| 19 মার্চ 2024
Categories
সেল বাজার

বইমেলা ২০২০

আনুমানিক পঠনকাল: 15 মিনিট

শিমুল মাহমুদ লিখেছেন —
কুলদা রায়কে পাঠে রাখলে পাঠক হিসেবে নিজেকে নতুন নতুন ভাবে আবিষ্কার করার সুযোগ পেয়ে যাই।অথচ তার গল্পের পাশে সমকালের অধিকাংশ জনপ্রিয় লেখকদের গল্পপাঠে কেবলি মনে হতে থাকে অপ্রাপ্তবয়স্কদের লেখা পড়ছি। সমস্যাটা আমার : আপনাদের জন্য এমনটি মনে হবে এমন কোনো কথা নেই।

মাহমুদ হাসান পার্ভেজ লিখেছেন–
কুলদা রায়। গল্প লেখেন। তাই তাকে চিনি। তার সাথে ফেসবুকে পরিচয়ের আগে তার গল্পের সাথে আমার পরিচয়। বিডি আর্টসে প্রকাশিত হয়েছিল সে গল্প। মথি উদয়ের তারা। এভাবে তাকে খুঁজে পাই গল্পপাঠ ওয়েবম্যাগে। তারপর থেকে তার অধিকাংশ গল্প পাঠ করেছি।
তিনি স্থান-কাল ভেঙ্গে দিয়ে গল্প বলতে পারেন। বর্তমানে বাংলা গল্পে যা বিরল। ভাষা ও শৈলীতে সিদ্ধহস্ত না হলে এ গুণ আয়ত্ত করা সম্ভব নয়। ‘মার্কেজের পুতুল’ সময় ভেঙ্গে তৈরি করা নতুন একটি গল্প। বলে রাখছি, বাংলা কথাসাহিত্যে কুলদা রায় ক্রমশ জ্বলজ্বল করতে থাকা তারা। তার গল্প পড়ুন।


‘মার্কেজের পুতুল ও অন্যান্য গল্প’ তার নতুন বই। অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয়েছে। সেই বই থেকে এই গল্পটি প্রকাশ করা হলো।


মার্কেজের পুতুল

কুলদা রায়

একদিন বিকেলবেলাতেই লোকটি টেবিল পেতে ডানকিন ডোনাট কফিশপের পাশে বসল। মাঝারি সাইজ। সাধারণ স্প্যানিশদের মতো হতশ্রী দশা তার নয়। চমৎকার ম্যাচ করে স্যুট প্যান্ট টাই পরা। কলাম্বিয়ান কার্নিভ্যালের টিকিট বিক্রি করছে। স্পানিশ টানে ইংরেজি বলে।

নাম পেদ্রো।

আমি দিনের বেলার একটু সময় পেলেই এই কফিশপে সময় কাটাই। এ এলাকায় থাকি বলে এদের সবার সঙ্গেই আমার খুব ভালো চিনপরিচয় আছে। তারা আমাকে দাদা বলে ডাকে।

বড় আকারের কাপে কালো কফি নিয়েছে পেদ্রো। তাকে শুধালাম, তুমি কি মার্কেজকে চেনো?

— আলবৎ চিনি। বলে হাসল পেদ্রো। তারপর পকেট থেকে খুব যত্নে একটা আধখাওয়া সিগার বের করল। দাঁতে চেপে তাতে অগ্নিসংযোগ করে বলল, অনেক মার্কেজই আছে। তুমি কোন মার্কেজের কথা বলছ?

— গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ।

–হু। কী করে?

— লেখে। কথাসাহিত্যিক। কলাম্বিয়ার যাদুবাস্তববাদী কথাসাহিত্যিক।

না। সে চেনে না এই নামে কোনো যাদুকরকে। ঘাড় নেড়ে জানাল পেদ্রো। 

পরদিন তাকে লাভ ইন দ্যা টাইম অব কলেরা বইটির কভার থেকে মার্কেজের ছবি দেখালাম। দেখে বলল– ও, গাবো। তুমি আমাদের গাবোর কথা বলছ। গাবো বেশ বড় যাদুকর। গাবোর দিদিমা ভুডু জাদু জানত। ইচ্ছে করলে জলজ্যান্ত কাউকে গায়েব করে দিতে পারত। আবার মৃত মানুষকেও হাজির করতে পারত। ইচ্ছে করলে কাউকে কাউকে জ্যান্ত করে রাখতে পারত শত শত বছর। পরী আনতে পারত। অদ্ভুত সব কাণ্ড কারখানা। শোনা যায়, বুড়ি দিদিমা মৃত্যুকালে প্রিয় নাতি গাবোকে তার জাদু বিদ্যা দান করে গেছে।

যাদু নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। তবে শাকিরাকে নিয়ে আছে। শাকিরার গান শুনি। পত্রপত্রিকায় তার কোনো খবর বের হলে গ্রোগ্রাসে গিলি। সেখান থেকেই জেনে গেছি– মাদক, সন্ত্রাস আর ভুডু জাদুর দেশ কলাম্বিয়ায় শাকিরা ১৯৭২ সালে জন্মেছে। নিজে গান লেখে, সুর করে আর বিশেষ ধরনের বেলি ড্যান্স করতে করতে গান গায়। সে বিদ্যুৎলতার মতো স্টেজ পারফরম্যান্স করে। বিশ্বকাপ ফুটবলের আসরে শাকিরা তিনবার গান গেয়েছে। দুইবার গ্রামী এওয়ার্ড পেয়েছে। তার গানের এলবাম সর্বাধিক বিক্রি হয়। শাকিরা আমার প্রিয় শিল্পী।

মার্কেজকে রেখে এবার পেদ্রোকে শুধালাম, শাকিরা আসবে তোমাদের কার্নিভালে?

— ও শাকিরা। শাকিরা শব্দটি শুনেই সে নেচে উঠল। স্প্যানিশ ভাষায় গেয়ে উঠল–

লা চিকাস এস্তান একুই এস্তা নোচে

নো পেলেইস, নো পেলেইস। 

টেনেমোস এ লোস রিফুইজিদাস একুই

নো পেলেইস, নো পেলেইস

শাকিরা শাকিরা

আশেপাশে কয়েকটি কলাম্বিয়ান যুবকযুবতী ছিল। তারাও পেদ্রোর সঙ্গে যোগ দিল। কোমর দুলিয়ে তাদের নাচে গানে বেশ জমে উঠল। ডানকিন ডোনাট কফিশপের কর্মী রোজা কফি বানানো রেখে তাদের সঙ্গে সুর মেলালো। সে গাইল ইংরেজিতে–

এন্ড আয়াম অন টুনাইট ইউ নো মাই হিপস ডোন্ট লাই

এন্ড আয়াম স্টারটিং টু ফিল ইটস রাইট

সবাই সমস্বরে গেয়ে উঠল– শাকিরা সাকিরা।

পেদ্রো নাচ গান শেষ করে আমার কাঁধ চাপড়ে বলল, শাকিরা এই কার্নিভালে আসবে। তাকে ছাড়া কলাম্বিয়ার কার্নিভাল অসম্পূর্ণ।

২.

দিনটা রবিবার। ভোর থেকেই ব্রুকলীনের ফ্লাশিং এভিনিউয়ে কলাম্বিয়ার লোকজন আসছে। এভিনিউয়ের দুপাশে তাবু গেড়ে দোকান পাট বসেছে। এর মধ্যে বেশ কিছু খাবারের দোকানও বসেছে। পুলিশ এই রাস্তাটি বন্ধ করে দিয়েছে। সাধারণ গাড়ি চলছে না। বেলা বাড়তেই সেজে গুজে বাদ্য বাজনা বাজিয়ে রঙ বেরংএর পোষাক পরে কলাম্বিয়ান লোকজনদের দীর্ঘ প্যারেড শুরু হয়েছে। তাদের কারো কারো মুখে মুখোশ। কারো বা গায়ে খুব সংক্ষিপ্ত পোষাক। ছেলেমেয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে এই প্যারেড মুখরিত হয়ে উঠল। এদের অধিকাংশকেই অন্য সময়ে দেখা যায় না। স্প্যানিশভাষী এরা সাগর পার হয়ে অবৈধভাবে আমেরিকা দেশটিতে এসেছে। খুব অল্প পারিশ্রমিকে কাজ করে। ইংরেজি ভাষাটিও ঠিক মতো বলতে পারে না। 

পেদ্রোকে পাওয়া গেল একটি ঘোড়ার আদলে। একদল মেয়ের সঙ্গে নাচতে নাচতে চলেছে। পুরো তুরীয় অবস্থা।

ছুটে গিয়ে তাকে শুধালাম, শাকিরা এসেছে?

পেদ্রোর কথা বলার সময় নেই।

কোনোভাবে অস্ফূট কণ্ঠে বলল, কে?

–শাকিরা।

ইশারায় বলল, আসবে। আসবে। কেউ বাদ যাবে না। চিন্তা নেই।

এবারে পেদ্রো শাকিরার আরেকটা গান পেদ্রো ধরল–

উই গট দি রিফুজিস আপ ইন হেয়ার

নো ফাইটিং, নো ফাইটিং–

মেয়েগুলো সমস্বরে গাইল–

শাকিরা! শাকিরা!!

আর পুরো প্যারেড কোনো এক গভীর বিষণন গলায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গাইল–

উই গট দি রিফুইজিস আপ ইন হেয়ার

বিকেল নাগাদ রাস্তায় মঞ্চ তৈরি শেষ হলো। উচ্চলয়ে যন্ত্রসঙ্গীত বাজছে। কিন্তু শাকিরা আসবে কিনা কেউ আমাকে বলতে পারল না। সেটা নিয়ে কেউ চিন্তিতও নয়। কার্নিভাল খুব জমে উঠেছে।

এর মধ্য পেদ্রো এক ফাঁকে উঁকি দিয়ে আমাকে বলল, হে ম্যান, তোমার শাকিরা এসে যাচ্ছে।

— কোথায়?

— ডানকিন ডোনাট কফিশপে।

শুনে কফিশপের কর্মী রোজা ছুটে এলো দরোজার দিকে। আমাকে শুধালো, কে আসবে দাদা?

–শাকিরা। শাকিরা আসবে। আমি রোজাকে উত্তর দিলাম।

রোজা খুব খুশি। তার ইচ্ছে শাকিরাকে সে বরণ করবে সবার আগে। তাকে একটু নেচেও দেখাবে। তাকে নিজের হাতে হাট-চকোলেট ড্রিংক বানিয়ে দেবে। খুব দ্রুত তার ঠোঁটে একবার লিপজেল বুলিয়ে নিল।

৩.

এ সময়ে কফিশপের দরোজা ঠেলে একজন ঢুকল বটে, কিন্তু শাকিরা নয়–ঢুকল মাঝারি গড়নের একজন লোক। লোকটির মাথায় ম্যাগডেলেনা নদী এলাকার সামবেরো ভুয়েলটিয়াও টুপি। 

লোকটি একটু হেসে কফির অর্ডার দিলেন। রোজা অন্যমনস্কভাবে তার কফি বানাল। তার মন পড়ে আছে রাস্তার দিকে।

একটা বড়ো আকারের কাপে কফি নিয়ে লোকটি বসলেন জানালার পাশে– রাস্তার ধার ঘেষে। রোজা তখনও দরোজার দিকে চেয়ে আছে। কাস্টমারের দিকে মন নেই। এটা বেশ অস্বস্তিকর। যে কোনো রেস্তোরার জন্য বিপজ্জনক। কাস্টমার ম্যানেজারের কাছে অভিযোগ করতে পারেন। তাতে কফিশপের কর্মীর চাকরি চলে যেতে পারে।

কফিতে কয়েক চুমুক দিয়ে লোকটি রোজাকে বললেন, তোমরা কার জন্য অপেক্ষা করছ?

— শাকিরার জন্য।

— শাকিরা আসবে না। খুব নিশ্চিত হয়ে ঘোষণা করলেন তিনি। তারপর কফির কাপের ঢাকনাটা খুলে এক প্যাকেট কৃত্রিম চিনি এসপ্লেনডা মেশালেন।

শুনে আর্তনাদ করে উঠল রোজা।

তিনি খুব ঠাণ্ডা মাথায় জানালেন, অস্ট্রেলিয়াতে পূর্বনির্ধারিত কনসার্টে যোগ দিতে শাকিরা চলে গেছে।

— তাহলে?

–তাহলে শাকিরাকে আনা হবে।

— কিভাবে?

— সেটা শুনতে চাইলে থ্রি স্কুপ নেস্পেরো আইসক্রিম নিয়ে এসে তো মেয়ে। বলে লোকটি বেশ ভারিক্কি চালে তার পুরু গোফে একবার হাত বোলালেন। তারপর যোগ করলেন, নাথিং ইজ ফ্রি ইন আমেরিকা।

এই কফিশপে বাস্কিন রবিন কোম্পানীর বহু পদের আইসক্রিম পাওয়া যায়। কিন্তু নেস্পেরো আইসক্রিম পাওয়া যায় না। সেজন্য রোজা খুব মন খারাপ করে বলল, স্যরি স্যার।

লোকটি হাসলেন। বললেন, চিন্তা নেই। তুমি ডাবল চকোলেট আইসক্রিম নিয়ে এসো। তা দিয়েই আমার কাজ চালিয়ে নেব। বুঝলে, আমার নাম কলাম্বিয়ার গাবো।

গাবো ব্যাগ থেকে দুটো ফল বের করলেন। বাইরেটা হলুদ বর্ণ। ছুরি দিয়ে কাটলেন। ভেতরটা সফেদা ফলের মতো। বেশ কাঁচা মিষ্টি গন্ধ আসছে।

আমার মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, তোমাদের ভারত দেশে এই ফলটি দেখে এসেছিলেন আমার বন্ধু পাবলো।

পাবলোর নাম শুনিনি। আমার বেশ কৌতুহল হলো। গাবোকে জিজ্ঞেস করলাম, কে পাবলো?

— পাবলো নেরুদা। পৃথিবীর মহান কবি। তিনি লিখেছেন, ‘আজ রাতে লিখে যেতে পারি আমি পৃথিবীর দু:খিততম কবিতা’। ফ্যাস ফ্যাস করে কবিতাটির কয়েকটি চরণ শোনালেন তিনি। কবিতাটি শোনাতে শোনাতে খুব যত্নের সঙ্গেই নেস্পরো ফল আইস্ক্রিমের মধ্যে মেশাতে লাগলেন। আয়েস করে খেতে খেতে গাবো পাবলো সম্পর্কে বেশ কয়েকটি তথ্য দিলেন। 

১৯২৬ সালে পাবলো রেঙ্গুনে চাকরি করতে চলে যান। সেটা ছিল তাঁর নি:সঙ্গ বাস। ১৯২৮ সালে তিনি বৃটিশ ইন্ডিয়ার কোলকাতা আসেন। কংগ্রেস পার্টির মহাসম্মেলন চলছিল সেখানে। মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর দেখা করার ইচ্ছে। দেখাও হলো। মহাত্না গান্ধীই তখন পাবলো নেরুদাকে এই ফলটি খেতে দিয়েছিলেন। তার খোসার রংটি ধূসর। আমাদের দেশের ফলটির খোসা হলুদ। নাম নেসপেরো। গান্ধী শুধালেন তাঁকে, স্বাদ কেমন?

পাবলো উত্তর করলেন, মধুর।

— হ্যাঁ। মধুরতাই জীবন। তার মধ্যে হিংসা রাখতে নেই। গান্ধি ফলটির ভারতীয় নাম বলেছিলেন, সফেদা।

পাবলো ১৯৫০ সালে প্যারিস থেকে স্বাধীন ভারতে যান। বিশ্ব শান্তি পরিষদের সভাপতি বিজ্ঞানী জুলিও কুরি দুটো চিঠি দিয়েছিলেন তাঁর হাতে। একটি বিশ্বখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী সি ভি রমনের জন্য আরেকটি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর জন্য। প্রধানমন্ত্রী তখন পণ্ডিত জহরলাল নেহেরু।

নেহেরু পাবলোর সঙ্গে বিশেষ কথা বললেন না। পৃথিবীতে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর স্নায়ূযুদ্ধ শুরু হয়েছে। আমেরিকা ও রাশিয়া– দু পক্ষই তাঁকে তাঁদের সঙ্গে যোগ দিতে চাপ দিচ্ছে। তিনি সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। 

বিদেশী যে কাউকেই তখন সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে। এয়ারপোর্টে গোয়েন্দারা পাবলোর লাগেজ ঘাটাঘাটি করে দেখেছে। কিছু কাগজপত্র নিয়ে গেছে। নেহেরুর কাছে প্রতিবাদ করেও কোনো সদুত্তর পেলেন না। এমন কি তিনি আগ্রার তাজমহল দেখার অনুমতি চাইলেন। কিন্তু সেটাও তাকে দেওয়া হলো না। মন খুব খারাপ হয়ে গেল।

এরমধ্যে একটি বিষয়ই পাবলোর ভালো লাগল, সেটা হলো নেহেরুর বোনের সঙ্গে আলাপ। অসাধারণ সুন্দরী নারী তিনি। দুজনে একটি ডিনারে বসেছেন। তিনি পরেছিলেন ভারতের অতি বিখ্যাত শাড়ি। শাড়ি, সোনার গয়না আর মুক্তোর হার থেকে নানা রঙ বিচ্ছুরিত হচ্ছিল। তার মধ্যে তিনিই ছিলেন সবচেয়ে উজ্জ্বল–অপরূপ অভিনেত্রীর মতো দেখাচ্ছিল তাকে। মনে হচ্ছিল তিনি কোনো অচিন দেশের রাজকন্যা। তিনি তার অঙুরীসজ্জিত অনিন্দ্য সুন্দর আঙুল দিয়ে প্লেট থেকে খাবার নেড়েচেড়ে মুখে নিচ্ছিলেন। তার কথাবলার ধরণটি ছিল মধুর। পাবলো তার প্রেমে পড়ে গেলেন। নেহেরুর নিরুত্তাপ আচরণ ভুলিয়ে দিল নেহেরুর বোন বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত। 

এই স্মৃতি নিয়ে দিল্লী থেকে কোলকাতায় কবিবন্ধু বিষ্ণু দের কাছে গেলেন পাবলো। বিষ্ণু দে-ই তাঁকে বললেন, প্রতিবেশি দেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নেহেরু তখন ভীষণ উদ্বিঘ্ন। দেশের পরিস্থিতি খুব খারাপ। যে কোনো সময় যুদ্ধ লেগে যেতে পারে।

একদিন বিকেল বেলা পাবলো গঙ্গার তীরে গেলেন। শান্ত হাওয়া। হাওড়ার ব্রিজ দেখা যাচ্ছে। একা হেঁটে যেতে লাগলেন। এর মধ্যে একটি জটলা দেখে থেমে গেলেন। দেখতে পেলেন, একটি কিশোরী মেয়ে নূপুর পারে ঘুরে ঘুরে নাচছে। লোকজন তালি দিয়ে উৎসাহ দিচ্ছে। কেউ কেউ তাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে। কেউ কেউ তার খুব কাছে এসে কোমর দোলাচ্ছে। কেউ বা ফাঁকে ফোঁকরে তার শ্লথ বসন ধরে একটু টান দিচ্ছে। মেয়েটির সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।

মেয়েটির চোখ ম্লান। মুখে আঁচড়চিহ্ন। গর্ভবতী বলেই মন হয়।

মেয়েটি খুব মৃদু স্বরে একটি গানও করছে। এতো মৃদু যে তা কান না পাতলে শোনা যায় না। তার অর্থও বোঝা যায় না। সন্ধ্যা হয়ে আসছিল। পুলিশ এসে এই জটলাকে হটিয়ে দিলেও মেয়েটির নাচ থামল না। পাবলোর দিকে একবার চোখ তুলে বলল, হা কৃষ্ণ..। আর কিছু নয়।

বিষ্ণু দে পাবলোকে জানালেন, মেয়েটি পূর্ববঙ্গ থেকে দাঙ্গার ভয়ে দেশ ছেড়ে এই দেশে রিফুজি হিসেবে এসেছে। পূর্ববঙ্গের এই রিফুজিরা পশ্চিমবঙ্গে ভরে গেছে। তাদের থাকার জায়গা নেই। উন্মুক্ত আকাশের নিচে আছে। রোদে পুড়ছে। বৃষ্টিতে ভিজছে। শীতে কাপছে। অনাহারে, অপুষ্টিতে রোগে শোকে মরছে। ভয়ানক অবস্থা।

বিষ্ণু দে পাবলোকে বেশ কিছু পেপার কাটিং দিলেন। গাবো সেগুলোকে খুব যত্নের সঙ্গে তার ব্যাগ থেকে বের করে আমাকে দেখালেন। কিছু ইংরেজিতে। কিছু বাংলা পত্রিকার কাটিংস। 

পড়ে দেখি লেখা আছে–১৯৫০ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি রাজনৈতিক নেতা একে ফজলুল হককে কোলকাতায় মেরে ফেলা হয়েছে বলে জোর গুজব রটে যায়। তারপর বরিশাল শহরে ৩০টি বাড়িঘরে দোকানপাট আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। একজনকে পিটিয়ে মারা হয়। এরপর ঝালকাঠি, গৌরনদী, নলছিটি, বাবুগঞ্জ, মূলাদীর বিভিন্ন গ্রামে একতরফাভাবে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে মার্চ মাস পর্যন্ত। আড়াই হাজারের মতো মানুষ খুন হয়। নিখোঁজ হয় দুই হাজারের মতো মানুষ। অসংখ্য নারী ধর্ষণের শিকার হয়। কয়েকজন নারী নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে থানার সামনে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে। 

গাবো আমার পড়া থামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জানো এই দাঙ্গায় ঐ এলাকার কতো মানুষ দেশত্যাগ করে পাশের দেশে রিফুজি হয়েছিল?

এ জিজ্ঞাসার উত্তর দেওয়ার আগেই গাবো নিজেই উত্তর দিলেন–প্রায় ছয় লাখ। এমনকি সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের যেসব মানুষ এই দাঙ্গাপ্রতিরোধ করতে গিয়েছিল তারাও আক্রান্ত হয়। 

গাবোর কথা শেষ হলে আনন্দবাজার পত্রিকার একটি রিপোর্ট চোখে পড়ল। সেখানে লেখা হয়েছে–

নারীদের সম্মুখে বাছিয়া বাছিয়া পুরুষদিগকে হত্যা

১৭ই ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় প্রায় ১২ শ স্থানীয় মুসলমান মূলাদী বন্দর আক্রমণ করে এবং সারাদিনব্যাপী লুটতরাজ চলে। বন্দরসঙ্গলগ্ন গ্রামগুলিও আক্রান্ত হয়, পুরুষদিগকে হত্যা করা হয় ও নারীদের উপর অত্যাচার চলে। বিপন্ন নরনারীগণ দলে দলে আসিয়া থানায় আশ্রয় নেয়; কিন্তু সেখান হইতে দারোগার নির্দেশে তাহাদিগকে থানা ত্যাগ করিয়া যাইতে হয়। অসংখ্য হিন্দু নরনারী ও শিশু জীবনভয়ে কয়েকটি গুদামে আশ্রয় লইয়াছিল। ৬/৭ শ সশস্ত্র মুসলমান বেলা প্রায় ১০/১১টার সময় গ্রামগুলি আক্রমণ আক্রমন করে। মেয়েদিগকে প্রাণে না মারিয়া সর্বপ্রকারে লাঞ্ছিত করে এবং তাহাদের সম্মুখেই বাছিয়া বাছিয়া পুরুষদিগকে হত্যা করে। ৫/৬ শত লাঞ্ছিত নারীকে গুণ্ডারা হরণ করিয়া লইয়া গিয়েছে।

—————————————————————–

আমার পড়া শেষ হলে গাবো পেপারকাটিংগুলো খুব যত্নের সঙ্গে গুছিয়ে ব্যাগে রাখলেন। ফিরে গেলেন পাবলোর কোলকাতার ঘটনা বর্ণনায়–

পরদিন আবার পাবলো একটু ভোরবেলা একা গঙ্গানদীতে গেলেন। দেখতে পেলেন কয়েকজন লোক নদীতে নেমে কিছু একটা ভাসাচ্ছিল। মনে হলো ওটা একটি ছোটোখাটো কোষা নৌকা। তার কোনো বৈঠা নেই। পালও নেই। তখন পাবলোর মনে হলো–ওটা ঠিক কৌষা নৌকা নয়–একটি অতিকায় বোয়াল মাছ। জোয়ারের স্রোত আছড়ে পড়ামাত্র দেখতে পেলো, ওটা মাছও নয়–কোনো দেবীর বিগ্রহ। পূজা শেষে ভক্তবৃন্দ তাঁকে নিরঞ্জন করছে। কাছে আসতেই তিনি দেখতে পেলেন ওটা দেবী নয়– সেটা একটা মানুষের মৃতদেহ। এবং মৃতদেহটি একজন কিশোরীর। লোকগুলো একধরনের শান্ত সমাহিত ভাব মুখে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করলেও ভেতরে ভেতরে বেশ বিরক্ত হচ্ছিল। তারা যতবারই মেয়েটিকে জলে ভাসিয়ে দিচ্ছিল, ততবারই সেটা ফিরে ফিরে আসছিল। নদী তাকে নেবে না। 

লোকজনকে পাবলো জিজ্ঞেস করলেন, মেয়েটি কে?

তারা বলল, এই মেয়েটি পূর্ববঙ্গ থেকে এসেছিল শরণার্থী হিসেবে। কিন্তু তার সঙ্গে কেউ ছিল না। তাকে কলকাতার লোকজনও রেপ করেছে। গঙ্গার পাড়ে কেউ রেপ করে ফেলে রেখে গেছে। সারা রাত নদীর পাড়ে পড়ে থাকার জন্য শেয়াল কুকুরে খেয়েছে। বিভৎস হয়ে উঠেছে। তাকে শ্মশান ক্ষেত্রে নিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। তাছাড়া এই জনমের দুর্ভাগা মেয়েটি যেন পরজনমে ভালো জীবন পায় সেজন্যই তাকে পবিত্র গঙ্গায় দিয়েছে। স্বর্গ থেকে আগত মা গঙ্গা সব পাপ ধুয়ে সূচি করে দেন।

পাবলোর মনে হলো– মেয়েটি মৃত নয়। নিদ্রিত সুন্দরী। জলের ঝাপটায় তার চোখ খুলে খুলে যাচ্ছিল। কিন্তু আশ্চর্য সুন্দর সেই চোখ দুটো। কোনো অভিযোগ নেই। যেন কারো প্রতীক্ষা করছে। লোকগুলো বারবার সেই খোলা চোখদুটোর পাপড়ি বন্ধ করে দিচ্ছিল। কিন্তু সবাইকে হতবাক করে জলের ঝাপটায় খুলে খুলে যাচ্ছিল। সে জল কিন্তু নদীর নয়। উদগত অশ্রু। বেশি নয়। এক ফোটা। ভারী। নদীর জলের সঙ্গে কোনোভাবেই মেশে না। কিন্তু সে জল নদীর জলকে ধীরে ধীরে রক্তবর্ণ দিচ্ছে। মাছি উড়ছে তাঁর ক্ষত বিক্ষত মুখটিতে। সেই মুখটি থেকে দুটি শব্দ বের হলো– হা কৃষ্ণ।

লোকগুলো এই শব্দ শুনতে পেয়েছে কি পায়নি সেটা ঠিক বোঝা গেল না। তারা মৃতমেয়েটিকে ছেড়ে জলের উপরে উঠে এলো। তারা গঙ্গাস্তোত্র পাঠ করতে করতে চলে গেল। কিন্তু সেই স্তোত্রের বদলে পাবলোর কানের ভেতরে মৃত মেয়েটির অস্ফূট শব্দ দুটি বিনবিন করে বাজতে লাগল। ক্রমশ তার মাথার মধ্যে ঢুকে পড়ল। আর চোখের মধ্যে ভাসতে লাগল সেই বিভৎস মুখটি। পাবলো পাগলপ্রায় হয়ে গেল। তার খাওয়া নেই। নাওয়া নেই। ঘুম নেই। আতঙ্কে মরে যাওয়ার দশা।

তখন কোলকাতা শহরে তেমন কোনো সাইক্রিয়াট্রিস্ট ছিল না। বিষ্ণু দে-ই তাকে কালীঘাটে একজন সাধুর কাছে নিয়ে গেলেন। সাধুটি তাকে মেয়েটির বিক্ষত মূর্তিটির একটি মানস চিত্র দেখান। বলেন, ভয় পেয়ো না।

কিন্তু সেটা দেখে পাবলোর সারা আতঙ্ক জেগেছে। 

সেটা দেখে সাধুজি যাদু বলে বিভৎস দর্শন মেয়েটিকে একটি প্রকৃত সুশ্রী চেহারায় রূপান্তর করেন। মুখশ্রীটি নেহেরুর বোনের মতো। এবং সেটা দেখে নেরুদার মন শান্ত হয়।

সাধু শুধালেন, একে দেখে আর ভয় করে?

মেয়েটির হাসি হাসি মুখশ্রী। পদ্ম ফুলের সৌরভ ভেসে আসছে। দেখে মনের বিকার চলে গেল। শান্ত হলেন পাবলো। মনে হলো এই মেয়েটিকেই সারা জনমভর দেখার মতো সুখ আর কিছুতে নেই। মাথা নেড়ে সাধুকে উত্তর দিলেন, না। ভয় নয়। ভালোবাসতে ইচ্ছে করে।

এই কথার পরে সাধু মৃত মেয়েটিকে ছোটো একটি পাথরের মূর্তিতে রূপান্তরিত করলেন। তার হাতে দিয়ে বললেন, এই মনোহর পুতুলটিকে তোমার কাছে রাখো। তাহলে তোমার আতংক থাকবে না।

সাধু তাকে আরো জানালেন, এই পুতুলে উৎকীর্ণ মেয়েটির সঙ্গে যদি তোমার প্রত্যক্ষ পরিচয় থাকে, যদি প্রকৃত প্রেমের সম্পর্ক থেকে থাকে দুজনের মধ্যে, তবে যাদু দিলেই পুতুলটি সেই মানুষটিতে রূপান্তরিত হবে। জ্যান্ত মানুষটি তাদের সামনে এসে দাঁড়াবে। যা বলবে মূর্তিটি তাই করবে।

এই পুতুলটি এক ধরনের ভুডু পুতুল।

পুতুলটিকে নিয়ে পাবলো ভারত ছাড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে রাখলেন। আর কখনোই তাকে কোনো ধরনের আতংকবোধই আক্রান্ত করেনি। তিনি বিভিন্ন দেশে চিলির দূত হিসেবে কাজ করেছেন। দেশের রাজনীতিতে অংশ নিয়েছেন। এমনকি একবার প্রেসিডেন্ট পদেও দাঁড়াতে চেয়েছিলেন। তার বন্ধু আলেন্দেকে যখন আর্মিরা মেরে ফেলেছিল, তখনও পাবলো শক্ত মেরুদণ্ড নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। আর্মির কাছে মাথা নত করেননি। তবে তিনি কখনোই পুতুলটিকে যাদু দেওয়ার ইচ্ছে পোষণ করেননি।

গাবো পাবলোর কথা শেষ করলেন। কফিতে চুমুক দিলেন। 

পাবলোর সঙ্গে গাবোর বয়সের বেশ পার্থক্য আছে। দুজনের দেশ আলাদা। তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়াটা খুব সহজে হওয়ার কথা নয়। গাবোর কথাতে মনে হলো নীবিড় বন্ধুত্বই ছিল দুজনের মধ্যে। গাবোকে শুধালাম, পাবলোর সঙ্গে তোমার শেষ কবে দেখা হয়েছিল?

— ১৯৮৮ সালে। গাবো হিসেব করে বললেন। 

গাবোর সঙ্গে যখন পাবলোর শেষ দেখা হয়েছিল, তখন পুতুলটি তাকে দিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, গাবো, আমার জীবনে কবিতা ছাড়া আর কোনো যাদু নেই। তুমি যাদু জানো। এটা রাখো। তোমার কাজে লাগতে পারে।

একথা বলে আমাকে আর রোজাকে বিশ্বাস করাতেই যেন গাবো তার ব্যাগ থেকে একটি পাথরের পুতুল বের করলেন। সেটা বেশ ছোটো হলেও নিখুঁত। নৃত্য ভঙ্গিমারত পুতুলটিকে জ্যান্ত বলে মনে হয়।

— এইবার। গাবো মন্ত্রোচ্চারণের মতো ফিসফিস করে বললেন, এইবার–

রোজা আর আমি একটু চমকে গিয়ে সমস্বরে শুধালাম, এইবার কী?

গাবো গাঢ় রহস্যময় গলায় উত্তর দিলেন, শাকিরাকে আনব।

শাকিরাকে খুব পছন্দ করেন গাবো। সময় বের করে তার বিভিন্ন কনসার্টে উপস্থিতও থাকেন। কখনো কখনো নিজেই স্টেজে চলে যান। শাকিরার সঙ্গে এই বুড়ো বয়সেও নাচেন ও গান করেন। এটা নিয়ে কিছু ফিসফাসও আছে। কারো কারো ধারণা, তিনি শাকিরাকে ভালোবাসেন। শাকিরাও তাকে বাসে। গাবোর অনুরোধে শাকিরা একটি সিনেমায় গানও গেয়েছিলেন। শাকিরা তার একটি অটোগ্রাফ নিয়েছিলেন। সেটা তার ব্যক্তিগত রুমের দেওয়ালে টানিয়ে রেখেছেন। গাবো তার ডাইরিতে লিখেছিলেন, আমরা যে জীবন যাপন করছি তা কিন্তু সত্যিকারের জীবন নয়। যে জীবনের কথা আমরা ভাবি, যে জীবনের গল্প আমরা বারবার করি– সেটাই আমাদের প্রকৃত জীবন। এই অটোগ্রাফ পেয়ে শাকিরা গাবোকে জড়িয়ে ধরে প্রকাশ্যে চুমু খেয়েছিলেন।

সেটা স্মরণ করে গাবো তার ডাইরির খোলা পাতাটিতে শাকিরার নামের উপরে চুমু খেলেন। তারপর পুতুলটির প্রতি গভীর আগ্রহ ভরে মন:সংযোগের চেষ্টা করলেন। যতটা সামান্য বিষয় মনে হয়েছিল বিষয়টা ততোটা সামান্য নয়।

জিজ্ঞেস করলেন, কী দেখছ?

— পুতুল দেখছি। উত্তর দিলাম। রোজাও বলল, ড্যান্সিং গার্ল।

–গুড। হাসলেন গাবো।

প্রকৃত জাদুকররা যেমন যে কোনো বিশেষ জাদু প্রদর্শনের সময় নানা কসরৎ করেন, নানা অভিনয় করেন, এমন ভাব দেখান যেন কাজটি সহজ সরল নয়– কঠিন, জটিল ও পরিশ্রম সাধ্য, যাতে করে দর্শকের মধ্যে আকর্ষণ সৃষ্টি হয়, টেনশন বাড়ে, শ্বাস রুদ্ধ হতে আসে, শেষ মুহূর্তের জন্যে অপেক্ষা করে– ঠিক সেরকম করেই গাবো পুতুলটিকে চোখের সামনে রেখে নানাভাবে চেষ্টা তদ্বির করতে লাগলেন। তার মুখের সহজ স্বাভাবিক রেখাগুলো পালটে যেতে লাগল। জিজ্ঞেস করলেন, এবার কী দেখছ?

— পুতুল। আমার সোজা উত্তর। রোজা বলল, নো চেঞ্জ গাবো। 

এবারে গাবোর মুখের হাসি উবে গেল। তার কপালে ঘাম দেখা দিল। তার হাত কাঁপতে লাগল। এবারে পুতুল থেকে শাকিরা না হয়ে পারে না। উত্তেজনায় তিনি দাঁতে দাঁত চেপে ধরলেন। চোখ বন্ধ করে ফেললেন।

তারপর গভীর আগ্রহের সঙ্গে আমার কাছে জানতে চাইলেন, শাকিরাকে দেখতে পাচ্ছ? 

কি হচ্ছে বুঝতে না পেরে রোজা ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে রইল। আমার ভয় লাগল, এই বুড়ো বেলায় গাবো নামের লোকটি আবার হার্ট স্ট্রোক করে না বসে। বললাম, গাবো, এটা ছাড়ো। শাকিরাকে দরকার নেই।

তিনি এবারে চিৎকার করে উঠলেন, থাকবে কেনো? শাকিরা আলবৎ আসবে।

রোজা এবারে সহ্য করতে পারল না। সে কী বুঝে বলে উঠল, শাকিরাকে দেখতে পাচ্ছি।

গাবো একবার আমার মুখের দিকে, আরেকবার শাকিরার মুখের দিকে তাকালেন। তারপর পুতুলটিকে আরো গভীরভাবে দেখতে লাগলেন।

তিনি বিস্মিত হয়ে বুঝতে পারলেন, শাকিরার প্রতি তার প্রেম আছে সত্যি। কিন্তু সেটা সত্যিকারের প্রেম নয়। সেটা এক ধরনের বাৎসল্য প্রেম। গাবো তার নিজের স্ত্রীকেই গভীরভাবে ভালোবাসেন। ভালোবাসেন বলেই তার সঙ্গে সারাজীবন পার করছেন। কোনো ঝামেলা হয়নি। ফলে পুতুলটি পুতুলই রইল। শাকিরায় রূপান্তরিত হলো না।

তিনি ব্যর্থ হয়ে পুতুলটিকে ছুড়ে ফেলে দিলেন। আঁতকে জিজ্ঞেস করলাম, আহ হা হা হা করেন কি, করেন কি?

তিনি উত্তর দিলেন না। হনহন করে কারনিভালের ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেলেন। রোজা আর্তনাদ করে উঠল।

৪.

এই সময় রেস্তোরাঁর সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন একজন বুড়ো লোক। মাঝে মাঝে তাকে এই এলাকায় দেখা যায়। এক সময় একটা গ্রোসারিতে কসাইয়ের কাজ করতেন। এখন বয়স হয়েছে। কাজ করার মতো সামর্থ্য নেই। কিন্তু গার্বেজ ড্রাম থেকে খালি সোডা ও জলের বোতল টোকান। সেগুলো বিক্রি করে কিছু টাকা পয়সা পান। লোকটি কিছুটা ছিটগ্রস্থ। বিড়বিড় করেন। কান পাতলে মনে হবে তিনি কারো সঙ্গে কথা বলছেন। কিন্তু তার কোনো সঙ্গী নেই। নিজেই কথক। নিজেই স্রোতা। এখন তার কাজ নেই। এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ান। আর সাবওয়ের বেঞ্চিতে ঘুমান। কেউ কেউ তাকে শ্যামদা নামে চেনে। তবে তার নাম শ্যাম বা শ্যামাপদ কিনা ঠিক করে বলা যায় না।

পুতুলটি এই শ্যামাপদর চোখে পড়ল। এটা তার দরকার নেই। তবু কি ভেবে পুতুলটি কুড়িয়ে নিলেন। বোতল কুড়ানো বাদ দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। চোখের খুব সামনে নিয়ে পুতুলটিকে সম্মোহিতের মতো দেখতে লাগলেন।

এভাবে বেশ কিছুক্ষণ দাড়িতে থাকতে দেখে রোজা ছুটে এসে জিজ্ঞেস করল, তুমি ঠিক আছ তো?

শ্যামাপদ শোনেননি বলে মনে হলো। রোজা বেশ বিব্রত হলো। রেস্তোরাঁর সামনে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার চল নেই। যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে তবে এম্বুলেন্স ডেকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেবে। রোজার অনুরোধে আমি তাকে শুধালাম, কোনো সমস্যা বোধ করছেন?

এবারে শ্যামাপদ গভীর ঘোর থেকে বেরিয়ে এলেন। আমার দিকে পুতুলটি দেখিয়ে বললেন, একে রাধারাণীর মতো লাগে।

একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, রাধাকৃষ্ণের রাধারাণী?

তিনি মাথা ঝাঁকিয়ে কী বললেন ঠিক বোঝা গেল না। অনুমানে বোঝা গেল, হতে পারে। আবার নাও হতে পারে।

তিনি পাথরের রাধারাণীতে মেতে আছেন। বিড়বিড় করে রাধারানীর কথা বলছেন–

এই পাথরের ছোটো রাধারানীর পরণে নীলাম্বরী শাড়ি। পদ্মের মতো পা। সেখানে নূপুর। ঝুনঝুন করে বাজে। গলার দুপাশে দুটো বেণী নেমে এসেছে। হাতে কুন্দ ফুলের বাজু। চক্ষু বেয়ে জল পড়তে পড়তে থেকে গেছে। রাধারানী আকুল হয়ে গাইছে–

ওরে নীল যমুনার জল!

বল রে মোরে বল কোথায় ঘনশ্যাম-

আমার কৃষ্ণ ঘনশ্যাম।

আমি বহু আশায় বুক বেঁধে যে এলাম-

এলাম ব্রজধাম।।

কৃষ্ণবিরহে রাধারানী কেঁদে কেঁদে ব্যাকুল হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে। বনে বনে, ঘরে ঘরে এই অনুসন্ধান। কিন্তু কৃষ্ণের দেখা নেই। সবাই কেঁদে কেঁদে সারা। কৃষ্ণ আছেন সর্বত্র। তিনি মিটি মিটি হাসছেন। এখনই দেখা দেবেন না। আড়ালে রইবেন। 

এই পর্যায়ে এসে রাধারানীর ডানপায়ের একটি দূপুর খুলে যায়। কেউ টের না পেলেও কৃষ্ণ এই নূপুরের খসে পড়াটা দেখতে পেয়েছেন। তিনি অন্তর্জামি। তার চোখ থেকে কিছুই এড়াতে পারে না। রাধারানী এখনো টের পায়নি। টের পেলে তার নাচ থেমে যাবে। অনুসন্ধান থেমে যাবে।

সেটা অসহনীয়। কৃষ্ণ আড়াল থেকে ছুটে এসে নূপুরটি রাধারানীর পায়ে পরাতে যান। পদ্মফুলের ন্যায় রক্তাভ পা দেখে তিনি নূপুর পরাতে ভুলে যান। সেখানে তার বুক পেতে দিতে ইচ্ছে করে। বলতে ইচ্ছে করে, দেহি পদপল্লভ মুদারাম। অনির্বচনীয় আনন্দে তার চোখ ভিজে আসে। 

উষ্ণ জলের ফোটা পায়ে পড়লে রাধারানী চমকে ওঠেন। দেখতে পান যে কৃষ্ণকে জগৎ জুড়ে তিনি খুঁজে চলেছেন, এ জগতের সবাই খুঁজে চলেছে– সেই অধরা কৃষ্ণ তার পায়ে পড়ে আছেন। তিনিও আকুল হয়ে কৃষ্ণের পরে ভেঙে পড়েন।

তখন পুষ্পবৃষ্টি হলো। চারিদিকে হর্ষধ্বনি করে ওঠে। জয় রাধারাণী।

এর মধ্যে রাধারাণী কৃষ্ণের বাঁশিটিতে তার রাখি বেঁধে দেয়। রাখির মাথায় রাধার মাথার সোনার টিকলি ঝোলে।

কৃষ্ণ উঠে দাঁড়ায় না। রাধারাণী তাকে ফিস ফিস করে বলে, দাদা উইঠা পড়েন। লোকে সন্দো করবে।

লোকে সন্দেহ করুক আর নাই করুক, তাতে কিছু যায় আসে না। কৃষ্ণপালার এ আসর জমাটি হয়েছে। কৃষ্ণরূপী শ্যামাপদ সেটা দেখে খুব খুশি। এরপর মাধবপাশায় আসর আছে। জমিদারবাবু এবার মেডেল দেবেন বলেছেন। তার জন্য কৃষ্ণযাত্রা দলটিকে বিশেষ প্রস্তুতি নিতে হবে।

শ্যামাপদর বর্ণিত কাহিনীর এইখানে এসে তাকে, জিজ্ঞেস করি, এই রাধারাণীর বাড়ি তো বৃন্দাবন না। তাইলে কোথায়?

এ ব্যাপারে শ্যামাপদ ঘোর থেকে ফিরে আসেন। স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন। মনে হলো তিনি প্রশ্নটির পুরোটা তিনি শুনতে পাননি। শুনতে পেলে উত্তর দেবেন। তাকে আবার প্রশ্নটি করি। 

তিনি জানান, রাধারাণীর বাড়ি বৃন্দাবনই। তবে এই রাধারাণীর নাম জ্যোৎস্না। বাড়ি মূলাদী বাজার থেকে একটু পশ্চিমে বন্দরহাটে। পাশে আড়িয়াল খাঁ নদী। হাঁটা পথে ঘণ্টাখানেক। মুলাদীর কৃষ্ণযাত্রার পালায় রাধারাণী সাজে বলে লোকে জ্যোৎস্না নামটি ভুলে গেছে। তাকে রাধারাণীই বলে সবাই আদর করে ডাকে।

এরপর শ্যামাপদ বলেন, সেদিন হিজলার কৃষ্ণপালা শেষ হলে রাধারাণীর দল মূলাদী রওনা করল। রূপসজ্জা ভাঙেনি। রাধারাণীর বেশেই চলেছে। পরণে নীলাম্বরী। পায়ে নূপুর। হাঁটলে ঝুমঝুম শব্দ হয়। সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ। বগলে রাখিচিহ্ন বাঁধা বাঁশিটি গুঁজে অমৃত বিড়ি ফুঁকছে। মাথায় ময়ূরপাঙখা গোঁজা।

হিজলা থেকে মুলাদী এসে পড়লে দেখা গেল, গ্রামের যুগী পাড়ায় লোক নেই। সাহাপাড়াও ফাঁকা। নমোপাড়ার লোকজন তাড়াহুড়া করে ঘর দোর রেখে চলেছে। তাদেরকে দেখে বলল, ওরে তোরা আর যাসনে। আমাগো সঙ্গে চল।

— কোথায় চলব?

— থানার সামনে।

— থানার সামনে? চমকে উঠল শ্রীকৃষ্ণ। থানার নামে তারা ভয় পায়।

— বরিশালে কাটাকাটি লাগছে। থানার দারোগা সাবে খবর দিছেন, সেখানে গেলে রক্ষা করতে পারবে।

রাধারানীর বন্দরহাটে যেতে পারলে তার ভয় নেই। সেখানে তার স্বজনরা আছে। কিন্তু সে গেল না। শ্রীকৃষ্ণকে ছেড়ে এভাবে সে যেতে পারে না। বলে, কৃষ্ণ বিহনে রাধা বাঁচে না গো।

থানার সামনে ততক্ষণে গ্রামের লোকজন পরিবার পরিজন নিয়ে ভীড় করেছে। তারা বেশ উদ্বিঘ্ন। ওসি সাহেবের সঙ্গে প্রবীণ কয়েকজন দেখা করার চেষ্টা করছেন। তিনি সন্ধ্যার আগেই বেরিয়ে গেছেন। সেকেন্ড অফিসার ফোন ধরে বসে আছেন। কারো কথা শোনার সুযোগ নেই। এদিকে রাত বাড়ছে। ভয়ঙ্কর খবর আসছে। 

শেষ রাতের দিকে থানায় ফিরলেন ওসি সাহেব। তিনি হুকুম করলেন উপস্থিত সবাইকে ফুড গোডাউনে আশ্রয় নিতে। সেখানে পুলিশ পাহারা দিতে পারবে। কোনো সমস্যা হবে না।

শ্যামদা বা শ্যামাপদ হঠাৎ করে থেমে গেলেন। আর কিছু বলছেন না। কোনো এক ঘোরের মধ্যে আটকে গেছেন। ঠোঁট ভয়ংকরভাবে কাঁপছে।

তাকে খুব মমতাভরে শুধালাম, তারপর?

তিনি খুব চেষ্টা করে নিজেকে থামালেন। স্বাভাবিক মানুষের মত তাকালেন। বললেন, তারপর আর কি। তারপর আর নাই। পরদিন ভোরবেলা ঐ গোডাউনে কাউকে দেখা যায়নি। সব সাফ সুতারো। শুধু একটা লাল রক্তের ধারা নদীর স্রোতে মিশে গিয়েছিল।

— রাধারানী? 

— কেউ কেউ বলে, রাধারানীকে পাশের গ্রামে দেখা গিয়েছিল। কেউ কেউ বলে রাধারানী টানবাজারের মাগী পট্টিতে চালান হয়ে গেছে। আবার কেউ কেউ বলে, রাধারানী বর্ডার পার হয়ে চলে গেছে। শিয়ালদায় বসে আছে। শরনার্থী ট্রেনের অপেক্ষায় আছে।

শ্রীকৃষ্ণ রাধারাণীকে খুঁজতে খুঁজতে শেয়ালদায় গেলেন। শুনলেন, সেখানে একটি কিশোরী মেয়ে নেচে নেচে কৃষ্ণপালার গান করে। তার বসন ভুষণ ছিন্ন। খেতে দিলে খায়। না খেতে দিলে খায় না। পানি পানি বলে রব তোলে। জল দিলে চেঁচিয়ে ওঠে। বলে, রক্ত। ফেলে দেয়।

তারপর যখন, তৃষ্ণা অসহনীয় হয়ে ওঠে তখন চোখ বন্ধ করে জল খায়।

রিফুজি রেজিস্টার তাকে জিজ্ঞেস করে, নাম কি?

–জ্যোৎস্না।

— পদবী কী?

— বেগম। জ্যোস্না বেগম। পিং সোমেদ মুন্সী।

রেজিস্টার কলম ফেলে বলে ওঠে, মোসলমান?

এর কোনো জবাব নেই রাধারানী অথবা জ্যোস্না বেগমের।

তাকে আর শেয়ালদায় দেখা যায় না। দেখা যায় গঙ্গার পাড়ে ঘুরতে। গর্ভচিহ্ন আছে।

শ্যামাপদকে জিজ্ঞেস করি, গঙ্গার পাড়ে খুঁজতে গিয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণ?

তিনি মাথা নাড়লেন, হ্যাঁ। সেখানে গিয়েছিলেন। লোকে বলল, একটি পাগলী ছিল বটে। তবে তাকে একদিন গঙ্গায় ভাসতে দেখা গিয়েছিল। কেউ কেউ বলে, তাকে রেপ করে লোকজন মেরে ফেলেছে। কেউ কেউ বলে, সে নিজেই জলে ডুবে আত্মহত্যা করেছে।

শ্যামাপদ আর সহ্য করতে পারেন না। কাটা পশুর মতো আর্তনাদ করে ওঠেন, আমার রাধা। রাধারাণী।

এ কথা বলতে বলতে শ্যামদা অথবা শ্যামাপদ তার কোমর থেকে একটি বাঁশি বের করেন। বাঁশিতে একটি রাখিচিহ্ন বাঁধা। রাখির মাথায় সোনার টিকলি ঝোলে। তার চোখ জলে ভরে ওঠে। টপ টপ করে সেই জল পুতুলটির গায়ে লাগে। পুতুলটিতে বিদ্যুতের ঝলক জাগে। ধীরে ধীরে তার আকার বড় হয়। দেখা যায়, তার পরনে নীলাম্বরী। পায়ে নূপুর। হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নেচে ওঠে। গেয়ে ওঠে, ওরে নীল যমুনার জল/ বল রে এবার বল

কোথায় ঘনশ্যাম….

রোজা আবার কফি বানানো ফেলে ছুটে আসে। তার সারা শরীরে আনন্দের হিল্লোল। কারনিভালের লোকজন তাকে দেখে সমস্বরে বলে ওঠে, শাকিরা। শাকিরা।

শাকিরা এসে গেছে। নেচে নেচে গান করছে।

She’s so sexy every man’s fantasy a refugee like me 

back with the refugees from a 3rd world country

I go back like when ‘pac carried crates for Humpty Humpty

I need a whole club dizzy

Shakira! Shakira! Shakira!

[গ্রন্থসূত্র: মার্কেজের পুতুল ও অন্যান্য গল্প]

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত