামের প্রয়োজন তো ফুরিয়েছে সেই কবে! তার ওপর চাদ্দিকে কত বাস, ট্যাক্সি, ওলা – উবের ক্যাব…আরও কত কি না জানি কালে কালে বেরোবে। তবু একদিন সুখবরের মতোই বার্তা এল আবার নাকি ২৪/২৯ চালু হবে। ডাক পড়ল আবার। আবারও আমি গায়ে খাঁকি উর্দি চাপিয়ে ড্রাইভারের কেবিনে এসে দাঁড়াই। চোখের ওপর খাঁচার জালে গোটা শহরটাকে বন্দী করে ট্র্যাকে চলতে থাকি।
কিন্তু ওই, সব ট্রিপের শুরুতেই মনে হয় প্যাসেঞ্জার কই! বালিগঞ্জ ব্রিজের কাছে খানিকক্ষণ থমকে থাকো অপেক্ষায়। এট্টু ধৈর্য ধরো। খইনি ডলে নাও। চটাস্ চট তালি মেরে চুন ঝাড়তে না ঝাড়তেই দেখবে একটি দুটি পাবলিক সুরুৎ সুরুৎ করে খোপে এসে ঢুকছে। যেন পোষা পায়রা ঢুকছে ঘুলঘুলি আর কার্নিশ তলায়।
কিন্তু ওরা কারা? মনে কৌতূহল জাগবেই। আমারো জাগে। আজকের কলকাতায় কেমনতরো পাবলিক, যারা কিনা এখনও ট্রাম চড়ে? প্রশ্নটা স্বাভাবিক। আমাকেও অনেকে সে প্রশ্ন করেছে। সত্যি বলতে কি, একবাক্যে উত্তর খুঁজে পাইনি। তবে দিনের পর দিন বালিগঞ্জ টু টালিগঞ্জ যেতে যেতে, ফিরতে ফিরতে, আস্তে আস্তে চলতে চলতে থামতে থামতে লক্ষ্য করেছি – ট্রাম যারা চড়ছে তারা কিছু অদ্ভুত প্রকৃতির মানুষ। আমি অবশ্যি সবটা নিজে চোখে দেখিনি, খানিকটা নিজে আর খানিকটা কন্ডাক্টরের চোখ দিয়ে দেখা। তা আপনিও চাইলে দেখতে পারেন।
টালিগঞ্জের বাস পাচ্ছেন না? সেই থেকে ঠায় দাঁড়িয়ে ! ভিড় বলে আগের বাসটা ছেড়ে দিয়ে এখন পস্তাচ্ছেন? উম্ হুঁ, ঘড়ি দেখছেন বারবার। আর মাঝে মাঝে আড়চোখে থেমে থাকা ট্রামটার দিকে তাকাচ্ছেন! আসলে ঠিক করতে পারছেননা উঠবেন কি উঠবেন না। আপনি হলেন গিয়ে কমন ম্যান। ট্রাম দাঁড়িয়ে। আপনিও দাঁড়িয়ে। এভাবে মিছিমিছি সময় নষ্ট করবেন কতক্ষণ? তার চেয়ে উঠেই পড়ুন। একদিনের জন্যেই তো! আরে কি এমন ক্ষতি! উঠুন উঠুন…অ্যায় অ্যায় অ্যা হ্যাঁ! উঠেই পড়লেন শেষমেশ তাহলে! এই আপনি হলেন গিয়ে আপনাদের প্রশ্নের উত্তরের প্রথম ক্যাটেগরি। মানে যারা নেহাতই ঠেকায় পড়ে ট্রামে চড়ে বসেন। আর মনে মনে ভাবেন ধূস্! কেন যে উঠতে গেলাম! যাক গে, উঠে তো পড়েছেন। এখন চিন্তা হচ্ছে বসার সিট নিয়ে। খালি সিটের তো অভাব নেই। উইন্ডো সিট? হ্যাঁ হ্যাঁ তা তো আছেই। যেখানেই বসবেন খোলামেলা উইন্ডো। হাঁ করে শহরটাকে গিলছে। আরে ওটাই তো আসল মজা।মানে খোলা জানালায় বসতে যারা ভালবাসেন তাদের কাছে। ওহো আপনার তো ওসব আবার পোষায়না। অর্থাৎ আপনি জানলা দিয়ে সবটা দেখবেন, কিন্তু আপনাকে যেন কেউ দেখতে না পায়। না দাদাভাই, ট্রামে বাইরে ভিতরে বলে কিছু নেই। সব এক। আপনি বরং ওই সিঙ্গেল সিটগুলোর একটাতেই বসে পড়ুন। ওকি উসখুস্ করছেন যে! পাছার গোড়ায় তাকাচ্ছেন বারবার! ভাবছেন ছাড়পোকা আছে কিনা? হাঃ হাঃ হাঃ! তা থাকতে পারে দু একটা।তবে নিয়মিত স্প্রে করা হয়।
টুং টুং! ঘচ্…ঘটর্ ঘটর্ ঘটর্…
অবাক কান্ড! ভর্তি হতে না হতেই ছেড়ে দিল যে! এটা একমাত্র ট্রামের দ্বারাই সম্ভব। কেননা ট্রাম জানে কে কখন কোন স্টপেজ্ থেকে এসে উঠে পড়বে তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। ওই যে দেখুন ওই ছেলেটা উঠে এসে বসল ঠিক আপনারই সামনে। যে ছেলেটার অল্প বয়সে কোনো একটি মেয়েকে ভাল লেগেছিল, অথচ একটি কথাও বলতে সাহস পায়নি, আজকাল তার মাথায় হঠাৎ করে ট্রাম চড়বার ইচ্ছে চাপে। আজ ও যুবক। আঠারো বিশ বছর পরেও ওর সেই ভাল লাগার চোখদুটো ঠিক একরকম। মেয়েটিরও চোখে সেই কাজল কালো গভীর দৃষ্টি একরকমই আছে, শুধু কোলে একটি বাচ্চা। রিক্সায় চড়ে আসছিল মেয়েটা, কতদিন পর বাপের বাড়ি এল। ছেলেটা হাঁটছিল। মুখোমুখি দেখা। মেয়েটা তাকিয়েছিল। হয়তো ভেবেছিল ছেলেটা কিছু বলবে…. আজও কোনও কথাই বলা হলনা। বালিগঞ্জের ব্রিজ টপকে এসে ওই ছেলেটাই উঠে পড়ল ট্রামে। যেতে যেতে ওর ঝিম ঝিম লাগবে। ডিটারজেন্টের ফেনার মতোই ওর মনের মধ্যে ফেনিয়ে উঠবে বিশ বছর আগেকার এক সময়। ও চাইবে সেই সময়টায় আরও একবার ফিরে যেতে। অটোর খোপে, বাসের ভিড়ে সেটা তো সম্ভব নয়! ভিড়ে হাঁটতেও ওর অস্বস্তি হত খুব…
কমন ম্যান আপনি, আজ ট্রামে উঠেছেন বলেই ছেলেটাকে খুব কাছ থেকে দেখছেন। বাসের ভিড়ে এমন কাউকে দেখলে হয়তো ফিরেই তাকাতেন না। খোলা জানালায় বসে বসে চলতে চলতে ও এখন কত কিছু ভাববে। হাতে ভাড়া বের করা। এক্সাক্ট ফেয়ার। মুখে কথা নেই। ওকে ওর মতো ভাবতে দিন….
এখন আপনি একটা চলমান ফ্রেমে বন্দী। ছটাকার টিকিট কিনেছেন, একটা জীবন্ত শো দেখবেন বলে ঠিক কিনা? না না না, আপনার কথা বলছিনা। আপনি তো কমন ম্যান। আমি বলছি আপনার কোণাকুনি বসা লোকটাকে। কাঁধে ঝোলা, কালো টাক বেমানান পাঞ্জাবী আর প্যান্ট। কোথাও যাওয়ার নেই। এমনিই উঠে পড়েছেন। এমন অনেক লোক এমনি এমনিই ট্রামে উঠে পড়েন। ট্রাম চড়বার জন্যেই ট্রাম চড়েন। ট্রাম চড়া ওনাদের একটা হবি। মোটর বোটে যেমন জলবিহার, তেমনি ট্রামে চড়ে স্থলবিহার।
এরা সবকিছু কেমন ঝাপ্সা দেখেন। ক্রসিং ভর্তি লোকজন, ফুটপাত ভর্তি দোকানপাট , শোরুম ভর্তি জামাকাপড়, ব্রা প্যান্টির বিজ্ঞাপন, ফ্লাইওভার, মল,হল সব কেমন মিলেমিশে একাকার, চোখের সামনে দিয়ে ভেসে চলে যায়। আলাদা করে এদের চোখে কিছু ধরা পড়েনা। আসলে দেখার জন্য কিছুই দ্যাখেননা এরা। শুধু তাকাবার জন্যেই তাকিয়ে থাকেন। আর এই চলমান শহরে চলমান তাকিয়ে থাকার উৎকৃষ্ট চলমান উপায় হল – ট্রাম।
–ওঠ ওঠ উঠে পড় বাবলাই! আহা তুমি আবার গেলে কোথায়! ওঠো তাড়াতাড়ি!
ভদ্রলোক পা দানিতে ঝুলছেন। বুঝতে পারছেননা কার হাত ধরবেন, ছেলে না স্ত্রীর। জমকালো ড্রেস করেছেন মাইরি! নিজে যেমন সেজেছেন, বউকেও সাজিয়েছেন তেমনি। বেশি বয়সে বিয়ে, হে হে! ছেলের বয়স দেখছেন না! কতই বা হবে! দশ এগারো। হাতে পায়ে একটু বেশি লম্বা এই যা। এখনও হাফপ্যান্ট ছাড়েনি। ভদ্রলোকের অবশ্যি পাকাচুল ঢাকবার তেমন চেষ্টা নেই। তবে মহিলাটির চুলে ব্রাউন কালার। হলদে কালো তাঁতের শাড়ি, ম্যাচিং ব্লাউজ। হাতে গলায় সিটি গোল্ডের গয়না টয়না…নেমন্তন্ন বাড়ি।
ওই ফ্যামিলি গেটটুগেদার আর কি! এও একরকম হ্যাপি ফ্যামিলি। যেখানেই যাননা কেন সব্বাই এদের খুব পছন্দ করেন। বিনিময়ে কিছু টোন্ টিটকিরি হজম করতে হয়…ওরা সেসব গায়ে মাখেননা। সবেতই হাসি হাসি মুখ করে থাকেন।
ভদ্রলোক ছেলেকে কথা দিয়েছিলেন ট্রাম চড়াবেন। আজ এক ঢিলে দুপাখি টিপ করেছেন। রিলেটিভের বাড়ি দশ মিনিটের পথ। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট পাবেননা। অটোয় চাপতে গেলে সাজুগুজুর বারোটা বেজে যাবে। অতএব বুঝতেই পারছেন, ছেলেকে দেওয়া ছোট্ট প্রতিশ্রুতি রাখতে, গিন্নির মেকআপ অক্ষুণ্ন রাখতে কত সূক্ষ হিসেব ওনাকে করতে হয়েছে! তা তো হবেই, ভদ্রলোক ব্যাঙকশাল কোর্টের মুহুরি যে!
ছেলেটা মাঝেমাঝেই বায়না ধরে।–ছোটবুল্টিরা সেদিন টয়ট্রেন চেপেছে বাবা।হেব্বি মজা! বাইরেটা সব কি সুন্দর দেখা যায়, আমিও চাপব বাবা টয়ট্রেন..বলো না কবে চড়াবে….
কথাটা সত্যি, গেলমাসেই ওনার রিলেটিভরা বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে নিক্কোপার্ক ঘুরে এল। ভদ্রলোক ছেলেকে বোঝান।–আরে ধূস্! টয় ট্রেন তো খেলনা। আমরা আজ সত্যিকারের ট্রাম চড়ব। কত গাড়িঘোড়াকে পাশ কাটিয়ে ঘড় ঘড় করে গড়িয়ে চলবে দেখবি। এক্কেবারে শহরেরর মাঝখান দিয়ে ছুটে যায় ট্রাম, তুই তারপর ছোটবুল্টিদের গল্প করবি দেখিস কেমন চমকে যায়!
ওপেন এয়ারে জানলা খুলে রাখলে ইকোনমিক ব্যালান্সটা সুন্দর করে বজায় রাখা যায়। ভদ্রলোক সেই চেষ্টাই করছেন।
— দ্যাখ বাবলাই! জানলা দিয়ে কি সুন্দর সব দেখা যাচ্ছে দ্যাখ. !
আপনার চোখ ঘুরতে শুরু করেছে। আপদি দেখতে চাইছেন ট্রামের ভেতরটা। ঘড়ঘড়ায়মান চলন্ত যন্ত্রদানবের শরীরে খুঁজতে চাইছেন পুরনো ক্ষতের দাগ। কত জায়গায় রঙের চলটা উঠে বেরিয়ে পড়েছে ভেতরের মরচে রঙ! তবু সে বেঁচে আছে কী করে! দেয়ালে অদ্ভুত সব লেখা। ‘ দিজ্ কার ইজ্ ইওরস, প্লিজ্ টেক কেয়ার‘.. ‘বিওয়্যার অফ পিক পকেটস!’ কথাগুলো লেখার সত্যিই হয়তো আর কোনো প্রয়োজন হয়না । তবে একসময় এর প্রয়োজন ছিল। অভ্যেসটা রয়ে গেছে। যেমন ওই আপনার ডানপাশে একেবারে সামনের সিটের মাঝবয়সী লোকটা—সঙ্গে ঢাউস দুখানা চটের ব্যাগ। ফর্সা রঙ। গায়ে ফতুয়া। ঠোঁট ফ্যাকাসে। খুঁজলে ওর ছোট্ট হাতব্যাগে প্রচুর ওষুধ পাবেন। আর পাবেন অল্প চিঁড়ে, শুকনো মুড়ি বা চিনিছাড়া বিস্কুট..আর দুটো শসা। প্রায় সবকিছুই খাওয়া বারণ হয়ে গেছে।
অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের মতোই জীবনটা তিতকুটে। বিরক্ত হন, সবই যদি বারণ করে দিল তবে বেঁচে কী লাভ! তবু নিয়ম করে তেতো ওষুধই খান। বেঁচে থাকার জন্যেই খান। বেঁচে থাকাটা অভ্যেস হয়ে গেছে। ভবানীপুরে জামা কাপড়ের ছোট্ট দোকান আছে ওঁর। সরাসরি বাসে গেলে অনেক তাড়াতাড়ি হয়। অন্তত রাসবিহারী থেকে এক্সট্রা হাঁটতে হয়না। লোকটি তবু হাঁটেন। তবু ট্রামে চড়েই যান রাসবিহারী পর্যন্ত। অভ্যেসটা রয়ে গেছে।
চারিদিকে তাকিয়ে দেখুন, এইসব নানারকম অভ্যেস নিয়েই মানুষজন আপনাকে ঘিরে সিটগুলোয় বসে আছে। সবাই একটা ট্র্যাকে চলতে চাইছে কিন্তু পারছেনা। সবকটা সিট কখন যে ভর্তি হল আপনি খেয়ালই করেননি! হাঁটুর ব্যথায় যে লোকটি ভালোমতো হাঁটতে পারেননা, উনি ট্রাম চড়েন একটু নিরিবিলিতে স্বচ্ছন্দে যাবেন বলে। যদিও রাস্তা খুব সীমিত। আসলে দূরে কোথাও বড় একটা তো যাওয়া হয়না। বুড়ি সব্জিওয়ালি মাসি আবার ট্রামে ওঠেন ভাড়া কম বলে। সোজা সাপ্টা থিওরি । দুয়ে দুয়ে চার, চারে দুয়ে ছয়। এই হিসাব মাথায় রেখেই কত শয়ে শয়ে সিনেমা হয়ে গেল ! দেখেননি! অ্যাঁ….কী বলছেন? সিনেমা টিনেমা দেখা হয়না? খুব বেছে বেছে ভাল সিনেমা হলে তবেই দেখেন! আচ্ছা তা ভাল, তা ভাল…
তা খেয়াল করেছেন কি আপনাকে টপকে ট্রামের হাতল ধরে এক্ষুনি কে এসে দাঁড়াল? লম্বা ফর্সা সুপুরুষ। বেশ কার্তিক কার্তিক চুল! ভারি কুখ্যাত লোক। ব্যাঙ্ক ডাকাতি থেকে রাহাজানি, গুন্ডা দিয়ে মার খাওয়ানো এসব একাধিক অভিযোগ ওর বিরুদ্ধে। বেশ কয়েকটা রেপ করেছেন। কিন্তু সবটাই সিনেমায়। দাঁড়িয়ে আছেন দুই হাত হাতলে তুলে। যেন আড়াল করতে চাইছেন নিজেকে। নামি অভিনেতার ছেলে, জানেন? স্বপ্ন ছিল হিরো হওয়ার। হয়ে গেলেন ভিলেন। বাজার খারাপ। ওসব রেপ সিন টিন দর্শক আর খায়না। সিনেমায় সব এখন আপডেটেড ভিলেন। আপডেটেড মর্ডান ক্রাইম। ছোট বাজেটের ছবিগুলোতে ওসব ক্রাইম ঘটানোর বেজায় ঝক্কি। ছবি ঝাড় খায়। ভদ্রলোক আর কাজ পাননা। ভিলেনগিরি করে নাম খুইয়েছেন। হিরো হওয়া এ জীবনে হয়তো আর সম্ভব নয়..বুকে অহরহ ঘন দীর্ঘ নিঃশ্বাস!
চোখদুটো লাল। দেখুন, কানের নিচে অল্প একটু শেভিং ক্রিম এখনো লেগে। ঝিনচ্যাক টাইপের হাফশার্ট পরে নিয়মিত টালিগঞ্জে ঢুঁ মারতে হয়..আড্ডা, চা সিগারেট…যদি একটা কাজ পাওয়া যায়! ট্রামে তো লোক বেশি নেই! তবু কেমন গুটিয়ে থাকেন…হাজার হলেও ভিলেন তো! ওই দ্যাখো দ্যাখো হিন্দুস্তান রোড থেকে বেরিয়ে একটা মেয়ে পড়িমরি করে রাস্তা পার হওয়ার চেষ্টা করছে! শ্যামলা রঙ। পরনে চুড়িদার..কি যেন বলে! হ্যাঁ পাতিয়ালা। বাঁহাতে ব্যাগের হাতল। ফোনে কথা বলছিল খুব উঁচু গলায়। ট্রাম দেখেই ছুটে আসতে চাইছে..হাতের ফোনটা তখনও বুঝি চালুই আছে…সিগন্যাল খোলা, সাঁই সাঁই গাড়ি..কেউ তো অকারণে দাঁড়ায়না। ট্রাম দাঁড়িয়ে পড়ে। খুব বিভ্রান্ত লাগছে মেয়েটিকে। হাঁপাচ্ছে খুব…দৌড়ে আসতে চাইছে। যেন জীবনের শেষ গাড়ি এটাই। ধরতে না পারলে সর্বস্ব খোয়া যাবে! গাড়ির ফাঁক ফোকর গলে টুক করে লাফিয়ে এসে ঝুপ করে ঢুকে পড়ল। স্মার্টফোন না। পুরনো বাটখারা টাইপের সিডিএমআর ফোন। ব্যাগটা বাঁহাতে কোনরকমে সামলে সুমলে ফোনটা সে অবস্থাতেই তুলে ধরল কানে।
-লাইন কাটবেনা বলছি! একদম লাইন কাটবেনা অর্জুন! আমি অনেক ঝক্কি সামলে একটা ট্রামে উঠে পড়েছি। না, পরে কথা নয় যা কথা হবার এখনই হবে। মেয়েটার গলার আওয়াজ উঁচু ডেসিবেলে চড়ছে।
–আমি বিরক্ত করি তোমাকে? তার মানে! কোথায় আছো, কী খেয়েছো এটা জানতে চাওয়াটা অপরাধ? সারাক্ষণ খিচ্ খিচ্ করি মানে! সারাক্ষণ ফোন করি আমি? প্রথম দুবছরে তো এটা নিয়ে কোনও প্রব্লেম হয়নি তোমার ! তখন তো নিজেই রাত দুপুরে ফোন করতে ..না না আমাকে ওসব মিটিং ফিটিং বোঝাতে এসোনা, কচি খুকি নই আমি! ..লাস্ট কবে দেখা হয়েছে আমাদের? পরশু। তারপর থেকে আর একটাও ফোন তুমি নিজে থেকে করেছ?…না না লেট মি ফিনিশ! স্পষ্ট করে বলে দাওনা কেন, আমাকে আর তোমার ভাল লাগছেনা! …ব্যস্ ঠিক আছে, তুমি তোমাকে নিয়েই ব্যস্ত থাকো! গো টু হেল!!
মেয়েটা হাত থেকে ছুঁড়ে দিল ফোন। দমাস করে আছড়ে ঢাকনা খুলে সেটা ছড়িয়ে গেল ট্রামের ফ্লোরে। সবাই হতভম্ব। মেয়েটাকে দেখছে। আপনারই সিটের পেছনে দাঁড়িয়ে মেয়েটা। গেটের একপাশে হাত রেখে অন্য হাতে মুখ ঢেকে কাঁপছে।
সেই যে ছেলেটা একটি মেয়েকে তার মনের কথা বলতে পারেনি, সে হঠাৎ উঠে এল। ফোনের ঢাকনা কুড়োল, ব্যাটারি লাগাল। ফিট টিট করে মেয়েটার হাতে দিয়ে বলল, –আসুন। আপনি আমার সিটে এসে বসুন। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে শরীর খারাপ করবে।
মেয়েটি যেন ওর কতদিনের চেনা। ম্যাজিকের মতোই কাজ হল। ছেলেটির একটিমাত্র কথায় চুপচাপ গিয়ে বসে পড়ল সিটে। চোখ মুছে হাসল একবার। খোলা হাওয়ায় ওর কপালে কুচ কুচি চুল এসে পড়েছে।মেয়েটা কিছু বলতে চাইছে, কিন্তু ভাষা খুঁজে পাচ্ছেনা। দেখল ছেলেটার কাঁধে একটা ব্যাগ।
–দিন আপনার ব্যাগটা আমাকে দিন। আপনার দাঁড়াতে কষ্ট হবে।
ছেলেটা খুশি হয়। কিন্তু লজ্জা পায়। এভাবে কেউ তো কখনো তাকে বলেনি। –নানা থাক আমার অসুবিধা হবেনা।
–হ্যাঁ হবে! আমি খুব ভাল করে বুঝি কার কিসে অসুবিধা হয় না হয়। দিন ব্যাগটা দিন!
মেয়েটার হাতে ফোন বাজছে। বোধহয় ওর সেই প্রেমিক অর্জুন না কি যেন নাম বলল, সেই করছে। মেয়েটা কেটে দিচ্ছে বারবার। ট্রামের ছেলেটি মনে মনে চাইছে যেন ফোন আর না আসে। হয়তো অজান্তে আপনিও সেটাই চাইছেন! কী করি আমার হাতে তো স্টিয়ারিং নেই! আমি শুধু এই ট্রামটাকে চালিয়ে নিয়ে যেতে পারি। ‘চালকদের ঢাকনি খোলা নিষেধ ‘। সাদা হাফটোন কালিতে লেখা আছে দেখেছেন তো? অনেক সময় দরজার পাল্লা আঁটা থাকলে ড্রাইভারকে আপনি পুরো দেখতেও পাবেন না। শুধু দেখবেন খাঁকি উর্দি পরা একটা হাফ শরীর স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে। আর একটা হাত ঘটাং ঘটাং লিভারের হাতল ঘুরিয়ে চলেছে..কখনো ডাইনে কখনো বাঁয়ে …ইলেকট্রিক কারেন্টের যত ঘ্যাঁচ কল সব ওখানেই। ড্রামের মতো ঢাকনি আঁটা ওই পার্টসের ভেতরেই যত কারেন্টের বাড়া কমা। ওটাকে তাই কন্ট্রোলার বলে। ওভারহেডের ছিরিক ছিরিক ওটার মধ্যে দিয়েই চাকায় চালান হয়, ব্যস এটাই আমার কাজ। হাতে কন্ট্রোলার, অথচ ঢাকনি খোলার উপায় নেই।
এসব কলকব্জা ব্রিটিশ আমলে তৈরী। ইঞ্জিনিয়ার বোঝে। তাই নিষেধ। চালক শুধু চালায়। । তাই বলে কি স্বপ্ন দেখতে নেই? আমি তো প্রায় দেখি…আমি চালাচ্ছিনা। আমার কেবিনের খাঁচার বাইরে একটা ঘোড়া আগে আগে ছুটে চলেছে টিক টক ঘটার ঘটার টিক টক টিক টক… রাস্তা ফুরিয়ে আসছে। মেয়েটা জানলার বাইরে তাকিয়ে অপেক্ষায়। ছেলেটা কিছু বলবে। ছেলেটা বলছেনা। বলবেনা বলবেনা করে শেষে জিজ্ঞেস করেই ফেলল –আপনি কোথায় নামবেন?
–’ এই তো সামনেই, চারু মার্কেট..আ আপনি?’
ছেলেটা চুপ। ওর হাতে ধরা হাতলে শক্ত হাত। আমি ইচ্ছে করে সিগন্যাল খাই। ইচ্ছে করে সব কটা গাড়িকে থেমে থেমে রাস্তা করে দিই…তবু দেখতে দেখতে হঠাৎ কখন রাসবিহারী ক্রসিং এসে পড়ে। অনেকের মধ্যেই নড়া চড়া। নামব নামব ভাব। এমন সময় রাস্তার মধ্যে বিশাল লোহার দন্ড হাতে আরও একটা উর্দি পরা লোকের আবির্ভাব । দন্ড হাতে দৌড়ে আসছে। চেনেন ওকে? আরে ওই তো ট্র্যাক মেলানোর আসলি লোক! হাতের মোচড়ে লাইনের সাথে লাইন জুড়ে দেয়! আমি ওকে চিনি। আচ্ছারকম পাগলপন্থী। যেকোনো সময়ে যেকোনো দিকে আমার গাড়ি চালিয়ে দিতে পারে। যদিও অন্য রুট বন্ধ । তববু রোজই চেষ্টা করে। পারেনা। কিন্তু আজ..
ঠিক তাই করল ও! অসাধ্য এক কাজ।
হাতের দন্ড দিয়ে বিশাল এক মোচড়ে গোটা লাইনের জয়েন্টটাকে ঘুরিয়ে দিল উল্টো ট্র্যাকে, একেবারে হাজরা রোডের দিকে! গোটা শহরটাতে যেন মোচড় লেগে গেল! পাল্টি খেয়ে উল্টে গেল ভবিষ্যতের মেগাসিটি। ওভারহেড তারে তারে ছিরিক ছিরিক! আচমকা ঘন ঘন ফ্লাশলাইটে রাস্তার সব মানুষ চমকে গেছে।ডায়াবেটিসে অসুখী লোকটির কী প্রবল উচ্ছাস! –”হাজরা আবার যাচ্ছে বুঝি! “
ওনার ঠোঁটের কষ বেয়ে গড়িয়ে নামছে শসার রস। বয়স যেন এক পলকে দশটি বছর পিছিয়ে গেছে… বাবলাই নামের সেই বাচ্চা ছেলেটা হাততালি দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। –বাবা কী মজা! আমি টয়ট্রাম করে আরও অনেকদূর যাবো!
ওর বাবা হতবাক। মাকে বলল, হাঁগো! ট্রাম যে দেখি উল্টোদিকে ঘুরে গেল। নেমন্তন্ন তাহলে ক্যান্সেল? স্ত্রী বললেন –ধূর্! ওদের বাড়িতে গেলে খালি পি এন পি সি হয়! তার চেয়ে বরং চলো না, ধর্মতলা নেমে ভাল কোনো রেস্টুরেন্টে আমরা একসাথে খেয়ে ফিরব। অনেকদিন তেমন কোথাও যাইনি…
যে ছেলেটা আজ অবধি কোনো মেয়েকে মনের কথা মুখ ফুটিয়ে বলতে পারেনি, তার বুকে যেন খুশির লাবডুব। আরও খানিকটা সময়, টালিগঞ্জ নয়, চারু মার্কেট নয়…অফুরন্ত রাস্তা এখন…বুকের ভেতর যে কথার পপকর্ন ফুটছে…
মেয়েটা ফোনের সুইচ অফ করে দিল। যাতে না কেউ ডিসটার্ব করে।
সিট খালি দেখে ভিলেন ভদ্রলোক বেশ গুছিয়ে আরাম করে বসলেন। আজজ আর টালি গঞ্জ যেতে হচ্ছেনা। অনেক হয়েছে উমেদারি। আর নয়…ভবানীপুরের পুরনো বন্ধুদের আড্ডায় কতকাল যে যাওয়া হয়নি! ওরা ভাবে হাফ সেলিব্রিটি বন্ধু ওদের ভুলেই গেছে। আজ ওখানে গিয়েই তেলেভাজা মুড়ি আর চা…
হাজরা রোডের বাস ট্যাক্সি সরে সরে যাচ্ছে….সরে গিয়ে পথ করে দিচ্ছে বহু পুরোনো এই ট্রামকে। আপনি চমকে গেছেন! আপনার হাত ঘড়িতে সেকেন্ডের কাঁটা ঘুরতে শুরু করেছে উল্টোদিকে…আপনি চিৎকার করে উঠেছেন –”অ্যাই হচ্ছেটা কি! থামাও! আমাকে নামাও…”
আমি শুনেও শুনছিনা।এখন চালিয়ে যাওয়া ছাড়া আমার কিচ্ছু করার নেই দাদাভাই! ভেতরের কলকব্জা কেমন সব উল্টে পাল্টে গেছে আমি তার কি জানি! চালকদের ঢাকনি খোলা নিষেধ। আমি দেখছি দুপাশের বাড়িগুলো সব উধাও হয়ে যাচ্ছে …সারি সারি গাছ দুই দিক থেক ঘন হয়ে ঝুঁকে পড়েছে কবেকার সেই সরণির মতো…তার মাঝখান দিয়ে ছুটে চলেছে ট্রাম…আর তাকে টেনে নিয়ে চলেছে ১৮৭৩ সালের এক বেঁটে কালো ঘোড়া …টিক টক টিক টক টিক টক…
কিঞ্জল ছদ্মনাম। নামটি এক বান্ধবীর দেওয়া। এ নামেই লেখালেখি। আসল নাম পার্থ রায়চৌধুরী। ১৯৮৮ সালের ১৭ই ডিসেম্বর, দক্ষিণ কলকাতার কসবা এলাকায় জন্ম। ২০০৬ সালে বালিগঞ্জ জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশন থেকে মাধ্যমিক পাশ। বাবার আকস্মিক মৃত্যু এবং আর্থিক টানাপোড়েনের কারনে হায়ার সেকেন্ডারিতে এডমিশন নিয়েও পরীক্ষায় না বসতে পারা।প্রথাগত শিক্ষার এখানেই ইতি ঘটে। তখন থেকেই কর্মজীবন শুরু। রেস্টুরেন্ট, ইন্স্যুরেন্স এজেন্সি, পেট ক্লিনিক, বিপিও, ফ্যাক্টরি সুপারভাইজার, এইচ আর কন্সাল্টেন্সি…বিভিন্ন জায়গায় কাজের বিচিত্র অভিজ্ঞতা।
লেখালেখিতে আসা আচমকাই।স্কুলের এক সহপাঠীকে চমকে দিতে গিয়েই সাদা উত্তরপত্রে কলমের অর্গল প্রথম খুলে যায়। সাহিত্যে ও সংগীতে অনুরাগ তখন থেকেই।দু-তিন বছর ধরে কলম সচল। ‘তথ্যকেন্দ্র’ পত্রিকা এবং সংবর্তক, ধ্রুব সাহিত্য কহন সহ কিছু লিটল ম্যাগাজিনে কয়েকটি গল্প প্রকাশিত হয়েছে। জীবন ও লেখা হাত ধরে পাশাপাশি চলেছে।
Related