| 27 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

ভালবাসার অ আ ক খ

আনুমানিক পঠনকাল: 51 মিনিট

পা টিপে টিপে আমরা এগুই।

সিনেমা হাউসের আড়াল-করা আলোর নামমাত্র আলোর আওতা ছাড়াতেই—একেবারে ঘুটঘুট্টির মধ্যে এসে পড়লাম। শুনলাম, মিনিটখানেক আগেই নাকি এধারের লাইন ফিউজ হয়ে রাস্তার সব বিদ্যুৎ-বাতি নিবে গেছে। একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার। একটুখানি ফিকে জ্যোৎস্নার আবছায়া থাকলে ভালো হতো,—এক কাস্তে চাঁদের আলো—চাঁদনির ফসল—পৃথিবীর পক্ষে নেহাত কম নয় (দুজনের পক্ষে তো খুবই বেশি!) কিন্তু এই আকস্মিক অমাবস্যায় একেবারেই মেরে দিয়েছে।

তবে এই অন্ধকারই ভালো! এমন ঘুটঘুট্টিই বা মন্দ কী? পা টিপে টিপে পাশাপাশি চলতে ভালোই লাগে। তবে পাশে নিতান্তই নিজের–কী বলে গিয়ে—ইয়ে, এই যা।

একটা খাসা ছবি–দুজনে মিলে উপভোগ করবার এই বেহালা পর্যন্ত আমাদের ঠেলে আসা! ছবিটার টানেই বিশেষ করে। নামজাদা ছবি, কিন্তু কলকাতার বড় বড় সিনেমায় যখন দেখানো হচ্ছিল, তখন ছোটখাটো নানা কাজে জড়িয়ে থেকে দেখা হয়ে ওঠেনি, তারপর আজ হঠাৎ কলকাতার উপকণ্ঠে এর পুনঃপ্রদর্শনীর ঘোষণা দেখে ভাবলুম এ-সুযোগ আর ফস্কানো না!

সুযোগই বলতে হয়! কলকাতায় বাস করে চাঁদের সঙ্গে আমাদের আড়ি। পূর্ণিমা আমাদের চোখে পড়ে না, অমাবস্যাও। চাঁদের বদলে আমরা পেয়েছি বিদ্যুতের চাঁদনি—সস্তার বাজার! হঠাৎ এই রাস্তা-জোড়া বৈদ্যুতিক বিকলতার দৌলতে, অমা-রজনীর রূপটা দেখতে পাওয়া গেল।

এইমাত্র সিনেমা ভেঙেছে, আর–আমরাও ভেঙে পড়েছি! যে অমা-রজনীর অপরূপ উপভোগ্যতা নিয়ে একটু আগেই উদ্বেল হয়ে উঠেছিলাম, এখন তার গর্ভে প্রবেশ করে তার চেহারা দেখেই চমকে উঠতে হলো।

এই সূচীভেদ্য যবনিকা ভেদ করে আজ বাড়ি পৌঁছতে পারব তো? কল্পনাকে বল্লাম : আমার হাত ধরো, নইলে হারিয়ে যাবে।

কল্পনার হাত আমার বাহুর আশ্রয় নেয়, এবং বলতে কি, নিজের ইয়ে হলেও আমার বেশ ইয়েই লাগে। আমি কল্পনাকে, মানে, কল্পনার সেই ভগ্নাংশকে বগলদাবা করে সন্তর্পণে পা বাড়াই। ফুটপাথটা কোন ধারে, ঠিক যে কোনে, পা দিয়ে হাতড়াতে থাকি।।

উঃ, কী অন্ধকার! কল্পনা দম নিয়ে বলে? বিচ্ছিরি! সিনেমার গহ্বর থেকে বার হবার তোড়ে আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছল—ক্ষণেকের জন্যেই। কিন্তু সেই মুহূর্তের মধ্যেই চারিধারের এই আঁধার আরো ঘোরালো আরো ঘনীভূত হয়ে উঠেছিল বুঝি। অনুভূতিটা, নানান দৃষ্টিকোণ থেকে, নানা ভাবে রোমন্থন করার আগেই কনা আমার বগলে ফিরে এসেছে। ভালো করে হারাবার আগেই আবার আমরা পরস্পরের করতলগত ও কুক্ষিগত হয়ে পড়েছি।

এবং সেজন্যে তেমন দুঃখিত কি? অমাবস্যার অবশ্যম্ভাবী সুযোগে মাধুর্য-কণ্টকিত সম্ভাবনাটা নিতান্তই মাঠে মারা গেল হয়তো? পেয়ে হারাবার এবং হারিয়ে পাবার এই ফাঁকতালে, কল্পনার বদলে, আর একটি মেয়ে, (কল্পনার মতই সুন্দর আর মিষ্টি, কল্পনা করা যাক না!) অপর একটি মেয়ে হস্তগত হয়ে এলে নেহাত মন্দ ছিল না বোধ হয়।

যাক, গতস্য শোচনা নাস্তি, দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলি। না, ঠিক ও-কথাটা বলি না। বলিঃ কতক্ষণ আর! এও সয়ে যাবে—সয়ে আসবে অচিরেই-কতক্ষণের দুর্যোগ।

কিন্তু ওর মধ্যেও অনুশোচনার সুর বেজে ওঠে—যোরালো একটা প্যাঁচ যেন থেকে যায়। মানে, অন্ধকারটা আস্তে আস্তে আমাদের চোখে সয়ে যাবে! সেই কথাই বলছি। অন্ধকারকে পরিষ্কার করে দিতে হয়।

এবং অন্ধকারের অরণ্য ভেদ করে আমরা দুজনে দুঃসাহসের দিগ্বিজয়ে বেরিয়ে পড়ি।

ওমা–। অকস্মাৎ আমি চেঁচিয়ে উঠি : চারধারেই জল যে। এবার যে গঙ্গা পেরুতে হয়।

অ্যাঁ? কী বলছ? গঙ্গায় এসে পড়লাম নাকি? কল্পনাও আঁৎকে ওঠে।

প্রায় তাই। জলমগ্ন পা-টাকে ফুটপাথের উপকূলে টেনে তুলি : কলকলধ্বনি শুনছ? এখন সাঁতরে পেরুতে হবে।

ইতস্ততঃ-প্রজ্জ্বলিত জোনাকি পোকার আলোয় যতদূর দৃষ্টি চলে, চারিধার জলে জলময়। এই অন্ধকারের অজুহাতে কোন এক রসিক রাস্তার ঘোলাটে জলের উৎস-মুখটা মজা করে খুলে রেখে গেছেন, (সারা কলকাতাকেই তার জলাঞ্জলি দেবার মৎলবে কিনা কে জানে!) তাইতেই এই কলোচ্ছ্বসিত জলোৎসব!

তাহলে কী হবে? কল্পনা আর পা বাড়ায় না।

কী আবার হবে! যুগে যুগে কারা গন্ধমাদন বহন করেছে? আমরাই। চলে এসো।

উহুঁ। সাদর অভ্যর্থনার বিজ্ঞাপনেও ও অবিচলিত।

তবে সারারাত এখানে দাঁড়িয়ে থাকা যাক! সেই ভালো।

এই দ্বীপে?

দ্বীপে।

বাঃ, দ্বীপ কাকে বলে তাও জানো না?

জানি বইকি। দ্বীপ হচ্ছে, ফুটপাথের অংশবিশেষ, এমন একটি স্থলভাগ যার চারিধারে জলবেষ্টিত হয়েও–

হয়তো এটা ব-দ্বীপও হতে পারে। কল্পনা ক্রমেই নিজেকে ফাঁপিয়ে তোলে। তাও হতে পারে। আবার আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে রাতারাতি যেসব দ্বীপ গজিয়ে ওঠে তার একটা হওয়াও বিচিত্র না! খুব অসম্ভব নয়। আমিও কল্পনার রাশ ছেড়ে দিই। রাশ ছেড়ে দেয়া খুব শক্ত ছিল না। এই সুপরিচিত শহরতলীও অন্ধকারের অপরিচয়-সূত্রে এমন অবাস্তব আর রহস্যময় হয়ে উঠেছিল যে এহেন জগতে এই মুহূর্তে সব কিছুই সম্ভব বলে বোধ হতে থাকে।

আচ্ছা, এই রকম একটা দ্বীপে উৎক্ষিপ্ত হবার বাসনা তুমি মনে মনে কখনো পোষণ করোনি, ঠিক করে বলো তো?

কখনো না। কল্পনার সুদৃঢ় কণ্ঠ : আমার ভারী ঠাণ্ডা লাগছে। আমি বাড়ি যেতে চাই।

ঠাণ্ডা লাগার অপরাধ কি? সাড়ে এগারোটায় সিনেমা ভেঙেছে—এমনিতেই তো

অধেক রাত। তার ওপরে অন্ধকারাচ্ছন্ন এই নির্জনতা ফাঁক পেয়ে মানুষের পাজরার ভেতরে ঢুকে হাড় কাঁপিয়ে দিতে চায়।

বাড়ি যেতে চাইবে, সে আর আশ্চর্য কি? আমি ওকে উত্তপ্ত করার প্রয়াস পাই? যারাই কিনা মকদ্বীপে উৎক্ষিপ্ত হয় তারাই বাড়ি ফিরে যেতে চায়। কিন্তু কদিন আর? অভ্যেস হয়ে যেতে আর কদিন? প্রথম প্রথম ওইরকম একটু মন কেমন করে। তারপর কিছুদিন গেলে আর কিছুতেই তাদের সেখান থেকে সেই মরুদ্বীপের স্বর্গোদ্যান থেকে সরানো যায় না। রবিন্সন ক্রুসো পড়েছ তো?

কল্পনা বলে, তুমি একটা ক্ষ্যাপা।

কেন, এমন হতে পারে না কি?– আমি ওকে বোঝাতে চাই : অঘটন কি ঘটে না পৃথিবীতে?

বাস্তবিক, যেখানে চিরকাল এত আলোর ঝলমলানি দেখে এসেছি, চাঁদের জ্যোৎস্নাটুকুও যে-পথে কদাচ পড়তে পায়নি, যেখানে পথঘাটের কোনোদিন অন্যরূপ দেখব এমন প্রত্যাশা ছিল না, সেখানে এই বিপুল—অদ্ভুত—অপরূপ অন্ধকার, এই অপরিমেয় রহস্যঘনতা, যা ভাবতেই, আপনিই যত অসম্ভব কল্পনা মনের বলগামুক্ত হয়ে এলোপাথাড়ি ছুটোছুটি লাগিয়ে দ্যায়।

…মিরাকল কি ঘটে না পৃথিবীতে?… আমি বলে চলি: এইমাত্র সিনেমার এক অবাস্তব জগৎ থেকে আমরা উঠে আসছি; আবার সেই আমাদের পুরনো পরিচিত পচা একঘেয়ে জীবনে ফিরে যাবার প্রত্যাশা নিয়ে, কিন্তু এর মধ্যে কী অঘটন ঘটে গেছে, না জানি কী যাদুবলে কলকাতার মায়া কাটিয়ে কোন এক সুদূর আদিম দ্বীপের উপকূলে, আমরা উৎক্ষিপ্ত এখন—যেখানে সভ্যতা নেই, ভদ্রতা নেই, অশান্তি নেই, যুদ্ধবিগ্রহ-মারামারি কাটাকাটি কিছু নেই, নিত্য নবযুগ, নিত্য নব নব হুজুগ নেই—কেবল চারিধারে নীলাম্বুরাশি আর তালীবন, আর শুধু তুমি আছো আর আমি আছি—এমন কি হতে পারে না নাকি?

তুমি একটা ক্ষ্যাপা। কল্পনার কণ্ঠে পুরাতন ঘোষণা।

এটা কি একটা জবাব হলো?

তুমি একটা আস্ত। কথাটা সম্পূর্ণ না করেই, আমার কবল থেকে সবলে তার হাত ছাড়িয়ে নেয় : হ্যাঁ, তাই আমার সন্দেহ হচ্ছে। আমি বাড়ি যেতে চাই। সে বলে।

যাবে বই কি। নিশ্চয়ই যাবে। আমি ওকে ভরসা দিই : যথাসময়েই যেতে পারে। আশ-পাশ দিয়ে একটা জাহাজ গেলে হোলো? আর জাহাজরা তো গিয়েই থাকে, কালেভদ্রে যায় বই কি! তখন আগুন জ্বেলে নিশানা দাও কি তোমার পাঞ্জাবী খুলে নিশান ওড়াও। দ্যাখো, ঐ দ্যাখো, কী একটা যাচ্ছে যেন।–

রক্তচক্ষু অতিকায় জাহাজপ্রতিম কী একটা, ভোঁসর্ভোস গর্জনে, দারুণ আওয়াজ ছেড়ে, বঙ্কিম দৃষ্টিতে আমাদের দিকে বারেক মাত্র কটাক্ষ করেই তীরবেগে অন্ধকারের মধ্যে তিরোহিত হয়ে গেল।

বাস গেল না? কল্পনা আর্তনাদ করে উঠল : বাজে বক করে বাসখানা হারালুম। থামালে কাজ দিত। থামালে না কেন?

কি করে থামাবো? আমি বিস্মিত হই : পাঞ্জাবী খুলে ওড়ানো আমার পক্ষে অসম্ভব। তাছাড়া, সময় পেলাম কই? আর, কলকাতার পথে আগুন জ্বালালে, বুঝতেই পারছো, পেনাল কোডে পাক্কা ছমাস।

পরের বাস আসতে আবার সেই আধ ঘণ্টা। কল্পনা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফ্যালে : আর আসবেই কিনা কে জানে।

নাই বা এলো। আমি ওকে সান্ত্বনা দিইঃ মরুদ্বীপে সময় হু হু করে কেটে যায়। টেরই পাওয়া যায় না। আর এমন আরামে কাটে। এমন কি, সেখানে বসে এক-আধটু রোমান্সও করা যায় না যে তা নয়।

ছবিতে দেখেছি বটে। কল্পনার শুষ্ক কণ্ঠ।

দেখলেই বা, রোমান্সে কোনো দোষ নেই আমি ওকে বুঝিয়ে দিই : আব তাছাড়া রোমান্স করতে হলে মরুদ্বীপে নিক্ষিপ্ত না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে তারও কোনো মানে নেই। রমণীয় যা, জো পেলেই জোগাড় করো-বাগে পেলেই বাগিয়ে নাও। রোমান্সের চুলের টিকি পাকড়ে আনো। অনেক বছব আগে, এমন একটা চমৎকার আঁধার রাত পেলে তুমি কী উচ্ছ্বসিতই না হতে।–

অনেক বছর আগে, তার মানে? কল্পনা প্রতিবাদ করে।

না, তত বেশি বছর আগে নয়। আমি ক্ষতিপূরণ করে দিই : কেন, তোমার গলার সুরে তো বোধ হচ্ছে যেন এই সেদিনের কথা। মনে হচ্ছে, সেই তুমি, সেই তরুণবয়সী তুমি, অনেক বছর—মানে, অল্প কিছুদিন আগের সেই তুমিই।

আমার গলার রেশ আমার কানে এসে লাগে। বেশ লাগে। নিজের স্ত্রীকে কেমন যেন পরস্ত্রী বলে মনে হয়।

এখনো তুমি ঢের কাঁচা, ঢের কচি। এখনো তোমাকে নিয়ে রোমান্স করা চলে।… আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো বলি! আমার আত্মপরভেদ লোপ পায়,—নিজের স্ত্রীর প্রতিই কেমন একটা অদ্ভুত টান অনুভব করি—কেমন যেন পরস্ত্রীকাতারের মতো হয়ে পড়তে থাকি ক্রমশঃ।

…এমন চমৎকার রাত…এহেন মোহিনী অন্ধকার…তুমি আর আমি এত পাশাপাশি…

নিজের গলা শুনে নিজেই বিগলিত হই। আমার মধ্যে এত মাধুর্য আছে–তাহলে না তো! এমন মধুর কন্ঠ যে আমিও কখনো শুনিনি।

…এসো, আরো কাছে এসো। আমায় একটা চুমু দাও। এই বলে কস্তুরীকা আপনগন্ধে আপনি মাতোয়ারা হয়ে ওকে কাছে টেনে একটা চুমু খেয়ে নিই।

এবং সঙ্গে সঙ্গে প্রেয়সী, আমার গালে এক চড় বসিয়ে দ্যান। বেশ মজবুত হাতের যুতসই এক চড়।

কী সাহস তোমার। কল্পনা হাঁপায় : এতদূর আস্পর্ধা।

বা রে, নিজের বৌকে যদি চুমু খেতে না পারো, আহত গালে হাত বুলোতে বুলোতে বলি : তাহলে কার বৌকে চুমু খেতে যাবো, শুনি?

যা? তার ওপরে আবার একটা বউ আছে বাডিতে? বটে? কল্পনা ফোঁপাতে থাকে : আগেই বোঝা উচিত ছিল আমার।

এই বলে কল্পনা, আর একটি কথাও না বলে অদ্ভুত আবহাওয়ায়, মরুদ্বীপ ত্যাগ করে জলে নেমে পড়ল এবং টলতে টলতে জলাশয় পাব হয়ে অন্ধকারের মধ্যে হারিয়ে গেল।

দোর গোড়াতেই কল্পনার সঙ্গে দেখা।

উঃ, আজ খুব একটা ফাড়া গ্যাছে। কল্পনা উচ্ছ্বসিত স্বরে বলে? বলছি, ভেতরে চলো।

ফাড়া? য়্যা? বলল কী?

যখন ছবি দেখে আমরা বেরুলুম, তুমি বল্লে না যে, আমার হাত ধরো,তোমার মনে নেই?

আছে বইকি। আমাকে স্বীকাব করতে হয়।

আমি ধরেও ছিলাম, কিন্তু অন্ধকাবে প্রত্যেক হাতই প্রায় এক রকম। আমি তোমার হাত মনে করে আরেক জনের-লোকটা কিন্তু ভারী রোমান্টিক, ই বলো। বিয়ের আগে তুমি যেমনটা ছিলে, অনেকটা তেমনি আর কি।

বুঝেছি, অন্ধকারের সুযোগে বেহাত হয়ে আমি কঠোর ভাষায় আরেক হাত নিইঃ তুমি বেশ একটু পরস্মৈপদী ফুর্তি লুটে নিয়েছ। …ভালো করোনি। ছিঃ।

বাঃ, কী করে জানব আমি? আমি ভেবেছিলাম, তুমিই। অনেকটা তোমার মতই গলা। অবশ্যি, কেমন একটু ক্ষ্যাপা মনে হচ্ছিল, তবুও যতক্ষণ না লোকটা আমায় চুমু খেল আমি সন্দেহই করতে পারিনি। তারপরই তো আমি টের পেলুম যে তুমি নয়। তুমি কখনো চুমু খাবার কথা ভাবতেই পারে না। নিজের বউকে কি কেউ চুমু খায়—মানে, বিয়ের এই এতদিন পরে?

যাকগে, যেতে দাও, বলে কথাটা আমি উড়িয়ে দিই: যে কাজটা ফেলে রেখে গেছি মনে আছে? কাল সকালেই তার ব্যবস্থা করতে হবে। পূজো তো এসে পড়ল। কাকে কী উপহার দেওয়া যায় আজ রাত্রেই তার ফয়সলা করার দরকার।

কাল সকালে আমার সময় হবে না। আমি জানাই। এবার টাকাকড়ির যা টান-আত্মীয়তার টানাটানিটা একটু কমালে কী হয়? এবার পূজোয় ধরে কাউকে কিছু যদি না দিই?

এবারে শারদীয়ায় কাকে কী তত্ত্ব দেয়া যায়, সেই সমস্যায় পড়া গেছল। সারা বছর কেউ কারো তত্ত্ব নেব না এবং পূজোর সময় সে-সমস্তর প্রতিশোধ নেব, এই আমাদের চিরাচরিত পারিবারিক প্রথা। পুজোর তত্ত্বকথা। এই দারুণ দুবৎসরে উক্ত প্রথার কোনোরূপ ইতরবিশেষ করা যায় কিনা ঠাওর করছিলাম।

উঁহু। তা হয় না। ঘাড় নাড়ল কল্পনা। পরিবারের কাছ থেকেই বাধা এল প্রথম।

তাহলে উপহার-দ্রব্য নিয়েও মাথা ঘামানোর দরকার নেই। আমি বলি : মঞ্জুকে একটা সিল্কের রুমাল, মামাকে এক কৌটো সিগ্রেট, সৌম্যকে একখানা ভালো বই, আমারই বই একখানা, আর রঞ্জনকে একটি ছড়ি—এই দেয়া যাক। এই—এই দিয়েই এবারকার হাঙ্গামা চুকিয়ে দিলে কী ক্ষতি?

ক্ষতি নেই? কল্পনা জিজ্ঞেস করে।

খতিয়ে দেখলে ক্ষতিই অবশ্যি। উপহারের ছড়াছড়ি করার আমিও পক্ষপাতী নই। কিন্তু তুমি আবার বলছো–

আমি মোটেই ওই দিতে বলছিনে। কল্পনা বাধা দিয়ে বলে? উপযুক্ত উপহার কী দেয়া যায় তাই আমি ভেবে দেখতে বলেছি।

ভেবে দেখতে আমি নারাজ নই। আমি স্বীকার করি। কিন্তু আমার কেমন ভয় হচ্ছে যে ভাবতে গেলেই আরো বেশি খরচের ধাক্কায় পড়ে যাব।

উপহার তো দিতেই হবে। কিন্তু তা যাতে দেবার মতো হয় তা কি ভাবতে হবে? আহা, কে যে কী চায়, সেইটে যদি কোনো উপায়ে জানা যেত—

রক্ষে করো। আমরা বাঞ্ছাকল্পতরু হতে পারব না। আমি ককিয়ে উঠি।

কল্পতরু না হই, তাদের ইচ্ছার একটুও তো পুরণ করতে পারি। চেষ্টা করলে করা যায় না কি?

একটুখানির মধ্যে নিজেদের ইচ্ছা সীমাবদ্ধ রাখার মানু; কিনা তারা? আত্মীয়দের ভালোমতই আমার জানা আছে—চিনতে আর বাকী নেই। তাদের মনের মধ্যে হানা দিতে গিয়ে

সোজাসুজি তাদের জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছি না কি? আমার বাপের বাড়িতে এরকম ব্যাপারে কী করা হয়ে থাকে জানো? জিজ্ঞেস করে কল্পনা।

কল্পনার পিত্রালয়ের রহস্য আমার কল্পনাতীত। আমি ঘাড় নেড়ে আমার অজ্ঞতা জানাই। উপহারের স্থলে সেখানে প্রহার দেওয়া হয় কি না, তাই ওদের পৈতৃক পদ্ধতি কি না, জানবার আমার কৌতূহ হয়।

ইচ্ছাময়ের লীলা বলে একরকমের খেলা আমরা খেলি। পূজোর কিছুদিন আগে আত্মীয়বন্ধুদের ডেকে একটা পার্টি দিই। সেই আসরেই খেলাটা ফাদা হয়। কার কী কী জিনিস পাবার কামনা, প্রত্যেককে তার তালিকা বানাতে বলা হয়। তারপরে যে কী য় আমার ঠিক মনে পড়ছে না।

দিস্তা দিস্তা কাগজ আনার দরকার পড়ে বোধ হয়? আমি অনুমান করি।–তাহলে বলো, রিমখানেক কাগজের জন্যে ভোলানাথ দত্তে অর্ডার দেয়া যাক?

বাজে বোকো না। ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে ও মনে হচ্ছে দুটা ইচ্ছের মধ্যেই তালিকা সম্পূর্ণ করতে বলা হোতো। আমরাও ওদের নেমন্তন্নের আসরে ডেকে এনে তাই বলবো। তাহলেই ল্যাঠা চুকে যাবে। তাহলেই তো ফর্দ আর বাড়তে পাবে না।

বেশ, তারপর?

তারপরে, ইচ্ছা পুরণের জন্য একজন করে আসর থেকে উঠে পাশের ঘরে যাবে—

যেমন ধরা যাক মঞ্জুলিকা। আমি উদাহরণের পক্ষপাতী। দৃষ্টান্তের স্বরূপছাড়া কোনো বস্তু প্রত্যক্ষ করা—সম্যকরূপে হৃদয়ঙ্গম করা আমার পক্ষে সুকঠিন।

বেশ, মঙুই হলো না হয়।

তাহলে আরেকজনকেও তো যেতে হবে তার সঙ্গে। বলি আমি।

কেন? আরেকজন কেন?

বাঃ, আর কেউ না গেলে তার ইচ্ছা পূর্ণ হবে কী করে?

এ তোমার–যতো—ইয়ের খেলা নয়। কল্পনা ঝাঁঝিয়ে ওঠে: একেবারে আলাদা জিনিস।

কিন্তু মঞ্জুর মন যা চায় তাইতো যোগাতে হবে? মনে মনে সর্বদাই সে পরমুখাপেক্ষী। তার মুখ্য ইচ্ছে হলো—

চুমু খাবার? তুমিই ভালো জানো! কিন্তু সেসব এখানে চলবে না।

তাহলে সেরকম নিরামিষ ইচ্ছাপুরণে মঞ্জুর বিশেষ উৎসাহ হবে বলে মনে হয় না। আমিও জানাতে বাধ্য হই।

হলো বয়েই গেল! আমাদের তালিকা পাওয়া নিয়ে কথা। তাদের মনের ইচ্ছাটা শুধু জানার দরকার। কাগজ পেন্সিল নিয়ে না হয় দুজন করেই পাশের ঘরে যাবে—

কিন্তু জোড়া গেঁথে যদি আমরা পাশের ঘরে পাঠাই তাহলে তা, কখন ফিরবে তার কি কিছু ইয়ত্তা আছে? কোন ঘরে শেষ পর্যন্ত তাদের পাওয়া যাবে তাও বলা মুস্কিল। এমন কি,–বলতে গিয়ে আমি চেপে যাই।

মুস্কিল কিসের? ও জিজ্ঞেস করে।

মানে, আদৌ ফিরবে কিনা, কোনো ঘরেই পাওয়া যাবে কি না তাই বা কে জানে! আমার উপসংহার। আত্মীয়রা এবং আত্মীয়তা স্বভাবতই আমার কাছে রহস্যময়।

তাহলে—তাহলে না হয় এক একজন করেই ছাড়া যাবে। কল্পনা বলে : তারপরে আর কি, তালিকার ছটা আইটেমের মধ্যে যেগুলো বেশ ব্যয়সাধ্য সেগুলো হেঁটে বাদ দিলেই হবে। তখন খুব সহজেই আমাদের দেবার জিনিস আমরা বেছে নিতে পারবো।

যেমন ধরা যাক— আবার আমার উদাহরণের প্রতি টান : আমাদের মামাবাবু চান–

১। ল্যান্ড মাস্টার গাড়ি,

২। বিমানপথে ভূ-ভারত-ভ্রমণ,

৩। বালিগঞ্জে বাড়ি,

৪। বাঘ শিকার করতে,

৫। কোনো বিশেষ চিত্রতারকার সৌখ্য, এবং ৬। ভালো এক কৌটো সিগ্রেট, তাহলে তিনি খালি সিগ্রেটই উপহার পাবেন। কেমন, এই তো?

ঠিক তাই। তালিকার কোথাও না কোথাও তার মনের তাল পাওয়া যাবেই। যে তাল আমাদের মনের মানের সঙ্গে খাপ খাবে।

কনার ইচ্ছামতো, অভিলাষ-আসর জমানো গেল। তালিকাও পাওয়া গেল যথারীতি। কিন্তু পেয়ে দেখা গেল, না পেলেই ছিল ভালো! আমাদের আত্মীয়দের উচ্চাকাঙ্ক্ষা কাঞ্চনজঙ্ঘাকেও হার মানায়। মানুষকে আত্মহারা করে দেয়। মুক্তকচ্ছ করে মহাপ্রস্থানের পথে টানতে থাকে।

মঞ্জু, তার ইচ্ছা-তালিকায় চেয়েছে দেখলাম—এক, একখানা বাড়ি; সিমলাশৈলে হলেই ভালো হয়, নেহাতপক্ষে সিমলা স্ট্রিটে হলেও ক্ষতি নেই; দুই, অভিনেত্রী জীবন (বলাবাহুল্য, চিত্রনায়িকারূপে); তিন, কাশ্মীর বেড়ানো; চার, লাখখানেক টাকা (অনেক কমসম করেই); পাঁচ, নতুন ডিজাইনের ডজন খানেক শাড়ি; আর ছ নম্বরে, দেশবিখ্যাত স্বামী।

তালিকাটি আগাগোড়া চষে গেলাম—ওর কটুকষায় উপসমাপ্তি অবধি। ওর শেষ প্রার্থনাটা আমার দ্বারা পূর্ণ হবার নয়। খোঁচাটা লাগলো। কিন্তু আমার অভাবে, ওর এই অপূরণীয় ক্ষতি কোনোদিন পূর্ণ হবে কিনা কে জানে।

সিল্কের রুমাল। সাব্যস্ত করল কল্পনা।

সিল্কের রুমালের কথা কোথাও কিন্তু নেই ওর। আমি আপত্তি করি।

তাই চেয়েছে পাকে প্রকারে। কল্পনা গর্জে ওঠে: ওকরম চালচলনে সিল্কের রুমাল হলে মানায় না। উঁচু নজরটা দেখেছ?

আহা, তোমারই তো বোন— আমি বলতে যাই।

আমাদের আজে-বাজে স্বামী হলে চলে যায়, আর ওর চাই কি না— কল্পনা গজরাতে থাকে।

সত্যি। সন্দেশ-বিখ্যাত স্বামী চাইলেও না হয় একটা গতি করতে পারা যেত। কিন্তু ভীম নাগও এহেন নাগিনীর বিষাক্ত নিঃশ্বাসের আওতায় আসতে চাইবেন কি না ভাবতে গিয়ে আমায় থামতে হয়।

আমাদের মামাবাবুর চাহিদাটা একটু রাজনৈতিক। তিনি কলকাতার মেয়র হতে চেয়েছেন। মন্ত্রীমণ্ডলীর মধ্যে একজন হতেও তার অনিচ্ছা নেই। ওই দুইয়ের একটাও যদি ঘটে যায় তাহলে কলকাতায় বাড়ি পাবার আকাঙ্ক্ষাকে তিনি তিন নম্বরের মধ্যে আনতেই রাজি নন; কেননা পূর্বোক্তরূপ বাড়াবাড়ি তার ভাগ্যে ঘটলে ঘরবাড়ি ইত্যাদি অবলীলাক্রমে আপনা থেকেই এসে যাবে। চতুর্থতঃ, রাজপ্রমুখ উপাধি লাভ করা। রাজত্ব থাকলে যে রাজপ্রমুখহওয়া যায় না একথা মানতে তিনি নারাজ। পঞ্চমত, বাংলাদেশের মুখ্যমন্ত্রী হওয়া, নিতান্ত না হতে পারলে তার বদলে—সেইটাই তাঁর শেষ ইচ্ছা—খাদ্য মন্ত্রীর দপ্তরে কোনো পদ (সেজন্য যেকোনো অপদস্থতা মেনে নিতে প্রস্তুত আছেন)।

তাঁকে এক কৌটো সিগ্রেট দিলেই হবে, আমরা বিবেচনা করে দেখলুম। কেননা যন্দুর অবধি দৃষ্টি যায়, তাঁর রাজনৈতিক জীবন ধোঁয়াতেই পরিসমাপ্ত হতে বাধ্য, দেখা গেল।

সৌম্য চেয়েছে (১) একটা মোটর সাইকেল, (২) কোডাকের ক্যামেরা, (৩) রাণিং শু, (৪) সাঁতার কাটবার নিজস্ব একটা পুকুর, (৫) একখানা ভালো ডিটেকটিভ বই, (৬) আস্ত একটা এরোপ্লেন।

ওর ইচ্ছামত, একখানা গোয়েন্দাকাহিনী ওকে দিতে আমাদের বিন্দুমাত্র দ্বিধা হোলো না। ব্ল্যাক গার্লস সার্চ ফর গডবার্নার্ড শর সেই বইখানা পড়ে ছিল—দিয়ে দেয়া গেল।

রঞ্জনের অভিলাষ একটু বিচিত্র রকমের। বন্দুক, পিস্তল, রিভলবার, হাতবোমা ইত্যাদি মারাত্মক যত অস্ত্রশস্ত্রেই তার অভিরুচি।

এছাড়াও বঞ্জনের একটা পুনশ্চ ছিলো, একশো গজ লাল রঙের শালু, কেন যে তা কে জানে। তার এই লালসার মধ্যে একটু কমরেড-কমরেড-গন্ধ মিলতে লাগল। লাল নিশান উড়িয়ে কেরলের দিকে ধাওয়া করবে কি না ওই জানে। আন্দাজটা ব্যক্ত করলাম।

কিন্তু এই বাজারে একখানা রুমাল কেনা দায়, কালোবাজারে আর লালবাজারে রেষারেষি,–এর মাঝে শালু আমি পাই কোথায়?

তাও আবার একশো গজ। কল্পনা মুখ বাঁকালো।

একশো গজের কথা থাক, একটা ইঁদুরের পরবার মতো কাপড় কেনার পয়সা জোটে। আমি বল্লাম : অবশ্যি এক কাজ করলে হয়। ওর বিয়ের ব্যবস্থা করতে হয়। আমাদের মঞ্জুর সঙ্গেই–

আর মঞ্জুকে একটা শালুর ব্লাউজ দিলেই চলে যাবে।

কল্পনাই উভয় সঙ্কটের সমাধান করে দেয়।

লাল শালুর ব্লাউজ। এক গজেই হবে তো? সায় দিই আমি? তাহলে একরকম একশ গজই দেয়া হবে। মঞ্জু আমাদের একাই একশ।

০২.

ভালোবাসিলে ভালো যারে বাসিতে হয়, সে যেন পারে ভালোবাসিতে… নিজমনেই গুনগুন করছিলাম।

বৃন্দাবনে কুরুক্ষেত্র কিম্বা কুরুক্ষেত্রে বৃন্দাবন, চুলচেরা বিচারে বলা কঠিন, কিন্তু তাহলেও অঘটনটার ল্যাজামুড়ো মিলিয়ে সম্রাট শালীবাহনের তেমন ভালো লাগবার কথা নয়। এবং লাগছিলও না। সে যুগের সম্রাট এ-অবস্থায় পড়লে কী করতেন কে জানে, কিন্তু একালে তার দরাজ সংস্করণ হয়েও এই লঘুভার বহনে যেন আমার ঘাড় ভাঙছিল। সত্যি, ব্যাপারটা যেন সহনশক্তির এলাকা ছাড়িয়ে যায়…

শাখা-প্রশাখা পত্র-পল্লব সব নিয়ে নিজগুণেই মর্মরিত হচ্ছি…..

এমন সময়ে সেই গুঞ্জরণের মাঝখানে কল্পনা হাওয়ার মতই বয়ে এলো।

দ্যাখো, এই ব্যাপারটায় আমিও ভারী অবাক হয়েছি। ব্যাজ-আঁটা সেই গোঁফালো অফিসারটির মোটর সাতদিনের মধ্যে চারবার আমাদেরই দোরগোড়ায় এসে বেগডালে, এটা যেন একটু কেমন-কেমন না? তুমি কী বলে? কল্পনার কপালে একাধিক রেখা পড়তে দেখা যায়।

আমি আবার কী বলব। তিক্তকণ্ঠে আমি বলি, কালকে লেকের ধারে বেড়াবার সময় দেখলে না? মাটি খুঁড়ে কোথাথেকে রেগুলার একদল কুচকাওয়াজ বেরিয়ে পড়লোদ্যাখোনি?

দেখেছি। কল্পনা একটু মুচকি হাসে: তা—শোনা আমাদেব তো দেখতে মন্দ নয়।

বা রে! দেখতে কেউ অমন্দ হলেই বুঝি আপামব সবাই বিশ্বগ্রাসী দৃষ্টি মেলে তাকে গিলতে থাকবে? বেশ কথা আর কি! লক্ষ্য কবে দেখলে এর চেয়ে অশোভন দৃশ্য আর কিছুই হতে পারে না। বিশেষ কবে শোভনা আমার শালী বলে তার বেলায় একথা তো আমি ভাবতেই পারি না। কেমন যেন শালীনতায় বাধে! ওকে দেখবার ভাব—যদি দেখতেই হয়—আপাততঃ তা কেবল আমার একলারই থাকা উচিত। স্পষ্টবাক্যে এই কথা ওঁর কাছে ব্যক্ত করব কি না ভাবছি, উনি আমার চিন্তাধারায় বাধা দিলেন—আমি মেসোমশায়ের কথাই ভাবছি।

হ্যাঁ, সে-ই আরেক ভাবনা! সে দিকটাও ভাবতে হয় বইকি। শশাভনার বাবা, জনৈক বাঙালী মেজর, যুদ্ধের উদ্দেশ্যে নিরুদ্দেশে যাবার আগে শোভনাকে আমাদের হাতে সঁপে দিয়ে গেছেন। ভেবে দেখলে কতো বড়ো দায় আমার ঘাড়ে। আমার—আমার না হোক, কল্পনারই হলো—আমার সেই কাল্পনিক মেসোমশাই আঁর পরম স্নেহের একমাত্র কন্যারত্নকে—মাতৃহীনা (এবং কে জানে, এতদিনে পিতৃহারাও কি না!) মেয়েটিকে আমাদের কাছে গচ্ছিত রেখে গেছেন—আর এদিকে তাঁর আদরের দুলালী তাঁর মেজর-শিকেও টেক্কা মেরে সারা সৈন্যবাহিনীর মেয়ে-কম্যাণ্ডার হতে চলেছে। রীতিমতো কুইকমার্চ করেই চলেছে বলা চলে।

এখন আমার মুনে পড়ে। শোভনাকে রেখে যাবার সময় কী যেন তিনি বিশেষ কবে বলতে চেয়েছিলেন। কী যেন একটা কখা বলি-বলি করেও বলতে পারছিলেন না।

আত্মজার জন্যে পিতৃসুলভ উৎকণ্ঠা অনুমান করে আমি তাকে অভয়-দানের চেষ্টা করেছি।

বলতে গেছি আমাদের দিক দিয়ে এবং আমোদের দিক দিয়ে কোনো কিছুর অভাব ঘটতে দেব না।

না, না, ভয়ের কিছু নেই, তেমন ভয়ের কিছু না–বলে উঠেছেন তিনি—তবে মেজরের মেয়ে কি না, এই যা।

এই কথা বলে একটা কথা যেন তিনি চেপে গেলেন বলেই আমার মনে হয়েছিল তখন। এখন দেখছি সেই এক কথার মধ্যেই সমস্ত কথা তিনি খোলসা করে বলে গেছেন। মেজরের মেয়ে—এই একটি কথাই খুব লাখ কথার এক কথা। মেজরের মেয়েকে আপাতদর্শনে মেজার করা যায় না।

এবং মেজরের মেয়ের কাছে থাকা যে যুদ্ধের কাছাকাছি থাকা, একথাই বা কে তখন ভাবতে পেরেছিলো? কিন্তু ভ্রমেও না ভাবলেও ক্রমেই তা অভাবিতভাবে প্রত্যক্ষ হতে লাগলো।

এই শহরেই কোথাও একটা ট্রেনিং ক্যাম্প খোলা হয়েছে শুনেছিলাম। ঐ ক্যাপের হবু (এবং গবু) সৈন্যবাহিনীর তিনশো পঁয়তাল্লিশ জনের ভেতরে তিনশো তেতাল্লিশ জনাই তামাদের শোনাকে জানে একথা জানা ছিল না। ক্রমশঃ জানা গেল।

তোমার মেসোমশাই কেন যে এই জাঁদরেল মেয়েটিকে এখানে ছেড়ে গেলেন এখন টেব পাচ্ছি। কল্পনাকে আমি জানাই আমাদের হোম্ ফ্রন্টু সামলানোর জন্যেই, বোঝা যাচ্ছে এখন।

খুক করে একটু কেশে ড্রইংরুমের দ্বার ভেদ করতেই খসখসে আওয়াজ কানে এল। সামান্য তাড়াহুড়ার শব্দ! ঘরের ভেতর অকস্মাৎ কী যেন একটা ঘটে গেল। কিছু একটা ইতববিশেষ। একটু ইতস্ততি। সড়াৎ করে জানালা-পথে তীরবেগে কে যেন তরোহিত হয়ে গেল বলে মনে হয়।

চক্ষুকর্ণের ভ্রম হওয়াই সম্ভব। কেননা, দ্বারপথে যা ধারণা হয়েছিল আরেকটু ভ্রমণ করে ঘরের ভেতর এসে তার সমর্থনে কিছুই পেলাম না। সব দুই যথাযথ। অ্যাজ ইট ইজ। যেখানকার যা সেখানেই আছে। ওলোট-পালটের চিহ্নমাত্র নেই। শোভনা পিয়োনোর টুলে বসে একখানা গৎ বাজাচ্ছে—ঠিক বাজাচ্ছে না বাড়াতে যাচ্ছে। রবিবাবুর গান কিন্তু স্বরলিপির খাতাটা উলটো করে ধরা, এইটুকুই যা ব্যতিক্রম দেখা গেল। তার বাহাদুরি।

জানালা দিয়ে গেল—ওটা কে? আমি জিগেস করলাম।

বেড়াল। অম্লানমুখে ও জানায়।

তুমি আসবার পর থেকে এ বাড়িতে বেড়ালের উপদ্রবটা যেন বড্ড বেড়েছে মনে হয়।

আমাকে কি আপনি মৎস্যকন্যা বলে সন্দেহ করেন নাকি? শাণিত চাহনির সঙ্গে শোভনার শানানো জবাব।

না না, তা বলছিনে। তবে কি না— বলতে বলতে আমি স্পষ্টবক্তা হই: শোনা, তুমি এখনো মাইনর তা জানো? এখন আর ছোট্ট মেয়েটি নও।

কথাটা পরস্পর বিরোধী হোল বুঝতে পারি। কিন্তু রাগের ভাষা অনুরাগের ভাষণের মতই মুখর হয়ে উঠলে নিজের তালজ্ঞান হারায়। কী বলতে কী বলা হয়ে যায়। কিন্তু তাহলেও সতের বছরের মেয়েকে বালিকা বলতে পারি না, নাবালিকাই বলতে হয়।

আপনিই বা কী এমন মেজর যে গায়ে পড়ে উপদেশ দিতে এসেছেন? শোভনাও একদম অস্পষ্ট না।

আর যাই হই আমি তোমার মতো নাবালক নই এটা তো মানো? আর সাবালক মানেই তো মেজর।

মোট্টেই না। শোভনা এক ফুৎকারে আমার সমস্ত ওজোর উড়িয়ে দেয় : মোটেই আপনি মেজর নন্।

যুদ্ধে না গিয়েও, স্রেফ আঠারো বছরে পা দিয়ে–ঘরে বসে-শুয়ে ঘুমিয়ে শুদ্ধমাত্র এই পদার্পণের কৌশলেই যে বেমালুম মেজর হওয়া যায়, মেজরিটির এই ধারণা ও টলিয়ে দিতে চায়। ওর মতে, সামান্য পদাতিক হয়ে সৈন্যদলে ঢুকে, যুদ্ধে এবং বিনাযুদ্ধে, হাত-পা অটুট রেখে এবং নিজে বজায় থেকে, ক্রমাগত পদোন্নতির ফলে কদাচ যা লভ্য হয়—একটু আগে পদচারণার সাহায্যে গবাক্ষপথে সদ্যপলাতক তজ্জাতীয় তথাকথিত বেড়ালদের ভাগ্যেও যে সুদুর্লভ গৌরব দৈবাৎ কখনো শিকে ছিড়ে থাকে সেই মহামহিমাই, এক কথায়, মেজর। এবং তা কেবল তার বাবাই হতে পেরেছেন। এবং আমি কোনোদিন পারব না, একথাও মুক্তকণ্ঠে জানাতে সে কুণ্ঠিত নয়।

বেশ, মেজর আমি না-হয় নাই হলুম, তুমি যে মাইনর তার তো আর ভুল নেই। তোমার ভালমন্দের দায়িত্ব এখন আমাদের তো।

কক্ষনো না। মেজরের মেয়ে কক্ষনো মাইনর হতে পারে না।

ক্ষুধারকণ্ঠে ও বলে। সেই ধারালো ক্ষুরের সামনে গলা বাড়াবো—এমন সাহস আমার হয় না। দরজা দিয়ে গলে আসি ফের।

সেদিন বিকেলে ড্রইংরুমে বসে স্বরলিপির বইটার পা ওল্টাচ্ছি, এমন সময় শোভনা থাকি পরিচ্ছদের অন্তর্গত একটি ভাবী মেজরের সাথে ঘরের মধ্যে সঞ্চারিত হলো।

নমস্কার। আমাকে সম্মুখে দেখে সেই খাকি পরিচ্ছদ সশব্দে অ্যাটেন্ হয়ে দাঁড়ালেন।

ডিট্‌টো। শুকষ্ঠে প্রতিনমস্কার জানালাম।

এই, আজ্ঞে—আমার বিজাতীয় সম্ভাষণে যুবকটি যেন একটু দমেই গেল।—এধার দিয়ে যাচ্ছিলাম, শোভনা দেবী দয়া করে আমাকে চা-পানের জন্য ডাকলেন।

ইনি—ইনি হাবিলদার পট্টনায়ক। শোভনা দেবী দয়া করে সামরিক শোভাটির পরিচয় প্রদান করেন।

ও তাই নাকি? আমি ভয়ানক খুশি হয়ে উঠি: তোমাদের বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ হলে এত আনন্দ হয় আমার কী বলবো? আপনিই শ্রীমান পট্টনায়ক? আপনাদের অনেকগুলি নায়কের সঙ্গেই ইতিমধ্যে আমার জানালোনা হয়েছে—অবশ্যি, আপনাদের শ্ৰীমতী শোভনা দেবীর সৌজন্যেই-বলাই বাহুল্য। এই যেমন, মিঃ চট্টরাজ, ক্যাপটেন চাই, কর্ণেল খোন্দকার, শ্ৰীযুত বাজপেয়ী কিম্বা বাজপাই যাই বলুন-লেফটেনেন্ট লাট্ট নারায়ণ—সিপাহি বিল সিং তেওয়ারি—ইত্যাদি ইত্যাদি। সত্যি, এমন প্লিজিং কোম্পানি কী বলবযারপরনাই।

আঁ—আজ্ঞে—? বেচারী থতমত খায়। আহত নেত্রে শোনার দিকে চেয়ে থাকে। আর শোভনা? শোভনার দিকে আমি চাইতেই পারি না। মেজর শোভার দুচোখে দুই বেয়নেট।

আমি—আমি তাহলে এখন আসি। ঢোক গিলে যুবকটি বলে।

না না, এখনই যাবেন কী? আমি আরো উৎসাহিত হই : এখনো তো চারটে বাজেনি। চারটের মধ্যেই আপনার সহযোগীদের সবার দেখা পাবেন—এখানেই পাবেন। মিষ্টার বেঙ্কটরম, মিষ্টার ভেঙ্কটল্লা এবং মিঃ বালাজী বাজীরাও—ঐতিহাসিক ক্রমানুগতিতে নম্বর তিন কি চার কী হবেন তা বলতে পারব না—একে একে সবাই আসবেন। তৃতীয় বালাজী বাজীরাও তো চারটে বাজলেই চায়ের ঝোঁকে এসে পড়েন।

পট্টনায়ক কী যেন বলবার চেষ্টা করেন, তাঁর গলার ভেতর ঘড়ঘড় করে ওঠে-ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চারটে বাজতে দেড় মিনিট দেরি আছে টের পান-তখন, সেই ঘর্ঘর-ধ্বনির সাথেই দ্রুত বিদায়বাণী উচ্চারণ করে—শুভসন্ধ্যা জানিয়ে—-তিনটে সোফা টপকে—পরপর পার হয়ে——টিপয় টেবিল দেরাজ পরম্পরা জানালার ধারে গিয়ে পৌঁছন। তারপরে আর একটুও ইতস্ততঃ না করে বেড়ালদের যাতায়াতের সেই রাজপথকেই সোজাপথ ভেবে তার ফাঁক দিয়ে এক লাফে নেপথ্যে অন্তর্হিত হন। এক মুহূর্ত আর দাঁড়ান না।…

আজকের গাড়িতেই আমরা কলকাতা ছাড়চি। কল্পনাকে গিয়ে বললাম।

আঁ? সে চমকে ওঠে।

হ্যাঁ। না গেলে কী সর্বনাশ হবে তার কিছু তুমি বুঝতে পারছো? এহেন সামরিক আবহাওয়ায়–এই যুদ্ধকালীন কলকাতায় শোতনাকে রাখার মত বিপজ্জনক আর কিছু হতে পারে না। এই ছোঁয়াচে আওতা থেকে দূরে নিয়ে ওকে বাঁচাতে হবে। ভেবে দ্যাখো—পরের কন্যাদায় আমরা নিজের ঘাড়ে নিয়েছি।

কিন্তু যাবো কোথায়? কল্পনা জিজ্ঞেস করে।

সুদূর কোনো গণ্ডগ্রামে। কেন, মাটিয়ারিতে গেলে কেমন হয়?

মাটিয়ারি?

মাটিয়ারির নামে কল্পনা কেঁপে ওঠে—তার কল্পনাও বুঝি ছাড়িয়ে যায়। এক বন্ধুর আমন্ত্রণে একবার সেখানে আমরা গেলাম। গণ্ডগ্রামের মধ্যে অপোগণ্ড যদি কিছু থাকে তো সে মাটিয়ারি। গণ্ডগোলের গ-পযও নাস্তি! মানুষ এবং অমানুষ-মোট জড়িয়ে সেখানে মাটি ছাড়া আর কিছুই নেই। জনপ্রাণী কাউকে প্রাণীজন বলে বোধ হয় না। জীবনের লক্ষণ কেবল দুটি দেখেছিলাম সেখানে—মহাস্থবির হাড়পাঁজরা-সার ঝরঝরে গাঁয়ের গা ঘেঁসে ঝিরঝিরে এক নদী—আর–আরেকজন—লঝঝড় এক ডাকহরকরা। এই দুইজনাই প্রাণের চাঞ্চল্য পরিস্ফুট করতে যা একটু ছুটোছুটি করত—এছাড়া আর কোথাও একটুখানি বাড়াবাড়ি ছিল না।

মাটিয়ারিতে এসে দিন সাতেক শোভনা মনমরা হয়ে থাকলো। অতগুলো ভাব মাটি করে—অমন মহা মহা প্রাদুর্ভাবের মহামারি থেকে এখানকার একঘেয়ে আড়ির মধ্যে এসে—মন ভারী হওয়া বিচিত্র নয়। কিন্তু ক্রমেই ওর আগ্রহ দেখা দিলো—ফেরারী উৎসাহ যেন ফিরে এলো আবার। মাটিয়ারি গ্রামের তৃতীয় জীবনের লক্ষণ আমরা প্রত্যক্ষ করলাম।

এমনকি, একদিন সে মুখ ফুটে বলেই ফেলল? নাঃ, জায়গাটা তত খারাপ না। যতটা মনে হয়েছিলো তা নয়। এমন স্থানেরও সম্ভাবনা আছে। বেশ সম্ভবনা আছে।

পার্বত্য ত্রিপুরার কুক্ষিগত এই দ্বিতীয় এবং অদ্বিতীয়) শান্তিনিকেতনের আবার কী সম্ভাবনা সে দেখেছে সেই জানে! নৈঋত কোণ অবধি চারধার বেশ করে খুঁটিয়ে দেখেও অশান্তির কোনো খুঁটিনাটি আমার নজরে পড়লো না।

যাক তবু যে এখানকার মাটিতে ওর মন বসেছে সেই ঢের। বনহরিণীসুলভ ওর মনোহারিণী লীলা আবার আমাদের চোখে পড়ছে, এই আমাদের সৌভাগ্য।

বিধি ডাগর আঁখি
যদি দিয়েছিলো
সে কি আমার পানে
ভুলে পড়িবে না?…

সেদিনকার স্বরলিপির পাতায় দেখা গানের এই কলিটা নিজের মনে গুন গুনিয়ে গাঁয়ের পথে বেরিয়ে পড়লাম…।

পোষ্টাফিসের অভিসারেই বেরিয়েছিলাম…

পোষ্টাফিসের নামান্তর-স্থানীয় মুদি ওরফে পোষ্টমাষ্টারের ভাঙা কেরোসিন কাঠের বাক্স থেকে হাতড়ে মাতড়ে যদি পাওয়া যায়—তেলচটা একখানা পোষ্টকার্ড বাগিয়ে আনার চেষ্টা করব।

পোক্টমাষ্টারের দাঁড়িপাল্লায় শোভমান খর্বাকার একটা খবরের কাগজ দেখা গেল—ত্রিপুরা-বার্তাবহ না কি! এই আকারের একখানা শোভনার হাতেও কালকে না কবে যেন দেখেছিলাম মনে হচ্ছে। আরো দেখলাম—কৌতূহল চরিতার্থ করতে গিয়ে আরো দ্রষ্টব্য দেখা দিলো—উক্ত সাপ্তাহিকের এক কোণে-বড় বড় না হলেও মেজ মেজ হরফে ছাপা রয়েছে—একটি ইস্তাহার!…

বিশেষ সংবাদ। ভারতবর্ষের সবকয়টি ট্রেনিং ক্যাপের সামরিক রিকুটেরা আগামী সপ্তাহে আমাদের পার্বত্য ত্রিপুরায় সম্মিলিত হইতেছেন। শান্তিপূর্ণ মাটিয়ারি অঞ্চলেই তাঁহাদের ছাউনি পড়িবে…

০৩.

কল্পনা টেলিগ্রামের থেকে চোখ তুলে আমার মুখে তাকালো এবং আমার থেকে চোখ নামিয়ে ফের টেলিগ্রামের দিকে।

এক্ষুনি চলে এসো—পিসিমা। বিড় বিড় করলো সেঃ পিসিমা কেন ডেকেছেন আঁচ পাচ্ছে কিছু?

বিশেষ করে ভেবে অবশেষে আমি বলি, গম্ভীর মুখেই বলি—আমার যা মনে হয়—হয়তো খুব অদ্ভুত শোনাবে, তবু এরমকটাও হওয়া সম্ভব—এর মানে হচ্ছে, চলে এসো চটপট। তাই কী?

তোমার মুণ্ডু! কল্পনার মুখঝামটা শোনা যায়? পিসীমার ভালোমন্দ কিছু হওয়া তো সম্ভব নয়—কী বলে?

এক হিসেবে সেকথা সত্যি। শ্রীশ্রীপিসীমা ভালোমন্দের অতীত। অপর পক্ষে, যাঁরা নিরপেক্ষ বিচারক তাঁদের মতে পিসীমার ভালো কিছুই নেই-হতেও পারে না; বরং মন্দ বলতে যাকিছু আছে সমস্তই তাতে বর্তমান। এবং আরো আরো বহুৎ মন্দ তাঁর আবশ্যম্ভাবী। অবশ্যি, এটা দৃষ্টিভঙ্গির তারতম্য মাত্র।

কী করবে ভাবছো? কল্পনা জিজ্ঞেস করে। —যাবে?

ক্ষেপেছো! এই দারুণ বর্ষায় শিলং-এর কথা ভাবতেই আমার হৃৎকম্প হচ্ছে—সেখানে না গিয়েই। ওকথা ভুলে যাও।

এবং আমরা ভুলে গেলাম। সন্ধ্যে পর্যন্তই। ইতিমধ্যে বাংলা মুলুকের টেলিগ্রাফের তার আরেকবার মোড খেয়েছে—আর তার আর্তনাদ আরেকটি খাকি রঙের খামে সন্ধ্যের মুখে আমাদের শান্তিকুঞ্জে ভেসে এসেছে।

জবাব নেই কেন দাঁড়ি চলে এসো এক্ষুনি দাড়ি নাটকটা এনো দাঁড়ি জরুরী পিসিমা। এতগুলি দাঁডি তারবার্তা থেকে পাওয়া গেল—পিসিমার তারস্বরের সঙ্গে। হাতে স্বর্গ পাওয়ার মতই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পেলাম।

ওঃ! চেঁচিয়ে ওঠে কল্পনা : তাই তো! ঠিকই তো!

য়্যাঁহ?

পিসিমার বিখ্যাত লোকদের সঙ্গে মেলামেশার চিরকেলে বাতিক, ভুলে গেছ? সে মনে করিয়ে দেয়ঃ বোঝা যাচ্ছে, পিসিমার বাড়িতে—মানে, পিসিমা সম্প্রতি কোনো পায়াভারী কাউকে—মানে হোমরা চোমরা কেউ সেখানে অতিথি হয়ে এসেছেন।

এসেছেন তো কী হলো?

কল্পনা আমাকে ঘরের মধ্যে ঠেলে দেয় : বোকো না, যাও। জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও গে। নাটকটাও নিয়ে। পিসিমা, কোনো থিয়েটারওয়ালা কি ফি-ডিরেক্টর কাউকে গেরেপ্তার করেছেন, টের পাচ্ছো না?

আমি লাফিয়ে উঠলাম তৎক্ষণাৎ। এরকমটা হলে অবশ্যি আলাদা কথা—এবং তাহলে এপর্যন্ত পিসিমা সম্বন্ধে যা বক্রোক্তি করেছি তার প্রত্যেকটি কথা প্রত্যাহার করতে আমি প্রস্তুত। পিসিমা যদি কল-কৌশলে কোনো হোমরা চোমরাকে পাকডে আমার নাট্যকারু সম্পর্কে থিয়েটার ও সিনেমাজগতের এতাবৎ শোচনীয় মন্তব্য পালটে দিতে পারেন, তাহলে এত খরচ করে কষ্ট স্বীকার করে শিলং যাওয়ার মজুরি পুষিয়ে যায়—নিঃসন্দেহেই।

শিলংয়ের সুশোভন দৃশ্যপট দেখতে দেখতে বিকেল নাগাদ তো পিসিমার আবাসে পোঁছানো গেল। দরজায় পোঁছে, নিজেদের আমরা টান করে নিলাম, কৃষ্টিসুলভ দৃষ্টি এবং কৃচ্ছসাধ্য উজ্জ্বল এক প্রস্থ হাসি উভয়ের মুখে জোর করে ফুটিয়ে তুললাম। বৈকালিক। চা-পানে নিযুক্ত হোমরাও চোমরাও লোকের সামনে ঝোড়ো কাকের মত অনাথ আতুররূপে উপস্থিত হয়ে তো কোনো লাভ নেই।

কিন্তু হোমরাও চোমরাও কেউ ছিল না সেখানে। আরো খারাপ, চায়ের কোনো ব্যবস্থাও। তবু পিসিমা সেখানে ছিলেন। এবং দর্শনমাত্র প্রথম কথাই তিনি পাড়লেন?

নাটকটা এনেছো?

নিশ্চয়, কিন্তু কোথায় তোমার—

পড়ো, শুনি আগাগোড়া। হুকুম হোলো তার।–পড়ে শোনাও আগে।

অগত্যা, আমি পড়ে গেলুম-মায়, প্রস্তাবনা সমেত তিন অঙ্কে সম্পূর্ণ, অসংখ্য দৃশ্য-উপদৃশ্যে বিভক্ত, পেল্লায় নাটকটা এক নিঃশ্বাসে আগাগোড়া পড়ে যেতে হলো।

বইটা পড়বার সময়ে দু একটা চাপা হাসি আমার কানে এসেছিল—পিসিমার হাসিই-তৎক্ষণাৎ আমি চোখ তুলে তাকিয়েছি। কিন্তু পিসিমার বক্র হাস্য নজরে ঠেকতেই ব্রীড়ায় চোখ নামিয়ে নিতে হয়েছে।

অবশেষে নাটকের যবনিকা পড়লো। কষ্টদায়ক একটা থমথমে ভাব বিরাজ করতে থাকলো ঘরের মধ্যে। এই নিস্তব্ধতা স্বভাবতই যে কোনো নাট্যকারের পক্ষে নিরুৎসাহজনক।

আমি ভেবেছিলাম নাটকটা খুব গুরুগম্ভীর হবে। পিসিমাই স্তব্ধতা ভাঙলেন? আদর্শমূলক কিছু হবে। তা নয়। নেহাতই হালকা ব্যাপার।

আমি ইচ্ছে করেই এটা হাস্যকর করেছি। বললাম আমি : যাতে মানুষ তার এত দুঃখের মধ্যেও একটু হাসতে পায়, হালকা হতে পারে, স্ফূর্তি পায় খানিক—সেই জন্যেই।

তাতে লাভ?

মনের আনন্দে লিখেছি—অপরকে আনন্দ দেবার জন্যেই! লাভালাভ খতিয়ে টাকার জন্য লেখা নয়তো।

সেকথা ভালো।

পিসীমার কণ্ঠস্বরে এবার যেন একটু আশ্বাস মিললো। মনে হোলো বইটা নিতান্তই ব্যর্থ হবে না। বাংলার সুরুচিসম্মত আর কৃষ্টিসম্পন্ন দর্শকদের পাতে পড়বে হয়ত বা। এবং অর্থভাগ্য তেমন যদি নাও থাকে, যশের ভাগ জুটলেই আমার যথেষ্ট।

টাকা না পাই না পাবো। আমার নাম হলেই হলো। বললাম পিসিমাকে।

হতে পারত নাম, কিন্তু হালকা জিনিস হয়েই মাটি করেছে। বললেন পিসিমা প্রথমতঃ, এর ইংরিজি অনুবাদ করা, শক্ত হবে,

কেন, অনুবাদ আবার কিসের জন্যে?

সৈন্যদের জন্যই। সম্প্রতি এখানে-আসা আমেরিকান সৈন্যদের আমোদিত করার জন্য স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়ে একটা ছোটখাট অভিনয়ের আয়োজন করেছি, বলিনি তোমায়?

না তো? আমি আকাশ থেকে পড়লাম—একেবারে হতাশ হয়ে।

বলবার সময় পেলাম কই? তোমরা আসা অবধি তো বসে বসে এই ছাই পাশ শুনছি। এর মধ্যে ফাঁক পেয়েছি বলবার? উলটে পিসিমারই অভিযোগ শুনতে হলো।

নাট্যকার-জীবনে এহেন কঠোর সমালোচনা অলভ্য নয়, ঘরে-বাইরে চার ধার থেকে কতোই শুনতে হয়েছে, নাটকের প্রতি আঘাত নিজের প্রতি আঘাত বিবেচনা করলেও একেবারে ভেঙে পড়লাম না। কেবল নাট্যকারেরাই এই অদ্ভুত ক্ষমতা রাখে—ভেঙে না পড়বার ক্ষমতা। তাহলেও বেশ একটু মচকে যেতে হলো? তা হলে তুমি বলছো সৈন্যদের জন্য এটা চলতে পারে?

সৈন্য সৈন্যই সই। যেখানে হোক, যেকেউ হোক—আমেরিকান, চীনেম্যান, নিগ্রো যেই হোক, কারো না কারো চক্ষুকর্ণে এই পরমাশ্চর্য জিনিস লাগুক এই আমার আকাঙ্ক্ষা।

ভেবে দেখি। আমার ধারণা ছিল আদর্শমূলক হবে তোমার বইটা—যার ছত্রে ছত্রে ভারতের নিজস্ব ভাবধারা তর তর বেগে বয়ে গেছে—এমন কিছু। বিদেশী সৈনিকদের কাছে তা ছাড়া কী আমরা দেখাতে পারি? আমাদের কাছে আর কী পাবার ওরা প্রত্যাশা রাখে?

বেশ, আমি এটাকে শুধবে গুরুগম্ভীর বানিয়ে দিচ্ছি। ভারতেব যত মৌলিক ভাবধারা এনে ফেলব—একেবারে মূল উপড়ে যার মূল্য হয় না। উপনিষয়ে থেকেও হ্যাচকা টান দেব, রবীন্দ্রনাথ এবং গান্ধীর থেকেও নেব কিছু। তারপর আমাদের বিবেকানন্দ তো পড়েই আছেন। সবার নিয়ে, সব মিলিয়ে একটা জগা-খিচুড়ি পাকাতে কতক্ষণ? তবে আমাকে সময় দিতে হবে। এটা লিখতে ছ হপ্তা লেগেছিল; মাস খানেক অন্ততঃ দিতে হবে আমায়। তবে লেখার সঙ্গে সঙ্গেই তুমি অনুবাদ করে যেতে পারো।

পাগল! তা হয় না। অত সময় হাতে নেই। আমেরিকান সৈন্যরা কি তোমার নাটকের জন্যে বসে থাকবে এখানে? তারা সবে এসেছে কয়েকদিন থেকেই কোথায় ফের চলে যাবে, তার কিছু ঠিক নেই। কাল থেকেই আমাদের রিহার্সাল শুরু।

তাহলে জানাশোনার মধ্যে যে সব মারাত্মক নাটক রয়েছে বঙ্গে বগী কি চন্দ্রগুপ্ত কি মিসরকুমারী—ওরই একটা নিয়ে লাগিয়ে দাওনা?

অসম্ভব। সত্যিকারের লেখকরা বইয়ের অভিনয়ের জন্য টাকা চেয়ে থাকে—তাদের রয়্যাটি দিতে হয়। পিসিমা দ্বিতীয়বার আমার হৃদয়ে আঘাত হানলেন।

সৈন্যদের জন্যেই হবে যদি গ্যারান্টি দাও তাহলে হয়তো না চাইতেও পারে।

আমি কিছু গ্যারান্টি দিতে রাজি নই। দাঁড়াও না, আগে তো পার্টগুলো কাকে কী দেয়া যায় ঠিক হোক। তারপরেই টের পাবে।

পরদিন প্রভাতে স্থানীয় অভিনয় শিল্পীরা পিসিমার কুটিরে সমবেত হলেন। যে সময়ে নেপথ্যে দাঁড়িয়ে নাট্যকার-সুলভ লজ্জায় আমি লাল হয়ে উঠছি, পিসিমা তাদের কাছে। আমার নাটকটির পরিশ্ম দিতে লেগেছেন। বইটার অখাদ্যতার জন্য যথেষ্ট মার্জনা ভিক্ষা করে অবশেষে বললেনঃ নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। এইটেকেই কোনো রকমে কেটে-হেঁটে খাড়া করতে হবে। নাট্যকার বলেছেন নিজেই সেসব ঠিক-ঠাক করে দেবেন—আজে বাজে সবকিছু বাদ দেবার সাথে সাথে একটা আদর্শমূলক মতবাদও এনে ফেলবে ভরসা দিয়েছেন।

তারপর পিসিমা–তাঁর স্বভাবসুলভ দক্ষতায়–নিজেকেই প্রযোজক, রঙ্গমঞ্চেব কর্তা, অভিনয়-শিক্ষক, সর্বাধ্যক্ষ এবং কার্যকরী-সমিতি নিযুক্ত করে স্বয়ং একাধারে সমস্ত হয়ে উপস্থিত প্রতিভাদের ভেতর থেকে অভিনেতা নির্বাচনে অগ্রসর হলেন।

সমস্তদিন ধরে বিদ্যুৎবেগে কাজ চলল। আমি বইটার হাস্যকর খোসালো অংশ বাদ দিয়ে জিনিসটাকে শাসালো করতে থাকি, পিসিমা সঙ্গে সঙ্গে বিলিতি বাক্যে রূপান্তরিত করেন আর কল্পনা তক্ষুনি তক্ষুনি টাইপ রাইটারে একসাথে একাধিক কপি বানিয়ে চলে। সন্ধ্যের মধ্যে সম্পূর্ণ বইটা দাঁড়িয়ে গেল——হাত-পা-মাথাকাটা কোমরভাঙা কোনো কিছুর পক্ষে যতটা দাঁড়ানো সম্ভব।

নাট্যকাররূপে আমার গৌরবলাভের আশা যখন রইল না, তখন অভিনেতারূপে চেষ্টা দেখলে কেমন হয়? অভিনয়ও আমি করতে পারি, আমার ধারণা ____ পাবেন। কিছু তাঁদের অসাধ্য নয়। আমি একবার এক নাট্যকারকে এক গ্রীনরুমে এক অভিনেত্রীর পা টিপতে দেখেছিলাম–সেটা তখন তিনি অভিনয়ই করছিলেন। কল্পনার কাছে থেকে একটা কপি হাতিয়ে নিয়ে এগিয়ে গেলাম আমি।

কী! মৎলব কী? জানতে চান পিসিমা।

আমি ভাবছি নায়কের ভূমিকাটা আমিই নেব।

অন্য কিছুর চেষ্টা দ্যাখো। বললেন পিসিমা। স্থানীয় লোকদের উৎসাহিত করাই আমার উদ্দেশ্য–নিজের ঘরের লোকদের না। এটাকে আমি আমার ঘরোয়া ব্যাপার বানাতে রাজি নই। তাছাড়া, তোমাকে সিনসিফটারের কাজে আমার দরকার।

এবারে আমি ভেঙে পড়লাম। নাটকের উরু ভেঙ্গেও আমার গুরুতর হানি হয়নি কিন্তু এবার—নাঃ, এই হচ্ছে উটের বোঝার ওপর খড়ের শেষ আঁটি–খরতর আঘাত। এবং নিজের পিসিমার নির্দয় হাত থেকে। ভাবতেও দুর্বিসহ। একবার এক অ্যামেচারী পালায় সিনসিফটার সেজেছিলাম, ও কাজ যে কতো ঝকমারির তা আমার অজানা না–কাজেই আবার সে পাল্লায় পড়তে হবে ভাবতেই আমি উটমুখো হয়ে উঠি।

আমাকে বাতিল করে দিয়ে পিসিমা স্থানীয় সজ্জনদের একজনকে জিজ্ঞেস করলেন : আপনি কোন্ পার্টটা নিতে চান বনমালীবাবু?

বিদূষক। বনমালীবাবু বললেন।

কিন্তু এ বইয়ে তো কোনো বিদূষক নেই। কাতরকণ্ঠে আমি প্রতিবাদ করি।

আমার বিদূষকের পার্ট আমার নিজেরই বানানো আছে। সগর্বে জানালেনবনমালীবাবু : মুখস্তই রয়েছে আমার। ইsটেজে দাঁড়িয়ে তাই গড় গড় করে আউড়ে যাব।

বেশ, বিদৃষকের পার্টই রইলো আপনার। প্রত্যেক দৃশ্যের আরম্ভে বিদূষক হয়ে আপনি সেইটে স্বগতোক্তি করবেন। ইংরেজিতে করবেন। ভালোই হবে বেশ। বললেন পিসিমা।

এবং তারপরে আরো ভালোও হলো, হতে থাকলো। অভিনেতাদের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে বইটাকে আরো যতদূর বেখাপ্পা করা যায় করা গেল। উচ্চাঙ্গের নাট্যকারিতা এবং সূক্ষ্ম কলাজ্ঞান নিয়ে এই আমাকেই করতে হলো সেই সব। কেবল বিদূষকই নয়, সকলের সখই মেটালাম। একজোড়া বাদশা-বেগমকেও ঝমঝমাঝম করে বইয়ের মধ্যে এনে ফেললাম। এবং সেই দ্বৈত সঙ্গীতেও কূল পাওয়া গেল না, চন্দ্রগুপ্ত থেকে চাণক্যের একটা দৃশ্যও টেনে আনতে হলো। নতুন ম্যারপ্যাচেই। (পিসিমা সকলের ঐক্য চান কি না! এবং) সেখানেই ফুরোলো না, একটি ছোট মেয়ের সুবিধার জন্য ছোটিসে দুনিয়ারে? বলে বেশ মোটাসোটা একটা হিন্দি গান ধরে পাকড়ে নিয়ে এসে নাটকের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো।

এবং ঠিক হলো সাদা বাংলাতে অভিনয় করাই সিধে হবে। বিদেশী সৈনিকরা যত বুঝতে পারবে না ততই বেশি আপ্যায়িত হবে, আর ততই আমাদের উচ্চ আদর্শ তাদের অভিভূত করবে। অতএব, সমস্ত বইটা আবার নতুন করে বাংলায় অনুবাদ করার ভার পড়লো আমার উপর।

করে দিলাম। অনুবাদ করতে গিয়ে আনকোরা আরেক নাটক হয়ে দাঁড়াল—তা হোক। এদেশী বেড়ালই কাবুলে বেড়াতে গেলে কাবুলিবেড়াল হয়ে যায়, তারপর ঘুরে ফিরে ফের বাংলায় এলে ম্যালেরিয়ায় ভুগে কাঠবেড়াল হয়ে পড়ে কে না জানে? নাটকের পরাকাষ্ঠা দেখে আমাকেও কাঠ হয়ে যেতে হলো।

তারপর কয়েকদিন ধরে রিহার্সাল চলবার পর কৃষ্ণকান্তি বাবু বললেনঃ আচ্ছা বইটা কোথায় আমরা ষ্টেজ করব, শুনি?

একটা কাজের কথাই তিনি বল্লেন, এতদিনে।

কেন, এখানকার টাউন হলে। বল্লেন পিসিমা। তাছাড়া আর কোথায় হবে?

তাহলে টাউন হলটা রিজার্ভ করে ফেলুন আগে। প্রত্যহই যেরকম সভা সমিতির হিড়িক চলেছে তাতে সহজে ও জায়গা খালি পাওয়া যায় না। একটা তারিখ নিয়ে রাখুন আগের থেকে।

আমি দেখলাম এই সুযোগ। সিনসিটারের দায় থেকে রেহাই পাবার এই যাক। অমনি বেঁকে দাঁড়ালাম: কবে তোমাদের টাউন হল পাওয়া যাবে তদ্দিন এখানে বসে থাকা আমার পক্ষে পোষাবে না। আমার অনেক কাজ কলকাতায়। জরুরী কাজ যত। এই শনিবারই আমায় যেতে হবে। বলে দিলাম পিসিমাকে।

তাহলে এই শুক্রবারটাই ঠিক করে ফ্যালো। যাও, এক্ষুনি টাউন হলের কর্তাদের সঙ্গে কথা কয়ে ঠিকঠাক করে এসো গে।

আমার ওপরেই পিসিমা ভার চাপান, বিশ্বের যত ভার—ভারবাহী এই একমাত্র কাঁধের ওপর।

কথা কইলাম গিয়ে। মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যানের সঙ্গেই কথা কইতে হলো। শুনতে না শুনতেই ভয়ঙ্কর ঘাড় নাড়তে লাগলেন তিনি।

অসম্ভব। একেবারে অসম্ভব। আমি ভারী দুঃখিত। এই শুক্রবার তো হয় না। শুক্রবার কেন, সারা সপ্তাহে এবং আগামী সপ্তাহেও একদিনের জন্যেও টাউন হল খালি নেই। এবং বলতে কি, সৈন্যরাই এই শুক্রবার ওটা নিয়ে রেখেছে।

বটে?

আমেরিকান সোলজারদের একদল ছেলে আমোদ প্রমোদের পক্ষপাতী। স্থানীয় লোকদের আনন্দ দেবার জন্যে আমেরিকান তামাসা বলে কী একটা পালা তারা দেখাবে। একটা খুব চটুল, হালকা, হাসির জিনিস–যদুর আমি টের পেয়েছি–

এবার আমার হাসি পায়। হাসি পায়। হাসি পায় সত্যিই। আমার প্রাক্তন নাটকের সমস্ত হাসি আমাকে পায়।

ভালো কথা, একটা কথা মনে পড়লো চেয়ারম্যানের চেহারা মুহূর্তের মধ্যে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে: আপনারাও সৈন্যদের আনন্দ দিতে চান, তাই বল্লেন না? ওরা আনন্দ চায় না। যথেষ্ট আনন্দেই আছে, তবে এই অভিনয়ের ব্যাপারে একজন ওস্তাদ লোকের দরকার ছিল ওদের, বলছিল ওরা। সেদিক দিয়ে সম্ভব হলে আপনি ওদের একটু সাহায্য করুন না? করবেন? আঃ, বড় খুশি হলুম। না, না, অভিনয় নয়, সে সব না, এই সিসিফারের কাজ শুধু। সামান্য কাজ, এমন কিছু কষ্টকর না, দুঃসাধ্যও নয়, কিন্তু এর জন্যে লোক পাওয়া মুস্কিল। কী বলে আপনাকে যে আমার কৃতজ্ঞতা জানাবো। আমার একান্ত আন্তরিক ধন্যবাদ।

০৪.

দশশালা বন্দোবস্তে বাংলাদেশের যে বেজায় ক্ষতি হয়েছে তা বুঝতে বেগ পেতে হয় না, আমার এক শালার ব্যবহারেই তা বোঝা যায়। শালা যে কী চীজ আমি তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। একজনের ধাক্কায় আমার একলার যা দুর্দশা করেছে তার পরিমাণকে দশগুণ বাড়িয়ে দশজনার পরিণাম খতিয়ে বার করা খুব কঠিন নয়। এমন কিছু শক্ত আঁক না।

তাহলে, গোড়া থেকেই শুরু করা যাক—

এই যে, সুচিত্র যে! এমন হঠাৎ?— আমার উচ্চস্বরে অভ্যর্থনা অথবা অভিযোগ, কী প্রকাশ পায় বলতে পারিনেঃ আপিসের ছুটি-টুটি না কি?

এই সকালে আর এমন অকালে বিনা নোটিশে সুচিত্রব আবির্ভাব আমার বিচিত্র বলেই মনে হয়।

ওর আসা-যাওয়া, প্রায় ধূমকেতুর মতই, এতই কখনো কদাচ যে, কল্পনাকেও একটু ভাবিত না করে পারে না।

বাড়ির খবর সব ভালো তো দাদা? জিজ্ঞেস করে ও।

বাড়ি? বাড়ির খবর? যদুর ভাল হতে হয়। সুচিত্রব একমুখ উত্তর : সত্যি বলতে, বাড়ির কোনো খবর নেই। বহুদিন ধরে পাইনি। তার মানে অবশ্যই যে, খবর ভালোই; খারাপ কিছু হলেই খবর আসত, কিন্তু সেকথা না—

বলতে বলতে সুচিত্র, আমাদের মাঝখানে, আমাদের প্রাপ্তরাশেব মধ্যস্থলে নিজেকে স্থাপিত করে। রাশীকৃত হয়।

আমার সময় বেশি নেই। তোমরা যদি খাওয়া দাওয়ার জন্যে খুব বেশি পীড়াপীড়ি লাগাও তাহলে এক্ষুনি আমায় উঠে পড়তে হবে। ব্রেকফাস্ট সেরেই বেরিয়েছি। সাড়ে আটটার ট্রেন ধরতে হবে আমায় বলতে বলতে ও জাঁকিয়ে বসে।

ওর কথা, সো পেয়ে, কিঞ্চিৎ আশ্বস্তিতে, দুখানা টোসটের অন্দরে একখানা পোচকে সুবিন্যস্ত করে প্রায় মুখে তুলবার মত পরিপাটি করে তুলেচি, সুচিত্ৰ চকিতের মধ্যে হাত বাড়িয়ে সেই টোস্ট আর পোচের হরিহরাত্মাকে আয়ত্তে এনে নিজের অম্লানবদনে পুরে দ্যায়—

বাঃ, তোমার টেষ্ট আছে হে, চকরবতি! বাঃ! রোমন্থনের সাথে সাথে সে জানায়ঃ বাস্তবিক, চক্কোত্তিদের যে রান্নাঘবের সম্রাট বলে সে কি সাধে? চক্কোত্তিরা মুসলমান হলে খাসা বাবুর্চি হতে পারে। এবং এই বলে সে অপরাপর টোস্ট-পোচদের ওপর পরের পর আক্রমণ চালায়। আর বলে যায় : একটা চক্কোত্তি কাটলে দুটো বাবুর্চি বেরয়, কথাটা মিথ্যে নয়।

তোমার সাড়ে আটটার ট্রেন ধরা চাই—বল্লে না—? সুচিত্র এবং দেয়ালঘড়ির দিকে যুগপৎ দৃষ্টি রেখে আমি মনে করিয়ে দিই। স্মরণ না করিয়ে পারিনে।

তার বদলে সাড়ে দশটার ধরলেও ক্ষতি নেই। সুচিত্র বলে।

তবে—আর কি! আমার হতাশ কণ্ঠস্বরে যদুব সাধ্য আনন্দের অভিব্যক্তিদানের প্রয়াস থাকে।

হ্যাঁ, যেজন্যে এসেছি আসল কথাই বলা হয়নি এখনো। সুরু করে সুচিতয় : আপিসের ছুটির কথা জিজ্ঞেস করছিলে না? সেই ছুটির সম্পর্কেই আমার আসা।

তবে যে বল্লে ছুটি পাওনি? পৃষ্ঠদেশের শেষ তৃণ-খণ্ডের জন্য অকাতরে অপেক্ষমান উটের মত আমি ওর উত্তরের প্রতীক্ষা করি। উটপুখের মতন।

এখনো পাইনি বটে, তবে পাবো শীগগিরই। হপ্তাখানেকের ছুটি নেব ভাবছি—এই সামনের হপ্তায়। সুচিত্র অচিরাৎ সব বিশদ করে দেয়। আর সেই কারণেই তোমার কাছে এলাম।

আমার কাছে? আমার কাছে এসে ভুল করেছ ভায়া। আমি ডাক্তার কি কবরেজ নই যে তোমাকে রেডিমেড-সাটিফিকেট দিতে পারব। মেডিকেল সার্টিফিকেট-বিতরণকারী কোনো ডাক্তার কবরেজের সাথে আলাপও নেই আমার। আমার কাছ এসে লাভ?

বিতৃষ্ণ নেত্রে আমার প্রতি দৃকপাত করে ও বলে-কল্পনাকেই বলে : এটা দিনকের দিন এমন হাঁদা হয়ে যাচ্ছে কেন রে? এটাকে তুই এতদিনেও মানুষ করতে পারিসনি দেখছি! একে কাটলে দুটো বোকা হয়। এমন কি, তেমন কায়দা করে কাটতে পারলে তিনখানাও বার করা যায়।

কল্পনা হাসতে থাকে, আমি ঘোঁৎ ঘোঁৎ করি।

অবিশ্যি, ঘোঁৎকারের চেয়েও, কঠোরতর ভাষায় আমি প্রতিবাদ করতে পারতাম, সুচিত্রর সঙ্গে আমার তথাকথিত মধুর সম্বন্ধ কটু-তিক্ত-কষায়ের যে-কোনোটায় রূপান্তরিত করতেও বিশেষ কোনো বাধা ছিল না, উক্ত রসান্তরণে যৎসামান্যই আমার যেত আসত কিন্তু কল্পনার যসিতে আমাকে কাহিল করে দেয়। অগ্রপশ্চাৎ উভয় প্রদেশ থেকে

অতর্কিতভাবে পরের দ্বারা আক্রান্ত হলে খুব পরাক্রান্ত লোকও বেসামাল হয়ে পড়ে।

ছুটি আমার মঞ্জুর হয়েই আছে, সেজন্য কাউকে মাথা ঘামাতে হবে না। বিবস কষ্ঠে ও জানায় সেজন্যে আমি ভাবছিনে। আমি ভাবছি যে ছুটিটা কাটানো যায় কোথায়। সবাই মিলে এই কটা দিন ফুর্তি করে এক সাথে কাটালে কেমন হয় রে খুকি?

খুব ভালো হয় দাদা! কল্পনা উল্লসিত হয়ে ওঠে: উঃ কী আমোদ যে হয় তাহলে!

কি বলগো, মজা হয় না খুব? কল্পনা আমার দিকে তাকায়।

তা–তা একটু হয় বৈকি। আমি চেষ্টা কবে বলি : সুচিত্র যে মজাতে অদ্বিতীয়—কে না জানে?

কিন্তু তোমাদের এখানে এসে কাটাতে আমি চাচ্ছি নে তো।

এখানে না? এতক্ষণে মজ্জমান আমার একটু আমেজ লাগে,—পিঠের তৃণদণ্ড অগাধ জলের তৃণখণ্ড হয়ে দেখা দেয়। অথই জলে ডুবে যাবার মুখে সেই তৃণটি ধরে আমি বলি : দুঃখের কথা! খুবই দুঃখের কথা! তোমার সঙ্গলাত আমাদের পক্ষে যে কতটা গ্রীতিকর তা তুমি জাননা, কিন্তু তাহলেও অন্যায় আসলিন্স ভালো না। ছুটির এই কটা দিন জোর করে আব সবার আলিঙ্গন থেকে ছিনিয়ে তোমাকে আমরা উপভোগ করতে চাইনে। না, কল্পনা, না, ও যখন আমাদের এখানে এসে ছুটিটা কাটাতে রাজি নয়, তখন ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে ওকে উপরোধ কোরো না। স্বার্থপরের মত সেটা সত্যিই জবরদস্তি করা হবে।

আমাকে আধখানা কথাও কি কইতে দেবে আগে? বিৰূপ চক্ষের বিষাক্ত চাহনিতে সৃচিত্র আমাকে বিদ্ধ করে : আমি কী মৎলব এঁটেছি তোমাদের বলি তাহলে। আমি বলছিলাম কি, আমরা সবাই মিলে ভবেশদের রিশড়ের ওইখেনে গিয়ে ছুটিটা কাটালে কেমন হয়?

হ্যাঁ, এটা মন্দ আইডিয়া না। কল্পনা সায় দেয়।

ভবেশ আমাদের প্রতিবেশী এবং পরিচিত। রিশড়ের বাড়িটাও আমাদের অচেনা নয়। জানাশোনার মধ্যে বেশ লোক বেছে বেছে ভবেশরা বাগান-বাড়িটা ভাড়া দিয়ে থাকে—অবশ্যি এক আধ হপ্তার কড়ারেই। আমবাও কয়েকবার সেখানে গিয়ে ফুর্তি করে কাটিয়ে এসেছি।

হুম। আমিও মাথা নাড়ি—ভবেশকে বলে দেখব। কী বলে শুনি। আমার ধারণা, আগামী সপ্তাহে ওরা নিজেরাই সেখানে বেড়াতে যাচ্ছে।

যাচ্ছে না। এখানে আসবার পথে ওদের বাড়ি হয়েই এলাম তো। ওকে বাজিয়ে এসেছি।

সুচিত্রর কার্যপ্রণালী এই বকমই। সম্পূর্ণ নিখুঁৎ। ওস্তাদী হাতের সূচী-শিল্পের মতই সুচাক-সব কিছুই এফোঁড় ওফোড় করে চলে যায়—তার সূচীভেদ্যতার ভেতর কোথাও ফাঁক রাখে না।

প্রথম হিম পড়ছে, ঋতু পবিবর্তনের মুখে এই সময়ে কলকাতার বাইরে পা বাড়ানো কি ঠিক হবে? আমি ইতস্তত কবি? তার ওপরে আমার আবার সদির ধাত।

বেশ, এই শনিবারই আমাকে রিশড়েয় যাওয়া ঠিক হলো দাদা। কল্পনা বলে। হাকিম যেমন হুকুম দিতে বসে আসামীর মুখাপেক্ষা করে না তেমনি অনায়াসে আমার মুখের দিকে না তাকিয়ে অম্লানবদনে বলে দ্যায়।

বাঃ, লক্ষী মেয়ে, খাসা মেয়ে! চমৎকার মেয়ে তো একেই বলে বাঃ! সুচিত্রর কলকলধ্বনি শুনিঃ বেশ ভালোই হলো। ঐ সাথে তোমরা যদি তরফদারকেও সঙ্গে নাও, আরো ভালো হয় তাহলে। গোবিন্দ আমার প্রাণের বন্ধু, জানে তো? তরফদারকে। নিমন্ত্রণ করতে কি তোমাদের কোনো আপত্তি আছে?

না, না, আপত্তি কিসের? তোমার বন্ধু আসবেন–সে তো সুখের কথাই। কল্পনাই জবাব দেয়।

কিন্তু তার তো আর ছুটি হয়নি—তার কি নিজের কাজকর্ম নেই? আমিই মৃদু আপত্তি জানাই, অবিশ্যি তরফদারের তরফ থেকেই।

গোবিন্দ? সে ক্যাজুয়াল লীভ নিয়ে বাড়িতে বসে আছে। টেলিফোন করে খবর নিয়েছি আমি। এখানে আসবার মুখে একটু আগেই ওকে বাজিয়ে এসেছি।

আহা, যখন এত লোককেই গায়ে পড়ে বাজিয়ে এসেছ, বাদ দাওনি কারুক্ষেই, তখন একটু কষ্ট করে ঐ সাথে আমার ব্যাঙ্কের ম্যানেজারকেও কেন বাজিয়ে এলে না? দয়া করে আগামী সপ্তাহে যদি কিছু ওভারড্রাফট দিতো আমায়? এতক্ষণে আমারো একটু ঝাঁঝ দেখা দেয়।

তোমার মেজাজটা আজকাল এমন তিরিক্ষে মেরে যাচ্ছে কেন হে? মনে হচ্ছে হাওয়া বদলানোর দরকার। রিশড়েয় কটা দিন কাটিয়ে এলে তোমার উপকার হবে। বলতে বলতে সুচিত্র উঠে পড়ে: আমি চললুম এখন। সেই রিশড়েতেই মিশব তোমাদের সঙ্গে। কেমন?

ঘূর্ণি হাওয়া চলে যাবার পর, ধ্বংসস্তুপে বিমূঢ় হয়ে পড়লেও মানুষ যেমন একটা অবর্ণনীয় স্বস্তি পায়, চারিধারের নষ্টাবশেষের থেকে অবশিষ্ট নিজেকে পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করে, আমি সেই মানসিক প্রয়াসে লিপ্ত, কল্পনা আমার তন্ময়তায় বাধা দিয়ে বলে

আচ্ছা, হ্যাঁগা, দাদা তটিনীর কোন কথা তুলল না যে? এটা যেমন একটু কেমন-কেমন না?

হয়তো অন্য তটিনীতে পাড়ি জমাচ্ছে আজকাল। আর কোথাও খেয়া বাইছে! দিলেই হলো, খেয়ালী তো!

উহু, তটিনী বলতে দাদা অজ্ঞান। এ হতেই পারে না। তটিনীকেও তাহলে নেমন্তন্ন করা যাক, কী বলো? তাক লাগিয়ে দেয়া যাবে দাদার, কেমন না?

সে কথা মন্দ নয়। আমি বলি। নিস্পৃহ কণ্ঠেই বলি।

ওর বেশি জোরালো সায় দিতে সাহস হয় না আমার, তবু এতক্ষণে, বলতে কি, সত্যিই আমার মন্দ লাগে না। উষর মরুভুমির মাঝখান দিয়ে তটিনী প্রবাহিত হওয়াটা মন্দ কী? অবগাহনের তেমন আশা না থাকলেও—পাড়ে দাঁড়িয়ে চেয়ে চেয়ে দেখতেই—এমন কী খারাপ? মিশকালো মেঘের রূপালী পাড়রা দেখা দিতে থাকে একে একে—এতক্ষণে।

অবশেষে আগামী সপ্তাহ এল। আমরা এলাম রিশড়েয়। ভবেশের বাগান বাড়িতে। হিমেল হাওয়া এল, হিম আসতে লাগল, ভয়ানক ঠাণ্ডা এসে পড়ল—কিন্তু সুচিত্ৰর আর দেখা নেই।

হিমেল হাওয়ার হাত ধরে সর্দি এল, কাশি এল, আমার পুরাতন হাঁচিরা এসে পড়ল, আধিব্যাধিদের যারা যারা আসবার এই সুযোগে একে একে এসে গেল, কেবল সুচিত্র এল না। অবশেষে আগামী সপ্তাহ কাবার হয়ে আরেক শনিবার ঘুরে এল।

সুচিত্রর একি লীলা? বুঝতে পারছিনে তো। কল্পনাকে আমি প্রশ্ন করি। আমার পায়ের কাছে তিন তিনটে গরম জলের বোতল, গলাগলি করে আমার পায়ের তলায় গড়াগড়ি যাচ্ছে। গলায় উলের কক্ষটার, আর গায়ে জড়াজড়ি যত রাজ্যের লেপ। লেপের ওপরে লেপের প্রলেপ।

ছুটি পায়নি বোধ হয়। কল্পনা সাফাই দিতে চেষ্টা করে।

তাহলেও তার করে জানানো উচিত ছিল তার। জলপাইগুড়িতে জলপাই আছে কি জানিনে, তবে টেলিগ্রাফ অফিস আছে, যদুব আমার জানা।

এখনো তো রয়েছে একটা দিন। কাল হয়ত আসতে পারে। দেখা যাক না।

কিন্তু না, কালও সে এল না। আবার আমরা বাড়ি ফিরে এলাম। সর্দি কাশি হচিরা সাথে সাথে এল, সেই সাথে আরো ঢের খাঁটি জিনিস আমদানির সম্ভাবনা দেখা গেল। আজ্ঞে হ্যাঁ, নিউমোনিয়া পর্যন্ত প্রায় এসে পৌঁছল, কিন্তু আমাদের ওল্ড ম্যানিয়া—সেই আমার শ্যালকরত্ন এল না।

আদা-গোলমরিচ-তেজপাতা-মিশ্রির গরম কাথ পান করছি, সন্ধ্যে হব-হব—এমন সময়ে টেলিফোন বেজে উঠল।

গেলাসটা নামিয়ে, স্বল জড়িয়ে, দুই বাড়ে দুই বালিশ সম্বল করে খলিত পদে টেলিফোনের জবাব দিতে গেলাম।

কি হে, বোকর! সুচির গলা বলি, আছে কেমন?

কে? সুচিত্র নাকি? কিরকম তোমার ব্যাভার বলো তো? সাত দিন ধরে আমরা সেখানে—আর তোমার দেখা নেই?

আমার দেখা? তার মানে? আমি যে দেখা দেব সে কথা কখন বললুম? সুচিত্রও বিস্মিত গলা বাড়ায়: ওখানে যে আমি যাব কক্ষনো তা তো আমি বলিনি। ঘুণাক্ষরেও না। আমার মতলবটা নিশ্চয়ই তোমরা—তুমি অন্ততঃ—আঁচ করতে পেরেছিলে?

জবাবের হলে কী যেন বলতে যাচ্ছিলাম, বলতে গিয়ে হেঁচে দিলাম। হচিরা পরম্পরায় এসে আমার বাক্যব্যয়ে বাধা দিল—কিন্তু ওর পক্ষে সবই সমান। আমার বক্তব্য বুঝতে তাতে ওর কিছু অসুবিধা হলো না।

ও বললে: বুঝেছি। আর বলতে হবে না। গোবিন্দটা গিয়েছিল?

তরফদার? নিশ্চয়! সে তো অবাক হয়ে গেছে। তুমিই তাকে আহ্বান করে এনে এভাবে বিসর্জন দেবে সে ভাবতে পারেনি। মতলবটা কী ছিল তোমার শুনি।

একদম তুমি আঁচতে পারেনি? বলো কী? বিন্দুবিসর্গও না? আচ্ছা আহম্ম তো! তোমরা কি ভেবেছিলে যে জলপাইগুড়ির জোয়াল থেকে এক হপ্তার এই মুক্তি রিশড়ের মাঠে মারবার জন্যেই আমি ক্ষেপে রয়েছি? যেকালে কি না নিষ্প্রদীপের স্বল্প আলোকে কলিকাতা মহানগরী আরো ঢের রহস্যময়ী হয়ে বাহু বাড়িয়ে সাদর অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন? তুমি দেখছি একটি নির্জলা বোক্চৈতন!

তাহলে এত কাণ্ড করে এই সব বাগানপাটির মানে? এসব ঠিকঠাক করার উদ্দেশ্য?

উদ্দেশ্য আছে বইকি বন্ধু! গোবিন্দকে আমার পথ থেকে রানো। যাতে আমি অবাধে তটিনীকে নিয়ে বয়ে যেতে পারি। একটু বোকা যদিও, গোবিন্দটা লোক মন্দ না। কিন্তু একটা ওর মহন্দোষ, তটিনীর ওপরে ঝোঁক। ওরও ঝোঁক। এইটেতেই ওকে মাটি করছে। এইহপ্তাখানেকের ছুটির সুযোগে ওর আড়ালে তটিনীর সঙ্গে একটা পাকাপাকি করে ফেলার আমার মতলব ছিল। ভেবেছিলাম, গোবিন্দটা যখন তোমাদের সঙ্গে রিশড়ের মাটি চষবে, সেই ফাঁকে আমি তটিনীকে নিয়ে, চাই কি, গোধূলি লগ্নে একেবারে স্থ হয়েও যেতে পারি। এই সব কারণেই, গোবিন্দকে সরানোর দরকার ছিল আমার। তোমরা যে আমার এত বড় একটা উপকার করে তার জন্য আমি চরিতার্থ—চিরকৃতজ্ঞ। গোবিন্দকে হটাবার জন্যে তোমাদের অজএ-অজ

টেলিফোনের পরপার থেকে ওর ধন্যবাদমুখরতা উদ্বেল হয়ে ভেসে আসে। সমস্তটা আমি নীরবে হজম করি, জীর্ণ করতে বেশ একটু লাগে বৈ কি! তারপরে ভেঁকুর তুলে বলি:

তাহলে এই কটা দিন বেশ ফুর্তিতেই কেটেছে, কী বলে? মতলবও হাসিল নিশ্চয়? তটিনী, তুমি আর গোধূলি—তিনজনে মিলে হলে ত্রিবেণীসম বাধিয়ে ফেলে, আশা করি?

নাঃ, দুঃখের কথা বলব কী তাই? দুঃখের সঙ্গে সুচিত্র জানায়: ট্রেন থেকে শেয়ালদায় নেমেই, ফোন করে খবর পেলাম, তটিনী কোথায় নাকি কয়েকদিনের জন্যে উধাও হয়েছে–এর কোন মেয়ে বন্ধুর সঙ্গে বেড়াতে গেছে নাকি কোথায়! ওর বাড়ি থেকেই বললে। কিন্তু কোথায় যে গেছে বাড়ির কারু জানা নেই। মেয়েটার নামও কেউ বলতে পারল না। কী করি, কোথায় কোথায় আর কার কার সঙ্গে যে ও যেতে পারে তার তালিকা নিয়ে খোঁজাখুঁজি করে ওকে খুঁজে বার করতেই গোটা হপ্তাটা আমার ছাওয়া হয়ে গেল।

বার করতে পেরেছে তো? আমি বলি: গোধূলিকেও শেষ পর্যন্ত কাজে লাগাতে পেরেই নিশ্চয়?

উঁহুঃ! বিদীর্ণ কণ্ঠস্বর সুচিত্রর।–গোধূলির যথাটা বার বার বোলো না, প্রাণে ব্যথা পাচ্ছি। অনেক মাইল লম্বা ওর দীর্ঘনিঃশ্বাস আমার কানে লাগে।

আহা, আমাদের রিশড়ের বাগানবাড়িতে মেও আসতে যদি একবার—আমিও সখেদে বলি : —এসে পড়তে যদি।

য়্যাঁ? তার মানে?

অবিশ্যি, তুমি না আসায় গোবিন্দ আর তটিনীর যে বিশেষ অসুবিধা হয়েছে একথা আমি বলতে পারব না—

বলছ কী তুমি? সুচিত্র বাধা দিয়ে বলে। ওর সূচীভেদ্য স্বর যেন বিঁধতে থাকে আমায়।

তটিনীর প্রতি তোমার টানের কথা তো কল্পনা জানে। ওকে নেমন্তন্ন করাব কথা বলতে তুমি হয়ত ভুলে গেছ এই ভেবে সে নিজের থেকেই তটিনীকে ডাকিয়ে এনেছিল। এবং তারপরে এই দিন সাতেক—এতগুলি দিনের একান্ত আওতায়—তটিনী কোন খাতে যে বয়ে গেছেন, যাক গে,—যেতে দাও, পরচর্চায় লাভ কী? ওসব পরে কথায় পরীর কথায় আমাদের কাজ কি ভায়া–

রিসিভার নামিয়ে রেখে, বালিস ঘাড়ে, কম্বল গায়ে, নড়বড় করতে করতে, আমাব ইজিচেয়ারে, গরম জলের বোতলদের পাশে, গেলাসের সেই ক্বাথের কাছে আবার এসে কাত হই।

ভেবে দেখলে, প্রেমের ফাঁদ তো চারধারেই পাতা–ভূমণ্ডলের কোথায় নেই? যথাস্থানে আর উপস্থিত মুহূর্তে, বোকার মত, ধরা দিলেই হয়। তা না করে বিধাতার ওপরে টেক্কা মেরে নিজের চেষ্টায় বিশেষ করে সেই ফাঁদ পাততে গেলে যা হয় তা কোন কাজের হয় না। মাঝখান থেকে পাতানো ফাঁদে অবাঞ্ছনীয় লোকেরা অযাচিতভাবে জড়িত হয়ে, সর্দি, কাশি, নিউমোনিয়া এবং মানসী ইত্যাদির অভাবিত মিলনে জর্জরিত হয়ে পড়ে। ইজিচেয়ারে তেরছা হয়ে শুয়ে কঠোপনিষদের এই সব কঠিন তত্ত্ব মানসচক্ষে দর্শন করি।

তবু, তাহলেও, এতক্ষণে অনেকটা ভালো লাগে। ঢের সুস্থ বোধ করি। ঠাণ্ডা যেন বহুৎ কমে গেছে—নিউমোনিয়ার উপসর্গগুলোও যেন এর মধ্যেই উবে যাচ্ছে মনে হয়। আরাম পাই, ক্রমশই চাঙ্গা হতে থাকি।

০৫.

সমুদ্রের তীরে, এমন একটি অপরাহ্নে অপর এবং অন্যের কথা মনে ঠাঁই পাই না। প্রত্যহের কোলাহল—প্রতিদিনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে এখন আমি হাজার হাজার মাইল দূরে। মাইল না বলে কিলোমিটার বললেই ঠিক হবে বোধ করি—দুটির অবকাশ জীবনের যুদ্ধক্ষেত্রের প্রাত্যহিক অপমৃত্যু থেকে পলায়ন ছাড়া আর কী?

আমার সামনে অনতিদূরে ওই উত্তাল সমুদ্র—আর চারিধারে ধূসর বালুর ধূধূ বিস্তার! তার মাঝখানে আমার ডেক চেয়ারে আমি আরামে সমাধিস্থ কল্পনা কখন ফিরবে সেই কল্পনাতেই বিভোর হয়ে রয়েছি মনে হয়।

স্বর্গদ্বারে তার এক সখীর সঙ্গে আলাপ করতে সেই যে উনি গেছেন, এখনো ওঁর দেখা নেই। অগত্যা আমি বেচারী কী আর করি? বিরহ-দুঃখে স্রিয়মান হয়ে মুহ্যমান হয়ে মশগুল হয়ে থাকতে বাধ্য হয়েছি।

সূর্যের ডুব দেবার খুব দেরি নেই। আমিও খবরের কাগজের মধ্যে ডুবে। সমুদ্রে সূর্যাস্ত ওরফে সূর্যাস্তের সমুদ্র শুনেছি দেখবার মতো একটা জিনিস,—দৃশ্যহিসাবে অতিশয় বিরল বলে নাকি! প্রকৃতি-রসিকরাই বলে থাকেন।

কিন্তু কেন বলা যায় না, কাঁচা পেয়ারা থেকে শুরু করে পৃথিবীর অনেক ভালো জিনিসই আমার কাছে তেমন পেয়ারের নয়! ধাতে কেমন বরদাস্ত হয় না, কোথায় গিয়ে যেন কামড়ায়! অস্তাচলগামী সূর্যের পরাক্রমে পরাস্ত হয়ে, আত্মরক্ষার খাতিরে সমুদ্রকে আড়াল করে খবরের কাগজের আড়ালে আমাকে আশ্রয় নিতে হয়েছে।

এই একটু আগে, এক জোড়া তরুণ-তরুণী আমার কাছাকাছি এসে কলহ জুড়ে দিয়েছিল—সূর্যাস্ত-দর্শনে তাদেরও সমান অরুচি দেখতে পেলাম—বকতে বকতে তাদের আলোচনার এবং আমার সীমান্তে এসে তারা পৌঁচেছিল। মুখে কাগজ চাপা দিয়ে আমি অকাতরে ঘুমোচ্চি তারা ধরে নিয়েছিল মনে হয়। ঘুমের ভাণ করে তাদের তর্ক করতে দেব, না, নড়ে চড়ে তাদের সতর্ক করে দেব–কোনটা ঠিক হবে সেই কথাই আমি ভাবছিলাম।

আবার তুমি না করচ! আমার নিজের চোখে দেখা। মেয়েটি বলছিল।

কিছুতেই তুমি দেখতে পারো না! প্রতিবাদ করে ছেলেটি : আমি ছিলামই না সে তল্লাটে! তোমার দিব্যি, তার ত্রিসীমানায় আমি ছিলাম না।

আমি নিজের চোখে দেখেছি! বলছি আমি। মেয়েটির ধারালো অনু-যোগ!-–আমি কি মিথ্যে বলছি?

দ্যাখো হেনা, আমার মনে হয় ডাক্তারকে দিয়ে তোমার চোখটা একবার দেখানো দরকার ভালো করে। তুমি আরেকবার এইরকম ভুল করেছিলে মনে আছে বোধহয়? সেই যেবার তুমি এমনি নিজের চোখে দেখেছিলে তোমার কোন্ এক বন্ধুকে নিয়ে আমি লাইটহাউসে ঢুকছি। মিনতি না কি যেন তার নাম! নিউ মার্কেট থেকে ফেরার পথে এমনি নিজের চোখেই দেখেছিলে তো! অথচ তুমি বেশ ভালোই জানতে, একটা প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে সারা দুপুর সেদিন আমি মিউজিয়ামেই কাটিয়েছিলাম। তবুও লাইটহাউসে আমাদের প্রবেশলাভ দেখতে তোমার একটুও বাধা হয়নি।

হয়ই নি তো। সেদিনও আমি ভুল দেখিনি! হেনার বরফ-জমানো গলা: সেদিনের কথাও আমি ভুলব না কোনো দিন!

মিনতির সুরে আরো কী যেন বলতে যাচ্ছিল ছেলেটি, কিন্তু হেনার এহেন জবাবের বফি-পাহাড়ে আটকে গিয়ে তার তুষার-গলানো আবেদন গলার মধ্যেই জমাট বেধে যায়।

খবরের কাগজের ম্যাজিনো-লাইন একটু ফাঁক করে যুধ্যমান দম্পতির দিকে একবার আমি উকি মারলাম। অগ্নিবর্ষিণী মেয়েটি দেখতে মন্দ নয়—তম্বীও বটে, বহ্নিও বটে! রোষকষায়িত হওয়ায় আরো যেন সুন্দরীই দেখাচ্ছিল ওকে। শানানো ছুরিব মত চকচকে আর ধারালো! যে কোনো মেষশাবকই ওর তলায় গলা পাততে দ্বিধা করবে না। কাগজের আড়াল দিয়ে আড় চোখে সেই আরক্তিম শোভার দিকে তাকাচ্ছিলাম–রঙদার আকাশকে উপেক্ষা করে সামুদ্রিক সূর্যাস্তের দিকে ভ্রুক্ষেপমাত্র না করে। সত্যি, অস্তায়মান সূর্যের ওপরেও টেক্কা মেরেছিলো মেয়েটা।

স্বামী হতভাগ্যের আর কী বর্ণনা দেব? রস, কষ, বর্ণ, গন্ধ যাওবা ছিল বেচাবীর, এই অভাবিত আকস্মিক আক্রমণে সমস্তই হাওয়া কোন দিক দিয়ে যে এই ব্লিংসক্রিগ ঠেকাবে, কোণঠেসা হয়ে খেই পাচ্ছে না! বিপন্ন বিপর্যস্ত জীবটির প্রতি অযাচিতই আমার সহানুভূতির উদ্রেক হতে থাকে।

তুমি সুমুদ্দুরে স্নান করতে গেছ সেজন্যে তোমাকে আমি কিছু বলছি না, আমাকে ফেলে একলা যাওয়ার জন্যেও না, কিন্তু কিন্তু অমন করে মিথ্যে কথা বানিয়ে আমাকে ঠকাতে চাওয়ার মানে?…

হেনার ভেতর থেকে চাড়ে-ভাঙা বরফের টুকরোগুলো ঠিকরে ঠিকরে বেরয়।

আমি তোমাকে একশো বার বলেছি, আবার বলছি, আজ আমি সমুদ্রের ধারে কাছেও যাইনি। স্নানই করিনি আজ! শপথ করে বলচি, সারা সকালটা আজ আমি শ্রীমন্দিরের কারুকার্য দেখে কাটিয়েছি,–তোমার তোমার শ্রীজগন্নাথের শপথ!

মনে মনে হাসলাম। সত্যি বলতে, আমি নিজেই আজ সমুদয় প্রাতঃকালটা মন্দির-গাত্রের সুচারু ফার্যে নিবিষ্ট ছিলাম এবং আমাদের—আমার এবং মন্দিরের এক মাইলের মধ্যেও এই মিথ্যাবাদীর টিকি আমার নজরে পড়েনি। অবশ্যি, মন্দির-পৃষ্ঠের কারু ভাস্কর্যের প্রতি ছেলেটির অরুচি থাকবার কথা নয়। ওই সব পৌরাণিক চারু-শিল্প থেকে আধুনিক কলানৈপুণ্য লাভের সুযোগ আছে। এমনকি, উভয়ের অনুত মিলও দেখা যায়। আধুনিকতা আর পৌরাণিকতা এই শ্রীক্ষেত্রে একই সঙ্গমে এসে অকেশে যেন মিশ খেয়েছে। এই কারণে পুরী এলে আর সুযোগ পেলে অনেকে আগে মন্দিরদান করে, এমনকি মন্দির দেখলে জগন্নাথদর্শন পর্যন্ত ভুলে যায়। কিন্তু প্রত্নতত্ত্ব আর যত্নতত্ত্বের সেই মিলনক্ষেত্রে এই গরমিলের নায়কের শ্রীমুখ আমি দেখিনি।

তুমি বলচ যে সমুদ্রের ধারে-কাছেও যাওনি আজ! বেশ, এই চুপ করলুম, আর আমি জীবনে তোমার সঙ্গে কথা বলব না বলতে বলতে ভাবাবেগে আপনা থেকেই হেনার কণ্ঠরোধ হয়ে আসে।

দ্যাখো হেনা, সারা দুপুর আজ তুমি আমার সঙ্গে কথা কওনি, সমশুক্ষণ মুখ ভার করেছিলে তাতে আমি প্রাণে কী ব্যথা পেয়েছি, তুমি জানো না। তারপর সেই তখন থেকে, বিকেল থেকে, তুমি আমাকে কী না বলছ,যা নয় তাই বলছ কিন্তু সব আমি সহ্য করেছি। এরপর ফের যদি তুমি এ-জীবনে আমার সঙ্গে কথা না বলো—জীবনের মতো কথা বলা বন্ধ করে দাও—তাহলে আমি কতদূর মর্মাহত হবো——কিরকম ঘাবড়ে যাবো তা কি তুমি ভাবতে পেরেচ? হেনা, তোমার পায়ে পড়ি, অতটা নিষ্ঠুর তুমি হয়ো না।

স্বামীর সকাতর প্রার্থনায় হেনা তক্ষুণি তক্ষুণি প্রতিজ্ঞা ভাঙলো :

আমি তাহলে বানিয়ে বানিয়ে বলচি এই কথাই তুমি বলতে চাও?

হেনার মুখে ঘুরে ফিরে সেই এক কথা-শব্দভেদী একাঘ্নী! ছেলেটির কপালে পর পর অনেকগুলি রেখা পড়ে তুমি খালি খালি আমায় অবিশ্বাস করচ, হেনা! এই সমুদ্রের সামনে আমি দিব্যি গেলে বলচি, কক্ষণো আজ আমি ওর জলস্পর্শও করিনি, তোমার ওই সমুদ্দুর সাক্ষী!

কিন্তু এত বড়ো সাক্ষ্যেও হেনা অটল,–হেনা হেলে না : তুমি কী বলতে চাও শুনি? পোস্টাফিসের ফেরতা এই পথে যেতে যেতে নিজের চোখে আমি কী দেখলাম তাহলে? ঠিক ওইখানটায়, ওই অতো দূরে, উঁচু ঐ বালির গাদাটার কাছে তুমি, আর তোমার চার পাশে একপাল–কী বলবো? একপাল জন্তু!

ছিঃ, হেনা, নিজের স্বজাতির নিন্দে কোরো না। ছেলেটি একটু ক্ষুন্ন হয় : নারীজাতির অবমাননা করতে নেই।

জন্তু না তো কী! কী বলব তাদের? বেহায়া মেয়ে যতো। হি হি হি শুনেই আমি থমকে দাঁড়িয়েছি! দেখলাম গুচ্ছের ছুঁড়ির মাঝখানে স্বয়ং আমাদের মূর্তিমান! আর কী দাপাদাপি বাপরে। কী লাগিয়েছিল ওরা? নটির পূজা, না, ঘোড়ার নাচ!

এখান থেকে ওই বালির গাদাটা কতোটা দূর! এখান থেকে দেখলে কিছুতেই তুমি আমাকে চিনতে পারতে না আর আমিও তোমাকে দেখতে পেতুম—মানে–যদি সত্যি সত্যিই ওখানে আমি থাকতুম সেই কথাই বলছি–

সেটা ভগবানের দয়া, কাছেই এখানে একটি ভদ্রলোক দুরবীণ নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন,-সমুদ্রের সুষমা দেখছিলেন তাই যেন বল্লেন,—তার হাত থেকে যন্তরটা একটুখানির জন্যে চেয়ে নিয়ে তার ভেতর দিয়ে তাকালুম। দেখতে আর কিছুই বাকী রইলো না। বলি, সুষমা বলে কেউ ছিল না কি ওদের মধ্যে? যে মেয়েটিকে তুমি হাত কলমে সাঁতার শেখাচ্ছিলে তিনিই সেই সামুদ্রিক সুষমা নন্ তো!

জীবনে আমি কক্ষনো কোনো সুষমাকে সাঁতার শেখাইনি। ছেলেটি প্রতিবাদ না করে পারে না। মেয়েদের নিয়ে সাঁতার কাটা আমার অভ্যেস নয়!

উঃ, কী বাহাদুরী মাইরি! তুমি নিজে গায়ে পড়ে মেয়েটাকে সাঁতার শেখাতে গেলে। আর শেখানো বলে, শেখানো! ইস্!–

সাঁতারেব আমি কী জানি যে শেখাবো! ছেলেটি বাধা দিয়ে বলে! অসঙ্কোচে নিজের অজ্ঞতা জাহির করতে কিছুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করে না।

তাই তো বলচি, আশ্চর্য! আর শেখাতে গেলে সেই ধিঙ্গিকে যে তোমাকেই শিখিয়ে দিতে পারে! যে তার একটু আগেই আধখানা সমুদ্দুর সাঁতরে এসেছে!–

আমি বার বার বলচি আমি নই, আর কেউ। ছেলেটি মুখ চুণ করে জানায়ঃ তুমি কি বলতে চাও যে আমি ছাড়া আমার মতো লোক আর একটিও এই পৃথিবীতে নেই? তোমার মতো আর একটা হা! তোমার জোড়া আর একটি মিললে হয়!

এক বাক্যে মেয়েটি ওকে উড়িয়ে দেয়। ওর সুচিন্তিত প্রস্তাব সমেত ওকে।

বেশ বুঝতে পারছি আমি আর অদ্বিতীয় নই! যেমন, আমাদের হিটলারের থাকে মেনি আমারও হয়েছে। আমারও জীবন্ত প্রতিমূর্তি হবহু প্রতিচ্ছবি, এই পুবীবই কোনোখানে ঘাপটি মেরে আছে নিশ্চয়। সেই হতভাগাই আমার সর্বনাশ সাধন করেছে, আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি!—ছেলেটি দীর্ঘনিঃশ্বাসের সাথে সাথে অবশেষে পরিত্যাগ করে তাকে দেখতে পেলে একবার আমি দেখে নিতাম।

তাই নাকি? হেনাও চলকে ওঠে: আমিও দেখতুম একবার।

হেনার বারংবার ছেলেটিকে হেনস্থা আমার হৃদয়ে—আমার অ্যানাটমির সব চেযে দুর্বল জায়গায় আঘাত হানছিল। স্বামীজাতিসুলভ সমবেদনায় আমি কানায় কানায় ভবে উঠেছিলাম। ভাববা দিকি, এই ছেলেটি না হয়ে যদি আমি স্বয়ং কল্পনার খপ্পরে এভাবে ধরা পড়তুম–কী হতো তাহলে? কল্পনা করতেই আমি শিউরে উঠি।

জীবনে কদাচ কাউকে উদ্ধার করার সুযোগ পাইনি। আমার সামনে কেউ জলে ডুবে মরেনি, আমার কাছাকাছি বাড়িতে আগুন লাগেনি কখনো–আমার দুর্ভাগ্যই বলতে হবে। স্ত্রী-পীড়িত এই অসহায় গোবেচারিকে বাঁচানো যায় কিনা, ভেবে দেখি।

ওদের অলক্ষ্যে উঠে যাই। তারপর হাওয়া খাওয়ার ছলনায় এধারে ওধারে ঘুরে ফিরে বেড়াতে বেড়াতে, পায়চারির ফাঁকতালে ওদের কাছাকাছি এসে পড়ি—তখনো দুজনের মধ্যে ঘোরতর লড়াই।

সাহস সঞ্চয় করে নিই আমি। তারপর সহাস্য মুখ তুলি :

এই যে, এই যে। দিগম্বরবাবু যে! আমি উছলে উঠি অকস্মাৎ : ফের আমাদের দেখা হলো, আঁ?—বলতে না বলতে অত্যন্ত অন্তরঙ্গ হয়ে পড়ি আমি–আজকেই আরেকবার। কী ভাগ্যি।

দিগম্বরের গলার ভেতরটা ঘড় ঘড় করে ওঠে।

আজ্ঞে—আজ্ঞে, মাপ করবেন। ছেলেটি বলে: আমি—আমি তো আপনাকে–আমার নাম দিগম্বর নয়।।

দিগম্বর নয়? সে কি মশাই, আজ সকালেই আপনি বললেন, আপনার নাম দিগম্বর? আর এর মধ্যেই নিজের নাম ভুলে গেলেন?

সকালে কখন আপনার সঙ্গে আমার দেখা হলো? দিগম্বর যেন দিগন্ত থেকে পড়লো।

আলবৎ হয়েছে। ঐ যে ঐখানে—ঐ——ঐ বালির গাদাটার পাশে? মনে পড়ছে আপনার? একদম না।

একদম না। ঐ বিচ্ছিরি গাদাটার ত্রিসীমানায় আমি ছিলাম না। দিগম্বর বিরসমুখে জবাব দেয়।

সে কি মশাই? এ-বেলায় ও-বেলায় ভুলে যানে। আমি সে-সময় মেয়েদের সাঁতার শেখাচ্ছিলাম, আপনি অযাচিতভাবে এগিয়ে এসে আমার কাজে কতখানি সাহায্য করলেন। কেন মশাই, সেই মেয়েটিকে–সমুদ্রের সুষমাকে—আপনিই তো স্বহস্তে সাঁতার শেখালেন, বলতে গেলে।–

বলতে বলতে আমি আরো কাছে এগিয়ে যাই, আরো তীব্র দৃষ্টিতে তাকাই, আরো তীক্ষ্ণতর কটাক্ষে ভদ্রলোকের আগাপাশতলা বিদ্ধ করি।

হ্যাঁ, আপনিই তো। সুষমার সমুদ্রে আপনাকেই তো তলিয়ে যেতে দেখেছি। ভালো করে অবলোকন করে অবশেষে বিহ্বল হতে হয : আশ্চর্য।…আমার বিস্ময়-বিস্ফারিত নেত্রের সঙ্গে আমার কিংকর্তব্যবিমূঢ় কণ্ঠ সমান তালে পাল্লা দ্যায় : তাই তো। আপনি তো দিগম্বর নন। উঁহু, দিগম্বরবাবু তো নন আপনি! এখন দেখতে পাচ্ছি! স্পষ্টই দেখছি এখন! কিন্তু কী অদ্ভুত মিল মশাই! এমন বিস্ময়কর সৌসাদৃশ্য সচরাচর দেখা যায় না। আশ্চর্য!

দিগম্বর–না, কী ওর নাম—ওকে দেখলে মনে হয়, ও যেন দৈববাণী শুনছে। স্বকর্ণেই শ্রবণ করছে! ফেরারী সত্য যুগ ফিরে এল নাকি ফের? সেই যে-যুগ—যে কালে, আপনি আসিয়া ভক্তরণস্থলে সংগ্রাম করিত দেবতাগণ!–পুনরায় দেখা দিল। নাকি আবার?

আর হেনাকে দেখলে মনে হয়, অপ্রত্যাশিত এই আবির্ভাবে, এহেন অভাবিত সাক্ষীর অভ্যুদয়ে, ও যেন আস্তে আস্তে আমার ওপরে আস্থা স্থাপন করতে শুরু করেছে।

ওঁর মতো একটি লোককে ঐ বালির গাদাটার পাশে আপনি দেখেছিলেন আজ সকালে? হেনা জিজ্ঞেস করে আমায়।

অবিকল। আর, দেখা মানে? আমরা দুজনে একই সমুদ্রে হাবুডুবু খেয়েছি। একই সুষমাময় সমুদ্রে। সত্যিই, অবাক কাণ্ড। দুজনে একেবারে হুবহু। একটু দূর থেকে দেখলে আলাদা করার উপায় নেই। যাক, কিছু মনে করবেন না মশাই, সামুদ্রিক সুষমায় যিনি মত্ত হয়েছিলেন, তিনি আপনি নন। তিনি অপর কেউ। এখন দয়া করে নিজগুণে আমায় মার্জনা করুন।

ছেলেটি আমায় মার্জনা করে দিল অম্লানবদনে, তৎক্ষণাৎ! তার মুখ দেখেই আমি টের পেলাম।

হোলো তো। দেখলে তো। বলছিলুম না যে আমি নই—সে যেই হোক্, সে কখনো তোমার স্বামী নয়–

চলে যায় ওরা, মেয়েটিকে কাটা কাটা কথা শোনাতে শোনাতে যায় ছেলেটি : সেই লোকটাই আসল বদ। সেই হচ্ছে আসামী। আর দূরবীনধারী সমুদ্রের সেই সুষমাদর্শনকারী হতচ্ছাড়াটা হচ্ছে তার মাস্তুত ভাই। সে লোকটাও কম পাজি না। সেই তো যতো নষ্টের গোড়া। সেই হতভাগাটা যদি না তোমাকে দূরবীন দিতো—যাগ গে, দিগ গে, তাকে কী। এখন, তাকে কি, তার মাস্তুত ভাই সেই সন্তরণবিলাসীকে তোমার স্বামী বলতে চাও? ইচ্ছে হয়, বলতে পারো।… বলতে বলতে চলে যায় ওরা।

আমি হাসি। একখানা স্বর্গীয় হাসি হেসে দিই। দুঃখ-জৰ্জর পার্থিব কোনো জীবের একটুও উপকারে লেগেছি,—একটাও ক্ষণভঙ্গুর সুখনীড়কে ভগ্নদশা থেকে বাঁচাতে পেরেছি–অকিঞ্চিৎকর এই জীবনের যৎকিঞ্চিৎ যাতনাও করতে পারা গেছে—এই ভেবে বিজাতীয় আনন্দ হতে থাকে।

ফেরা যাক্ এবার।

ফিরতেই দেখি, আমার পেছনে দাঁড়িয়ে কল্পনা। মূর্তিমতী শ্রীময়ী স্বয়ং–

ঠোঁটে ঠোঁটে জমাট লেগে সারা মুখ সুকঠিন—দুই চোখে ওর গনগনে আগুন। একটু আগে হেনার মুখে যে-ছবি দেখেছিলাম তারই পুনর্মুদ্রণ। কিন্তু তার চেয়ে আরো ভয়াবহ।

এই বুঝি তোমার মন্দির দেখতে যাওয়া? আজ সকালে সারা বেলাটা—এই–এই বুঝি?…এই করেই বুঝি…?

দলিতা ফণিনীর মতো কল্পনা ফোস ফোস করে। গর্জে গর্জে উঠতে থাকে ক্ষণে ক্ষণে।

আর আমি?…

কল্পনার কাছে এখনো কৈফিয়ত দিতে হচ্ছে।…

০৬.

একটু চা না হলে তো বাঁচিনে! কল্পনা দীর্ঘনিঃশ্বাসের দ্বারা বক্তব্যটা বিশদ করল।

চা-বিহনে মারা যাচ্ছি এমন কথা আমি বলতে পারিনে –সত্যনিষ্ঠার প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে বলতে হয় : তবে এক কাপ পেলে এখন মন্দ হেতো না নেহাত!

চায়ের একটা দোকান কাছাকাছি আছে কোথাও নিশ্চয়।

আমারও তাই ধারণা। চায়ের গন্ধ পাচ্ছি যেন! মিনিট খানেকের মধ্যেই কোনো চায়ের আড্ডার ওপরে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়তে পারি মনে হচ্ছে।

কিন্তু মিনিটের পর মিনিট কেটে যায়, অগুনতি মিনিট, এবং হোঁচটও বড়ো কম খাইনে, কিন্তু কোনো চাখানার চৌকাঠে নয়। আমি হতাশ হয়ে পড়ি এবং কল্পনা পেঁয়ো লোকের বোকামি আর ব্যবসাবুদ্ধিহীনতার প্রতি তীব্র কটাক্ষপাত না করে পারে না।

বাস্তবিক, গ্রামের পর গ্রাম পেরিয়ে যাচ্ছি অথচ চায়ের নামগন্ধ নেই। কেন, গাঁয়ে গাঁয়ে চায়ের দোকান খুললে কী ক্ষতি ছিল? ফলাও কারবারে দু পয়সা উপায় হতে বইতো নয়! এই তো, আমরাই তো দু কাপ খেতাম। ডবল দামেই খেতে পারতাম। এমনকি, চারগুণ দাম দিতেও পেছপা ছিলাম না—চা-র এমনি গুণ।

কিন্তু এই গেয়ো লোকগুলো—একালে বাস করেও সেকেলে—সেসব কিছু বোঝে কি? যাতে দু পয়সা সাশ্রয় নগদা-নগদি আমদানি, তাতেই ওরা নারাজ।

নাঃ, এখনকার কারু দূরদৃষ্টি নেই। কেন যে লোক মরতে আসে এখানে? বেড়াবার কি আর–

কথাটা কল্পনাকে কটাক্ষ করেই বলা। পল্লী অঞ্চলে, পল্লী মায়ের আঁচলে হাওয়া খাবার সখ ওরই উথলে উঠেছিল হঠাৎ। এবং বলতে কি, যে-আমি এমন কলকাতাসক্ত, যাকে কলকাতার বাইরে টানা ভারী শক্ত ব্যাপার, প্রাণ গেলেও পাড়াগাঁর দিকে পা বাড়াইনে—সেই আমাকে একরকম তাড়িয়ে নিয়ে এসেছে যাদুরে।

–আর জায়গা পায় না? বাক্যটাকে উপসংহারে নিয়ে আসি। এবং বলতে, বলতে, পাড়াগাঁ-সুলভ-আরেক নম্বরের দূরদৃষ্টিহীনতা—পথভ্রষ্ট এক গাদা গোবরের ওপর পদক্ষেপ করে বসি। ঠিক বসিনি—তবে আরেকটু হলেই বসে পড়তে হতো, চাইকি ধরাশায়ী হওয়াও বিচিত্র ছিল না, কিন্তু হাতের কাছাকাছি কল্পনাকে পেয়ে পেয়ে গিয়ে, তক্ষুনি তাকে পাকড়ে, নড়বোড় করে কোনোরকমে দাঁড়িয়ে গেছি।

তোমার যে বাপু অদূরদৃষ্টিও নেই। বিরস-বদনে কল্পনা বলে। স্বামীর আশ্রয়স্থল হয়েও সে সুখী নয়। তার ব্লাউজের একটা ধার নাকি ফ্যাঁ—স করে গেছে।

ব্লাউজ উদ্ভিন্ন হওয়ার দুঃখ আমার মনে স্থান পায় না। আমার আত্মরক্ষাতেই আমি খুশি। তাছাড়া ভেবে দেখলে, কে কার? রাউজ তো আমার নয়। এবং ব্লাউজ ইত্যাদি বিসর্জন দিয়েও স্বামীরত্নদের যদি অধঃপতনের হাত থেকে বাঁচানো যায় (সাধ্বীদের অসাধ্যি কী আছে?) তা কি স্ত্রীজাতির কর্তব্য না?

বা রে। তুমি কি বলতে চাও যে আমি ইচ্ছে করে পড়তে গেছি? মানে, ঐ গোবরটার সঙ্গে চক্রান্ত করে–? ক্ষুব্ধ কণ্ঠে আমি বলি : এই কথা তুমি বলতে চাও?

যাও। এদিকে চায়ের তেষ্টায় প্রাণ যাচ্চে–তোমার ইয়ার্কি আমার ভালো লাগে না।

বাস্। আমি তো নেমেই চায়ের কথা তুলেছি। রেলওয়ে রেস্তোরাঁয় ঢুকতেই যাচ্ছিলাম—তুমিই বাধা দিলে।

আমাদের আগে আগে রেস্তোরাঁয় সেই মেয়েগুলো ঢুকলো না? মনে নেই তোমার?

হ্যাঁ, সেই অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান মেয়েরা? তাতে কী?

কী সব খাটো খাটো ফ্রক-পরা তাদের–দেখেছিলে তো?

দেখেছিলাম।

তুমি যে দেখেছিলে সেটা আমিও দেখেছি। লক্ষ্য করতে আমার দেরি হয়নি।–আর সেই কারণেই ওখানে যাওয়া ঠিক হবে না আমরা স্থির করলাম।

আহা? আহা। কল্পনার এই স্ব-গৌরবে বহুবচন—আমার ন্যায় নেহাৎ আ-স্বামীর পক্ষে এর জবাব আর কী আছে? তবুও আমতা আমতা করে বলতে যাই। কিন্তু ওরা তো বাঙালী নয়? মেম তো?

কিন্তু তা হলেও—তবুও তো অসময়ে চায়ের পিপাসা জেগে উঠতে তোমার কোন বাধা হয়নি।

তোমার ভারী সন্দিগ্ধ মন। আমার বিশ্বাস, দার্জিলিঙে গেলে তুমি আমাকে কাঞ্চনজংঘার দিকেও চোখ মেলে চাইতে দেবে না। আমাকে দেখছি সব সময়েই এভারেস্টের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতে হবে।

বলার সাথে সাথে, দৃষ্টান্ত-স্বরূপ, (দার্জিলিঙে না গিয়েই) এভারেস্টের প্রতি ভ্রূক্ষেপ করি। আমার চিরতমার আগাপাশতলা বারেক পর্যবেক্ষণ কবে নিই—এমনকি, অভ্রভেদী গিরিশৃঙ্গ (সম্প্রতি কুটিকামুক্ত) অব্দি বাদ যায় না। আগার দিক থেকেই আগাই-গোড়ায়।

ইয়ার্কি কোরো না, যাও! কল্পনা রাগ করে।

ইয়ার্কি হলো কোনখানে? ভেবে দেখলে তুমিই তো আমার, একাধারে, ইভ এবং রেস্‌ট,—আর দ্বিধামুক্ত হলেই-এক কথায় ঐ! ব্যাকরণমতে দাঁড়ায় এভারের সুপারলেটিভ! তাই নও কি? সাদা বাংলায় যাকে চিরন্তনী বলে গো!

কল্পনা কোনো জবাব দেয় না। কথাটা তলিয়ে দেখার চেষ্টা করে হয়ত বা।

অবশ্যি কবিতা করেও বলা যায় কথাটা। সাদা বাংলাতেই আজকাল কবিতা লেখা হচ্ছে কিনা! আমি দৃষ্টান্তের দ্বারা আরো প্রাঞ্জল করি : সুধীন দত্তের লেখা পড়েছো তো? পড়োনি?

খুব হয়েছে। আর ব্যাখ্যানায় কাজ নেই। এখন কোথায় চাখানা আছে একটু দয়া করে দেখবেন মশাই?

এভারেস্টের উচ্চতম চূড়া থেকে এভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলে বাক্যস্ফূর্তি কেন, সব ফুর্তিই লোপ পায়। আমিও আর উচ্চবাচ্য না করে চুপটি করে চলতে থাকি। ইতস্তুত-বিক্ষিপ্ত গোবরদের সন্তর্পণে বাঁচিয়ে, ছোটখাট খানাখন্দ, উঁচু-নীচু নীরবে অতিক্রম করে চলি।

একটু পরে কল্পনাই নিজের থেকে পাড়ে : তখন আমি এইজন্যেই বলেছিলাম যে টিফিন ক্যারিয়ার সাথে নিই। তুমিই তো না করলে। আনতে দিলে না আমায়।

আমিও না বলে পারি না: যত দোষ নন্দ ঘোষ!

এক বাক্যে, ঐ একটি মাত্র প্রবচনে, আমাদের অসন্তোষ ব্যক্ত করি—আমার আর নন্দ ঘোষের।

এবার ও গম্ভীর হয়ে যায়। বহুক্ষণ গুম-কোন কথাবার্তা নেই। আমাকে ব্যস্ত হতে হয় অগত্যা। আমার কি রকম যে স্বভাব-অপর কেউ গুম্ হলেই আমি যেন খুন হয়ে যাই। কোথায় আমার খুনসুটি লাগে, বুকের মধ্যে গুমরে ওঠে। ডিজিটালিস খেয়ে, এমন কি, গীতার সেই মারাত্মক শ্লোক আউড়েও কোনো ফল হয় না কিছুতেই এই ক্ষুদ্রং হৃদয়-দৌর্বলং কাটিয়ে উঠতে পারি না দেখা গেছে। মার্জনা-প্রার্থনার সুরে, মার্জিত স্বরে অনুতাপের আর্জি পেশ করি।

খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনে বিশ্বাস করাই ভুল হয়েছে। আমি ভেবেছিলাম যে কী বড়লোকের অট্টালিকায় আর কী ছোটলোকের হট্টমন্দিরে রাজপ্রাসাদেই কী আর পর্ণ কুটিরেই বা কী, বাংলার ঘরে ঘরে ভারতীয় চা আজকাল সমাদৃত হচ্ছে। এখন দেখা যাচ্ছে তা নয়—অন্তত ঠিক ততটা নয়।

টিফিন ক্যারিয়ারটা আনতে দিতে কী হয়েছিল? কল্পনার সেই এক কথা—প্রাচীন পরিকল্পনা।

থার্মোফ্লাসকে চাও আনা যেত। এখন তাহলে যেখানে হয় বসে পড়ে মজা করে পিকনি করা যেত কেমন?

আনতে দিতে আর আপত্তি কী ছিল, কেবল বইতে তোমার কষ্ট হতো বই তো  না–তাইতো বারণ করলুম। মানে—মানে আমারই হাত ব্যথা হয়ে যেত কি না শেষটায়,-কল্পনার বহন-নৈপুণ্যে আমি অতাব নাস্তিক্যবাদী।

টিফিন-ক্যারিয়ারের প্রস্তাবটা একধারে যেমন মুখরোচক, দূরদৃষ্টি আর বিচক্ষণতা-সহকারে চিন্তা করে দেখলে, অপরদিকে তেমনই ঘর্মাক্তকর-দিব্যদৃষ্টির সাহায্যে এই মর্মান্তিক ভবিষ্যৎ, পা বাড়াবার আগেই আমি পরিষ্কার দেখেছিলাম, কল্পনার কাছে এই অপরাধ এখন মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করি।

তুমি ভারী স্বার্থপর! ও বলে: নিজের হাত পার ওপর এত দরদ তোমার?

তা স্বার্থপর আমি একটু বইকি। ভূতপূর্ব আমার সেই ভবিষ্যৎ-দর্শন এবার আরো একটু স্পষ্ট করি : ভেরে দেখলাম এও তো হতে পারে, তুমি নিজেই অচল হয়ে পড়লে! হাঁটাহাঁটির বালাই তো নেই আমাদের। তখন এক হাতে টিফিন ক্যারিয়ার আরেক হাতে তুমি কোনটা সামলাই? আর, গ্রাম্য দৃষ্টিতেও সেটা খুব সুদৃশ্য নয়! এমনিতে হয়ত একটা বোঝা তত বেশি না—কিন্তু তার ওপরে শাকের আঁটি চাপালেই মাটি! ঐতিহাসিক উটের পিঠে চূড়ান্ত তৃণখণ্ডের মতোই দুঃসহ কাণ্ড! তা ছাড়া ছাড়া বিষয়টা আমি আরো খোলসা করি: দুটো বোঝা থাকলে হয়ত আমি দোনামোনায় পড়ে যেতাম। ওরকম অবস্থায় মানুষ অপেক্ষাকৃত হাই বেছে নেয় কিনা!

জানি জানি, আর বলতে হবে না। কল্পনা ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে: তুমি টিফিন ক্যারিয়ারটাই হাতে নিয়ে ট্যাং ট্যাং করে বাড়ি ফিরে যেতে আমি খুব জনি।

মোটেই না। আমি গম্ভীর ভাবে ঘাড় নাড়ি: আমি তোমাকেই নিতাম। টিফিন ক্যারিয়ারের চেয়ে মাউন্ট এভারেস্টই আমার কাছে বেশি হাল্কা মনে হতো। তাছাড়া, পর্বতচূড়া বইবার ভাগ্য কজনের হয়? হলে কজন সে সুযোগ ছাড়তে পারে? পুরাকালে সেই একদা শ্রীমান্ হনুমান এই মোকা পেয়েছিলেন—গন্ধমাদন-বহনের সময় কিন্তু তিনি—তিনিও যতই বোকা হন, হাতছাড়া করতে পারেননি।

হয়েছে হয়েছে, খুব হয়েছে। যেমন পুরাণ, তেমনি ইতিহাস, সবই তোমার নখদর্পণে—টের পেয়েছি বেশ। এখন কোথায় গেলে একটু চা পাওয়া যায় তা যে কেন তোমার মাথায় আসছে না, তাতেই আমি ভারী অবাক হচ্ছি।

দাঁড়াও না। এক্ষুনি একজন সদাশয় অতিথি-বৎসল আদর্শ গ্রাম্য লোকের দেখা পেলুম বলে। আমাদের দেখেই তিনিই আপ্যায়িত হয়ে অভ্যর্থনা করবেন—চা-তো খাওয়াবেনই, সেই সঙ্গে চিড়েমুড়কি-ঘোরো গোরুর খোড়ো দুধ—সমস্ত মিলিয়ে মিষ্টি একটা ফলারও বাদ যাবে না। শুনেছি পাড়াগাঁর ওরা নিরাশ্রয় বিদেশী লোক দেখলেই কোন কথা শোনে না, ধরে বেঁধে খাইয়ে দ্যায়।

সেসব দিন গেছে। কল্পনার হাহুতাশ শুনিঃ এসব দৈত্য নহে তেমন। দুঃখের চোটে, হেমচন্দ্র থেকে পঞ্চোদ্ধার করতেও সে বাকী রাখে না।

আচ্ছা, এইবার কাউকে দেখতে পেলে জিগেস করব। আমি বলি। মরিয়া হয়ে বলি।

দেখতে পেলে তো। কল্পনা বিশেষ সান্ত্বনা পায় না।

বাস্তবিক, এতক্ষণ ধরে, এতখানি পথ—এত গণ্ডা চষা এবং না-মা মাঠ পার হয়ে এলাম, দু-একটা গণ্ডগ্রামও যে না পেরিয়েছিল তা নয়, কিন্তু বাক্যালাপ করবার মতো একটা মানুষ চোখে পড়ল না। যাও বা এক আধটা আমাদের সীমান্ত প্রদেশ ঘেঁষে গেছে, তাদের চাষাভুষো ছাড়া কিছু বলা যায় না। চাষা কি আর চায়ের মর্ম জানে, চায়ের সোয়াদ চায়? তাকে চায়ের কথা জিজ্ঞেস করাও যা, আর কল্পনাকে চাষের কথা জিজ্ঞেস করাও তাই—একজাতীয় কল্পনাতীত ব্যাপার!

কিন্তু না, এর পর যে ব্যক্তিই সামনে পড়বে, তা সে যেই হোক, তার কাছেই চায়ের কথা পাড়ব। এ-গাঁয়ের চাষাই হোক আর ভুষোই হোক, প্রথম কথাই চায়ের কথা এবং চায়ের ছাড়া অন্য কথা না।

এবং পড়লও একজন সামনে!

তিনটে চষা ক্ষেত আর সিকি মাইল সরু আলের রাস্তা ডিঙিয়ে গিয়ে তার দেখা মিলল। গাছের মগডালে পা ঝুলিয়ে বসেছিল লোকটা। গাছের ডালে বসে থাকাটাই বোধ হয় এধারকার লতি ফ্যাসানট্যাকসোবিহীন আমোদ-প্রমোদ—এইরকম আমার ধারণা হয়েছে। যখনই কোনো গেঁয়ো লোকের প্রাণে ফুর্তির সঞ্চার হয়, সাধ হয় যে একটু হাওয়া খাই, অমনি সে খুঁজে পেতে বিলাসিতার নামান্তর সহনশীল একটা গাছ আবিষ্কার করে তার ডালে উঠে বসে থাকে।

এখানে চাখানা কোথায় বলতে পারো? বৃক্ষাশ্রী লোকটাকে আমি প্রশ্ন করি।

ও নামে কেউ এখানে থাকে না। পা দোলাতে দোলাতে সে জানায়। এবং তার কাছ থেকে কিছুতেই এর বেশি আর কিছু বার করা যাবে না। আমরা তাকে গাছের ডালে পরিত্যাগ করে আবার আমাদের ভূপর্যটনে বেরিয়ে পড়ি।

এর পরেই একটি তরুণী মহিলার সহিত আমাদের ধাক্কা লাগলো। মেয়েটি রাস্তার ওপরে বসে ধূলো-মাটি জমিয়ে বালির ঘর রচনায় ব্যস্ত ছিল—কি এমনও হতে পারে, মাটির বানানো পুলিপিঠেই বানাচ্ছিল হয়ত বা।

খুকি, শোনো তো? এখানে কোথায় চা পাওয়া যায়, জানো তুমি? কল্পনাই জেরা করে।

হ্যাঁ, জানি। খুকি তার সপ্রতিভ ছোট্ট ঘাড়টি নেড়ে তক্ষুনি জানায় আমাদের কেদার কাকু। কেদার কাকু চা ব্যাচে। কেদার কাকুর কাছে চলে যাও।

কোথায় থাকেন তিনি—সেই তোমাদের কেদার কাকু? এই গাঁয়ের শেষে—একেবারে শেষে গিয়ে।

খুকির ব্যবহারে এবং বুদ্ধিমত্তায় চমৎকৃত হই। তৎক্ষণাৎ পকেট হাতড়ে কে দুটো আনি ওর দু হাতে সঁপে দিই—সত্যি, পৃথিবীতে মেয়েরা না থাকলে—এই স উপাদেয় প্রাণীরা আজো না টিকে থাকলে আমরা দাঁড়াতাম কোথায়?

তারপর—চলেছি তো চলেইছি। যে-গাঁয়ের অবশেষে কেদার কাকুর উপনিবেশ সে গাঁ আর আসে না। এক মাইল হাঁটাহাঁটির পর আমি বলি : এতখানি পথ পেরিয়ে এলাম, এতক্ষণে তো সে গ্রামে আমাদের পৌঁছানো উচিত ছিল।

আমিও সেই কথাই ভাবছি। কল্পনাও ভাবিত হয়েছে দেখা যায় : আরো কতোদূরে গ্রামটা, এসো, ঐ বুড়ো লোকটাকে জিজ্ঞেস করে জানা যাক।

আমাদের প্রশ্ন শুনে বুড়ো লোকটি আকাশ থেকে পড়লেনঃ সে-গ্রাম তো তোমরা পেছনে ফেলে এসেছ বাপু! আনমনা হয়ে ছাড়িয়ে এসেছ, তাই তোমাদের নজরে পড়েনি।

বুড়ো লোকটি ভারী অবাক হয়ে যান—এবং আমরা—ততোধিক অবাক হই।

যাই হোক, ফিরে চলি আবার—এবারে দুধারে খর-দৃষ্টি চালিয়ে যাই—দুজনেই কড়া নজর রাখি—যাতে ফের আবার কোনো গতিকে না ফসকে যায় গ্রামখানা।

আমার-আমার মনে হচ্ছে এইটাই বোধ হয় সেই গাঁ। পথিমধ্যে থেমে পড়ে কমনা আপন সংশয় ব্যক্ত করে।

এটা যদি এদের গ্রাম হয়— আমি বলি–তাহলে পর্ণ কুটির বলতে এরা কী বোঝে তাই আমি জানতে চাই।

আমরা কুটির ওরফে সেই পল্লীগ্রামের দ্বারে গিয়ে ঘা মারি। দরজা বলতে বিশেষ কিছু ছিল না-দরজার পাঠান্তর সেই নামমাত্র একটি যা ছিল তার ওপরে করাঘাত করতে হলে যথেষ্ট সাহসের দরকার—কেননা তার ফলে গ্রাম-চাপা পড়বার দস্তুরমতই আশঙ্কা ছিল।

কল্পনার হারমোনিয়াম বাজিয়ে অভ্যেস–সে-ই করাঘাতের দায়িত্ব নেয়। আমি গ্রামের আওতা থেকে সরে দাঁড়াই। কাপুরুষতার জন্যে না, দৈবাৎ যদি একজন গ্রামের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে নিমজ্জিত হয়—তাহলে তাকে সেই গ্রাম্য সমাধির কবল থেকে উদ্ধার করতে, নিতান্ত না পেরে উঠলে সেই গ্রামেই সমাধি দিয়ে ফিরতে আরেক জনের থাকা দরকার।

করাঘাতে একটু পরেই, গ্রাম ভেদ করে—কিংবা গ্রামান্তর থেকে একটি বুড়ো লোক বেরিয়ে আসেন।

কেদারবাবু এখানে থাকেন কোথায় বলতে পারেন দয়া করে? দুজনেই যুগপৎ জিগেস করি : কেদারবাবু ওরফে কেদারকাকু?

আমিই কেদারকাকু।

ও, আপনিই! যাক, বাঁচিয়েছেন। আমি উৎসাহিত হয়ে উঠি: গাঁয়ের ওরা বললে আপনি নাকি—মানে আপনার নাকি—মানে—আপনার এখানে কিনা—

কী করে কোন ভাষায় যে চায়ের নেমন্তন্নটা অযাচিতভাবে গ্রহণ করবার সুযোগ নেব ভেবে পাইনে।

আপনি নাকি মনে করলে আমাদের একটু চা খাওয়াতে পারেন। কল্পনার কিন্তু বলতে দেরি হয় না। প্রাণকাড়া একখানা হাসি হেসে চোখ ঘুরিয়ে কথাটা বলে দ্যায়।

বাস্তবিক, অদ্ভুত এই মেয়েরা! ভাবলে চমক লাগে! সত্যি, পৃথিবীতে এরা না থাকলে অব্যর্থ আমরা গোয় যেতাম।

কেদার কাকু নিজের দাড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে প্রকাশ করলেনঃ ও—হ্যাঁ–তা ওরা ঠিকই বলেছে। কিন্তু চা আমার পুরোণো খুব। তিন মাসের মধ্যে নতুন চা আসেনি—জেলায় আর যাওয়া হয়নি কিনা। কিন্তু চা তৈরির তো কোনো পাট আমার নেই। এমনি ছটাক খানেক দিতে পারি—অরই রয়েছে। পাঁচ আনা লাগবে কিন্তু।

আপনি–আপনার এখানে চা তৈরি হয় না? কল্পনার তারস্বর—হতাশার সুরে মেশানো।

আমার এটা মুদির দোকান—চায়ের আড্ডাখানা না! কেদার কাকুর বিরক্তিম মুখ থেকে বেরিয়ে আসে। পাঁচ আনা দিয়ে আধ ছটাক চা-র একটা প্যাকেট বগলদাবাই করে আমরা সেই গ্রামের দ্বারদেশ থেকে ছিটকে বেরুই। এবং আবার আমাদের অভিযানে বেরিয়ে পড়ি।

 

তারপর কত যে হাঁটি তার ইয়ত্তা হয় না—স্টেশনের দিকেই হাঁটবার চেষ্টা করি। কিন্তু বিভিন্ন পথিকের বিবৃতি থেকে যা টের পাই তার থেকে এহেন ইষ্টিসন-বহুল গ্রাম যে ভূপৃষ্ঠে আর দুটি নেই এই ধারণাই আমাদের হতে থাকে। এখান থেকে–পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ-যেদিকেই যাই না কেন একটা করে স্টেশন পাবো—অচিরেই পেয়ে যাবে—দশ বিশ মাইলের মধ্যেই পাওয়া যাবে তাও জানা গেল। এমনকি, সরাসরি নাকের বরাবর নৈশৃং কোণ ধরে চলে গেলেও আর একটা নাকি পেতে পারি, সেরকম সম্ভাবনাও রয়েছে। অতএব কোনদিকে যাওয়া শ্রেয় হবে স্থির করতে না পেরে, অস্থির হয়ে আমরা দিঘিদিকে চলতে শুরু করে দিলাম।

চলতে চলতে হঠাৎ এক অভাবনীয় দৃশ্য আমাদের চোখের সামনে উদঘাটিত হলো। পার্শ্ববর্তী ছোট্ট একটি আমবাগানের ছায়ায় দুটি হেলে-স্কুল-পালানো বলেই সন্দেহ হয়—পিকনিকের আযোজনে মশগুল বয়েছে।

সুচারু একটি পিকনিক! স্টোভে খিচুড়ি চাপানো হয়েছিল প্রায় শেষ হয়ে এল বলে—ভুরভুরে তার স্টে চারিদিক আমোদিত। পেঁয়াজ ছাড়ানো। ছোট বড় গোটাকতক ডিম কাছাকাছি। ডাগডি যাচ্ছে—খিচুডির সাথে আমলেটেব যোগাযোগ হবে আন্দাজ করা কঠিন নয়।

ঘেসো জমির ওপর খবরের কজ বিছানো হয়েছে। তার ওপরে ঝকঝকে চিনেমাটির প্লেট—খিচুড়ির আবির্ভাবের প্রতীক্ষায় সেজেগুজে বসে।

আহা! আমার জিভে জল এসে যায়। চাযের তেষ্টা তো ছিলই, তার ওপরে খিদেও পেয়েছিল বেশ।

এক প্লেট খিচুরি পেলে মন্দ হতো না। এই কথাটা স্বগতোক্তির নেপথ্যেই রেখে দি।

চায়ের কাপও রয়েছে দেখেছে!কল্পনা দেখিয়ে দ্যায়। তাবা মনে, চায়ের আয়োজনও হয়েছে ওদের বলতে গিয়েও মুখ ফুটে বলতে পারে না ও—মনের মধ্যেই চেপে রাখে। ওর জিভের খবর বলতে পারি না, তবে ওই কথাটাই ওব নখ চোখে উম্মুখর হয়ে—ভরপুর হয়ে উঠেছে, দেখতে পাই।

খবরের কাগজের ওপরে আরো কী কী যেন ছিল—আচার, আমসত্ত্ব, পাঁপড়, হানার মণ্ডা, মাখন এবং আরো কী কী সব-পাশ দিয়ে যাবার সময়ে, ঝুকে পড়ে, খুঁটিয়ে দেখবার আমি চেষ্টা করি—দেখেই যতটা সুখ। কল্পনা আমাকে এক হ্যাচকা লাগায়। চলে এসো! ছিঃ! ওকি? হ্যাংলা ভাববে যে!

অবশ্যি, দেখতে পায়নি। হেলে দুটি খিচুড়ি নিয়েই মত্ত। তাহলেও কল্পনাই ঠিক। পরের খিচুড়ি এবং ইত্যাদি—পরকীয় যা কিছু, চেখে দেখার আশা নেই তা শুধু শুধু চোখে দেখে লাভ? সুধা দেখলে কি আর ক্ষুধা মেটে?

পরদ্রব্যেষু লোষ্ট্রবৎ করে ফের আমরা রওনা দিই। কল্পনা আমাকে বকতে বকতে যায় তোমার ভারী পরের জিনিসে লোভ! বিচ্ছিরি! কেন, আমি—আমি তো একটুও লালায়িত হইনি।… সুরুৎ করে জিভের ঝোল টেনে নিয়ে সে জানিয়ে দেয়।

আমবাগানটা পেরুতে না পেরুতেই বিরাট এক চিৎকার এসে পৌঁছয়। আওয়াজটা আমাদের তাড়া করে আসে। আমরা দাঁড়াই, সেই হেলেদুটিই দৌড়তে দৌড়তে আসছে।

আপনাদের পিছু ডেকে বাধা দিলুম, কিছু মনে করবেন না। ওদের একজন কিন্তু-কিন্তু হয়ে বলে: দেখুন, আমরা ভারী মুস্কিলে পড়েছি—পিকনিকে সমস্ত আনা হয়েছে, কেবল চায়ের প্যাকেটটা আনতে ভুলে গেছি। অথচ, সব কিছু হলেও, চা ছাড়া কি পিকনিক জমে, বলুন তো?

অপর ছেলেটি শুরু করে পাশের জেলা থেকে বেড়াতে এসেছি—এখানকার দোকান হাট কোথায় কিছু জানিনে। কোথায় গেলে চা কিনতে পাওয়া যাবে, মুদিখানা কিম্বা মনোহরী দোকানটা কোন ধারে বলে দেবেন দয়া করে?

মুদিখান। এখান থেকে ঢের দূর। প্রায় একখানা গ্রাম জুড়েই একটা মুদিখানা। আমি বলিঃ কিন্তু তার দরকার কী, আমাদের সঙ্গেই এক প্যাকেট চা আছে—ইচ্ছে করলে নিতে পারো—স্বচ্ছন্দেই।

দেখেছিস! একটি ছেলে জ্বলজ্বলে চোখে আরেকটির দিকে তাকায়। একেই বলে বরাত—দেখলি তো। কী বলেছিলাম? ধন্যবাদ। আপনাদের কী বলে যে ধন্যবাদ দেব বলতে পারি না। তা—তা এর দাম কতো?

ও-না না। সে তোমাদের দিতে হবেনা।আমি হাত নেড়েকথাটা উড়িয়ে দিই—প্রায় মাছি তাড়ানোর মতই।

এবং এর পর—এর পর আর ওদের কী করবার ছিল? নিতান্তই যা ছিল তা না করে উপায় ছিল না। এবং পর পর অনিবার্যরূপেই মিনিট দশেক বাদে সবাই আমরা, সেই ভূপতিত খবরের কাগজকে ঘিরে খিচুড়ির চার পাশে জমায়েত হলাম।

মাখম-মাখানো আলু-সফুল গন্ধ-ভুরভুরে গরম গরম সেই খিচুড়ি, অমলেটের সাহায্যে কী তোফাই যে লাগলোতা আর বলবার নয়। তার সাথে মাঝে মাঝে চাটনি——পাঁপড়ের টুকরো—আচারের টাকরা—প্রভৃতিরা—আর অবশেষে, সবশেষে চা, আহা,–বলাই বাহুল্য।

সেদিন রাত্রে বাড়ি ফেরার পর কল্পনা বলল : বলতে গেলে হয়তো তুমি ছোটলোক বলবে! কিন্তু আমাদের চায়ের বাকীটা, সেই প্যাকেটটা, সঙ্গে নিয়ে আসা উচিত ছিল। প্রায় আধ-পোটাক চা–পাঁচ আনা দাম তো।

সংসারে ফিরে এলে উচ্চ নজরও তুচ্ছ খবরে নেমে আসে। সংসার এমনিই! তাছাড়া, তিল কুড়িয়েই তাল, তে কি। এবং যে সব তিলোত্তমাকে সেই তাল সামলাতে হয় তাঁরাই জানেন।।

পকেট থেকে বার করে বিনাবাক্যব্যয়ে চায়ের প্যাকেটটা ওর হাতে তুলে দিই।

কিন্তু এতো —আমাদের কেনা চায়ের প্যাকেট নয়। …একি? …য়্যাঁ? ১/৩ বিস্মিত, ১/৩ বিমুগ্ধ, ১/৩ বিরূপ দৃষ্টিতে আমার দিকে সে তাকায়।

এ ছাড়া—ভেবে দ্যাখো—ওদের পিকনিকে যেগ দেবার আর কোনো উপায় ছিল। আর তুমি—তুমিও চা চা করে যেমন চাতকের মত হয়ে উঠলে–কী করব?

কৈফিয়তের সুরে আমি বলি : আর তোমার জন্যে—বলো–কী না আমি করতে পারি?

সহধর্মিণীর জন্যে লোকে সহনীয় অধর্ম তো করেই, করে থাকেই, অসহনীয় ধর্মাচরণেও পেছপা হয় না—আমি আর এমন কী বেশি করেছি? দস্যু রত্নাকরের খুনসুরি থেকে শুরু করে তাজমহল স্রষ্টার প্রিয়তমার কর-ই রচনা—অহো। আগাগোড়া সব জড়িয়ে শেষ পর্যন্ত আমার নিজের জ্বাজ্বল্যমান উদাহরণে এসে পৌঁছব—জবাবদিহির এই সব পাচ মনে মনে ভাঁজছি, কল্পনা আমার চিন্তাশীলতায় বাধা দেয় : অবশ্যি, চায়ের জন্যে কী না করা যায়! তা ঠিক। কিন্তু তা বলে এতটা—এতদূর–কূটনৈতিক ভাষায় কুলিয়ে উঠতে না পেরে অবশেষে ও স্পষ্টবাদী হয়ে পড়ে : য়্যাঁ? শেষটায় চুরি-চামারিও তুমি বাদ দিলে না। ছি ছি!

দ্যাখো, আর যাই বলো চুরি বলো না! ক্ষোভার্ত কণ্ঠে আমি বলি : চামারি বলতে পারো ইচ্ছা করলে।… কিন্তু যারা দুবেলা চা মারে তাদের আর চামার হতে বাকী কী?

হাতসাফাইটা করলে কখন শুনি? অবাক লাগছে আমার!

সেই যখন ঝুঁকে পড়ে খবরের কাগজের ওপরে সমবেত খাদ্য-তালিকাদের দেখছিলাম, সেই সময় ওদের এই চায়ের প্যাকেটটাকে অসহায় অবস্থায় পেয়ে—প্রথম দর্শনেই–

যাও যাও, আর বলতে হবে না। ছি ছি! কল্পনা কানে আঙুল দ্যায়।

০৭.

বিটকেল আওয়াজে সেদিন সকালের ঘুম ভাঙল। আওয়াজটা পিছনের বাগান থেকে লাফিয়ে উঠে শোবার ঘরের জানালা ভেদ করে বর্শার মত আমার কর্ণমূলে এসে বিঁধল। কল্পনার তারস্বর তাতে ভুল নেই, কিন্তু কতটা বীরত্বঘটিত হলে তা তীরস্বরে পরিণত হতে তার কল্পনাতেও কোনদিন ছিল না। সেই মুহূর্তে স্বকর্ণে স্পষ্ট প্রত্যক্ষ করা গেল।

এবং শুধু কাল্পনিক কণ্ঠই নয়, সেই সঙ্গে সম্মিলিত হয়ে আরেক কেকা-ধ্বনি! আনকোরা অচেনা গলার কক কক। সঙ্গে সঙ্গে নীচের ঘরে সশব্দে দরজা বন্ধ হওয়ার খবর পাওয়া গেল। তারপর সব চুপ।

তীরস্বর শুনেই, কল্পনা ধনুর্ধারের মত কিছু একটা করছে টের পেয়েছিলাম। জানালা খুলে মাথা বাড়িয়ে খোঁজ নিলাম।

কার সঙ্গে আলাপ করছিলে গা?

একটা পাখি ধরেছি। কল্পনা ব্যক্ত করল।

পাখি? কী পাখি?

দেখে যাও এসে। পুরে রেখেছি আমাদের বোটুকখানায়। নামলাম নীচে। কল্পনা খুব সাবধানে বৈঠকখানার দরজা দেড় ইঞ্জিটাক ফাঁক করল। সাহস বুকে বাঁধতে হলো আমায়। কে জানে,একটা ঈগল কি উটপাখিই হবে হয়ত; তাড়া করে আসে যদি? যতদূর সম্ভব সতর্কতা অবলম্বন করে সেই দেড় ইঞ্চি যকের ভেতর দিয়ে আধ ইঞ্চি দৃষ্টি চালিয়ে দিলাম। বহু চেষ্টার পর, টেবিলের আড়ালে, আমার গদি আঁটা স্মোরে উপবিষ্ট পাখির মত চেহারার একজন আমার চগোচর হলো।

পাখির মত হাবভাব, কিন্তু পাখি কিনা নিশ্চয় করে বলা শক্ত। পাখির মত চেহারা, পাটকেলের মত রঙ (হঁটের মতও বলা যায়), হাতলের তলা দিয়ে প্যাট প্যাটু করে আমার দিকে চাইছে। ভারী বিরক্ত চাউনি। আর জলের কলের দম বন্ধ হলে যে রকম বকুনি বেরয় অনেকটা সেই জাতীয় ব-ব-নিনাদ!

কী পাখি? জিজ্ঞেস করল কল্পনা।

সূক্ষ্মদৃষ্টির সাহায্যে যতটা পারা যায়, পক্ষী-আকারকে আমি মনে মনে পরীক্ষা করলাম। পাখি বলেই তো বোধ হচ্ছে। আমি বল্লাম। উড়ে এসেছিল, না কি?

প্রায় উড়েই এল বইকি। জবাব দিল কল্পনা : কিংবা কেউ ছুঁড়ে দিল যেন। বোকেন বাবুদের বাগানের দিকটা থেকে এল?

দ্যাখো, এখানে আমরা ফেরারী হয়ে এসেছি। আমার প্রখরদৃষ্টির খানিকটা পাখির থেকে টেনে কল্পনার মুখে নিক্ষেপ করি। এখনো এখানকার সকলের সঙ্গে ভালো পরিচয় হয়নি। এস্থলের ইতরভদ্র প্রাণীদের কে কী ধরনের কিছুই জানিনে। এমতাবস্থায় সম্পূর্ণ অপরিচিত কাউকে নিজেদের ঘরে আশ্রয় দেয়া কি ঠিক হবে? চোখ কান ঠুকরে নেয় যদি?

বাস্তবিক, ইভ্যাকুয়েশনে আসা আর খুন করে পালানো আসামীতে কোনো প্রভেদ নেই। কারো তারা প্রতিভাজন না। সবাই তাদের বিষ নজরে দ্যাখে। স্থানীয় বাজার-দর বাড়ানোর কারণ বলে বাজারের কারো কাছে তাদের আদর নেই। এমনকি, ওই পাখিটা পর্যন্ত দ্যাখো না, দুই চোখে বিদ্বেষ উদগীরণ করছে! ভেবে দেখলে, বোমার ভয়ে কলকাতা থেকে পালিয়ে শেষে এই বিভঁয়ে এসে বুননা পশুপক্ষীর গর্ভে যাওয়া কোনো কাজের কথা বলে আমার বোধ হয় না। অপরের জিতে নিজের স্বাদ গ্রহণ খুব উপাদেয় নয়,

অন্ততঃ নিজের জিভে অপরকে আস্বাদ করার মত ততটা নয় বলেই আমার আন্দাজ।

ধরো যদি কোনো রকমের বুনো হাঁস টাস হয়? ডিম পাড়ে যদি? কল্পনা নিজের পরিসীমা বাড়ায়। এখানে তো কিছুই মেলে না। খাদ্য-সমস্যাটা কিছুটা তো মিটতে পারে তাহলে?

বলতে কি এই জন্যেই ওকে আমি এত ভালবাসি। আমার বুদ্ধির অভাবের কিছুটা ওর দ্বারা মোচন হয়। আমার বোকামির ও ক্ষতিপূরক। আমার অনেকখানি প্রতিষেধক, বলতে কি!

আমার যেসব বন্ধু নামজাদা মেয়েদের বিয়ে করেছিল, যারা সান্ত্বনা, মেহ, সুষমা বা লাবণ্যলাভ করেছিল, তৎকালে মনটা একটু, খুঁতখুঁত করলেও এখন আর সে বিষয়ে আমার কোনো ক্ষোভ নেই। সেই সব স্নেহধন্যরা সুখে থাকুন। তাঁদের নিজেদের সুরম্য উপত্যকায় বিরাজ করুন আনন্দে। সেই সান্ত্বনাদাতাকেও (যিনি মুখেই খালি সান্ত্বনা দিতেন, সত্যিকার সান্ত্বনা যাঁর কাছ থেকে কোনোদিন পাইনি) অকাতরে আমি এখন মার্জনা করতে পারি। এমনকি, আমার যে-বন্ধুটি কেবল বিয়ের দৌলতেই প্রতিভাবান বলে বিখ্যাত হয়েছেন (হতে বাধ্য) তাঁর প্রতিও আমার আর ঈর্ষা নাই। কল্পনাপ্রবণ হয়েই বেশ আমি আরামে আছি।

কল্পনার তারিফ করতে হয়। ডিমের দিকটা আমার একদম খেয়াল হয়নি। ভাবনার দিকটাই ভেবেছি। সম্ভাবনার দিকটা ঠাওর হয়নি। কি হবে, ওর মত অমন মর্মভেদী দৃষ্টিভঙ্গি আমার কই?

থাজ তাহলে। কিছু পাড়ে কিনা, দেখা যাক। আমি বল্লামঃ ওই বোটুকখানাতেই বসবাস করুক। আমাদের বোটুকখানায় এইতো প্রথম এখানকার সামাজিক পায়ের ধূলা পড়লো!

বিকেলে স্টেশনে বেড়াতে গিয়ে বোকেনের সঙ্গে দেখা। (মফঃস্বলে স্টেশনই হচ্ছে একমাত্র গম্যহল—ঠিক রম্যস্থল না হলেও—ওছাড়া আর চড়বার জায়গা কই? সেখানে ঢাকুরিয়ার মত লেক নাস্তি, অন্ততঃ বর্ষাকাল না এলে দেখা যায় না, কাজেই সুন্দর মুখ দেখতে হলে রেলগাড়িরই শুধু ভরসা। তাছাড়া, থিয়েটার যাত্রা সিনেমাও দুর্লভ রেলগাড়ির প্রবেশ ও প্রস্থানেই যা কিছু যাত্রা ইত্যাদি নজরে পড়ে।)

বোকেন আমার দিকে কুটিকুটিল হয়ে তাকিয়ে থাকল খানিক। তারপর মুখভার যারপরনাই কঠোর করে আমার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ল যেন আমার বন্য কুকুট কোথায়?

বন্য কুকুট? আমি বোকা সাজলামঃ বন্য কুকুট আবার কী হে?

ন্যাকা! ওসব ইয়ার্কি চলবে না। আমার বালিহাঁসটাকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছ বলো।

যখন এইভাবে আমার প্রতি লালবাজার-সুলভ-জেরা চলছে ঠিক সেই মুখে যতীন এসে হাজির। তার মুখেও কেমন একটা সন্দিগ্ধ ভাব।

তোমাদের বালিহাঁসের কথায় মনে পড়ল। তোমরা কেউ আমার সখের পারাবতটিকে দেখে? বল্ল সে।

পারাবত? তার মানে? পারাবত তো পায়রা। আমিও না বলে পারি না? মোটেই পায়রার মতো দেখতে নয়।

যতীন আর বোকেন—দুজনেই চোখ কুঁচকে আমার দিকে তাকায়।

নয়ই তো। যতীন একমুখ হাসি এনে ফ্যালে : উড়ে এসে জুড়ে বসলে হয় পায়রা; আর গৃহপালিত হলে হয় কপোত। গৃহকপোত বলা হয়ে থাকে শোনোনি! সেই বস্তুই বাইরে পাওয়া গেলে পারাবত। এই বেড়ালই বনে গেলে বনবিড়াল হয় যেমন হে!

কক্ষনো তা নয়। তোমার বন্যকুকুটও না…আর…আর তোমার বুনো পায়রাও নয়। সারস পাখি আমি কখনো চোখে দেখিনি, যদি হয় তাহলে তাই।

ধরা পড়ে যাবার পর আর পিছিয়ে আসা যায় না। সাফাই দিতেই হয়। তবে যদি বন্য সারস হয় তো বলতে পারি নে। সেই সঙ্গে এটুকুও অনুযোগ করি—বুননদের, সঙ্গে তো এইখানেই আমার আলাপ।।

ওদের গোয়েন্দা-মার্কা চাউনি তখন পরস্পরের ওপরে পড়েছিল। পরস্পরকে সন্দেহ করছিল ওরা। উভয় পক্ষ থেকেই বিপক্ষতার কোনো ত্রুটি হোততা না, মুখোমুখি থেকে হাতাহাতি পর্যন্ত গড়াত কিন্তু সেই মুহূর্তে একটা ট্রেন এসে পড়ে বাধা দেয়ায় লড়াইটা থেমে গেল।

কুরুক্ষেত্র থেকে আমরা ধর্মক্ষেত্রে চড়াও হলাম। সন্ধি করে ফেলাম। সকলের জবানবন্দী জোড়াতালি দিয়ে জানা গেল, যতীন ঐ পাখিটকে কাল, সন্ধ্যায় তার বাগানে উকি মারতে দেখেছিল। তার ধারণায়, পাখিটাও আমাদের মতই পলাতক, তবে ধারে কাছের নয়, সুদূর থেকে আসা, বৰ্মা মুলুকের আমদানি হওয়াই সম্ভব। আর বোকেন আজ সকালে পা টিপে টিপে তার বাগানের সীমান্তে পৌঁছে পাখিটাকে প্রায় ধরে ফেলেছিল আর কি, সেই সময়ে পাখিটা কেমন করে তার হাত ফসকে (পাখোয়াজির কোথাও গলদ ছিল নিশ্চম) বেড়া টপকে আমাদের এধারে এসে পড়ে।

একজনের প্রথম দর্শন, অন্যজন থি-ফোর্থ ধরে ফেলেছিল, আরেক জনের কাছে ধরা দিয়েছে—অধিকারসূত্রের এরকম ঘোরপ্যাচে—পাখিটা আপাতত আমার আস্তানাতেই বাস করবে স্থির হলো।

বাড়ি ফিরে জানলাম কল্পনা ইতিমধ্যেই ওর নামকরণ কবে ফেলেছে। মীনাক্ষি। নামটা খুব অযথা হয়নি। প্রথম দেখা থেকেই ওর চাউনিতে, বিশেষ করে আমার প্রতি ওর হাবভাবে বিজাতীয় একটা মীনে আমি লক্ষ্য করেছি। মিনেসিং সামথিং, ভাষায় ঠিক তার প্রকাশ হয় না। মীনাক্ষি বললেই ঠিক হয়।

ওকে আমাদের খাবার ঘরে এনে রেখেছি। কল্পনা বল্ল : বোটুকখানায় ভারী একা একা বোধ করছিল বেচারা।

তা; বাগানে কেন ছেড়ে দিলে না? নিজের মনে বেড়িয়ে বেড়াতো।

বাগানে? আমার সাহস হয় না বাপু। কেউ যদি নিয়ে পালায়?

সে কথা ঠিক। এ যা কগান! বাড়ি ভাড়া করেই একটা বাগানবাড়ি পেয়ে গেছি বটে বাগানটা ফাউয়ের মধ্যেই—তবে এ-অঞ্চলে বাড়িমাত্রই বাগানবাডি। চারধাবে ঘেরা বেড়া দেয়া থাকলেও, এসব বাগান তৈরি করা না স্বয়ংসৃষ্ট বলা কঠিন। ঝোপ-ঝাড়-জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে এক একটা মনুষ্যাবাস। তার ভেতরে কোনোটা বাংলোপ্যাটার্ণ কোনোটা একতালা, কোনোটা বা আটচালা, কদাচিৎ একখানা দোতালাও। কিন্তু এগুলো যে কিসের বাগানবাগানের কোষ্টা যে-কী গাছ তার ঠিকুজি ঠিক করা আমার পক্ষে বাতুলতা। পত্র-পাঠ গাছ চেনা আমার অসাধ্য (প্রকৃতিরসিক আমাদের বিভূতি বাড়জ্যে মশাই-ই শুধুতা পারেন)—গাই আমার কাছে ওষুধের মতোই—সেই রকম ত্যাজ্য এবং কেবল ফলেন পরিচয়তে। গাহের কর্মফল না দেখে এবং স্বয়ং ফলভোগ করে কিছুতেই গাছ-চিনতে পারি না। কিন্তু এসব গাছের ফল দেখব তার যো কি?। তলায় পড়া দূরে থাক, গাছেই ভালো করে ধরতে পায় না—পাড়ার ছেলেরা এসে দেখতে না দেখতে ফাঁক করে দেয়। গাছে গাহেই তাদের ফলা, এসব বাগান হচ্ছে মা ফলেষু কদাচন। একমাত্র গীতার কর্মযোগী ছাড়া আর কেউ যে অস্মিন্ দেশে বাগান করার উদ্যোগ করে না তা নিশ্চয়। এখানে হচ্ছে একজনের বাগান এবং আর-সবার বাগাননা। এ বাগানে যদি পাড়ার ছেলেরা এসে এই বেপাড়ার পারাবতকে একলাটি ঘুর ঘুর করতে দেখে তাহলে যে এক মুহূর্ত ছেড়ে কথা কইবে না সে কথা খাঁটি।

খাবার সময়ে দেখা গেল মীনাক্ষি অতিশয় অবজ্ঞাভয়ে রেডিয়োর ওপরে বসে রয়েছে। আক্রমণাত্মক কোনো লক্ষণ ওর দেখা গেল না। যতুটা মারাত্মক ভাবা গেছল তা নয়; নিতান্তই নিরীহ একটি বন্য পারাবত! (পারাবত বা যাই হোক!) ক্রমেই দেখি মীনাক্ষি এগিয়ে এসে আমাদের থালার থেকে খাবার খুঁটে নিতে লাগল।

দেখতে দেখতে আমরাও মীনাক্ষির আসক্ত হয়ে পড়লাম। দ্বিতীয় দিনেই অদ্বিতীয় পাখিরূপে আমাদের জীবনে কায়েম হলো। একটা বুনো সারস (অথবা বালিহাঁস যাই হোক)–যদিও কিঞ্চিৎ মনমরা—তবু গার্হস্থ্য জীব হিসাবে নেহাত মন্দ না। আর যাই হোক, যখন তখন ঘেউ ঘেউ বা ম্যাও ম্যাও নেই, কাউকে ধরে কামড়াবে না, কিংবা পাড়াপড়শীর বাড়ি গিয়ে চুরি করে দুধ মেরে আসবে না। পাড়াতুত গণ্ডগোল ল্যাজে বেঁধে আনবে না। একটা কক্ষকে আওয়াজ আছে বটে কিন্তু বকবক কম করে। তেমন বক্তা নয়, গানের আপদ নেই, শ্লোগানের বালাইও না।

পাখিটার আমরা প্রেমেই পড়ে গেলাম, বলতে কি! আমাদের পোষ্যকন্যারূপে ওকে গ্রহণ করারও প্রায় মনস্থ করে বসেছি এমন সময়ে বোকেন আর যতীনেব তরফ থেকে বাধা এল।

বোকেন এসে বললে : বাঃ বাবা! খাসা চালাচ্ছো! দিব্যি একটা খরচ বাঁচিয়ে ফেল্লে! বেশ বেশ বেশ!

ডিমের ভাবনা রইলো না। মন্দ কি। যতীন যোগ দিল সেই সঙ্গে।

তুখোর ছেলে! তবে একটু চশমখোর, এই যা! বোকেনের বক্র কটাক্ষ।

তোমরা বল কী? আমি আকাশ থেকে পড়ি।

বলব আর কী! ভাগ্যবানের ডিম ভগবানে যোগায়। তবে কথাটা এই, অপরের সম্পত্তি থেকে যোগানটা আসছে এই যা!

ডিম? আমার চমক লাগে : তোমাদের কি ধারণা যে–

আরে না না! বোকেনের ঠাট্টার সুর : তুমি কি আর ডিমের লোভে-কে বলে! তোমার দাতব্য অতিথশালায় গৃহহীন বন্য কুক্কুটরা এলে অমনিই আশ্রয় পায়।

গার্হস্থ চিড়িয়াখানা বলো। বলল যতীন। এদের দুজনকেই বা বাদ দিচ্ছ কেন?

এই রকম দিনের পর দিন ওদের কচকচি শুনতে হয়, অথচ মীনাক্ষি এদিকে একদিনও একটা ডিম পাড়েনি। ডিম তো পাড়েনি, তার ওপরে কদিন থেকে এমন মেজাজ দেখাতে আরম্ভ করেছে যে আমরা আর ওকে তালা দিয়ে রাখতে চাই না বরং তালাক দিতে পারলেই বাঁচি। এমন স্বার্থপর আত্মসর্বস্ব একগুয়ে পাখি এর আগে আর আমার নজরে পড়েনি—মনুষ্যত্ব দূরে থাক, পক্ষীত্বের লেশমাত্রও ওর নেই।

আজকেও ডিম পেড়েছে তো? এই প্রশ্ন মুখেকরে একদা প্রভাতে যেইনা বোকেনের প্রাদুর্ভাব, অমনি না আমি অম্লানবদনে মীনাক্ষিকে ওর করকমলে সম্প্রদান করে দিয়েছি। যতীনকে সাক্ষী করে।

এবং গদগদ কণ্ঠে বলতেও দ্বিধা করিনিঃ তোমাকে ঘরজামাই করতে পারলুম না, দুঃখ থাকল কিন্তু এই আমার অনুরোধ, আমাদের মীনাক্ষিকে তুমি সুখে রেখো। আর মীনাক্ষি মাকেও বলি, ও তোমার জন্য নিত্য নিয়মিত ডিম পাডুক।

ডিমের ওর বাড়-বাড়ন্ত হোক, সর্বান্তঃকরণে সেই প্রার্থনা করে মীনাক্ষিকে ওর সমভিব্যাহারে দিলাম। এবার ওর সুর বদলায় কিনা দেখা যাক। দিনকয়েক গেল, বোকেনের কোনো বৈলক্ষণ্য দেখা গেল না। তবে কি মীনাক্ষিই তার সুর বদলালো না কি?

কি হে, কিরকম ডিম্বলাভ চলছে? কৌতূহলী হতে হলে আমায়।

প্রত্যেকদিন একটি করে ফাঁক নেই। বোকেন সহাস্যবদন, বন্যকুক্কুট হলে কি হবে, সভ্যতায় অভ্রভেদী!

বলো কী! আমি বিস্মিত না হয়ে পারি না।

তুমি একটা অপদার্থ! কী করে ওদের সঙ্গে ব্যবহার করতে হয় জানো না। রাত দিন রেডিয়োর বাত্ময় বসিয়ে রাখলে কি আর ডিম পাড়ে? গানের দিকে কান থাকলে ডিমের দিকে মন দিতে পারে কখনো? বাগানে দুবেলা দৌড় করাতে হয়। একসারসাইজ দরকার—যেমন আমাদের তেমনি ওদেরও। দুবেলা আমরা ওকে নিয়ে সারা বাগান চষছি——আমি একবেলা, গিন্নী আরেক বেলা। তবে তো ফলছে ডিম!

বোকেন ওদের ঘোড়দৌড় দেখবার জন্য আমাদের আমন্ত্রণ করল, কিন্তু বন্য পশুপক্ষীর কীর্তিকলাপ আর কী দেখব? তাছাড়া মীনাক্ষির আচরণে প্রাণে বড় ব্যথা পেলাম। ও যে এতটা বিশ্বাসঘাতক আর নিমকহারাম হবে তা আমি ভাবতেও পারিনি। আর অমন পাখির মুখ দ্যাখে?

সমস্ত শুনে যতীন তো খাপ্পা। বাঃ, মীনাক্ষি ওর একলার না কি? ওতো এজমালি সম্পত্তি। কেন, আমাদের কি বাগান নেই, না, আমরা ঘোড়দৌড় করাতে জানিনে? আমাকে যদি ও মীনাক্ষির ভাগ না দেয় তো আমি সোজা আদালতে যাব। আমার সাফ কথা আমি বলে রাখলাম।

ঘোড়দৌড়টা আদালতের দিকে গড়ালে নেহাত মন্দ হয় না, এবং দৌড়বাজিতে ঘোড়ার সংখ্যা যত বাড়ে দৃশ্য হিসাবে ততই আরো দ্রষ্টব্য হয়ে দাঁড়ায়। সম্ভাবনাটা বোকেনের কাছে গিয়ে ব্যক্ত করতে চেহারা ও নামের মধ্যে যতটা আশ্বাস ছিল আসলে বোকেন তত বোকা নয় দেখা গেল—সে বলে ওঠে-ঠিক কথাই তো! কালকেই মীনাক্ষি ওর বাগানে যাবে, আসছে হপ্তাটা ওর পালা! মীনাক্ষি এই ভাবে আমাদের সবার হাত ঘুরবে, সেই তো ন্যায্য!

বোকেন তার কথা রাখল। রাত্রি প্রভাত হওয়া মাত্র, মীনাক্ষিকে স্বহস্তে যতীনের হাতে সঁপে দিয়ে এল।

বিকেলের দিকে স্টেশনে আমাদের দেখা হতেই, বোকেন আমাকে আড়ালে ডেকে বললে: ওহে শোননা, তোমার সঙ্গে আর হলনা করতে চাইনে। তুমি ঠিকই বলেছিলে। মীনাক্ষি একদম বাঁজা।

তবে এই যে বলে সেদিন, তোমার প্রক্রিয়ায় বেশ সুফল দেখা দিয়েছে।

কাঁচকলা! তোমাকে যা বলেছিলাম তা স্রেফ প্রচার কার্য! সিনেমা কোম্পানিতে পাবলিসিটি অফিসারের চাকরি করতাম সেটা কেন ভুলে যাচ্ছ? আর, কথাটা রটিয়েছি ওই যতনেটার জন্যেই। মীনাক্ষি ডিম পাড়ছে জানলে ও নগদ টাকায় আমাদের অংশগুলো কিনে নিতে রাজি হবে। ওর যা ডিমের লোভ! দেখো, ঠিক ও মীনাক্ষিকে একচেটে করে নিয়েছে, তুমি দেখে নিয়ে।

কিন্তু মীনাক্ষি যদি ডিমই না পাড়ে—আমি হতবুদ্ধি হই।

তোমাকে কি আর সাধে বোকা বলি! বোকেন বলল আরে না পেড়ে যাবে কোথায়? ওরা কতগিন্নীতে দুবেলা মীনাক্ষির সঙ্গে হানড্রেড ইয়ার্ডস দেবে তো সারা দিন বাগানেই ছাড়া থাকবে মীনাক্ষি। সেইসময়ে কোনো ফাঁকে বাগানের কোথাও একটা ডিম ফেলে দিয়ে আসার মামলা। সে ভার আমার উপর থাকলো। বুঝলে এবার?

বুঝলাম বই কি! নাঃ, বোকেন তার নামের দারুণ অমর্যাদা করছে—ওইসূত্রে সেই কথাটাও আরো বেশি বুঝলাম। সেই সঙ্গে, ওর তুলনায় নিজেকেও নিখুঁতরূপে টের পেলাম এতদিনে।

সপ্তাহ ফুরুতেই যতীনের ওপরে আমাদের নোটিশ পড়ে গেল। মীনাক্ষির পালা তার খতম।

তা—তাতে কী হয়েছে? ও ঘোঁৎ ঘোঁৎ করল : কাল সন্ধ্যেয় আমার বাড়ি তোমাদের নেমন্তন্ন। সেই সময়ে সবাই মিলে ভদ্রভাবে মীনাক্ষির বিষয়ে আলোচনা করা যাবে।

ওষুধ ধরেছে তাহলে। ও একাই মীনাক্ষির অভিভাবক হতে ইচ্ছুক। শুধু মুখরোচক খাদ্যের সঙ্গে সামাজিক ভদ্র মিশিয়ে মীনাক্ষির দরটা একট নামাতে চায় মাত্র—ভেবে এমন হাসি পেল! হায় কাল বাদ পরশু সকাল থেকে ডিম পাড়া যখন বন্ধ হবে, তখন মীনাক্ষি প্লাস আমাদের প্রতি তার এই আদরের পরিণতি কী দাঁড়াবে তাই ভাবি। যাই হোক, সাক্ষ্য ভোজে তো গেলাম আমরা। বোকেন এবং শ্রীমতী বোকেন; আমি আর আমার বুদ্ধিমতী।

সন্ধ্যেটা কাটলো বেশ। ভারতীয় চায়ের সঙ্গে স্বদেশী মাংসের পিঠে—খারাপ কি?

টেবিল থেকে পেয়ালা পিরিচ সরে যেতেই বোকেন খুকখুক করে কাশল। ব্যাস কাশি নয়, ভদ্র কাশি, ভদ্রভাবে আলোচনা শুরু করার পূর্বাভাস।

আচ্ছা, এইবার আমরা মীনাক্ষির ভবিষ্যৎ নিয়ে—আরম্ভ করল বোকেন।

শুনে যতীনের শ্রীমতী তো হেসেই কুটোপাটি। যতীনও একটু হাসল, যৎসামান্য, সচরাচর বুদ্ধমূর্তির আননে যে ধরনের রহস্যময় হাসি দেখা যায়।

তোমাদের বলতে দুঃখ হচ্ছে, কিন্তু না জানিয়েও উপায় নেই। বলল যতীন: বেচারী মীনাক্ষির কোনো ভবিষ্যৎ নেই।

য়্যাঁ?–বোকেনের চোয়াল ঝুলে পড়ে।

আমাদের ঈষৎ ভুল হয়েছিল—এমন কিছু না—এই লাক্ষণিক ভুল। যতীন তেমনি অমায়িক : কিন্তু মীনাক্ষি যেদিন আমার হাতে এল, সেইদিনই কলকাতা থেকে আমার শ্যালক এলেন–তিনি ভেটারনারি ডাক্তার। দেখবামাত্রই মীনাক্ষির অবস্থা তিনি ধরতে পারলেন। তখনি সব পরিষ্কার হয়ে গেল।

কী পরিষ্কার হলো, শুনি? শুনে আমিও একটু গরম হই। আসল কথার পাশ কাটাবার এই চাল আমার ভালো লাগে না।

জানা গেল যে—বলতে দ্বিধা করল না যতীন মীনাক্ষি আসলে হচ্ছে মীনাক্ষ। এই তথ্যের গুঢ়তা গাঢ় হয়ে যতই আমাদের মর্মে প্রবেশ করে ততই তার মর্মান্তিক তীক্ষতা আমরা টের পাই।

ডিম পাড়া তার ক্ষমতার বাইরে। যতীন-গিন্নি কোন রকমে একটুখানির জন্য হাস্যসম্বরণ করে আমাদের আলোচনায় এই মন্তব্যটুকু যোগ করতে পারলেন। এবং তার পরেই আরেক প্রস্থ হাসি আঁকে পেয়ে বসল আবার!

আমরা আর কোনো কথাটি না বলে নিজের গৃহিণীদের সংগ্রহ করে উঠে পড়লাম। নিঃশব্দেই।

অমায়িক যতীন আর আহ্লাদে আটখানা ওর বৌদরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এল আমাদের।

বাগানে পা দিয়ে বোকেন বললে? যাই হোক মীনাক্ষি কোথায়? তাকে দেখছিনে কেন?

মীনাক্ষি শ্রীমতী যতীন থেমে থেমে জানালেন : সেই পিঠের মধ্যে ছিল।

সেও অতীতের কথা। এখন পেটের মধ্যে, সেই কথাই বলো! বলল যতীনতোমার বন্য সারসটা বেশ সরস হিল হে। বলে কটাক্ষ করল আমার দিকে।

আমরা আর দাঁড়ালুম না। উদরস্থ মীনাক্ষিকে ধরে আমরা পাঁচ জন আমাদের সোজা পথ ধরলুম।

হ্যাঁ, ভালো কথা। পেছন থেকে হেঁকে বলল যতীন : কদিন ধরে তোমরা যে ডিমগুলো পাঠিয়েছ তার জন্যে ধন্যবাদ। সবগুলো মুরগির ছিল না, কয়েকটা হাঁসের ছোট ডিম ভেজাল দিয়েছিলে; তার মধ্যে, এটা আবার গিন্নী বলছিলেন, একটু পচাই। নাকি! যাকগে, যা বাজার, আর যেরকম মাগ্যি গণ্ডা, আর যেমন দিনকাল পড়েছে তাতে ওই নিয়ে আমরা কোনো বচসা করতে চাইনে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত