| 27 এপ্রিল 2024
Categories
গদ্য সাহিত্য

বিচ্ছেদ 

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

অরণ্য বিষহীন বাস্তুসাপের মত ঘুরপাক খাওয়া থোকা থোকা জোছনার সিঁড়ি। অথচ ছাদ বড় নিষিদ্ধ পরিহাস, তাই, একমহলায় গৃহবন্দী একমহলা। ফুলেল স্কার্ট। কী ফুল। কে জানে। তবে তার চেতনার ভাষায় সে হয়ে ওঠে, কুমুদ। একটা হাল্কা মিঠে আওয়াজ কানে এসে বাজে। ফুলের ঘ্রাণ ছড়ানোর স্বচ্ছন্দ বাজনা। উৎকণ্ঠা নেই। নেই নিষেধের কালচে রুমাল। জৈষ্ঠ্যের দ্বিপ্রহরে সারাটা সময় চৌধুরীদের পরিত্যক্ত বনসায়র ও সংলগ্ন বাতাস মাতাল হয়ে থাকে। এ শুধু সৌরভ নয়, এক স্বয়ংসম্পূর্ণ সুবাসের নিভৃত যাপন। তাতে মিশে আছে স্বাধীনতার বাঁকা মেঠো পথ। বাঁশবাগানের নীচু জলায় বসে থাকা অদৃশ্য পাখিটির রোধ। স্থানে স্থানে অবারিত চোরকাঁটা। সেই পথ বেয়ে আরো একটু এগিয়ে গেলে লতাগুল্মের অবগুণ্ঠনে সুপ্ত এক নির্মেদ সায়র। যেন কত স্নান বাকি রয়ে গেছে। যেন এই বিচ্ছেদ তার নিরবিচ্ছিন্ন অভিমানের বিকল্প লয়। কুমুদখচিত এইসব নির্বিকল্প প্রণয় ছাদ হেতু রচনা নিষিদ্ধ। অথচ ছাদটিকে নিবিড় অরণ্যের নির্লিপ্ত সায়র ভেবে নিতে কারো নিষেধ ছুঁতে লাগে না।ছুঁতে লাগে না একতলার আধকানা ঘরটিকে মুক্ত জোৎস্নায় স্নানরত একরত্তি প্রাগৈতিহাসিক ছাদের অভিসারে যেতে। একমহলা যায় ছাদের কাছে, ছাদ যায় অরণ্যে। যাওয়াই সার। কেউ কারোরই কাছে পৌঁছতে পারে না। অপেক্ষায় অপেক্ষায় দোল খায়।

 

একটি জলপাই সাইকেল। ততোধিক জলপাই তার টুংটাং৷ চিঠি আসে। ধুলো মিশে থাকা অক্ষর। যুদ্ধমথিত কোনও সৈনিক। যুদ্ধই তার ধ্যান। যুদ্ধই তার জ্ঞান। এবং ডানহাতি। যাকিনা গুরুতর জখম। প্রেমিকাকে চিঠি লিখে দিচ্ছেন সহকারী বন্ধু। বন্ধুটি এ ভাষার কেহ না। তবু তার চেষ্টা এ চিঠিতে এ ভাষাতে ছত্রে ছত্রে বর্তমান। সেই চিঠি ঘটনার ঘূর্ণাবর্তে আছাড়ি পিছাড়ি খেয়ে কলম্বাসের মত পৌঁছায় ভুল ঠিকানায়। অভিযান নেশায় ভরপুর আমাদের ভাষা। সদ্য মালভূমি বয়ে আসা কিশোরী। ভুল চিঠিদের ভুল বানানে মরিয়া জখম খুঁজে নেয়। ভাষা বলতে। কেবলই তার উৎসহারানো জল। ল্যাটেরাইট মাটি। শাল-পলাশের শ্যামলা ছায়ায় মেঘলা নৈবেদ্য’র দেশ। নিরুদ্দেশ। মুহুর্মুহু উড়ে আসা কাঠঠোকরার পিয়ানো। মনের কথাগুলি বয়ে বেড়ায় মল্লভূমের নির্জন বাতাস। শত সাবধানতা অবলম্বন সত্ত্বেও লাল লাল ধুলো ক্রমশ ঘনিয়ে আসে। ধুলোয় যেন কার রক্ত। রক্তে বিচ্ছেদের বারুদ। কিছু ভুল না শুধরানো ভালো। চিঠিদের আসলে কোনও ঠিকানা হয় না। কিছু উত্তর প্রশ্নচিহ্নসমেত শেষ হয়। তাই প্রশ্নেরা কমে আসে। কালবৈশাখীতে ধাক্কা খাওয়া গোধূলির আলোর মত। শেষ চিঠিটি তে খোঁপার মত ঝুলে থাকে একটি জলপাই চন্দ্রবিন্দু।

 

এখানে বিনোদন মানে কেবলই বেতার। প্রচার তরংগগুলি ফণিমনসার মত প্রচারবিমুখ। গ্রীষ্মের নিস্তেজ দুপুর। মুখিয়ে থাকা শৈশবের খানকয়েক দৃঢ মুখ। স্কুল প্রায় একমাস ছুটি। তারই রেশ ধরে খুড়তুতো-পিসতুতো গল্পসফর। দোতলার সমস্ত ঘর যেন সেই সফরের টাইমমেশিন। সন্ধ্যার আহ্নিক সেরে হরজ্যাঠা শুয়ে থাকেন খাটিয়া পেতে। মাধব মন্দিরে কীত্তন শেষ হব হব। শহরের উপকণ্ঠে যে গ্রাম। তার সমস্ত অন্ধকার মাতোয়ারা। ব্রজবুলি ধুনোর আঁচে। মোহন কাকার দোকান থেকে উড়ে আসে সলজ্জ ফুলুরির মোহ। কাদের বাড়িতে যেন তালের লুচি ভাজা হয়। আদিম আদিম ছাতিম গাছটি ঠিক এইসময়ই জেগে ওঠে প্রতিদিন। এইসব মায়াবী সুর যখন ভারী করে রেখেছে ছুটির আক্ষরিক প্রবাহ। লণ্ঠনের খয়েরি আলোয় পড়া হয় বই। লাইব্রেরি থেকে চুরি যাওয়া বই। সে কোন জমানার লাইব্রেরি। লাইব্রেরিয়ানের মতই প্রাচীন। ততোধিক উদাসীন। তার পোকায় কাটা পাতা। হলুদ। পাঠের গুণে আগুন হয়ে ওঠে। পুরানো পাতার কড়া মিহি গন্ধ। মাঝখানে লণ্ঠন। গোল হয়ে বসে আছে খাতভাঙা শৈশব। জামবাটি মুড়ি। সতর্ক কান, মুদে আসা চোখ আর নিস্তব্ধ জাবরের হাপুস হুপুস- এইসব সন্ধের ঘনত্ব মাপতে পারেননি কোনও গণিতজ্ঞ। রাত্রি সহজাত রাত্রিতর হয়। হরজ্যাঠার পৈতৃক বেতার তখনো নিজের খেয়ালে ঘষে চলেছে ফ্রিকোয়েন্সি। একটাদুটো ব্যর্থ যাওয়া ফুলকি। বিচিত্র সব শব্দের ঠুমরিতে নেশা নেশা লাগে। আলো পর্যাপ্ত না হওয়ায়, বোঝা যায় না কে কতখানি নেশাচ্ছন্ন। সেই নেশা কোনও রাতজাগা পাখির ডানা ঘেষে সাংঘাতিক হয়ে ওঠে আগামী দুপুরবেলা। নিস্তেজ দুপুরবেলা। নিমগাছের ডালে কী একটা বাতাস এসে লাগে। বেতার বেতার বাতাস। শুনছেন। গল্প “পথের দাবী।” পরবর্তী অংশ। কতদিন সেই প্রচারতরংগের কাটাকুটিতে ছিঁড়ে ছিঁড়ে আলগা হয়ে যায় সমস্ত উদ্যমে পাঠরত দরদী নারীকণ্ঠ। মনের কত লুকানো অনুভূতি শোনা হয়ে ওঠে না। স্বয়ং চরিত্রের কণ্ঠে । কতক্রোশ দূর থেকে ভেসে আসা ভারতী। অপূর্ব। ডাক্তার। সুমিত্রা। বর্মার অতুলনীয় পটভূমিকা। ঘড়িধরে তিরিশ মিণিট ব্যাস। তাও তত মসৃণ না। লণ্ঠনের কাঁচাপাকা আলোর মতই অস্পষ্ট অথচ সম্ভাবনাময়। সম্ভাবনাময় শৈশবের সেইসব বেতার বেতার বাতাস। সান্ধ্য পল্লীগ্রাম। বাতাসের আবেশে আলগোছে পড়ে যাওয়া ফুলদানির মত বাংলা ভাষা। সম্ভাবনাময়। সেইসব চুরি যাওয়া বই। পালা করে করে গল্পপাঠ। জামবাটি মুড়ি। লাইব্রেরি। ওরফে উদাসীন লাইব্রেরিয়ান। আজকাল আছেন কেমন?

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত