পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত লেখকরা আর ছোটোগল্প লেখেন না। ছোটোগল্পের স্বর্ণযুগ যেন ক্ষীয়মাণ। এককালের নবীন লেখকরা প্রথমে ছোটোগল্প লিখে হাত পাকাতেন, তারপর কিছুটা আত্মবিশ্বাস অর্জন করলে শুরু করতেন উপন্যাস। এখন অনেকে শুরুতেই সরাসরি উপন্যাসে চলে আসেন।
তার অন্যতম কারণ, সাহিত্য-পত্রিকাগুলির বিলুপ্তি। একসময় লেখকরা পরিচিত হতেন এইসব পত্রিকার মাধ্যমে। এখন উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি সরাসরি চলে যায় প্রকাশকের কাছে। সালমন রুশদি, বিক্রম শেঠ কিংবা অমিতাভ ঘোষ কখনও ছোটোগল্পের দিকে মনোযোগই দেননি।
বাংলাতেও স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর পরবর্তী প্রধান লেখকরা অনেক ছোটোগল্প রচনা করেছেন। বস্তুত, বাংলা সাহিত্যে সার্থক উপন্যাস অঙ্গুলিমেয় কিন্তু হীরকদ্যুতির মতন বিস্ময়কর ছোটোগল্প অজস্র। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতন লেখকদের একটি দুটি উপন্যাসের কথাই আমাদের মনে পড়ে। কিন্তু তাঁদের অনেক ছোটোগল্পই অবিস্মরণীয়। সত্যিই বাংলায় একসময় ছোটোগল্পের স্বর্ণযুগ ছিল, অনায়াসেই বলা যায়। অনেক বিশ্বমানের ছোটোগল্প রচিত হয়েছে বাংলাভাষায়। কিন্তু আফসোসের কথা এই, এখনও অনেক উচ্চাঙ্গের ছোটোগল্প লেখা হয় বটে, কিন্তু প্রকাশপ ও পাথকমহলে ছোটোগল্পের তেমন সমাদর বা চাহিদা নেই।
এখনকার পৃথিবীতে জীবিত লেখকদের মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য গাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ অবশ্য বেশ-কিছু ছোটোগল্প লিখেছেন। মোট সংখ্যা উনচল্লিশ। গল্পগুলি আকর্ষণীয় একটি বিশেষ কারণে। নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত উপন্যাস নিঃসঙ্গতার এক শতাব্দির লেখক হিসেবেই মার্কেজ সর্বশেষ পরিচিত এবং তাঁর নাম শুনলেই মনে পড়ে ম্যাজিক রিয়েলিজমের কথা। কিন্তু সেই বিশিষ্ট শিল্প আঙ্গিক মার্কেজের অনেক গল্পেই অনুপস্থিত। এই ছোটোগল্পগুলির রচয়িতা যেন অন্য এক মার্কেজ। বড়জোর তাঁর কয়েকটি গল্পকে বলা যায় ম্যাজিক রিয়েলিজম আঙ্গিকের আঁতুড়ঘর। অন্যান্য গল্পগুলিতে টানা বর্ণনারীতিই অনুসৃত হয়েছে।
ম্যাজিক রিয়েলিজম ব্যাপারটা কী? গত শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে এই অভিধা চিত্রশিল্প সম্পর্কে প্রথম প্রযোজ্য হয়েছিল। তারপর এটা সাহিত্যের আঙ্গিক হিসেবেই বেশি ব্যবহৃত হয়। আর্জেন্টিনার প্রসিদ্ধ লেখক হর্হে লুইস বোর্হেস, জার্মানির গুন্টার গ্রাস কিংবা ইংল্যান্ডের জন ফাউলসের রচনাতেও এই উপাদান পাওয়া যায়। সেইসঙ্গে নাইজেরিয়ার বেন ওকোরি আর কিউবার আলেহো কারপেনতিয়ের অবশ্যই। তবে মার্কেজই এর প্রধান প্রবক্তা হিসেবে গণ্য। রূপকথা, উপকথায় ফ্যান্টাসি, যার অনেকখানিই অবিশ্বাস্য, তাঁর সঙ্গে আধুনিক জীবনের অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য ঘটনার খুঁটিনাটি মিলিয়ে নেওয়াকেই ম্যাজিক রিয়েলিজম বলা যেতে পারে সংক্ষেপে। মার্কেজ এই আঙ্গিকটি কী করে আয়ত্ত্ করলেন, তা বুঝতে গেলে তাঁর জীবনীর কিছু কিছু ঘটনা জানা দরকার।
বাচ্চা বয়েসে মার্কেজ থাকতেন কলম্বিয়ার আরাকা টাকা নামে একটা ছোটো শহরে দাদু ও দিদিমার কাছে। দাদু অবসরপ্রাপ্ত জবরদস্ত এক কর্নেল। মস্তবড়ো বাড়ি, পুরোনো ও রহস্যময়, কেউ কেউ বলে ভূত আছে। দিদিমা ছাড়াও অনেক মাসি-পিসি মিলিয়ে বাড়ি ভরতি অনেক বুড়ি মহিলা, সবাই কুসংস্কারগ্রস্ত ও ভূত-প্রেত-অলৌকিক ঘটনায় বিশ্বাসী, তারা অনবরত সেইসব গল্প বলতেন। তাঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ গল্প বলিয়ে ছিলেন মার্কেজের দিদিমাই। তাঁর মুখচোখের ভঙ্গি এমন হত গল্প বলার সময়, যেন তিনি ওইসব অলৌকিক ঘটনা একেবারে দেখতে পাচ্ছেন চোখের সামনে। এসব গল্পই বালক মার্কেজের মনে দাগ কেটে যায়। পরবর্তীকালে ওইসব চরিত্রও তাঁর গল্প-উপন্যাসে এসে পড়েছে। এরকম তো অনেক লেখকের রচনাতেই তাঁদের বাল্য বয়েসের দেখা চরিত্র ও ঘটনার প্রতিফলন হয়। মার্কেজের জীবনে এর বিশেষত্ব কী?
আইন পাশ করে উকিল হবার বদলে মার্কেজ যখন সাংবাদিকতা ও গল্প-উপন্যাসে হাত পাকাচ্ছিলেন, তখনও তিনি নিজস্ব আঙ্গিকটি খুঁজে পাননি। তাঁকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে ফ্রান্ৎস কাফ্কার ‘মেটামরফসিস’ নামে গল্পটি এবং উইলিয়াম ফকনারের রচনা। কাফকা ও ফকনারের রচনারীতির কোনো মিল নেই। কাফকার গল্পটি পড়ে মার্কেজ উপলব্ধি করেন যে একেবারে প্রথার বাইরে গিয়ে সম্পূর্ণ অপ্রাকৃত বিষয়কেও বাস্তবসম্মত করে লেখা যায়। আর ফকনারের রচনায় অপ্রাকৃতের কোনো স্থান নেই, তিনি তাঁর চেনাশুনো পরিবেশ ও মানুষগুলি নিয়েই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লিখেছেন।
মার্কে জ এই দুই বিপরীত আঙ্গিককেই মেলাতে চেয়েছেন, সেটাই তো ম্যাজিক রিয়েলিজম। কিন্তু এই আঙ্গিকও তাঁর কাছে সহজে আসেনি। নিজের লেখায় সন্তুষ্ট হতে পারছেন না। ফকনার যেমন একটি কাল্পনিক অঞ্চল তৈরি করে তাঁর মধ্যে তাঁর বাল্যকালের পরিচিত চরিত্রগুলি ঢুকিয়ে দিচ্ছিলেন, মার্কেজও সেইরকম মাকুন্দো নামের একটি অঞ্চল তৈরি করতে চাইছিলেন। তারপর সেই অলৌকিক ঘটনাটি তাঁর নিজের জীবনেই ঘটে।
১৯৬৫ সালের জানুয়ারি মাসে দারিদ্র ও অস্থির ভুবনের মধ্যে একদিন মার্কেজ তাঁর স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে আলকাপুলশোর দিকে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ মাঝপথে তাঁর এক বিস্ময়কর উপলব্ধি হল। বিদ্যুৎচমকের মতন তিনি যেন তাঁর নতুন উপন্যাসটির প্রথম পরিচ্ছেদের প্রতিটি লাইন দেখতে পেলেন। তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠল তাঁর দিদিমার মুখ। তাঁর উপলব্ধি হল যে কল্পিত নগরীতে দিদিমার মুখে শোনা গল্পগুলি শুধু ব্যবহার করলে তা কৃত্রিম হতে বাধ্য। দিদিমা যখন গল্প বলতেন, তখন তাঁর মুখের যে ভাব, লেখককে সেটাই ব্যবহার করতে হবে, অর্থাৎ লেখককেও ওইসব অলৌকিক ও ভূতের গল্প সম্পূর্ণ বিশ্বাস করেই লিখতে হবে! বেড়াতে যাওয়া হল না। গাড়ি ঘুরিয়ে মার্কেজ ফিরে এলেন বাড়িতে। নিজের ঘরের মধ্যে বন্দি হয়ে। সংসার কী করে চলবে, না চলবে তাঁর তোয়াক্কা না করে লিখতে বসলেন। প্রায় এক বছর পর সমাপ্ত হল তাঁর যুগান্তকারী উপন্যাস নিঃসঙ্গতার এক শতাব্দী।
ছোটোগল্পগুলি লেখার মাঝে মাঝে মার্কে জ বেশ কিছু চলচ্চিত্র ও টিভি ফিলমের চিত্রনাট্যও লিখেছেন। তখন তিনি ইনগমার বার্গমানের চলচ্চিত্রের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন কি না জানা যায় না। বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে বার্গমানের ছবিতে ম্যাজিক রিয়েলিজম প্রত্যক্ষভাবে ফুটে আছে। দা সেভেনথ সিল, ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিস কিংবা ফ্যানি অ্যান্ড আলেকজান্ডার ছবিগুলি এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তবে মার্কে জের কিছু কিছু ছোটোগল্পে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের প্রভাব খুঁজে পাওয়া দুষ্কর নয়। একসময় তিনিও হেমিংওয়ের মতন প্যারিসের ল্যাটিন কোয়ার্টারর্সে কাটিয়েছেন কিছুদিন। তাঁর ‘বিমানে এক ঘুমন্ত রূপসী’ গল্পটি একেবারে হেমিংওয়ের ঘরানার গল্প। মার্কেজ ও বোধহয় এ সম্পর্কে সচেতন ছিলেন, খোঁজাখুঁজি করছেন নিজস্ব স্টাইল। ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না’ গল্পটি তিনি এগারোবার লিখেছেন ও ছিঁড়েছেন।

৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪, ২১ ভাদ্র, ১৩৪১ বঙ্গাব্দ – ২৩ অক্টোবর ২০১২ বিংশ শতকের শেষার্ধের এক জন প্রথিতযশা বাঙালি সাহিত্যিক। ২০১২ খ্রিস্টোব্দে মৃত্যুর পূর্ববর্তী চার দশক তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা-ব্যক্তিত্ব হিসাবে সর্ববৈশ্বিক বাংলা ভাষা-ভাষী জনগোষ্ঠীর কাছে ব্যাপক ভাবে পরিচিত ছিলেন। এই সাহিত্যিক একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সম্পাদক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট হিসাবে অজস্র স্মরণীয় রচনা উপহার দিয়েছেন। তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার জীবনানন্দ-পরবর্তী পর্যায়ের অন্যতম প্রধান কবি। একই সঙ্গে তিনি আধুনিক ও রোমান্টিক। তাঁর কবিতার বহু পংক্তি সাধারণ মানুষের মুখস্থ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় “নীললোহিত”, “সনাতন পাঠক” ও “নীল উপাধ্যায়” ইত্যাদি ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্ম অধুনা বাংলাদেশের ফরিদপুরে। মাত্র চার বছর বয়সে তিনি কলকাতায় চলে আসেন। ১৯৫৩ সাল থেকে তিনি কৃত্তিবাস নামে একটি কবিতা পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেন। ১৯৫৮ খ্রিস্টোব্দে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একা এবং কয়েকজন’ এবং ১৯৬৬ খ্রিস্টোব্দে প্রথম উপন্যাস ‘আত্মপ্রকাশ’ প্রকাশিত হয়। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বই হল ‘আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি’, ‘যুগলবন্দী (শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে), হঠাৎ নীরার জন্য, রাত্রির রঁদেভূ, শ্যামবাজারের মোড়ের আড্ডা, অর্ধেক জীবন, অরণ্যের দিনরাত্রি, অর্জুন, প্রথম আলো, সেই সময়, পূর্ব পশ্চিম, ভানু ও রাণু, মনের মানুষ ইত্যাদি। শিশুসাহিত্যে তিনি “কাকাবাবু-সন্তু” নামে এক জনপ্রিয় গোয়েন্দা সিরিজের রচয়িতা। মৃত্যুর পূর্বপর্যন্ত তিনি ভারতের জাতীয় সাহিত্য প্রতিষ্ঠান সাহিত্য অকাদেমি ও পশ্চিমবঙ্গ শিশুকিশোর আকাদেমির সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
নীললোহিত সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছদ্মনাম। নীললোহিতের মাধ্যমে সুনীল নিজের একটি পৃথক সত্বা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। নীললোহিতের সব কাহিনিতেই নীললোহিতই কেন্দ্রীয় চরিত্র। সে নিজেই কাহিনিটি বলে চলে আত্মকথার ভঙ্গিতে। সব কাহিনিতেই নীললোহিতের বয়স সাতাশ। সাতাশের বেশি তাঁর বয়স বাড়ে না। বিভিন্ন কাহিনিতে দেখা যায় নীললোহিত চিরবেকার। চাকরিতে ঢুকলেও সে বেশি দিন টেঁকে না। তাঁর বাড়িতে মা এবং দাদা বৌদি রয়েছেন। নীললোহিতের বহু কাহিনিতেই দিকশূন্যপুর বলে একটি জায়গার কথা শোনা যায়। যেখানে বহু শিক্ষিত সফল মানুষ কিন্তু জীবন সম্পর্কে নিষ্পৃহ একাকী জীবন যাপন করেন।
২০০২ সালে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কলকাতা শহরের শেরিফ নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭২ ও ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে আনন্দ পুরস্কার এবং ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। ২৩ অক্টোবর ২০১২ তারিখে হৃদযন্ত্রজনিত অসুস্থতার কারণে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে ৪ এপ্রিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কলকাতার ‘গণদর্পণ’কে সস্ত্রীক মরণোত্তর দেহ দান করে যান। কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একমাত্র পুত্রসন্তান সৌভিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ইচ্ছেতে তাঁর দেহ দাহ করা হয়।