| 19 মার্চ 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প গল্প সম্পাদকের পছন্দ সাহিত্য

সুদানের গল্প: এক মুঠো খেজুর । তায়েব সালিহ

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

|| ১ ||

আমি তখন একেবারেই ছেলেমানুষ। বয়েস ঠিক কত ছিল এখন আর স্মরণে আসে না, কিন্তু মনে আছে যখনই লোকে দেখত আমি ঠাকুরদার হাত ধরে গুটি গুটি চলেছি, তারা এসে হয় আমার মাথায় টোকা মারত না হয় গালে চিমটি কাটত— খালি আমাকেই করত, আমার ঠাকুরদার গায়ে হাতটি পর্যন্ত ছোঁয়াত না। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, আমি বাবার সঙ্গে কোথাও যেতাম না, ঠাকুরদাই আমাকে নিয়ে যেত সব জায়গায়। অবশ্য সকালে ছাড়া, সেই ভোরবেলা উঠে আমি মসজিদে ছুটতাম কোরানের পাঠ নেবার জন্য। মসজিদ, নদী, খেত, খোলা প্রান্তর— এই ছিল আমাদের সরল, সাধারণ জীবনের দিকচিহ্ন। আমার বয়েসি সব বাচ্চারাই মসজিদে কোরান শিখতে যেতে গাঁইগুঁই করত, কিন্তু আমি নয়; আমার সেটা সারা দিনের সবচেয়ে প্রিয় কাজ। ক্লাসের সময় মসজিদে কোন গণ্যমান্য অতিথি এলেই মাননীয় শেখ আমাকে বলতেন উঠে দাঁড়াতে আর মহিমময় আল্লার মহিমা আবৃত্তি করতে— আর অতিথিরা তাই শুনে হয় আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন, অথবা গাল টিপে আদর করতেন।

হ্যাঁ, মসজিদে যাওয়া আমার সবচেয়ে প্রিয় কাজ, আর নদীর ধারে যাওয়াও। সকালের কোরান পাঠ কোনভাবে শেষ করেই শ্লেট পেনসিল ফেলে জিনের মতন ছুটে যেতাম ঘরে, তারপর মায়ের দেওয়া খাবারটুকু গোগ্রাসে গিলে ফেলেই দৌড়ে গিয়ে নদীতে ঝাঁপ। সাঁতার কেটে কেটে শরীর ক্লান্ত হলে চুপচাপ বসা নদীর পাড়ে, জলের দিকে তাকিয়ে। সরু জলে খরস্রোত এঁকে বেঁকে পূর্বগামিনী, খানিকটা দূরে মিলিয়ে যায় ঘন বাবলাবনের আড়ালে। আমার কল্পনাও আকাশছোঁয়া—ভাবতাম বনের ওপারে বাস করে এক দৈত্যাকার উপজাতি— হিলহিলে লম্বা মানুষগুলো, ধবধবে শাদা দাড়ি তাদের, আর ঠাকুরদার মতো তীক্ষ্ণ নাক। আমার প্রশ্নের পর প্রশ্নের উত্তর দেবার চেষ্টা শুরু করবার আগেই ঠাকুরদা তর্জনী দিয়ে নাক চুলকে নিত; আর তার দাড়ি— নরম, মোলায়েম, পেঁজা তুলোর মত শাদা; আমার ক্ষুদ্র জীবনে তার থেকে শুভ্রতর বা সুন্দরতর আর কিছু আমি দেখিনি। ঠাকুরদা বোধহয় লম্বাও ছিল খুব, কারণ পুরো তল্লাটে আমি এমন কোন মানুষ দেখিনি যে ঠাকুরদার চোখে সোজাসুজি তাকাতে পারে, সব সময়েই ঘাড় তুলে তাকাতে হয় তার মুখের দিকে; আর এমন কোন দরজা বা চৌকাঠ দেখিনি যেখানে ঠাকুরদা মাথা অনেকটা না নুইয়ে সোজা ঢুকে যেতে পারে। সেই সময় ঠাকুরদার আঁকাবাঁকা শরীরটাকে গ্রামের প্রান্তের আঁকাবাঁকা নদীর মতন লাগে। আমি ভালবাসতাম ঠাকুরদাকে আর প্রাণভরা শ্রদ্ধাও করতাম, মনে মনে কল্পনা করতাম বড় হয়ে তার মতন দীর্ঘদেহী, কৃশকায়, সুদর্শন মানুষ হব, আর লম্বা অম্বা পা ফেলে সোজা হেঁটে চলব।

সবসময় মনে হত আমিই ঠাকুরদার খাস পেয়ারের নাতি; এতে অবাক হবার কিছু নেই আমার খুড়তুতো-জ্যাঠতুতো ভাইবোনদের সবগুলোই বোকা হাঁদা আর আমি— যাকে বলে দুর্দান্ত চালাক চতুর। আমি জানতাম কখন আমার হাসা চলবে, আর কখন নীরব থাকতে হবে। আমি মনে রাখতাম ঠাকুরদার নমাজ পড়ার সময়গুলো এবং কেউ কিছু বলার আগেই যথাসময়ে এনে হাজির করতাম তাঁর আসন, ওজু করার জল ভরে দিতাম তার পেতলের গাড়ুতে। হাতে একটু সময় থাকলেই ঠাকুরদা ডাকত আমায়, আমি এসে উদাত্ত কন্ঠে আবৃত্তি করতাম কোরান থেকে সুরার পর সুরা— শ্রোতার চোখ বন্ধ থাকলেও মুখ দেখেই বুঝতাম সে অভিভূত।

[br]

|| ২ ||[br]

আমাদের নিকট প্রতিবেশীর নাম মাসুদ; একদিন ঠাকুরদাকে জিজ্ঞেস করে বসি, “তুমি মাসুদকে পছন্দ করো না কেন?”

ঠাকুরদা তার অভ্যেসমত আঙুলের ডগা দিয়ে নাক ঘষে তার পর উত্তর দেয়, “মাসুদ লোকটা আলসে, পরিশ্রম করতে ভয় পায়; এমন মানুষকে আমার ভীষণ অপছন্দ।”

“এরকম বলছো কেন?” আমি ঠাকুরদাকে বলি।

উত্তরে ঠাকুরদা চিবুক নুইয়ে ভাবে কিছুক্ষণ, তারপর খোলা মাঠ আর ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে বলে, “এই যে সমস্ত জমি দেখছিস, একদিকে মরুভূমির প্রান্ত আর অন্য দিকে নীল নদীর পাড়, সব মিলিয়ে একশো একরেরও বেশি? ওই যে সার সার খেজুর গাছ দেখছিস? আর ওদিকে বাবলার ঝোপ, সারি সারি তাল, ডুমুর আর উইলো গাছ, দ্যাখ? এই সবের একদিন মালিক হয়েছিল মাসুদ, উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিল তার আব্বার কাছ থেকে।”

ঠাকুরদা চুপ করে যায়, আপন মনে ভাবে। আমি তার মুখের থেকে চোখ সরিয়ে উন্মুক্ত প্রান্তরের দিকে তাকাই, মনে মনে বলি, “আমি কেয়ার করি না কে ওই দূরের খেজুর গাছের বা এই কাছের কালো, ফুটিফাটা জমির মালিক— আমি জানি এই আমার স্বপ্নের এলাকা, আমার খেলার মাঠ।”

একটু পরেই নীরবতা ভাঙল ঠাকুরদার, শুরু করল কথা বলতে, “জানিস ভাই, প্রায় চল্লিশ বছর আগে এই পুরো এলাকাটার মালিক ছিল মাসুদ কিন্তু এখন ওর প্রায় তিন ভাগের দুভাগ আমার নিজের।”

চমকে উঠলাম কথাটা শুনে; আমি ভাবতাম এই সব জমি জিরেত চিরকালই ঠাকুরদার মালিকানায়— সেই আল্লা যখন পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছিলেন, তখন থেকে।

“আমি যখন এই গ্রামে প্রথমে আসি, কপর্দকহীন অবস্থা ছিল আমার, জমি থাকা তো দূরের কথা। মাসুদ ছিল গ্রামের সবচেয়ে ধনী, বেশিরভাগ জমির মালিক। জমানা পাল্টে গেছে এখন। জানি না কবে আল্লা আমায় চিরশান্তির ডাক দেবেন, কিন্তু তার আগে তিন ভাগের বাকী এক ভাগ আমি কিনে নিতে পারব আশা রাখি।”

জানি না আমার মনে তখন কোন ভাবনা প্রবল— ঠাকুরদার জন্যে সমীহ অথবা প্রতিবেশী মাসুদের জন্যে করুণা। মনের ইচ্ছা ঠাকুরদা এখনই যা বলল তা যেন কোনদিনই না করে। মনে পড়ল মাসুদের গলায় গান, গমগমে তার কন্ঠস্বর; আর তার দিলখোলা হাসি, কুলছাপানো নদীর স্রোতের মতন সাবলীল। ঠাকুরদাকে আমি সাতজন্ম কোনোদিন হাসতেই দেখিনি।

ঠাকুরদাকে জিজ্ঞেস করি মাসুদ কেন তার সব জমি বিক্রি করতে বাধ্য হল।

“মেয়েমানুষ,” ঠাকুরদা এমনভাবে উচ্চারণ করে কথাটা যে মনে হবে মেয়েমানুষ একটা বাঘ-ভাল্লুক বা ভয়ংকর কিছু। “তুই বুঝবি নে ভাই, কিন্তু মাসুদের চিরকাল শাদী করার শখ। এক একটা মেয়েমানুষ জোটায় আর এক-দু একর জমি বাধ্য হয়ে বিক্রি করতে আমাকে।” আমি অল্পস্বল্প আঁক কষতে জানি, মনে মনে হিশেব করে দেখি মাসুদের অন্তত: আশি-নব্বইজন বিবি থাকা উচিত। মনে পড়ে তার তিন রোগা-ভোগা বিবির মুখ, তার নোংরা কর্কশ মুখমণ্ডল, অসংবৃত বেশবাস, তার বাহন গাধাটির এক পা খোঁড়া, তার জিন ও সাজসরঞ্জাম সব ছেঁড়া, পরনের ফতুয়ায় তালি মারা। এই সব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই দেখি সেই মানুষটা নিজেই হাঁটতে হাঁটতে ধীরপায় আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে— ঠাকুরদা আর আমি অবাক চোখে একে অন্যের পানে চাই।

“আজ খেজুর কেটে ফসল তোলার দিন,” মাসুদ বলে, “তুমি কি নিজে গিয়ে দেখে শুনে সব তদারকি করতে চাও?”

আমার মনে হল মাসুদ কেবল কথার কথা বলছে, তার মোটেই ইচ্ছে নয় ঠাকুরদা সেখানে যায়। ঠাকুরদা কিন্তু মাসুদের কথা শুনেই উঠে দাঁড়াল সটান, এক নিমেষের জন্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার বৃদ্ধ চোখদুটো। খুব দ্রুত আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল খেজুর গাছগুলোর দিকে।

কেউ একজন মহিষের ছাল দিয়ে একটা চৌকি এগিয়ে দিল ঠাকুরদার বসার জন্যে, আমি রইলাম পাশে দাঁড়িয়ে— সামনে খেজুর কাটার দৃশ্য। এলেবেলে অনেক মানুষ এসে জুটেছে আশেপাশে, আমি তাদের প্রায় সবাইকেই অল্পবিস্তর চিনি— কিন্তু ঠিক জানি না কি কারণে, আমি পুরো সময়টাই একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম মাসুদের দিকে। খেজুরগাছ থেকে খেজুর পাড়া হচ্ছে তার নিজের জমিতে, কিন্তু সে নিজে দাঁড়িয়ে রয়েছে দূরে, একটেরে নিরাসক্ত, উদাসীন ভাব তার চোখে মুখে। মজুরেরা গাছে উঠেছে কাস্তে হাতে, ডাল সমেত খেজুর পড়ছে নীচে মটিতে, কিন্তু তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। কখনো সখনো কোপ মারতে শুরু করলে মাসুদ হঠাৎ বলে ওঠে, “দেখিস বাছা, খেজুর গাছের আত্মাটাকেও কেটে ফেলিস না যেন।”


আরো পড়ুন: জন্মদিনের মেয়ে । হারুকি মুরাকামি


কেউ তার কথা শোনে না বা মনোযোগ দেয় না তার দিকে— খুদে মজুর তার আপন মনে কোপ মেরে যায়, গোছা গোছা খেজুর ধুপধাপ পড়ে মাটিতে— স্বর্গের দরজা খুলে গিয়েছে যেন, ফলের বৃষ্টি নেমে আসছে সেখান থেকে। জমির মালিককে খাতির করে না কেউ, সবাই কাজ করে যায়। আমার মনের ভেতর ঘুরে ফিরে বেড়ায় মাসুদের মন্তব্যটি— “খেজুর গাছের আত্মা।” আমার মনে হতে থাকে খেজুর গাছের সুখ-দু:খের বোধ রয়েছে— যেন তারও বুকের মধ্যে ধকধক করছে জীবন্ত কলজে। হঠাৎ মনে পড়ে যায়, বেশ কিছু দিন আগে আমি অন্য ছেলেদের সঙ্গে খেলতে খেলতে একটা কমবয়েসি খেজুর গাছের ডাল ধরে নাড়া দিয়েছিলাম— মাসুদ দূর থেকে আমাদের দেখতে পেয়ে কাছে এল, কিন্তু ধমক দিল না, খালি বলল, “ছেলেরা, তোমরা কি জানো খেজুর গাছ ঠিক মানুষের মতন, তাদেরও সুখ দু:খ রয়েছে, তারাও আঘাত পেলে কাঁদে।” আমি বিনা কারণেই ভেতরে ভেতরে শিউরে উঠেছিলাম আর খুব লজ্জা লেগেছিল।

অনেকক্ষণ পরে আবার বাগিচার দিকে তাকিয়ে দেখি কমবয়েসি ছেলেরা পিঁপড়ের দঙ্গলের মত ভিড় করছে খেজুর গাছগুলি ঘিরে আর মাটি থেকে খেজুর তুলে তুলে ইচ্ছেমতো খেয়ে চলেছে। মজুরেরা গাছ থেকে নেমে সব খেজুর স্তূপাকার করে সাজাল। এবার এগিয়ে এলো ব্যাপারিরা; তারা খেজুর ওজন করে করে থলিতে থলিতে বা বাক্সে ভরতে লাগল— গুণে দেখলাম— সব মিলিয়ে তিরিশটা। খেল খতম দেখে বাড়ি ফিরতে শুরু করল সকলে— রইলো কেবল ব্যাপারি হুসেন, আমাদের পূবদিকের খেতের মালিক প্রতিবেশী মুসা, দুজন লোক যাদের আমি আগে কোনদিন দেখিনি, মাসুদ আর আমরা দুজন।

মৃদু নাক ডাকার শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখি ঠাকুরদা চৌকিতে বসে ঢুলছে। মাসুদ আগের মতই একটেরে দাঁড়িয়ে, তার মুখে একটা খেজুর ডাল, সে আপন মনে চিবিয়ে চলছে আর কিছু করার নেই বলে। মুখ দেখলে মনে হবে খাবারে তার অরুচি, যা মুখে নিয়েছে সেটাকেও গিলবে না ফেলে দেবে, তাই নিয়ে ভাবছে।

[br]

|| ৩ ||[br]

হঠাৎ ঘুম ভেঙে যেতেই ঠাকুরদা লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল আর হন্তদন্ত হয়ে হেঁটে চলল খেজুর ভরা থলিগুলোর দিকে। তার পেছন পেছন হুসেন, মুসা আর অচেনা লোকদুটো; কিন্তু মাসুদ কোথায়? তাকিয়ে দেখি সে একটু দূরে দাঁড়িয়ে, খুব ধীরগতিতে চেষ্টা করছে আমাদের দিকে আসার। দেখলে মনে হবে তার পা দুটো আসছে আমাদের দিকে, কিন্তু মন বলছে ঘুরে দাঁড়িয়ে উল্টোদিকে হাঁটতে। শেষ পর্যন্ত পুরো দলটা সমবেত হল খেজুরের থলেগুলোকে ঘিরে— মন দিয়ে পরীক্ষা করে দেখল থলে আর খেজুর, কেউ কেউ মুখে ভরল দু একটা। ঠাকুরদা একমুঠো খেজুর তুলে দিল আমার হাতে, আমি চিবোতে শুরু করলাম। খেলো না মাসুদ— সে দুহাতে অঞ্জলির মত করে তুলে নেয় একমুঠো খেজুর, নাকের কাছে নিয়ে গিয়ে গন্ধ শোঁকে তাদের, আবার পরম মমতায় সন্তর্পণে নামিয়ে দেয় তাদের থলের মধ্যে।

আস্তে আস্তে ভাগাভাগি হল সব থলে। হুসেন নিল দশটা, দুই অচেনা লোক মিলে নিয়ে গেল পাঁচ, প্রতিবেশী মুসা নিল পাঁচ, বাকী পাঁচ ঠাকুরদার। আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না পুরো ব্যাপারটার। মাসুদের দিকে তাকিয়ে দেখি তার চোখে-মুখে অস্বস্তি— একবার বাঁদিকে তাকায়, একবার ডানদিকে, কিন্তু আমাদের দিকে তাকায় না।

“এখনো তোমার কাছে পাওনা রইল পঞ্চাশ পাউন্ড,” ঠাকুরদা বললে মাসুদকে, “পরে সেই নিয়ে কথাবার্তা হবে।”

হুসেনের কাজের লোকেরা এসে খেজুরের বস্তা চাপাল গাধার পিঠে, অচেনা মানুষ দুটোর সহকারীরা নিয়ে এল তাদের উট— সবাই যে যার মালপত্র নিয়ে হেলতে দুলতে রওনা দিল। একটা গাধা বিকট গলায় চেঁচিয়ে উঠতেই চমকে থামল উটেরা, তাদের মুখ থেকে বেরুল ফেনা আর উদ্ভট শব্দ। আমি না জেনেই পেয়ে পেয়ে এগিয়ে গেলাম মাসুদের দিকে— তার মুখে আপনজনকে হারানোর শোক। আমি হাত বাড়ালাম তার দিকে— ছুঁতে গেলাম তার জোব্বার প্রান্ত। গলা থেকে ঘড়ঘড় আওয়াজ বেরুল তার— ভেড়ারা জবাই হতে যাওয়ার পথে যেরকম শব্দ করে। কেন জানি না অসম্ভব ব্যথা লাগলো আমার বুকে। অন্ধকার হতে থাকল দুনিয়া।

সোজা ছিটকে বেরিয়ে দৌড়তে লাগলাম আমি। দূর থেকে শোনা গেল ঠাকুরদার কন্ঠস্বর, “কোথায় যাচ্ছিস? এদিকে আয়!” একবার থেমে খানিক ইতস্তত: করি আমি, আবার রওনা দিই সবেগে। যদিও আমার ঠাকুরদা, সেই মুহূর্তে তাকে আমি বিন্দুমাত্র ভালবাসি না, বরং ঘেন্না করি। আমার গতিবেগ বাড়ে, গভীর গোপন কিছু লুকিয়ে রয়েছে আমার ভেতর, তার থেকে রেহাই পেতেই হবে, না হলে আর গতি নেই। বাবলা ঝোপঝাড়ের কাছাকাছি নদীর বাঁকের মুখে পৌঁছে যাই; কিছু না বুঝেই এক অমোঘ টানে আমার দু আঙুল ঢুকিয়ে দিই কন্ঠনালীর মধ্যে, বমি করে ফেলি একটু আগে খাওয়া সমস্ত খেজুর।


লেখক পরিচিতি—

পুরো নাম আল-তায়েব সালিহ, জন্ম ১৯২৯ সালে আল-দেব্বা নামে মধ্যসুদানের এক বর্ধিষ্ণু গ্রামে, যেখানে কৃষিকর্ম আর ইসলাম ধর্ম—সমাজের দুটি প্রধান অবলম্বন। মিশর থেকে মধ্য-আফ্রিকার ব্যবসা-বাণিজ্যের যাত্রাপথে এই গ্রামটি, তাই শৈশব থেকে বিচিত্র মানুষের সঙ্গে মেশার অভিজ্ঞতা। প্রথম শিক্ষা মাদ্রাসায়, ধর্মীয় শিক্ষকের কাছে, পরবর্তীকালে খার্তুম শহরে কলেজ এবং ব্রিটেনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাক্রম। দেশে ফেরার পরে প্রথমে কিছুদিন শিক্ষকতা, তারপরে বিবিসির আরবী ভাষার নাটকের প্রযোজক ও পরিচালক।

লেখকের মাতৃভাষা আরবী— ১৯৫৩ সালে প্রথম গল্পটিও লেখেন সেই ভাষায়। অনূদিত গল্পটির রচনাকাল ১৯৫৪। গল্পটি আরবী ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন ডেনিস জনসন-ডেভিস ১৯৬৮ সালে। সেই একই বছর প্রকাশিত হয় তাঁর কৃশকায় ইংরেজি গল্প সংকলন, “জিন এর শাদী এবং অন্যান্য গল্প”— “এক মুঠো খেজুর” গল্পটি সেই সংকলন থেকে নেওয়া।

সমালোচকদের মতে তাঁর শ্রেষ্ঠ সাহিতকর্ম— “উত্তরমুখী অভিবাসনের কাল” নামক উপন্যাস। ১৯৬৯ সালে ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হলে তাঁর খ্যাতি ছড়ায় ইওরোপে “সুদানের আরব্য রজনীর লেখক” হিশেবে। তিক্ততা এবং কাব্যময় সংবেদনে ভরা উপন্যাসটির নায়ক মুস্তাফা লন্ডন শহরে চতুর লালসায় মত্ত। রূপসী নারীর অভাবে নেই শহরে— মুস্তাফার সঙ্গে কামনাময় শারীরিক মিলনের পরই ঘটে তাদের রহস্যময় মৃত্যু!

দীর্ঘজীবী লেখকের অনেকগুলি গ্রন্থ— গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক। প্যারিসে ইউনেসকো (UNESCO) সংস্থায় কর্মজীবন শেষ করে তাঁর অবসর জীবন কাটে লন্ডনে— সেখানে তাঁর মৃত্যু ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০০৯।

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত