তুষার দাশ
জীবনানন্দ দাশের একটি অপ্রকাশিত কবিতা ও কবিতার ভাষ্য
বালক-কালের সেই মূল্যহীন, অপরাধহীন সাদা দিনগুলোর থেকে
. আজও এই আয়ুর বিপথে ফিরে—অন্ধকারে—আমি [১]
. বার-বার নগরীর ঘ্রাণে নাকে তুলে নিয়ে—তবু
. সস্মিত আমোদে তাহা এক বার—আধ বার—প্রত্যাখ্যান করি [২]
. মাথার উপরে এক বিষাক্ত [৩] নীলের দিকে চেয়ে [৪]
. অথবা যেখানে মেঘ জড়ো হয়—দু’চারটি—তৌলের ’পরে
. নির্মল [৫] তুলার মতো—এমনই নিয়ম তবু মৌন নিসর্গের
. আমাদের সব ক্রেন—ধূমা—রক্ত—ইস্পাতের চেয়ে
. ভারি তাহা; অথবা সে-সব মেঘ উড়ে যায়—খয়েরি, করুণ
. চিলগুলো (যদিও তাদের প্রাণ বাজারের বিনিময়ে দিতে
খানিক ইচ্ছুক তারা—তবুও খানিক তাহা আকাশের)—আমারও হৃদয়ে
. অন্য এক পরিসর এনে দেয়—কখনও বাষ্পের গন্ধে আমি
. চেয়ে দেখি নদীর নিকটে এসে দাঁড়ায়েছি—এইখানে জল
. মানুষের আধো-ব্যবহিত এক ভিন্ন প্রতিভার
. আওতায় প’ড়ে গিয়ে নিজেকে অভিজ্ঞ ক’রে নেয়
. (আজ ভোরে—দু’-পহরে—অথবা তিমির রাতে গিয়ে)
. কেননা সৃষ্টির পথ সর্বদাই নবীন, নতুন প্রক্রিয়ার
. দাগ দিয়ে আপনাকে কেটে নিয়ে নিজের আলোক
. অনুমান ক’রে নেয়—নিজের পর্যাপ্ত অন্ধকার
. নিরূপণ ক’রে দেখে—এই গাঢ় হুগলি’র জল
. আমার হৃদয়ে এক নতুন মুখের প্যারাডিম
. উদ্বোধিত ক’রে দেয়—খানিক রক্তিম তাহা, ধূমায় মলিন
. তেলের ন্যক্কারে ক্লান্ত, লশকরের মূঢ় তামাশায়
. অথবা ব্যথায় বিষ—চারি-দিকে দীর্ঘ নগরীর
. কবন্ধের মতো হিম পরিপ্রেক্ষণীর তালে প’ড়ে
. এখানে সে নির্ঝরের মতো এক শিশু
. নয় আর। কোথাও নিক্বণ নেই। হিরাচাঁদ খেমকা’র
. ভালো লেগে যেত—মানুষের সক্রিয় শরীর
. তুষের মতন খুলে—তবুও পিঙ্গল জলে শুশুক’এরা আজ
. নীরবে লাফায়ে উঠে নদীর এ-সব কথা জানে
. যখন ভোরের সূর্য ভাসমান নোঙরের ’পরে
. অথবা তাদের ভিজে মসৃণ পিঠের উপরে জ্ব’লে উঠে
. নিভে যায় নক্ষত্রের নিরুপম রাত্রির অঙ্গারে
. কোথাও সাধিত কিছু হয়ে যায়—
. আকাশ, নক্ষত্র, নদী, সৃষ্টি আমাদের
. শত শতাব্দীর সাথে বেড়ে উঠে এখন এ-অসময় সময়ের পথে
. আমাদের আরক্তিম মূঢ় নগরীর চেয়ে তবু বড়ো
. নয়। অথবা তবুও কিছু মহত্তর হয়ে তারা আজ
. নিজেদের পরিচয় শুদ্ধতর ক’রে নেয় মানুষের হাতে [৬]
. ধরা প’ড়ে—মানুষকে ধ’রে ফেলে—যেমন জননী
. ঈষৎ রুপালি চুলে টান খায় ডানপিটে সন্তানের হাতে
. সহসা নৃত্যের মাঝে যে-রকম গাধা—গাধাবোট
. সমূহ তাউসটাকে চেয়ে দেখে চোখের সম্মুখে
. কোথাও মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায় হয়তো-বা—অথবা ঘড়ির
. সময় ঘড়ির পানে—হয়তো চালক তার শুধু লবেজান
. অন্ধকার—উজ্জ্বলতা—তবু এই—তবুও বালির ঘড়ি অন্ধকারে বেজে
. ব্রহ্মাণ্ডের [৭] ঘড়িটিকে চিনে নেয় ব’লে তারা পরস্পরের প্রপূরক।
বিকল্প : ১. আমার হৃদয়; ২. ক’রে; ৩. নির্মেঘ আকাশের; ৪ চেয়ে থাকে; ৫. অমল; ৬. চোখে; ৭. সাময়িক
খ্রিস্টাব্দ ১৯৪০ সেপ্টেম্বর
সৌজন্য:
অমিতানন্দ দাশ
প্রিয়ব্রত দেব, প্রতিক্ষণ
❑
জীবনানন্দ দাশ-এর যে কোনো কবিতার ভেতরেই প্রাপ্তির একটা তৃপ্তি আছে—এ বোধ করি বাহুল্য বলা নয়। তাঁর অনেক দুর্বল কবিতার ভেতরেও হঠাৎ করে একটা শব্দ বা শব্দগুচ্ছ, একটা পঙ্ক্তি অনাবিষ্কৃত চমক জাগায়। পুরো দু’পৃষ্ঠার কবিতাটি (এ ক্ষেত্রে কবিতা-খণ্ডটি বলা সমীচীন মনে হয়) আদ্যোপান্ত জীবনানন্দীয়। জীবনানন্দের কবিতা বিষয়ে গুণীজনরা এ যাবৎ যত কথা বলেছেন, তাঁর কবিতার ভেতর থেকে মহৎ যে সব সৌন্দর্য আবিষ্কার করেছেন; তাঁরা, জীবনানন্দের কবিতা সম্পর্কে যেসব বাক্য ব্যবহার করেছেন, রবীন্দ্রনাথ-কথিত ‘চিত্ররূপময়তা’ থেকে শুরু করে অলোকরঞ্জনের ‘গীতময়তা’ আবিষ্কার—এ কবিতাটিকেও তার বাইরে ফেলা যাবে না।
কবিতাটিতে আমি তিনটি প্রস্তাবনা পেলাম—এই তিনটির সঙ্গে একটা সম্পর্কসূত্র কবি তৈরি করে দিয়েছেন চমৎকারভাবে। ‘বালক-কালের সেই মূল্যহীন, অপরাধহীন সাদা দিনগুলোর থেকে’ শুরু করে ‘কখনও বাষ্পের গন্ধে আমি চেয়ে দেখি নদীর নিকটে এসে দাঁড়ায়েছি’—এ পর্যন্ত হলো প্রস্তাবনা এক। এর ভেতর দিয়ে কবি ব্যক্তি-সত্তার সঙ্গে প্রকৃতির বিস্তৃততর, ব্যাপকতর এক নিখিল রূপের সঙ্গে; যা স্পর্শাতীত, শুধুই অনুভববেদ্য; সম্পৃক্তির এক মহা-আয়োজন তৈরি করে নিয়েছেন।
এক মানুষের জীবনবৃত্তান্ত—যা আসলে বহু মানুষের মতোই—আসলে যা চিরকালের মানব-যাত্রারই জীবনবৃত্তান্ত।
দ্বিতীয় প্রস্তাবনার শুরু ‘এইখানে জল মানুষের আধো-ব্যবহিত এক ভিন্ন প্রতিভার আওতায় পড়ে গিয়ে নিজেকে অভিজ্ঞ করে নেয়’ এবং এর পরপরই সেই দার্শনিক উম্মোচন—‘কেননা সৃষ্টির পথ সর্বদাই নবীন’। এ প্রস্তাবনার শেষ হচ্ছে সুন্দর এক ঝংকৃত পঙ্ক্তিতে— ‘নিভে যায় নক্ষত্রের নিরুপম রাত্রির আঁধারে’। ‘ন’ আ ‘র’-এর রিনিরিনি আর পাশাপাশি তার চিত্ররূপময়তা অসাধারণ, চিত্রকল্পটি এরকম পুরোটা—‘যখন ভোরের সূর্য ভাসমান নোঙরের পরে অথবা তাদের ভিজে মসৃণ পিঠের উপর জ্বলে উঠে নিভে যায় নক্ষত্রের নিরুপম রাত্রির আঁধারে।’
‘কোথাও সাধিত কিছু হয়ে যায়’ দিয়ে শুরু তৃতীয় প্রস্তাবনার—যা ‘তবুও বালির ঘড়ি অন্ধকারে বেজে/ ব্রহ্মাণ্ডের ঘড়িটিকে চিনে নেয় বলে তারা পরস্পরের প্রপূরক’ দিয়ে শেষ হচ্ছে। এক মানুষের জীবনবৃত্তান্ত—যা আসলে বহু মানুষের মতোই—আসলে যা চিরকালের মানব-যাত্রারই জীবনবৃত্তান্ত—যার সঙ্গে জড়িয়ে মহাশূন্যতার আকাশ-ধারণা, তার নীলিমা-মেঘ, যার অন্তিম পরিণতি আবার জল, যে জলের সঙ্গে আবার বিস্তৃতভাবে সভ্যতার, মানবযাত্রার ওতপ্রোত নিবিড়তা—সব মিলিয়ে আসলে মানুষের অনন্ত প্রবাহকে কবি ব্যক্তি থেকে পরিব্যাপ্ত করেছেন অনন্ত মানবযাত্রার কথকথায়। নিটোল, সুন্দর পৃথিবী কিভাবে নানান আঘাত আর ঘটনার অভিঘাতে বিষাক্ত হয়ে উঠেছে—তার চমৎকার ভাষ্য এখানে উঠে এসেছে।
এটাকে একটি ‘পরিবেশবাদী’ দার্শনিক কবিতা বললেও কেউ খুব একটা ভুল বলবেন বলে মনে হয় না। কিন্তু পরিবেশবাদিতার বাইরে দার্শনিক উপলব্ধির যে মাত্রা তিনি এখানে যুক্ত করেছেন—সেটি দর্শন ছাড়িয়ে শেষ পর্যন্ত এক সফল কবিতার দিকেই যাত্রা করেছে। মাত্রার সামান্য হের-ফের বা দুর্বলতাকে ছাড় দিলে অতি প্রাকৃতভাবেই এটি একটি নিটোল কবিতা—স্বাভাবিক সুন্দর কবিতা। আসলে জীবনানন্দের প্রতিটি কবিতাই একেকটি নতুনতর খনির মতোই, যার ভেতরে আবিষ্কারের প্রয়াসের পরও বহু বহু কিছু অনাবিষ্কৃত থেকেই যায় শেষ পর্যন্ত।
প্রকৃতি হারাচ্ছে তার ভারসাম্য—যার অভিঘাত কবির চেতনায় ভিন্ন ভাষ্যে উদ্বোধিত হচ্ছে।
প্রকৃতি নানানভাবে বিষাক্ত হচ্ছে দীর্ঘ দীর্ঘ কাল থেকে—মানুষ তাকে, তার আবিষ্কৃত যন্ত্রসমূহের ভেতর দিয়ে ক্ষয় করে দিচ্ছে। প্রকৃতি হারাচ্ছে তার ভারসাম্য—যার অভিঘাত কবির চেতনায় ভিন্ন ভাষ্যে উদ্বোধিত হচ্ছে—আবার এর মধ্যে মানুষের নতুনতর নিজস্বতার ভাষ্য, নিজেকে যাচাইবাছাই করার প্রক্রিয়ার কথাও বলা হচ্ছে দার্শনিক উপলব্ধির ভেতর থেকে। জল আর ব্যক্তি—তাদের মিশ্রিত সত্তার ভেতর দিয়ে নতুন এক উপলব্ধির দিকে কবিকে নিয়ে গেল—প্রথম প্রস্তাবনা আর দ্বিতীয় প্রস্তাবনার মিশেলে। ‘কেউ যাহা শোনে নাই কোনো এক বাণী আমি বহে আনি’ পর্যায়ের কিছুটা পরবর্তী বলে মনে হয় এই কবিতা—কিন্তু অনেক বেশি সংহত প্রকাশের দিক থেকে।
লেখাটি অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক ‘নতুন ধারা’ পত্রিকায়
২০১১ সালে প্রকাশিত