ভোরে ঘুম ভাঙ্গে পেশালের ডাকে। খুব অস্বস্তি হয় কমন বাথরুম ব্যবহারে কিন্তু নিরুপায়। দাঁত মেজে অল্প গরমপানি ব্যবহার করে রেডি হয়ে নিচে নামি সকালের নাস্তা সারি। আবার পদযাত্রা, একটা দিন বিশ্রাম যদি নেওয়া যেত! কিন্তু ফিরতি বিমান টিকেট, পেশাল এর নির্ধারিত সময়, পেশাল পারে তো আজই বেইজ ক্যাম্প দর্শন শেষে ফিরে আসে লেবুচে।
চারিদিকে বরফে মুড়ে রয়েছে গতকালের তুষার ঝড়ে, রাতে আরও পরেছে কিনা কে জানে! চমৎকার উজ্জ্বল সকাল। দু’তিন লজের গ্রাম কিন্তু পরিচ্ছন্ন নয়। লেবুচে খুম্বু গ্লেসিয়ারের ভেতরেই পড়ে। হাঁটা ধরি পাড় ধরে। যেখান দিয়ে হাঁটছি পাথর আর নিচে বরফের চাই ধূলো মাটি দিয়ে চাপা পড়া। দ্রুত গতিতেই এগুনো যাচ্ছে কারণ খুব বেশি চড়াই উৎড়াই নেই আর মনটাও চনমনে, আরাধ্য মাউন্ট এভারেষ্ট দর্শন বেইস ক্যাম্পে যাবার সেই অদম্য ইচ্ছা পূরণের দিন আজ। গতিটা বেশ, খুম্বুর পাশ দিয়ে আরও বেশকটি গ্লেসিয়ার চলে গ্যাছে ‘চাংরি নুপ’ ও ‘চাংরি সার’। দূরে দেখা যাচ্ছে কালাপাথর তাকে সুউচ্চ স্থান থেকে গ্রাস করছে পুমারী পর্বতের চূড়া। পথে সুউচ্চ পর্বতমালার গবেষণার জন্য নির্ধারিত স্থান চোখে পড়লো। ডানে সুবিস্তৃত খুম্বু গ্লেসিয়ার, সম্ভ্রম আর ভয় জাগানো অনুভবে তাকাই আমি। দূরে নুপুৎসের চূড়া, লোৎসেও দেখা যাচ্ছে মাঝে মাঝে। নুপুৎসের আইসফল সাদা, হঠাৎ হঠাৎ সি গ্রীন বা সামুদ্রিক সবুজের মতন লাগে,দৃষ্টিভ্রম ভেবেছিলাম কিন্তু আসলে অমনই, নিজের তোলা ছবি ও অন্যান্যদের ছবিতে তা সবুজাভ রং এর। আমাকে অবাক করে কালাপাথর পাহাড়ের তলায় দেখা দিল গোরখশেপ গ্রাম। এই র্পাবত্য অঞ্চলের শেষ মনুষ্য আবাসস্থল। দ্রুতই পৌঁছলাম বলা চলে। গোরখশেপের পাশে সুবিস্তৃত মরুভূমিসম সমতল ভূমি; তা পাড়ি দিয়েই
কালাপাথরে ওঠার দু’টো পথ চলে গেছে। পরিব্রাজকরা ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ওখানে। গোরখশেপে পৌঁছে দেখি সাইবার ক্যাফে, পৃথিবীর উচ্চতম স্থানে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা। আমার ফোনে নেট ব্যবহার করা যায় অতি সস্তায়, উচ্চতম স্থানের চড়া মূল্যের ইন্টারনেট ব্যবহার আমার না করলেও চলবে। কয়েকটা মাত্র লজ। ‘বুদ্ধা লজ’ এ ঢুকলাম। রুম নিতে গিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে বাইরে চলে এলাম। বিশালতায় দাঁড়িয়ে খুম্বু গ্লেসিয়ার ওপারে সব নাম না জানা পর্বতমালার চূড়া আর বরফের রাজ্যে আমার ঢুকে পড়া। পছন্দ হলো রুমটা। সামনে বারান্দা ঢাকা দেয়া অবশ্যই, খোলা হলে কোন কাজেই লাগতো না আমার। তিনটে মোটে রুম জানালা দিয়ে তাকাতেই কালাপাথর আর পুমারি পর্বতের চূড়া। বিন্দুর মত মানুষরা কালাপাথরে ওঠা নামা করছে। পর্বতকূলের সেরা মাউন্ট এভারেষ্ট সর্বোৎকৃষ্ট উপায়ে দর্শনের উদ্দেশ্য। দেরী না করে ‘বুদ্ধা লজ’র ডাইনিং এ বসে স্যুপ আর নুডুলস এর অর্ডার দেই। প্যাটেল বাবুও আমার সঙ্গী হলেন। বুদ্ধা লজ এর মালিক পেমবা শেরপার সাথে পরিচিত হই। বিখ্যাত পেমবা শেরপা বহুবার চূড়ায় উঠেছেন। তার হলরুম গম গম করে উঠে তিব্বতী সুরের মূর্ছনায়। কিন্তু ততটাই হতাশ হই খাদ্যের মানে এই পুরো পথ এ সব চাইতে অখাদ্য স্যুপ আর ধুলো মিশ্রত নুডুলস খেলাম দ্রুত কারণ বেইস ক্যাম্পে যেতে হবে আবার ফিরেও আসতে হবে। এজন্য নূন্যতম ছয় ঘন্টা সময় প্রয়োজন। যদিও গোরখশেপ থেকে বেইস ক্যাম্প দেখা যাচ্ছে খুবই কাছে কিন্তু খুম্বু গ্লেসিয়ারের পার ঘেঁষে ওখানে পৌঁছুনো বহু কষ্টসাধ্য কিন্তু বড়ই আরাধ্য। মজার ব্যাপার এতোদিন ধরে এই অঞ্চলে হাঁটছি তো হাঁটছি কিন্তু একবারের জন্যও এমন খোলা জায়গায় গন্তব্য দেখা যাবার মতন ঘটনা ঘটেনি। দেখতে পাচ্ছি যেমন বেইস ক্যাম্প আবার বুঝতেও পারছি যতটা দেখা যাচ্ছে আসলের দূরত্ব আর কষ্ট ততোধিক হবে।
সব লাগেজ লজ এ রইল নিলাম শুধু ক্যামেরা আর ডাউন জ্যাকেট। প্রথমেই লজ থেকে নেমে বিশালাকার বালুময় সমতল মাঠ পেরুলাম, বেশ ঠান্ডা কিন্তু ডাউন জ্যাকেট গায়ে দিলে আর একটু পরই গরম লাগবে। উষর ভূমি শুধু পাথর আর চারধারে বরফের চাই, সূর্যও প্রখর এখানে, বামে কালাপাথর আর তার ওপাশে পুমারীর, অপূর্ব দৃশ্য দেখতে দেখতে হাঁটি। ভাগ্যভালো আবহাওয়া খুব ভালো। মেঘের লেশমাত্র নেই। দুপুর গড়ালেই পাহাড়ে মেঘের আনাগোনা বাড়ে, আবার ভাবলাম এই উঁচুতে বোধহয় মেঘই জমে না। পথে নানা মানুষের আলাপচারিতায় শুনেছি বেইস ক্যাম্পে গিয়ে তুষারপাতের যন্ত্রণায় ঠিকমতো ঘুরে দেখতে পারেননি আর এভারেষ্ট এর চূড়া মেঘ তুষারের আড়ালে ঢাকাই ছিলো দৃষ্টি সীমার বাইরে। এই শেষ বেলায় এসে নানা শারীরিক প্রতিবন্ধকতার মাঝেও বেশ চাঙ্গা বোধ করি এবং হাঁটতে থাকি দ্রুত, ভুলে যাই দুপুরের অতি নিন্মমানের খাবার। এবার আবার উঠতে হবে খুম্বু গ্লেসিয়ারের পাড়ে, ওঠাটা তেমন কষ্টসাধ্য হয় না। কিন্তু সামনে তাকিয়ে যাবার পথটা সব উৎসাহ দমিয়ে দেবার মতো, কোন পদ চিহ্ন যুক্ত রাস্তা তো নেই, বড় বড় এলোমেলো পাথরের এবড়ো থেবড়ো বোল্ডার পেড়িয়ে দীর্ঘপথ পাড়ি দেবার পর আবার নামতে হবে। খুম্বু গ্লেসিয়ার নিয়ে অনেক উত্তেজনা ছিলো আমার, দীর্ঘদিনের পাহাড়ের সান্নিধ্য আমাকে যতটা পুলকিত করার সম্ভাবনা ছিলো তা প্রশমিত করে রেখেছে। অসংখ্য হেলিকপ্টার বেইস ক্যাম্প এ ওঠা নামা করছে, তার মানে হল প্রতিনিয়তন কেউ না কেউ অসুস্থ হচ্ছে যাদের দ্রুত চিকিৎসার জন্য ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কাঠমন্ডু। আমার ডানে খুম্বু গ্লেসিয়ারের ওপারেই লোৎসে, নুপুৎসে দিগন্তজোড়া ধবধবে বরফের রাজ্য। ছোটখাট আইসফল বা অ্যাভালাঞ্জ হচ্ছে প্রতিনিয়ত কিন্তু স্থির ক্যামেরায় তা বন্দি করা মুশকিল। এভারেষ্ট এর এতকাছে আমি। অন্যরকম উত্তেজনা কাজ করছে। এখনো দেখিনি সেই সুবিশাল পর্বতচূড়া হাঁটছি আর হাঁটছি। কড়া রোদ্দুরে পোলারাইজড্ সানগ্লাস ছাড়া তাকালে চোখের সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। এই স্বল্প দূরত্ব যেন শেষই হতে চায় না। খুম্বু গ্লেসিয়ারের মাঝে মাঝে বরফ গলে ছোট ছোট পুকুর সৃষ্টি হয়েছে, আরও বরফ গলে গেলে তা আমাদের দেশের জন্য কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা আঁচ করার চেষ্টা করি। ‘গ্লেসিয়াক ওয়াকর্স’ বলে একটি সংগঠন বেইস ক্যাম্পে ছবির প্রদর্শনী করছে। কি করে এই সব গ্লেসিয়ারগুলোর বরফ গলে যাচ্ছে, সমুদ্রে পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়িয়ে দিচ্ছে গলা বরফ। চিকিৎসক বন্ধু ড. বানু বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছে প্রদর্শনী যেন দেখি। পথে পথে বিজ্ঞাপন দেখছি। বড় করে লেখা আছে চা ও বিস্কুট দিয়ে আপ্যায়িত করা হবে, এ অঞ্চলে এটা যে কত বড় আপ্যায়ন যিনি না আসবেন বুঝবেন না। হয়তো চা বিস্কুটের লোভ ‘রিভার অব আইস’ প্রদর্শনীতে ধাবিত করে পর্বতারোহীদের।
আমিও আগাই, লোৎসে ও নুপুৎসে পর্বতচূড়ার ফাঁক গলে অবশেষে দেখা মেলে পর্বতচূড়া শিরোমণি মাউন্ট এভারেষ্ট এর শৃঙ্গ। কি অপার মহিমায় আভিজ্যাত্যে বিরাজমান। মুগ্ধ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছবি তুলি প্রচুর। প্রায় মেঘবিহীন আকাশে অপরূপ নীল এর পটভূমিকায় এভারেষ্ট চূড়ায় যতটা বরফ ছবিতে দেখেছিলাম তার কিছুই দেখা যায় না। আমার গাইড কাম পোর্টার তাড়া দেয় এখনো বাকি অনেক বেইস ক্যাম্প। আবার আলোর রেখা থাকতে থাকতে ফিরতে হবে। মজার বিষয় হলো বেইস ক্যাম্প থেকে এভারেষ্ট চূড়া দেখা যায় না। আর সবচেয়ে ভালোভাবে দৃষ্টিগোচর হয় কালাপাথর থেকে। দ্রুত গতিতে হাঁটতে থাকি, দৃষ্টির সীমার বাইরে চলে যায় এভারেষ্ট চূড়া, লোৎসে আর লুপুৎসের চূড়া আর গায়ের বরফ যেন লুকিয়ে ফেলে এভারেষ্টকে। দিনের আলো দ্রুত কমছে, বেইস ক্যাম্প পৌঁছতে ঢের বাকি আছে। দ্রুত হাঁটা এখানে কষ্টকর, উচ্চতা বেইস ক্যাম্প থেকে অনেক বেশী, অক্সিজেন কম, একটু স্বাভাবিক গতিতে হাটলেই ক্লান্তি ভর করে তবে স্বল্প সময়ের বিশ্রামই অনেক চাঙ্গা করে দেয়, আর বেইস ক্যাম্প পদার্পণের উত্তেজনা তো আছেই। ভাগ্য ভালো খুব ঝকঝকে আকাশ, পরিব্রাজক অনেকের কাছেই শুনেছিলাম দুপুর গড়ালেই তুষারপাত শুরু হয়। আর তুষারপাতের তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাকে ভয়ার্ত করে তুলেছিলো কিন্তু চমৎকার নীল আকাশ আর আকাশে সন্ধ্যার বিপুল বিশাল চাঁদ এর আভাষ আমাকে মুগ্ধ করেছে। কিন্তু বেইস ক্যাম্প তো আর আসে না, স্বল্প দূরত্ব ও অনেক দূরের হয়ে যায়। রুক্ষ পাথুরে জায়গাগুলোতে মানুষের হাঁটা চলায় পথের মতন জায়গাগুলো আরও বিকট মনে হয় কিন্তু চারপাশের অপার্থিব পাহাড়ের মেলা অপরূপ মোহ সৃজন করে মূহুর্তেই। আলো ধীরে কমে আসছে, আশংকা ঢুকে মনের ভেতরে যেতে যা সময় আসতে যেরকম লাগলে ফিরতে তো পুরোই অন্ধকার হয়ে যাবে। আলো কমার সাথে সাথে বাড়ছে শীত ও হাওয়ার দাপট। বেইস ক্যাম্প দর্শনের উত্তেজনা সেই সকল দাপটকে অস্তমিত করে বেরুচ্ছে। পাহাড়ের রিজ ধরে হাঁটার পালা শেষ এখন নামতে হবে নিচে খুম্বু গ্লেসিয়ার আর পর্বত মালার মিলনস্থলই হলো বেইস ক্যাম্প। পথ আরও বন্ধুর নামার বেলায়। সবাই ফিরেছে আর আমি এখনো যেতেই পারলাম না। তবে হাঁটার গতি আমার বেড়েছে। দেখা যাচ্ছে একটা বরফের আচ্ছাদনে ঢাকা আর সরু দুইদিকে শক্ত বরফের দেয়াল দেয়া এক ফুটেরও কম প্রশস্তের পথ দিয়েই ঢুকতে হবে বেইস ক্যাম্পের পথে। সোজা হয়ে যাবে না ঢোকা। এবারই আমি আমার পোর্টারকে টেক্কা দিয়ে দৌড়ে ঐ জায়গাটা পেরিয়ে গেলাম অদ্ভূত এক উত্তেজনা বুকের মাঝে। গেল কয়েকটা দিন এই ক্ষণের জন্য এত্ত পরিশ্রম, একটা অদ্ভূত পুলক জাগে, আমার শারীরিক সব প্রতিকূলতাকে পর্যুদস্ত করে আমি হিমালয়ের সবচাইতে গহীনে সুউচ্চ এভারেষ্ট এর তলায় এর বেইস ক্যাম্প পৌঁছেছি। চূড়ায় আহরণের সাফল্যও আমার আনন্দের কাছে ম্লান হয়ে যাবে। আমি ফোন বের করলাম আমার ছেলের সাথে কথা বলার জন্য, সবচাইতে আনন্দ তারই হবে আমি জানতাম।
পাথরের গাঁয়ে নানা দেশের নানা বর্ণের মানুষের স্বাক্ষর, বিশ্ব শান্তি কামনা বাক্যমালা, শ্বেত কপোত আঁকা। প্যাটেল বাবু ফিরছেন, জানালেন ইন্ডিয়ান আর্মির ক্যাম্প আছে, চা বিস্কুট দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। তবে নিরুৎসাহিত করলেন যেতে। বেইস ক্যাম্পে ঢুকতেই এস্কিমোদের ঈগলুর আকৃতির ঘর, তার আগে ঢোকার মুখে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষজনের শান্তির জন্য শুভকামনা, হিংসা, বিদ্বেষ আর অসম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত এ বিশ্বের মানব সমাজের মানবিক সমাজ নির্মাণের আকুলতার কথা ব্যাক্ত হয় পরিব্রাজকদের লেখায়। দিনের আলো এখন যে পর্যায়ে আমি দ্রুত বেইসক্যাম্প ঘুরে না যেতে পারলে ঘোর অন্ধকারে পরবো। মাথাতেই ছিল না আর মাত্র চার দিন বাদে বুদ্ধ পূর্ণিমা। বিক্ষিপ্ত কিছু তাবুতে বিভিন্ন দেশের পর্বতারোহীদের শেষ বিকেলে হাঁটাচলা। আর একটু সামনে এগিয়ে ডেভিড ব্রেশিয়েরস এর গ্লেসিয়াক ওয়ার্ক এর চিত্র প্রদর্শনী ‘রিভার অব আইস’। কি করে গ্লেসিয়ার গলে যাচ্ছে, নদীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তন এই পর্বতমালায় কেমন পরিবর্তন আনছে যার প্রভাব গিয়ে পরছে আমাদের দেশের প্রান্তিক মানুষ জনের উপর। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে হিমালয় জুড়ে গ্লেসিয়ারগুলো দিনে দিনে বরফ শূন্য হয়ে পড়ছে। ডেভিড ব্রেশিয়ের বিখ্যাত মানুষ, হিমালয় নিয়ে বিখ্যাত সিনেমা বানিয়েছেন, এখন এই হিমালয়ের দূর্গম প্রান্তেই থাকেন বেশিরভাগ সময়। গ্লেসিয়ার ওয়ার্কস-র ওয়েব সাইটটি খুব সমৃদ্ধ, প্রদর্শনীতে খুম্বু গ্লেসিয়ারের ১৯৫২ সালের আর বর্তমানের ছবির তুলনা দেখলাম। অষ্ট্রিয়ার পরিব্রাজক নরম্যান ডাইরেনকারট এর তোলা ছবি দেখে আমি মুগ্ধ কারণ অমন সময়ে ফটোগ্রাফির আধুনিক অনেক কিছু না থাকার পরও এত চমৎকার ছবি কি করে তুললেন উনি? ডেভিড ব্রেশিয়েরস ২০০৭ এ তোলা ছবিতে দেখা যাচ্ছে হিমবাহ কতটা গলে যাচ্ছে। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বে দ্রুত প্রস্থান করি। বেইসক্যাম্পে হাঁটা চলা অনেক দুষ্কর বরফের চাইতেও আমার অনভ্যস্ত শরীর প্রবল ঠান্ডা, শেষ বিকেলের হাওয়ার পর্যদুস্ত। আমাদের দেশের তিন অভিযাত্রী এখানে বা এডভান্স বেইস ক্যাম্পে আছেন চূড়ায় উঠবেন বলে। ওয়াসফিয়া নাজরিন এর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল বেইস ক্যাম্পে আসার আগ পর্যন্ত।
এদিক ওদিক চোখ বুলালাম যদি চোখে পড়ে যদি আমার দেশের মানুষের দেখা পাই, যাই হোক সময় খুব সংকীর্ণ থাকার ফেরার পথে পা বাড়াই দ্রুত। বরফের সরু খাঁজের পথ পেরুতে আলো নিভে যাবার মতন কমে গেলো। এবার উপরে উঠতে হবে অনেকটা। সেই সকাল থেকেই তো হাঁটছি যদিও দূরত্বের বিচারে তেমন নয়, মাঝে তো থেমে থেমে বিশ্রাম আছেই তবুও ক্লান্তি, বেইস ক্যাম্পে পৌঁছে যাবার উত্তেজনা ফুরিয়ে যাবার সাথে সাথে যেন ঝাঁপিয়ে পড়লো প্রচন্ড ক্ষুধা। একটা মাত্র স্নিকার যেন কিছুই না। দ্রুত চেষ্টা করি কিন্তু খাড়া সংকীর্ণ পথে আর কত দ্রুত ওঠা যায়। অন্য আলোয় সন্ধ্যা নামে, এমন আলোর নাচন আর দেখা হবে কি এ জনমে? পর্বতচূড়াগুলোর মাথা থেকে সোনালী রং গাঢ় নীলে রূপান্তর ঘটে লোৎসে, চুলুৎসের ফাঁকে প্রায় পূর্ণ চাঁদ। উঁকি দেয় আর একটু সামনে এগিয়ে এভারেষ্ট, এক মোহময় পরিবেশ, কিন্তু উপভোগের সময় কই, পেশাল আর ঠান্ডা হাওয়ার বেগ তাড়া দেয়। এখন দুঃখ হচ্ছে সেই তাড়ার মানসিক চাপে পড়ে ক্যামেরাটা একবারও বের করলাম না ঐ ছবি তোলার জন্য। হাঁটা পথের জায়গাটা রুক্ষ বরফের পাথর আর ধূলিময়, অন্ধকার যেখানে দ্রুত ঘনায়। পথে আর কেউ নেই, পেশাল বেশ কিছুটা এগিয়ে, হঠাৎ মাথায় আসে লং শটে এ দৃশ্যটি যে কোন সিনেমায় কতটাই না দারুণ হতো! চড়াই উৎরাই পেরিয়ে অনেক অবশেষে গোরখশেপের আলোর দেখা মেলে।
কয়েকজন কালাপাথর থেকে নেমে আসছে, বিন্দুসম সব চলাফেরা। বুঝি আরও দূরত্ব অনেক বাকি এখনো। পথের ধারে পাথরে তৈরী ঝুপরিতে ক’জন আগুন জ্বালানোর আয়োজন করছে ইয়াক এর গোবর দিয়ে, এই শীতে তারা এখানে কি করে জিজ্ঞসা করতে পেশাল জানায় পোর্টার এরা, লজে থাকা ও খাওয়ার সামর্থ্য নাই তাই কোনমতে রাত কাটানো শীতের তীব্রতা বাঁচিয়ে। ওদের দুর্দশা দেখে আমার কষ্ট অতি তুচ্ছ মনে হয়। শরীর ভেঙ্গে আসছে তবুও হাঁটতে হবে অনেকটা পথ, দূরের আলো নিকটে যেন আসে না, চমৎকার চাঁদ যেন আমাকে টানতে পারছে না, এভারেষ্ট শৃঙ্গের গা বেয়ে উঠে আসা চাঁদের আলোয় আমি পথ বেয়ে সমতল ভূমিতে ফিরে আসি। গোরখশেপ সমতল ভূমি থেকে সামান্য উঁচুতে, অতটুক উঁচুতেও যেন আর উঠতে ইচ্ছে হয় না। বুদ্ধা লজ এর দরজা খুলে আমি যেন এক অন্য জগতে ঢুকলাম। উষ্ণ ডাইনিং রুম সরগরম। আমাকে প্যাটেল বাবু তার পাশে বসার আহবান জানায়। পেমবা শেরপা কাউন্টারে তার ম্যাক বুক থেকে তিব্বতীয় সুরে গাওয়া গান ছেড়েছে, ডাইনিং হলের আবহ সেই গান আরও ভয়ার্ত করে তুলেছে। প্যাটেল বাবু’র প্রশিক্ষণ নেয়ায় এই চরম আবহাওয়া তাকে পর্যুদস্ত করে তোলেনি আজ বুঝলাম, তাঁর সাথে আড্ডায় কিছুটা চাঙ্গা বোধ করলাম। অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ বেশী রকমের পরিশ্রম হয়েছে আর সর্বোচ্চ উচ্চতায় হাঁটা চলা, তাই দেরীও বেশ, ন’টার কাছাকাছি বাজে। আমার রুম ডাইনিং হল থেকে বেড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে খুম্বু গ্লেসিয়ারের রিজ ধরে আবার ছোট একটা সিঁড়ির পরে। সামনে লফট এর মতন, যেখানে অনেকে এলে আড্ডা জমানো যেত। চাঁদের আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে চারদিক এত উচ্চতায় আর চাঁদ দেখার সৌভাগ্য হবে কিনা কে জানে।
সাদা বরফের চূড়াগুলো সোনালী আভা ধারন করে দাঁড়িয়ে। প্রচন্ড শীত উপেক্ষা করে এ সৌন্দর্য্যের উপভোগ সংক্ষিপ্ত করে বাধ্য হলাম। রুমে ফিরে এলাম। আমার এখানে রাত্রিবাসের মূল সমস্যা হলো বাথরুমে যেতে প্রথমে বাইরে যেতে হবে তারপর আবার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে হয়। মধ্যরাতে একবার প্রয়োজন হওয়াতে বাইরে বেরিয়ে যে অপার্থিব সৌন্দর্য্যরে মুখোমুখি হলাম তা বর্ণনার অতীত। সকালে আলো জানালা গলে আমার মুখে পড়তেই লাফ দিয়ে উঠলাম দেরী হয়ে গেছে ঢের। কালাপাথর উঠতে নামতে তিন ঘন্টাতো লাগবেই। বইয়ের বর্ণনায় মনে হয়েছিলো দূরবর্তী কোন স্থান গোরখশেপ থেকে। কিন্তু গোরখশেপ সংলগ্ন খাড়া পাহাড় উপরের কালো পাথরের স্তুপ, বরফ জমে না চূড়ায় কোন। দ্রুত তৈরী হয়ে নিলাম। শুনেছি এভারেষ্ট এর পুরো রেঞ্জটা এই কালাপাথর থেকেই চমৎকার দেখা যায়। সূর্য ওঠার মূহুর্তেই। দ্রুত রওনা দিলাম, শুকনো বালুময় মাঠ পেরিয়ে ওঠার শুরু, দেখতে যতটা সহজ মনে হয়, ততটা যে হবে না কালই বুঝেছি। আধ ঘন্টা উঠে উল্টো দিকে তাকাতেই অদ্ভূত সুন্দর পর্বতমালার বরফগুলো অন্ধকারের নিচে থেকে আলোকিত হয়ে উঠছে। আর ওঠার পথে পুমারী পিক দেখতে দেখতে ওঠা। শেষ হয় না আর, মনে হয় পুমারী পিকে সামিট করতে চলেছি। তবে দূর থেকে পাহাড়টি যতটা খাড়া মনে হয়ে ছিলো ততটা নয়। সাড়ে ছটায় এভারেষ্ট এর পেছন থেকে সূর্য উঁকি দিলো, অদ্ভূত দৃশ্য। কাল বেইস ক্যাম্পে যাবার পথ থেকে এভারেষ্ট যতটা দূরের মনে হয়েছিলো, আজ আরও কাছে লাগছে কালাপাথর এর উপর থেকে। অনেক প্রার্থনা বাক্য লেখা পতাকার সমারোহ কালাপাথর এর চূড়ায়। মনে হচ্ছে আর একটু হেঁটে গেলেই পুমারি পিক এ চড়া যাবে। সামনে খুম্বু গ্লেসিয়ারের উপর সাদা মেঘের নদী। অন্যরকম নীল আকাশের বুকে হেলান দিয়ে সারি সারি লোৎসে, নুপুৎসে, এভারেষ্ট।
এত উচ্চতায় নিঃশ্বাস আটকে আছে। ৮:৩০ এর দিকে নেমে এলাম আবার বুদ্ধা লজ এর ডাইনিং-এ, নাস্তার অর্ডার দিয়ে ব্যাগ নামিয়ে আনতে চললাম আমি আর পেশাল ঢাল। যথারীতি চড়া দামে নিন্মমানের খাবার, কোনরকমে মুখে পুরে বেড়িয়ে পড়লাম, আজ থেকে ফিরে যাবার পালা, প্রথম দিন ঠিক করলাম ‘লেবুচে’ পেড়িয়ে ‘ফেরিচে’ পর্যন্ত যাব। কিন্তু মাঝে ধুকলা পেরুতে হবে ভাবতেই একটু আঁতকে উঠি। যাত্রার শুরুটা আনন্দদায়কই ছিলো। লেবুচে পর্যন্ত দ্রুততাই চলে গেলাম, ভাবলাম নামা তো বেশ সহজই কিন্তু ধুকলা উঠতে এবং বড় বড় পাথরের বোল্ডার ভেঙে নামতেই শরীর ভেঙে এলো, আকাশ কালো করে এসেছে, প্রচন্ড ঠান্ডা হাওয়ায় পাহাড়ের উপরের কবরস্থানটা ভূতুরে ভাবে পেরিয়ে এলাম। ধুকলায় একমাত্র রেস্তোরাঁয় ভেতরে ঢুকে পড়লাম। বাইরে বসার কোন জো নেই। বৃষ্টি হবে বোঝাই যাচ্ছে। এখানের খাবারও তেমন সুস্বাদু নয়, দ্রুত খাবার খাই, ঠান্ডা সহনীয় হয়ে গেছে আর উপর থেকে নামছি বলে ততটা প্রকট লাগছে না। বিল মিটিয়ে ধুকলা থেকে বেরুনোর ব্রিজ পেরুতে এগিয়ে যাই, এই পথটুকু বেশ চড়াই আর উৎরাই। খুম্বু আর গ্লেসিয়ার গলা পানির প্রবাহ আজ কম, বেশীর ভাগই বরফ হয়ে আছে। পেশাল যখন আমার মালপত্র বাঁধাছাঁদা করছিলো। ডিংবোচের লজ-এ অতীব সুন্দরী এক শেরপা তরুনীকে দেখেছিলাম, আমার লজ এ গোসলে এসেছিলো। তাকে এখানে দেখলাম। অনুমতি চাইলাম ছবি তুলতে পারি কিনা, সহাস্যে এগিয়ে এলো, মেঘ না চাইতে জল, নানা ভঙ্গিমায় পোজ দিলো ছবি তোলার জন্য, আবার দেখলো ছবি ঠিক হয়েছে কিনা? যাক একটা সুন্দরী শেরপা নারীর ছবি এ যাত্রায় তুলে নেয়া গেল। তারপরই শুরু হল পথ চলা।
যদিও নামতে হবে আরও নিচে, গন্তব্য ফেরিচে, ডিংবোচে থেকে লেবুচে যাবার পথে পাহাড় বহু নিচে দেখেছিলাম। পথে লোক সমাগম কম। খাড়া রুক্ষ পাহাড়ী পথ, গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিতে ভয়াবহ হয়ে উঠলো দ্রুত। ডাউন জ্যাকেট থাকায় বৃষ্টিটা গায়ে লাগছিলো না। যত নিচে নামছি বৃষ্টির তীব্রতা বাড়ছে। বৃষ্টি এতগুলো জামা কাপড়ের উপর পড়েও এর তাপমাত্রা বুঝিয়ে দিচ্ছিলো কতটা শীতল। একটু ভয়ই করছিলো অত ঢাল বেয়ে নামার সময় পিছলে পড়ে যাবার, এমনিতেই বুট জোড়া ভারী তারপর ভিজে তা আরও ভারী হয়ে উঠলো, অবশেষে নেমে এলাম ঐ খাড়া উৎরাই বেয়ে নিচে। অসংখ্য স্রোতের ধারা কোথা বেঁকে নেমে এসে বয়ে যাচ্ছে। আগাছা টাইপের ছোট গাছপালা। বোঝা যায় গাধা, ঘোড়া, ইয়াক এর খাদ্য হয় এগুলো। তুষারপাত শুরু হলো, প্রথমে খুব ধীরে ধীরে, তারপর বাড়ছে। নালার মতন স্রোতধারাগুলো বাঁচিয়ে এগিয়ে চলেছি। কর্দমাক্ত পথ। এখনো বহুদূর ‘ফেরিচে’ পৌঁছেতে। মাঝে এক জায়গায় কটি বাড়ি ঘরের নিশানা দেখে ভুল করেছিলাম। ওগুলো ইয়াক চড়ায় যারা তারা ঘিরে ঘাস এর চাষ করে, ইয়াক থাকার জায়গা। তুষারপাত আর বৃষ্টির মাঝে হেঁটে চললাম দ্রুততায়; কারণ পথে কাঁদা থাকলেও এখন আর তেমন দুরূহ নয়। পেশাল খুবই একটি করুণ লজ এর খোঁজ দিলো আমি বাগড়া দিলাম, আজ একটু আয়েশ করে থাকতে চাওয়াটা অতিরিক্ত নয়। তবে সবচাইতে সুন্দর যে লজ,ওটির সব কামরা পূর্ণ। এর উল্টো দিকেই ঠাঁই মিললো যে লজটায়, ওটা চলনসই। এর মাঝে তুষারের মাত্রা বেড়েই চলেছে। রুমে ঢুকে ভাবলাম এক বাটি গরম পানি পেলে মন্দ হয় না অন্তত হাত পা গুলো একটু মুছে দিলে এই গোসল অভ্যস্ত শরীর কিছুটা তৃপ্তি পাবে। খুব সাদরে বড় এক বাটি গরম পানি পাওয়া গেল, আমি অত্যন্ত মুগ্ধ। তবে এই বাটির দাম পরে ২০০ নেপালী রুপী দিতে হয়ে ছিলো। চমৎকার যে হোটেলটি তার নাম ‘হিমালয়ান হোটেল লজ’ সিট খালি না থাকায় আমি থাকতে পারি নাই। পরে এই ফেরিচে রিসোর্ট এর ডাইনিং রুমে ঢুকে তার দুঃখ পুরো দূর হয়ে গেলো।
আজ অতিথি কম, কানডার একজন তরুণ আইনজীবি ও জার্মানী এক নারী। উষ্ণ ডাইনিং হল এর পরিচ্ছন্ন পরিবেশ মন ভরিয়ে দিলো। আর বাইরে তো রূপকথার গল্পের মতন তুষার ঝরছে। চারিদিক সাদা হয়ে গেছে। হিমালয়ান হোটেল লজকে মনে হচ্ছে রূপকথার রাজকন্যার বাড়ি। প্রথমেই ক্ষুধার্ত আমি দুটো সেদ্ধ ডিম অর্ডার করলাম দাম ২৫০ রুপী মাত্র। বেশ আয়েশী ভঙ্গিমায় খেয়ে তারপর রাতের খাবার বললাম। এর মাঝে আড্ডা জমে উঠলো, চারপাশের দৃশ্যাবলী আমাকে এ জগতের বাইরের কোথাও যেন নিয়ে গেলো। পশ্চিমা দেশগুলোতে তুষারপাত এত মোহনীয় নয় আমি নিশ্চিত। আজ তেমন পরিশ্রান্ত না হলেও আগামীকাল অনেকটা পথ পেড়িয়ে যেতে হবে। জার্মান আর কানাডিয়ান দু’জনের সাথেই প্রশিক্ষিত শেরপা গাইড, গাইডদের সাথেও আলাপ ভালই জমে কিন্তু আমার পোর্টার কাম গাইড পেশাল ঢাল বাগড়া দেয়, ঘুমাতে হবে। এখনও তুষার পড়েই চলেছে, এমন চলতে থাকলে কাল পথ চলা কঠিন হবে আবার তুষার গলে পথ যদি পিচ্ছিল হয়ে পড়ে তবেও বেশ বিপদ। সকালে ঘুম ভেঙ্গে দেখি অবাক কান্ড, উজ্জ্বল রোদ্দুর আর ধবধবে সাদা চারদিক। মনটা ভাল হয়ে গেল এত অপরূপ আবহাওয়া, নাস্তা সেরে সব বিল মিটিয়ে বিদায় দিলাম ফেরিচে এর শেরপানীকে। বরফের মাঝ দিয়ে পথ চলা। আগে কোন ইয়াক এর পাল চলে যাওয়ায় একটু সুবিধা হয়েছে। ছোট আগাছাগুলো সাদা হয়ে আছে। কাছের দূরের সব পাহাড় ও সাদায় ভরে আছে। অন্যরকম সৌন্দর্য্য এই উচ্চতায়। এখান থেকে সোমারে গ্রাম হয়ে প্যাংবোচে তারপর থ্যাংবোচে, আজ যাব নামচে পর্যন্ত, প্রথমে বুঝিনি কিন্তু দূরত্বটা একটু বেশীই হয়ে গিয়েছিলো সাথে ক্লান্তিটাও। প্যাংবোচে পৌঁছুনোর পর তুষারে প্রকোপ কিছুটা কম। কিন্তু গলে যাওয়া বরফের কারণে হাঁটার গতি কমিয়ে দিলাম। একটা ব্রীজ পেরুলেই তারপর রডডেনড্রন বনের ভেতর দিয়ে চমৎকার রাস্তায় উঠে যাওয়া থ্যাংবোচের দিকে। থ্যাংবোচে পৌঁছলাম যখন তখন বেলা বারটাও বাজে নি। কড়া রোদ্দুর ঠান্ডাও আছে কিন্তু কে বলবে কাল এমন তুষারপাতের মাঝে ছিলাম। খোলা একটা রেস্তোরায় বসলাম। চমৎকার কফির গন্ধ আসছে, সাথে বেকারীরও বেশ সুন্দর ঘ্রাণ। রোদ্দুরে গা এলিয়ে দিয়ে খেতে খেতে দুই সাদা চামড়া বালকের কৃত্তি দেখলাম। কারুরই বয়স বিশ এর উপর নয়। ধনী দেশ থেকেও এলে কি করে পয়সা বাঁচিয়ে এই ট্রেইলে ঘুরে বেড়াচ্ছে মনের সুখ মিটিয়ে। থ্যাংবেচে মনাষ্ট্রির মহাত্ম এই কড়কড়ে রৌদ্দুরে খুব ম্যাড়ম্যাড়ে লাগছে। যাবার সময় কুয়াশা, মেঘের ফাঁকে যতটা মিষ্ট্রিরিয়াস বা রহস্যময় লাগছিলো আজ একেবারেই সাধারণ। এবার নামার পালা, নামতে হবে বহুদূর পুংগিতাংগা পর্যন্ত তারপর আবার ওঠা। এবার ক্লান্ত বোধ করি আকাশ আবার ভারী হয়ে উঠেছে। রাস্তায় ধূলোর ঝড়, দ্রুত ক্যামেরা বাক্স বন্দি করে ফেলি। দূরের একটা পাহাড়ে আভালাঞ্জ এর ফলে বিস্তীর্ণ অঞ্চল বরফশূন্য হয়ে আছে।
পুংগিতাংগায় আর্মি ক্যাম্প পর্বত পৌঁছুতেই বৃষ্টি ধেয়ে এল তবে জোরে নয়। যাবার পথের খাবার দোকানে ঢুকলাম অতটা ক্ষুধার্ত নই, তবুও খেতে হবে কারণ পরের খাবার দোকান বহু দূরে। যাবার দিনের মত অত সুস্বাদু মনে হল না খাবার। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি এর মাঝেই রওনা হয়ে গেলাম। আরও নিচে নেমে ব্রিজ তারপর ব্রিজ পেরিয়ে কেবল ওঠা আর ওঠা। বনের ভেতর দিয়ে। খুব ক্লান্ত লাগছে যদিও কিছুদূর যাবার পর ছোট গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছতে অদ্ভূত বৃষ্টির সম্মুখীন হলাম। পড়ছে তুষার কিন্তু মাটির কাছাকাছি এসেই বৃষ্টির পানি হয়ে যাচ্ছে অবাক বিস্ময়ে দেখতে দেখতে তোড় এত বাড়লো যে আশ্রয় নেয়া ছাড়া উপায় থাকলো না। একটা অত্যন্ত নোংড়া ঘরে ঢুকলাম, এটা আসলে স্থানীয়দের রেস্তোরা,খাদ্য বলতে আলু সেদ্ধ আর স্থানীয় মদ, দুর্গন্ধযুক্ত দুটোই। ইচ্ছে ছিলো খাব কিন্তু দমন করলাম কারণ আর বহু পথ বাকি হাঁটার। এর মাঝে স্বপ্ন দেখি নামচে বাজারের নেষ্ট হোটেলের আরামদায়ক রুম, গরম পানির গোসল আর উপাদেয় খাবারের। বৃষ্টি থামছেই না, তবে তোড় কিছুটা কমামাত্র বেড়িয়ে পড়লাম। ভাবলাম হাঁটার গতি দ্রুত করবো কিন্তু ক্লান্তি স্বাভাবিক রাখতেই বাধ্য করলো আমাকে। উঠছি তো উঠছি ওঠার শেষ নেই দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেলো হাঁটা চলছেই তো চলছেই। বৃষ্টি থেমেছে বহুক্ষণ, চারদিকে সজীব প্রকৃতি, মনে হলে ছেড়ে যাচ্ছি এসব, মনটা খারাপ হয়ে যায়। সেই রডডেনড্রেন বনের মাঝে সাঁঝবেলায় অন্ধকার বেয়ে হেঁটে যেতে কেমন একটা মায়ার টান অনুভব করলাম। আমাদাবালাম ভিউ রেস্তরাঁয় থামলাম, একটা স্নিকার আর চা খাব বলে, এখানে পরিচয় হল রাশিয়ান একটা গ্রুপ এর সাথে, এত চমৎকার মানুষ এরা। দেশটির মানুষগুলোর মানবিক আচরণ আমাকে মুগ্ধ করলো। তারা অনুরোধ করলো আমাক এই লজে থেকে যেতে কিন্তু আমার চোখে দি নেষ্ট এর নেশা। বিদায় জানালাম। আর সামান্য এগুতেই আলো মিলিয়ে গেলো। পেশাল জানালো আর দু’ঘন্টা লাগবে। শীত জাকিয়ে বসেছে, চারদিকে আধো আলোর খেলার কি যে অপরূপ রং। কিন্তু ছবি তুলবো ঠান্ডা আর তাড়ায় সে উপায় নেই। কেমন নীল আভা আমার বাম দিকে দূরে আবছা দেখা মিললো এভারেষ্ট এর এভারেষ্ট ভিউ পয়েন্ট থেকে বামে একটু দূরে আমাদাবালাম, আর তামা সেরকু যেন পাশে পাশে হেঁটে চলছে, নীল অন্ধকার আর একটু বাড়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়াই তামা সেরকুর চূড়ার দিকে, এমন সৌন্দর্য্য দেখিনি কখনো। কত পূর্ণিমায় ভেসেছি চরাচরে কিন্তু বরফের মোড়া চূড়ায় আবডালে প্রায় পূর্ণ চাঁদের উঁকি দিয়ে তাকালো আমায় আপ্লুত করে। ক্যামেরা হাতে উঠে আসে সকল ক্লান্তি ভুলে, কাঁপা কাঁপা হাতে কয়টি ছবি তুলে নেই আর চোখের মনিতে গেঁথে যায় অপরুপ ভাললাগা। আবার হাঁটা দূরের নামচে বাজারের আলো চোখে পড়ে কিন্তু প্রায় আটটা বাজে, অন্ধকারে চাঁদের আলোর মায়ায় হাঁটি আমি। নেষ্ট হোটেল ঠিক করা নইলে পথেই আপার নামচেতে থেকে যাওয়া যেত। শহরের গলি ঘুপচিতে অন্ধকার, র্টচ বের করি পথ চলতে। ঠান্ডা কিছুটা কম কারণ বাতাস যেন শহরে আটকে গেছে।
উপর থেকে নিচে নেমে আসতে ১ ঘন্টা লেগে গেলো প্রচন্ড ক্লান্ত হয়ে হোটেল গরম পানিতে দীর্ঘদিন পর গোসল। আমার প্রতিদিনে কয়েকবার গোসলে অভ্যস্ত শরীর যেন মূহুর্তেই চাঙ্গাহয়ে উঠলো। তারপর ডাইনিং এ খেতে যেয়ে দেখলাম আমি ছাড়া কেউ নেই। পোর্টারদের খাওয়াও শেষ। পরদিন রওনা দিলাম দেরী করে। নামচে থেকে সাধারণত মানুষ লুকলা চলে যায় কিন্তু আমি আগে একটা দিন বাঁচিয়েছি তাই গন্তব্য ফাকদিং পর্যন্ত নির্দিষ্ট করে হাঁটা শুরু করলাম গনগনে রোদ্দুরে কিন্তু বেশ ঠান্ডা। নামাটাও যে কতটা কষ্ট ওঠবার সময় কল্পনায় ছিলো না। তবে বনের মধ্যে দিয়ে আসবার সময় যতটা আতঙ্ক ছিলো নামার সময় প্রকৃতির মনোরম রূপে সিক্ত হয়ে নামতে বেশ আরামদায়ক লাগছিলো। কিন্তু পাহাড় ডিঙ্গোতেই ভয়াবহ ক্লান্তি ভর করলো। লারজা ব্রিজ পেরিয়েই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির মধ্যে পড়লাম। প্রচন্ড স্রোতধারা দুধকোশী নদী বোল্ডারে আঁছড়ে পড়ছে। বড় বড় বোল্ডারে পা ফেলে ফেলে এগিয়ে চলছি, আবার রাশিয়ান দলটির সাথে দেখা হল। ওরা একজন বাদে সবাই বয়ষ্ক, কিন্তু প্রাণশক্তি আর সামর্থ্য দেখে ঈর্ষা জাগে বেশ। এগিয়ে গেলো ওরা, সামনে এগিয়ে একটা ব্রিজ পেরিয়ে জোরেসালে।
চমৎকার ছোট গ্রাম, আপেল বাগান নদীর স্রোতের শব্দের সাথে। এখানে বেশ কিছুদিন বিশ্রাম নেয়া যায়, আবহাওয়াও মনোরম। আমি চেকপোষ্ট পেরিয়ে মানজো ব্রিজের কাছে খাবারের দোকানে থামলাম, দুপুরের খাবারের জন্য। বৃষ্টির লুকোচুরি শুরু হয়েছে, আর বার বার রেইনকোট পড়া খোলায় বিরক্তই লাগছে। ডাউন জ্যাকেট যেটা ভাড়া করে ছিলাম নামচেতে ফেরত দিয়ে জামানতের টাকা নিয়ে এসেছি। ভরসা এখন আমার বঙ্গবাজার থেকে কেনা দেখতে দশাসই কিন্তু অকার্যকর জ্যাকেটখানা। কেমন যেন গোমরা হয়ে এল আবহাওয়া। ‘মানজো’-তে সাগরমাথা এন্ট্রি পোষ্ট বেশ উঁচুতে, ব্রিজ পার হয়ে শুরু হল ওঠা। বৃষ্টি বিরক্তি ধরিয়ে দিল। হাঁপিয়ে উঠলাম ঐ পাহাড় পাড়ি দিতেই। তারপর মানজো শহর পেড়িয়ে যাচ্ছি। ছবির মত সব লজ, খুব লোভ হচ্ছিলো থেকে যেতে। লোভের আগুন বাড়িয়ে দিলে রাশিয়ান দলটি। ‘মানজো গেষ্ট হাউসের’ বাগানে বসে তারা বিয়ার খাচ্ছিলো। তাদের থেকে যাওয়ার অনুরোধ আর ফেলতে পারলাম না। পরিবেশ বান্ধব এই গেষ্ট হাউসটি চমৎকার। মিসেস ডোমা শেরপা চালান এটি। সবকিছু এখানে আকর্ষনীয়। গরম পানির ব্যবস্থা সৌরশক্তি দ্বারা করা আছে। আড্ডা জমে উঠলো রাশান দলটির সাথে, দলনেতা গিমেত পেশায় সার্জন, মস্কোর সরকারি হাসপাতালে কাজ করেন। একজন পেইন্টার, একজন আর্ট ডিলার আর একজন প্রকৌশলী। অসম্ভব বন্ধুভাবাপন্ন গিমেত এর সাথে কথা বলে বেশ ভাল লাগলো। আর্ট ডিলার প্রস্থে আমার তিনগুণ হবে এবং প্রতি দশ মিনিট অন্তর তার সিগারেট চাই। জিজ্ঞাসা করলাম তুমি এত খাও কেন, সরল উত্তর আমার ভাই খেত, একবার সে ছেড়ে দিলো আর মরে গেলো, আমি মরতে চাই না! বেচারা! গিমেত পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষ, দাগস্থানে তার পূর্বপুরুষের ভিটার চমৎকার বর্ণনা মিললো তার কাছে। আমন্ত্রণ জানালো, আমার ইচ্ছা থাকলে যেন তাকে মেইল করি আমাকে নিয়ে যাবে তাদের গ্রাম ‘চোখ’ এ। খুব ভোরে উঠে আবার রওনা দিলাম অনেকটা পথ বিভিন্ন ছোট ছোট গ্রাম পেরিয়ে এলাম ‘ফাঁকদিং’- এ একটা রেস্তোরায় চা খেলাম। আর পানি বিশুদ্ধকরণ দিয়ে বিশুদ্ধ পানি খেতে ইচ্ছা করছিলো না। এক বোতল পানি কিনলাম দরদাম করে ৮০ রুপীতে। ফাঁকদিং আসলে সেইভাবে দেখা হয়নি যাবার সময় আজ দেখতে দেখতে এগুলাম। কত মনোরম থাকার ব্যবস্থা এখানে, ঐগুলোর দিকে তাকালেই আলস্য ভর করে, মনে হয় সব ছেড়ে ছুঁড়ে এই পাহাড়ের বাঁকে যদি চলে আসা যেত। আমার খুব ভাল লেগেছিলো ঘাট জায়গাটা। সবুজ চারদিক, সেই মনোরম রেস্তরাঁয় বসলাম দুপুরের খাবার খাব বলে। পেশাল আগে চলে গেছে কালকে আমার বিমান টিকেট কনফার্ম করতে। রৌদ্দুরে গা এলিয়ে সবুজ ঘাসের উপর সাদা বেঞ্চ এ আহা মনে চাইছিলো না আর কোথাও যাই, পাশের বাড়িটার দিকে নজর গেলো ছোট একটা দোতলা বাড়ি। সামনে সবজির বাগান, পাথরে বানানো ওয়ালের উপর টবে রঙ বেরঙের ফুলের সমারহ। কল্পনায় আমি ঐ বাড়ির বাসিন্দা বনে যাই। দুপুর পেরুলেই আবহাওয়া খারাপ হয় আজও আকাশ কালো হয়ে এলো। বৃষ্টির ফোঁটায় আমার চমৎকার কল্পনা বাঁধ সাধলো। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি তাই রওনা হলাম রেইনকোট চাপিয়ে। লুকলা এখান থেকে বেশ উঁচুতে। বেশ বৃষ্টি হচ্ছে। একটা ব্রিজ পেরিয়ে আশ্রয় নিলাম বাড়ির কার্নিশে। জেসান এর সাথে দেখা বেচারা শুকিয়ে অর্ধেক, টগবগে দুরস্ত শরীর ভেঙ্গে গেছে, জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছিলো, ইমজাতে উঠবার কাছে পেট খারাপ আর বমিতে এই দশায় পড়েছে। এবং এর জন্য পানিকে দায়ী করলো। আমার অন্তত পানি সংক্রান্ত কোন জটিলতায় পড়তে হয়নি কারণ আমরা এর চাইতেই দূষিত পানি ব্যবহার করে অভ্যস্ত। বেচারাকে শুভ কামনা জানিয়ে বিদায় দিয়ে আবার হাঁটা ধরলাম বুট ভিজে একেবারে বাজে অবস্থা মনে হচ্ছে আমি নিজেই পুরোটা ভিজে গেছি। নানা রকমের রেইনকোট পড়া মানুষ-জন, এসব রেইনকোট তাদের স্বাচ্ছন্দ্য দিচ্ছে চলাচলে আর জুতোর ধরন সহজে চলতে সাহায্য করে। রাশান সার্জন গিমেত আমাকে পরবর্তীতে পাহাড়ে আসার জন্য বেশ যুৎসই তথ্য দিয়েছে। ওদের দেশে ছোটবেলা থেকেই মানুষজন আউটিং এ অভ্যস্থ, তাই যথার্থ পোষাক পরিচ্ছেদ আর উপকরণ তারা ভালো চেনে। আমাদের দেশের পরিব্রাজক ধারণাটা খুব অল্প দিনের। পর্বতারোহণ আমরা ক’দিন হল শুরু করেছি, হয়তো শিখে যাবো দ্রুত। পাহাড়ের চারধার অতি মনোরম কিন্তু বৃষ্টির বাধায় চলতে অসুবিধা হচ্ছে। এর মাঝে এক পশলা তুষারপাতও হলো ডাউন জ্যাকেটের অভাবে আর গায়ে কম জামা থাকাতে ঠান্ডা লাগছিলো। বৃষ্টি বিদ্ধস্ত করে দিলেও অরণ্য আর পাহাড়ের মায়ায় পথ পেড়িয়ে লুকলার কাছে এসে দেখলাম ঝিরি যাবার পথ যেখানে গাড়িতে আসা যায় তারপর পনেরদিনের হাঁটা পথ আসা যাওয়ায়। আগেই বলেছি লুকলা এখন বেশ বড় শহর। শহরে ঢোকার পর বৃষ্টি কমে এলো, পথ মনে হয় একটাই। পেশাল হাসি মুখে আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
যাওয়ার টিকেট কনর্ফাম, আমার ফ্লাইট সকাল ৯ টায়। রাশান দলটি যে হোটেলে উঠেছে, দামী হোটেল কিন্তু জায়গা নেই তার পাশেই একটা হোটেলে উঠলাম। রাশানরা আগেই এসে পৌঁছুতে পেরেছে এবং বাগানে হাঁটাহাটি করছে। আমি অবাক আমার হোটেলের দরজা আর এয়ারপোর্ট এর বহিরাগমণ লাউঞ্জের দূরত্ব ১০ ফুট দেখে। খুবই সাধারণ গেস্ট হাউস। কিন্তু আমার ভালো লাগলো। বৃষ্টি থেমে গেছে, চারদিক তুষারে সাদা হয়ে আছে গেষ্ট হাউসের পেছনে বাগানে সবুজ ঘাসের উপর সাদা তুষার চমৎকার লাগছে। দ্রুত রুমে গিয়ে পোশাক বদলালাম। পেশাল কে বললাম আমার ছিঁড়ে যাওয়া ব্যাগটা সেলাই করার ব্যবস্থা করে দিতে, আমি আসছি। লুকলায় প্রচুর দোকানপাট এবং দাম তুলনামুলক কম। আসার পথে দেখেছি একটা পথের ধারে দোকানে মাছ ভাজতে, খুঁজে বের করলাম পেশালসহ। ঘুপচি একটা ঘরে দু’জন তরুণী দেশীয় মদ আর মাছ ভাজা বিক্রি করছে সাথে আছে ডিম সেদ্ধ। খুব লোভ হল। পেশাল দেশীয় মদ ছাং দু গ্লাস নিমিষেই সাবার করলো। আমি এক কৌটা বিয়ার দিয়ে মাছ ভাজা খেয়ে ধন্য। সুযোগ পেলে সবাই পেয়ে বসে, তরুণী দুটোও আমার কাছ থেকে বিল নেবার ক্ষেত্রে তাই করল। আমি অন্যরা কি দিয়েছিল দেখেছি, অবশেষে পেশালের মধ্যস্ততায় কিঞ্চিত বেশী দিয়ে বেরিয়ে এলাম।
খুব রিলাক্স লাগছে আবার মনের ভিতর বেদনাও কাজ করছে এই চমৎকার জায়গা ছেড়ে চলে যাবার। ব্যাগ সেলাই এর দোকানে জিজ্ঞেস করলাম কত দেব? তার দাবী ৪০০ রুপী আমি আকাশ থেকে পড়লাম, ছিড়ে যাওয়া ব্যাগ সেলাই এ এমন কেউ চাইতে পারে, তারা জানালো বাবু এ লুকলা এখানে চাল এর কেজি কাঠমান্ডুর দ্বিগুণ। অবশেষে ৩০০ তে রফা করে ফেললাম। পেশাল এর খুব শখ তার বাড়ীতে আমাকে নিয়ে যাবে আমিও তার শখ পূরণে উৎসাহী হলাম, এমনিতেই ঠিক করে রেখেছিলাম আমার এখানে ব্যবহৃত সবই তাকে দান করে দেব।তার বাড়ি যাবার সময় স্ত্রীর জন্য প্রসাধনী জাতীয় পণ্য কিনলাম, অতি জীর্ণ কাঠের ঘরের প্রতিটি ইঞ্চির যথার্থ ব্যবহার দেখলাম পেশাল এর বাড়ীতে আর অত্যন্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। পেশাল আমাকে নানা জিনিসে আপ্যায়িত করতে উৎসাহী হয়ে উঠলো, আমি বললাম শুধু চা খেতে পেলেই আমি খুব খুশি হবো। চমৎকার চা খেয়ে বাহিরে বের হয়ে অবাক বিস্ময়ে পূর্ণিমার চাঁদ আমাদের আলোকিত করে তুললো। আজ বৌদ্ধ পূর্ণিমা, গৌতম বুদ্ধর জন্ম তিথিতে এখানে থাকতে পেরে বেশ সৌভাগ্য বোধ হল।
বাইরে প্রচন্ড ঠান্ডা থাকায় গেষ্ট হাউজের ডাইনিং রুমে চলে এলাম। মালিক অত্যন্ত ধার্মিক বৌদ্ধ, প্রার্থনায় রত, এখানে চমৎাকার খাবার খেলাম বাইরে পূর্ণিমা সাদা তুষারে মোড়া পাহাড়ে ঠিকরে পড়ছে। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম, পেশালের ডাকে ঘুম ভাঙলো। আমি আমার দুটো জ্যাকেট আইস প্যান্ট সহ বহু কিছু তাকে দিলাম। জানি এগুলো ব্যবহৃত হলেও এখানে বেশ মূল্যবান দ্রব্য।আর সাথে টিপস, বেচারা শেষ কালে এসে টিপস নিয়ে একটু বচসা করে আমার মনটাই খারাপ করিয়ে দিলো।তার কি কামনা ছিল কে জানে? ফেরার যাত্রীরা সবাই উৎফুল্ল, চমৎকার ঝকঝকে সকালে আজকের প্লেনটা আসারটার চাইতেও ছোট কিন্তু যাত্রা আসার সময়ের মত ভয়াবহ নয়।দুরুদুরু বুকে এয়ারপোর্টটা ছাড়তে পারলেই বাঁচোয়া, আশেপাশের সহযাত্রীদের আলোচনায় শুনছিলাম।একজন তার বন্ধুর পাঁচ তারকার হোটেল রুমে গিয়ে আধবেলা গোসলে ব্যায় করতে চায়।কাঠমান্ডুতে নেমে এয়ারপোর্ট থেকে বেড়িয়ে কড়া রোদ্দুর।ট্যাক্সিওয়ালার সাথে দামাদামী করে থামেলে একটা চমৎকার হোটেলে উঠলাম, একটা দিন বিশ্রাম আবার কাল রওনা দিতে হবে সমতলভূমি আমার ঢাকা শহরের পানে।
পাহাড়ের এযাত্রা অনেক রোমাঞ্চকর। শীর্ষে যাবার কল্পনা না করলেও, আমার কাছে চিরস্মরণীয় আর এটা আমার শুরু।আবারও আসব হিমালয়ের কোলে নানা প্রান্তে প্রকৃতিও সংস্কৃতির সন্ধানে পরম আবেগে।
মারুফ কবিরের সব লেখা ও এই ধারাবাহিকের আগের পর্বগুলো পড়তে ক্লিক করুন।
কবি, অভিনয়শিল্পী।