| 26 এপ্রিল 2024
Categories
গদ্য সাহিত্য

বাংলা প্রকাশনা ও রবীন্দ্রনাথ

আনুমানিক পঠনকাল: 2 মিনিট

আশিস পাঠক

নিজের লেখা প্রথম বইই রীতিমতো বোঝা হয়ে উঠেছিল রবীন্দ্রনাথের কাছে। বিক্রি না হওয়ার বোঝা। অবশ্য, তাঁর প্রথম বই ‘কবিকাহিনী’ ছাপা হয়েছিল ব্যক্তিগত উদ্যোগে, বন্ধুকৃত্যের তাগিদে।  সেই ব্যক্তিগত প্রকাশক বই ছেপে ব্যাবসা করতে নামেননি। সে বই ছাপা হয়েছিল নিছক বন্ধুকে তাক লাগিয়ে দেওয়ার জন্য৷ প্রবোধচন্দ্র ঘোষ ছিলেন রবীন্দ্রনাথের বন্ধু৷ রবীন্দ্রনাথ যখন আমদাবাদে,  মেজদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে,  তখন তাঁর ‘উৎসাহী বন্ধু এই বইখানা ছাপাইয়া আমার নিকট পাঠাইয়া দিয়া আমাকে বিস্মিত করিয়া দেন।’ কিন্তু কাজটা, রবীন্দ্রনাথের ভাল লাগেনি। ‘জীবনস্মৃতি’-তে লিখেছেন, ‘তিনি যে কাজটা ভালো করিয়াছিলেন তাহা আমি মনে করি না,  কিন্তু তখন আমার মনে যে-ভাবোদয় হইয়াছিল, শাস্তি দিবার প্রবল ইচ্ছা তাহাকে কোনোমতেই বলা যায় না। দণ্ড তিনি পাইয়াছিলেন, কিন্তু সে বইলেখকের কাছে নহে— বই কিনিবার মালেক যাহারা তাহাদের কাছ হইতে।’

তার পরে পেরিয়ে গিয়েছে প্রায় একশো চল্লিশ বছর। রবীন্দ্রনাথ এখন একটি বহুমুখী বাণিজ্যের উপকরণ। আজকের প্রকাশক বন্ধুদের মুখে শুনতে পাই, রবীন্দ্রনাথ নিয়ে খাড়াবড়িথোড় কিছু একটা ছাপলে তা মার যাবে না কোনওমতেই। গুটিপোকার গতিতে হলেও কেটে যাবে ঠিক।

বাঙালির বইবাণিজ্যে সেই ভরসা আজও জুগিয়ে চলেছেন রবীন্দ্রনাথ। আজি হতে শতবর্ষ পরে ইত্যাদি স্বপ্ন দেখেছিলেন যে রবীন্দ্রনাথ তিনি অবশ্য তাঁর বইয়ের কাটতির কারণগুলো জানতে পারলে বেশ হতাশই বোধ করতেন। প্রকাশকবন্ধুদের মতে, রবীন্দ্রনাথ নিয়ে যে কোনও বইয়ের ভবিষ্যৎ বিক্রয়যোগ্যতার প্রধান কারণ ডিগ্রিপ্রত্যাশী বাংলা পড়ুয়ার দল। রাজ্যে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের কমতি নেই কোনও, নিত্যনতুন গজিয়েও চলেছে। আর, রবীন্দ্রনাথ ছাড়া বাংলা সাহিত্যের পঠনপাঠন অচল। সুতরাং সেই নোটাভিলাষীরা রবীন্দ্রচর্চার পুস্তকসকলের প্রধান উপভোক্তা।

তবে বই কেনার মালিকেরা, অন্তত চুরি-যাওয়া-নোবেলটি পাওয়ার আগে পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন না। ঊনবিংশ শতকে খান পঁচিশেক বই প্রকাশিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের। সেগুলির মোটে চারটে দ্বিতীয় সংস্করণ এবং দুটো তৃতীয় সংস্করণ পর্যন্ত গুটি গুটি করে পৌঁছতে পেরেছিল৷ বাকি উনিশটির ভাগ্যে ছাপাখানার মুখ দেখার সুযোগ হয়েছিল একবারই।

আসলে জয়মাল্য যতই পান না কেন, আদি যুগের রবীন্দ্রনাথের বিক্রি মেরে দিয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। উপন্যাসে তখন হটকেক বঙ্কিম। তাঁর ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ যে বছর বেরোল (১৮৭৮),  সেই বছরই প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের প্রথম বই ‘কবিকাহিনী’৷ বঙ্কিম বেঁচে থাকতে ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’-এর চারটে সংস্করণ হয়, ‘কবিকাহিনী’র একটাও না৷ সংস্করণ তো দূরের কথা,  প্রথম পাঁচশো কপিরই দশা যে কী হয়েছিল তা ‘জীবনস্মৃতি’-তেই লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ৷ মজা করে বলেছেন, ‘শুনা যায় সেই বইয়ের বোঝা সুদীর্ঘকাল দোকানের শেল্‌ফ্‌ এবং তাঁহার চিত্তকে ভারাতুর করিয়া অক্ষয় হইয়া বিরাজ করিতেছিল।’

আজও বহু প্রকাশকের ঘরে সুদীর্ঘকাল দোকানের শেলফ আলো করে রবীন্দ্রনাথ-সংক্রান্ত নানা বই বিরাজ করে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এখন যেহেতু এক প্রবল ফ্যাশনের নাম তাই প্রকাশকের মনে একটা আশা থাকে, পড়ুয়ারা না হোক, অন্তত মেহগনির মঞ্চ ভর্তি করার নেশা যাঁদের তাঁদের ঘরে যাবে সে সব বই।

যায়ও। হয়তো সে কারণেই রবীন্দ্রনাথ আজও বহু বাঙালি প্রকাশকের অবলম্বন। কিন্তু প্রতি জন্মদিন, মৃত্যুদিনে চর্বিতচর্বণের বাইরে নতুন করে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ভাবেন কি কেউ?

প্রশ্নটা সহজ, উত্তরটা কি জানা?

• লেখক আনন্দবাজার পত্রিকায় এক দশক সাংবাদিকতা করেছেন। এখন বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগে প্রকাশন শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত।

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত