আনুমানিক পঠনকাল: 2 মিনিট
১.
একা থাকার দিনে শব্দের সাথে আলাপের চেয়ে নৈঃশব্দ্যে থাকা শ্রেয়। জানি, শহর জুড়ে কালো ধোঁয়ার মিছিলের বিপরীতে সবুজের সন্তানেরা কেমন খেলছে টোপাভাতি-হৈচৈ – এইসব চেয়ে দেখা ভাল। মলাটে দাগ ফেলে দাগের জিনোম যেন পাল্টাচ্ছে রঙ। বেরসিক সময় ফ্যানের নিচে অপ্রস্তুত কল্পনাপ্রবণ। আমার মন শুনো, নেইলপালিশে নিঃসঙ্গ পকেট; লুকানো যা ছিল, তাও। ভিতর বাড়ির পাটকাঠির বেড়া খসে খসে পড়ে খুলে গেছে দোর। যা যাবার, তা-ই গেছে। ঠুলি ভরে শূন্যতা দিয়ে গেছে চোর।
২.
কোথাও কাজ নেই, আব্বার শ্বাসকষ্ট বেড়েছে।মা মুখে হাত দিয়ে বসে থাকেন।আব্বা ঝিমান; ভাবেন, করফিউ তুলে নিলে হয়তো কাজ হবে, কাজে যাবেন। ভাতের জন্য ছোটভাই কেঁদে কেঁদে ঘুমায়, ফ্রকছেড়া ছোটবোন তার হাড়গুলো গুনে। আমি দেখি- ছাপড়াঘরে আধভেজা অন্ধকার, দরজার খিল, ছিপছিপে জানালা দিয়ে ধূলোবালি আসে, লালাভা, পিঁপড়েরা শরীরে হাঁটছে, আজানের করুণ সুর, গলির মোড়ে নেড়ি কুকুর কেমন উচ্চস্বরে কী যেন বলে যায়- আমি শুনি; আমার কান কী যেন শোনে।
৩.
একবার আব্বার সাথে মাছ মারতে গেলাম বারোদুয়ারি বিলে। বিলজুড়ে তখন হলুুদ শাপলা ফুটেছে; আমার শাপলা হওয়ার বাসনা জাগে।ঘোর আন্ধারে দুয়েকটা তারা আকাশে হাসছে; আমার আকাশ হওয়ার বাসনা জাগে। মনে হয় কয়েকটা টইটই হাস ভাসছে; আমার হাস হওয়ার বাসনা জাগে।
পিনপতন নীরবতা চারদিকে বিস্তর।আমি নীরব হয়ে বসে আছি। ছইয়ে বসে আব্বা টেটা তাক করে আছে অদূরে। আমার কি টেটা হওয়ার বাসনা জাগে?
আব্বার নিশানা বেশ প্রখর। ছো মেরে শোল মাছ এনে রাখেন পাটাতনে। আমি আলুথালু ঘুমে মাচানে বসে জিমাই। আব্বাকে দেখি; পাটাতনে তাকাই। পাটাতনের নিচে ঘুমায় কেমন আমার জীবন!
৪.
শহরের বিচ্ছিন্নতা, কেমন গড়গড়িয়ে যায় নদীর স্রোত!
পেঁয়াজফুলের বুকে হাওয়ার সুখ দোলে কোন বোধে-
আমি দেখি খুন্তিতে মাটি পাকানোর কী রূপ। তোমাকে
গোপ মাৎস্যন্যায়ে রেখে যে শব্দ তারপর গেছে,
তার খোঁজে ঘর ছেড়ে যাই তরুসোনারং জোড়ামঠে ।
সেখানে মেহগনির ছায় ঘিরে এক বিতল পুকুর
লাজের এলাজে উত্তল, চেয়ে আছে ঐকিক ছায়ায়
ছেয়ে আছে যেন আরো কাছে।
ঢিলে ঢিলে বেলা বাড়ে; বলা হয় কি না হয়-
আমার সব বলা কবিতায় বলা আছে।
৫.
ঘুম থেকে উঠে পায়ে-পায়ে ঠুস খেতে খেতে আমি তখন মক্তবে যেতাম। মনে আছে, আমি তখন আমপারা’র মাঝে। একটা মেয়ে আসে। আমি দেখি, সে মৌলভীর পাশে বসে চোখাচোখি হয়, হয় না আবার। এমন করে চললো বেশ। দিন যেতে যেতে আমপারা’র শেষের দিনে সেই মেয়েটি নিরুদ্দেশ।
আমি খুঁজি আজও। মেয়ে, কখনো কি আসবে আলিফ-লাম-মিমে?
৬.
আমি তো থেকে যেতে চেয়েছি মায়ের রক্তাভ জরায়ুতে গুটিসুটি মেরে; অথচ কী এক নিমীলিত সুখে সে আমায় প্রকাশ করল বিষণ্ণ পৃথিবীতে। এখন আমার নিমঘুমও ভেঙে যায় মৃত কৈ মাছের শব্দে। আলোছায়ার ঘোলা জলে যেন আমি এক ছাপা বই, জালসূত্র পড়ে গন্তব্য এইসব জলজীবন। জেলের উল্লাসে উড়ে যাওয়া ধুয়া হলেও কী ভাল হতো! বাতাসের সখ্যতায় জীবনের মানে পাওয়া যেত। এখন না পাওয়ার আক্ষেপ নিয়ে আমি কতকাল ফিরে যেতে চাইবো প্রাক্তনে? এর কি শেষ আছে? শেষ দেখা? আমার থেকে যেতে চাওয়ার গল্প কবিতায় বর্ণনা? যখন একা হই- আরো একা হতে ইচ্ছে জাগে, আতর-লোবানের ঝাঁঝে আমি বিমোহিত হই আরো। আর কী সব চিত্রকলা সেই বাসস্থানে এঁকে নিজেকে রঙ ভেবে বেরঙ হই- এসব কেউ জানবে না। কয়েকটি গোরপোকার সাথে আমার একাত্মতা আরো প্রগাঢ় হলে অজস্র রাত পাশে বসে দেখে আমার ক্ষরণ ও খনন
দৃষ্টি চেরাইয়ে আরো বেশি ব্যক্তিগত হয় মোহনকাল।
৭.
আমি ঐ জগতের লোক নই যে জগতে তোমরা থাকো
ঐ ভবের ভাবুক নই যে ভবে তোমরা ভাবো।
তাহলে?
নিরেট শূন্যতায় অস্তিত্বের প্রগাঢ় আলোড়নে ঝলসে যায় চোখ
স্থির দশমিকে মন যে আরো আনচান সহজিয়া!
সাধন-ভজন পিঙ্গলায়
আরো প্রশংসিত নীরবতা
উত্তর দিনে সংক্রমিত কলবে ইজতেহাদ সাধু এই কি নজরানা ভবিষ্যৎ?
জেহনে প্রগাঢ় আলোড়নে নিরেট শূন্যতায়
বোধিবৃক্ষ-নির্বাণ-মোক্ষ-উপনিষদ।
(স্নাতক) সমাজবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
কর্ম: সম্পাদক, প্রতিবাক। যুগ্ম-আহ্বায়ক, চোখ সাহিত্য সংসদ।