| 25 এপ্রিল 2024
Categories
নারী

অ্যানপুরের অনুজা

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

বিপর্যয় কখন কীভাবে কার সামনে এসে দাঁড়াবে কেউ বলতে পারে না। বিশ্বের শক্তিশালী দেশ চীন যে এভাবে করোনার কবলে পড়বে চীন নিজে কি কখনও ভেবেছিল ? দশদিনে এক হাজার শয্যার হাসপাতাল তৈরীর ক্ষমতা থাকলেও এক মাসে দু’হাজার চৈনিককে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারে নি সে দেশ। এমনই তীব্রতা চীনের সাম্প্রতিক বিপর্যয়ের। তবে বিপর্যয় কখনোই শেষ কথা হতে পারে না। তাকে মাথায় নিয়েই এগিয়ে চলে রাষ্ট্র, এগিয়ে চলে মানুষ, এগিয়ে চলে সভ্যতা। যেমন চলছে চীন। যেমন চলেছে অনুজা অধিকারী — অ্যানপুরের অনুজা।

আর দশজন শহুরে মানুষের মতো আমিও গেছিলাম সুন্দরবন বেড়াতে। উদ্দেশ্য ছিল বাঁদাবনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ। বেশ কয়েকবছর আগে আয়লা ক্ষতবিক্ষত করেছে এই বাঁদাবনকে। সে নিদর্শন আজও রয়েছে সেখানে। হঠাৎ করেই সেখানে দেখা মিলেছিল অনুজার। সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রাম সাউহেলিয়ার অ্যানপুরের অনুজা অধিকারীর সঙ্গে দেখা না হলে জানতেও পারতাম না আয়লা বিপর্যয়ের সঙ্গে কীভাবে লড়াই করে বেঁচে আছে সে এলাকার মানুষ। ২০০৯ এ আয়লা ঝাপট মেরেছিল। সে ঝাপটা আজও সামলে যাচ্ছে অনুজারা। আয়লার রেখে যাওয়া বেদনা থেকে আজও তারা মুক্ত নয়।

প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পর সরকারি -বেসরকারি ত্রাণ হয়তো মিলেছিল। সাময়িক চিকিৎসা শিবিরও গড়ে উঠেছিল সুন্দরবনে। কিন্তু এই সাময়িক প্রচেষ্টা ফিরিয়ে আনতে পারে নি সেখানকার পুকুরের নোনাজল, জমির উর্বরতা, নানা প্রজাতির মাছ৷ এগুলোই ছিল সে অঞ্চলের মানুষের প্রধান জীবিকা। রুজি রোজগার হারিয়ে ঘরে ঘরে তখন বেঁচে থাকার লড়াই। এই শোচনীয় অবস্থা থেকে বাদ যায় নি অ্যানপুরও। সেখানকার মানুষজন ভিনরাজ্যে পাড়ি দেয় রোজগারের আশায়। কিন্তু অনুজা পড়ে থাকে তার জন্মভিটে আঁকড়ে। অ্যানপুরে থেকেই সে শুরু করে তার বেঁচে থাকার লড়াই।

সুন্দরবনের মানুষের কাছে মা বনবিবি হলেন বিশ্বাসের দেবী৷ নরখাদক দক্ষিণরায় ও বনবিবির লড়াইয়ের কথা সকলেরই জানা৷ অশুভ শক্তিকে পরাজিত করে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির নিদর্শন প্রতিষ্ঠা করেন বনবিবি। প্রতি বছর মাঘ মাসের প্রথম দিনটি বনবিবির পালাগানে মুখর হয়ে ওঠে সুন্দরবন। জঙ্গলে যারা কাঠ কাটতে বা মধু সংগ্রহে যায় বাঘের আক্রমণ থেকে তাদের রক্ষা করার জন্য বনবিবির পুজো করে এলাকার মানুষ। সেখানেই চলে বনবিবির পালাগান৷ অ্যানপুরের বনবিবি পালায় “দুখে” নামের একটি চরিত্রে নিয়মিত অভিনয় করত অনুজা। পাশাপাশি জারি ছিল গ্রামের রজত জুবিলি স্কুলে তার পড়াশোনা। তবে গান আর অভিনয়েই অনুজা মনের খোরাক খুঁজে পেত বেশি। অভাবের সংসার। হাজারো অসুবিধে। তা সত্ত্বেও সারা রাত “দুখে”-র গান গেয়ে বনবিবি পালার আসর জমিয়ে রাখত অনুজা।

মনের খোরাক জুটলেও পেটের খোরাক জুটত না পালাগান গেয়ে। ফলে অনেকেই অনিয়মিত হয়ে পড়ে এ গানে। তবে অনুজা কিন্তু তার চর্চা জারি রাখে। এরই মধ্যে সুন্দরবন অঞ্চলকে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলায় উদ্যোগী হয় রাজ্য সরকার। তৈরী হয় প্রচুর লজ ও হোটেল৷ ভগবান বোধহয় এবার মুখ তুলে তাকায় অনুজার মতো শিল্পীদের দিকে। পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্য গড়ে ওঠা নতুন হোটেল ও লজগুলিতে শুরু হয় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সেখানে “সুন্দরবন চেতনা সাংস্কৃতিক নাট্যসংস্থা” আয়োজিত বনবিবির পালায় “দুখে”-র ভূমিকায় পালাগান গেয়ে সামান্যকিছু পয়সার মুখ দেখতে শুরু করে অনুজা। অনুজার মনে হয় দিন বুঝি এবার ঘুরতে লাগল। ইচ্ছে হয় তারও ঘর হোক, বর হোক। হল তার ইচ্ছেপূরণ৷ ঘর বাঁধল গ্রামের ছেলে নিশিকান্তর সঙ্গে৷ নিশিকান্ত জাল বিছিয়ে মাছ ধরে। অনুজা জালের একপ্রান্ত ধরে সে কাজে নিশিকান্তকে সাথ দেয়। কখনও বা নিশিকান্ত চাষের জমিতে জনমজুরের কাজ করে। অনুজা তার দুপুরের ভাত পৌঁছে দিয়ে আসে সেখানে। ততদিনে অনুজার কোলে এসেছে ছেলে সমন্বয়। খুশি অনুজা, খুশি নিশিকান্ত৷

মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এক প্রত্যন্ত গ্রামে চাওয়া পাওয়ার পরিমাণ খুবই সামান্য৷ তিলমাত্র পাওয়াতেই খুশি থাকে সেখানকার মানুষজন। ব্যতিক্রম নয় অনুজা-নিশিকান্ত। এই খুশির সংসারে আবারও এল এক খুশখবর। মা হবে অনুজা আরও একবার। কোল আলো করে জন্ম নিল দ্বিতীয় পুত্র। অনুজা নাম রাখল — প্রত্যাশা। এ ছেলে জন্মান্ধ। তাতে কিছু যায় আসে না অনুজার। যদি যেত তাহলে কি আর ছেলের নাম রাখত “প্রত্যাশা” ? সে জানে তার চোখ দিয়ে সন্তান দেখবে এই জগতসংসার। তবে প্রকৃতি রুষ্ট হলে বোধহয় নিমেষে সবকিছু ওলোটপালোট হয়ে যায়। প্রত্যাশার যখন এক মাস বয়স তখনই আয়লা আছড়ে পড়ল সুন্দরবনে। ছারখার করে দিল অনুজার মতো অজস্র অনুজার শান্তির নীড়।

আয়লাতে শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় নিশিকান্ত। সংসারের সব দায়িত্ব সেদিন থেকে অনুজাকে নিতে হল। তবে গ্রাম ছেড়ে বাইরে গেল না অনুজা। দুর্দিনে হাতিয়ার করল নিজের ভেতরে থাকা শিল্পকে৷ গ্রামে পড়ে থাকা নারীদের নিয়ে গড়ে তুলল “সুবাসিনী নাট্য গোষ্ঠী”। এখন আর দুখে-র ভূমিকা নয় — দুখে-র মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করে অনুজা৷ অ্যানপুরে পদে পদে বিপদ। কিন্তু সেসব তোয়াক্কা না করে বারোমাস অনুজা তার দল নিয়ে ঘুরে বেড়ায় এ-লজ থেকে সে-লজ। তার বনবিবির পালা অবাক করে শহুরে ট্যুরিস্টকে। তারা খুশী হন। পেছনের লড়াই চাপা পড়ে যায় অনুজার গানে। এত প্রতিকুলতার মাঝে বড় হয়ে ওঠে প্রত্যাশা। দাদার কাছে শুনে শুনে দাদার পড়াগুলো তার মুখস্থ৷ মায়ের কাছ থেকে রপ্ত করেছে বনবিবির পালা।

আপাত শান্ত ছোটখাটো চেহারার অনুজাকে দেখে বোঝার উপায় নেই কী আগুন জ্বলছে তার ভিতরে। আয়লার মতো বিধ্বংসী বিপর্যয়ের কাছে মাথা ঝোঁকায় নি সে। ঘুরে দাঁড়িয়েছে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে। খুঁজে নিয়েছে আবার পায়ের তলায় মাটি৷ শুধু নিজেই ঘুরে দাঁড়ায় নি। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে গ্রামের অন্য নারীদের দিকে। “নারী ক্ষমতায়ণ” নিয়ে গান বেঁধেছে অনুজা। দুর্বল নারীকে উদ্দীপনা জুগিয়েছে অনুজার সে গান। আজ অনুজার হাত ধরে অ্যানপুরের প্রচুর নারী নিজের পায়ের তলার মাটি খুঁজে পেয়েছে। নিজের ভেতরে থাকা শিল্পীসত্তাকে হাতিয়ার করে এগিয়ে চলেছে সে একক প্রচেষ্টায়। অনুজা যে কতবড় একজন শিল্পীমনের অধিকারী সেটি বোঝা যায় ওর দুই ছেলের নামকরণ থেকে। প্রথম যখন শুনলাম ওর দুই ছেলের নাম “সমন্বয়” এবং “প্রত্যাশা” বেশ অবাক হয়েছিলাম৷ প্রত্যন্ত এক গ্রামে বসবাসকারী যে নারী তার সন্তানদের এত সুন্দর নাম রাখে সে যে একজন খাঁটি শিল্পী তখনই মালুম হয়। আমার কাছে অনুজা অধিকারী একজন আদর্শ নারী। নারীদিবসে কুর্ণিশ জানাই অ্যানপুরের অনুজাকে।

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত