| 26 এপ্রিল 2024
Categories
সময়ের ডায়েরি

ভাষাহীনতা

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

বেশ খানিকটা আগেই এয়ারপোর্ট পৌঁছে গেছে সুমিতা।গতবার দিল্লী যাওয়ার সময় বড্ড দেরি করে ফেলেছিল,একটুর জন্য মিস করেনি।তাই এবারে কোন চান্স নেয়নি।ব্যাগ ড্রপের পরে অনেকটা সময় হাতে।প্রায় দেড় ঘন্টার ও বেশি।আসার সময় ফোনে শুভ মাথা খাচ্ছিল,”আমাদের গতকালের দেখা হওয়া টা নিয়ে কিছু লেখো।প্লিজ লেখো।” শুভ ওর বন্ধু।অসমবয়সী।প্রায় দশ বছরের ছোট।ওদের বাংলা সাহিত্য নিয়ে অনেক আলোচনা হয়,গান হয় দেখা হলে।আর শেষমেশ থাকে সেটা নিয়ে গল্প বানাবার আবদার।সুমিতা শুধু ফেসবুকেই লেখে।বই নেই কোন।বন্ধুরা জোরাজুরি করলেও কোনদিন বের করেনি।ওর পার্সোনাল ব্লগ “হিয়ার মাঝে” বেশ জনপ্রিয়।পাঁচ হাজার ফলোয়ার।ওখানেই লেখে ও।মজা টা হচ্ছে যে সুজিত ও সবসময় আশা করে থাকে ওদের দেখা হওয়া নিয়ে সুমিতা কিছু লেখা দেবে। সুমিতা গত তিন বছর ধরে সুজিতের সঙ্গে প্রতিটি দেখা কে শব্দে সাজিয়েছে।জনপ্রিয় হয়েছে প্রতি টি লেখা ই।সুজিত ওর ভালোবাসার নাম।সুজিতের ও আবদার “যাচ্ছো,কিছু লিখে দিও।” সুমিতা বসে বসে লিখতে শুরু করে।বসে বসে আপডেট দেখে কলকাতা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন কাশ্মীরী ডাক্তার,ছেলে মেয়েরা স্কুলে আক্রান্ত।অপমানিত বোধ করে চলে যাচ্ছেন।খবর এসেছে রেজাউদ্দিন আক্রান্ত।রেজাউদ্দিন এক পরোপকারী ছেলে।দুঃস্থ মানুষের কাছে খাবার,ওষুধ,জামাকাপড় পৌছে দেয় সকলের কাছে আবেদন করে।সেই
সেই পরোপকারী ছেলেটিকে দেশদ্রোহী বলা হচ্ছে।এরা কারা?বাংলার মাটিতে,বিশেষ করে ,কলকাতার এত নিষ্ঠুর চেহারা এর আগে দেখেনি সুমি।বাংলার মাটিতে বাংলাভাষী সকলেই বাঙ্গালি। অথচ এখনো ওরই কত বন্ধু বলে ও তো আমাদের মতো বাঙালি না।ও মুসলমান।কতবার যে ডিবেট হয়েছে এ নিয়ে তা বলার নয়।বাংলা ভাষা বলে যে সে ই বাঙালি।বাঙালি কোন ধর্ম নয়।এমনকি জন্ম সূত্রে বাঙালি নয়,কিন্তু কলকাতায় থেকে বাংলা বলতে পারে।অনেক বন্ধু আছে যারা নিজেদের বাঙালি পরিচয় দেয়।শুভ কে লেখা টা পাঠিয়ে দিল।মনটা অস্থির লাগছে।পুলওয়ামার জঙ্গি আক্রমণের ঘটনার পর গোটা শহরটা বদলে গেছে যেন।এত ঘৃণা মানুষ পুষে রেখেছিল অন্তরে?না হলে রাষ্ট্রশক্তি চাইল আর রাতারাতি পারস্পরিক অবিশ্বাস এমন জায়গায় পৌছালো যে ফেসবুক পোস্টের জন্য মানুষ লোকের বাড়ি ভাঙচুর করতে শুরু করল।খিস্তির বন্যা বইয়ে দিল? বাঙালির এমন ভাষার প্রকাশ্য অবনমন সুমি এর আগে কখনো দেখেনি। “বোর্ডিং কি শুরু হয়েছে?
“না ম্যাডাম,দশ মিনিট বাদে।” ইমরান খান কিছু একটা বলছেন স্ক্রিনে।অফিস থেকে সরাসরি এসেছে সুমিতা এয়ারপোর্টে।অফিসে ওদের জোনাল এইচআর হেড দুপুরে বকবক করছিল কিছু একটা নিয়ে বাকি কলিগ দের সাথে।প্রথমে সুমিতা অত মনোযোগ দেয়নি।তারপর শুনল উনি একটি জায়গার ঘটনা বলছেন,যেখানে নাকি একটি স্কুলে গিয়ে আর্মি অফিসারেরা বলেছেন যে কী হয়েছে সীমান্তে।তাদের কথা শুনে নাকি বাচ্চা রা এমন War cry করেছে চিৎকার করে,বড়রা হার মেনে যাবে।ওনার বক্তব্য হল,অনেকেই বলেছে স্কুলে কেন এসব করা হল?কিন্তু উনি মনে করেন,ওরা বাচ্চাদের হাতে বন্দুক ধরিয়ে দিচ্ছে,আমরা যদি কিছু না করি,কদিন পরে হিন্দু বলে কিছু থাকবে না।বাকি কেউ যদিও শুনে বিশেষ কোন রি-অ্যাকশন দেয় নি।যে যার কাজে নিজেদের ল্যাপটপে মুখ গুঁজেছে।বলাই বাহুল্য এসব তথ্য হোয়াটস্অ্যাপ সম্বলিত আর এই হোয়াটস্অ্যাপে বিদ্বেষ ছড়ানো একটা খুব সহজ পদ্ধতি হয়ে দাড়িয়েছে।খুব ইচ্ছে করছিল সুমিতার যে ওকে বলে ভারতবর্ষটা হিন্দু দের দেশ নয় শুধু। সুতরাং বৈরীতাটা কোন সম্প্রদায়ভিত্তিক নয়,দেশ ভিত্তিক।তবু মনে হল একে ইগনোর করাই ভালো।তাই উত্তর দেয়নি কোন।ফ্লাইটে বসে গেছে সুমিতা।ঘুমিয়ে পড়তে হবে এবার।কানে ইয়ার -প্লাগ গুঁজে , আরো তুলো গুঁজে ঘুমিয়ে পড়ে সুমিতা।স্বপ্নে কেন জানিনা,বারবার একজন বাউল কে দেখতে পায়,দেখতে অনেকটা রবি ঠাকুরের মত।কিন্তু নিজের মনে একতারা বাজিয়ে গান গেয়ে চলেছেন,লালনের গান।ঘুম ভেঙে যায়।ঘড়ি দেখে,এখনো পয়তাল্লিশ মিনিট।নেমে হোটেলের দিকে যাওয়ার জন্য এয়ারপোর্ট ট্যাক্সি নেয়।সে ছেলেটি তামিল।যদিও ভাঙা ভাঙা হিন্দি বলে।অনেকক্ষণ চলে আসার পর সুমিতা হিন্দিতে জিঞ্জেস করে “আর কতটা দূর?” ছেলেটি উত্তর দেয় “মনে হয় আগের রাস্তা দিয়ে যেতে হবে।” “মানে? আপনি ন্যাভিগেশন অন করেন নি?” “না,ম্যাডাম,আমি ভাবলাম আপনি চেনেন।”
“এটার মানে কী?আপনার এগেইনস্টে আমি কমপ্লেইন করব।” এই পুরো কথাবার্তা যদিও হিন্দি তে হল।দুজনেই নেভিগেশন অন করল।গজগজ করতে করতে সুমিতা পৌঁছল হোটেল।রসিদ প্রিন্ট করতে গিয়ে প্রথমবার কাগজের রোল ঠিক জায়গায় ছিল না।ঘুরে গেল,পরে আর কিছুতেই রসিদ টা বের করতে পারছে না।সুমিতা বলেছে রসিদ না দিলে এক টাকা ও দেবে না।ছেলেটা ঘামছে দরদর করে।কাকে যেন ফোন করছে।হাত কাঁপছে ওর।সুমিতা বুঝলো সাড়ে আটশো টাকার ধাক্কা ও নিতে পারবে না।ওকে দেখে ভয় করছিল,পড়ে না যায়।সুমিতা টাকা দিয়ে হোটেলে চেক ইন করল।অনেক দেরি হয়ে গেছে।ওরা বলল,’ম্যাডাম ডিনার টা করে নিন।” “একটু ফ্রেশ হয়েই করছি।” মুখ ধুতে ধুতে টয়লেটে রাখা ফোন টা বেজে উঠল।”হ্যালো,ইয়েস গিভ মি জাস্ট ফাইভ ফোর মিনিটস্।” ওরা রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে দেবে।সুমিতা গিয়ে,প্লেট নিয়ে একটা রুটি আর পনীর নিয়ে এসে বসল।একটি ছেলে এগিয়ে এসে বলল,”এনি স্টার্টার ম্যাডাম?
“না।লাগবে না”
সুইট? চমচম,গুলাবজমুন,দহি?” “না। ” ছেলেটি হেসে বলল “আমিও বাঙালি ” সুমিতা জিঞ্জেস করল,”কোথায় বাড়ি?” “বর্ধমান ম্যাডাম,আসানসোল থেকে যেতে হয় অনেক টা।আমাদের গ্রামে পৌঁছতে গেলে।” “নাম কি?” “শঙ্কর, আপনি আরেকটু কিছু নিন ম্যাডাম।”
“না গো,এতো রাত হয়ে গেছে।”
“সে কী? এতো কম খেলে চলবে কি করে? আমি একটু স্টার্টার নিয়ে আসি।কাবাব এনে দিল।ফিশ ফ্রাই খাবেন ম্যাম?”
“না না।”
“তা বললে কী হয়? বাঙালি আপনি,মাছ খাবেন না।” শংকর ওর কোন বারণই শুনছে না। পাত্রপক্ষকে যেমন করে মেয়ের বাড়ির লোক খাওয়ায় তেমন করে খাওয়াচ্ছে।
“এখানে ম্যাডাম স্টাফেদের মধ্যে আমিই বাঙালি।রেয়ারলি আপনাদের মত দু-এক জন এলে বাংলায় কথা বলতে পারি।” ওর চোখে মাতৃভাষা বলার আনন্দ।ওর চোখের ভাষার আকাশে এখন গোলাপ হয়ে ফুটে রয়েছে।
শংকরের আতিথেয়তায় মন ভালো হয়ে গেল।সুমিতা কাবাব একটু একটু করে খাচ্ছে আর লিখছে,একটা কবিতা।”ম্যাডাম খেয়ে নিয়ে কাজ করুন না,ও মা,আপনি বাংলায় লিখেছেন।কী লিখেছেন?” অন্য সময় হলে সুমিতা কেউ মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে দেখলে বিরক্ত হত।আজ হল না।”কবিতা ” “আপনি কবিতা লেখেন?” “হ্যাঁ ” “আচ্ছা লিখুন,ডিস্টার্ব করব না।” শংকর চলে গেল।বসে থাকল সুমিতা।খাওয়া শেষ করে রুমের দিকে হাঁটা দিল।পরের দিন সকালের ডিসকাশন সেশনে,ওর এক মুম্বাইয়ের কলিগ বলে উঠলো,”ইউ নো,সুমিতা ইজ আ পোয়েট,সি ইজ আ সিংগার টু” চেন্নাইয়ের একজন,দিল্লীর একজন প্রায় একসাথে বলে উঠল “ইউ বেঙ্গলিজ হ্যাভ আ রিচ কালচারাল হেরিটেজ।ইউ হ্যাভ সো মাচ ট্যালেন্ট ইন বেঙ্গল অ্যান্ড উই হ্যাভ সিন মোস্ট অফ দি বেঙ্গলিজ আর কালচারালি রিচ। মোস্ট অব ইউ রাইট পোয়েমস্ অর পারফর্ম সামথিং।উই রিয়েলি অ্যাপ্রিশিয়েট।” ওদের কথা শুনে সুমিতার ঐ কাশ্মিরী শাল ওয়ালার রক্তাক্ত মুখ মনে পড়ছে যাকে কলকাতা শহরের বুকে মেরে নাক মুখ ফাটিয়ে দিয়েছে এক ‘অন্য কলকাতার’ দেশপ্রেমী রা।”কালচারালি রিচ”? ঘামছে সুমিতা।
‘হোয়াট হ্যাপেনড্?নট ফিলিং ওয়েল ‘?
“ক্যান ইউ এক্সকিউজ মি ফর আ মিনিট।”
ওয়াশরুমে গিয়ে মুখ চোখ ভালো করে ধুয়ে কমপ্যাক্ট বুলিয়ে ফিরে আসে সুমিতা।সবার অনুরোধে একটা গান ও গায়,”দো উই হ্যাভ নট আন্ডারস্টুড দ্য ল্যাঙ্গুয়েজ,উই লাইক ডি মেলোডি মোস্ট।থ্যাংক ইউ সুমিতা।” সবাই হাততালি দিয়ে ওঠে।সারাদিনের কাজের পর ক্লান্ত সুমিতা ডিনার খেতে যায় আজ সাড়ে নটা তেই।দেখে শংকর হেসে এগিয়ে আসছে।” ম্যাডাম আপনাকে প্লেট নিতে হবে না,প্লিজ আপনি এখানে বসুন।আমি সব দিয়ে দিচ্ছি।”
যেন সুমির রিজার্ভড্ সিট এমন করে বসিয়ে দিয়ে গেল শংকর।তারপর আবার সেই আপ্যায়ন করে খাওয়ালো।
কিছুক্ষণ পরে একজন বন্ধুকে নিয়ে এসে পরিচয় করায় “শি ইজ সুমিতা ম্যাম,আ পোয়েট ফ্রম বেঙ্গল,শি রাইটস্ বেঙ্গলি পোয়েট্রি।”সেই ছেলেটি “নমস্তে ।food is good maa’m?’সে সাউথের একজন ছেলে,নাম আরাসান।সুমিতা মাথা নাড়ল।”ওকে, গুড নাইট”। ও চলে গেলে,শংকর বলল”ওরা ঠিক বাংলা কবিতার মর্যাদাটা বোঝে না।আপনার কোনো লেখা কীভাবে পড়তে পারি?” সুমিতা ব্লগের নামটা বলে দেয়।’থ্যাংক ইউ ম্যাম।সবাই তাকিয়ে থাকে শংকরের দিকে।”কে এই হনু টি?” ভাবতে চেষ্টা করে অন্য বোর্ডাররা.শংকর নির্বিকার। পরের দিন রাতে শংকর যেন অপেক্ষা করেছিল।সুমিতা ঢুকতেই এগিয়ে এসে বলল ‘কাল মাঝরাত অবধি পড়েছি ম্যাডাম,বহুদিন পর বাংলা কবিতা,গল্প পড়লাম।পড়তে পড়তে ভোর চারটে বেজে গেছে।খুব খুব ভালো লেগেছে,ম্যাম।” ওর হাসি মুখে যেন বেঁচে যাওয়ার স্বস্তি।’ কাল আছেন তো?”
“নাহ্,কাল ভোরেই ফ্লাইট।”
‘ওহ্” ।চুপ করে থাকে শংকর।”তোমার নম্বর দাও।”
“নিয়ম নেই ম্যাডাম।”
“আচ্ছা তবে থাক।আমার যদি কোন বই বেরোয়,তোমাকে প্রথম দেবো।”
খুব খুশি হয়ে যায় শংকর।খাবার দিতে শুরু করে।
তারপর সুমি জানতে পারে এই স্টার্টারের কাবাব বা ফিশফ্রাই টা ওদের কোম্পানীর টাই-আপের প্যাকেজে বরাদ্দ নয়।তবে বাঙালি বলে শংকর ওর জন্য ওটা বরাদ্দ করেেছে।ও আজ দশ বছর বাংলার বাইরে।মনের মধ্যে এক সবুজ বাংলা কে তাই লালন করছে।ভাষার পরিতৃপ্তি ওর ঠোঁটের চারপাশে আলগোছে চুমুক দেওয়া দুধের মতো লেগে আছে।হঠাৎ সুমিতার মনে পড়ে গতকাল একুশে ফেব্রুয়ারি ছিল।
“বর্ণমালার শুভেচ্ছা নাও শংকর।ভালো থেকো,বাঙালি থেকো।” মনে মনে বলতে বলতে বেরিয়ে আসে সুমিতা।কাল সকালে কলকাতা ফিরতে হবে।সংস্কৃতির কলকাতা।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত