| 26 এপ্রিল 2024
Categories
নারী

মীরাঃ এক উত্তরণের গল্প

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

 

বৃষ্টির স্কুলে আজ grandparents’ day সেলিব্রেশান। সব ছাত্রছাত্রীরা তাদের ঠাকুমা-ঠাকুরদা বা দাদু-দিদিমা কে নিয়ে আসবে।কয়েকজন সিলেক্টেড স্টুডেন্ট কিছু বলবেও। বৃষ্টি বাংলা পড়ায়। সে তার ছাত্র-ছাত্রী ও কলিগদের কাছে এত্তবার তার ঠাকুমার গল্প করেছে যে তাঁকে একটি বিশেষ বক্তৃতা দিতে সকলে অনুরোধ করেছে। আজ বৃষ্টির সত্যিই দিদার কথা খুব মনে পড়ছে। সে ঠাকুমাকেই দিদা বলতো। একসাথে মহালয়া শোনা, শিবরাত্রির দিন একসাথে মন্দিরে যাওয়া, সব ছবির মত মনে আসছে। স্টাফরুমে বসেই চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল।

সব শেষে ডাকা হল বৃষ্টিকে স্টেজে। বৃষ্টি বলা শুরু করল-“আমার ঠাকুমা। মীরা চ্যাটার্জী। আমার ছোটবেলার বন্ধু। আমার মা-বাবা দুজনেই চাকুরীরতা হওয়ায় স্কুল থেকে ফিরে বেশ খানিক সময় আমার ঠাকুমার সাথেই কাটত। আমার বন্ধু মীরার জীবনেরই গল্প বলব আজ। আমার ঠাকুমার বিয়ে হয় বেশ কম বয়সেই। পনেরো কি ষোলো। ওনার শ্বাশুড়ি ওনাকে একটি বিয়ে বাড়িতে দেখে পছন্দ করেন, নিজের ভাবী পুলিশ অফিসার ছেলের জন্য। দিদার কাছেই শুনেছি খুব মিল ছিল দু’জনের, মনের। কুষ্টিবিচারে রাজযোটক। বিয়ের পরের বছরই আমার বাবা মানে ওনার এক পুত্রসন্তানের জন্ম হয়। আমার ঠাকুরদা শরীরচর্চা করতেন ওনার পাড়া মানে নবদ্বীপের একটি ক্লাবে। আমার ঠাকুমার শ্বশুরালয়ের সকলেই ওনাকে খুব পছন্দ করতেন। দারুণ সেলাই করতেন, রাঁধতেন সাথে বর ছেলে ও ননদ-দেওরদের যত্ন করতেন খুব। এই সব গল্পই আমার দিদা ও বাবার মুখ থেকে শোনা।
কিন্তু অদৃষ্টের কি পরিহাস! রাজযোটক মিল স্থায়ী হল না। বাবার যখন প্রায় ছয় বছর বয়স, দিদা আবার সন্তানসম্ভবা হন। কিন্তু সেই সময়ে উচ্চশিক্ষার্থে আমার ঠাকুরদাকে লন্ডন যেতে হয়। দিদার তখন সাত-আট মাসের গর্ভাবস্থা। পৌঁছানো সংবাদ একটি চিঠি পেয়েছিলেন।ভালবাসামাখা। তখনকার সেই সব দিন তো ফোন, ভিডিওকল, হোয়াটস্যাপ থেকে শত কোটি যোজন দূরে। মাসখানেকের মাথায় খবর আসে আমার ঠাকুরদা ফায়ার-প্লেস থেকে বদ্ধ ঘরে উৎপন্ন হওয়া কার্বন-মনোঅক্সাইড গ্যাসে suffocation হয়ে মারা গেছেন। গর্ভাবস্থা বলে দিদার শ্বশুর মশাই মৃতদেহ আর কলকাতা আনান নি। দিদার সম্বল হয়ে রইল শুধু ঐ চিঠিটি। আমার পিসি posthumous child….ওনার নিজের বাবাকে চাক্ষুষ করার সুযোগ হয়নি।

দিদার কাছে শুনেছিলাম, এরপর উনি হাতের কাজ, সেলাই, শাড়ি ফল-পিকো ইত্যাদি করা শুরু করেন।কিন্তু বাপের বাড়ি ফিরে আসেন নি। পিসি ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে।কিন্তু ছেলেমেয়েদের সামনে দিদা নাকি একটুও চোখের জল ফেলতেন না…..অদম্য মনের জোর…কীভাবে যে পারতেন! শ্বশুর-শাশুড়ির পূর্ণ সাহায্য পেয়েছিলেন নিজ স্বভাবগুণেই। নিজের যৎসামান্য উপার্জন হয়তো অপ্রতুল ছিল দুই ছেলে-মেয়ের জন্য….কিন্তু কখনই বাবার গলগ্রহ হন নি। একাধিক দেওর-ননদের মধ্যে উনি ছিলেন সবার বড় বৌদি- তাই শুধু সন্তান প্রতিপালন নয়… সংসারের অন্য অনেক দায়িত্বও ছিল কাঁধের উপর।
আমার বাবা তার ঠাকুরদার কাছেই পড়াশুনো করতেন। পিসিও তাই, বড় হওয়ার পর। দুই ছেলে-মেয়েই পরে খুব কৃতি হয়। মাত্র চব্বিশ বছর বয়সের একাদশী করা বাড়ির বউ ভাগ্যের পরিহাসেও বিন্দুমাত্র ভেঙে পড়েন নি। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কাপড়ের খুঁটে কান্না চেপেছেন এই শুনে, ছ’বছরের বড় দাদা তার বোনকে বলছে “তোর আর মা’এর কোন চিন্তা নেই রে, আমি তো আছি”। আমাদের শহরতলির বাড়িতেই দিদা থাকতেন আমাদের সাথে। পিসির বিয়ে হয়েছিল মালদা তে। গরমের ও শীতের ছুটিতে আমাদের কাছেই পিসি আসতো আমার দুই যমজ ভাইকে নিয়ে।

স্কুল থেকে ফিরে আমার সর্বক্ষণের খেলার সঙ্গী ছিলেন তিনি। তখনকার দিনে ম্যাট্রিক পাশ করেছিলেন।আমাদের শহরতলীর ফ্ল্যাট ছিল পাঁচতলায়।লিফ্ট ছিল না। আমার স্কুলব্যাগ নিয়ে উঠতে কষ্ট হবে বলে দিদা নেমে আসত তিনতলায়।
দিদার একখানা ছোট নোটবই ছিল। সেটিতে লিখে রাখতেন প্রাণাধিক প্রিয় নাতি-নাতনিদের বিভিন্ন বয়সের একাধিক সাফল্যের দিনক্ষণ— কবে প্রথম স্কুল, প্রথম পুরস্কার, আমার প্রথম স্টেজে নৃত্য- পরিবেশন ইত্যাদি ইত্যাদি।

আজ আমার পুত্রকে একইভাবে তার ঠাকুমার সান্নিধ্যে বড় হতে দেখছি চোখের সামনে। ছোটবেলার বহু স্মৃতিকে পুনরুজ্জীবিত হতে দেখি। আমাদের মতই আমার মা–বাবা দুজনেই যেহেতু চাকুরীজীবী ছিলেন, তাই দিনের একটি বড় সময় থাকতাম দিদার সাথে। অরণ্যদেবের গল্প শুনতাম, অনেক ছবির বই দেখতাম। সময় কাটত বেশ।

আমার আলুভাজা খাওয়ার প্রতি বিশেষ আকর্ষণ ছিল। এখনও আছে। বাবার বলে দেওয়া নিয়ম ছিল, একবার সবাই নির্দিষ্ট পরিমাণ পাওয়ার পর যদি কিছু অবশিষ্ট থাকে তবেই দ্বিতীয়বার পাতে পড়বে আলুভাজা, নচেৎ নয়। সবাই খেয়ে উঠে যাওয়ার শেষে আমার পাতে দিদার নিজের ভাগে রাখা আলুভাজার একাংশ পড়ত। ওটিই ছিল আমার কাছে বিশেষ আকর্ষণ।

আমার স্কুলের বাস চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতেন বারান্দায়। একবার রেজাল্টের দিন ফি-বই নিয়ে যেতে ভুলে গেছিলাম বলে নিজেই তা নিয়ে স্কুলে চলে আসেন—ঠাকুমা হয়ে সকল মা-বাবার সামনে দিয়ে বীরদর্পে কৃতী নাতনির রিপোর্ট কার্ড নেন। বড় নাতনি হিসেবে একটু বেশীই প্রিয় ছিলাম ওনার কাছে।

জন্মদিনে আসনে বসিয়ে দিদার আশীর্বাদ করা, নীলষষ্ঠী, শীতলষষ্ঠী, অশোকষষ্ঠীর দিনে ব্রতকথা শোনানো এসবই আমার শৈশব ও কৈশোরের মধুর সব স্মৃতি। একদিন স্কুল থেকে এসে গল্প শুনতে শুনতে ডুকরে কেঁদে উঠেছিলাম। হঠাৎ ভয় লেগেছিল খুব এই ভেবে যে দিদা যেদিন থাকবে না সেদিন বড় একা হয়ে যাব। দিদা সান্ত্বনা দিয়েছিল “ আমার বৃষ্টিরানী তখন তো অনেক বড় হয়ে যাবে, একা থাকতে শিখে যাবে, রাজপুত্র এসে ঘোড়ায় করে নিয়ে যেতেও পারে।“

পুজোর গন্ধ এলেই মহালয়ার পর থেকে মানে দেবীপক্ষে প্রতিবছর দিদার কথা খুব মনে পড়ে।আমার প্রথম মহিষাসুরমর্দিনী শোনা বোধহয় আট বছর বয়স এ… আমার দিদার সাথেই। দিদা মহালয়ার আগের দিন রাতে আমার বাবাকে বলতেন আকাশবানীর সঠিক স্টেশনটি রেডিওতে ঠিক করে রাখতে। ভোরবেলা চারটের আগেই উঠে যেতেন দিদা…বলতেন “যদি অ্যালার্ম শুনতে না পাই”…

প্রভাতী অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে আকাশবানীতে শুরুর একটি বিশেষ সুরে বাজনা বাজে…দূরদর্শনেও ঐ বাজনা শুনেছি…খুব নস্টালজিক লাগে এখনও।তারপরেই ঘোষনা হয়-“শুরু হচ্ছে মহালয়ার বিশেষ প্রভাতী অনুষ্ঠান “মহিষাসুরমর্দিনী”…

এরপর শঙ্খধ্বনি, “য়া চন্ডী”-র পরেই শ্রী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কন্ঠে “ আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জরী”…দেবীপক্ষের সুচনা। গায়ে কাঁটা দেয় এখনও। দিদা স্তোত্রপাঠ শুরু হলেই ঘরে ধূপ জ্বালাতেন…একটি বিশেষ সুগন্ধযুক্ত…এক মোহময়তা সৃষ্টি হতো।আমরা দুজনে একসাথে পুরো মহালয়া শুনতাম..মা দুর্গার সৃ্ষ্টি, অস্ত্রদান ইত্যাদি প্রতিটি স্তোত্রের অর্থ দিদা আমাকে বুঝিয়ে দিতেন।এভাবে আমার শৈশবের দিনগুলিতে দেবীপক্ষের আগমন ঘটত।

পুজোর প্রতিদিন আমাদের বাড়ির কাছে বৈকালিকী স্বপন স্মৃতি পাঠাগারে সন্ধ্যারতি দেখে দিদা ঠাকুর দেখতে বেরোতেন।

এ সবই আজ স্মৃতি…২০১২ সালে পুজোর  অনেক আগেই দিদা আমাদের ছেড়ে চলে যান। সেই থেকে আজ অবধি আমি ও আমার বোন একসাথে রেডিওতে মহালয়া শুনি… বৈকালিকী আর যাওয়া হয় না…আমরা সেই শহরতলির আস্তানা ছেড়ে এখন দক্ষিন-কলকাতাবাসী। কিন্ত দিদা চলে যাওয়ার পরও ছোটবেলার সেই ধূপের গন্ধটা প্রতি মহালয়ার দিনে পাই…হয়তো আশেপাশের কোন বাড়ি থেকে আসে…একই সুগন্ধ…কিন্ত আমার মন যুক্তি মানতে চায় না…মনে হয় “মীরা” সবসময় বিশেষ করে দেবীপক্ষে আমার আশেপাশেই থাকেন।”

দীর্ঘ বক্তৃতার পর একটু দম নিল এক নামী স্কুলের বাংলার শিক্ষিকা, বৃষ্টি চট্টোপাধ্যায়। সামনে উপস্থিত সকলের চোখেই তখন অবারিত অশ্রু।

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত