| 27 এপ্রিল 2024
Categories
ইতিহাস এই দিনে

লেনিন জাদুঘর

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

তাঁর পুরো নাম ভ্লাদিমির ইলিচ উইলিয়ানভ। কিন্তু বিশ্বের অসংখ্য মুক্তিকামী ও প্রতিবাদী মানুষের কাছে তার পরিচয় তাদের প্রিয় নেতা লেনিন। ১৮৭০ সালের ২২ এপ্রিল জন্ম  নেওয়া এই মহান নেতা তাঁর জীবদ্দশায় মুক্তিকামী মানুষের জন্য করেছেন অনেক কিছু। জন্ম রাশিয়ায় হলেও সারা পৃথিবীর মানুষের কাছেই তাঁর সমান মর্যাদা। মুক্তিকামী সব মানুষের প্রিয় এই নেতা ছিলেন অক্টোবর এবং মহান নভেম্বর বিপ্লবে বলশেভিকদের প্রধান নেতা। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান এবং লেনিনবাদ তত্ত্বের প্রবক্তা। আজ তাঁর জন্ম দিবসে ইরাবতী পরিবারের বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। তাঁকে নিয়ে লিখেছেন—তারেক অণু।


যদি বলি Vladimir Ilyich Ulyanov এবং Ioseb Besarionis dze Jugashviliর প্রথম সাক্ষাৎ কোথায় হয়েছিল তাহলে অধিকাংশই পড়ুয়াই ভুরু কুঁচকে বলে বসবেন- ভর সন্ধ্যাবেলা এই খটোমটো নামগুলো না বললে হচ্ছে না! কিন্তু এদের দুইজনকে নিয়ে আজ পর্যন্ত যত বই লেখা হয়েছে মানব ইতিহাসে তার জুড়ি মেলা ভার। আবার দুইজনেই লিখেছেনও অনেক, প্রথমজনতো দার্শনিকের মর্যাদা পেয়েছেন সারা বিশ্ব জুড়ে। তাদের পছন্দ করুন, অপছন্দ করুন, ঘৃণা করুন, বা সন্মান করুন ইতিহাসে তাদের ভূমিকা কেউ-ই এড়াতে পারবে না।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


কিন্তু যদি বলতাম লেনিন এবং স্ট্যালিনের প্রথম দেখা কোথায় হয়েছিল? তাহলেই সবাই বলতেন, ওহ তারা! তা তেনাদের আসল নাম এমন লৌহবেষ্টনী দিয়ে ঘেরা নাকি !

অবাক ব্যাপার হচ্ছে লেনিন এবং স্ট্যালিনের প্রথম দেখা হয় ১৯০৫ সালের ছবির ঘরটিতে, যার অবস্থান বর্তমান ফিনল্যান্ডের তামপেরে শহরে, যা ছিল লেনিনের বাসস্থান ( ফিনল্যান্ডে তিনি অনেক দিন আত্মগোপন করেছিলেন জারের রোষানলে , এই বাসাতেও ছিলেন প্রায় ২ বছর), বর্তমানে লেনিন জাদুঘর। আজকের যাত্রা সেই দিকেই-


images

download


১৯০৫ সালের ডিসেম্বরে বলশেভিকদের কনফারেন্স হয়েছিল তামপেরে শহরের এই ওয়ার্কার হলে, এবং কদিন পরেই ১৯০৬র ৭ জানুয়ারি লেনিনের সাথে ব্যক্তিগত ভাবে কথা বলেন তরুণ জর্জিয়ান নেতা স্ট্যালিন, ব্যক্তিগত জীবনে লেনিনের ব্যপক ভক্ত হওয়া সত্ত্বেও সেদিন লেনিনের ভোটে অংশগ্রহণের রাজনৈতিক কৌশলের সমালোচনাই করেছিলেন বলে জানা যায়।


Lenin_and_stalin


এইটি বিশ্বের দুর্লভতম জাদুঘরগুলোর একটি, কারণ সোভিয়েত রাশিয়ার ভাঙ্গনের পর লেনিন নিয়ে সমস্ত স্মৃতিমালা যেন চাপা পড়ে গিয়েছে এক নিমেষে, কিন্তু ফিনল্যান্ডের ক্ষুদে জাদুঘরটি টিকে গেছে, মূলত এই দেশের লোকদের আগ্রহের কারণেই। লেনিন বলেছিলেন – রুশ জাতিভুক্ত জনসাধারণ তথা শ্রমিক ও কৃষক অন্য কোন জাতিকে পীড়ন বা অত্যাচার করার কোনো ইচ্ছাই পোষণ করে না। রুশ দেশের সীমানার অন্তর্ভুক্ত অরুশ কোন জাতিকে জবরদস্তি করে বেঁধে রাখার কোন ইচ্ছাই রুশ জাতির নেই এবং কস্মিনকালেও করবে না। এর অর্থ হলো যে, বৃহত্তর রুশ জাতির পোল্যান্ড, ইউক্রেন, ফিনল্যান্ড, আর্মেনিয়া কিংবা অন্য কোন জাতিকে জবরদস্তি করে বেঁধে রাখবে না। বৃহত্তর রুশ জাতির অন্য সকল জাতিকে স্বেচ্ছায় এক মৈত্রীমূলক সংযুক্ত সংঘে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে।


05_moravov-tampere


সেই প্রতিশ্রুতি মোতাবেক বলশেভিক বিপ্লব সফল হবার পরপরই ফিনল্যান্ড প্রতিনিধিদলের সাথে আলাপ করে তাদের স্বাধীনতার ব্যাপারে সম্মত হন, এই ব্যাপারে তার এক যুক্তি ছিল- এই স্বাধীনতার ফলে ফিনল্যান্ডের ভিতরের পুঁজিবাদীরা আর সমাজতন্ত্রের ভয় দেখিয়ে সাধারণ ফিনিশ জনগণকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারবে না সাম্যবাদের দুয়ার থেকে ।

সেই আদর্শবাদী কমরেড লেনিন কে নিয়েই সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখেছিলেন-

লেনিন ভেঙেছে রুশে জনস্রোতে অন্যায়ের বাঁধ,
অন্যায়ের মুখোমুখি লেনিন প্রথম প্রতিবাদ।
আজকেও রাশিয়ার গ্রামে ও নগরে
হাজার লেনিন যুদ্ধ করে,
মুক্তির সীমান্ত ঘিরে বিস্তীর্ণ প্রান্তরে।
বিদ্যুৎ-ইশারা চোখে, আজকেও অযুত লেনিন
ক্রমশঃ সংক্ষিপ্ত করে বিশ্বব্যাপী প্রতীক্ষিত দিন,-
বিপর্যস্ত ধনতন্ত্র, কন্ঠরুদ্ধ, বুকে আর্তনাদ;
-আসে শত্রুজয়ের সংবাদ।

সযত্ন মুখোশধারী ধনিকেরও বন্ধ আস্ফালন,
কাঁপে হৃৎযন্ত্র তার, চোখে মুখে চিহ্নিত মরণ।
বিপ্লব হয়েছে শুরু, পদানত জনতার ব্যগ্র গাত্রোত্থানে,
দেশে দেশে বিস্ফোরণ অতর্কিতে অগ্নুৎপাত হানে।
দিকে দিকে কোণে কোণে লেনিনের পদধ্বনি
আজো যায় শোনা
দলিত হাজার কন্ঠে বিপ্লবের আজো সম্বর্ধনা।
পৃথিবীর প্রতি ঘরে ঘরে,
লেনিন সমৃদ্ধ হয় সম্ভাবিত উর্বর জঠরে।
আশ্চর্য উদ্দাম বেগে বিপ্লবের প্রত্যেক আকাশে
লেনিনের সূর্যদীপ্তি রক্তের তরঙ্গে ভেসে আসে;
ইতালী, জার্মান, জাপ, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, চীন,
যেখানে মুক্তির যুদ্ধ সেখানেই কমরেড লেনিন।
অন্ধকার ভারতবর্ষঃ বুভুক্ষায় পথে মৃতদেহ-
অনৈক্যের চোরাবালি; পরস্পর অযথা সন্দেহ;

দরজায় চিহ্নিত নিত্য শত্রুর উদ্ধত পদাঘাত,
অদৃষ্ট ভর্ৎসনা-ক্লান্ত কাটে দিন, বিমর্ষ রাত
বিদেশী শৃঙ্খলে পিষ্ট, শ্বাস তার ক্রমাগত ক্ষীণ-
এখানেও আয়োজন পূর্ণ করে নিঃশব্দে লেনিন।

লেনিন ভেঙেছে বিশ্বে জনস্রোতে অন্যায়ের বাঁধ,
অন্যায়ের মুখোমুখি লেনিন জানায় প্রতিবাদ।
মৃত্যুর সমুদ্র শেষ; পালে লাগে উদ্দাম বাতাস
মুক্তির শ্যামল তীর চোখে পড়ে, আন্দোলিত ঘাস।
লেনিন ভূমিষ্ট রক্তে, ক্লীবতার কাছে নেই ঋণ,
বিপ্লব স্পন্দিত বুকে, মনে হয় আমিই লেনিন।।


lenin_speech2


কিন্তু আদপেই কী বাস্তব জীবনে লেনিন এবং তার রাজনীতি এতটাই মহান ছিল?

লেনিনের জীবিত অবস্থাতেই লাল বাহিনী হানা দিয়েছিল ক্ষুদের দেশ এস্তোনিয়াতে, মাত্রে ১ মিলিয়ন জনসংখ্যার দেশটি তারা দখল করে রেখেছিল ১৯৯১ পর্যন্ত, যে দীর্ঘ সময়ে তাদের মাতৃভাষায় জাতীয় সংগীত ছিল নিষিদ্ধ, শুনতে হয়েছে শুধু চাপিয়ে দেওয়া রুশ ভাষার জয়গান।
পরবর্তীতে চেক প্রজাতন্ত্র, হাঙ্গেরি, ইউক্রেইন, মলদোভা কোথায় অস্ত্রের মুখে রুশ সাম্রাজ্যবাদকে সাম্যবাদের মুখোশে ঢেকে বিস্তারের চেষ্টা করে নি রুশী বাহিনী! যেহেতু লেনিনের সময়েই এই অরাজকতার শুরু হয়েছিল তা হলে আমরা কি ধরে নিব- যে মুখে মানুষের মুক্তি বুলি আউড়ানো সমাজতান্ত্রিক বিল্পবের ঝাণ্ডা উড়ানো এই নেতাও ছিলেন আর দশ জন রাজনীতিবিদের মতই? না হলে অন্য দেশ দখলে যায় কি করে তার সেনাবাহিনী?

তার চেয়েও বড় কথা- উনি বললেন, সবাইকে স্বেচ্ছায় যোগ দিতে, পরবর্তীতে যোগ না দেওয়ায় আক্রমণ চলল! তার মানে কি – ভালোয় ভালোয় বলছি আমার সাথে থাক, আর না থাকলে মুণ্ডু উড়িয়ে দিব?

যে লেনিন মাঠে ক্রীড়ারত বালকদের দিকে চেয়ে বলেছিলেন এদের কারো কারো বাবাকে বিল্পবের বলি হতে হচ্ছে সময়ের দাবীতে, যাতে এই ছেলেদের ভবিষ্যৎ অনেক উজ্জলতর হয়, ভালো হয়! আসলেই কি তাই ঘটেছিল?

লেনিন সম্পর্কে বর্তমানে প্রাপ্ত তথ্য দেখা যাচ্ছে তার ক্ষমতায় আরোহণের জন্য আপোষ করা, বিরোধীদের দমন করা, এবং অনেক সময় পৃথিবী থেকে চিরতরে সরিয়ে দেবার ক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিলেন না তিনিও। যদিও সবই বিপ্লবের বলি বলে পাশ কাটিয়ে গেছেন সবসময়ই।


lenin2


বিশাল ভবনের দুই কক্ষ মিলিয়ে ক্ষুদের জাদুঘরটি, দেয়াল জুড়ে লেলিনের জীবনের নানা সময়ের আলোকচিত্রের কপি, গুরুত্বপূর্ণ খবরের কাগজ, পোস্টার, লিফলেট, তার লেখা অযুত বইয়ের সংগ্রহ। আসলে এখানে ব্যক্তি লেলিন সম্পর্কে একটা ধারণা দেবার চেষ্টা করা হয়েছে, সেই সাথে দেখানো হয়েছে লেনিন CULTকে। বিখ্যাত সেই ছবিটির দেখা মিলল যেখানে ছদ্মবেশী লেনিনকে দাড়ি ছাড়া অবস্থায় দেখা যাচ্ছে একজন
শ্রমিকের বেশে,


lenin-in-disguise-1916

eeis_01_img0347


এর সাহায্যেই ফিনল্যান্ডে পালিয়েছিলেন তিনি জারের রোষানল থেকে রক্ষা পেতে, ফিরেছিলেন আবার বিপ্লবের অগ্নিক্ষণে। তামপেরে থেকে ১৯০৭ সালে সুইডেনে পালাতে বাধ্য হবার পর পরবর্তী ১০ বছরে লেনিন রাশান সাম্রাজ্যের কোথাও আসতে পারেন নি, অবশেষে জার্মানদের সাহায্যে ১৯১৭র বিশ্ব কাঁপানো বিপ্লবে ফেরেন রাশিয়াতে, যে স্টেশনে ফিরেছিলেন , দিয়েছিলেন আগুনঝরা ভাষণ তার নাম ফিনল্যান্ড স্টেশন!


tampere


কাঁচের শোকেসে রাখা আছে লেনিন ও স্ট্যালিনের ডেথ মাস্ক। অবশ্যই নকল ছাঁচ।


406829559_6b822e7f02_z

PC011511


স্ট্যালিনের দিকে তাকিয়ে অবাক লাগে, যে মানুষটি বিপ্লবের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিলেন অনেকবার, নিজের সাইবেরিয়ার নির্বাসিত হয়েছিলেন অগণিত বার সেই মানুষটির কী পরিবর্তন দেখা গেল নিরঙ্কুশ ক্ষমতা পাবার এবং তা ধরে রাখার জন্য। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সকল দেশে এমনকি পিতৃভূমি জর্জিয়াতেও স্ট্যালিন এক অভিশপ্ত নাম, তার কারণে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে প্রায় ৫ কোটি লোক মারা গিয়েছিল! সরাসরি হত্যা থেকে শুরু করে সাইবেরিয়ায় নির্বাসন, কৃত্রিম ভাবে দুর্ভিক্ষ তৈরি এমন অনেক ভাবেই সামান্যতম বিরুদ্ধমত পোষণকারীদের শায়েস্তা করেছে স্ট্যালিন ও তার পাণ্ডারা। বিশেষ করে তার Personality Cult এর চর্চা কিংবদন্তী হয়ে আছে এখনও ইতিহাসের কালো অধ্যায় হিসেবে।

ফিনল্যান্ডে স্ট্যালিনকে হিটলারের চেয়েও অনেক নিষ্ঠুর, খুনি, ঘৃণিত হিসেবে দেখা হয়। (১৯১৭ সালে ফিনল্যান্ড ছিল জারের সাম্রাজ্যের অধীনে একটি স্বায়ত্তশাসিত রাজ্য বা ষ্টেট, যাদের ছিল নিজস্ব সিনেট, মুদ্রা। বলশেভিক বিল্পবের ফলে তারা জারতন্ত্রের কবল থেকে মুক্তি পেয়ে নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং লেনিন নিজেও এটি অনুমোদন করেন। কিন্তু অন্য শীর্ষ নেতারা কেউই এই সিদ্ধান্ত উদারতার সাথে মেতে নিতে পারে নি, ফলে সবসময়ই তাদের শোষণমূলক মনোভাব জারি ছিল শিশুরাষ্ট্রটির বিরুদ্ধে, তাই কেবলমাত্র স্তালিন বাহিনীর কবল থেকে রক্ষা পাবার জন্য হিটলারের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করতে বাধ্য হন ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ফিনিশ সরকার ( বাঙ্গালী নেতা সুভাষ বসু যেমন ইংরেজদের শত্রু হিসেবে হিটলারের সাথে জোট বাঁধতে চেয়েছিলেন), ফলে বিশ্বযুদ্ধের পর রাশান সেনাবাহিনী ফিনল্যান্ডের ২য় বৃহত্তম শহর ভিপুরিসহ কারেলিয়ায় অঞ্চলের বিশাল এলাকা দখল করে নেয় যা আজ পর্যন্ত রাশিয়ার দখলেই আছে। )

ইতিহাসকে নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখতে চেষ্টা করি আমরা, যদিও তা খুব কঠিন কাজ, লেনিন, স্ট্যালিনের মত ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রদের black or white ভাবে মাপা খুব কঠিন কাজ, স্তালিনের শত নৃশংস কাহিনী প্রচার পেলেও বলা হয় না তার জ্যেষ্ঠ পুত্র জ্যাকব নাৎসি বাহিনীর হাতে ধরা পড়লে কয়েকজন বন্দী নাৎসি অফিসারের মুক্তির বিনিময়ে তারা জ্যাকবকে মুক্তি দিতে রাজী হয়, কিন্তু স্ট্যালিন এমন প্রস্তাবে রাজী না হওয়ায় তারা জ্যাকবকে হত্যা করে।


2265_04_stalins_familie_0
(ছবিতে দেখা যাচ্ছে নাৎসিদের হাতে বন্দী স্ট্যালিনের ছেলে জ্যাকবকে, লাল বৃত্ত দিয়ে চিহ্নিত)


আবার সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বের উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা লাভের যুদ্ধে নানা দেশের জন্মে প্রত্যক্ষ ভুমিকা রেখেছে, বাংলাদেশও তার ব্যতয় নয়। মানবতার ধব্জা ওড়ানো বর্তমানের ইংল্যান্ড-ফ্রান্স-স্পেন- জার্মানি কোনদিন চায় নি আমরা স্বাধীনতার সূর্য দেখি, কিন্তু সোভিয়েতরা চেয়েছিল, সাহায্য করেছিল।

কবি পাবলো নেরুদা যেমন বলেছিলেন, আমরা ইতিহাসের অনেক কালো অধ্যায় জানতাম না, আমাদের চোখে স্ট্যালিন ছিলেন সেই নেতা যিনি হিটলারকে যুদ্ধে হারিয়েছিলেন। কথাটি শতভাগ সত্য, যে কারণে মানুষ আজ ভুলতে বসেছে যে ২য় বিশ্বযুদ্ধে ২ কোটি ৬০ লক্ষ রাশিয়ান সৈন্য নিহত হয়েছিল (যেখানে ব্রিটিশ সৈন্য মারা গিয়েছিল আধা মিলিয়ন, আমেরিকান সৈন্য আধা মিলিয়ন সেখানে রাশিয়ান সৈন্য ২৬ মিলিয়ন, অন্যদের চেয়ে ৫২ গুণ বেশী) , কিন্তু আবার এটিও সত্য যে নাৎসিদের সাথে চুক্তি করার যে মাশুল স্ট্যালিনের লালফৌজকে দিতে হয়েছিলে অযাচিত আক্রমণের শিকার হয়ে তার অন্যতম কারণে ছিল স্ট্যালিনের হঠকারী সিদ্ধান্তের কারণে হাজার হাজার চৌকষ অফিসারকে ফাঁসিতে ঝোলানো অথবা নির্বাসনে পাঠানো!

ছোট হলেও জাদুঘরটি বেশ পরিপাটি, লেলিনের পড়ালেখার টেবিল এমন ভাবে রাখে যেন মনে হচ্ছে খানিকক্ষণের জন্য কোথাও গেছেন তিনি, ড্রয়ার আধখোলা, বইয়ের পাতা ওল্টানো, কয়েকটা চিঠি পঠিত হবার অপেক্ষায়। নানা জায়গায় লেনিনের ভাস্কর্য।


7794148972_b94bb2280e_z


বিশেষ জাদুঘরের এক কোণে যত্ন করে সংরক্ষিত ছবির সোফাটি চোখে পড়ল। হেলসিংকি বিশ্ব-বিদ্যালয় গ্রন্থাগারের স্লাভিক বিভাগের প্রধান ভ্লাদিমির স্মিরনভের কার্যালয়ে সোফাটি অবস্থান করত এককালে, বিশেষ মেকানিজমে সোফাটির হাতল দুটি নিচু করা যায়। স্মিরনভের কার্যালয়ে অবস্থানের সময় এই সোফাতেই রাত্রিযাপন করেছিলেন বিশ্বখ্যাত লেখক আলেক্সেই ম্যাক্সিমোভিটস পেসকভ, যিনি জীবনের সমস্ত তিক্ততা বুকে টেনে নেবার পর নিজেই নিজেই নামকরণ করেছিলেন ম্যাক্সিম গোর্কি ( গোর্কি মানে তিক্ত), এবং এই সোফাতেই মাঝে মাঝে রাত্রিযাপন করতেন গোর্কির ভক্ত, বিপ্লবী, দার্শনিক কমরেড লেনিন।


lenin 2


গোর্কির আত্মজীবনী আমার ছেলেবেলা কতদিন নিয়ে গেছে তুষারপ্রান্তরের দেশটাতে, তার ভাষার গুনে হারিয়ে গেছি পাভেল ভ্লাসভের সাথে রুশি কারখানার ধোঁয়া আর জীবন সংগ্রামে। তার রোজনামচা আমার বিশেষ বিশেষ প্রিয়, তারই স্মৃতি বিজড়িত সোফাটি দেখে কত ভাবনা খেলে গেল মনের মাঝারে, এইখানে হেলান দিয়েই কি গোর্কি আগুনের লেলিহান সম্মোহনকারী শিখা নিয়ে অসাধারণ রচনাটি করেছিলেন? কিংবা লিখেছিলেন পাথরে খোদাই করা ছোট গল্প?


455px-Maxim_Gorky_authographed_portrait


স্ট্যালিনের আমন্ত্রণেই ইতালির নির্বাসিত জীবন থেকে রাশিয়ায় ফিরেছিলেন গোর্কি, তার রূপকথার গল্প “A Girl and Death” স্ট্যালিনকে পড়ে শোনাবার ঘটনাটি ক্যানভাসে অমর করে রেখেছেন ভিক্টর গোভোরোভ।


gorkys


অথচ জীবনের শেষ দিকে রাজনৈতিক কারণে হাউজ অ্যারেস্ট ছিলেন গোর্কি, ১৯৩৬ সালে তার মৃত্যুর পরে কফিন পরিবহণকারীদের মাঝে স্ট্যালিন স্বয়ং থাকলেও গোর্কি মৃত্যুর পিছনে তার এবং অনুগতবাহিনী হাত ছিল বলে সন্দেহ করা হয় আজ পর্যন্ত!!! ঢাকাতে কেনা এক ম্যাক্সিম গোর্কি টি-শার্টেও পেয়েছিলাম সেই তথ্য!


475px-Joseph_Stalin_and_Maxim_Gorky,_1931


জাদুঘরে একটি ছোট্ট দোকানও আছে, সেখানে নানা পোস্টার, লিফলেটের কপির সাথে সাথে লেনিনের স্মৃতিসম্বলিত কিছু কিনতে পারবেন চাইলে। সেখানে কর্মরত ফিনিশ-রাশিয়ান মহিলার সাথে কথা হল জাদুঘরটির জনপ্রিয়তা, বিদেশী অতিথি, ইতিহাস নিয়ে। বেশ প্রশংসা করলেন আমাদের কিউবা ভ্রমণের অভিজ্ঞতার, বললেন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অংশ হতে চান তিনি, বয়স হয়েছে অনেক, কিছুটা নিশ্চিন্ত জীবন চান এই সায়াহ্নে, আধুনিক বিশ্বের তীব্র প্রতিযোগিতামূলক জীবন তার পছন্দ নয়। কিন্তু যখন জানতে চাইলাম স্ট্যালিনের সময়কার চরম আতঙ্কময় মোসাহেবি জীবনের প্রতি ফিরতে চান, তখন আবার বেশ রাগ ঝাড়লেন সেই সময়ের নেতার উদ্দেশ্যে।

বেশ কিছুটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া নিয়েই বাহির হলাম লেনিন জাদুঘর থেকে, তবে মনে মনে জানি যেহেতু শেষ পর্যন্ত মানবজাতির ইতিহাস কেবল মানুষের জন্যই, তাই মানুষের অধিকার পায়ে দলে আদতেই কোন বিপ্লব, আদর্শ টিকে থাকে না, থাকতে পারে না।

 

 

 

 

( পোষ্ট লেখার সময় দেখি জাদুঘরে তোলা সব ছবি অজানা কারণে ডিলিট হয়ে গেছে ! এই পোস্টের কেবল দুইটি ছবি আমার তোলা, বাকী সবই নেট থেকে সংগৃহীত)

 

কৃতজ্ঞতা: সচলায়তন তারেক অণুর ব্লগ

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত